তর্ক থেকে তর্কাতীতের দিকে আল মাহমুদ
সময় আর মহাসময়ের ফোকর গলিয়ে যে তর্কাতীত পরাবাস্তব জমিন, সেই দিকেই ধাবমান ছিল কবি আল মাহমুদের কাব্যযাত্রা। অন্তত আমার এই বিবেচনা এবং বিশ্বাসও বটে। সব রকম বিবেচনা বোধের স্থাপত্য নির্মিতি পায় বিশ্বাসের সুতো ধরে। বিশ্বাস শব্দটি তর্কাতীত, যুক্তি সেখানে অচল-প্রায়। বিশ্বাস এমন সব উপাদানে ভরপুর যে তার তেমন কোনো বস্তুবাস্তব ইমেজ নেই। নেই কঠিন কোনো আকার-আকরণ। ফলে গণমানুষের কাছে বিশ্বাস শব্দটির সামাজিক ইমেজ ধর্মের অন্য চেহারা। ‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’ বলে যে চেতনার জন্ম দিয়েছিলেন লোক কবি, তারই বহুস্তরে নিহিত আছে বিশ্বাসের ফল্গুধারা। ধর্মপ্রাণ মানুষ বিশ্বাসকেই আঁকড়ে ধরে আছে তার ধর্মীয় চেতনা ও চেহারায়, তার রিচুয়ালসমূহের প্রাত্যহিক প্র্যাকটিসের মাধ্যমে।
আল মাহমুদ [১৯৩৬–২০১৯] কবিতার তর্কের জীবনে ঢুকেছিলেন গত শতকের পাঁচের দশকের মধ্যভাগে। তাঁর হাতে ছিলো ব্রহ্মাস্ত্র—নাম তার শব্দ। সেই শব্দসম্ভারে ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন, লোকাচারে ভরপুর শব্দপুঞ্জ হলো তারই ব্রহ্মাস্ত্র। যাকে বলে গণজীবন ও তার প্রতিবেশ, আল মাহমুদের কাব্যভাষার রগে-রেষায় মিশেছিল সেই শব্দ-সঙ্গীতের চারণভূমি। সেই কালে এবং হয়তো এই একবিংশ শতাব্দীর মহাকালেও যুক্তিশীলতা সেই ধারাবাহিকতারই প্রতিরূপ নয়। তবে রূপান্তরিত বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শব্দের যুক্তিও রূপান্তরিত হয়েছে। সেই রূপান্তর একই সঙ্গে শব্দের আদি যুক্তির সঙ্গে নতুন প্রেক্ষিতের ইন্টারেকশন ঘটিয়েছে। শব্দ তার খোলসও যে পাল্টায়, তা আমরা বিলক্ষণ বিশ্বাস করি। শব্দের নির্মাতা ও ব্যবহারকারীদের মধ্যে দুস্তর সামাজিক ও মানসিক ফারাক বিদ্যমান। শব্দের নির্মাতাগণ সমাজ গঠনের আগেই কিছু শব্দের দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন। সঙ্গে দান করেছিলেন সেই সব শব্দের আদি অর্থ, যা আমরা কিছু জানি, কিছু জানি না। এরাই মূলত সমাজে শব্দের অর্থসহ চালু করেন। তারা বনে যান সমাজের নেতা এবং ত্রাতা। এ-কালেও, আমরা যদি লক্ষ করি, সমাজের সেই সব ক্ষমতাবানই নতুন নতুন শব্দ সৃজন/নির্মাণ করছেন তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য, আর আমরা যারা সমাজের সাধারণ মানুষ, নির্দ্বিধায় সেই সব শব্দের মানেসহ তা ব্যবহার করি। এভাবেই প্রচল হচ্ছে শব্দের ভাষিক সাম্রাজ্য, যা মূলত যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে এবং নীতি-নির্ধারকদের স্বার্থ উদ্ধারে কাজে লাগছে। ‘প্রমিত’ শব্দটি আমাদের চলমান জীবনে এসে ঢুকেছে অনেক পড়ে, তাকে আমরা কম-বেশি ব্যবহার করছি দৈনন্দিন জীবনের নানা ফাঁকে-ফোকরে। উদাহরণ হিসেবে আমরা এর রাজনৈতিক ব্যবহারও দেখাতে পারি।
যুক্তির নির্মাতা হলো ধারণা-চালিত আবেগের একটি পর্যায় বা স্তর, যা মূলত সমাজের সাংস্কৃতিক অবকাঠামো বা আকরণ। আবার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে মানুষেরই চিন্তাশীলতা ও কর্মচেতনার আলোকে। প্রয়োজনকে সামনে রেখে গণ-মনন যেসব কল্যাণকর কাজ সমাজকে উপহার দিয়ে তার বাঁধনকে শক্ত ও পোক্ত করেছে এবং দীর্ঘস্থায়িত্ব দিয়েছে, তাই সংস্কৃতি। সংস্কৃতিই নির্মাণ করে মানুষের চিন্তা-ভাবনার খোলনলচে, তার ভাবনা-সাম্রাজ্যের অবয়ব, অবকাঠামো পরিমণ্ডল। কবি, শিল্পী-সাহিত্যিকগণ সেই খোলনলচে ধরেই নিজেদের সৃষ্টিশীলতার শব্দসমূহ আহরণ করেন। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিগণ নিজ নিজ প্রয়োজনমাফিক নির্মাণ করেন তার নতুন চেতনাজাত দুনিয়া। সমাজের একেবারে তৃণমূলের মানুষেরাও সৃজন করেন তাদের দৈনন্দিনের যোগাযোগের ভাষিক শব্দমালা, আঞ্চলিক ও প্রান্তিক সেই ভাষিক শব্দমালাকে আমরা আজ বলি ডাইলেক্ট। ওই লোকসমাজের বিশিষ্ট প্যাটার্নে সৃষ্টি হওয়া প্রয়োগসিদ্ধ শব্দগুলোই বৃহত্তর গণজীবনের সম্পদ। সেই সম্পদের মালিক সবাই, কিন্তু তা ব্যবহার করেন তৃণমূলের সাধারণজন, যাদের আমি ‘লোকস্নাত মানব’ বলে জানি এবং মানি এবং বলি। আল মাহমুদ তাদেরই একজন, লোকস্নাত জীবনবীক্ষার কবি। গণজীবনের চিন্তার প্যাটার্নকেই তিনি নির্মাণ করেন আধুনিক ধারণার বাংলা কবিতায় এবং তার উত্তরণ ঘটান আধুনিকতাবাদের উত্তরাংশের কবিতা চেতনার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জমিনে। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আর্থসামাজিক জীবনাচারের গহনগামী মানব চরিত্র।
একটি কবিতা উদ্ধৃত করা যাক—
তোমার জন্য একটি সুখবর আছে কবি
উত্তরাধুনিকেরা খাচ্ছে আজ তোমার লোকজ কবিতা
গো-গ্রাসে, ক্ষুধার্ত বাঘ
যেমন তার শিকারে রাখে মুখ
ওরা খাচ্ছে তোমার লোকসত্তার চর্বি, আনাজপাতিময় প্রকৃতি
হাওয়া, বুনোঘ্রাণময় খাড়ুর ঝংকার
শুনতে পাচ্ছো কী শব্দ তার?
নাকি নগর নাইওরির মতন নিজেকে করেছো বেড়িবন্দী?
যে মেয়েটির সঙ্গে তোমার প্রেম অহোরাত্রি
নোলক-পরা জড়োসড়ো সলাজ বধূ
ও কি কবিতা তোমার?
গেঁয়ো শ্যামাঙ্গিনী, ঘাসের ডগার মতন হালকা,
মাটির সোঁদা গন্ধে ভরপুর বাঁশপাতা-মেয়ে
নগর-নটীর এই রূঢ় বাস্তবে একেবারে দিশেহারা,
মন কি তোমার খারাপ হলো প্রেমিকার প্রতি কিম্ভূত নগর-দিঠিতে?
তোমার জন্য একটা সুখবর আছে আল মাহমুদ
তোমার কবিতা আজ উত্তরাধুনিকদের প্রধান খাবার!
[কবিতাসমগ্র/মাহবুব হাসান>আল মাহমুদ, তোমার কবিতা]
আল মাহমুদ-উত্তরপুরুষ এক কবির এই নিবেদন কি উত্তর আধুনিক কবিতা আন্দোলনকারীদের বীক্ষাকাশের একটি নমুনা?
আমি লক্ষ করেছি, ছয়-এর দশকের পূর্ব ও উত্তরকালের কবিদের মধ্যে ব্যাপকভাবে এই বোধ জারি আছে যে, আল মাহমুদ চৌদ্দটি সনেটের মালিক-প্রণেতা। যেখানে বাংলা সংস্কৃতিজীবনের নারী ও পুরুষের মধ্যেকার প্রত্যাশার রূপায়ণ ঘটেছে। অর্থাৎ তিনি লোকস্নাত জীবনের এমন এক কবি চরিত্র যে, তাঁর পরবর্তীকালে রচিত কবিতার কথা আমরা অনেকে উল্লেখ করতে চাই না। আবার তাঁর এই তিনটি বইয়ের সনেটধর্মী আরও কিছু কবিতা আছে, যেগুলোর নাম জানি এবং পাঠেও আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, তবু সেগুলো মুখ্য ভূমিকা রাখে না তাঁর সৃষ্টিশীলতার নামে। তাঁর কিছু কবিতার নাম তো নিতে পারি আমরা, যেগুলো প্রায়শই উল্লেখ করেন কেউ কেউ। যেমন লোক লোকান্তর-এর নাম কবিতা, তিতাস, ড্রেজার বালেশ্বর, নূহের প্রার্থনা, পিপাসার মুখসহ আরও কিছু কবিতা। তেমনি কালের কলস-এর নাম কবিতা, প্রত্যাবর্তন, সাহসে আঘাতে স্পর্শে, অসীম সাহসে-সহ আরও কিছু কবিতা আমরা নিত্যই উচ্চারণ করতে পারি। কিন্তু সেই দিকে আমাদের চেতনার অ্যান্টেনা ঘোরে-ফেরে না। সোনালি কাবিন-এর নাম কবিতা ছাড়াও অনেক ভালো কবিতা রয়েছে, কিন্তু আল মাহমুদকে ওই ১৮ মাত্রার চৌদ্দ পঙ্ক্তির সনেটের লোকজ কবি হিসেবেই চিত্রিত করতে চান অধিকাংশজনই। এই প্রবণতা যে একজন কবিকে কেবল খণ্ডিতই করে না, তার সৃষ্টির ধারাকেও স্বীকৃতি দেয় না যেন। মনে হয় আল মাহমুদ ওই লোকসত্তার ভেতরেই নিহিত আছেন, বাইরের পৃথিবী তিনি দেখেননি বা অবলোকন করেননি বৃহত্তর জনজীবনের লোকাচার ও নগর জমিনের ক্ষত ও ক্ষুদ্রতা।
তাঁর প্রথম কবিতার বই লোক-লোকান্তর [১৯৬৩]। নাম থেকেই বোঝা যায় তিনি গ্রামীণ চেতনাজাত কবি। লোক-লোকান্তর বইয়ের প্রথম কবিতা ‘বিষয়ী দর্পণে আমি’ প্রথম চারটি পঙ্ক্তি অন্ত্যমিল আছে। দ্বিতীয় ও চতুর্থ পঙ্ক্তিতে এসে সেই অন্ত্যমিলের অনুরণন আমরা শুনতে পাই। পাঁচ নম্বর পঙ্ক্তিটি ১০ মাত্রার একটি অপূর্ণ পঙ্ক্তি বা খাটো পঙ্ক্তি, দশ নম্বর পঙ্ক্তিটিও ১০ মাত্রার এবং ১৪ নম্বর পঙ্ক্তিও ১০ মাত্রার। এই তিনটি অপূর্ণ মাত্রার পরও এ-কবিতার বক্তব্য তার গন্তব্য ছুঁয়ে গেছে।
ক’বার তাড়িয়ে দিই, কিন্তু ঠিক নির্ভুল রীতিতে
আবার সে ফিরে আসে ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরে
তার সেই মুখখানি কুটিল আয়না হয়ে যায়
নিজেকে বিম্বিত দেখি যেন সেই মুহূর্ত-মুকুরে।
আধুনিক কবিতার আত্মপ্রতিকৃতিতে যে আত্মদহন ও দোদুল্যমানতা, যে সংশয়, অবিশ্বাস—আল মাহমুদ সেই সৃজন-নির্মাণের অংশীদার। এটা মনে রাখতে হবে যে আল মাহমুদ পাঁচের দশকের মধ্যভাগে এসেছেন বাংলা কবিতার স্রোতোধারায়। তখন বাংলা কবিতায় আধুনিকতাবাদীদের উত্থানপর্বের মধ্যগগন। তিরিশি কবিদের হাত ধরে ইউরো কালচারাল ও কবিতাসত্তার যে পশ্চিমাধারা বাংলা কবিতায় অনুপ্রবেশ করে, পরবর্তী চার ও পাঁচ-এর দশকের বাংলাদেশের ও পশ্চিম বাংলার কবিরাও শামিল হন সেই অভিযাত্রায়। কারণ, শিল্প বিপ্লবোত্তর ইউরোপীয় আধুনিকতার নতুন মনোবিকলন ও সামাজিক জীবনবীক্ষার অবক্ষায়িত ধারা এ দেশের তিরিশিদের চেতনায় এমন আলোড়ন তোলে যে তারা প্রায়-অযান্ত্রিক বাংলা-জীবনে চারিয়ে দিতে চান যন্ত্রতাড়িত এবং যন্ত্রণাজাত সমাজ-বাস্তবতার নিরালম্ব নিখিলের অভিজ্ঞতা। ওই অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞান আমাদের চলমান জীবনে অনুপস্থিত হলেও সেই যন্ত্রণাকাতর ইমেজারির গনগনে তাপে তিরিশোত্তর বাংলা কবিতা জ্বলতে থাকে।
রবীন্দ্রনাথ-উত্তর কাজী নজরুল ইসলাম [১৮৯৯-১৯৭৬], জসীম উদ্দীন-এর [১৯০৩-১৯৭৬] মতো বিপ্লবী ও সৃষ্টিশীল লোক বাংলার কবিও তিরিশি পশ্চিমা আধুনিকদের চোখে ব্রাত্যজন হিসেবে চিহ্নিত হন। তিরিশি পঞ্চপান্ডব-খ্যাত বুদ্ধদেব বসু [১৯০৮-১৯৭৪], অমিয় চক্রবর্তী [১৯০১-১৯৮৪], সুধীন্দ্রনাথ দত্ত [১৯০০-১৯৬৮], জীবনানন্দ দাশ [১৮৯৯-১৯৫৪], বিষ্ণু দে [১৯০৬- ১৯৮৫] যে ইউরো কালচারাল হেগেমনির নীল জলে গোসল সেরে নিজেদের প্রাগ্রসরতার চিন্তার দূত হিসেবে নির্মাণ করেছেন বাংলা কবিতার নতুন চৌকাঠ, সেটাই আমরা দেখতে পাই তাঁদের কবিতার অন্তরমহলে। তাঁদের পরবর্তী চার ও পাঁচের দশকের কবিদের মধ্যে তিরিশি কবিতা আলোড়ন তোলে ব্যাপকভাবে। আধুনিক বাংলা কবিতার নতুন বাঁক নেবার কথাও তাঁরা প্রচার করেন। এটি সত্য যে, রবীন্দ্র-নজরুল-জসীম উ্দদীন-উত্তর বাংলা কবিতায় ইউরোপীয় চেতনা কার্যকরভাবেই উত্তরসূরি চিন্তা-চেতনায় প্রগাঢ়ভাবে ঢেউ তোলে। ছয়-এর দশকের কবিদের মধ্যে সেই অভিঘাত নতুন নতুন ইজমের খরো-রোদ তাঁদের চেতনাকে বিপ্লবের মতোই উদ্দীপিত করে। ডাডইজম, নিহিলিজম, কিউবিজম, এক্সপ্রেশনিজম, ইমপ্রেসনিজম, সুররিয়ালিজম প্রভৃতি কল্পবাস্তবে মেশানো পশ্চিমা স্পর্শকাতর অভিজ্ঞান নকল হতে থাকে বাংলা কবিতার শরীর ও মজ্জায়। বাহ্যিকভাবে ওই সব ইজমের নিখিলের রাজনৈতিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও মননশীলতার কোনো দৃঢ় রূপ দাঁড়ায়নি। বরং একটি গ্রাম-নগর পরিবেশের দ্বৈত মিশ্রণে সৃষ্ট সাংস্কৃতিক বীক্ষা চলমান সমাজ-সংসারে বহমান ছিল বা আজও তা আছে অনেকটাই সংস্কৃত হয়ে।
ঢাকা মহানগর তখনো মহানগর হয়ে ওঠেনি এবং আজকের যে জাগর মহানগর জীবনের অভিঘাতে চলছে, তারও সূচনা হয়নি তখন পর্যন্ত। কিন্তু কবি-সাহিত্যিকগণ যেহেতু প্রাগ্রসর চিন্তার ধারক ও বাহক ও স্বপ্নবাজ এবং সৃষ্টি-নির্মাতা, তাই অগ্রগামিতাই আমরা লক্ষ করি তাঁদের সৃষ্টিচৈতন্যে, তাঁদের সৃষ্টিশীলতায়। তাঁদের ভাবনারাজ্যের বাখরখানিতে মেলে নতুন অভিজ্ঞানজাত স্বাদ, নতুন আকরভূমির নবনীতা, যা আমাদের আকর্ষণ করে। এবং সহসাই সেই নতুন মাত্রার অভিজ্ঞানকে শিকড়চ্যুত বলতে পারি না আমরা। কেননা, বাংলা ভাষা ও তার ভাষিক প্যাটার্ন ও সত্তার বর্ণমালায় সজ্জিত আমাদের সামাজিক প্রতিবেশ তিরিশি ও তিরিশোত্তার কবিদের ভাষিক অভিনেতা হিসেবে বেশ জোরালো ভূমিকাই রাখে। সেই সঙ্গে আমরা এটা ভুলিনি যে আমাদের লোকজ গল্পগাথায় আমরা স্নাত হয়ে বড় হয়ে উঠেছি। সেখানে আজকের জাদুবাস্তবতার যে ল্যাটিনি বাগবৈভব গর্বিত ভঙ্গিতে চিহ্নিত ও উচ্চারিত হয়, সেই উপাদান-উপকরণ ও মোটিফ আমাদের হাজার বছরি পুরাতন লোকজ গল্পের ভেতরে বহমান ছিল এবং আজও আছে। আমাদের সাংস্কৃতিক বীক্ষায় যে জাদু আছে, তাকে আমরা তুলে ধরতে লজ্জাবোধ করি। কারণ সেই সব গল্পকে আমরা পুরাতন/সনাতন ও পরিত্যক্ত-যোগ্য বলে বিবেচনা করি, যা নিজেকে অস্বীকারের শামিল। কারণ, ওই লোকশ্রুত গল্পগুলোই আমাদের ঐতিহ্যের সিঁড়ি নির্মাতা, পাটাতনের এক একটি সৌষ্ঠব। গ্রামীণ সমাজের পারিবারিক পরিবেশে গল্পকারদের বয়ান থেকেই জাত হয়েছে ওই সব গল্প। তাদের কল্পনাশক্তি ও চরিত্র চিত্রণ বলে দেয় আমাদের সাহিত্যের গোড়া কতটা মজবুত এবং দিগন্ত উন্মোচনকারী প্রেরণার উৎস। আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা নির্মাতার উপকরণ-উপাদানই আমাদের চিন্তার রাজনৈতিক ভিত্তিভূমি। আল মাহমুদের কবিতার ভেতরে যেসব গল্প আঁটোসাঁটো কায়দায়, কবিতার প্রতীকী ব্যঞ্জনায়, মেটাফরের লোকজ ফর্মে, ইমেজারির নানা বাঁকে প্রবহমান, তা লক্ষ করলেই আমরা বুঝব, তিনি কতটা লোকসম্পাতি কবি ছিলেন।
গত শতকের পাঁচের দশকের কবিতা মূলত পশ্চিম ইউরোপীয় চিন্তাজাত এবং আমি তাদের সৃষ্টিশীলতাকে বলি ইউরো-চেতনার-চিন্তার ও ইমেজারির বাংলা অনুবাদ। আশাকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে, হতাশার নাভি চটকে, বিবিক্তির উৎসারিত চেতনায় নিজেদের ভাবনাকে ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজস্ব একক ও একাকিত্বের সিংহাসেনে আসীন পশ্চিম ইউরোপীয় কবিতাশিল্পের অধিকর্তারা মানুষের প্রত্যাশাকে নিরালম্ব করেছে। কারণ, তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের সুষমা শুষে খেয়ে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে তাদের শিল্পবিপ্লব। মূলত আমেরিকা ও ল্যাতিন আমেরিকার সোনা-রুপাসহ সব ধরনের সম্পদ লুটে নিয়ে উপনিবেশ স্থাপনকারী ব্রিটিশ, ফ্রান্স, স্পেন, ডাচ-গণ তাদের শিল্পবিপ্লব সম্পন্ন করেছে। লুটেরা সম্পদে গড়ে তোলা যান্ত্রিক শিল্প ও কলকারখানার মালিকেরাও লুটেরা মনন ও মানসিকতা-শাসিত ছিল। সেই লুটেরা লিগেসিই [উত্তরাধিকার] তারা বিভিন্ন উপনিবেশেই কেবল রপ্তানি করেনি এনলাইটেনমেন্টের মোড়কে, সেই সঙ্গে নিজেদেরকে চিন্তার ক্ষেত্রে ঈশ্বরপ্রতিম বলে চিত্রিত করেছে। ভারতেও তারা ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের পাশাপাশি আমাদের ইংরেজি ভাষা, সাহিত্য ও জ্ঞানে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করে তোলার প্রকল্প নেয়। তারা যে অনেকটাই সফল তার নিদর্শন আমাদের ভাষাকেন্দ্রিকতাকে পাশে ফেলে দিয়ে এ-দেশের মানুষের মনে এটাই স্থায়ী হয়েছে যে তারা এনলাইটমেন্টের জ্ঞান নিয়ে আমাদের আলোকিত করেছে। আজ আমরা সেটাই বিশ্বাস করি। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যই কেবল নয়, গোটা ইউরোপীয় সাহিত্যের ওপরই আমাদের অগাধ বিশ্বাস। ইংরেজি না জানলে জ্ঞান থেকে বহুদূরে পড়ে থাকতে হবে—এই মিথ্যা তথ্য বা বিকৃত তথ্য দিয়েই তারা নির্মাণ করেছে আমাদের চৈতন্যের শিরদাঁড়া। প্রতিষ্ঠা করেছে তাদের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ। এই ভাষিক ও সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ উৎখাত না হওয়া পর্য়ন্ত আমাদের চিন্তার স্বাধীনতা মিলবে না, আমাদের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার মুক্তি অর্জিত হবে না।
সেই ইউরোপীয় জ্ঞানালোকে স্নাত হয়েই তিরিশের দশকের বাংলাভাষী কবিরা আমদানি করেন নতুন কবিতা, যাকে তাঁরা আধুনিক বলে চিত্রিত এবং চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু তাঁদের আগেই যে কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীম উদ্দীনের হাতে বাংলা কবিতার নতুন মাত্রা উন্মোচিত হয়েছে, মানুষের জাগর চেতনার উদ্বোধন ঘটে গেছে, তা তিরিশিরা বুঝতেও পারেননি। তাঁরা ইংরেজি, জর্মন, ফ্রান্সের কবিতায় এতটাই মুগ্ধ হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন যে, চারপাশের প্রতিবেশ ও পরিবেশের জনজীবন ও লোকজীবন দেখতে পাননি বা তা অবলোকনের উৎসাহ পাননি। তাই জসীম উদ্দীনকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে নজরুলকে পাশে সরিয়ে রেখে ইয়ংবেঙ্গলদের মতোই একটি সম্পূর্ণ কবি সমাজ গড়ে তোলেন তাঁরা, যাঁদের কবিতায় জীবন ও নগর থাকলেও গণজীবনের নন্দিত রূপ ও উৎপাদক শ্রেণির অরূপরতন সেখানে তেমনভাবে মেলে না। তাহলে এটা বলতে হবে—লোকজীবন কী?
সেটা জানা জরুরি। সেই লোকজীবন ও তার সাংস্কৃতিক বীক্ষার আকাশ নির্মাতা কবি হলেন কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন এবং আল মাহমুদ।
আল মাহমুদের কবিতা জীবনের সূচনা তিরিশি কবিদের আবহে, চেতনাযাত্রায়। তাঁরাই তাঁর চিন্তাপ্রবাহের প্রধানস্রোত নির্মাতা ছিলেন। কিন্তু একেবারেই গ্রাম থেকে উঠে আসা তরুণ আল মাহমুদ পাঁচের দশকের মধ্যভাগে, তাঁর সদ্য-অতীত গ্রামীণ জীবনের রূপ ভুলতে পারেননি। আবার সেই লোকজীবনের প্রাণশক্তি লোকজ সাংস্কৃতিক সম্ভার তিনি অবলীলাক্রমে তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন, বহন করেছেন অসঙ্কোচে। ফলে আধুনিক ফর্মে রচিত কবিতায় লোকজ উপকরণ ঠিকই গা ঘেঁষে বসবাস করছিল। আমরা যদি আল মাহমুদের লোক লোকান্তরের কবিতাগুলো পড়ি, তাহলে আমার এই বিবেচনা চেনা যাবে।
লোক লোকান্তর [১৯৬৩] সালে প্রকাশিত হলেও এর কবিতাগুলো রচিত হয়েছে পাঁচের দশক ও ছয়-এর দশকের প্রথম তিন বছরের মধ্যে। কালের কলস [১৯৬৬], সোনালি কাবিন [১৯৭৩]—এই তিনটি বইয়ে সম্মিলিত মানবিক ও মানসিক রূপ আল মাহমুদকে লোকবাংলার আধুনিক কবি হিসেবে চিত্রিত করে। ফর্মে তিনি আধুনিক হলেও শব্দ ব্যবহারে এবং চিত্রকল্প নির্মাণে, অলঙ্কার সজ্জায়, রূপক সংগঠনে, প্রতীক ভাষ্যে তিনি নির্ভর করেছেন তার চেনাজগতের অন্তর্গত সুষমায়। এ-বইয়ের প্রায় সব কবিতায়ই তিনি তাঁর চারপাশের জীবনের, প্রকৃতির বিচিত্র ছবি এঁকেছেন এবং সেই জীবনের প্রতি তাঁর মোহমুগ্ধ কথাগুলো কবিতার ফর্মে ঢুকেছে। লোক লোকান্তর নামের কবিতায় সনেটের মিল সমেত গণজীবনের পরিপার্শ্বের উপাদান-উপকরণে সাজিয়েছেন। চৌদ্দ পঙ্ক্তির এই সনেটের উপরিভাগে আছে ৮ পঙ্ক্তি, নিচে ৬ পঙ্ক্তির বিস্তার। পেত্রাকীয় সনেটের আঙ্গিক কি এখানে ব্যবহৃত হয়েছে, নাকি শেকসপিয়ারিয়ান সনেটের ফর্ম? তারও চেয়ে অধিক মূল্যবান আমার কাছে লোকজ উপাদান ও তার অন্ত্যমিলের দ্যোতনা ও অর্থবোধের অনন্য গহনগামিতা। ঘোষিত হয়েছে কবিতার আসন্ন বিজয়।
তাকাতে পারি না আমি রূপে তার যেন এত ভয়
যখনি উজ্জ্বল হয় আমার এ চেতনার মণি,
মনে হয় কেটে যাবে, ছিঁড়ে যাবে সমস্ত বাঁধুনি
সংসার সমাজ ধর্ম তুচ্ছ হয়ে যাবে লোকালয়।
লোক থেকে লোকান্তরে আমি যেন স্তব্ধ হয়ে শুনি
আহত কবির গান। কবিতার আসন্ন বিজয়।
বৃহত্তর জনজীবনের কবিতারই যে বিজয় আসন্ন, এটাই ঘোষণা করেছেন তিনি। প্রথম বইয়েই যিনি তাঁর চিন্তার মনোভঙ্গি দৃঢ়তার সঙ্গে প্রকাশ করেন, তাঁকে বুঝতে হলে পাঠকের চিন্তার পথটিকেও সমাজ সংসারের ভেতরে সেঁধিয়ে দিতে হবে।
আল মাহমুদের কবিতাযাত্রায় আমরা দেখতে পাচ্ছি তাঁর শিল্পচেতনার মোড় ফেরানোর বিষয়গুলো। লোক লোকান্তর, কালের কলস ও সোনালি কাবিন—এই তিনটি বই তাঁর কবিতাযাত্রার পোড়াপত্তন করেছে এবং তাঁকে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের মধ্যে বিশিষ্ট কবি হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। তাঁর হাতে হাজার বছরি লোকবাংলার নারী-পুরুষের প্রেম ভালোবাসাসহ অন্যান্য লোকজীবনের চিত্রভাষ্য নির্মিতি পেয়েছে। এই পর্বের কবিতার জন্যই তাঁকে বাংলাদেশের একজন মৌলিক কবি বলে চিহ্নিত করা হয়। তাঁর কবিতার বিষয়-বিস্তার লক্ষ করলে দেখা যায়, তিনি প্রেম, প্রকৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাণ, সাম্য সমাজচেতনা, দেশপ্রেম প্রভৃতির ভেতর দিয়ে আমাদের চেতনায় তার সাংস্কৃতিক রূপ সৃষ্টি করেছেন। এই সাম্যময় জীবনব্যবস্থার কথা সোনালি কাবিনের ভেতর দিয়েও প্রকাশ পেয়েছে, যা বারবার ব্যর্থ হয়ে গেছে। আবার তিনি তাঁর শ্যামাঙ্গীর চেয়েও শস্যের বিপদকে বড় করে দেখেছেন। বর্গীরা, মানে লুটেরা মানুষ যারা প্রতিবছরই লুটে নিয়ে যায় কৃষির প্রধান ফসল ধান, যা গণমানুষের উৎপাদন তাদের স্বপ্নের ও নিত্যদিনের সৃজন, তারই বিপদ আল মাহমুদ উপলব্ধি যেমন করেছেন, তেমনি তার প্রেমিকাকেও বলছেন।
অতীতে যাদের ভয়ে বিভেদের বৈদিক আগুন
করতোয়া পার হয়ে এক ইঞ্চি এগোতো না আর,
তাদের ঘরের ভিতে ধরেছে কি কৌটিল্যের ঘুণ?
ললিত সাম্যের ধ্বনি ব্যর্থ হয়ে যায় বার বার
বর্গীরা লুটেছে ধান নিম খুনে ভরে জনপদ
তোমার চেয়েও বড়ো হে শ্যামাঙ্গী, শস্যের বিপদ।
[৯ নম্বর সনেট/ সোনালি কাবিন]
এই যে রাজনৈতিক ও লুটেরা দস্যুবৃত্তির ভয়, যা শ্যামাঙ্গী প্রেমিকার চেয়েও বড় মনে করেছেন আল মাহমুদ, যা আমাদের মানসিক সংস্কৃতিতে বহমান থাকলেও তার অভিঘাত যেন আমরা ভুলে গেছি বা ভুলে থাকি। অর্থশাস্ত্রকার কৌটিল্যের ঘুণ চিহ্ন দিয়ে তিনি আমাদের অর্থনৈতিক প্রাগ্রসরতার গতিকে থামিয়ে দিতে চেয়েছেন যাঁরা, তাঁদের কথাই কবি এখানে বলেছেন। সেই ঘুণে যেন বাংলা জনপদ মহাবিপদে না পড়ে, সেই ইঙ্গিতই কি দেননি আল মাহমুদ?
তিনি লালন ফকিরও হতে চেয়েছেন। লালন হতে চাওয়ার সঙ্গে তাঁর কাব্যভাব ও লোকচেতনার বৈচিত্র্যময়তাকেই কেবল ধারণ করতে চাননি, একই সঙ্গে ওই গণমানুষের কবি-চেতনার ধারাও ক্রিয়াশীল ছিল তাঁর মধ্যে। লালনের উত্তরাধিকার হতে চাওয়ার মধ্যেও আছে, তার লোকজ সত্তার মানবিক প্রকাশ।
আবার এই ধারাক্রমের পাশাপাশি তাঁর চেতনায় নানামাত্রিক লোকজ বোধন কাজ করেছে, আমরা তার রূপ দেখতে পাচ্ছি চৌদ্দ পঙ্ক্তির এই সনেটগুচ্ছে। তিনি বলছেন—
সে-কোন গোত্রের মন্ত্রে বলো বধূ তোমাকে বরণ
করে এই ঘরে তুলি? আমার তো কপিলে বিশ্বাস,
প্রেম কবে নিয়েছিলো ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ?
মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস।
[৪ নম্বর সনেট/ সোনালি কাবিন]
সবকিছুর ওপর প্রেমই উপরে, এই কথাই তিনি বলেছেন। ধর্মের মর্ম ভেদ করে প্রেম সব সময়ই প্রধান মানবিক স্রোত হিসেবে বরিত হয়েছে। প্রেম কখনো কোনো ধর্ম বা সংঘের শরণ দেয় না,—সেই প্রজ্ঞাও তিনি জারি করেন এখানে।
যে সাম্য চেতনার কথা তিনি চার নম্বর সনেটে উচ্চারণ করেছেন, তারই পূর্ণাঙ্গ রূপ আমরা দেখতে পাই ১০ নম্বর সনেটে।
শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতের উঠিয়েছে হাত
হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা।
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বন্টন,
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণির উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।
[১০ নম্বর সনেট/ সোনালি কাবিন]
লোকধর্মে যেন আর ভেদাভেদ না ঢুকতে পারে, সেই মতপ্রকাশের আগে তিনি বলেছেন তাঁর নিজের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বন্টনে। এ-কথা বলার অর্থ হচ্ছে শ্রেণিবিভক্ত সমাজ ও সংসারের ভেতরে যে অসাম্য বিভক্তি রয়েছে, তার উচ্ছেদই তার লক্ষ্য। মুসলমানদের মধ্যে সব মানুষ সমান, কিন্তু সেই ধর্ম চেতনা সামাজিক মুসলমানের মধ্যে বিরাজমান নেই বহুলাংশে। উচ্চ-নীচ বা আশরাফ আতরাফ বিভেদ ও ভেদাভেদ মুসলিম সমাজকেও অনেকটাই বিতর্কিত ও টানাপোড়েনের মধ্যে রেখেছে। ধনী দরিদ্র্যের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা সৃষ্টি করে রেখেছে।। অর্থনৈতিক মানদন্ডের কারণে এই বিভেদ যা মানুষকে সাংস্কৃতিকভাবে বিভক্ত করে রাখে, যা কবির কাম্য নয়। এই শ্রেণির উচ্ছেদই চাইছেন কবি। আবার হিন্দু সমাজেও অর্থনৈতিক বিভাজনের ফলে ন্যায় ও কল্যাণ সেখান থেকে বিতাড়িত। ধর্মের কন্টকিত শ্রেণীকরণের ফলে তারাও অন্যায় ও অবিচারের শিকার। তাদের বর্ণবাদিতাও বিদ্যমান। শিডিউল কাস্ট প্রথা তাদের এক বড় অনৈতিক ও অমানবিক ধারা, যা তাদের ধর্মাচারিতায় প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে। এই বিভাজন প্রথা মূলত সমাজের উচ্চবর্ণের নেতাদেরই অপরাধমূলক কাজ। মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করে কাউকে উচ্চবর্ণাধিকারী, কাউকে অচ্ছুত নিম্নবর্ণের চিহ্নদান চরম অপরাধ। এই অপরাধমূলক বর্ণপ্রথা বিলোপ করাই কবির লক্ষ্য। এই উভয় ধর্মের সকল রকম শ্রেণিরই উচ্ছেদের কথা আল মাহমুদ উচ্চারণ করেছেন এখানে। এবং এই শ্রেণি উচ্ছেদের সিংহপুরুষ যারা, এশিয়ার সেই বীরের পোশাকে তকমা এঁটে দেবার কথা বলেছেন তিনি। অর্থাৎ চীনের মাও সে তুঙয়ের কথাই তিনি বলেছেন বিশেষভাবে। চীনা বিপ্লবের ফলে যে মানবিক সমাজ, সাম্য সমাজের ধারার সূচনা হয়েছে তা মূলত ইসলামেরই এক সংস্করণ। ইসলাম ধর্মে সব মানুষ সমান, উচ্চ-নীচ বলে কোনো ধারণার অন্তর্গত নয় তার সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি। ধর্মের সেই রীতি-আদর্শ আমরা মান্য করি বটে, কিন্তু ফলো করি না। এই অনুসরণ না করার ফলেই সমাজে আশরাফ-আতরাফ-এর কালচারাল বিভাজন গজিয়েছে। কেবল আল মাহমুদই নন, মুসলিম সমাজের এই অনৈতিক বিভাজন নির্মূল চাই আমরা সবাই। কারণ, ওই বোধ-সত্তা আমাদের মানবিকতাকে ঘুণের মতোই কুরে কুরে খাচ্ছে।
এই ক্ষত ও ক্ষতাক্ত সাংস্কৃতিক ধারা আমাদের কীভাবে দেশ ও মাটির লগ্ন থেকে বিচ্যুত করছে, আল মাহমুদ তারও রূপ দেখেছেন তারই চারপাশে। পালক ভাঙার প্রতিবাদে, খড়ের গম্বুজ, জাতিস্মর, সাহসের সমাচার, চোখ, ওল্টানো চোখ, চোখ যখন অতীতাশ্রয়ী হয়, আমার চোখের তলদেশেসহ আরও কিছু কবিতা তারই রূপ বর্ণনা করে। উদ্ধৃত করা যাক—
ক. এ মুখ আমার নয়, এ মুখ আমার নয়, বলে—
যতবার কেঁপে উঠি, দেখি
আমার স্বজন হয়ে আমার স্বদেশ এসে
দাঁড়িয়েছে পাশে। নির্ভয়ে, আশ্বাসে
জিয়ল মাছের ভরা বিশাল ভান্ডের মতো নড়ে ওঠে বুক।
…
খেতের আড়াল থেকে কালো
মানুষের ধারা এসে বলে দেবে সরোষে আমাকে
কী ভাবে এগোবে তারা দুর্ভেদ্য নগরের তোরণে প্রথম।
[পালক ভাঙার প্রতিবাদে/ সোনালি কাবিন]
খ. কে যেনো ডাকলো তাকে, সস্নেহে বললো, বসে যাও,
লজ্জার কি আছে বাপু, তুমি তো গাঁয়েরই ছেলে বটে,
আমাদেরই লোক তুমি। তোমার বাপের
মারফতির টান শুনে বাতাস বেহুঁশ হয়ে যেতো।
পুরোনো সে কথা উঠলে এখনও দহলিজে
সমস্ত গাঁয়ের লোক নরম নীরব হয়ে শোনে।
[খড়ের গম্বুজ/ সোনালি কাবিন]
গ. আমি যতবার আসি, মনে হয় একই মাতৃগর্ভ থেকে পুনঃ
রক্তে আবর্তিত হয়ে ফিরে আসি পুরোনো মাটিতে।
ওঁয়া ওঁয়া ওঁয়া শব্দে দুঃখময় আত্মার বিলাপ
জড়সড় করে দেয় কোন দীন দরিদ্র পিতাকে।
আর ক্লান্ত নির্ভার আরামে
মায়ের সজল চোখ মুদে আসে।
কখন, কীভাবে যেন বেড়ে উঠি
পূর্বজন্মের সেই নম্রস্রোতা নদীর কিনারে।
[জাতিস্মর/সোনালি কাবিন]
ঘ. যেদিন নদী এসে আমাদের বাড়িটাকে ধরলো
সেদিনের কথা আমার চোখের ওপর স্থির হয়ে আছে।
বাক্সপেটরা থালা ঘটিবাটি নিয়ে আমরা
গাঁয়ের পেছনে বাপের কবরে গিয়ে দাঁড়ালাম।
জায়গাটা ছিলো উঁচু আর নিরাপদ। দেখতে
অনেকটা চরের মতই। মা সেখানে বসে
হাঁপাতে লাগলেন। কাঁদলেন এমনভাবে যে
অভিযোগহীন এমন রোদন ধ্বনি বহুকাল শুনিনি আমি।
তারপর ভাঙনের রেখা পেছনে রেখে
আমরা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছিটকে পড়লাম।
কেউ গেলাম মামুর বাড়িতে। কেউ ফুপুর। যেমন
বাবেল থেকে মানুষের ধারা
ছড়িয়ে পড়লো পৃথিবীতে।
[চোখ যখন অতীতাশ্রয়ী হয়/সোনালি কাবিন]
রোদন ভাঙার প্রতিবাদে কবিতাটি মূলত একটি কল্পবাস্তবের রূপ। তার প্রত্যাশা কালো মানুষেরা এসে দখল নেবে নগর এবং নগর জীবন। কল্প-বাস্তব বলছি এ জন্য যে এই স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা বাস্তব করার যে রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা ও কর্মপরিকল্পনা থাকা উচিত ছিল, তা আমাদের রাজনৈতিক সমাজে ও গ্রামীণ সমাজে তেমন কোনো জোরালো হয়ে ওঠেনি কোনো দিনই। বরং সেই আন্দোলনের যারা শক্তিদাতা, সেই উৎপাদক শ্রেণি, শ্রমিক শ্রেণি যাকে আল মাহমুদ ‘কালো’ মানুষের প্রতীকে বর্ণনা করেছেন, তাদের মানসে ওই বিপ্লবের রেখাপাত ঘটেনি। বিপ্লবের সেই অমোঘ মন্ত্র পশেনি তাদের কর্মময় লোকজীবনের কর্ণকুহরে। আত্মার বিশ্বাসে গাড়েনি সেই চিন্তার শিকড়। কারণ, বিপ্লবীদের রাজনৈতিক ভাষা ও কৃষকের সামাজিক ভাষা, বা দৈনন্দিনের লোকভাষার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ফলে কম্যুনিকেশন হয়নি গণমননের সঙ্গে বিপ্লবী চেতনার। এই ব্যর্থতা মূলত যোগাযোগ ভাষার সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনার ব্যাখ্যার। আমাদের কালো মানুষের নেতারা যতটা না কালো মানুষদের সঙ্গে বসবাস করেছে, তাদের ভাষা ব্যবহার করে শোষণের বিষয়গুলো পরিষ্কার করে বুঝিয়েছে, তত দিন ওই কথিত কালো মানুষেরা ঐক্যবদ্ধ হবে না বা হয়নি। তাই আল মাহমুদের এই প্রতীকী উচ্চারণ আমাদের চেতনার তাঁর রাজনৈতিক চরিত্রকে স্পষ্ট করলেও, সেই পথে তিনি রাস্তায় নেমে সংগ্রামে শামিল হননি।
মনে যতই হোক না কেন, তিনি ডাক দিলেই নদীর সব মানুষ উঠে আসবে না তাঁর কাছে। এই বাস্তবতা তাঁকে তাই ওই পথে নেমে আসার সাহস জোগায়নি।
উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুচ্ছের মধ্যে একটি বিষয় অত্যন্ত সরলভাবে আমরা বুঝতে ও চিনতে পারি, তাহলে আল মাহমুদের কবিতাগুলো লোকবাংলা ও তার সন্নিহিত প্রতিবেশের বর্ণনা। ওই বর্ণনার ভেতরে আছে গল্পের একটি নাতিদীর্ঘ চেহারা। তাঁর বর্ণনাগুলো আমাদের চেতনায় ও রেটিনায় প্রতিবেশের ছবি সেঁটে দেয়। সেই প্রতিবেশ আমাদেরই শৈশব ও যৌবনের স্মৃতির মিনারে পরিণত হয়ে আছে। আমরা চোখ মুদলেই দেখতে পাই আমাদের গ্রামের বাড়িটি। তার চারপাশের পরিবেশ, পাড়াপ্রতিবেশীদের মুখ জ্যোৎস্নায় ডোবা ধোঁয়াশাক্রান্ত চেনা-অচেনার দোলায় কাঁপা ছবি হয়ে আছে। আল মাহমুদের কবিতার ভেতরকার গল্পগুলো সেই রকম। আমি উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলো থেকে আবারও পঙ্ক্তি তুলে দিয়ে আমার বক্তব্যের সপক্ষে যুক্তিকে নির্মাণ করতে পারি, কিন্তু সেই পথে না গিয়ে আমি নতুন কবিতা, কালের কলস ও সোনালি কাবিন থেকে কয়েকটি কাব্যপঙ্ক্তি তুলে আনি। তাতে নতুন কবিতাও আমাদের অনেকটাই জানা হয়ে যাবে।
শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি
নীলবর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতোন হঠাৎ
দারুণ হুইসেল দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।
যাদের সাথে শহরে যাবার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ
জানালায় উবুর হয়ে আমাকে দেখছে। হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
আসার সময় আব্বা তাড়া দিয়েছিলেন, গোছাতে গোছাতেই
তোর সময় বয়ে যাবে, তুই আবার গাড়ি পাবি!
আম্মা বলেছিলেন, আজ রাত না হয় বই নিয়েই বসে থাক,
কত রাত তো অমনি থাকিস।
আমার ঘুম পেলো। এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আমি
নিহত হয়ে থাকলাম।
…
বৈঠকখানা থেকে আব্বা
একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন
ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান…।
বাসি বাসন হাতে আম্মা আমাকে দেখে হেসে ফেলবেন।
ভালোই হলো তোর ফিরে আসা। তুই না থাকলে
ঘরবাড়ি একেবারে শূন্য হয়ে যায়। হাত মুখ
ধুয়ে আয়। নাস্তা পাঠাই।
আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে
ঘষে ঘষে
তুলে ফেলবো।
[প্রত্যাবর্তনের লজ্জা/সোনালি কাবিন]
খুবই জনপ্রিয় কবিতা এটি। পাঠকের অন্তরে এই কবিতার চিত্রসমূহ তাদের স্মৃতিকে ঠোকরাতে ঠোকরাতে জাগিয়ে তোলে সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত কালের অসংখ্য স্মৃতি। রেলে যারা যাতায়াত করেন, তাদের অনেকের জীবনেই ট্রেন ফেল করার ঘটনা আছে। যাদের রেলভ্রমণের অভিজ্ঞতা নেই তারাও কল্পনায় দেখতে পাবেন ওই চিত্রসমূহ। কারণ, মা-বাবার আচরণ এমনটাই হয়ে থাকে। এ কারণেই প্রত্যাবর্তনের লজ্জা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। অথচ এই কবিতায় খুব কমই আছে কবিতার মৌলিক উপাদান-উপকরণ। প্রতিবেশ বিশ্বের উপকরণের কথা যদি ধরি আমরা তাহলে রেললাইন এবং ট্রেন চলে যাওয়ার সময় যে নীল সিগন্যাল বাতি জ্বলে আর নেভে, সেই দৃশ্য এবং নির্বাক প্রকৃতি তাদের ইঙ্গিতময় ব্যবহার এই গল্পের বিষয়টিকে কবিতার রূপে সাজিয়েছে।
কবিতার পঙ্ক্তিগুলো আমি এখানে তুলে দিচ্ছি।
ক. হতাশার মতোন হঠাৎ দারুণ হুইসেল
খ. এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আমি নিহত হয়ে থাকলাম।
গ. কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো।
ঘ. শীতের বিন্দু জমতে জমতে নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ
লাল সূর্য উঠে আসবে।
ঙ. পরাজিতের মতো আমার মুখের ওপর রোদ
চ. ছড়ানো-ছিটানো ঘরবাড়ি, গ্রাম। জলার দিকে বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। তারপর দারুণ ভয়ের মতো ভেসে উঠবে আমাদের আটচালা।
জ. দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে।
প্রত্যাবর্তনের লজ্জা কবিতাটিকে প্রতিবেশের ন্যারেটিভের মধ্যে উল্লিখিত পঙ্ক্তিগুলো কবিতার মহিমা দান করেছে। ওই ন্যারেটিভে উল্লিখিত পঙ্ক্তিগুলো না থাকলে তাকে একটি ছোটগল্প হিসেবে বিবেচনা করা যেত। তবে সেই ন্যারেটিভ কবির হাতে রচিত বলেই তার রূপ এমন ভঙ্গিতে বেড়ে ওঠে যে তাকে কবিতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। আমরা যদি আল মাহমুদের উপন্যাস বা গল্প পাঠ করলেও দেখতে পাব এমনই গদ্যভাষা। কবির হাতে, তাঁর কল্পনা চিত্রের সঙ্গে কল্পনাকেও যুক্ত করে দেন। ফলে সেই গদ্যও হয়ে ওঠে স্বাদু এক গদ্যভাষা, নিরেট নয়। সাধারণত গদ্যকারদের হাতের রচিত উপন্যাস-গল্পের গদ্য বর্ণনার ঝোল-চর্বি বর্জিত নিরেট হয়ে থাকে। টান টান গদ্যের নিপাট যাত্রায় গল্পের চরিত্রগুলো অ্যাক্ট করে থাকে। কিন্তু কবির হাতে সৃষ্ট গদ্যে চরিত্র চিত্রণও চিত্রময় কল্পনার স্বাদু উপকরণে ছাওয়া থাকে। আল মাহমুদের গদ্য সেই শ্রেণির।
চোখ যখন অতীতাশ্রয়ী হয় এবং আমার চোখের তলদেশে কবিতা দুটোই বর্ণনাত্মক। প্রত্যাবর্তনের লজ্জার মতোই বিদ্যুচ্চমকে ভরা চিত্রকল্পের উপমা ও প্রতিতুলনার নতুন আকাশ আমরা দেখতে পাই। আমি তুলে আনি কিছু তার।
ক.
আমি যখন ছোটো, আমাদের গ্রাম ছিল
এক উদ্দাম নদীর আক্রোশের কাছে।
খ.
আমার বাপের ছিল অঘুমের অসুখ। সারারাত
ধসনামার শব্দ পোহাতেন।
গ.
কাঁদলেন এমনভাবে যে
অভিযোগহীন এমন রোদন ধ্বনি বহুকাল শুনিনি আমি।
[চোখ যখন অতীতাশ্রয়ী হয়/সোনালি কাবিন]
কিংবা,
ক.
একদা এমন ছিল যে, আমার চোখই ছিল সমস্ত দুঃখের আকর।
এমন কি একটা করুণ উপন্যাসও পড়তে পারতাম না আমি।
বুক ঠেলে কান্না উঠে আসতো চোখে। গাল ভরে নামতো জলধারা।
উপচানো চোখ নিয়ে আমি লজ্জায় মুখ লুকাতাম।
একটা সামান্য বই নিয়ে আমার এ অবস্থা দেখে
পড়ার টেবিলে আমার বোনেরা পাথর হয়ে যেতো। আম্মা
থমকে দাঁড়াতেন। আর আব্বা ঘরে থাকলে
সোজাসুজি বিহ্বলদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে
কী যেন ভাবতে ভাবতে মসজিদে চলে যেতেন।
খ.
আজকাল আমার মার সাথে কদাপি দেখা হয়।
মাঝে মাঝে আসেন। গ্রাম থেকে নিয়ে আসেন সরু চাল।
গাওয়া ঘি। খাঁটি সর্ষের তেল আর বিশুদ্ধ অনুতাপময় কান্না।
গ.
তাকে সংসার চালানোর মতো টাকা দিই। কিন্তু
আমার চোখ শুকনো থাকে। যেন
সকালের সংবাদপত্রের দু’টি জাজ্বল্যমান
আন্তর্জাতিক হেডলাইন।
[আমার চোখের তলদেশে/সোনালি কাবিন]
এ-দুটি কবিতার গল্প, প্রায় নিরেট গল্পের মতোই ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। যদি আমরা এ কবিতা দুটির ভেতরে থাকা কাব্যময়তার অংশ খুঁজি, তা সহজেই মিলবে এমন নয়। তার এই গদ্য এমন মগ্নময় যে তাকে গল্প বলতে কষ্ট হয়। তাই যখন তিনি কান্না শব্দের আগে ‘অনুতাপময়’ শব্দ বসিয়ে যে পরিবেশ নির্মাণ করেছেন, তাকে কবিতারই উপাদান বলব আমি। এই বিশেষণই ওই কান্নাকে পান্নার মতো সমুজ্জ্বল করেছে। আবার কবি নিজের কান্নাহীন চোখকে আন্তর্জাতিক সংবাদের দুটি হেডলাইনের সঙ্গে তুলনা করে বুঝিয়েছেন যে, আন্তর্জাতিক মানবসমাজও তারই মতো কর্তৃত্ববাদী আচরণের সম্রাট। মায়ের সঙ্গে পুত্রের এই আচরণ নগরের কঠিন জীবনের মতোই দয়াহীন প্রায় অমানবিক। জননীর বাষ্পাকুল চোখ দেখেও নগরে বাস করা পুত্রের চোখের কোণ ভিজে ওঠে না। কারণ, নগর মানুষের মৌলিক যে গুণ সেই মানবিকতাই হরণ করে বসে আছে। এই গল্প-কবিতায় এই দৃশ্যগুলো আমাদের যে শিক্ষা ও মনন সৃজন করে, তাই একে গল্প না বলে কাব্যিক আধার বলতে পারি। কারণ, মা যে উদ্বেলিত মন ও স্নেহ-মমতা নিয়ে পুত্রের সংসারে আসে, সেই মমতার স্পর্শ তিনি না পেলেও এতটুকু ক্ষুব্ধ হন না। এই চিরন্তনী চেহারাই যেমন আমাদের লোকজ সম্পদ তেমনি আমাদের সাংস্কৃতিক বন্ধনেরও রজ্জু তা। এই প্রেরণাই আল মাহমুদের কবিতার মৌলিক নির্যাস।
‘আমার অনুপস্থিতি’, ‘নদী তুমি’, ‘সত্যের দাপটে’, ‘আমি আর আসবো না বলে’, ‘আঘ্রাণ’, ‘স্তব্ধতার মধ্যে তার ঠোঁট নড়ে’, ‘বোধের উৎস কই, কোনদিকে’—এসব কবিতায় কী সব ইঙ্গিত আছে, যা আমাদের নতুন স্বাধীন জীবনের জন্য প্রজ্ঞার আগুন জ্বালিয়ে রাখবে?
ক.
আমি জানতাম প্রত্যেক বিজয়ীর জন্য থাকে পুরস্কার।
যুদ্ধফেরত ক্লান্ত বীরদের পাওনা, পুলকের প্রস্রবণ।
এমন কি আহত, পঙ্গুদের বুকে সান্ত্বনার পদক ঝলকায়।
আর কে না জানে এসব তাদেরই প্রাপ্য। চিরকালই বীরত্বের
বিনিময়ে এরকম রেওয়াজ রয়েছে।
কিন্তু একজন কবিকে কি দেবে তোমরা? যে ভবিষ্যতের দিকে
দাঁড়িয়ে থাকে বিষণ্ণ বদনে? অঙুলি হেলনে যার নিসর্গও
ফেটে যায় নদীর ধারায়। উচ্চারণে কাঁপে মাঠ,
ছত্রভঙ্গ মিছিল, মানুষ, পাক খেয়ে এক হয়ে যায়।
[স্তব্ধতার মধ্যে তার ঠোঁট নড়ে/সোনালি কাবিন]
খ.
হঠাৎ গুলির শব্দ। চিৎকার, ধর ধর ধর
কিন্তু আমি কাকে ধরবো? স্টেনগান কাঁধে নিয়ে হেঁটে যায়
উনিশশো তেয়াত্তর সাল।
বাগান মাড়িয়ে দিয়ে জীপ যায়,
আবার গুলির শব্দ।
মা…মা…মা… জানালা বন্ধ করো
টেলিফোন টেলিফোন…
আবার গুলির শব্দ। বাঁচাও বাঁচাও
বানাও শালকে ছিঁড়ে ফেলো—
ট্যাট… ট্যাট… ট্যাট…
খোল শালী চোরের চোদানী শাড়ি খোল
ট্যাট… ট্যাট… ট্যাট…
ছেলে তুই, ছেলে তুই আমার ধর্মবাপ তুই…
ট্যাট… ট্যাট… ট্যাট্
[বোধের উৎস কই, কোন দিকে?/ সোনালি কাবিন]
সোনালি কাবিন-এর কবিতা নিয়েই কেবল উচ্ছ্বাস লক্ষ করি আমরা। এ বইয়ের অন্যান্য কবিতা বিষয়ে আলোচকদের নীরবতা কেন, বুঝতে পারি, আবার পারিও না। সেই সুদূর অতীতের এক যুবক আর তার প্রেমিকার রূপ/রস আর কামজ বর্ণনায় আমাদের চেতনার আনন্দ এতটাই উদ্বেলিত হয়ে ওঠে যে আমরা ভুলে যাই এ বইয়ে নান্দনিক জিরোমের পাশে লুকিয়ে আছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের রাজনৈতিক ও পতনোন্মুখ সাংস্কৃতিক জীবনধারা। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করে এসে দেখেছি গোটা বাংলার সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতি, তারা যেমন ওই ধর্ষকামুক অস্ত্রবাজদের অপরাধ করতে দেখেছি, তেমনি রাজনৈতিক সরকারের ব্যর্থতাও আমাদের দারুণভাবে আহত করেছে। বোধের উৎস কই, কোন দিকে স্বাধীনতা-উত্তরকালের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি দালিলিক কবিতা। ‘আমাকে রাখতে দাও হাত।/ একবার স্পর্শ করি শিশ্নে, সহ্যগুণে, প্রেমে/ রক্তের ভেতর দিয়ে একবার দেখা যায় যদি/ বিশাল মিনার সেই, যাকে লোকে পুরুষার্থ বলে।’ এই সব পঙ্ক্তি এ কবিতার শেষ লাইন। অর্থাৎ কবির এ পর্যায়ের কবিতা চেতনার আপাতশেষ পঙ্ক্তিমালা। কারণ হিসেবে আমি বলতে চাই, এর পরের কবিতার বই মায়াবী পর্দা দুলে ওঠোতে তিনি কবিতার চলমান জগৎকে পাশ ফিরিয়ে নিয়েছেন। আর সেই পাশ ফেরাকে আমরা বলতে পারি নয়া বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছেন।