পাওলো ফ্রেইরি ও মানবমুক্তির শিক্ষাপদ্ধতি
আমাদের ভেতর যারা একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তথা সনদপত্র অর্জনের জন্য পড়ালেখা করেছি, তাদের ভেতর একটি প্রশ্ন বা আলোচনা কিংবা বিতর্ক প্রায়শই ঘুরপাক খায় বা খেতে দেখা যায়। এই প্রশ্ন-আলোচনা-বিতর্ক থেকে সাধারণত যে ফলাফলে আমরা পৌঁছাই তা হলো, আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বেশ ভালোভাবেই ত্রুটিপূর্ণ, যার মাধ্যমে শিক্ষার্জনে আগ্রহীদের প্রকৃত ও আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা একেবারে অসম্ভব না হলেও, বেশ কঠিনই বটে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, এই আলোচনার উদ্ভব যেই বইটির কারণে, সেই বইটি পড়ার আগ পর্যন্ত শিক্ষা কিংবা শিক্ষাদানের পদ্ধতি নিয়ে প্রচলিত ব্যবস্থার ধারণাগুলোই ছিল বর্তমান সমালোচকের পুঁজি। আর এই বা এমনতর পুঁজিকে সম্বল করে যাঁরা বইটি পড়তে যাবেন, তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে মারাত্মক অস্বস্তি, অনেকটাই অবিশ্বাস এবং শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস হারানোর প্রবল সম্ভাবনা।
আলোচ্য বইটি হলো পাওলো ফ্রেইরির পেডাগজি অব দ্য অপ্রেসড। ব্রাজিলের দার্শনিক ও লেখক পাওলো ফ্রেইরি ১৯৬৮ সালে এই বইটি লিখেছিলেন পর্তুগিজ ভাষায়, যা ইংরেজি ভাষায় প্রথম অনূদিত হয় ১৯৭০ সালে। ফ্রেইরির এই রচনাটিকে তাঁর সবচেয়ে প্রভাবশালী কাজ মনে করা হয়। একই সঙ্গে উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, এই বই বিদ্যায়তন বা অ্যাকাডেমিয়ায় সমাজবিজ্ঞান-বিষয়ক রচনায় সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত হওয়া সূত্রগুলোর ভেতর আছে বেশ ওপরের দিকে, তৃতীয় অবস্থানে।
পেডাগজি শব্দটির সঙ্গে বর্তমান সমালোচকের পরিচয় খুব দীর্ঘদিনের নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যুক্ত থাকার ফলে তার [সমালোচকের] কাছে এই শব্দের অর্থ মূলত শিক্ষাদান পদ্ধতি। আর এখানেই ফ্রেইরি তাঁর প্রথম ধাক্কাটি দিয়েছেন, অথবা সমালোচক প্রথম এবং তার [সমালোচকের] ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুতর ধাক্কাটির সম্মুখীন হয়েছেন। ফ্রেইরি তাঁর এই বইতে পেডাগজি শব্দটি এই শব্দের একেবারে প্রকৃত বা আদি অর্থে ব্যবহার করেছেন, যা হলো to lead a child বা কাউকে পথ দেখানো। অর্থাৎ বর্তমান সময়ে যেখানে পেডাগজি বলতে আমরা বুঝে থাকি কারও দ্বারা অপরের শিক্ষিত হওয়ার তথা শিক্ষাদানের উপায়, সেখান থেকে সরে গিয়ে ফ্রেইরি একেবারেই অন্য কিছু বোঝাতে চাচ্ছেন।
এই ‘অন্য কিছু’ আসলে কতটা অন্য ধরনের বা আলাদা, তা বুঝতে পারা যায় বইটির প্রথম অধ্যায়েই। আমরা যে ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছি, কিংবা যে ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার উত্তরাধিকার বহন করে এগিয়ে যাচ্ছি, একে ফ্রেইরি বলতে চান শিক্ষার ব্যাংকিং ব্যবস্থা। একে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে; কারণ, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় ধরেই নেওয়া হয় যে, যিনি শিক্ষক তিনি সব জানেন এবং তিনিই সঠিক বিষয়টি জানেন। অপরদিকে যাঁরা শিক্ষা গ্রহণ করতে চান, অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা আসলে অজ্ঞ এবং বাস্তবতা সম্পর্কে তাঁদের কোনো বাস্তব ও সঠিক উপলব্ধি নেই। এই উপলব্ধি তাঁরা অর্জন করে নেবেন শিক্ষকের কাছ থেকেই। শিক্ষা প্রদানের এই মডেলটিকেই ফ্রেইরি ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন, যেখানে শিক্ষকগণ পালন করেন জমাদানকারীর ভূমিকা, যিনি বা যাঁরা তাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, উপলব্ধি একতরফাভাবে জমা করেন শিক্ষার্থীদের মন ও মগজে। আর বিপরীত দিক থেকে একটি ভাণ্ডারের মতো শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের থেকে প্রাপ্ত এসব অভিজ্ঞতা-জ্ঞান-উপলব্ধি নিজেদের ভেতর জমা করে রাখেন বা রাখতে বাধ্য হন কিংবা রাখার ভান করেন।
শিক্ষা প্রদানের এই পদ্ধতিকে ফ্রেইরি একতরফা ও ত্রুটিপূর্ণ মনে করেন। কারণ, এই ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের বাস্তবতা, ব্যাখ্যাপদ্ধতি ও চিন্তাকে কোনো স্থান দেওয়া হয় না। বরং তাদের ওপর শিক্ষকেরা তাদের [শিক্ষকদের] নিজস্ব ব্যাখ্যা ও বোঝাপড়া চাপিয়ে দেন। আর এই চাপিয়ে দেওয়া ব্যাখ্যাকে কোনো ধরনের অনুভূতি ছাড়াই মুখস্থ করে নানা ধরনের পরীক্ষায় উগরে দিতে পারলেই শিক্ষার্থীরা সনদ হাতে পেয়ে সমাবর্তনের গাউন গায়ে চাপাতে পারেন। কিন্তু এর বিপরীতে এই শিক্ষাব্যবস্থা যে তাদের চিন্তাশক্তির বিলোপ ঘটিয়ে তাদেরকে ফ্রেইরির ভাষায় স্বতন্ত্র ব্যক্তি থেকে নিছক এক বস্তুতে পরিণত করে, তা নিয়ে ভাবার মতো চিন্তাবিষ্টতাটুকু তাদের ভেতর আর অবশিষ্ট থাকে না।
এই অবস্থার বিপরীতে ফ্রেইরি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ভেতর প্রচলিত এই একমুখী প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। এটি জরুরি সেই শিক্ষাব্যবস্থার জন্য, যা আদতে মানুষকে মুক্ত করতে চায়, মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তৈরি করতে চায়। এ জন্য ফ্রেইরি বলেন, শিক্ষকদের হতে হবে একই সঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, আর শিক্ষার্থীদের হতে হবে একই সঙ্গে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। অর্থাৎ একধরনের দ্বান্দ্বিকতার মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যেকোনো বিষয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনা তাদের বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে নিজেদের ভেতর আলোচনা করে একটি অবস্থানে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে, থাকবে না কোনো ধরনের চাপিয়ে দেওয়া ব্যাপার। আর এই যে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো বিষয় বা ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি, তাকে ফ্রেইরি বলছেন ডায়ালজিক্যাল বা সংলাপনির্ভর পদ্ধতি, যা দিন শেষে অবশ্যই দ্বান্দ্বিক। এই পদ্ধতিতে মনে করা হয় যেকোনো একটি বিষয়ে কোনো মানুষের ব্যাখ্যাই ভুল নয়, বরং নিজেদের বাস্তবতার আলোকে সেই ব্যাখ্যাগুলো প্রায়শই স্বতঃসিদ্ধ মনে হতে পারে, আর এসব ব্যাখ্যা নিয়ে সবার ভেতর বারবার ও চলমান আলোচনা থেকেই বেরিয়ে আসে প্রকৃত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-কার্যকরণ। ফ্রেইরি মনে করেন, শুধু এমন ডায়ালজিক্যাল পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থাতেই মানুষের প্রকৃত মুক্তি সম্ভব; যা সম্ভব নয় প্রচলিত পদ্ধতি তথা অ্যান্টিডায়ালজিক্যাল ব্যবস্থায়, কিংবা এমন কোনো প্রগতিশীল শিক্ষাব্যবস্থায় যা আদতে ডায়ালজিক্যাল নয়।
পাওলো ফ্রেইরির পেডাগজি অব দ্য অপ্রেসড আসলে একটি বিপ্লবী তৎপরতা, যেখানে শিক্ষাপদ্ধতি কেমন হবে সেই আলোচনা এ জন্যই করা হয়েছে, যেন প্রত্যেক মানুষ প্রকৃত অর্থেই পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হতে পারে। আধিপত্যশীল শ্রেণির সদস্যদের আধিপত্য, নির্যাতন, নিপীড়নের ফলে নিপীড়িত মানুষেরা যেখানে মানুষের পর্যায়ে না থেকে একেকটি বস্তুতে পরিণত হয়, সেই বস্তুতে পরিণত হওয়া মানুষদের পুনরায় মানুষ এবং পর্যায়ক্রমে পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়েই ফ্রেইরি এমন একটি শিক্ষাপদ্ধতির প্রস্তাবনা দেন।
নিপীড়িত মানুষদের মুক্তির লক্ষ্যে ফ্রেইরি তাঁর পদ্ধতি উল্লেখের ক্ষেত্রে মার্ক্স, গ্রামসি ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের তত্ত্ব থেকে সহায়তা নিয়েছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুলে ধরেছেন প্রায় স্বতন্ত্র এক পদ্ধতি। মানুষের মুক্তির জন্য একই সঙ্গে চিন্তা ও তৎপরতার উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তার কথা ফ্রেইরি উল্লেখ করেছেন বারবার, যেখানে এর যেকোনো একটির অনুপস্থিতি মূল লক্ষ্য থেকে দূরে ঠেলে দেয় সবাইকে। ফ্রেইরি মনে করেন, মানবমুক্তির তৎপরতার সঙ্গে বিপ্লব ও ক্ষমতা গ্রহণের সম্পর্ক খুব গভীর নয়; বরং বিপ্লব কিংবা ক্ষমতা গ্রহণ হলো মানবমুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত আন্দোলনের বিশেষ কিছু পর্যায় মাত্র।
এ ক্ষেত্রে যারা মানবমুক্তির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেন, তাদের ভেতর মানুষের জন্য ভালোবাসা, মানুষের প্রতি বিশ্বাস, নম্রতা, আশাবাদিতা এবং ক্রিটিক্যালি চিন্তা করার প্রবণতার উপস্থিতিকে ফ্রেইরি অপরিহার্য গুণাবলি মনে করেন। তা ছাড়া কীভাবে একটি জনগোষ্ঠীর মানুষ তাদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য, তথা তাদের মুক্তির জন্য প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, যেন তারা আসলেই তাদের পৃথিবীকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে, তার বিষদ রূপরেখাও ফ্রেইরি এই বইতে উল্লেখ করেছেন।
ফ্রেইরি মনে করেন, মানুষকে বস্তুতে পরিণত করে, তাদের শোষণ করে ও শ্রেণি আধিপত্য ধরে রেখে একদল মানুষ যখন নিজেরা ফুলে-ফেঁপে উঠতে চায়, তখন তারা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষাব্যবস্থা তথা অ্যান্টিডায়ালজিক্যাল ব্যবস্থা প্রণয়ন করে; যার মূল লক্ষ্য থাকে অন্য মানুষদের অধিকার করে নেওয়া। এ জন্য তাদের নানা শ্রেণিতে ভাগ করে শোষণ জারি রাখা হয়, তাদেরকে শোষকের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, আর তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় শোষক শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী সাংস্কৃতিক চিন্তা-ভাবনা।
এর বিপরীতে মানুষকে মুক্ত করার জন্য ফ্রেইরি ডায়ালজিক্যাল ব্যবস্থার কথা বলেন। যেখানে মানুষের ভেতর দৃঢ় যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে সবার ভেতর সহায়তার মনোভাব তৈরিই থাকে মূল লক্ষ্য। আর এই লক্ষ্য পূরণের জন্য গ্রহণ করা হয় একতা, সংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংশ্লেষণ তথা সকল সংস্কৃতির ভেতর সমন্বয় সাধনের মতো পন্থাসমূহ।
তাই বলতেই হয় যে, পাওলো ফ্রেইরির পেডাগজি অব দ্য অপ্রেসড নিছক শিক্ষাব্যবস্থা কিংবা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে লেখা কোনো সাধারণ রচনা নয়। ফ্রেইরির মূল উদ্দেশ্য মানুষের প্রকৃত মুক্তি, যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পন্থা হিসেবে তিনি নিপীড়িত মানুষকে শিক্ষিত তথা সচেতন করার উপযুক্ত পদ্ধতিটিকে সামনে এনেছেন। ফ্রেইরির আলোচনার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বিপ্লব কিংবা স্বৈরতন্ত্রের নামে তিনি বাহ্যিকভাবে আরোপিত কোনো নেতৃত্বকে স্বীকার করেন না বা এগুলোকে কার্যকর কিছু মনে করেন না। এ জন্যই তাঁর এই বইতে সাধারণ মানুষের ওপর আধিপত্য বিস্তার করা শাসকদের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষকে বুঝতে না পারা, সাধারণ মানুষের ওপর নিজেদের চিন্তা-ভাবনা ও কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়া তথাকথিত বিপ্লবী নেতাদের সমালোচনাও খুঁজে পাওয়া যায় নিয়মিতই।
দিন শেষে ফ্রেইরি মানবমুক্তির জন্য বিপ্লবী তৎপরতাকে গুরুত্বপূর্ণ বিচার করেছেন। আর এ জন্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিপ্লবী নেতৃত্বের প্রকৃত জোট ও যোগাযোগকে মনে করেছেন অপরিহার্য বিষয়। এ ক্ষেত্রে ফ্রেইরি যে কথাটি বারবার স্মরণ করিয়ে দেন তা হলো, সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিপ্লবী নেতাদের দৃঢ় যোগাযোগ ও আস্থার সম্পর্ক না থাকলে কোনো বিপ্লবই আসলে মানবমুক্তি অর্জন করতে পারে না, সেগুলো বরং হয়ে যায় যান্ত্রিক বিপ্লব, যা মানুষকে আবার সেই বস্তুতেই পরিণত করার দিকে এগিয়ে যায়।
তবে ফ্রেইরি যে পদ্ধতিতে সাধারণ মানুষকে সচেতন ও শিক্ষিত করার কথা বলেছেন, সেই পদ্ধতিটি কেবল বিপ্লবী সংগঠনই নয়, বরং ব্যক্তিপর্যায় থেকেও বাস্তবায়নের চেষ্টা করা সম্ভব বলেই মনে হয়। নিঃসন্দেহেই সেই পথটি খুব সহজ হওয়ার কথা নয়, কিন্তু মানবমুক্তির জন্য যেখানে মানুষের চিন্তাকে মুক্ত করা খুবই প্রাথমিক একটি চাহিদা, সেখানে সেই চাহিদা পূরণে কিছুটা ভূমিকা রাখার মাধ্যমে তো নিজেদেরও পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হওয়ার সূচনা ঘটে। এটি কি দারুণ এক সুযোগ নয়?