স্বার্থপরতা বনাম পরার্থপরতার অর্থনীতি
প্রথমেই বলি, আকবর আলি খান অর্থনীতির ছাত্র ও আমলা, তবে দারুণ রসিক। যে বইটির নাম পরার্থপরতার অর্থনীতি, সেখানে তিনি লিখেছেন অম্লস্বাদের সব দুরূহ টপিক নিয়ে, কিন্তু বয়ান অতি মধুর। যে পাঠক অর্থনীতিকে অনর্থক ভেবে চোখ বুজে থেকেছেন, তার কাছেও এটি অতি সুখপাঠ্য বই। কেবল বলার ঢঙের কারণেই কঠিন বিষয় মজাদার হতে পারে। যে অর্থশাস্ত্র গণিত ছাড়া পা ফেলতে পারে না, তাকে অবলীলায় নাসিরুদ্দীন হোজ্জার কৌতুক দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যায়। গণিতের বিভীষিকা ও দুর্বোধ্য লেখচিত্র দিয়ে যা বোঝানো যায় না, সামান্য চটুল আলাপে তা জলের মতো সহজ হয়। যেকোনো তত্ত্বের সার্থকতা তার প্রয়োগে, বিশ্বের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদের গবেষণা মুখ থুবড়ে পড়ে প্রয়োগের ব্যর্থতায়। অর্থনীতি একটি হতাশাবাদী ও দুর্বোধ্য বিজ্ঞান, এখানে কোনো তত্ত্বের প্রায়োগিক সফলতার হার নির্ভর করে ব্যক্তিমানুষের পরার্থপরতা বা স্বার্থপরতার ওপর।
বইয়ের প্রথম রচনার শিরোনাম পরার্থপরতার অর্থনীতি। স্বার্থপরতা শব্দটা যত বেশি চেনা, পরার্থপরতা যেন ততটাই অচেনা। মানুষ মূলত স্বার্থপর প্রাণীই। তবু অনেক ভালো ভালো বিশেষণের জন্ম হয়েছে। দয়ালু, মহানুভব, দানবীর আরও ইত্যাদি। মূলত ধর্মের খাতিরেই ভালো কাজ করে মানুষ, পরকালের ভয় এবং পুরস্কারের আশায়। দান-খয়রাত তাই ইহজাগতিক অর্থনৈতিক কাজের আওতায় আসেনি দীর্ঘদিন। ব্যক্তিগত দান-খয়রাতের দেয়াল টপকে রাষ্ট্রীয় কল্যাণকর কাজের মর্যাদা পেতে অনেক দিন লেগেছে। রাষ্ট্রপ্রধানেরা নিজেদের জনপ্রিয় করে তোলার খাতিরে এসব শুরু করেছিলেন। ধীরে ধীরে সমাজবিজ্ঞানীরা দান করাকে আমলে নিয়েছেন। আরও পরে অর্থনীতিবিদগণ এসব নন-প্রফিট কাজকে তাঁদের গবেষণায় স্থান দিয়েছেন। মানুষের স্বার্থপরতা ও দানশীলতার স্বভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বয়ং এডাম স্মিথ ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর দ্য থিয়োরি অব মোরাল সেন্টিমেন্ট এবং ওয়েলথ অব ন্যাশন পড়লে মানুষের আপাতবিরোধী দুই স্বভাবের অঙ্ক মেলে না। দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা যেগুলোর নাম জানি, তারা কীভাবে ঠিক করেছে—কী করলে কল্যাণ হয়? কিংবা সরকার যখন দেশের পিছিয়ে পড়া জনগণের জীবনমান উন্নত করতে চায়, তখন কী ধরনের পদক্ষেপের কথা ভাবে? এসব প্রশ্নের জবাব সহজ নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই, সাহায্য যার দরকার তার হাতে পৌঁছানোই মূল সমস্যা। দুর্নীতি আর অদক্ষতা প্রকট হয়ে ওঠে। অর্থনীতির মৌলিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে টেকসই পরার্থপরতা সম্ভব নয়। স্যামুয়েল জনসন যথার্থই বলেছেন, ‘দোজখের সড়ক সদিচ্ছা দিয়ে বাঁধানো’। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের গৃহায়ন প্রকল্প এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
দুই
বইয়ের দ্বিতীয় রচনার শিরোনাম- ‘শুয়োরের বাচ্চাদের’ অর্থনীতি। চমকে উঠবেন না। এটা ঠিক গালি নয়, অবস্থা। দুর্ভাগা দেশের উদাহরণের জন্য আমাদের দূরে যেতে হয় না, নিজের দেশই সবচেয়ে বড় উদাহরণ। এ দেশে তিন ধরনের লোক আছে—সজ্জন (যারা ঘুষ খায় না), বজ্জাত (যারা ঘুষ খায় এবং ওয়াদামাফিক কাজ করে দেয়), আর শুয়োরের বাচ্চা (যারা ঘুষ খেয়ে কাজ করে দেয় না)। খেয়াল করলে দেখবেন আপনার আশপাশেই আছে এমন সন্তুষ্ট লোক, যে ঘুষের বদলে সময়মতো কাঙ্ক্ষিত ফল পেয়ে খুশি, ঘুষ দেওয়া নিয়ে কোনো আফসোস নাই। কিন্তু যখন ঘুষ দিয়েও কাজ হয় না, তখন গালি আসে কি না আপনিই বলুন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এ দেশে ইংরেজরা যে শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে, সেটাই ব্যাপক দুর্নীতির কারণ। তার আগে এই অঞ্চলে এত ভূমিধস দুর্নীতি ছিল না। ব্রিটিশ আইনকানুনের গ্যাঁড়াকল থেকে উপমহাদেশের মানুষের মুক্তি শিগগিরই মেলার কোনো আশা নেই। শিকড় ছড়িয়ে গেছে অনেক দূর। কিন্তু আকবর আলি খান আপনাকে ব্রিটিশবিরোধী হয়ে শান্তিতে থাকতে দেবেন না। দক্ষিণ এশিয়ার হাড়েমজ্জায় যে দুর্নীতি সেটা অনেক আগে থেকেই ছিল, দুই হাজার বছর আগে চাণক্য সে কথা বলে গেছেন।
তিন
সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি তৃতীয় প্রবন্ধ। যেকোনো বিচারেই সংস্কার শব্দটি রীতিমতো ভীতিকর; এটা ঝুঁকিপূর্ণ এবং ফলাফল অজানা। কিন্তু কিছুই তো আসলে থেমে থাকে না, আর চলতে থাকলে দুই পা ভুল ফেললে এক পা হয়তো ঠিক পড়বে। জেনেবুঝে পরিবর্তন আনতে গেলেও ভুল হতে পারে। এক দেশে যে মডেল শুভ ফল দেয়, অন্য দেশের বেলায় সেটাই ক্ষতিকর হতে পারে। ফলে সংস্কার যে অঞ্চলে ঘটবে, সে অঞ্চলের মানুষের অবিশ্বাস যায় না। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ তাই সংস্কার দ্রুত করে ফেলার পক্ষে, যেন বিরোধী মত আওয়াজ তোলার আগেই যা করার করে ফেলা যায়। আবার কেউ কেউ বলেছেন, পরিবর্তন না করার একটা দোষ, কিছুই করা হয়নি বলে এক লাইনে একটা অভিযোগ ওঠে। কিন্তু কাজ করতে গেলে হাজার ভুলত্রুটি নিয়ে কথা ওঠে। ফলে সংস্কারের জন্য প্রয়োজন সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার। সংস্কারের প্রশ্নে ভালো অর্থনীতি আর ভালো রাজনীতির মধ্যে প্রায়ই দ্বন্দ্ব দেখা যায়। সংস্কারের ঝুঁকি নিয়ে আকবর আলি খান মোল্লা নাসিরুদ্দীনের কৌতুক বলে মজা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, সব ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে অতি সাবধানে এগোলে সংস্কার অসম্ভব। ফলে একটা প্রাথমিক ও গোপন রেকি করে দ্রুত কাজ করে ফেলতে হবে, তারপরে সংস্কারের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। ধীরপন্থীদের সাথে এ ক্ষেত্রে সংঘর্ষ অনিবার্য। সরকারের কাঠামো এবং অর্থনীতির মজবুতি এ ক্ষেত্রে প্রধান ফ্যাক্টর। একনায়ক হলে জনগণের ভোটের তোয়াক্কা থাকে না, আবার অর্থনীতি মজবুত না হলে সংস্কার টেকসই হয় না। সংস্কার তাই রাজনীতি ও অর্থনীতি—দুই ক্ষেত্রেই অতি দুরূহ কর্ম।
চার
রচনার শিরোনাম বাঁচা-মরার অর্থনীতি। বুঝতেই পারছেন, মেডিকেল সেক্টর এবারের আলোচ্য। অসুখ ভালো হওয়ার পরে ডাক্তারের বিল নিয়ে পিলে চমকে যাওয়া মানুষের সংখ্যা রোগীর চেয়ে বেশি। রোগী থাকে একজন কিন্তু বিলের মাশুল গোনে পুরো পরিবার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দিয়েই শুরু করা যাক। তাহলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পিলে কম চমকাবে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান বলেছেন, স্বাস্থ্য পরিচর্যা মার্কিন অর্থনীতিকে জ্যান্ত গিলে ফেলছে। হিপোক্রিটাসের শপথের বিস্তারিত আলোচনায় ডাক্তারদের ট্রেড ইউনিয়ন এবং ফি নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার মীমাংসা হয়নি। ডাক্তারদের ব্যক্তিগত ভূমিকা এবং রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো পরস্পরের সাথে খাপ না খেলে অঙ্ক কখনো মিলবে না।
উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতকে পুরোপুরি বাজারের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন কালোদের এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ, তেমনি বাংলাদেশেও ধনীদের তুলনায় গরিবের স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ আশঙ্কাজনকভাবে অপ্রতুল। এ বৈষম্য গ্রাম ও শহরে যেমন, নারী ও পুরুষে তেমন। এ বৈষম্য দূর করে সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করাই হবে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। শুধু ডাক্তারদের জন্য নয়—অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদদের জন্যও।
পাঁচ
এবারে ভবিষ্যদ্বাণীর ফাঁদে সমাজবিজ্ঞানীরা। তাঁদের দূরদর্শিতার ওপরে তাঁদের তত্ত্বের সাফল্য নির্ভর করে। মুশকিল হলো, দৈব বাণীর মতো কিছু বলে ফেলতে পারবেন না তাঁরা। সামনের একশ বছরের কথা বলতে গেলে তাঁদের পেছনের একশ বছর আমলে নিতে হয়। রবি ঠাকুরের মতো নিশ্চিন্তে একশ বছর পরের পাঠক তার কবিতা পড়বেই—এমন সুখের কপাল অর্থনীতিবিদদের নয়। ক্ষণে ক্ষণে বাতিল হয়ে যায় গাণিতিকভাবে নির্ভুল তত্ত্ব। ম্যালথুসের জনসংখ্যা তত্ত্ব তাই বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু কৃষিজমি এবং উৎপাদন না বাড়লে তার ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যেতে পারত। আমরা এখন জানি, পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ হয়েছে খাদ্যের অভাবে নয়, মানুষের রাজনৈতিক ব্যর্থতা এবং স্বার্থপরতার কারণে। অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো আসলে কখনো স্বতন্ত্র সমস্যা নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক এমনকি ব্যক্তিগত সমস্যা এর চালিকাশক্তি।
ছয়
শোষণের রাজনৈতিক অর্থনীতি এই অধ্যায়টি পড়ার আগে শিরোনামের দিকে তাকিয়ে খানিক অপেক্ষা করতে হয়। শোষণ শব্দটি কবে থেকে মানুষের হয়েছে? যত দূর লিখিত ইতিহাস আছে, তত দূর তো শোষণের ইতিহাসই। আদিম সাম্যবাদী সমাজের অনুমান কতটা যুক্তিনির্ভর? মানুষের ইতিহাস যদি শোষণ দিয়ে শুরু না হয়ে থাকে, তবে সেটা শুরুর কারণটা আসলে কী? এসব জানা যাবে কোনো দিন? মানুষের ইতিহাস তো সেই বই, যার শুরুর পৃষ্ঠাগুলো হারিয়ে গেছে আর শেষেরগুলো এখনো লেখা হয়নি। এই অধ্যায়ে সাড়ে চার হাজার বছর আগের এক মিসরীয় কবির একটা কবিতা আছে। এই কবিতার দিকে তাকিয়ে মানুষের নির্দয়তার শাশ্বত রূপ পাওয়া যায়। মানুষের ভালোত্ব খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছে মানুষ। আড়াই হাজার বছর আগে কনফুসিয়াস ভালো শাসকের কথা বারবার বলেছেন। শাসক ভালো হলে মানুষের ওপর মানুষের শোষণ থাকবে না—এই আশার গুড়েও বালি। মানুষের ইতিহাস তাই শোষণের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের ইতিহাস। কিন্তু সমাজতন্ত্রের ধসে পড়া দেখে মনে হয় শোষিত শ্রেণির মধ্যেও বিভিন্ন ভাগ আছে। ধর্ম, ভাষা, আঞ্চলিকতা—এসবে বিভক্ত হয়ে একটিমাত্র সর্বহারা পরিচয়ে আসতে পারে না। ঔপনিবেশিকতার শোষণ নিয়ে সব সময় বিভান্তি ছড়ানো হয়েছে। শিক্ষা ও সভ্যতার আলো ছড়ানোর নামে আফ্রিকা-এশিয়ার সম্পদ নিয়ে গেছে ইউরোপ। দুনিয়াব্যাপী শোষণের এই মারাত্মক দিকটিই পুরো মনুষ্য প্রজাতিকে চিরকালীন অসাম্যে বেঁধে ফেলেছে।
সাত
লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের অর্থনীতি– ভয় পাবেন না। এটা নারীবাদী নিপীড়ন নিয়ে ওমান্স চ্যাপ্টার ধরনের কিছু নয়। লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের সুস্পষ্ট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস আছে। আকবর আলি খানের মুনশিয়ানা দেখা যায় এখানে। অতিবাস্তব এক সমস্যার আলোচনা শুরু হয়েছে বনলতা সেন কবিতা দিয়ে। বলতে চেয়েছেন, সামাজিক পরিচয়হীন বনলতা প্রবল বৈষম্যের শিকার একটা নারী-অংশের প্রতিনিধি। এখান থেকে চলে গেছেন অমর্ত্য সেনের নিরুদ্দিষ্ট নারীতে। কারা নিরুদ্দিষ্ট নারী? সামাজিক ও পারিবারিক অবহেলায় যাঁরা মৃত্যুহার বাড়িয়েছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, মানুষের ইতিহাস তো শোষণেরই ইতিহাস, তাহলে নারীর বঞ্চনার কথা আলাদা করে উঠছে কেন? উঠছে কারণ, নারী তার বঞ্চনার প্রতিবাদ করার সময় পায়নি।
কেন পায়নি? কারণ, মানুষের বাচ্চা স্বাবলম্বী হতে প্রাণিকুলের অন্য প্রজাতির চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে। সন্তান জন্মদানের পরে নারীর মন ও মস্তিষ্কের বেশির ভাগ দখল করে সন্তানকে বড় করার চিন্তা। নিজের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করা তার মূল কাজের অংশ হয়ে উঠতে পারে না।
পিতাপুরুষটিও কাজ করেন, হয়তো সন্তানের জন্য পরিবারের জন্যই করেন। কিন্তু তার মূল কাজের সাথে সাথে নিজের সাথে ঘটা শোষণের প্রতিবাদ করা সম্ভব হয়।
মানব ইতিহাস এগিয়ে নেওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের সিংহভাগ নারীর কাঁধে। একটি শিশুর জন্মদানের প্রক্রিয়া পাহাড় বাওয়ার মতো। এভারেস্ট বিজয়ীর নাম ইতিহাস হয়ে যায় আর নারীর মা হওয়াকে দেখা হয় অতি সাধারণ জৈবিক কাজ হিসেবে। বিজ্ঞানের হাজার সমালোচনা থাকতে পারে, কিন্তু সন্তান জন্মদানের নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নারীর জন্য অনেক বড় আশীর্বাদ। না হলে জীবনের বেশির ভাগ সময় চলে যায় বারবার মা হওয়া আর শিশু বড় করায়। যে কাজের জন্য নারীর কোনো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক স্বীকৃতি নেই। ধর্ম তাদের পায়ের তলের বেহেশত দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। কেউ স্বীকার করেনি—নারীর আত্মত্যাগ ছাড়া মনুষ্য প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যেত।
প্রহসন আরও আছে। গড় আয়ু বাড়া এবং কম সন্তান ধারণ করে যে সময় নারী বাঁচিয়েছে, সেই সময় সে কাজ করতে ব্যয় করছে। কোন ধরনের কাজ? নিজের পছন্দের অর্থনৈতিক কাজ? সে আরেক বঞ্চনার কাহিনি।
আট
বইয়ের শেষ দিকে এসে আলোচনা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আটকে ফেলেছেন খান সাহেব। আগের অধ্যায়গুলোতে তবু পুরো পৃথিবীর, একটা দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতি এসেছে। কিন্তু আলোচনা শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কেন্দ্রীভূত হলে, শুধু পাঠ আর যথেষ্ট হয় না। নিজের চোখে দেখার সাথে মিলিয়ে নেওয়ার ঝক্কি পোহাতে হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির একটা বড় নিয়ামক—বন্যা। এই অঞ্চলে বন্যা আছে হাজার হাজার বছর ধরে। চাণক্য এবং আদি ভারতের মুনি ঋষিরা বন্যার সতর্কতা নিয়ে অনেক কথা বলে গেছেন। কিন্তু তাঁরা কৃত্রিম উপায়ে নদীশাসনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। হয়তো তারা প্রকৃতির নিজস্ব ছন্দে হস্তক্ষেপ করার বিপদ আঁচ করতে পেরেছিলেন।
বাংলাদেশে বন্যা রীতিমতো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঘটনা। বন্যা মানেই দুর্বল বাঁধ আর রিলিফ। রিলিফ মানেই দেশি-বিদেশি সাহায্য আর চুরি। বন্যা মানে রাজনৈতিক নেতা আর সরকারের জনপ্রিয়তা ঝালাইয়ের ধূর্ত অভিনয়। বন্যা মানেই কিছু লোকের ধনী হওয়া। কৌতুক আছে একটা: প্রায় সকল মুসলিম দেশের খনিজ তেল আছে, বাংলাদেশের আছে বন্যা।
নয়
সোনার বাংলার অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলা আজকের দিনের জন্য বিরাট ভীতিকর কাজ। কিন্তু সোনার বাংলা শব্দ দুটি কি আমাদের এই ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করে যে একদিন সত্যি সোনার ছিল বাংলা? রবীন্দ্রনাথ যখন লিখেছেন, তখন যে নয়, এ তো জানে সবাই। তবে কবে ছিল? ইনবে বতুতার কথা শুনে খুশি হওয়ার কিছু নেই হয়তো। তার ক্রয়ক্ষমতা অনেক বেশি ছিল। ফলে জিনিসপত্রের দাম পানির দাম মনে হয়েছে, কিন্তু স্থানীয়দের কাছে সস্তা মনে হয়নি—তিনিই বলেছেন। ফলে সোনার বাংলা আসলে একটা ভাবালু আদরের ডাকই। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে এর যোগ নেই।
দশ
বইয়ের শেষ অধ্যায়—অর্থনীতির দর্শনের সন্ধানে। এর চেয়ে ভালো শেষ আর হতে পারত না। অর্থনীতির যাবতীয় সংশয় দর্শনের নামে চালিয়ে দিতে পারলে খানিক শান্তি মেলে। শুরু থেকেই বিজ্ঞানের টুপি মাথায় নিয়ে অর্থনীতির আত্মপ্রকাশ। কিন্তু বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাতে অর্থনীতিবিদদের আগ্রহ তেমন দেখা যায়নি। গাণিতিক ফর্মুলায় ফেলে বিশ্বজনীন তত্ত্ব হাজির করতে চেয়েছেন, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে অর্থনীতির মূল সূত্রসমূহ পরিবর্তিত হয়, এটা অনেক অর্থনীতিবিদই স্বীকার করতে চাননি। প্রখ্যাত দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ স্টুয়ার্ট মিল বলেছেন, অর্থনৈতিক সূত্রসমূহ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নিয়মের মতো অমোঘ নয়। মিল্টন ফ্রিম্যান বলেছেন, অর্থনৈতিক তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতার কষ্টিপাথর হলো, এই তত্ত্ব সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে কি না। এর চেয়ে দুরূহ পরীক্ষা তো আর হতে পারে না। অনুমান আর ভবিষ্যদ্বাণীর ওপরে ভর করে কংক্রিট অঙ্ক করে অর্থনীতিকে মানুষের খামখেয়ালির পুল পেরোতে হয়।
দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানের দর্শন সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্বের অপ্রতুলতার ফলে সম্প্রতি এক নতুন দর্শনের জন্ম হয়েছে। এই দর্শনের নাম হলো দার্শনিক নৈরাজ্য। এ মতবাদের প্রবক্তা ফেয়েরাবেন্ডের স্লোগান— সবকিছুই চলবে। মানে সৃষ্টিজগতের কোনো কিছুই যখন স্থির নয়, তখন বিজ্ঞান বা অর্থনীতি কীভাবে নির্ভুল ও বিশ্বজনীন কোনো তত্ত্বে বরাবর স্থির থাকতে পারে? বারবার প্রশ্ন উঠেছে অর্থনীতি আসলে বিজ্ঞান কি না। যদি এভাবে বলা যায়, অর্থনীতি আসলে বিজ্ঞানই, কিন্তু এর কাজকর্ম ঠিক বিজ্ঞানের মতো নয়। হাস্যকর শোনালেও এটাই সত্যি। আকবর আলি খানের পরার্থপরতার অর্থনীতি পড়া শেষ হলে পাঠকের অর্থনীতি নিয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা জন্মাবে না, কিন্তু অনেক কিছু নিয়ে বিস্তারিত পাঠের আগ্রহ জন্মাবে। আর কঠিন তত্ত্বের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কৌতুকগুলো শেখাবে কঠিন বিষয় সহজে কীভাবে বলা যায়।
আকবর আলি খানের এই বইটার সিনোপসিস যা গ্রহণ করলাম তাকে সাধুবাদ দেই। অর্থশাস্ত্রের থিওরি প্রকাশের জন্য বিজ্ঞানসম্মত কিছু টুল ব্যবহার করা হয়, যেমন, অঙ্কের সূত্র, জ্যামিতি ইত্যাদি। সেগুলো দুর্বোধ্য মনে হবে কেন? এগুলো তো বেসিক ম্যাথমেটিক্স! এদেশে যাদব চক্রবর্তী জন্মেছিলেন বলে অবাক হতে হলো! অংকের কথা যদি বলি, তার উতুঙ্গ ব্যবহার হয় পদার্থবিদ্যায়। দ্বিতীয়ত, গবেষণার কোয়ালিটির পার্থক্য হবেই ব্যক্তির ঝোঁকের ওপরে নির্ভর করে। তো অর্থনীতির নাম করা গবেষণাগুলোকে কি বিদ্রূপ করা হলো? আমরা জানি না কি যে কত গবেষণা বিশ্ব জুড়ে নীতি নির্ধারণ ও প্রয়োগে সাহায্য করেছে? লেখকের এই দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য পড়ে তার পড়াশোনার লেভেল নিয়ে সন্দেহ হলো। আমরা সবাই বলি, অংক দিয়ে জ্ঞানের প্রকাশকে জর্জরিত করা ঠিক নয়। কিন্তু তার মানে কি এই যে অংক আমাকে বস্তুনিষ্ঠতা দিচ্ছে না? এ ব্যাপারে দর্শণশাস্ত্র তো এনকারেজই করেছে! সবশেষে বলি, সমাজবিজ্ঞান ও নীতি সংক্রান্ত ডিসকোর্সে এই বইটিকে বসিয়ে আলোচনা করাটা ভাল হবে। খান কেন পরার্থপরতাকে সাধুবাদ দিলেন? এটা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। ধন্যবাদ।
Faizul Islam
অক্টোবর ০৭, ২০২১ ০৯:১৬
খুবই ভাল রিভিউ। বইটি পড়তে আগ্রহ পাচ্ছি।
Abu Hena Timu
অক্টোবর ০১, ২০২১ ১১:৪৬