মাস্টারপিস

 

ঘটনাটা এগিয়ে যাচ্ছিল একটা নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। একটা গাড়ি শোঁ শোঁ শব্দে ছুটে এলো, তারপর গোলচত্বরটা ঘুরে ঢুকে পড়ল একটা বড়সড় রাস্তার পাছার মধ্যে। একজন মধ্যবয়সী লোক, যার গোঁফগুলো বিশ্রাম নিচ্ছিল তার দাঁতের ওপর, গোলচত্বরটার যে জায়গাটায় আমি বসে ছিলাম, তার ঠিক উল্টো পাশে দাঁড়িয়ে সে আমাকে দেখছিল। যখন সে আমার কাছে এলো, আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি এই গোলচত্বরেই থাকি।

সে আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল কিছুক্ষণ। আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলাম, প্যান্টের জিপার তো ঠিকই আটকানো আছে! শার্টের নিচের দুটো বোতাম বেশ আগে থেকেই ছেঁড়া কিন্তু তাতে আহামরি বেখাপ্পা লাগছে না। আমি তাকে আশ্বস্ত করি ফুটপাতের ওপর আমার থাকার জায়গাটি দেখিয়ে।

সে জিজ্ঞেস করল, আপনি গোঁফ রাখেন না কেন? সে তার বিক্ষিপ্ত গোঁফ উঁচিয়ে ধরল আমার সামনে। আমি বললাম, বাহ্‌, চমৎকার! সে গোঁফটা ধরে বেশ জোরে একটা ঝাঁকুনি দিল। আমি এই ঝাঁকুনির অর্থ বুঝতে পেরে বললাম, গোঁফটা যে আসল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আমার কথা শুনে ঝাপসানো গোঁফ ঠেলে তার দাঁতগুলো হঠাৎ বেরিয়ে পড়ল। তবে আমার দাঁতগুলো আসল নয়, সে বলল।

আপনার দাঁতগুলো যে নকল, তা কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নেই। চকচকে সাদা নিখুঁত দাঁত। আপনার গোঁফের সাথে চমৎকার মানিয়েছে, আমি বললাম।

তাহলে কেন আপনি গোঁফ রাখেন না? সে নকল দাঁতে সত্যিকারের হাসি ধরে রেখে আমাকে প্রশ্ন করল। কারণ, আমার দাঁতগুলো আসল, আমি উত্তর দিলাম।

আমি আপনার কাছে কেন এসেছি জানেন? আমি বললাম, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, কারণ আমি ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। আমি জানি, আপনি আমার কাছে আসবেন, অন্তত আমার অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে। আপনার উদ্‌ভ্রান্ত দৃষ্টি, যেটা নির্দিষ্ট কোনো কিছুর দিকে স্থির নয়। আমি প্রতিদিন এই সব উদ্‌ভ্রান্ত দৃষ্টিকে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের সন্ধান দিয়ে থাকি। এই গোলচত্বরটা একটা গোলকধাঁধা। এখানে আসার পর ভুলে যাবেন কোন দিক দিয়ে আপনি ঢুকেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, এখানকার সব রাস্তা একই রকম জট পাকানো। আপনি যখন একটা থেকে আরেকটা কোনোভাবেই আলাদা করতে পারবেন না, তখন আপনার মস্তিষ্ক গুলিয়ে যাবে আর আপনি হয়ে পড়বেন দিক্‌ভ্রান্ত। এখানে আপনি সব দিকে তাকিয়ে আছেন অথচ কোনো দিকে তাকিয়ে নেই। সবকিছু দেখছেন আবার কোনো কিছুই সত্যি বলতে দেখছেন না। যদি মনে করেন সামনের রাস্তাটা আপনাকে সঠিক গন্তব্যে নিয়ে যাবে, তাহলে এই মুহূর্তে আপনার মতো বোকা আর একটাও নেই। আবার যদি পেছনের রাস্তাটা বেছে নেন আপনার আগের গন্তব্যে ফেরার জন্য, তাহলেও আমি বলব আপনি জীবনের সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্তটা তুলে নিয়েছেন। অথবা যদি আমার কথার পরিপ্রেক্ষিতে খানিকটা চতুরতার আশ্রয় নিয়ে ডান কিংবা বাম দিকের কোনো একটা পথ বেছে নেন, তাতেও আপনার ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। এই মুহূর্তে আপনার কাজ হলো মস্তিষ্ককে কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম দেওয়া ও আমার নির্ভুল দিক নির্ণয়ের ওপর আস্থা রাখা। আর আমার কাজ হলো আপনার মস্তিষ্কের বিভ্রম দূর করা।

কিন্তু আমি সে জন্য আপনার কাছে আসিনি, সে বলল। আমি এসেছি এটা বলতে যে, এই মুহূর্তে আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ। আর আপনি যদি শিল্পানুরাগী হয়ে থাকেন, তাহলে আমি হলফ করে বলতে পারি, এটাই আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। আমি বেশ বিনয়ের সাথে উত্তর দিই, একেবারে ঠিকই ধরেছেন, আমি বলতে গেলে শিল্পের সাধক। তবে আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না।

সে বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে উত্তর দিল, চমৎকার! তাহলে আমাদের একটা সিদ্ধান্তে আসা দরকার।

আমি বললাম, সবকিছু তো ঠিকঠাকই চলছে, প্রতিদিনের মতো সকালের সূর্য উঠতে শুরু করেছে। এখনই ঝলমলে রোদে আলোকিত হবে এই গোলকধাঁধা। তখন এখানে আরও মানুষের পদচারণা বাড়বে গোঁফসহ, গোঁফ ছাড়া, খাটো, লম্বা, নির্বোধ, বুদ্ধিমান; তবে সকলের পরিণতি এক; ওই দিক্ভ্রান্তি, এবং শেষমেশ আমার দ্বারস্থ! প্রতিদিন আমার কাছে এমন কিছু পরিচিত মুখ আসে যাদের দৈনন্দিন চলাচলের পথে এই গোলকধাঁধায় পড়তে হয়। প্রতিবারই আমি তাদের পথ দেখিয়ে দিই। যখন তারা বলে, ভাই বলতে পারেন, আমার বাড়ির রাস্তাটা কোন দিকে? তখন আমি মোটেও অবাক হই না। কারণ, আমিই যে প্রতিদিন তাদের বাড়ির পথের সন্ধান দিই, তারা তা মনে রাখতে পারে না।

তাহলে আপনার গোঁফ রাখলে ক্ষতি কী? গোঁফ রাখাটা তো একান্ত আমার নিজস্ব ব্যাপার আমি বললাম, তা ছাড়া আমার ঠোঁট বিষয়টাকে ভালোভাবে নেবে না, কারণ, সে খোঁচাখুঁচি একদম পছন্দ করে না।

কিন্তু আপনি সারাক্ষণ গোলচত্বরে বসে থাকেন কেন? আমি বললাম, গাড়িগুলোকে মানুষের পাছার মধ্যে ঢুকতে দেখলে আমার ভালো লাগে!

তাহলে কেন গাড়িটা আমার ওপর উঠে গেল না? আমি তো ওটার সামনেই দাঁড়িয়েছিলাম, একদম রাস্তার মাঝখানে, আমি আমার গোঁফ উঁচু করে ধরলাম, দাঁতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে চালকের চোখ ঝলসে দিল, কিন্তু আমি আমার নাড়িভুঁড়ি আর মগজকে রাস্তার ওপর ফুলের পাপড়ির মতো পড়ে থাকতে দেখলাম না!

আপনার দুর্ভাগ্যের কারণ, আপনার ওই সৌন্দর্য পিপাসা, আমি বললাম। আমি বছরের পর বছর গাড়িগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে আসছি, ওগুলো নিয়ম না মেনে আপনাকে হতাশ করবে, কিন্তু পাছার মধ্যে ঢুকে আপনাকে আনন্দ দেবে। ওগুলোর শব্দ শুনলেই আমি বুঝতে পারি। কারণ, ওগুলো শোঁ শোঁ করে আসে, ব্রেক কষতে কষতে গোলচত্বরটাতে দুটো পাক দেয়। আমার মনে হয়, নকল দাঁতগুলোই আপনার আনন্দটা মাটি করে দিয়েছে।

লোকটা আামার পাশে এবার না বসে আর পারল না। তাহলে গোঁফটা রেখে সে কী করবে? সে হতাশ হয়ে পড়ল। সে তার দুর্ভাগ্যের দায়টা পুরোপুরি গোঁফের ওপর চাপাল। এই প্রথম গোঁফটা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কারণ, সূর্যের আলো দাঁতে পড়ার বদলে ওগুলোর মুখে চুমো খাচ্ছিল। আমি বললাম, তবে এমন একটা গোঁফের জন্য আপনার নকল দাঁতগুলো একেবারে উপযুক্ত। কারণ, প্রচন্ড রাগের মধ্যেও দাঁতগুলো গোঁফটাকে কেটে তছনছ করে দেয় না। লোকটা এবার বলতে শুরু করল, সে আমার কাছে না এসে পারেনি, শুধু এই জন্য নয় যে, আমি ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। সে এসেছে এটা জানতে, কেমন করে ওই রকম একটা বিপজ্জনক অবস্থায় তাকে দেখে নির্লিপ্ত আমি ছিলাম। বেপরোয়া বেগে গাড়িটা আসছে দেখেও কেন তাকে চিৎকার করে আমি সরে যেতে বলিনি? সে ভেবেছিল আমার চিৎকারে এমন একটা বেপরোয়া গাড়ির সামনে সে দাঁড়িয়ে থাকার সাহসটুকু শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারবে না। সে এই জায়গাটা বাছাই করেছিল বেশ কয়েক দিন আগেই। এখানে মানুষের তেমন জটলা নেই। বেশ নিরিবিলি। কিন্তু তার একমাত্র দ্বিধার জায়গা ছিলাম আমি। তাই সে আমার কাছে এসেছে জানতে গোঁফ ছাড়া একটা মানুষ কীভাবে এমন অবস্থায় নির্লিপ্ত থাকতে পারে?

আমি বললাম, এখানে আমি সতেরোজনকে গাড়ির নিচে পড়ে মরতে দেখেছি, আর প্রত্যেকে মরেছে এই গোলচত্বরের গোলকধাঁধায়, ঝড় ওঠার জায়গাটায়। আপনি একটা ভুল জায়গা নির্বাচন করেছেন। আমি নিশ্চিত ছিলাম আপনি ব্যর্থ হবেন। কারণ, ওখানে পাগল ছাড়া কেউ দাঁড়ায় না। তাই আপনাকে আমি এখনো একটা পাগল ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছি না।

লোকটা জানতে চাইল, মরার পর কারও নাড়িভুঁড়ি গোলাপের পাপড়ির মতো রাস্তার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখেছি কি না, কিংবা চাকার নিচে মাথাটা পড়ার পর ওই চমৎকার বাঁশফাটা শব্দ শুনেছি কি না, অথবা সাদা-বাদামি মগজগুলো ছিটকে কখনো মুখে এসে লেপ্টে পড়েছে কি না? ভেবেছিল এতক্ষণে সে মূল্যবান ক্যানভাসের দুর্লভ শৈল্পিক উপাদান হয়ে উঠবে। তার মাথাটা চাকার নিচে পড়ে কচি ডাবের মতো ফেটে যাবে। সবাই টায়ার ফেটেছে ভেবে এসে দেখবে, একটা নিথর মাথা পড়ে আছে, যেটার ওপরের অংশ ফেটে ছড়িয়ে পড়েছে লাল টকটকে তরমুজের মতো, পাশ দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে ক্ষীণ লাল স্রোত। পাশেই ছিন্নভিন্ন একটা দেহ, ঠিক দেহ বললে বেশ অশৈল্পিক লাগে কথাটা, একটা দৃষ্টিনন্দন চিত্রকর্ম! সৌন্দর্যপিপাসুরা কিংবা কলাবোদ্ধারা চমৎকার মানিয়ে নেবে এই দৃশ্যের সঙ্গে।

আমি বললাম, হ্যাঁ, এর চেয়ে চমৎকার দৃশ্য আর একটাও হতে পারে না। গোলচত্বরটাতে আসার তিন দিন পর প্রথম মৃত্যুটা আমি দেখেছিলাম। বছর পাঁচেকের ফুটফুটে বাচ্চা ছিল সেটা, চাকার সঙ্গে এমনভাবে লেপ্টে ছিল যে, দেহটাকে আর বের করা যাচ্ছিল না। পুরো চাকাজুড়ে ছিল তার থেঁতলানো দেহ। বীভৎস! কিন্তু সতেরোতম মৃত্যুটা ছিল চমৎকার, কারণ তখন ছিল আমার বোদ্ধা চোখ। মাথাটা দেহ থেকে একেবারে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। দেহটা পড়ে ছিল একটা মুখ-না-গড়া দেবীর মতো। মুখ নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তে খুঁজে পাওয়া গেল না।

লোকটা আমাকে প্রশ্ন করল, সতেরোজনের মধ্যে কারও গোঁফ ছিল কি না? আমি উত্তর দিলাম, না। সে বলল, গোঁফ ছাড়া এর মধ্য থেকে মাস্টারপিস বের করা খুব দুরূহ ব্যাপার। পুরো ঠোঁট ঢাকা ছাড়া আমি কখনো একটা গোঁফ কল্পনা করতে পারি না। হিটলারের মতো গোঁফ হলে ব্যাপারটা কেমন বিশ্রী হয়ে উঠবে ভেবে দেখেছেন? আমার মনে হয়, ওই গোঁফের কারণেই তাকে এমন কার্টুন আর রুক্ষ লাগত। কারও চোখেই ওই গোঁফ একটা মাস্টারপিস তো দূরের কথা, কোনো করুণাও জাগিয়ে তুলতে পারত না। ওই গোঁফটা যখনই আমার চোখে পড়ে, যেটা একটা কুকুরের কালো বিক্ষিপ্ত গু ছাড়া কিছুই নয়, আমি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ি। পৃথিবীতে এমন বিরক্তিকর গোঁফ আর একটাও আছে বলে আমার মনে হয় না। যখন প্রথম আমার নাকের নিচে গোঁফগুলো গজাতে শুরু করেছিল, নারীর বুকের লোমের মতো একেবারে হালকা আর বাদামি, আমি ওগুলোকে বাড়তে দিয়েছিলাম একটা কালো গাবগাছের শরীর না পাওয়া পর্যন্ত। যখন ওগুলো ওপরের ঠোঁটকে গিলে মুখের মধ্যে নামতে শুরু করেছিল, তখন আমার আসল দাঁতগুলো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। আমি দাঁতগুলোকে বোঝাতে ব্যর্থ হলাম এই কালো গাবগাছগুলো নিরাপদ আর কোমল! একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি দাঁতগুলো আমার গাবগাছগুলো কেটে উজাড় করে ফেলেছে। তারপর আর একদিনও বিলম্ব না করে সেগুলোকে উপড়ে ফেললাম। দাঁতগুলো উপড়ানোর সময় ডাক্তার বলেছিল দুইখানা মাড়ির দাঁত অন্তত রাখুন, আপনার গোঁফ তো আর মাড়িতে এসে পড়ছে না!

আমি বললাম, প্রতিটা মৃত্যুই ছিল স্বতন্ত্র আর অসাধারণ। একটার সাথে আরেকটাকে আমি কখনো গুলিয়ে ফেলিনি। সেই ফুটফুটে বাচ্চা থেকে মুণ্ডুছেঁড়া রমণী কেউই পুনরাবৃত্তির দিকে যায়নি। শুধু ক্যানভাসের ব্যাকগ্রাউন্ডটা সব সময় অপরিবর্তিত থেকে গেছে। পনেরোতম মৃত্যুর ক্যানভাসটা ছিল দারুণ সাদামাটা কিন্তু বিস্ময়ে ভরা। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, এটা মাস্টারপিস ছিল কি না? আমি বললাম, এটা ছিল দেখার মতো একটা মৃত্যু! বৃদ্ধ লোকটাকে একটা ট্রাক সজোরে ধাক্কা দিল। ধাক্কায় বৃদ্ধ প্রায় উড়ে গিয়ে পড়ল একটা বেঞ্চের ওপর। দেখে মনে হলো যেন আগে থেকেই তার জন্য বিছানা পাতা ছিল। আমি এগিয়ে দেখলাম, বৃদ্ধ টান টান হয়ে আরামে ঘুমোচ্ছে। কোথাও কোনো থেঁতলানো কিংবা লাল স্রোত নেই, একেবারে নিষ্প্রভ ক্যানভাস। আমি হতাশ হলাম, কিন্তু যখন তার চোখে আমার চোখ পড়ল, আমি আর কিছুই দেখতে পেলাম না। কারণ, শুধু তার চোখ দুটোই ছিটকে বেরিয়ে গেছে। আমি একই সঙ্গে এমন ছিমছাম আর ভয়ানক ক্যানভাস কখনো দেখিনি। হ্যাঁ, আমি বছরের পর বছর এখানে অপেক্ষা করছি একটা মাস্টারপিসের আশায়।

আমি আমার দাঁতগুলোকে এই মুহূর্তে খুলে ফেলতে চাই, সে বলল। এগুলো এখন একেবারে মূল্যহীন মরা ইঁদুর। তার চেয়ে আমার মাংসল ভুতি, যা একেবারে আসল, এবং একটা মাস্টারপিস হয়ে ওঠার জন্য চমৎকার। আমি তার হতাশা বুঝতে পেরে বললাম, আমাদের দুজনকেই একজন চমৎকার গাড়ির চালকের জন্য সাধনা করতে হবে। কারণ, আমাদের লক্ষ্য অভিন্ন। বেপরোয়া চালকগুলোই এ দেশের গ্রেট আর্টিস্ট। ওরা এক একটা পিকাসো কিংবা সালভাদর ডালি! ওদের হাত, যেগুলো একটা মাস্টারপিসের জন্ম দিতে পারে যখন-তখন। ওদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক স্বয়ং শিল্পানুরাগী রাষ্ট্র। ওরা বছরের পর বছর ধরে আমাদের কলাঙ্গনকে ঐশ্বর্যময় করে তুলেছে। আমরা ওদের কাছে চিরঋণী। গোয়ের্নিকা কিংবা সফট কনস্ট্রাকশন উইথ বয়েলড বিনস এর মতো স্বপ্ন-কল্পনা মিশ্রিত দৃশ্যকে ওরা পাত্তা দেয় না। ওরা মডার্ন গ্রেট আর্টিস্ট, ওরা ঝাঁ-তকতকে বাস্তব দৃশ্য সৃষ্টি করে, একেবারে ঈশ্বরের মতো, একেবারে অকৃত্রিম। যা দেখা যায়, ছোঁয়া যায়, পবিত্র গন্ধ ছড়ায়। সে জিজ্ঞেস করল, ওদের কারও গোঁফ আছে কি না? আমি এবার তাকে নিরাশ না করে বললাম, হ্যাঁ, ওরা সবাই গোঁফধারী। ওদের গোঁফগুলো একেবারে ঝাপসানো আর তলোয়ারের মতো বাঁকা।

তাহলে আজ থেকে আমি গোঁফে মোম লাগাতে শুরু করব। গোঁফটাকে একটা চমৎকার শেপে আনা দরকার। একেবারে ওই পরম শ্রদ্ধেয় গ্রেট আর্টিস্টদের মতো! একটা মাস্টারপিসের জন্য এই অগোছালো আর অবাধ্য গোঁফটাকে সুন্দর ঝাঁ-তকতকে করা আমার কাছে কোনো ব্যাপারই না। গোঁফের উৎপত্তি ও বিকাশের স্তর সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন? আমি তাকে প্রশ্ন করলাম।

সে বলল, গোঁফগুলো প্রথমে নাকের নিচ থেকে বের হয়ে এসে ওপরের ঠোঁটকে গিলে ফ্যালে। তারপর আসল দাঁতগুলোকে সারাক্ষণ জ্বালাতে থাকে। আমি বললাম, দেখুন, শুধু মোমের জোরে গ্রেট আর্টিস্টদের গোঁফগুলো এমন ধারালো তলোয়ার হয়ে ওঠে না। কথাটা শুনে সে হতাশ হয়ে পড়ল।

আমি ফুটপাতে পড়ে থাকা আমার ব্যাগের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। এই যে ব্যাগটা দেখছেন, এর মধ্যেই রয়েছে গ্রেট আর্টিস্টদের মাস্টারপিসগুলো। আমি খুব পরিশ্রম আর যত্ন করে এগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছি। আমার মতো কলাবোদ্ধার এটাই একমাত্র ব্রত। এগুলো দেশের অ্যাসেট। এগুলো আমাদের শিল্পভান্ডারকে শুধু সমৃদ্ধই করছে না, বরং প্রত্যেক জনগণকে কলামুখী করে তুলছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্ববাসী প্যারিসের মুখে থুতু ছিটিয়ে আমাদের দেশকে মাথায় তুলে নাচবে! বাক্‌স্বাধীনতা আর কলানুরাগই এ দেশের মূল আদর্শ। সংকীর্ণমনা কিংবা কলাবিমুখ হলেই রাষ্ট্র আপনার ঘাড়ে এসে পড়বে।

আমি ব্যাগটা খুললাম, আর বের করে আনলাম সাম্প্রতিক সময়ের একটা মাস্টারপিস। কলাবোদ্ধা হলে আপনি এই ক্যানভাসটা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। একই ক্যানভাসে দুই মহান আর্টিস্টের এক মহৎ চিত্রকর্ম! সঙ্গমরত একটা লাল আর একটা সবুজ বাসের মাঝে কনুই থেকে বিচ্ছিন্ন একটা খন্ডিত হাত। লাল-সবুজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা হাতটা আমাদের জাতীয়তাবোধের সাথে একটা নতুন মাত্রা যুক্ত করে দিয়েছে। লাল-সবুজের মাঝে খন্ডিত হাতটাই এখন আমাদের শিল্পানুরাগী মননের প্রতীক। হাতটা বেরিয়ে এসে হাতছানি দিচ্ছে কলাবোদ্ধাদের। ক্যানভাসটা মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে সে বেশ আলোড়িত হয়ে বলল, এমন একটা মাস্টারপিসের জন্য এ রকম একশটা হাত কিছুই না!

লোকটা আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গোলচত্বরটার ঠিক সেই জায়টায় গিয়ে দাঁড়াল, যেখানে সে আগে দাঁড়িয়ে ছিল। হয়তো সে আমার কাছে আসেইনি কিংবা বিনিময় হয়নি আমাদের মধ্যে একটি বাক্যও। হয়তো আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম শুধু কিছুক্ষণ অথবা হয়তো সে আমাকে বোধ হয় খেয়ালই করেনি। কিন্তু সেটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। মূল ব্যাপার হলো, আমরা দুজনই কলানুরাগী! এমন সময় শোঁ শোঁ শব্দে একটা গাড়ি এসে লোকটাকে ছিন্নভিন্ন করে ঢুকে গেল সামনের রাস্তাটার পাছার মধ্যে। আমি উল্লাসে চিৎকার করে উঠলাম, মাস্টারপিস! মাস্টারপিস!