স্বগত দিন স্বগত রাত
সাতসকালে আমরা যখন মনসুরউল হকের মৃত্যুসংবাদ পাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই জানালা দিয়ে তীব্র, আলুথালু বোটকা একটা দুর্গন্ধ এসে ঢুকতে শুরু করে আমাদের ঘরের ভেতর। আমাদের ঘরদোর অবশ্য খুব বড় নয়, তবে একেবারে ছোটও তো না; বাতাস সে ঘরে কখনোসখনো নিশ্চয়ই ঢেউ খেলে। তবু মনে হতে থাকে, দুর্গন্ধটা তীব্র হয়ে উঠছে না, আবার ছড়িয়ে পড়তে পড়তে মিলিয়েও যাচ্ছে না কোনোখানে; বরং স্থির হয়ে যেন আটকে পড়ছে ঘরের প্রতিটি বিন্দুতে।
এমন একটা দুর্গন্ধ ধেয়ে আসতে আসতেই হঠাৎ থমকে গিয়ে কেমন স্থির হয়ে পড়ছে! অথচ কী আশ্চর্য, তার কোনো উৎস খুঁজে পাই না! কচি সবুজ পেয়ারার গা-গতর থেকে উঠে আসা আলো-আলো এই সকালে রাস্তা দিয়ে সিটি করপোরেশনের আবর্জনা ব্যবস্থাপনার গাড়ি ছোটাছুটি করার কথা নয়, করছেও না; অ্যাপার্টমেন্টটায় বড় কোনো খোলা ডাস্টবিন নেই, ঘরেও ময়লা জমেনি গত কয়েক দিন হয়। অথচ তারপরও বাতাসের গায়ে লাগা কী এক টনটনে অ্যামোনিয়া মেশানো দুর্গন্ধ আমাদের বাধ্য করছিল বারবার টিভির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে নিতে, দুর্গন্ধের উৎসের খোঁজে বারবার এদিক-ওদিক তাকাতে।
কিন্তু যত দুর্গন্ধই হোক না কেন, মনসুরউল হকের মৃত্যুকে ম্লান করার মতো শক্তি কি তার আছে? কিংবা আমরাই কি পারি এই মৃত্যুকে ম্লান হতে দিতে? আমরা তাই সেটাকে উপেক্ষা করি এবং উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে থাকি। ভীষণ এক সকাল এখন। যদিও আমাদের সবার এখন আসলে ঘুমিয়ে থাকার কথা। কিন্তু একেকটা স্যাটেলাইট চ্যানেল যেন একেকটা ধূর্ত শেয়াল—যত দীন, ম্লান ঝোপের মধ্যেই থাকুক না কেন তারা, কিছুতেই তাদের সঙ্গে কুলিয়ে ওঠা যায় না। দিন হোক রাত হোক, দুর্ঘটনা ঘটার আগেই তারা তা ঘটানোর জন্যে ওত পেতে থাকে এবং আমাদের ঘুমের দরজা ঠেলে তাই সাতসকালেই একটি মৃত্যুসংবাদ সবাইকে জাগিয়ে তোলে। যদিও খবরটি জানার পর উদ্বিগ্ন ও বেদনার্ত হয়েও সংশয়ে দুলতে থাকি আমরা, মনের মধ্যে কেমন যেন খচখচ করতে থাকে,—সত্যিই কি মনসুরউল হকের মৃত্যু ঘটেছে? কাল রাতেই তো কতজনকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে দেখলাম আর দেখাদেখি নিজেও দিলাম, ‘মনসুরউল হকের অবস্থা আগের চেয়ে স্থিতিশীল আছে। আপনারা কেউ শুনে হাজিমার্কা স্ট্যাটাস দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াবেন না’, তাহলে তার কী হবে? আচ্ছা, রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রী কি কোনো শোক প্রকাশ করেছেন? আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ অভিভাবক যদি শোক প্রকাশ না করে থাকেন, তাহলে কি বলা উচিত হবে যে, মনসুরউল হক আর নেই? আমরা তো জানি, এই কয়েক দিন আগেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন, তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিয়েছেন, তাঁকে এক গোছা তাজা দোলনচাঁপা ফুল উপহার দিয়েছেন, তাঁর নাতি-নাতনির জন্যে নিয়ে গেছেন রাজ্যের খেলনাপাতি এবং প্রধানমন্ত্রীকে দেখে মনসুরউল হকও নাকি শিশুর মতো খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠেছেন, তাঁর দুই হাত চেপে ধরে শিশুর মতো কেঁদে উঠেছেন। প্রধানমন্ত্রী গিয়ে দেখা করে আসার পরও তিনি বেঁচে থাকবেন না কিংবা তারপরও তাঁর পরিচর্যার ত্রুটি হয়েছে, এমনটা বিশ্বাস করা আমাদের জন্যে খুব কষ্টকরই বলতে হবে। আমরা তাই এমন কোনো চিন্তা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করি, যাতে ক্ষীণ হলেও একটু আশার আলো ফুটে ওঠে। আমরা ভাবি, হতে পারে মনসুরউল হক আসলে গভীর কোমায় চলে গেছেন, ডাক্তারদের কেউ কেউ হয়তো চিন্তা করছেন লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলার কথা, কেউ কেউ হয়তো এ নিয়ে পরামর্শ নিচ্ছেন অন্য কোনো বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে; আর হয়তো কোনো সূত্রে এই পর্যন্ত জেনেই রিপোর্টারদের কেউ একজন এমন সুন্দর সাতসকালেই তাঁর মৃত্যুর নিউজ ফেঁদে বসেছে!
স্যাটেলাইট চ্যানেল এ রকম মাঝেমধ্যেই করে বসে—ব্রেকিং নিউজের তীব্র তাড়নায় তারা ভালো করে শোনে কি শোনে না, নিউজ এডিটরকে ফোন করে বসে, হ্যালো অমুক ভাই, একটা গরম খবর আছে। নিউজ এডিটর সেই গরম খবর শোনে কি শোনে না, তার আগেই তা স্ক্রল হয়ে মানুষজনের চোখের সামনে চলে আসে। অবশ্য সেই নিউজ ভুয়া হলে সঙ্গে সঙ্গে সেই স্ক্রল উধাও হয়ে যায়, কখনো কখনো ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতেও দেরি করে না তারা। কেননা গরম গরম প্রচারের মতো গরম গরম ক্ষমাপ্রার্থনাতেও সিদ্ধহস্ত তারা—কোনো কিছুতেই দেরি করা পছন্দ নয় তাদের। আমরা তাই গভীর ব্যাকুল হৃদয়ে আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করি, রিমোট কন্ট্রোল হাতে এ চ্যানেল থেকে ও চ্যানেলে, ও চ্যানেল থেকে এ চ্যানেলে ঘোরাফেরা করতে থাকি, কিন্তু ক্ষমাপ্রার্থনা দূরে থাক, কোনো স্যাটেলাইট চ্যানেলকেই স্ক্রল তুলে নিতে দেখি না; বরং নতুন স্ক্রল ভাসতে দেখি, ডুবতে দেখি। ভেসে বেড়ানো, ডুবে বেড়ানো সব স্ক্রল থেকে আমরা নিশ্চিত হই, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দুজনেই বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক মনসুরউল হকের মৃত্যুতে শোকাহত গভীরভাবে। জানতে পারি, তাঁর মরদেহ দেশের সেরা হাসপাতালের বরফঘরে এখন। জানতে পারি, তাঁর ছেলেমেয়েরা বিশেষ ব্যবস্থায় দেশে ফিরছে বিদেশ থেকে। এবং এ-ও শুনি যে, এই মারাত্মক করোনাভাইরাসের মাতামাতির মধ্যেও রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী—দুজনেই তাঁর শেষ যাত্রায় অংশ নেবেন।
তাহলে মনুসরউল হকের মৃত্যুর ঘটনা মোটেও গুজব নয়! সত্যিই মারা গেছেন তিনি! ভাবতে ভাবতে ঝাউপাতা দুলে ওঠে আমার ভেতর। যদিও এখন গুজব নিয়েও নানা গুজব ছড়ায় আর সেটা ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই যা ঘটার, তা একেবারে ঠিকঠাকই ঘটে যায়। যেমন গতকাল দুপুর থেকে ফেসবুকে হঠাৎ করেই আমরা দেখতে থাকি নানা স্ট্যাটাস, নানা ছবি, এমনকি নানা ভিডিও—পাটকলশ্রমিকদের ওপর নাকি গুলি চালানো হয়েছে, কমপক্ষে ১২ জন নাকি ঘটনাস্থলেই মারা গেছে, বিক্ষোভ নাকি ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে, শ্রমিকেরা নাকি পাঁচ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না, বেতন না দিয়েই পাটকল নাকি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে...ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমরা ধরতে পারি না, বিষয়টা গুজব কি না; কেননা কোনো প্রেসনোট আসে না, কেননা স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর স্ক্রলে শ্রমিক অসন্তোষ কিংবা গুলিবর্ষণের কথা বলা হলেও কারও মৃত্যুর খবর আমাদের চোখের সামনে ভাসে না। কোনটা গুজব আর কোনটা গুজব নয়, আমরা তা ধরতে পারি না, আমরা তা ধরতেও চাই না। আমাদের বন্ধু সাবেক বাম আসিফ বারেক তাই কায়দা করে স্ট্যাটাসও দেয়, ‘এমনটা যদি ঘটে থাকে, তবে তা সত্যিই নিন্দনীয়। কিন্তু বিষয়টা যদি ঘটেও থাকে, তাহলে আইনের আশ্রয় নেওয়াই তো শ্রেয়। একটা গণতান্ত্রিক দেশে তো আর কথায় কথায় বিক্ষোভ করা ঠিক নয়। বিশেষ করে সে দেশের সরকার যখন গণতন্ত্রবান্ধব, মুক্তিযুদ্ধবান্ধব, উন্নয়নবান্ধব।’ আর আমরা আমাদের চোখের সামনেই দেখতে পাই, স্ট্যাটাস দিতে না দিতেই পকাম পকাম করে লাইকের পর লাইক পড়ছে, যত না পড়ছে লাইক, তারও বেশি পড়ছে ‘লাভ’। আসিফ বারেক এত লাইক আর লাভ দিয়ে কী করবে, ভেবে পাই না; আর কারও কথা বলতে পারব না, তবে আমি বরং অপেক্ষা করি আর ভাবি, আগামীকালের সংবাদপত্র দেখে বরং বিষয়টা অনুমান করার চেষ্টা করা ভালো। কিন্তু ফেসবুক কিংবা স্যাটেলাইট চ্যানেল সবই মনসুরউল হকময় হয়ে উঠেছে। আমাদের হৃদয় বেদনায় ভরে যায়, কেননা আমরা অকস্মাৎ এই চরম সত্য অনুভব করতে থাকি, জনভবনে গিয়েও ভীষণ উচ্চকণ্ঠে কথা বলার মতো কেউই আর রইল না আমাদের মধ্যে। আবার আমাদের মন গর্বেও ভরে ওঠে। কেননা আমরা দেখি, বেলা নয়টা বাজতে না বাজতেই শুধু স্ক্রল নয়—প্রতিটি চ্যানেলে মনসুরউল হককে নিয়ে শুরু হয়েছে বিশেষ সংবাদ বুলেটিন, কেউ কেউ পুনরায় প্রচার করছে তাঁর পুরোনো সাক্ষাৎকার বা এ রকম নানা কিছু,—যার কাছে যা আছে, তাই নিয়ে মহাসমারোহে শোক প্রকাশ করে চলেছে সবাই। আমরা চোখ বুজে না বুজে ভালো করে মনে করার চেষ্টা করি, এর আগে কখনো কি এ রকম হয়েছে? কখনো কি কোনো বুদ্ধিজীবী, কোনো সাহিত্যিক এত সম্মান পেয়েছেন? রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান কি চেয়েছেন অংশ নিতে তেমন কারও শেষ যাত্রায়? নাহ্, আমাদের ঠিক মনে আসে না। তারপরও আমরা নানা হিসাবনিকাশ করি মনে মনে, একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলি ফোনে ফোনে; তারপর নিশ্চিত হই, কখনোই আমাদের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকারপ্রধান কোনো সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীর মৃত্যুর পর আসেননি শোক যাত্রায়। অতএব মনসুরউল হককে ঘিরে আমাদের গর্ব ও বেদনা আরও নিবিড় ও গভীর হয়—আমরা নিশ্চিত হই, এ জাতির মর্মমূলে পৌঁছে গেছেন তিনি, তাঁকে আর সম্ভব নয় কারও পক্ষেই এড়িয়ে যাওয়া। আমাদের ঘুম ছুটে যায়, আমরা তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে ফেলি, তাড়াতাড়ি ইস্ত্রি করা শুভ্র পোশাক পরি এবং চটজলদি চিন্তা করতে থাকি, মনসুরউল হকের সঙ্গে আমাদের ঠিক কী কী স্মৃতি আছে, ঠিক কোন কোন স্মৃতির কথা বলা যেতে পারে তাঁর মৃত্যুপরবর্তী প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে; চিন্তা করতে থাকি, কখন কীভাবে কোথায় তাঁর শেষ যাত্রা হবে এবং আমরাই-বা কীভাবে তাতে অংশ নেব। একটু বেলা বাড়তে শুরু করলে এবং কোনো স্যাটেলাইট চ্যানেল থেকেই টেলিফোন না আসায় আমাদের কেউ কেউ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন, ‘আশ্চর্য, আমার কথা কোনো টিভি চ্যানেলেরই মনে পড়ছে না! অথচ মনসুরউল হকের মৃত্যুপরবর্তী প্রতিক্রিয়ার জন্যে আমাকেই তো প্রথম মনে হওয়ার কথা!’ কেউ কেউ এই উদ্বেগ মনের মধ্যে চেপে আর রাখতে পারেন না, ঘনিষ্ঠ কাউকে ফোন করে বসেন, তিনি আবার ফোন করেন অন্য কাউকে—এইভাবে বিষয়টি কেবল মনসুরউল আহমেদের মৃত্যুতেই সীমিত থাকে না, মৃত্যুকে ছাপিয়ে আমাদের এমন জমজমাট কথোপকথনের বিষয় হয়ে ওঠে,—কে কে সেই চরম হতভাগ্য বুদ্ধিজীবী কবি সাহিত্যিক, যাঁরা এখনো স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোয় মনসুরউল হকের মৃত্যুতে নিজের শোকস্তব্ধ মুখ দেখাতে পারেননি; আর কারাই-বা মুখ দেখাতে পারছেন এবং দেখাচ্ছেন কোন সে খুঁটির জোরে।
যাঁরা এখনো স্যাটেলাইট চ্যানেলে মুখ দেখানোর সৌভাগ্য অর্জন করেননি, কিন্তু একটু চালাক তাঁরা অবশ্য বিষয়টিকে বেমালুম চেপে যান। যেমন, আমার কথাই ধরুন, টিভি পর্দায় বেশ আরাম করেই এই সব কথাবার্তা দেখছিলাম। ওদিকে আমার বনসাই করে ফেলা বউটি তখন বারান্দায় থাকা বনসাই গাছগুলোর যত্নআত্তি করছিল। কিন্তু কী কারণে ঘরে ঢুকে কয়েক সেকেন্ড টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে থেকে সেই স্ত্রীই কিনা আমাকে প্রশ্ন করে বসে, ‘কী, ওরা তোমার কোনো ইন্টারভিউ নিলো না?’
তীব্র শ্লেষ দুলে দুলে ওঠে তার কণ্ঠস্বরে। যত দূর জানি, সংসার করতে করতে তার আর নিজস্ব কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই, অনুভূতি নেই; কিন্তু তার কণ্ঠের এই শ্লেষই আমাকে মাঝেমধ্যে বুঝিয়ে দেয়, এখনো তার কোনো আকাঙ্ক্ষা মরে যায়নি, এখনো বেঁচে আছে সে তার পুরোনো সব সুতীব্র অনুভূতি নিয়ে। মনে হয় বটে, এই সংসার করতে করতে সে একটা বনসাই স্ত্রী হয়ে গেছে, কিন্তু আমি বুঝতে পারি, এই ঘরের বাইরে মাটির ওপর রাখলে এবং একটু রোদ-বৃষ্টি পেলেই সে বেড়ে উঠবে তরতরিয়ে। আজকের এই মৃত্যুসংবাদ এবং আমার প্রতি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর উপেক্ষা তেমন এক মুহূর্ত নিয়ে এসেছে। একটু নড়েচড়ে বসি আমি, ভড়কেও যাই, কিন্তু মুহূর্তেই সবকিছু সামলে জোর গলায় বলি, ‘এসেছিল। বেশ কয়েকটা ফোন এসেছিল। কিন্তু জানোই তো, আমি কোনো অচেনা নাম্বার ধরি না...’
বনানী, মানে আমার স্ত্রীর কণ্ঠনালি থেকে কেমন একটা অদ্ভুত ধ্বনি উঠে আসে। মনে হয় সে কোনো মজাদার হাসি গিলে খাচ্ছে। কিন্তু আমি থেমে থাকি না, বলতে থাকি, ‘...তো তারপর ওরা বেশ কয়েকটা মেসেজও দিয়েছিল। কিন্তু আমি আর যোগাযোগ করিনি। কেন করব, বলো? ওই বাক্সে নিজের চেহারা দেখাতে দেখাতে আমি কী বলব, বলো? মনসুর ভাই মারা গেছেন, আর আমি সেজেগুজে আতর মেখে কথা বলব!? ... ওরা এ রকম চিন্তা করার ধৃষ্টতা পায় কী করে?’
আমার বনসাই করে ফেলা স্ত্রীর ঠোঁটের কিনারে কেমন একটা বিচিত্র হাসি ফুটে উঠতে দেখি, ‘ও—তাহলে ফোন করেছিল তোমাকে!’ বলে সে চুপ হয়ে যায় বটে, কিন্তু কোথায় যেন আমি তার বিচিত্র হাসির শব্দ শুনতে থাকি।
হঠাৎ করেই আমি আর সেই বিশ্রী দুর্গন্ধটা কোনোখানে খুঁজে পাই না। খুব অসহায় বোধ করি। সত্যিই কি মনসুরউল হকের সঙ্গে আমার কোনো অন্তরঙ্গতা ছিল না? কেউই মনে করে না, তাঁর মৃত্যুতে আমার কিছু বলার আছে? আমি আনমনে এর-ওর কাছে ফোন করতে থাকি। কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, ঠিক কোনো প্রত্যাশা নিয়ে নয়; আবার উদ্দেশ্য কিংবা প্রত্যাশা যে একেবারেই নেই, সে রকমও নয়। কে জানে, আমি হয়তো প্রত্যাশা করি যে, তাদের কেউ বলে উঠবে, ‘আরে, আপনাকে তো কোনো চ্যানেলে দেখলাম না...দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমি ওদের সঙ্গে কথা বলছি।... না, না, মনসুর ভাই মারা গেছে, অথচ আপনার কোনো কমেন্ট নেবে না, শালাদের এত আস্পর্ধা!’
কিন্তু সবাই চালাক। কেউই এসবের ধারেকাছে যায় না। আবার চালাক মানুষও বহু কিসিমের। সে রকম দু-চারজন বলেন, ‘না, না, মনসুরউল মারা গেছে, আমার অনেক—অনেক কথা বলার আছে...মনসুরউলের সঙ্গে আমার যে কত স্মৃতি, তা তো একজনমেও বলে শেষ করতে পারব না! আর সবকিছু তো আমি বলতে পারবও না...কত স্মৃতি! তবে আমার যে কষ্ট হচ্ছে, সেটা তো একটু-আধটু বলাই যায়...কিন্তু তাই বলে এই করোনার মধ্যে? আমি যে গাড়িতে করে টিভি স্টেশনে যাব, সেখানে যে করোনা অ্যাটাক করবে না, সেটা কি কেউ দিব্যি দিয়ে বলতে পারে? আর এই গলার কাছে যে মাউসপিস আর তার ক্লিপ লাগিয়ে দেয়, তাতেও যে ওই ভাইরাস নেই, ওরা কি সেই গ্যারানিট দিতে পারবে? না—না—, আমি এসবের মধ্যে নেই ভাই।’
এইভাবে মনুসরউল হকের মৃত্যুসংবাদ নানা তরঙ্গ সৃষ্টি করে, নানা ঢেউ বইয়ে দিতে থাকে, নানা প্রসঙ্গের সঙ্গে এই মৃত্যুর সম্পর্ক তৈরি করে চলে এবং তাঁর মৃত্যুকে ছাপিয়ে বিবিধ বেলুন উড়তে শুরু করে আকাশে; কেবলই উড়তে থাকে, এমন কোনো কিছুই তাদের নাগালে পৌঁছে না যে হঠাৎ করে দু-একটি ফেটে চুপসে যাবে।
কেবল শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে কেন্দ্রীয় কারাগারের কোনো এক সেলের মধ্যে মাথাটা পেছনের দিকে ঠেলে দেয়ালে পিঠ ঠেস দিয়ে চোখ বুজে বসে থাকা কবি রুদ্র দুপুরের কাছেই পৌঁছায় না এই মৃত্যুর সংবাদ। অবশ্য পৌঁছানোর কথাও নয়। রুদ্র দুপুর তো তেমন কোনো বড় কবি নয়, মাঝারি গোছেরও কেউ নয়, যার কাছে সাহিত্যিক মনসুরউল হকের মৃত্যুসংবাদ পৌঁছানোর তাগিদ কেউ অনুভব করবে।
বেশ আগে এই কারাগার ছিল আমাদের শহরের মধ্যেই। কিন্তু একদিন গভীর—গভীর রাতে কারাগারে এত জোরে পাগলাঘন্টি বাজতে থাকে যে, শহরের সবার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুমকাতুরে হিসেবে ভারী সুনাম ছিল আমাদের তখনকার রাষ্ট্রপতির মাত্র ২১ বছরের তরুণী কন্যার। মাঘ মাসের ঠাণ্ডা পানি মাথায় ঢাললেও ঘুম ভাঙে না বলে বছরের পর বছর তার নাম আর ছবি ছাপা হয়েছে ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ। আর প্রতিবছরই সেই উপলক্ষে তার ছবি ছাপা হয়েছে আমাদের সংবাদপত্রগুলোর একেবারে প্রথম পাতার প্রথম স্তম্ভের ওপরের দিকে। কিন্তু সেই ঘুমকাতুরে মেয়েটিরও ঘুম ভেঙে গেল ওই পাগলাঘন্টির তোড়ে। ফলে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস থেকে চিরতরে বাদ পড়ে গেল তার নাম। পাগলাঘন্টির আর্তনাদে অবশ্য কয়েকজনের জীবনের শেষ চিৎকারও সেদিন রাতে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল কারাগারের ভেতর। কিন্তু পরদিন বড় করে সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল পাগলাঘন্টির শব্দে রাষ্ট্রপতিকন্যার ঘুম ভেঙে যাওয়ার সংবাদ। আশঙ্কা করা হয়েছিল, গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস থেকে এবার হয়তো তার নাম বাদ পড়বে। অতএব পরদিনই মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কারাগারটাকে শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি আসে, রাষ্ট্রপতি যায়, প্রধানমন্ত্রী আসে প্রধানমন্ত্রী যায়—কারাগারটা কেন যেন আর সরে না শহরের ভেতর থেকে। তারপর কী দিয়ে কী হয়, দুষ্টু লোকে বলে, তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হওয়ার পর আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্বপ্ন দেখেন, কারাগারে নেওয়া হয়েছে তাকে। অতএব পরদিন সকাল থেকেই কারাগারটাকে শহরের বাইরে নিয়ে গিয়ে ‘মানবিক কারাগারে’ রূপান্তর করার কাজ শুরু হয়ে যায়।
কারাগার এখন শহর থেকে দূরে, উচ্চুঙ্গা রুদ্র দুপুরও তাই অনেক দূরে। আমরা জানি না, ঠিক কতটা ‘মানবিক কারাগার’ সেটা, তবে এটি উদ্বোধনের দিন আমাদের কবি অমলেন্দু সাহা একটি দুর্দান্ত কবিতা লেখেন এবং সরকারি দলের সদস্যরা কবিতাটিকে পোস্টকার্ড কাগজে ছেপে নিজেদের জামার পকেটে লাগিয়ে রাখে। শোনা যায়, মনসুরউল হক নিজে গিয়েও দেখা করতে পারেননি রুদ্র দুপুরের সঙ্গে। কথাটা সত্যি হোক আর মিথ্যা হোক, অমলেন্দু সাহা সেটাকে এভাবে বলতেই বেশি ভালোবাসে—‘উনি তো ওই উচ্চুঙ্গাটার সাথে দেখা করতে গেছিল। এখনো কত মহব্বত!’ তা যাহোক, শেষ পর্যন্ত রুদ্র দুপুরও হয়তো এই মৃত্যুসংবাদ পাবে; তবে নিঃসন্দেহে বাসি হয়ে গেলে। আর যদি কপাল ভালো থাকে, তা হলে আগামীকাল সকালেই সংবাদপত্র পড়তে গিয়ে খবরটা পেয়ে যাবে সে। কিংবা আজকেই হয়তো কারাগারের জেলারের কক্ষ থেকে হঠাৎ টিভি সংবাদের লাগসই এই অংশটুকু তার কানে এসে ঢুকে পড়বে। রুদ্র দুপুরের ঘুম অবশ্য ইদানীং প্রভাতেরও অনেক আগেই ভাঙে। জেলে যাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই নাকি সাত-সন্ধ্যায় বিছানায় শুয়ে পড়ার অভ্যাস অর্জন করে ফেলেছে সে। বেয়ারা মশা কিংবা তীব্র গরম যত উপদ্রবই করুক, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়ে আর কম্বলের নিচে শক্ত মেঝের অস্তিত্ব তার ঘুমকে নাকি বেশ নিবিড়ই করে তোলে। খানিক দূরের এক সেল থেকে একদিন কেউ একজন তাকে টিটকারি মেরেছিল, ‘এ নাকি কবি! তো কোন জাতের কবি এ? সাত-তাড়াতাড়ি ঘুমায় আর সাতসকালেই উঠে পড়ে!’ কী করে যেন কথাটা রুদ্র দুপুরেরও কানে গিয়ে ঢোকে আর সে ভারি খুশি হয়, এখনো কবি হতে পারেনি ভেবে। যেমন, তার এই নামটায় মানুষজন যত কবিত্বই খুঁজে পাক না কেন, সে নিজে তো জানে, এতে একদমই কাব্যিকতা নেই। এ আসলে ঠেলায় পড়ে বেড়ালের মতো গাছে চড়া, বাঘের মতো ধান চিবিয়ে খাওয়া ব্যাপারস্যাপার। যত দূর মনে আছে তার, ফেসবুকে যেদিন সে অ্যাকাউন্ট খুলতে গিয়েছিল, সেদিনের দুপুরটা ভারি এলোমেলো ছিল। মনে হচ্ছিল, এখনই ঝড় শুরু হবে, আর রোদটাও ছিল ভীষণ কড়া। বন্ধুরা বলছে বলেই একটা আইডি খোলার চেষ্টা করা, তাই সে নিজেকে একটু লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল বাকি দশজন থেকে, কিন্তু প্রখর রোদে ভরা ঝোড়ো হাওয়া কেমন দাপুটে বেগে তার চিন্তাকে এলোমেলো করে দিচ্ছিল। অতএব কী দিয়ে কী যে ঘটেছিল, নামের জায়গায় সে লিখে ফেলেছিল ‘রুদ্র দুপুর’। আর এমন একটি নামের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে সে নাকি দু-চারটে কবিতার লাইনও লিখতে শুরু করে। তারপর কী আশ্চর্য, কবি হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক থেকে সবখানে।
আমরা জানি না, রুদ্র দুপুরের এসব কথা মনে আছে কি না। কিন্তু ভয়ানক ঈর্ষায় এসব কথা আজকাল হঠাৎ হঠাৎ বরং আমাদেরই বেশি মনে পড়ে। বিশেষত মানুষজন যখন কেমন এক মুগ্ধতা মিশিয়ে ফিসফিসিয়ে নিষিদ্ধ কোনো কিছুর মতো করে তার নাম বলে। প্রচণ্ড ঈর্ষায় জ্বলতে জ্বলতে আমাদের কেবলই মনে হয়, আজকালকার এইসব নাক টিপলে দুধ বেরোনো ছেলেমেয়েগুলো এমন কী পেল ওই রুদ্র দুপুরের মধ্যে! ও যে কবিতা লিখতেই পারে না, সে কথা যতই বোঝানো হোক না কেন, উচ্চুঙ্গা পোলাপানগুলোর সেটা মাথাতেই ঢোকে না। কেউ কেউ আবার বেয়াদবের মতো বলে বসে, ‘কবিতা হয় না সেটা আমরাও বুঝি। কিন্তু মনে রাইখেন, হওয়া না হওয়া দিয়া কবিতা দাঁড়ায় না। কবিতা সময় দিয়াও দাঁড়ায়ে থাকে। আপনার যদি ভালো না লাগে, পড়বেন না। এত হেদায়েত করতে আসেন কেন?’
আমরা আর কিছু বলি না, ভয়ানক ঈর্ষা নিয়ে আমরা সবকিছু ছেড়ে দিই ভবিষ্যতের হাতে। কিন্তু ভবিষ্যৎ ক্রমাগত বর্তমান হয়ে যায় এবং এভাবে তা আমাদের কাছে অধরাই থেকে যায়। তবে হয় কি, আমরাও মনসুরউল হকের মতো প্রশ্রয়ের সুরে তরুণ-তরুণীদের কাছে রুদ্র দুপুরের কথা জিজ্ঞেস করতে শিখি। অবশ্য আড়ালে-আবডালে বলাবলিও করি, ‘মনসুর ভাই এখনো মহাধান্ধাবাজ, নইলে রুদ্র দুপুরের খবর জিগায় ক্যান?’ তা যা হোক, এইভাবে আমরা জানতে পারি, এখন নাকি সারা শরীরটাকে স্পর্শ করতে না পারলেও রুদ্র দুপুর স্পষ্ট অনুভব করতে পারে, কী আশ্চর্য সব ছোট ছোট টিলা জেগে উঠেছে তার দেহের নানা জায়গায়, আর দেখা দিয়েছে ছোট ছোট নালা—যেনবা পরম স্বস্তিতে শুয়ে আছে একাধিক লাল কেন্নো, কোথাও-বা থির হয়ে আছে থেঁতলানো মাংস—যেন হালকা গুঁড়ো মরিচ মেশানো চৈত্রদিনের ছেঁচা কাঁচা আম। তার পোশাকআশাকও তেমন পরিষ্কার নয়,—যেন কাঁচা হাতের রাঁধুনির রান্না করা ছ্যাকড়া ছ্যাকড়া প্রায় সিদ্ধ মসুরের ডাল পড়ে এখানে-সেখানে শুকিয়ে আছে। রুদ্র দুপুর নামের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখার কারণ আর এই নাম রাখার সার্থকতা জানতে তাকে নাকি এখনো প্রায় প্রতিদিনই নানা রকম হালকা আদরযত্ন করা হচ্ছে। রুদ্র দুপুর পরম ধৈর্য নিয়ে সেই হালকা আদরযত্ন প্রতিদিনই উপভোগ করার চেষ্টা করছে। যদিও শেষ পর্যন্ত আর পারছে না উপভোগ করতে।
হঠাৎ প্যান্টের পকেটে রাখা মোবাইল ফোন বেজে উঠলে আমি সংবিৎ ফিরে পাই, আচ্ছা, মারা তো গেছেন মনসুরউল হক—আমার কেন অযথাই বারবার রুদ্র দুপুরের কথা মনে হচ্ছে! এর উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই আমি ফোনটা ধরি এবং কবি অমলেন্দু সাহার গলাখাঁকারির শব্দ শুনি। রিংটোন শুনে বনানী পাশের ঘর থেকে এ ঘরে এলেও বেশ নির্ভার লাগে আমার। যদিও কেন লাগে জানি না।
কবি অমলেন্দুকে আমি বলতে শুনি, ‘আচ্ছা, আপনার কী মনে হয়? রাষ্ট্রপতি, পিএম একটু বেশি বেশি করছে না?’
আমার মুখে হঠাৎ কোনো কথা জোগায় না। তা ছাড়া বনানী একেবারে সরাসরি তাকিয়ে আছে; এই এক সমস্যা, তাকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখলেই আমার মনে হয়, সে বোধ হয় মনে করছে, আমি কোনো গুপ্ত আলাপে মশগুল, আমি কোনো নিষিদ্ধ সম্পর্কে জড়িয়ে আছি। সমস্যাটা আমার নাকি তার বুঝি না; তবে আজকাল মাঝেমধ্যেই মনে হয়, ভুলটা আমারই—এইভাবে ঘরসংসারের সঙ্গে তার জড়িয়ে পড়াটাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হয়নি, পার্টটাইম হলেও একটা চাকরিবাকরিতে থাকলে খানিকটা হয়রানির ওপরে থাকত, বুঝত এই পৃথিবীতে বেঁচেবর্তে থাকার জন্যে নারী-পুরুষ সবাইকেই কত ফাও আর আজাইরা প্যাঁচাল পাড়তে হয়। কিন্তু ও নিজে থেকেই কী করে যে সে সংসারে একেবারে পেঁচিয়ে গেল, আমি তা টেরই পেলাম না, বোধ হয় ও নিজেও পেল না। এখন নিবেদিতপ্রাণ হয়ে মার্কেটে মার্কেটে ঘোরাফেরা করে কেনাকাটা করলে আর হাত-পা ছড়িয়ে কিংবা গুটিয়ে-শুটিয়ে যেভাবেই হোক না কেন, খাওয়ার টেবিলে বসলেই তাকে বনসাই স্ত্রীর মতো লাগে; অবশ্য কে জানে, হয়তো ওরও মনে হয়, একটা বনসাই স্বামী হয়ে গেছি আমি, ওরই অনুকম্পায় একটু লেখক-লেখক গন্ধ এখনো লেগে আছে আমার গায়ে।
কিন্তু এসব পরে ভাবা যাবে, আমি এখন বনানীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বলি তাকে, ‘কী রকম বেশি বেশি?’
কবি অমলেন্দু সাহাকে হঠাৎ কেমন রাগী-রাগী লাগে, ‘নাদানের মতো কথাবার্তা বলেন কেন? কিছু জানা নাই আপনার? মনসুরউলের জন্যে আমাদের পিএম তো বিপদেই পড়ে গেছিল। ব্যাটায় আদর্শ মারায় সেক্যুলার জাতীয়তাবাদের আর খায়খাতির যত নাস্তিক বামপন্থীদের সাথে। ব্যাটায় বোঝে না, সেক্যুলার মানে হইল, মসজিদ-মন্দির সবখানেই দুই হাতে টাকা ঢালা। এই লোককে শ্রদ্ধা জানানোর কী আছে, বলেন? আচ্ছা, রাষ্ট্রপতি নাহয় গেল, উনি তো দেশের সবারই মা-বাবা। কিন্তু পিএম তো পিএম—পার্টির সাথে তিনি তো এখনো আছেন, নাকি? তার কি উচিত মনসুরউল হকের জানাজায় যেয়ে ভোট নষ্ট করা?’
আমার মুখে সত্যিই কথা জোগায় না এবং আবারও রুদ্র দুপুরের কথা মনে পড়ে যায়। সে থাকলে নিশ্চয়ই ঠাস করে বলত, ‘তাইলে আপনি কইতে চাইতেছেন, আস্তিক ভাম আর নন-সেক্যুলাঙ্গারিস্টদের সাথে মনসুরউল হকের খায়খাতির থাকা উচিত ছিল?’
‘কী, তুমি কিছু কও না কেন?’—কবি অমলেন্দুকে বড় অস্থির মনে হয়। আর আমিও খানিকটা অস্থির হয়ে উঠি, বলি, ‘বলার আর কী আছে! ওনারা যে জায়গায় বসে আছেন সেখান থেকে তো অনেক কিছু বেশি জানেন, হিসাবপাতিও অনেক বেশিই করতে হয়। নিশ্চয়ই বুঝেসুঝেই যাচ্ছেন।’
‘না—না—এর মধ্যে কোনো বোঝাবুঝি নাই। এই সব লোকজনের জন্যেই তো জঙ্গিরা লাই পায়। এটা তো নাদানেও বোঝে।’
বলে মহাবিরক্তি নিয়ে কবি অমলেন্দু সাহা আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই লাইন কেটে দেয়। আর আমার একটু ভালোই লাগে, যাক, এই নিয়ে বেশিক্ষণ কথা বলতে হলো না। তা ছাড়া নিজেকে খুব বুদ্ধিমানও মনে হয়, আহ্, কী সুন্দর টেকনিক্যাল ভাষায় পিএম সম্পর্কে মন্তব্য করলাম,—‘নিশ্চয়ই বুঝেসুঝেই যাচ্ছেন।’ এই কথা যতই রেকর্ড করুক, আমাকে ভুল বোঝার কোনো সুযোগ নেই। আজকাল মোবাইলে হোক আর ল্যান্ড ফোনে হোক, বেডরুমেই হোক আর রিসোর্টেই হোক, কোনোখানে বলা কথাবার্তাই তো দেখছি আর গোপন থাকছে না। কিন্তু এইমাত্র যা বলাবলি হলো, তাতে সরকারের লোকজন কবি অমলেন্দুকে বেকায়দায় ফেলতে পারলেও আমাকে পারবে না। এমন প্রশান্তি কব্জা করার পরও রুদ্র দুপুর আর কিছুতেই পিছু ছাড়ে না আমার। রুদ্র দুপুর, কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা রুদ্র দুপুর, ফেসবুকের কবি-লেখক রুদ্র দুপুর, কী ভয়ংকর ঝামেলায়ই না ফেলেছিল মনসুরউল হককে। আর খালি মনসুরউল হককে কেন, সেই সঙ্গে আমাদেরও তো! জনভবনে প্রধানমন্ত্রী ভালোবেসে ডেকেছিলেন আমাদের এক বিকেলে। আর সেই প্রীতিসম্মিলনীর পর থেকেই তো বোধ হয় ভাটা পড়ে মনসুরউল হক আর রুদ্র দুপুরের সম্পর্কে। কী করে যে মনসুরউল হকের বুকের পাটা সেদিন বেদম চওড়া হয়ে গিয়েছিল, কে তা জানে। অবশ্য চওড়া হলেও বেশ বিনয়ের সঙ্গেই তিনি বলেছিলেন তাঁর উষ্ণ প্রীতি-বক্তৃতার সময়, ‘মানুষের ধর্ম পালনের অধিকার যেমন আছে, তেমনি ধর্ম পালন না করে নিজের মতো জীবনযাপনের অধিকারও আছে। ধর্মনিরপেক্ষতার মানে কেবল যার-যার ধর্ম তার-তার পালন করার অধিকার নয়, ইচ্ছে হলে ধর্ম পালন না করেও সমাজ-সংসারে আর ১০টা মানুষের মতো বেঁচে থাকার অধিকার।’ আহ্, কী চমৎকার কথা, শুনতে শুনতে আমাদের বুকের ছাতি ফুলে উঠেছিল, এমন একটা কথা যিনি প্রধানমন্ত্রীর সামনে বসে বলতে পারেন, আমরা কিনা তাঁর পাশাপাশি বসে কত অনায়াসে কত ফালতু কথাবার্তাও বলি, রোমান সাম্রাজ্যের অন্ধকার যৌনাচারের ইতিহাসও বাদ পড়ে না আমাদের সেই বলাবলি থেকে। কিন্তু সারা দেশে তখন শ্মশান আর গোরস্থানের দম বন্ধ করা বোবা দিনরাত গোঁ গোঁ করছে, মাঝেমধ্যে শুধু কানে বেজে উঠছে ঝরা শুকনা পাতার হালকা মচমচে শব্দ—যেন খুব নিস্তব্ধে পালিয়ে যাচ্ছে সন্ত্রস্ত খরগোশ কিংবা গুইসাপ, এমনকি শেয়াল আর সাপেরাও ভীষণ সতর্ক তখন, গর্তের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকার পরও বড় ভীত তাদের চেয়েও প্রকাণ্ড ভয়ংকর কোনো জানোয়ার কিংবা সরীসৃপ এই পৃথিবীতে দেখা দিয়েছে বলে। আমরা তাই খুব খুশি হই, আমরা তাই হাততালি দিয়ে উঠি। সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতা পল্লব আমিন খানকেও দেখি সহর্ষে হাততালি দিতে। পৈতৃক সূত্রে বিশিষ্ট নারী উদ্যোক্তা ও কবি বনে যাওয়া মাজেদা জেবুন্নেসাকেও দেখি হাততালি দিতে দিতেই নিজের হিজাবটাকে একটু ভালো করে টেনে দিতে।
মনসুরউল হকের এই কথায় প্রধানমন্ত্রী কী মনে করেছিলেন, তা অবশ্য জানা নেই আমাদের। ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি আমাদের মধ্যেই ছিলেন বটে, কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের নাগালের বাইরেও ছিলেন। কেউ বলেন, তিনি হাততালি দিয়েছেন; কেউবা বলেন, তিনি হাততালি দেননি। কেউ বলে, তাঁর চোখ ও ঠোঁটের কোণে তখন আনন্দের হাসি ফুটে উঠেছিল; কেউ বলে, চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠেছিল আর ঠোঁটের কোণে দেখা দিয়েছিল চরম বিরক্তির আভাস। হতে পারে, এসবের সবই ঘটেছিল সেই দিন একসঙ্গে, কেননা কে না জানে, রাজনীতিকদের চোখ, মুখ, ঠোঁট আর হাত-পা একই সঙ্গে দুই রকম কথাই বলতে পারে। তবে এইটা তো ঠিক, আমাদের আসনের ঠিক পাশ দিয়েই যেতে যেতে কাউকে যেন বলতে শুনেছিলাম, ‘বলতে দিন, বলতে দিন। মনের দুঃখ উগলাতে দিন—একবার উগলাতে পারলে আশায় আশায় বসে থাকবে আরও সাত যুগ। এই ফকিন্নি লেখক-শিল্পীদের আমাদের পিএম এভাবেই সামলায়। মাঝেমধ্যে নিয়ে আসে, একসাথে বসে বকরবকর করে, ঘুড়ি ওড়ায়, মাছ ধরে, মার্বেল খেলে, দুই-চারটা ছড়া-কবিতা শোনে, তাতেই এদের পোদে এত তেল জমে যে আর নড়তে পারে না।’ আমরা একথা শুনি কি শুনি না, বুঝি কি বুঝি না, কিন্তু বড়ই প্রীত হই জীবনের প্রথম এবং হয়তোবা শেষবারের মতোও জনভবনের অন্দরে একটু ঘোরাঘুরি করে। আমরা অনুভব করি, মনসুরউল হকের সুবাদে ও নেতৃত্বে আমরা যে জনভবনের এই প্রীতি সম্মিলনীতে আসতে পেরেছি, এই-ই অনেক। অতএব অজস্র ছবি উঠতে থাকি আমরা, তীব্র আনন্দ বোধ করতে থাকি এবং আমাদের সঙ্গে যাওয়া নবীন কবি শাহাদাত নবী তাৎক্ষণিকভাবে এই স্ট্যাটাসও পোস্ট করে ফেসবুকে: ‘আহ্, এ যেন আরাকান রাজসভা। আমরা একেকজন সেই রাজসভার আলাওল, দৌলত কাজী, মাগন ঠাকুর, মারদান কোরেশী। আরও একবার প্রমাণিত হলো, আমাদের প্রধানমন্ত্রী গুণীদের মর্যাদা দিতে জানেন।’
জনভবনে থাকতে থাকতেই টের পাই আমরা, ট্রল হতে শুরু করেছে কবি শাহাদাত নবীর স্ট্যাটাস, ট্রল হচ্ছে আমাদের ছবি-টবিও। বাসায় ফিরতে ফিরতে খুবই বিরক্ত হই আমরা। বিরক্ত হই, তা ছাড়া জনভবন থেকে বেরিয়ে বড় অরক্ষিতও মনে হতে থাকে আমাদের। এই এক দোষ আমাদের, কেউ সম্মানিত হচ্ছে দেখতে পেলেই তার পিছে না লাগলে ভালো ঠেকে না। অমুক, অমুক হয়তো ভালোই লেখে—কিন্তু তারা যে জনভবনে আমন্ত্রণ পায়নি, সেটা কি আর আমাদের দোষ? আসিফ বারেক ঠিকই বলে, নিশ্চয়ই এদের তরিকায় কোনো ঝামেলা আছে, নইলে আমন্ত্রণ পাবে না কেন! হঠাৎ এ-ও মনে হয়, মনসুরউল হক যে মারাত্মক একটা কথা বললেন, তা যদি পত্রপত্রিকায় চলে আসে! তাই পরদিন সকালবেলা হকারের দেওয়া খবরের কাগজ হাতে নিয়েই পায়ের চারপাশে ঘুরে ফেরা কোমল অবলা মার্জারকে সরিয়ে দিয়ে আমরা জনভবনের প্রীতিসম্মিলনীর খবর খুঁজতে থাকি। কেননা আমরা জানি, যত ছোট অনুষ্ঠানই হোক না কেন, মনসুরউল হক উপস্থিত থাকলে সে খবর ছাপা হবেই। আর এ তো একেবারে জনভবনের অনুষ্ঠান! কিন্তু আমাদের সব অনুমান মিথ্যা হয়ে যায়, যেমন নাকি কখনো-সখনো মিথ্যা হয়ে যায় নিজের কাছে নিজেরই হৃদয়। আমরা দেখি, মনসুরউল হকের খবর ছাপা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই কথাগুলো ছাপা হয়নি। আমরা বিস্মিত হই, ‘ভীতুর ডিম’ বলে খবরের কাগজগুলোর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে থাকি। ‘ভেজাল টুপির দোকানদারদের দালাল’ বলে শাপশাপান্ত করি, যেমন করে থাকে রুদ্র দুপুর। কিন্তু সত্যি বলতে কি, মাথা থেকে মনে হয় বিরাট একটা ভার নেমে যায়—যাক, কোনো ঝুট-ঝামেলায় তা হলে পড়তে হচ্ছে না; তলোয়ার নাচাতে নাচাতে ধড়মুণ্ডু আলাদা করে ফেলা দলটার জন্যে এমন একটা গা গড়গড় করে তোলা কথাবার্তার চাক্ষুষ বা লিখিত কোনো প্রমাণ তাহলে পৃথিবী থেকে লোপাট হয়ে গেল! প্রতিভা বটে সরকারের একেকজন।
কিন্তু তারপরও কথাটা ছড়িয়ে পড়ে; কেননা নাবালক মিনি কবিতা লেখক রুদ্র দুপুর এই সাড়ে-সর্বনাশ করে বসে। ফেসবুকে সে ঘটা করে মনসুরউল হকের বক্তব্যের ওই অংশটুকুর ভিডিওসমেত স্ট্যাটাস দিয়ে বসে, ‘আমি বিপ্লবী নই; আর আপনিও নন, প্রিয় মনসুরউল হক। কিন্তু তারপরও আপনাকে আজ আমি বিপ্লবী শুভেচ্ছা জানাই। আপনি যে সাহস করে জনভবনে গিয়ে কৃতার্থ হয়ে পড়া রাজ্যের মেরুদণ্ডহীন মোসাহেব কবি সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীদের সামনে এই কথাগুলো উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, সেটাই প্রমাণ করে, আপনার মেরুদণ্ড দুর্বল বা সবল—যেটাই হোক না কেন, সেটা আপনার নিজের মতোই। আপনার এই কথাটুকু নিশ্চয়ই একটি পরমতসহিষ্ণু গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে বড় ভূমিকা রাখবে।’
মনসুরউল হকের বলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলোই খবরের কাগজে ছাপা হয়নি বলে হাহাকার করছিলাম আমরা সকালজুড়ে। অথচ এই স্ট্যাটাস দেখেই বিশাল এক ভার আমাদের মাথায় চেপে বসে। অতি দূর দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে যায় এবং আমরা চরম বিরক্তি নিয়ে বলাবলি করি, কী দরকার ছিল এই ইঁচড়েপাকা উচ্চুঙ্গাটার ফেসবুকে এই সব আজাইরা বিপ্লবী কথাবার্তা লেখার! এখন যদি তলোয়ার নাচাতে নাচাতে আমাদের ধড়মুণ্ডু আলাদা করে ফেলার জন্যে জঙ্গি-টঙ্গিগুলো লাফালাফি শুরু করে, তাহলে প্রটেকশন দেবে কে? অবশ্য এই ব্যাপারে মনসুরউল হক নিজে কী ভাবছেন, তা আর আমাদের জানা হয় না। আমরা কেবল দেখি, তিনি কী এক শীতঘুমে চলে গেছেন। অথবা আমরা আর কিছুই দেখি না। ভীষণ ক্ষত জমতে থাকে আকাশজুড়ে; কেননা হঠাৎ করেই করোনাকাল এসে ঘিরে ফেলে আমাদের প্রত্যেককে। আমরা জানতে পারি, করোনা নামে ভয়ংকর এক ভাইরাস দেখা দিয়েছে এই পৃথিবীতে, হাসতে হাসতে খেলতে খেলতে সে কোনো লক্ষণ ছাড়াই ঢুকে বসতে পারে যেকোনো মানুষের শরীরে, বসবাস করতে পারে দিনের পর দিন অথবা বসবাস করার জন্যে অপেক্ষা না করেই দেখা দিতে পারে ভয়ংকর এক চেহারা নিয়ে। চারপাশে যত সব নিরীহ রোগবালাই ঘোরাফেরা করছে, সেসবেরই হালকা-পাতলা লক্ষণে বারবার মাথাচাড়া দেয় সে, মনে হয় নিতান্তই সরল-সহজ সর্দিজ্বর সে, তারপর হঠাৎ করেই একদিন ভয়ংকর দৈত্য হয়ে দেখা দিয়ে হাসতে থাকে হো হো করে; বীভৎস ভঙ্গিতে মানুষ তার মুখটা হাঁ করে বসে থাকে, উঠে দাঁড়ায়, ছোটাছুটি করে, গোঁ গোঁ করতে করতে গড়াগড়ি খায় এবং নিঃশ্বাস নেওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাতে থাকে। সামান্য একটু বাতাসের জন্যে ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে না আসা পর্যন্ত মানুষজন ধারণাই করতে পারে না যে, এই ভয়াবহ ভাইরাসটি তার শরীরেও ভর করেছে। আর ধারণা করার তো কোনো কারণও নেই—যত ছোঁয়াচেই হোক না কেন, এর তো অনন্য ও আলাদা কোনো লক্ষণ নেই, যা থেকে ধারণা করা যাবে, রোগটি শরীরে এসে ভর করছে!
আমরা গুটিয়ে-শুটিয়ে লুটিয়ে পড়ি, আমরা শেয়ালের গর্তে ঢুকে পড়ি, আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আর আগের মতো এখানে-ওখানে সাংবাদিকদের সামনে দাপাদাপি করতে দেখা যায় না, তাই বলে অদৃশ্য ভীতিকর কী এক শক্তির বিরুদ্ধে চড়কির মতো তার তরবারি ঘোরানো বন্ধ হয় না। তরবারি ঘুরতেই থাকে, ঘুরতেই থাকে এবং এত দ্রুতগতিতে যে কার কার কল্লা কাটা পড়ে, তা-ও ঠিক টের পাওয়া যায় না। আমরা আর সাহিত্যিক মনসুরউলকেও আগের মতো আমাদের সামনে বা পেছনে পাই না—সত্যি কথা বলতে গেলে, আমরা তো আমাদের নিজেদেরও তখন খুঁজে পাই না। কত রকম গুজব ছড়াতে পারে এমন মুহূর্তে, গুজব ছড়িয়ে দেশ-দশের বারোটা বাজাতে পারে শত্রুসকল, অতএব আমরা সবাই নীরব থাকি, সরবে শুধু একটি সংগীতই বাজতে থাকে সবখানে—‘নীরবে থাকিস সখী, ও তুই নীরবে থাকিস’।
দিনের পর দিন কেটে যায়, আমরা ঠিক জানতেই পারি না, ওই স্ট্যাটাস দেওয়ার কারণে রুদ্র দুপুরের কিছু হয় কি না। তবে এটা ঠিক, আমরা আর রুদ্র দুপুরকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুঁজে পাই না। তা ছাড়া তাকেও কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার স্ত্রীকে অবশ্য এ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হতে দেখি এবং সেই প্রথম আমি জানতে পারি, তারই এক খালাতো বোন নাকি রুদ্র দুপুরের সঙ্গে টানা তিন বছর হয় বিয়ে না করেই সংসার করছে আর মাসখানেক আগে মেয়েটি কনসিভও করেছে। আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই, এ রকম একটা ব্যাপার আমি একদমই জানি না বলে। যেকোনো সময় আমরাও টানাহেঁচড়ার মধ্যে পড়তে পারি,—এই আশঙ্কা আমাকে রক্তশূন্য করে ফেলে। একটা সুন্দরী মেয়েকে আমরা অবশ্য অনেকবারই দেখেছি রুদ্র দুপুরের সঙ্গে, ভেবেও নিয়েছি প্রেমিক-প্রেমিকা তারা, নিজেরা একটু ‘কালচারড’ বলে মেয়েটিকে বলেছি ‘উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের’; তবে ঘটনা হলো কী, যত বড় সেক্যুলারই হই না কেন, আমার আত্মীয়কুলের কেউ এভাবে ‘লিভ টুগেদার’ করবে আবার কনসিভ করার পর সগর্বে ঘুরে বেড়াবে, সেটা তো আমার একদমই ধারণার বাইরে। আমার মাথা ঘুরতে থাকে, এখন যদি সত্যিই এই রুদ্র দুপুরকে নিয়ে সরকার টানাটানি করে, পত্রপত্রিকায় তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সরস ভাষায় রিপোর্ট ছাপা হতে থাকে, তাহলে আমার অবস্থাটা কী দাঁড়াবে! আমি তাই আমার স্ত্রীকে যাচ্ছে তাই গালিগালাজ করতে থাকি। যদিও মনে হয় না, সেসব তার কানে ঢুকছে। একদিন তিন ঘণ্টা পর মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হলে আমি রুদ্র দুপুরের তালাশ করি। কিন্তু তাকে সত্যিই খুঁজে পাওয়া যায় না কোনোখানে, আর আমার চেনাজানা বন্ধুরাও তাকে খুঁজে পায় না, কি মোবাইল ফোনে, কি মেসেঞ্জারে, কি ফেসবুকে-টুইটারে। আমরা বুঝতে পারি না, ও রকম একটা বিপ্লবাত্মক স্ট্যাটাস দেওয়ায় আমরা তাকে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুতালিকা থেকে বাদ দিয়ে ফেলেছি কি না; নাকি সেই ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের কারও কোনো লাইক না পেয়ে আমাদের ব্লক করে রেখেছে কি না। যেটাই হোক না কেন, হাঁপ ছেড়ে বাঁচি আমরা—কবে কোন যুগে রুদ্র দুপুর আমাদের বন্ধুতালিকায় যুক্ত হয়েছিল, কিংবা হতে পারে, আমরাই তাকে সোৎসাহে যুক্ত করেছিলাম লেখক হিসেবে আমাদের অনুসারী বা বন্ধুসংখ্যা বাড়বে ভেবে—এখন কীই-বা আসে যায় এই সবে! সে যে আর আমাদের সঙ্গে নেই চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা হয়ে, সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার।
আমি খুব কর্কশ চোখে টিভির পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকি। এ ছাড়া আপাতত আর কী করতে পারি আমি! চুপচাপ দেখি আমি, মনসুরউল হকের ভবনের সামনে শোকার্ত মানুষের ঢল, দেখি তাঁর শেষ শয্যার আয়োজন, দেখি তাঁর বই বুকে নিয়ে ফুলের বাগানে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোরী...দেখি কিছু একটা ঘটবার ঘনঘটা। আর সত্যিই কিছু একটা ঘটে, সেই কিশোরী বুকে মনসুরউল হকের বই নিয়ে নিজের মুগ্ধতার কথা বলে চলে, বলতে থাকে, বলতেই থাকে; বলতে বলতে শেষমেশ সে এই কথা বলে, ‘তবে তিনি সব সময় যে সবকিছু ভালো বলেছেন, সেটা বলা যাবে না। তিনি যে বলেছেন, নাস্তিকদেরও অধিকার আছে, এইটা ঠিক বলেন নাই।’
আমার হোঁচট লাগে, দেশের কিশোরীরা এত কিছু নিয়ে ভাবে, জানা ছিল না আমার। কেমন সাজানো গোছানো, তোতাপাখির বুলি মনে হয় কথাগুলোকে। কিন্তু এটুকুই—আর এগোতে পারে না সে। তবে টিভির উপস্থাপককে মনে হয়, বিষয়টিকে আরও একটু এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়, ‘তা ঠিক। একজন মানুষের সবকিছু তো আর ভালো লাগে না। কিন্তু সত্যিই কি তিনি এ রকম কিছু বলেছেন?’
‘বলেছেন তো! ফেসবুকে সেটা ভাইরালও হয়েছিল। কবি রুদ্র দুপুর ভিডিওটি পোস্ট করেছিলেন। এনি ওয়ে, এখন মনসুরউল স্যার মারা গেছেন, মৃত ব্যক্তি নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। ওপরওয়ালা যেন তাঁকে ক্ষমা করেন। সবকিছু তিনিই তো দেখবেন।’
বলে কিশোরী তার হিজাবটাকে দরকার না থাকলেও অযথাই টেনেটুনে ঠিক করে। আর আমার আবারও রুদ্র দুপুরের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে আমি আমার স্ত্রীকে সুপরামর্শ দিয়েছি কোনো একদিন, ‘চেপে যাও। তুমি যে ওই কালো—থুক্কু উজ্জ্বল শ্যামলা মেয়েটার কেউ, এটা ঘুণাক্ষরেও কাউকে বলতে যেয়ো না। সময়টা খুব খারাপ। কী হয়েছে, কে জানে! অযথাই এক বিড়ম্বনা—’
তা বিড়ম্বনাই বটে। ফেসবুকে রুদ্র দুপুর নিজে থাকুক বা না থাকুক, ফেসবুকে কী করে যেন ফিরে এসেছিল সে। আমরা দেখেছিলাম, কী বীভৎস আর নির্দয়ভাবে পেটাতে পেটাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে। অবশ্য নিজের চোখে দেখিনি, তবে যেভাবে দেখেছি সেটা তো বলতে গেলে নিজের চোখেই দেখা—মাত্র ৩৮ সেকেন্ডের একটা ভিডিও ক্লিপ, নির্দয়ভাবে ক্রিকেটের ব্যাট দিয়ে রুদ্র আকাশকে পেটাতে পেটাতে একটা সাদা রঙের গাড়িতে তোলা হচ্ছে, হয়তো ক্রিকেটের ব্যাটটা তার বাসা থেকেই নেওয়া হয়েছে, পিছে পিছে চিৎকার করতে করতে আসছে হিয়া নামের সেই মেয়েটি, কালো—থুক্কু, উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের মেয়েটি, যে রুদ্র দুপুরের সঙ্গে থাকে একই বাসাতে। মাত্র ৩৮ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপ, আমরা ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি না, সত্যিই সেটি রুদ্র দুপুরকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও ক্লিপ কি না। আজকাল কত সব প্রযুক্তি এসেছে, মানুষজন সেগুলো দিয়ে কী সব এটা-ওটা বানিয়ে আনন্দ-আহ্লাদ করে, কেউবা গুজব ছড়ায়। এটা সে রকম একটা কিছু—ওই যে কী যেন বলে টিকটক—সে রকম একটা কিছু কি না, কে জানে! আর এটা তো জলের মতো পরিষ্কার, আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো হচ্ছে ১১ হাতে। তাই আমরা খুব সতর্কতার সঙ্গে দেখতে থাকি, সত্যিই ক্লিপের মানুষটি রুদ্র দুপুর কি না, সত্যিই লোকগুলো সাদা পোশাকের কি না আর তাদের হাতে ধরা অস্ত্রগুলো সত্যিই অস্ত্র কি না। মনসুরউল হকের নাতিদীর্ঘ ড্রয়িংরুমে বসে তাঁর ল্যাপটপে আমরা এই অবিশ্বাস্য ভিডিও ক্লিপ দেখি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, দেখি লোকজন ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে গালিগালাজ করে মন্তব্য লিখছে, সেসব পড়তে পড়তে সহ্য করতে না পেরে আমাদের কবি আসগর মুহম্মদও চটেমটে লিখেছে, ‘দেশটা স্বাধীন করাই ভুল হয়ে গেছে। দেশবিরোধী (সরকারবিরোধী) এই সব পরগোতিশীলগুলা রাজাকারের বংশধর।’
কিন্তু থাক সেসব কথা, বলেছি তো সকাল থেকেই কী এক অদ্ভুত দুর্গন্ধ মনে হয় শুয়ে আছে চারপাশে, আমার ইচ্ছে করছে ঘর ছেড়ে দৌড়ে পালাই, অথচ করোনাভাইরাসের ভয়ে ঘরের বাইরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না। অথচ আমার স্ত্রী নাকি কোনো দুর্গন্ধই পাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে কী ভীষণ বৈপরীত্য নিয়ে আমরা কাটিয়ে আসছি সারাটা জীবন। তা ছাড়া স্যাটেলাইট চ্যানেলে কিশোরী মেয়েটিকে হঠাৎ করেই ওই সব বলতে শুনে আমি নতুন কিছু একটার ঘ্রাণ পাই। মনের গহন থেকে কে যেন বলে ওঠে, আমার মোবাইল ফোন বন্ধ করে ফেলতে হবে, ল্যান্ডফোনটা বিকল করে ফেলতে হবে যেকোনো উপায়ে; মোবাইল ফোন বন্ধ করে ফেলতে হবে বনানীর। কিন্তু সেসব করার আগেই আমার ফোন বাজতে থাকে আর আমিও অবোধ সুবোধ নির্বোধের মতো সেটা ধরে ফেলি। ‘দেশ মাটি দূরদর্শন’ থেকে ফোন এসেছে, আমার সরাসরি লাইভ করতে চায় ওরা; আমি দেখি, আমার স্ত্রী ফোনের শব্দ শুনে আবারও চৌকাঠ পেরিয়ে এই রুমের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে জিজ্ঞাসু চোখ নিয়ে।
সাতসকালে বনানীর কাছে যা বলেছি, তার মান বাঁচাতে আমি উচ্চস্বরে বলি, ‘না, না, ভাই, আমি আরও অনেক চ্যানেলকে বলেছি, আপনাদেরও বলি, এখন আমি কথা বলার মতো অবস্থাতে নাই। আপনারা তো জানেন, মনসুরউল হক আমার কত আপন মানুষ ছিলেন। এখন তাঁকে নিয়ে কোনো কিছু বলার অবস্থায় আমি নাই।’
‘কিন্তু আপনারা যদি না বলেন, তাহলে কে বলবে, বলেন? রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী—তাঁরা পর্যন্ত শোকাহত। এদিকে কেউ কেউ আবার এর মধ্যেই কেমন উল্টাপাল্টা কথা বলতে শুরু করেছে। এখন আপনারা যদি মুখ না খোলেন, তাহলে কেমন হয়, বলেন?’
‘কিন্তু ভাই, আমি তো কোনো কিছু বলার মতো অবস্থায় নাই—’
‘কিন্তু স্যার, সবাই চাইছে, আপনি কিছু একটা বলুন।’
‘কী বলব বলেন? তা ছাড়া কতজনই তো বলছে, সবই তো বলা হয়ে গেছে, আমার আর কী বলার আছে!’
‘নিশ্চয়ই আছে স্যার। বলছি তো, সবাই চাইছে—বুঝতেই পারছেন, অনুষ্ঠান মনিটরও হচ্ছে। আমরা যদি তাদের বলি, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, আপনি কিছু বলতে রাজি হননি, ব্যাপারটা কেমন হয়ে যায় না?’
আমি চুপ হয়ে যাই। দিব্যি বুঝতে পারি, এবার একটা খেলা হবে, কাদা-ছোড়াছুড়ি হবে। কাদার ওড়াউড়িতে আর কোনো কিছুই চোখে পড়বে না আমাদের। চোখে পড়বে না, শুভ্র নীল আকাশ, পাখিদের ওড়াউড়ি; কিংবা আকাশজুড়ে মেঘ, পাখিদের সন্ত্রস্ত চিৎকার; কানে আসবে না গুলির শব্দ, মানুষের আর্তনাদ। কিংবা কী হবে তার কিছুই জানি না আমরা, কোনো কিছু না জেনেই একটা কিছু করতে চলেছি আমরা। যা-ই হোক না কেন, কয়েক দিন আমরা সবাই অস্থির থাকব এখন। সেই অস্থিরতা কাটতে না কাটতেই নতুন কিছু নিয়ে বাতচিত শুরু হবে, আমরা ফের ঢাকা পড়ে যাব। যেমন, ঢাকা পড়ে গেছে রুদ্র আকাশ। একদিন হঠাৎ করেই কলবেল বেজে ওঠায় দরজা খুলে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম মনসুরউল হককে দেখে। আমার বাসায় বলা নেই, কওয়া নেই মনসুরউল হক? তিনি আমাকে সরিয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন, ‘সরো, সরো,—তুমি কি মনে করো, শুধু তোমার ডাকেই আসি? আজ আমাদের অন্নদাত্রী ডেকেছেন।’
অন্নদাত্রী, মানে আমার স্ত্রী। আমরা যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিই, চায়ের কাপে ঝড় তুলি, তারপর সবশেষে যে রীতিমতো ভোজও করি, তার সবই তো তার কল্যাণে, মনসুরউল হক তাই এ নামেই ডাকে তাকে। কিন্তু তার কী কাজ মনসুরউল হকের সঙ্গে? প্রশ্ন জাগবার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর পেয়ে গিয়েছিলাম আমি আর পায়ের ডগা শেষে মাথার চুল পর্যন্ত শিরশির করে উঠেছিল। কত সব কথাবার্তা যে হয়েছিল সেই দিন! কিন্তু শেষের কথাগুলো স্পষ্ট মনে আছে। আমার স্ত্রী বলেছিল মনসুরউল হককে, ‘তাহলে ভাই, আপনার কিছুই করার নাই?...ঠিক আছে, ভাই, সে কোনো কবি না, সে অনেক ঝামেলা করে, কিন্তু সে তো আপনারও পরিচিত একজন মানুষ, ভাই...আর আপনাকে এই দেশের কে না চেনে? আপনি কি পেপারে একটা স্টেটমেন্টও দিতে পারেন না ভাই তার সন্ধান চেয়ে?’
মনসুরউল হককে হঠাৎ দেখেছিলাম নির্বাক হয়ে যেতে। নির্বাক এবং ফ্যাকাশে। বেশ খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর আমার স্ত্রী ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলেছিল, ‘আপনি ভাই একটা কিছু বলেন!’
মনসুরউল হক চমকে সোজা হয়ে বসেছিলেন। অদ্ভুত চোখে আমাদের দিকে চেয়েছিলেন, যেন আমরা অজানা, অচেনা কেউ। তারপর মৃদু কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘তোমাদের কি মনে হয় আমি কিছুই করি নাই?...শোনো, আমি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গিয়েছি। কিছু হয় নাই। তারপর আমি খবরের কাগজে নিজে স্টেটমেন্ট দিয়েছি। তোমরা কি ভাবো, আমি যা বলি, সবই ছাপা হয়? শোনো, খবরের কাগজওয়ালারাও জানে, আমার কোন কথাটা ছাপা হলে সরকার খুশি হবে, কোন কথাটা ছাপতে হবে, কোন কথাটা ছাপতে হবে না। আমার সব কথাই যদি ছাপা হতো, তাহলে কি রুদ্রকে ওভাবে স্ট্যাটাস দিতে হয়?’
তার মাথা নিচু হয়ে এসেছিল। চোখের কোণ বেয়ে দরদরিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়েছিল। নিশ্চয়ই তা উষ্ণ ছিল।
আমি প্যান্ট-শার্ট পরতে থাকি। পরতে পরতে অনুভব করি, আবারও পচে যাওয়া মৃতদেহের দুর্গন্ধে আমার চোখ কান নাক মুখ বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু আশ্চর্য, আমার স্ত্রীকে তা যেন স্পর্শ করছে না। সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার বনসাই স্ত্রী কী করে যেন বিরাট এক বটবৃক্ষ হয়ে উঠছে। আমি যেন এক ভয়ংকর অমাবস্যার রাতে সেই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আমি কেবলই ছোট হয়ে যাচ্ছি, ছোট হতে হতে আমার বিরাট বটবৃক্ষ স্ত্রীর নিচে একটা বনসাই স্বামী হয়ে স্থির হয়ে গেছি। সে আমাকে বলছে, ‘এই করোনার মধ্যে কই যাচ্ছ তুমি?’
‘টিভিতে যেতে হবে। ছাড়ছে না কিছুতেই, কিছু একটা নাকি বলতেই হবে—’
‘কী বলবে তুমি?’
আমি আমার স্ত্রীর মুখে একটা তির্যক হাসি ফুটে উঠতে দেখি আর অনুভব করি, অন্য কোনোখান থেকে নয়, আমার শরীর থেকেই মৃত পচা বীভৎস দুর্গন্ধ বের হচ্ছে, আমার বিশাল বটবৃক্ষ স্ত্রী তির্যক হাসি ছড়িয়ে সেই দুর্গন্ধকে উপভোগ করছে আর অপেক্ষা করছে রাজ্যের পাখিদের জন্যে, যারা ঠুকরে ঠুকরে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে এই পূতিদুর্গন্ধময় শরীরটাকে... ♦
প্রথম দিকে গল্পের যে বয়ান, তাতে আমি গল্পটি ক্লিসে স্টার্ট হবার আশংকা করেছিলাম কিন্তু ইমতিয়ার শামীম কিন্তু পুরো গল্পে বিশ্ময় ছড়িয়ে দিয়েছেন, রাষ্ট্রকাঠামো ও মিডিয়ার মকারিরে মোটা দাগে মার্ক করেছেন। বেশ কিছু বয়ানে এমন ভাষার ব্যবহার করেছেন, যাতে সময়ের একটা ক্ষত টের পেয়েছি। শিল্প সাহিত্যেরও গরীবিপনাও চিত্রিত হয়েছে। দুর্দান্ত একটা গল্প তো বটেই বরং লেখকের ভেতরের পীড়নও টের পেলাম। আপনাকে সাধুবাদ ও ভালোবাসা।
শাখাওয়াত বকুল
জুলাই ০৪, ২০২১ ২৩:২৯
Outstanding!
Shaheduzzaman
জুলাই ০৪, ২০২১ ১৪:৫৮