স্বপ্ন-বাস্তবতায় কাজী আনোয়ার হোসেন
১
খুব গান ভালোবাসতাম ছোটবেলায়। এখনো যে বাসি না তা নয়। আনমনে, কখনো কোনো কাজের ফাঁকে গুনগুন করে উঠি, এই যে আকাশ এই যে বাতাস, বউ কথা কও যেন সুর ভেসে যায়...
এখনকার মতো আমাদের ছোটবেলায় গান শোনাটা এত সহজসাধ্য ছিল না। এখন তো রেডিও-টিভি, টেপরেকর্ডার, কম্পিউটার-মোবাইলসহ হাজার উপকরণ। আমাদের ছোটবেলায় কেবল রেডিওই ছিল ভরসা। আর ছিল গ্রামোফোন বা কলের গান। বিয়েশাদির অনুষ্ঠান ছাড়া কলের গান শোনা যেত না, তবে রেডিওটা ছিল যখন তখন শোনার জন্য।
কিন্তু রেডিও সহজলভ্য হলেও যখন তখন যার তার কাছে পাওয়া যেত না। আমাদের রেডিও ছিল না। পাশের বাড়ির একজনের কাছে ছিল। তারা মাঝে মাঝে খুব জোরে জোরে বাজাত। রেডিওর আওয়াজ শুনলেই আমি হাজির হয়ে যেতাম।
কত গান যে বাজত রেডিওতে। সে সময়ের এবং তার আগের সময়ের জনপ্রিয় সব গান। আবদুল জব্বার, বশীর আহমেদ, মাহমুদুন্নবী। আবদুল আলীম তো ছিলেনই। আবদুল আলীমের সঙ্গে কাজী আনোয়ার হোসেন নামের একজনের দ্বৈত কণ্ঠের ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’ গানটা প্রথম কখন শুনেছিলাম, তা আর মনে নেই। কিন্তু গানটা খুব ভালো লাগত। কিন্তু আবদুল জব্বার, বশীর আহমেদ, মাহমুদুন্নবী, আবদুল আলীমের মতো বারবার শোনা নামগুলোর পাশে কাজী আনোয়ার হোসেন নামটা কেমন একটু অপরিচিত আর দলছুট মনে হতো।
ওই একটি গান ছাড়া কাজী আনোয়ার হোসেনের আর কোনো গান শুনিনি। তবে চমৎকার একটা গান আর ব্যতিক্রমী নামের কারণে হয়তো তাঁর নাম ভুলিনি। আর সে ‘কেমন একটু অপরিচিত আর দলছুট’ নামটাই যে পরে এত পরিচিত, প্রিয় আর রহস্যময় হয়ে উঠবে, তা তখন কে ভেবেছিল!
ক্লাসের বই ছাড়াও ক্লাসের বাইরের বই পড়ার নেশাটা স্পষ্ট করে বলতে গেলে ওয়ানেই শুরু হয়েছিল। ক্লাস টু-তে পড়তে পড়তে মৌলভী নজিবর রহমানের আনোয়ারা পড়ে ফেলেছিলাম। আবদুল ফাত্তাহ কোরেশীর সালেহা বোধ হয় ক্লাস থ্রিতে পড়তে পড়তে আর মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু ক্লাস ফোরেই শেষ। এর মধ্যে অবশ্য দস্যু বাহরাম টাহরামও পড়া হয়ে গেছে। একদিন বছর পাঁচেকের বড় এক আত্মীয় বলে বসল, ‘তুমি তো দেখি বেশ দস্যু বাহরাম পড়ো, মাসুদ রানা পড়তে পারো না?’
‘মাসুদ রানা! সেটা আবার কী?’
আত্মীয় তার বুকশেলফ থেকে একটা বই বের করে দিল। ‘এটা পড়ো। বুঝতে একটু কষ্ট হবে। কিছু টেকনিক্যাল শব্দ আছে। তবে মজা পাবে।’
বইটার নাম ধ্বংস পাহাড়।
গল্পের বই পড়ার ব্যাপারে আমি তখন রীতিমতো ‘অমনিভরাস’, মানে সর্বভুক। যা পাই, তাই গিলি। ধ্বংস পাহাড় নিয়ে এলাম। ‘টেকনিক্যাল’ শব্দগুলো তেমন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারল না। দুদিনের মধ্যেই তামাম শোধ।
আরও পরে জানলাম, বিদ্যুৎ মিত্র মানে কাজী আনোয়ার হোসেন। একাধারে মাসুদ রানার লেখক এবং সেবা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী।
ধ্বংস পাহাড় পড়ার পর থেকে ছাত্রজীবনটা মাসুদ রানাময় হয়ে উঠল। ভারতনাট্যম, স্বর্ণমৃগ, অস্থির সীমান্ত, মূল্য এক কোটি টাকা মাত্র, বিস্মরণ, জাল, অটল সিংহাসন, অগ্নিপুরুষ, আই লাভ ইউ, ম্যান... কী রহস্যময় আর কাব্যিক এক একটা নাম। সোহানা, রূপা, গিলটি মিয়া, সোহেল... কী রকম মুগ্ধতাজাগানিয়া এক একটা চরিত্র। আর কবীর চৌধুরী? সে তো আছেই। আর ওই কাঁচাপাকা ভুরুর চুরুটটানা রাহাত খান। রানা-সোহেলদের অকুতোভয় বুকে কাঁপনধরানো আদরের বুড়ো। বড় হয়েও কৈশোরকালীন একটা কল্পনা আমার কাছে বাস্তব হয়ে ধরা দিতে চাইত। মনে হতো বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সি, মতিঝিলের ছয়তলা বিল্ডিং এসবই আছে। সিআইএ, মোসাদ আর কেজিবির মতো বিসিআইও একটা দুনিয়ার বুকে দাবড়ে বেড়ানো গোয়েন্দা সংস্থা আর মাসুদ রানা তার দুর্ধর্ষ একজন স্পাই।
মাসুদ রানাকে নিয়ে অনেক গল্প আছে আমার অসংখ্য রানাভক্তের মতো। কিন্তু একটা গল্প একদম বাস্তব। সেটা হলো মাসুদ রানা একবার আমাকে ঘোরতর বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের জীবনে একবার পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলাম। মাসুদ রানা এসে আমাকে বাঁচিয়েছিল তাদের হাত থেকে।
সে গল্পটা, মানে সত্যি ঘটনাটা বলি। এসএসসি পরীক্ষায় ফেলের ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই গিয়ে নৌকোয় চাকরি শুরু করেছি অনেকটা আবেগ আর অ্যাডভেঞ্চারের ঘোরে। কাপ্তাই লেকে দশহাতি দাঁড় টানি, নৌকোয় মাল ভরি। বড় কঠিন কাজ। প্রথম প্রথম কষ্ট হতো। কিন্তু পরে অভ্যস্ত হয়ে যাই।
নাইয়া, মানে নাবিকদের ঘরবাড়ি ওই নৌকাই। একটা কাপড়ের ব্যাগ, তাতে দুটি লুঙ্গি, একটা গামছা আর বড়জোর গোটা দুয়েক জামা। এই তাদের সম্পদ কিংবা সম্বল। ব্যাগ একটা আমারও থাকত। তাতে নিত্যব্যবহার্য ওসব জিনিসপত্র ছাড়াও থাকত বই। বেশির ভাগই মাসুদ রানা সিরিজের গোয়েন্দা কাহিনি। ওগুলো ছিল আমার অবসরের সঙ্গী। যখন নৌকায় কাজ থাকত না, ওগুলো পড়ে পড়ে সময় কাটাতাম।
৮০/৮১’র কথা। পার্বত্য চট্টগ্রামে তখন সেটলার যাওয়ার সময়। বেশির ভাগই ময়মনসিংহের মানুষ। অন্য জেলারও থাকত। সে রকম নারায়ণগঞ্জের এক ছেলের সঙ্গে দেখা হলো রাঙামাটিতে। এক দোকানে বসে চা খাচ্ছি, ছেলেটা এসে বলল, সে রাঙামাটিতে নতুন এসেছে। রাতে থাকার জায়গা নেই। আর সে কাজ খুঁজছে। সারা দিন কিছু খায়নি, উপোস করে আছে।
আমার নৌকা বনরূপার একটা ঘোনার ভেতর। ভাড়া নেই। বসে বসে দিন কাটাচ্ছি। মাঝি গেছে কাপ্তাই।
সারা দিন ছেলেটি কিছু খায়নি শুনে খারাপ লাগল। ওকে নিয়ে নৌকায় আসলাম। ভাত রেঁধে দুজনে খেলাম। বললাম, নৌকায় চাকরি করবে কি না। করলে আমাদের নৌকায় কাজ করতে পারবে। মাঝি কাপ্তাই থেকে ফিরলে ফাইনাল কথাবার্তা হবে। ছেলেটি খুব মাথাটাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল।
রাতে অনেক গল্পটল্প করে দুজনে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে জেগে দেখি, ছেলেটা নেই। একটু অবাক হলাম, তবে খুব বেশি মাথা ঘামালাম না। বরং স্বস্তি বোধ করলাম যখন দেখলাম, কিছু চুরিটুরি করে পালায়নি। অবশ্য সে রকম কিছু ছিলও না। টোল খাওয়া আধপুরোনো ভাতের হাঁড়িকুড়ি আর মাটির শানকি কেই-বা চুরি করতে যাবে? হাতের টাকা ফুরিয়ে এসেছে। মাঝি কখন আসে কে জানে?
পান্তাভাত খেতে খেতে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, আমিও কাপ্তাই যাব। নৌকা একা ফেলে গেলেও সমস্যা হবে না। পাশে একটা স মিল। মোটামুটি চেনাজানা। তাদের বলে যাব, যেন একটু খেয়াল রাখে।
রাঙামাটির রিজার্ভ বাজার ঘাট থেকে লঞ্চে উঠলাম। হাতে কাপড়চোপড় আর বইয়ের গাট্টিঅলা ব্যাগ। লঞ্চ ছেড়ে দিল। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সারা লঞ্চে একবার চক্কর লাগালাম। হঠাৎ দেখলাম, নৌকা থেকে পালিয়ে আসা ছেলেটাও আছে। চোখে চোখ পড়তে কাছে গিয়ে বললাম, ‘কী ব্যাপার? কিছু না বলে পালিয়ে এলে যে!’ অস্পষ্ট স্বরে কিছু একটা বলে সরে গেল ছেলেটা। আমি আর মাথা ঘামালাম না। এক জায়গায় বসে হ্রদের পানি আর পাহাড় টাহাড় দেখে সময় কাটাতে লাগলাম।
আধঘণ্টা পর। ছেলেটাকে দেখলাম আমার দিকে আসছে। জিজ্ঞাসু চোখ তুলে চাইতে বলল, ‘আপনারে ডাকছে।’
‘কে ডাকছে?’
ছেলেটা আঙুল তুলে যেদিকে দেখাল, সেদিকে কয়েকজন পুলিশের লোক। চোখে চোখ পড়তেই পুলিশদের একজন হাত ইশারায় ডাকল। কখনো কোনো পুলিশের সঙ্গে কথা বলিনি। তাই একটু সংকোচ আর ভয় বোধ হলো। পরে ভাবলাম, আমি তো কোনো দোষ করিনি। ভয় পাচ্ছি কেন?
পরের ঘটনাগুলো এভাবে। পুলিশগুলো বলল, ‘ছেলেটা বলছে ও রাতে তোমার নৌকায় ছিল। আর তুমি তার সাথে খারাপ কাজ করতে চেয়েছ। সত্য নাকি?’
অবাক হয়ে তাকালাম ছেলেটার দিকে। ‘তোমাকে রাতে নৌকায় থাকার জায়গা দিলাম, ভাত খাওয়ালাম। তুমি তার ফল এভাবে দিলে?’
ছেলেটা তেড়ে উঠল। ‘করেননি? আপনি আমার সাথে খারাপ কাজ করার চেষ্টা করেননি?’
লঞ্চে আরও অনেক যাত্রী। পুলিশদের মধ্যে একজন বলল, ‘থাক। কাপ্তাই গিয়ে দুজনেই আমাদের সাথে যাবে। ঘটনা কী হয়েছে, সেখানে শুনব। এখন দুজনের কেউই কোথাও যাবে না। আমাদের কাছে বসে থাকো।’
পুলিশ ক্যাম্প কাপ্তাইয়ের ভেতর বাজারে। ওখানে পৌঁছে আমাদের দুজনকে নিয়ে পড়ল পুলিশেরা। রীতিমতো জেরা শুরু করে দিল। রাতে কী ঘটেছে ছেলেটার সঙ্গে, জানার জন্য চাপাচাপি। পুলিশদের মধ্যে একজনকে বেশ গম্ভীর আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে হলো। তার উদ্দেশে বললাম, ‘কারও ভালো করতে গিয়ে যে এ রকম জঘন্য পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে, যদি বুঝতাম...’
এরপর চোস্ত বইয়ের ভাষায় একগাদা কথা বলে ফেললাম। একজন নৌকার নাইয়ার কাছে এমন তুখোড় শুদ্ধ ভাষা আশা করেনি পুলিশ। মুখ দেখে মনে হলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।
নেতা পুলিশটাকে এমনিতেই একটু ভাবুক টাইপের দেখাচ্ছিল। অন্য পুলিশগুলোর চেয়ে কথাও একটু কম বলছিল। আমার কথার তোড় শেষ হতেই সোজা হয়ে বসল। আমার ব্যাগের দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘দেখি, তোমার ব্যাগে কী আছে?’
‘কাপড়চোপড়।’
‘এদিক নিয়ে আসো দেখি।’
নিয়ে গেলাম। তারপর দেখালাম ভেতরে কী আছে। মাসুদ রানার বইগুলো দেখে চোখ বড় হয়ে উঠল তার। হাতে নিয়ে একটা একটা করে প্রতিটির নাম পড়ে ফেলল আগে। তারপর জানতে চাইল ওগুলো কেন রেখেছি। আমি কি এগুলো পড়তে পারি?
কাজী আনোয়ার হোসেন © সুদীপ্ত সালাম/ ঢাকা অপেরা
মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম। চিন্তিত দেখাচ্ছে রাজ্জাককে, মানে ওই পুলিশকে [পরে তার নাম জেনেছি। আমার সঙ্গে একটা বন্ধুর মতো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল]। বোঝাই যাচ্ছে বিভ্রান্তিতে পড়ে গেছে লোকটা। নৌকার নাইয়া মাসুদ রানা পড়ে! ব্যাপারটা হজম করতে পারছে না মনে হয়।
‘তুমি তো দেখছি পড়তে পারো। বেশ ভালোই পারো। কত দূর পড়েছ?’
‘এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম ফেল করব মনে করে।’
একটা কাগজ আর কলম দিল আমাকে। ‘দেখি, তোমার নাম লেখো।’
তিন সেকেন্ডে নিজের নাম লিখে দিলাম। মনের ভেতর একটা আতঙ্কের মতো ছিল। এবার সেটা কাটতে শুরু করেছে। এরা বোধ হয় বিশ্বাস করেনি ছেলেটার অভিযোগ।
খুব মন দিয়ে লেখাটা পরীক্ষা করল রাজ্জাক। হাসল। তারপর ছেলেটার দিকে ফিরে বলল, ‘এই ছেলে তোমার সাথে খারাপ কাজ করেছে?’
‘হ ভাইয়া।’
‘সত্যি বলছ?’
‘হ ভাইয়া। একদম সইত্য। খোদার কছম, রছুলের কছম...’
‘থাম ব্যাটা! কয়বার খারাপ কাজ করেছে?’
চুপ করে রইল ছেলেটা। জবাব দিচ্ছে না।
‘কই? বল, কয়বার খারাপ কাজ করেছে?’
‘দু-দুইবার...’ ঢোঁক গিলল ছেলেটা।
‘দুইবার! এই, বেতটা আন তো।’ একজনকে হুকুম দিল রাজ্জাক।
পুলিশের বেত এসে পড়ল। সামনের ছোট টেবিলের ওপর বেত দিয়ে একটা বাড়ি লাগাল রাজ্জাক। গর্জে উঠে বলল, ‘শালার ব্যাটা, তখন কইছিলি খারাপ করার চেষ্টা করছে আর এখন বলছস দুইবার... এদিকে আয়। আয় বলছি।’
‘স্যার স্যার... ভাইয়া...’ ছেলেটা দৌড়ে গিয়ে পা ধরতে গেল।
কিন্তু স্যার-ভাইয়া তাতে ভুলল না। বাঁকানো পিঠের ওপর সপাং করে ঝেড়ে দিল বেতটা।
‘ও ম্মাগো...’ বলে চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটা। আরও দু-তিন বাড়ি পড়তে লুটিয়ে পড়ল মেঝেয়।
‘বল। বল কী হয়েছিল? সত্যি কথা বললে মাইর কম খাবি।’
এরপর গড়গড় করে আসল কথা বলে দিল ছেলেটা। বলল, ‘ও আমাকে নৌকায় চাকরি করতে বলেছিল। কিন্তু আমার চাকরি করতে ভালো লাগে না, তাই সকালে ওকে কিছু না জানিয়ে চলে এসেছি। তারপর কাপ্তাইয়ের স্টিমারে ওকে দেখে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছিলাম। ভেবেছিলাম, পুলিশ বিচার করে ওর কাছ থেকে কিছু জরিমানা আদায় করে দেবে। আমার কাছে ভাত খাওয়ার টাকা নেই।’
ঘটনার শেষ এখানেই। রাজ্জাক ছেলেটাকে বের করে দিল হালকা-পাতলা শাসন করে। আর আমাকে বলল, আমি যেন মাঝে মাঝে ওর কাছে যাই। রাজ্জাক মাসুদ রানার ভক্ত। আমাকে মাসুদ রানা পড়তে দেখে অবাক হয়ে গেছে সে। নৌকার নাইয়ারা মাসুদ রানা পড়ে, এটা তার মাথায়ও আসেনি এর আগে।
কাজী আনোয়ার হোসেন মাসুদ রানার স্রষ্টা আর বিভিন্ন প্রজন্মের হাজার হাজার তরুণের স্বপ্নপুরুষ। আমার মতো এই তরুণেরাও হয়তো মতিঝিলে বিসিআইয়ের বাস্তব অফিস আছে বলে মনে করে এবং রাহাত খান সোহেল, সোহানা আর মাসুদ রানা বলে কিছু লোক সেখানে আছেই হয়তো।
১৯৯৭ সালে একদিন কাজীদার সামনে গিয়ে বসলাম কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে। আমার সামনে কাজী আনোয়ার হোসেন আর পেছনে দেয়ালে টাঙানো ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ক্লাস টেনে যার অসীমের সন্ধানে প্রবন্ধটি পাঠ্য ছিল। উত্তেজনা আর আবেগে কাঁপছিলাম রীতিমতো। কাজীদাকে খুব ভয়ে ভয়ে বলেও ফেলেছিলাম, ‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেনের সামনে বসে আছি। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমি কাজী মোতাহার হোসেনের বাড়িতে বসে আছি।’
২
স্বপ্নপুরুষ কাজী আনোয়ার হোসেন তাঁর মৃত্যুর পরেও অসংখ্য রানাভক্তের মনে স্বপ্ন হয়েই থাকবেন। আমার মনেও সে রকম তিনি। তবে কাপ্তাই হ্রদে কাপড়ের থলেয় করে মাসুদ রানার বই বয়ে বেড়ানো নৌকার নাইয়া সে ছেলেটা যে একদিন সে স্বপ্নের কাজী আনোয়ার হোসেনের সেগুনবাগিচার বহুতল ভবনের একটি কক্ষে তার সামনে গিয়ে বসবে, এটা একটু অতিকল্পনা হয়ে যায়। তবু সেটাই সত্যি।
১৯৯৭ সালে একদিন কাজীদার সামনে গিয়ে বসলাম কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে। আমার সামনে কাজী আনোয়ার হোসেন আর পেছনে দেয়ালে টাঙানো ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ক্লাস টেনে যার অসীমের সন্ধানে প্রবন্ধটি পাঠ্য ছিল। উত্তেজনা আর আবেগে কাঁপছিলাম রীতিমতো। কাজীদাকে খুব ভয়ে ভয়ে বলেও ফেলেছিলাম, ‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেনের সামনে বসে আছি। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমি কাজী মোতাহার হোসেনের বাড়িতে বসে আছি।’
ভেবেছিলাম, কাজী আনোয়ার হোসেন হয়তো আমার মতো না হলেও আমার আবেগে কিছুটা সাড়া দেবেন। কিন্তু ভাবনা সত্যি হলো না। কাজীদা শুধু একটু মৃদু হাসির ভাব করলেন। তারপর সরাসরি কাজের কথায় চলে গেলেন। বললেন, ‘আপনার বিশাল পাণ্ডুলিপি [সেবা থেকে আমার প্রথম ওয়েস্টার্ন উপন্যাস আশ্রয়] উল্টেপাল্টে দেখলাম। কিছু সংশোধন করে ছাপানো যাবে। আপনার বানান ভুল আছে। বানান নিয়ে আমরা মাস্টারি করতে চাই না। আপনি ঠিক করে দেবেন।’
আমার বানান ভুল খুব ক্বচিৎ। এটা নিয়ে একটু গর্বও আছে মনে মনে। কাজীদার কথায় হতাশ হয়ে গেলাম। বললাম, ‘বুঝতে পারছি না। বানান ভুল কোথায়?’
‘যেমন আপনি একবার ‘কি’ লিখেছেন, আরেকবার লিখেছেন ‘কী’?
আমি বললাম, ‘ওটা ভুল নয়, কাজীদা। ‘কি’ এবং ‘কী’ দুটো ভিন্ন ভাব প্রকাশক। যেমন, প্রশ্নের জবাব ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ দিয়ে দেয়া গেলে সেখানে ‘কি’ ব্যবহার হবে। আর জবাব ‘হ্যাঁ-না’ দিয়ে দেয়া না গেলে সেখানে ‘কী’ ব্যবহার হবে।’
কাজীদা কিছু বললেন না। তবে ভাব দেখে বোঝা গেল, আমার ব্যাখ্যা তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
এক কাপ কালো কফি দিয়ে আপ্যায়ন করলেন সেবা প্রকাশনীর মালিক কাজী আনোয়ার হোসেন। এটাই প্রথম সাক্ষাৎ কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতা এক হয় না। মাসুদ রানার লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনকে আমি প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেনের মাঝে খুঁজে পেলাম না। তবে সে জন্য প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেনকে দোষ দেওয়া যাবে না। আমি ছোটবেলা থেকে কাজীদাকে কখনো চোখে না দেখেও চিনি। এই চেনার মধ্যে রয়েছে আনন্দ, মুগ্ধতা আর রহস্যময়তা। মাসুদ রানায় মুগ্ধ হওয়ার মতো সব বৈশিষ্ট্য তার স্রষ্টার মাঝে থাকবে, এটা ভাবাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মাসুদ রানা একটা কল্পিত চরিত্র মাত্র, বাস্তবের মানুষ নয়। সে অবাস্তব মানুষের চরিত্রে সব ধরনের গুণগত বৈশিষ্ট্য আরোপ করা যায়। কিন্তু একজন বাস্তবের মানুষের কাছে কখনোই তা আশা করা যায় না।
কাজী আনোয়ার হোসেন © সুদীপ্ত সালাম/ ঢাকা অপেরা
কাজীদা যে কতটা কাজের মানুষ, সেটা আরও স্পষ্ট হলো পরের দেখায়। ১৯৯৮ সালে জ্বালা বের হয়েছে। প্রকাশের এক মাস পরে ঢাকায় গেলাম। দেখা করলাম তাঁর সাথে। পুরোনো টেবিল চেয়ার আর কী কী সব দিয়ে যেন সজ্জিত তাঁর অফিসরুম। এবারের মুখোমুখিতে কিছু পরামর্শ পেলাম। আশ্রয়ে ‘চন্দ্রালোকিত’, ‘প্রস্তরাকীর্ণ’...এমন ধরনের কিছু ব্যবহার করেছিলাম। উনি সেগুলো নিয়ে আপত্তি জানালেন। বললেন, ‘এসব শব্দের চল এখন আর নেই। ভাষা যত সহজ হবে, পাঠককে তত টানবে। পাঠক বই পড়তে গিয়ে ডিকশনারি খুলতে যাবে না।’
বললেন, এসব ঠিক করা না হলে ইন ফিউচার সেবা আর বই বের করবে না।
উপদেশগুলো চমৎকার লেগেছিল। খুব মন দিয়ে শুনছিলাম। কিন্তু শেষের কথাটা একদম ধাক্কার মতো লাগল। কাজীদা এত কড়া করে কথা বলতে পারলেন! পরমুহূর্তে এই বলে মনকে সান্ত্বনা দিলাম। বলতেই পারেন। ইনি তো লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন নন, প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেন। ইনি তাঁর ব্যবসা দেখবেন।
এটা বুঝেও কেন যে প্রচণ্ড অভিমান হলো! সেটাও বুঝতে পারি। পেলে, ম্যারাডোনা, মেসি, নেইমার, শেখ হাসিনা সবার পরিচিত। কিন্তু যাদের পরিচিত, তারা কি সবাই তাদের পরিচিত? কাজী আনোয়ার হোসেন আমার ছেলেবেলা থেকেই পরিচিত, কিন্তু আমি কি তার পরিচিত? এ অভিমানের পেছনে যে আবেগ, সেটা আমার ক্ষেত্রে নিখুঁত সত্যি হলেও, অনেক গভীর বা নিবিড় হলেও তাঁর কাছে এর কোনোই মূল্য নেই। কারণ, আমি তাঁর সব চিনি, তিনি আমার কিছুই চেনেন না। আমি তাঁর কাছে জনৈক ব্যক্তিমাত্র।
তবে কাজী আনোয়ার হোসেনের একটা চমৎকার পরিচয় পেলাম। ‘কি’ এবং ‘কী’ প্রসঙ্গে নিজ থেকে বললেন, “আপনার কথাই ঠিক। ‘কি’ এবং ‘কী’ এর অর্থ ভিন্ন। আমি বাংলা একাডেমিতে ফোন দিয়েছিলাম। তারা আপনার মতো করেই ব্যাখ্যা দিল।”
একথাটা আমার মন ভালো করে দিল। কেঠো প্রকাশক কাজীদার এই স্বীকারোক্তির মধ্যে তাঁর সারল্য এবং মহত্ত্বের পরিচয় পেলাম। কিন্তু কাজীদার মুখে ‘আপনি আপনি’ শুনতে অস্বস্তি লাগছিল। তিনি তো প্রায় আমার বাবার বয়সী। তুমি করে বললেই পারেন। বারদুয়েক বলেছিলামও। কিন্তু কাজীদা ‘আপনি’ বলা ছাড়েননি। তিনি ‘আপন’ হলেন না, ‘পর’ই থেকে গেলেন।
আমি মানুষটা একটু অন্য ধরনের। সহজে কাউকে পছন্দ করি না। আবার পছন্দ করলে নিঃস্বার্থভাবেই পছন্দ করি। আর যদি বুঝতে পারি, কেউ একজন আমাকে পাত্তা দিতে চাইছে না, তখন তার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই চলি।
যখন বুঝতে পারলাম কাজীদা আমাকে পছন্দ করেন না, তখন থেকেই তাঁর সাথে দেখা করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।
আসল কথা হলো, লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন আমার কাছে [আমার মতো আরও অনেকেরই] পরম প্রিয়, আত্মার কাছাকাছি মানুষ। ব্যক্তি কাজী আনোয়ার হোসেন তা কখনো নন।
কাজীদাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়ার জন্য ফেসবুকে অনেক পোস্ট দিয়েছি। কাজীদাকে সেসব পোস্টের কথা কখনো জানানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। কারণ, আমি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কিংবা প্রিয়ভাজন হওয়ার উদ্দেশ্যে ওসব পোস্ট দিইনি।
এরপর সেবা প্রকাশনীতে অনেকবার গিয়েছি। কিন্তু তাঁর সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ বোধ করিনি। আমার স্বপ্নের কাজীদাকে প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেনের মধ্যে দেখতে চাইনি বলেই হয়তো।
৩
কিন্তু কেমন ছিলেন প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেন? এককথায় বলতে গেলে বাস্তববাদী, হিসেবি, নিরাবেগ ও স্বার্থসচেতন। সেবা প্রকাশনী তার দীর্ঘ সময়ে যত লেখকের বই প্রকাশ করেছে, একটা নির্দিষ্ট হিসাব ধরে পাইপাই করে মিটিয়ে দিয়েছে তাদের পাওনা। রহস্য পত্রিকায় এমনও দেখেছি, রহস্য পত্রিকার লেখকদের নাম ঠিকানা ছেপে জানানো, তাদের লেখার বিল নিয়ে আসার জন্য। আমার একটিমাত্র লেখা ছাপা হয়েছিল। চট্টগ্রামে বসে আমি কাজীদার হাতে লেখা চিঠি পেয়েছি, লেখক সম্মানী পাঠানোর জন্য আমি যেন মানিঅর্ডার ঠিকানা পাঠাই। লেখক চাইবার আগেই প্রকাশকের নিজের উদ্যোগে টাকা পরিশোধের বিষয়টা বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্কৃতিতে এক বিরল ঘটনা। আর তার হোতা প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেন। সেবা প্রকাশনী তো আর এমনি এমনি গড়ে ওঠেনি। প্রকাশনীর প্রাণপুরুষ তাঁর সব শ্রম, মেধা আর সততাকে বিনিয়োগ করেছিলেন এর মধ্য দিয়ে। তাই সেগুনবাগিচার ‘সেবা’ আদতেই সেবা হয়ে উঠেছিল।
মৃত্যু অনিবার্য। কেউই বেঁচে থাকে না। কাজী আনোয়ার হোসেনও আর বেঁচে নেই। কিন্তু কাজীদা মারা যাবেন, ব্যাপারটা কখনোই মনে হতো না। সত্যি বলতে কি? এখনো মনে হয় না। তাঁর পরিবার-পরিজনের কাছে তিনি মৃত, কিন্তু আমাদের কাছে সে রকম মনে হবে না।
কারণ, রানা যেমন চিরতরুণ, তার স্রষ্টাও তো চিরঞ্জীব হবেন, তাই না? আর প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেন মানুষের স্মৃতিতে কয়দিনই-বা বেঁচে থাকবেন? কেনই-বা বেঁচে থাকবেন?