শ্রীরামপাঁচালির সাহিত্যিক ভাষা: লোক বাংলা ভাষার জয়
বাল্মীকি-রামায়ণের কাহিনির ওপর ভিত্তি করে কৃত্তিবাস ওঝা শ্রীরামপাঁচালি রচনা করেছিলেন, যাকে বাংলার মানুষ কৃত্তিবাসী রামায়ণ হিসেবে চিনেছে এবং শত শত বছর ধরে সমাদর করে আসছে। এই আখ্যানকাব্য ঠিক বাল্মীকি-রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ ছিল না—ভাষান্তরই ছিল। কৃত্তিবাস ওঝা পৌরাণিক রামকে বাঙালির আবহমান নৈতিক ও সামাজিক মানসের পরিপ্রেক্ষিতে নতুনভাবে তাঁর কাহিনিতে নির্মাণ করেছিলেন। যে কারণে আমরা দেখি, শ্রীরামপাঁচালিতে বাংলার বিভিন্ন পুরাণ ও লোকগাথার অনুষঙ্গের অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে। আহমদ শরীফ ধারণা করেছেন, শ্রীরামপাঁচালি রচিত হবার আগেই সংস্কৃত ভাষায় রচিত বাল্মীকি-রামায়ণের কাহিনি লোকগাথার অংশ হিসেবে বাংলার মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। তখন অবশ্য সেসব লোকগাথার কোনো পুঁথি রচিত হয়নি। এটিই আমাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয় যে জনশ্রুতিধারার রামচরিতবিষয়ক এসব কাহিনির সাথে মূল রামায়ণের পার্থক্যই ঘটে গিয়েছিল। কাজেই শ্রীরামপাঁচালিতে বাংলার লোকগাথার উপাদান ঢুকে পড়াটা বিচিত্র কিছু নয়। সংস্কৃত ভাষাতে লিখিত মূল রামায়ণের ভাষান্তর করতে গিয়ে কৃত্তিবাস ওঝা নিশ্চয় এ কারণেই তার রামায়ণ-কাহিনির বর্ণনাতে বাংলার লোকসাহিত্যের পাঁচালির ঢঙটিকেই ব্যবহার করেছিলেন। সেই সময়ের জনপ্রিয় অবহট্ট সাহিত্যিক ভাষাতে তিনি তাঁর আখ্যানকাব্যটি রচনা করেননি। কাব্যের ভাষা হিসেবে বরং তিনি ১৫ শতকের প্রায়োস্থিত আধুনিক বাংলা ভাষাই ব্যবহার করেছিলেন।
কৃত্তিবাস ওঝার জন্মকাল আমরা সঠিকভাবে জানি না বলে তাঁর সাহিত্যকর্মের রচনাকাল আমরা নির্দিষ্ট করতে পারিনি। সুখময় মুখোপাধ্যায়ের ধারণানুযায়ী যদি আমরা ভেবে নেই যে ১৪৪৩-এ জন্মেছিলেন কৃত্তিবাস ওঝা, তবে শ্রীরামপাঁচালির রচনাকাল গিয়ে ঠেকবে ১৫ শতকের মধ্যভাগের দিকে [সুখময় মুখোপাধ্যায়ের হিসাব অনুযায়ী ধরে নেওয়া যাক, আনুমানিক বাইশ বছর বয়সে কৃত্তিবাস ওঝা শ্রীরামপাঁচালি লিখতে শুরু করেছিলেন]। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র গবেষণা থেকে যদি আমরা ধরে নেই, ১৩৯৯ সালে কৃত্তিবাস ওঝা জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তবে বলতে হবে যে ১৫ শতকের প্রথমার্ধের কোনো এক সময়ে গৌড়েশ্বরের আনুকূল্যে এই তরুণ কবি শ্রীরামপাঁচালি রচনা করেছিলেন। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের জানাচ্ছেন, মোটামুটিভাবে ১৪৬০ থেকে ১৪৯০ সালের ভেতরে কৃত্তিবাস ওঝার জন্ম হয়েছিল। এ অনুমানের ওপরে ভিত্তি করলে বলতে হবে, ১৪৮২ থেকে ১৫১২ সালের ভেতরে কোনো এক সময়ে একুশ কি বাইশ বছরের কৃত্তিবাস ওঝা শ্রীরামপাঁচালি রচনা করেছিলেন। এদিকে সুকুমার সেন বলছেন, পনেরো শতকের প্রথম ভাগে কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর এই কাব্য রচনা করেছিলেন যে হিসাবটি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র গবেষণাফলের অনুরূপ।
শ্রীরামপাঁচালিতে কৃষ্ণলীলার লোকজ কোনো অনুষঙ্গ অনুসৃত হয়নি বলে অনুমান করে নেওয়া যেতেই পারে যে এ কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর কিছু আগেই রচিত হয়েছিল। এবাদে আমরা লক্ষ করি, শ্রীরামপাঁচালির কাহিনি ও জীবনাদর্শনে চৈতন্যদেব প্রবর্তিত বৈষ্ণব মতবাদ ও কৃষ্ণভক্তির জনপ্রিয় ভাব একবারেই অনুপস্থিত। চৈতন্য-পরবর্তী যুগে শ্রীরামপাঁচালি রচিত হলে, তখনকার বাংলাদেশে বৈষ্ণব মতবাদের তুমুল জনপ্রিয়তার আলোকে, শ্রীরামপাঁচালিতেও বৈষ্ণব ধর্মের অনুষঙ্গগুলো প্রযুক্ত হতে পারত, যেটি কিনা আদৌ ঘটেনি। এ যুক্তিতে বলা যেতেই পারে, ১৪৮৬ সালে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগেই কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর এই কাব্য রচনা করেছিলেন। এমন একটি যুক্তিতেই শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, শ্রীরামপাঁচালির ভাষা দেখে মনে হয় না যে, এ ভাষা খুব একটা প্রাচীন ঘরানার ভাষা; বরং এ ভাষার সাথে শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের অব্যবহিত পূর্বকালে প্রচলিত বাংলা ভাষারই মিল রয়েছে। যাহোক, আহমদ শরীফের সুরের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা অন্ততপক্ষে এটুকু বলতে পারি, কৃত্তিবাস যে পনেরো শতকের কবি ছিলেন, সে বিষয়ে বড় কোনো সংশয় নেই। এবার দ্বিমত যেটি রয়ে গেল সেটি হলো, পনেরো শতকের ঠিক কোন ভাগটিতে শ্রীরামপাঁচালি লিখিত হয়েছিল, তা আর আমরা পরিষ্কার করে বলতে পারছি না।
ভারতবর্ষের লোকজ আখ্যানগীতিকার একটি ঢঙ হলো পাঁচালি। পঞ্চালি বা পঞ্চালিকার বা পাঁচালির গীতগুলো অক্ষরবৃত্তে রচিত হয়ে থাকে। পাঁচালি-পরিবেশনায় সাধারণত পাঁচটি অঙ্গের অন্তর্ভুক্তি আমরা লক্ষ করি—গীত, যন্ত্রের অনুষঙ্গ, ছড়া, গায়েনদের লড়াই এবং নাচ। গীত-পরিবেশনার সময় গায়েনরা ঝুমুর পায়ে দিয়ে, হাতে মন্দিরা বাজাতে বাজাতে নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। গায়েনদের নৃত্যের জায়গাতে একদা পুতুলনাচের রেওয়াজ ছিল। বাংলামুলুকেও এই পাঁচালির ঢঙে বিভিন্ন পরিবেশনা জনপ্রিয় হয়েছিল তখন।
পুরো পনেরো শতকজুড়ে বাংলা ভাষার চেহারাটি কেমন ছিল? বাংলা ভাষার ইতিহাস থেকে ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি, নব্যভারতীয় আর্য ভাষার পূর্বীশাখার তিনটি বঙ্গীয় উপভাষা—অসমীয়া, উড়িয়া এবং গৌড়ীয় বাংলা ভাষার আদল তখন থিতু হতে যাচ্ছে। মধ্যভারতীয় আর্য ভাষার মিলিত অর্বাচীন অপভ্রংশ বা অবহট্ট ভাষা থেকে বিবর্তিত হতে হতে বঙ্গীয় উপশাখার আধুনিক উড়িয়া ভাষা ১৩ শতকের দিকে নিজ বৈশিষ্ট্যে পৃথক হয়ে গেছে এবং তখন আধুনিক অসমীয়া এবং বাংলা ভাষার পৃথক পৃথক চেহারা নির্দিষ্ট হয়ে উঠছে আরও। পরে আমরা দেখব, ১৬ শতকে পরস্পর থেকে বিছিন্ন হয়ে গেছে আধুনিক অসমীয়া এবং বাংলা ভাষা। অর্থাৎ ১৫ শতকে আধুনিক বাংলা ভাষা স্থিতপর্যায়ের ভাষায় রূপ পরিগ্রহ করেনি। তাই এ পর্যায়ের বাংলা ভাষাকে আমরা ‘প্রায়োস্থিত বাংলা ভাষা’ বলতে পারি। আমরা এ-ও জানি, ১৫ শতকে নব্যভারতীয় আর্য ভাষার এই আধুনিক তিনটি ভাষার বিবর্তন-প্রক্রিয়ার পাশাপাশি ক্রিয়াশীল ছিল বঙ্গীয় উপশাখার আধুনিক ভাষাগুলো গড়ে ওঠার অব্যবহিত পূর্বের অর্বাচীন অপভ্রংশ বা অবহট্ট ভাষার ধারা। মধ্যভারতীয় আর্য ভাষার অপভ্রংশনির্ভর ভগ্ন-ভাষার ধারা থেকে অর্বাচীন অপভ্রংশ বা অবহট্ট ভাষার বিবর্তন সূচিত হয়েছিল ১২ শতকের দিকে এবং তা চলেছিল আনুমানিক ১৪ শতক অবধি। অবহট্টের এই মিলিত ধারাতে ভারতবর্ষের উত্তরাপথের পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত সুবিশাল ভৌগোলিক এলাকাতে সাহিত্য রচিত হবার নিদর্শনও আমরা পেয়েছি। পনেরো শতকের যে সময়টির কথা আমরা বলছি, তখনো এই বাংলাদেশের সাহিত্যে প্রাকৃত-অপভ্রংশ-অবহট্ট ধারায় সাহিত্য রচনার চর্চা চলমান ছিলই বলে প্রতীয়মান হয়। এবাদে তখন উত্তরাপথের পশ্চিম থেকে পুবের এলাকাগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই গণমানুষের পৃথক পৃথক মুখের ভাষার অনুসরণে রচিত হচ্ছিল, যার যার ভাষার লোকসাহিত্য। মানুষের মুখে মুখে সৃষ্ট হয়ে, মানুষের মুখে মুখেই জনশ্রুতিধারার লোকসাহিত্য তখন গতিময় হয়েছে এই বিস্তীর্ণ অংশে। আমরা দেখেছি, এই সময়টিতে বাংলা নামের ভৌগোলিক অঞ্চলেও ক্রিয়াশীল রয়েছে ছড়া, লোকগীতি, গীতিকা, উপকথা, পাঁচালি ইত্যাদি লোকসাহিত্য-নির্ভর কাঠামো। ধারণা করা যেতে পারে, অবহট্টধারার সাহিত্যিক ভাষার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ক্রমপরিবর্তনগামী বাংলা ভাষার লোকজ অংশের ওপরে নির্ভর করে তখন গড়ে উঠছিল নতুন একটি সাহিত্যিক ভাষা। প্রায়োস্থিত বাংলা ভাষার লোকজ অংশের এই কাঠামো ও মানুষের মুখের স্বাভাবিক ভাষাতেই শ্রীরামপাঁচালি লিখেছিলেন কৃত্তিবাস ওঝা। পয়ার ছন্দে অন্ত্যমিলের বৈশিষ্ট্যের সেই কাঠামোতে তাই আমরা ভাষার কোনো আড়ম্বর প্রত্যক্ষ করি না।
ভারতবর্ষের লোকজ আখ্যানগীতিকার একটি ঢঙ হলো পাঁচালি। পঞ্চালি বা পঞ্চালিকার বা পাঁচালির গীতগুলো অক্ষরবৃত্তে রচিত হয়ে থাকে। পাঁচালি-পরিবেশনায় সাধারণত পাঁচটি অঙ্গের অন্তর্ভুক্তি আমরা লক্ষ করি—গীত, যন্ত্রের অনুষঙ্গ, ছড়া, গায়েনদের লড়াই এবং নাচ। গীত-পরিবেশনার সময় গায়েনরা ঝুমুর পায়ে দিয়ে, হাতে মন্দিরা বাজাতে বাজাতে নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। গায়েনদের নৃত্যের জায়গাতে একদা পুতুলনাচের রেওয়াজ ছিল। বাংলামুলুকেও এই পাঁচালির ঢঙে বিভিন্ন পরিবেশনা জনপ্রিয় হয়েছিল তখন। তাই আমরা দেখি, বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে পাঁচালির এই আখ্যানগীতিকার ঢঙে বাংলার গণমানুষ পরস্পরের মাঝে রামায়ণ, মহাভারত, মনসার গীত, চণ্ডীর গীত ইত্যাদি পরিবেশন করেছে। পাঁচালির এই ঐতিহ্যবাহী ধারাতেই শ্রীরামপাঁচালির পরিবেশনা স্থির করেছিলেন কৃত্তিবাস ওঝা। পাঁচালির ঢঙে রামায়ণকথার পরিবেশনা তাঁর যৌক্তিক পছন্দ ছিল বলেই আমরা মনে করি। নিশ্চয় বাংলার গণমানুষের মনের খুব কাছে পৌঁছাতে চিয়েছিলেন তিনি। সংস্কৃত ভাষার সুপণ্ডিত হয়েও কৃত্তিবাস ওঝা হয়তো এ কারণেই তৎকালীন সাধু ভাষা অর্থাৎ অবহট্ট ভাষায় তাঁর কাব্য রচনার প্রয়াস পাননি। বাল্মীকিপ্রণীত রামায়ণের ভাষান্তরের সময় হয়তো তিনি সহজ, সাবলীল এবং অলঙ্কারবর্জিত একটি ঢঙই ধরতে চেয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি প্রযুক্ত করেছিলেন সমকালীন লোকজ বাংলা ভাষা। এভাবেই বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে প্রায়োস্থিত আধুনিক বাংলা ভাষা প্রয়োগের পয়লা নিদর্শন আমরা পেয়ে যাই শ্রীরামপাঁচালিতে।
শ্রীরামপাঁচালিতে কৃত্তিবাস ওঝা যে লৌকিক বাংলা ভাষা ব্যবহার করেছিলেন, তার স্থানিক রূপ নিয়ে এবার আমরা কিছু সূত্র উল্লেখ করতে চাই। আমরা জানি, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ফুলিয়া নামের গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কৃত্তিবাস ওঝা। শ্রীরামপাঁচালির ভণিতাতে আমরা তার যে আত্মজীবনীর সন্ধান পাই, তা থেকে দেখা যায়, তার পূর্বপুরুষ পূর্ববঙ্গ থেকে অভিবাসন ঘটিয়ে আবাস গেড়েছিলেন গঙ্গাতীরের এই ফুলিয়াগ্রামে। তার বয়স যখন বারো, তখন তিনি উত্তরবঙ্গের পদ্মাপারের কোথাও বিভিন্ন শ্রাস্ত অধ্যয়ন করতে যান। অধ্যয়ন শেষ হলে তিনি বাংলার তৎকালীন রাজধানী গৌড়ে গিয়ে কাব্যরচনায় প্রবৃত্ত হন। কাজেই আমরা দেখছি, শ্রীরামপাঁচালির ভাষাতে রাঢ়ের উপভাষার প্রভাব রয়েছে। এই লৌকিক ভাষাতে তৎকালীন নদীয়া, হুগলি, বর্ধমান, এমনকি মুর্শিদাবাদের গণমানুষেরা কথা বলেছে। অবশ্য ভাষাতাত্ত্বিকদের মতানুসারে এ-ও বলতে হবে, তখন আসলে রাঢ়-বরেন্দ্রের উপভাষাগুলোর চেহারার মাঝে খুব একটা ফারাক ছিল না।
কৃত্তিবাস ওঝা বিরচিত এক ভণিতাটুকু ছাড়া বর্তমানে শ্রীরামপাঁচালির মূল রচনার আর কিছুই অবিকৃত অবস্থাতে নেই। এই ভণিতা দীনেশচন্দ্র সেন ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত তাঁর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য নামের বইতে সংযোজন করেছিলেন। এর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে কৃত্তিবাস ওঝার যে আত্মজীবনী সংগৃহীত হয়েছিল, তা ১৩৪৯ বঙ্গাব্দে ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন নলিনীকান্ত ভট্টশালী। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য নামের বইতে শ্রীরামপাঁচালির মূল রচনার যে ভণিতাংশ সংযোজন করেছিলেন...
আহমদ শরীফ, সুকুমার সেন, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বলছেন যে, শ্রীরামপাঁচালির মূল রচনার ভাষার স্বরূপ অন্বেষণের কাজটি খুবই দুরূহ। এর তিনটি কারণ আমরা চিহ্নিত করতে পারি। প্রথমত, কৃত্তিবাস ওঝার শ্রীরামপাঁচালির আদি পুঁথির কোনো খোঁজ আমরা পাইনি। তিন শ বছরের মতো সময়জুড়ে তা ফিরেছে কথকদের মুখে-মুখে, গায়েনদের পাঁচালিগীতের পরিবেশনায়। কাজেই অনুমান করে নেওয়া যায়, শ্রীরামপাঁচালির জনশ্রুতিতে দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রক্ষেপণ ও বিয়োজন ঘটে গেছে। আমরা জানি, ১৮০২ সালে উইলিয়াম কেরির প্রচেষ্টায় শ্রীরামপুর মিশনের প্রেস থেকে শ্রীরামপাঁচালির প্রথম সংস্করণটি সংকলিত, মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছিল। শ্রীরামপাঁচালির পুঁথি প্রথমবারের মতো মুদ্রিত হবার আগেই শত শত বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে ঘুরতে নিশ্চয় এই কাব্যের ভাষা আদি মৌখিক রূপ থেকে পরিবর্তিত হয়ে দূরেই চলে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, ১৮৩০-৩৪ সালে যখন শ্রীরামপুর মিশনের প্রেস থেকে শ্রীরামপাঁচালির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় তখন সেই সংস্করণের দায়িত্বে ছিলেন ফোর্ট উইলিয়ামের সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। আমরা দেখছি, অধ্যাপক জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনাকালে শ্রীরামপাঁচালির প্রথম সংস্করণের ভাষা আধুনিক বাংলা ভাষায় রূপ পরিগ্রহ করেছে। তৃতীয়ত, শ্রীরামপাঁচালি নামে বটতলার যেসব হাজার হাজার সংস্করণ শত বৎসর ধরে বাজারে রাজত্ব করছে, সেসব পুঁথির ভাষা আমাদের কাছে আরও আধুনিক বলেই মনে হয়। এসব কারণেই বর্তমানে প্রচলিত কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এর বিভিন্ন টেক্সটে মূল রামায়ণ রচনার তেমন কোনো অংশই আর রক্ষিত হয়নি বলে আহমদ শরীফ সংশয় প্রকাশ করেছেন।
অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, কৃত্তিবাস ওঝা বিরচিত এক ভণিতাটুকু ছাড়া বর্তমানে শ্রীরামপাঁচালির মূল রচনার আর কিছুই অবিকৃত অবস্থাতে নেই। এই ভণিতা দীনেশচন্দ্র সেন ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত তাঁর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য নামের বইতে সংযোজন করেছিলেন। এর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে কৃত্তিবাস ওঝার যে আত্মজীবনী সংগৃহীত হয়েছিল, তা ১৩৪৯ বঙ্গাব্দে ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন নলিনীকান্ত ভট্টশালী। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য নামের বইতে শ্রীরামপাঁচালির মূল রচনার যে ভণিতাংশ সংযোজন করেছিলেন, তার কটি ছত্র নিচে উদ্ধৃত হলো:
আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী র্পূর্ণ মাঘমাস।
তথিমধ্যে জন্ম লইলেন কৃত্তিবাস॥
শুভক্ষণে গর্ভ হৈতে পড়িনু ভূতলে।
উত্তম বস্ত্র দিয়া পিতা আমা লৈল কোলে॥
দক্ষিণ যাইতে পিতামহের উল্লাস।
কৃত্তিবাস বলি নাম করিলা প্রকাশ॥
এগার নিবড়ে যখন বারতে প্রবেশ।
হেনকালে পড়িতে গেলাম উত্তর দেশ॥
বৃহস্পতিবারের উষা পোহালে শুক্রবার।
পাঠের নিমিত্ত গেলাম বড়গঙ্গাপার॥
তথায় করিলাম আমি বিদ্যার উদ্ধার।
যথা যথা যাই তথা বিদ্যার বিচার॥
সরস্বতী অধিষ্ঠান আমার শরীরে।
নানা ছন্দে নানা ভাষা আপনা হৈতে স্ফুরে॥
বিদ্যা সাঙ্গ করিতে প্রথমে হৈল মন।
গুরুকে দক্ষিণা দিয়া ঘরকে গমন॥
ব্যাস বশিষ্ঠ যেন বাল্মীকি চ্যবন।
হেন গুরুর ঠাঙি আমার বিদ্যা সমাপন॥
ব্রহ্মার সদৃশ গুরু বড় উষ্মাকার।
হেন গুরুর ঠাঙি আমার বিদ্যার উদ্ধার॥
গুরু স্থানে মেলানি লইলাম মঙ্গলবার দিবসে।
গুরু প্রশংসিলা মোরে অশেষ বিশেষে॥
রাজপণ্ডিত হব মনে আশা করে।
পঞ্চ শ্লোক ভেটিলাম রাজা গৌড়েশ্বরে॥
[সূত্র: সেন, দীনেশচন্দ্র (১৮৯৬)]
পরীক্ষা করে দেখা যায়, উদ্ধৃত ভণিতাংশের ভাষা খুবই সহজ-সরল যেখানে কাব্যের অলংকার প্রায়-অনুপস্থিত। অক্ষরবৃত্তে ১৪ মাত্রায় অর্থাৎ পয়ার ছন্দে কবি এখানে সাজিয়ে গেছেন একের পরে এক পঙ্ক্তি। আলোচ্য ভণিতাটিতে আমরা তৎসম শব্দের কোনো প্রাচুর্য খুঁজে পাই না, যা কিনা আমরা লক্ষ করেছিলাম শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর পদগুলোতে। এবাদে বাক্যস্থিত পদগুলোর চেহারা এবং প্রকৃতি-প্রত্যয়বিচারে আমরা বুঝতে পারি, এই কাব্যের সাহিত্যিক ভাষাতে প্রাচীন অপভ্রংশজাত অবহট্ট ভাষার কোনো ছাপই নেই। বরং শ্রীরামপাঁচালির ভাষা প্রমাণ করে, পনেরো শতকের সেই সময়টিতে বিবর্তনের ধাপে ধাপে আধুনিক বাংলা ভাষা প্রায় থিতু হতে চলেছে। আমরা মনে করি, বাংলা ভাষার বিবর্তনের মাপকাঠিতে আধুনিকত্বের এই ছাপই বিশিষ্ট করে তুলেছে কৃত্তিবাস ওঝার সাহিত্যকর্মকে।
উপসংহারে আমরা বলতে চাই, শ্রীরামপাঁচালির মূল রচনার ভাষা প্রায়োস্থিত আধুনিক বাংলা ভাষার লোকজ অনুষঙ্গের ওপরে আশ্রয় করেই রচিত হয়েছিল, গড়ে উঠেছিল সম্পূর্ণ নতুন এক সাধু ভাষা। পনেরো শতকেই রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এবং বৈষ্ণব পদাবলীতেও শ্রীরামপাঁচালির মতো আধুনিক বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয়নি। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে বাংলামুলুকে যে মঙ্গলকাব্য, বিদ্যাসুন্দরের কাহিনি, প্রণয়োপাখ্যান [যেমন, মুহম্মদ কবীরের মনোহর-মধুমালতী উপাখ্যান], সত্যনারায়ণ ও সত্যপীরের গাথা এবং দোভাষী পুঁথিসাহিত্যের চর্চা হয়েছিল সেখানে আমরা ফের এই সহজ, সরল লোকজ ভাষায় পাঁচালিছন্দে আখ্যানকাব্য নির্মাণের প্রবণতা দেখতে পাই। এমনকি ১৯শ শতকে এসে আমরা দেখতে পাই, কবি দাশরথি রায় পাঁচালির ঢঙেই গীত বেঁধেছিলেন যা ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে। গ্রামবাংলায় গীত-পরিবেশনায় এখন আমরা তার ছাপ লক্ষ করি তুমুলভাবেই।
গ্রন্থপঞ্জি
• বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীকুমার [১৯৬৭]: বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা, প্রথম খণ্ড, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, কলিকাতা, জুলাই ১৯৬৭।
• মুখোপাধ্যায়, সুখময় [১৯৬০]: মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের তথ্য ও কালক্রম, জি. ভরদ্বাজ অ্যান্ড কোং, কলিকাতা, ১৯৬০।
• শরীফ, আহমদ [২০১৬]: বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, জুন ২০১৬।
• শহীদুল্লাহ্, মুহম্মদ [২০১৪]: বাংলা সাহিত্যের কথা, দ্বিতীয় খণ্ড, মাওলা ব্রাদার্স, সেপ্টেম্বর ২০১৪।
• সেন, দীনেশচন্দ্র [১৮৯৬]: বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, প্রথম ভাগ, ভারতবর্ষ প্রিন্টিং ওয়ার্কস কলিকাতা, ১৮৯৬।
• সেন, সুকুমার [১৯৪০]: বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, মডার্ন বুক এজেন্সী, কলিকাতা, ১৯৪০।