বাংলা কবিতার নতুন রাজধানীর প্রতিষ্ঠাতা শামসুর রাহমান

 

বাংলাদেশের কবিতার আলোচনায় শামসুর রাহমান [১৯২৯-২০০৬] একদিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে কীর্তিত হন, তেমনি অতিমূল্যায়িত [Over rated] বলেও আখ্যায়িত হন। গুরুত্বপূর্ণ না হয় বোঝা গেল। কিন্তু অতিমূল্যায়িত কথাটা কী ও কেন, তা বোঝা দরকার। রাহমানকে অতিমূল্যায়িত মনে করা গোত্রের কবি-সাহিত্যিক-সমালোচকদের বিবেচনায় থাকে তাঁর রাজনৈতিক কবিতাবলি। এই দৃষ্টিভঙ্গির লোকেরা মনে করেন, জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে রাহমান বিভিন্ন সময়ে কবিতা লিখেছেন এবং জাতীয় গুরুত্ব অর্জন করেছেন। ওই রাজনৈতিক কবিতাগুলো যতটা না কবিতা  তার চেয়ে বেশি রাজনীতি, স্লোগান, মহান ঘটনা। এগুলো একধরনের উদ্দেশ্যমূলক আইটেম কবিতা। জাতীয় ইতিহাসের ওই সব ঘটনা বাঙালির কাছে স্বভাবতই মহান ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইতিহাসের এই মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব গিয়ে আছড়ে পড়েছে রাহমানের কবিতাগুলোর ওপর এবং অব্যর্থভাবে কবিকে মহান করেছে; রাহমানকে জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। এই বিষয়টা খতিয়ে দেখার সূত্রে বাংলা ও বাংলাদেশের কবিতার নাতিদীর্ঘ প্রেক্ষাপটে শামসুর রাহমানের বিশেষত্ব বোঝার চেষ্টা করব এই লেখায়। এ ক্ষেত্রে রাহমানের কবিতার ভাষার দিকটিই আমাদের মুখ্য মনোযোগ পাবে।

এক

শামসুর রাহমান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অনেক লাগসই কবিতা লিখেছেন। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী [১৯৫৩] সংকলনে একুশের কবিতা থেকে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ [১৯৬১] পর্যন্ত বাঙালির প্রতিটি জাতীয়তাবাদী আলোড়নে রাহমান সাড়া দিয়েছেন দ্বিধাহীনভাবে। তাঁর নিজবাসভূমে [১৯৬৯] কাব্যগ্রন্থের একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্রে রেখে রচনা করেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থ বন্দী শিবির থেকে [১৯৭২]। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর লিখেছেন বেশ কিছু পুরাণাশ্রিত কবিতা। নব্বইয়ের স্বৈরশাসনামলে ও গণ-অভ্যুত্থানে লিখলেন বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় [১৯৮৮] কাব্যগ্রন্থসহ অনেক বিচ্ছিন্ন কবিতা। এই সব কারণে বলা যায়, বাংলাদেশের ইতিহাসের হাত ধরে রাহমানের কবিতা পথ চলেছে। কিন্তু এটাই কি রাহমানের কবিত্ব ও কবিতার প্রধান পরিচয়! এটাই কি তাঁর শামসুর রাহমানকে মূল্যায়নের প্রধান মাপকাঠি! রাহমান কি এতেই ফুরিয়ে যান!

একথা কবুল করতেই হবে যে, বাংলাদেশে কাব্য-কবিতা বিবেচনার ক্ষেত্রে কবিতায় ধারণ করা জাতীয়তাবাদী চেতনা আর জাতীয় ইতিহাসের রাজনৈতিক বিষয়ের খোঁজখবরই বেশি করা হয়। এই সবের উপস্থিতিই বাংলাদেশের কবিতার ও কবির বড়ত্বের একটা বড় নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে! সন্দেহ নেই, বিষয়টা বহু ব্যবহারে ক্লিশে এবং প্রায় একমুখী। কবিতা ও কবি বিবেচনার আরও হাজারটা ব্যাপার ও পথ আছে। বিশ্ব-কবিতার ইতিহাস তো কেবল প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক বিষয় বা খালি গুরুতর জাতীয় ইতিহাসের ব্যাপার-স্যাপার না। তা তো আসলে এক অর্থে ভাষা আর উপস্থাপনের বিশেষত্বের ইতিহাস; শিল্পীয়ানার ইতিহাসও বটে। বাংলাদেশের কবিতা বিবেচনার ক্ষেত্রে সে-সবে আমরা কমই নজর দিতে পেরেছি। এমনকি ওই জাতীয়তাবাদী চেতনা আর রাজনৈতিকতার খোঁজখবরও খুব যে গভীর ও বিস্তৃতভাবে করতে পেরেছি, তা-ও মনে হয় না। আমাদের আলোচনা-সমালোচনায় উচ্চগ্রামের রাজনৈতিক ঘটনা ও স্বদেশ বন্দনার কবিতাগুলোই কেবল শনাক্ত হয়েছে; বাহবা পেয়েছে। এমনকি ভাষায় আর বিষয়ে আপাত-মুখচোরা, নিম্নকণ্ঠ হাজারো কাব্য-কবিতার এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী পাঠ দিতে আমরা পারিনি। জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয় ইতিহাস তো কেবল রাজনৈতিক ঘটনাধারা দিয়ে তৈরি হয় না। এর একশ রকমের গঠনগত উপাদান থাকে। এমনকি একজন কবির প্রেমবিষয়ক একটি কবিতার ভাষা থেকে শুরু করে চিত্রকল্প, উপমা, স্বরপ্রক্ষেপণ-ভঙ্গি পর্যন্ত রাজনৈতিকতাকে ধারণ করতে পারে [যেমন, নির্মলেন্দু গুণের বা আরও কারও কারও ষাটের দশকে রচিত অনেক কবিতা]। এই আপাত অরাজনৈতিক রাজনৈতিকতাকে আবিষ্কারের দুঃসাধ্য বিশ্লেষণের পথেও আমরা খুব বেশি পা বাড়াইনি বলেই মনে হয়। শামসুর রাহমানের কবিতার মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয়। তাঁর উচ্চস্বরের প্রধানত রাজনৈতিক কবিতাগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে বলা হয় যে, তিনি রাজনৈতিক ঘটনাশ্রিত কবিতার আশীর্বাদপুষ্ট কবি। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে, সংখ্যায় এই ধারার কবিতা এত কম যে, একদমে গুনে ফেলা যাবে। সে ক্ষেত্রে শামসুর রাহমানের বিপুল অধিকাংশ কবিতার ব্যাপারে কী বলা যাবে! রাহমান তো শুধু ওই সব কবিতার মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যান না। শহীদ কাদরী তাঁর এক লেখায় এ সম্পর্কে যে-কথা বলেন, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, অনেকেই এখন শামসুর রাহমানের সমসাময়িকতার কথা বলেছেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা এবং পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততাকে সবিশেষ উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু তাঁর সংবেদনশীল মন আরো বহুবিচিত্র বিষয়কে স্পর্শ করেছে। আমার মনে হয় তিনি যদি রাজনীতি সচেতন নাও হতেন, শুধু তাঁর প্রেমের কবিতাগুলোর জন্যেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েছি এমন অনেক কবিতা, যা কিনা আধুনিকতা থেকে উৎসারিত একটি প্রধান স্রোত। [শহীদ কাদরী ২০০৬ : ৬৮] আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, রাজনৈতিক কবিতার কারণে অতিমূল্যায়িত আখ্যা দেওয়া বা রাজনৈতিক কবিতাকেই সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে রাহমানকে বিবেচনা করা বা এমনকি শুধু প্রেমের কবিতায় রাহমানের শ্রেষ্ঠত্ব বিবেচনা করতে যাওয়া এসবই তাঁর খণ্ডিত মূল্যায়ন। বাংলাদেশের কবিতায় শুধু নয়, বাংলা কবিতায় রাহমান তাঁর সামগ্রিক অবদানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কী সেই অবদান, তা বোঝা দরকার।

দুই

বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে শামসুর রাহমান দ্বিতীয় প্রজন্মের কবি। তাঁর আগের প্রজন্মের কবিদের অধিকাংশের বিকাশের সাথে কলকাতার কবিতার ইতিহাসের কোনো না কোনো শ্লিষ্টতা ছিল। এই তালিকায় থাকবেন শাহাদাৎ হোসেন [১৮৯৩-১৯৫৩], গোলাম মোস্তফা [১৮৯৭-১৯৬৪] থেকে শুরু করে আবদুল কাদির [১৯০৬-১৯৮৪], সুফিয়া কামাল [১৯১১-১৯৯৯], আহসান হাবীব [১৯১৭-১৯৮৫], ফররুখ আহমদ [১৯১৮-১৯৭৪], সৈয়দ আলী আহসান [১৯২২-২০০২] প্রমুখ। এঁদের অধিকাংশকেই অন্তত প্রাথমিকভাবে কবিতার পরীক্ষা দিতে হয়েছে তৎকালীন বাংলা কবিতার রাজধানী কলকাতায়। সেই পরীক্ষায় বাঙালি মুসলমানের কাব্য-কবিতার প্রচেষ্টা পশ্চাৎপদ বলেই চিহ্নিত হোত। এইসব কবির একটা বড় অংশ নিখিল বাংলা কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতায় স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ের পরিচয়ে চিহ্নিত ঊন-কবিতার কবি বলেই চিহ্নিত হতেন। এ কারণে, এঁদের অধিকাংশের কবিতা প্রকাশিত হতো মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত পত্রিকায়। অনেকটা ভাই ভাই এই তো চাই এর মতো ব্যাপার। তখনকার পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানের কবিতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, এই কবিদের ব্যতিক্রম বাদে একটা বড় অংশই ভাষায় ও ভাবে নিজ সম্প্রদায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট থেকে বৃহত্তর কবিতার ইতিহাসে পল্লবগ্রাহীতার দলে পড়বেন। কেউ কেউ সমসাময়িক কবিতার অগ্রগতির সাথে নিজেকে কিছুটা শামিল করে নিলেও বাংলা কবিতার দীর্ঘ ইতিহাসে খুব একটা জায়গা করে নিতে পারেননি। যদিও নিজ সম্প্রদায়ে তাঁরা প্রত্যেকেই বড় কবি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। এই সব কবি যখন কলকাতায় নিজেদের শিল্পসাহিত্য নিয়ে জাতে ওঠার একটা প্রাণান্তকর সংগ্রাম করছেন, কবি হিসেবে মূলধারায় ফেরার সংগ্রাম যখন করছেন এবং কেউ কেউ কিছুটা আমলেও আসছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান আন্দোলনের হলকা, জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মাদনা কবিদের প্রায় অধিকাংশের কবিতার মধ্যে হানা দেয়। এই সব জাতীয়তাবাদী কবিতা রচনায় পূর্বোল্লিখিত কবিদের অধিকাংশের সাথে নতুন কবিরাও যুক্ত হয়েছেন। এসব কবিতার আলাদা রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক গুরুত্ব-মাহাত্ম্য স্বীকার করে নিয়েও বলা যায়, দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ কবিই তাঁদের ওই জাতীয়তাবাদী আবেগকে একটা যথাযথ কাব্যভাষার খাপের মধ্যে পুরতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবু বাঙালি মুসলমান পরিচয়ে চিহ্নিত এই সব কবির কাব্যপ্রচেষ্টা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁরা আধুনিক যুগের বাঙালি মুসলমানের কাব্যসাধনার ধারাকে প্রশস্ত ও বেগবান করে রেখেছিলেন। কারণ, কবিতার বড় কবি যখন আসবেন তখন বাঁক ফেরাবার জন্যে তাঁকে পেতেই হবে প্রশস্ত ও বেগবান নদী। [সৈয়দ শামসুল ২০১৬ : ৩৬] শামসুর রাহমান বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে সেই কবি যিনি পূর্বজদের প্রশস্ত ও বেগবান কবিতার নদীতে একটা বড় বাঁক বদলে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি শুধু রাজনৈতিক কবিতা বা প্রেমের কবিতার কবি নন।

শামসুর রাহমান © ছবি: সাহাদাত পারভেজ

তিন

বাংলাদেশের কবিতায় শামসুর রাহমানের প্রথম বড় অবদান, তিনি বাংলা কবিতার বিকল্প একটি রাজধানী স্থাপন করেছেন। আগেই বলেছি, তাঁর আগের কয়েক প্রজন্মের কবিতার রাজধানী ছিল মূলত কলকাতা।শামসুর রাহমান বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র রাজধানী ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা। এর সাথে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ও ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানী হওয়ার একটা প্রত্যক্ষ যোগ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র আর রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হওয়াটাই প্রধান এবং একমাত্র কথা নয়। বাংলা কবিতার নতুন একটা ভাষা আর প্রকরণের আবিষ্কার করে ফেলাও একটা বড় ব্যাপার। কবিতার নতুন রাজধানী স্থাপনের কাজটা রাহমান একা করেননি হয়তো। তাঁর প্রজন্মের অনেকে মিলে করেছেন। কিন্তু রাহমান এই প্রজন্মের মধ্যে বয়সে যেমন বড় তেমনি তাঁর ভূমিকাটাও পুরোহিতের। তিনিই প্রথম নতুন রাজধানীর প্রতি কবিতার পুরাতন রাজধানীর সমীহ আদায় করেছেন।

কবিতার নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠার পুরোহিত হিসেবে বাংলা কবিতার ঢাকাকেন্দ্রিক চর্চায় শামসুর রাহমানের সবচেয়ে বড় অবদান বোধ করি নতুন কাব্যভাষার আবিষ্কার। তাঁর এই কাব্যভাষা শুধু বাংলাদেশের কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নয়, পুরো বাংলা কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন। তাঁর আগের প্রজন্মের পূর্ব বাংলার অধিকাংশ কবি ছিলেন ভাষার প্রশ্নে আড়ষ্ট। যাঁরা আড়ষ্ট ছিলেন না তাঁরা আবার বাঁক বদল করার মতো মৌলিক এবং ধারাবাহিক ছিলেন না। ফররুখ আহমদ ছাড়া কবিভাষার প্রশ্নে স্বাতন্ত্র্য দেখাতে পেরেছেন খুব কম কবিই। যাঁদের কবিভাষায় মৌলিকত্ব ছিল, তাঁরা নিজের মধ্যেই সীমিত থেকেছেন। প্রজন্মান্তরের কবিদের তাঁরা খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেননি। কবিতায় মৌলিক রূপান্তর আনতে পারেননি। তাই তাঁরা কবিতার বাঁক বদলের কবি নন।

এই ফাঁকে বলে রাখা প্রয়োজন, অন্য অনেকের মতো শামসুর রাহমানও তাঁর কবিজীবনের শুরুর দিকে ত্রিশের দশকের কবিদের উপাসক ছিলেন। কিন্তু প্রথম কাব্যগ্রন্থেই খুব দ্রুততার সাথে সেই উপাসক মনোবৃত্তি কাটিয়ে ওঠেন। প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে [১৯৬০]-এর কবিতাগুলো ধারাবাহিকভাবে পাঠ করলে দেখা যাবে, আস্তে আস্তে একেকটি কবিতায় তিনি ক্রমাগত নিজের ব্যক্তিত্বটি স্পষ্ট করে তুলেছেন। প্রথম কবিতা প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে থেকে শেষ কবিতা রজনীগন্ধার ঘ্রাণ পর্যন্ত কবিতার ভাষা আর বিষয়ের অভিযাত্রায় ক্রমাগত একজন শামসুর রাহমান স্পষ্ট হয়ে উঠেছেন। ভাস্কর যেমন পাথর কুঁদে কুঁদে ক্রমে একটা মূর্তি স্পষ্ট করে তোলেন, তেমনি প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা থেকে আস্তে আস্তে জীবনানন্দ দাশের প্রভাবকে উতরে উঠে একজন শামসুর রাহমান অনেকটাই মূর্ত হয়েছেন। এরপর কাব্যপরম্পরায় বাংলা কবিতার নতুন রাজধানীর নতুন শাসকের মূর্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে; বাংলা কবিতার নতুন পালাবদল উঁকি মারতে থাকে। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ রৌদ্র করোটি [১৯৬৩]-তে থেকে রাহমান তিরিশি প্রভাব প্রায় পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠেন। বিধ্বস্ত নীলিমায় [১৯৬৭] তিনি ত্রিশের প্রভাবকে অতীত জ্ঞান করে স্বীকার করেন যে, একসময় তাঁর ওপর ত্রিশী আচ্ছন্নতা ছিল। কবিতায় বলেছেন, মধ্যপথে কেড়েছেন মন/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, সম্মিলিত তিরিশের কবি। [শামসুর ২০১২ : ১৭৮/১] নিজবাসভূমে [১৯৬৯]-তে এসে ঘোষণা করেন, নিপুণ গার্ডের মতো হুইসিল বাজাতে বাজাতে সবুজ ফ্ল্যাগ/ ওড়াতে ওড়াতে একটি কবিতার শাঁ শাঁ ট্রেনকে অন্তিম স্টেশনে পৌঁছে দিতে না দিতেই/ কিছু পঙ্‌ক্তি পেয়ে বসে আমাকে আবার। দুর্দান্ত/ এক পাল জেব্রার মতো ওরা আমার বুকে ধুলো উড়িয়ে বারংবার/ ছুটে যায়, ফিরে আসে।/ ক্ষমা করুন রবীন্দ্রনাথ, আপনার মহান মায়াবী শৈলাবাস থেকে,/ ভুল বুঝবেন না নজরুল, আপনার হারমোনিয়ামের আওয়াজে/ মধুর মজলিশ আর হাসির হুল্লোড় থেকে,/ কিছু মনে করবেন না জীবনানন্দ, আপনার সুররিয়ালিস্ট হরিণেরা/ যেখানে দৌড়ে যায়, সেখান থেকে,/ মাফ করবেন বিষ্ণু দে, আপনার স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ থেকে/ অনেক দূরে যেতে চায় সেই দামাল জেব্রাগুলো। [শামসুর ২০১৭ : ২৫৫/১] আদতে এই ঘোষণার অনেক আগেই রাহমান তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশের কবিতার এক আলাদা স্বর আর সাম্রাজ্য।

বলছিলাম কবিতার নতুন রাজধানী ও শামসুর রাহমানের কবিতার ভাষা নিয়ে। বাংলা কবিতার ভাষার প্রশ্নে ত্রিশের দশকের কবিরা যে-স্বপ্ন দেখেছিলেন রাহমান, সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করে উঠেছিলেন। ত্রিশের কবিরা কবিতার ভাষাকে মুখের ভাষার কাছাকাছি করার যে-আকাঙ্ক্ষা ও কোশেশ করেছিলেন, তা তাঁরা পুরোপুরি পেরেছিলেন এমন নয়। রবীন্দ্রনাথ থেকে তাঁরা বের হয়ে আসতে দারুণভাবে সফল হলেও আরোপিত কাব্যিকতা আর রোমান্টিক উচ্ছ্বাস থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেরিয়ে আসতে পারেননি। মুখের ভাষার কাছাকাছি তারা আসতে পারেননি। কবিতাকে গদ্যের অনেক কাছে আনতে পারলেও চলিত গদ্যের চলনভঙ্গির মধ্যে আঁটিয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু রাহমান বাংলা কবিতার ভাষাকে ড্রয়িংরুম থেকে জনসমুদ্র হয়ে অলিগলির মধ্যে, নিত্যকার কলকোলাহলের মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। কবিতার ভাষার গা থেকে আরোপিত কাব্যিকতাকে অনেকটাই ঝেড়ে ফেলতে পেরেছিলেন। কবিতাকে তিনি যত দূর সম্ভব জনপাঠ্যতার কাছাকাছি আনতে পেরেছিলেন। ক্রমে তিনি এমন এক ভাষায় কবিতা লেখা শুরু করলেন যে, কবিতার সাবেকি রুচি হোঁচট খাওয়ার উপক্রম হলো। কবিতাকে মৌখিক বাকভঙ্গি সমেত গদ্যের এত কাছাকাছি নিয়ে গেলেন যে, অনেক সময় তাঁর কবিতার মধ্যেকার কাব্যত্ব নিয়েও সংশয় হবার উপক্রম হয়। এ কারণে দেখা যায়, রাহমানের কবিতা ঈর্ষণীয়ভাবে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এতকাল কবিতা পড়া সীমাবদ্ধ ছিল যেন শুধু কবিতা পড়ার ট্রেনিংপ্রাপ্ত পাঠক আর কবিদের মধ্যে। কিন্তু রাহমান এমন এক কাব্যভাষা আবিষ্কার করলেন, যে-ভাষায় সাধারণ শিক্ষিত মধ্যবিত্তও কবিতার পাঠক হয়ে উঠলেন। কবিতাকে রাহমান গণনিষ্ঠ [!] করেছেন। ত্রিশের কবিরা যা করেছেন তার উল্টো। রাহমানের জননিষ্ঠ কবিভাষা আবিষ্কারের মাধ্যমে কবিতাকে জনপ্রিয় করে তোলার বিষয়টি দারুণভাবে শনাক্ত করে একটু যেন ঘুরিয়ে বলেছেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তিনি বলেছেন, এ যাবৎ শামসুর রাহমানের ১৫টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। খুব কম কবির বই-ই একালে দ্বিতীয় সংস্করণের মুখ দেখতে পায়। কিন্তু শামসুর রাহমানের প্রথম দিককার অনেক কাব্যই একাধিক সংস্করণের স্বীকৃতি পেয়েছে। [আবু হেনা ২০১০ : ২০] এই পাঠকপ্রিয়তার প্রধান কারণ তাঁর কবিভাষার সহজতা ও উচ্চারণের উষ্ণ উদার ঘনিষ্ঠতা। [আবু হেনা ২০১০ : ২০]

এই সহজতা ও উচ্চারণের উষ্ণ উদার ঘনিষ্ঠতার মধ্যে তিনি তাঁর অভিনব কবিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এই কবিত্ব আরও অনেক কিছুর মতো নিহিত আছে তাঁর কবিতার মধ্যকার সংগীতময়তার মধ্যে। এটা সহজে চোখে পড়ে না। কিন্তু ঝর্নাধারার মতো অথবা চাইমের মতো মৃদু ও স্বাদু আওয়াজ তোলে। এই একই ধরনের সাংগীতিক মূর্ছনা অত্যন্ত প্রবলভাবে ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিভাষার মধ্যে। কিন্তু মাইকেলের কবিতায় এই সাংগীতিক ব্যঞ্জনা অধিকাংশ সময় তৈরি হয় মূলত দৃষ্টিগ্রাহ্য যমক, অনুপ্রাস ইত্যাদি শব্দালংকারের সজ্ঞান প্রযোজনায়। এই দৃষ্টিগ্রাহ্য শব্দালংকারকে কিছুটা কড়া মেকাপের সাথে তুলনা করা যায়। মাইকেলের কবিতার অলংকারের এই কড়া উপস্থিতির সাথে মধ্যযুগের কবিতার একটি দূরসম্পর্ক থাকা অসম্ভব নয়। কারণ, কবিতা তখন কেবল মধ্যযুগের গর্ভ থেকে একটু একটু করে মুক্ত হতে শুরু করেছে মূলত মাইকেলের হাত ধরেই। সাংগীতিক ব্যঞ্জনা তৈরির প্রশ্নে অতুলনীয় মাইকেলের সাথে শামসুর রাহমানের মিল থাকলেও অন্তর্প্রকৃতির দিক থেকে দুজনের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে। রাহমানে মাইকেলের মতো আনুষ্ঠানিক যমক, অনুপ্রাস ইত্যাদি শব্দালংকারের ঠাটবাট নেই। মদনভস্মের পরে যেমন মদন অদৃশ্য হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল ঠিক তেমনি। মনে হয় নেই, কিন্তু আছে; একালের অভিজাত নারীর মেকাপের মতো। মাইকেল ও রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষার মধ্যকার সহজ সাংগীতিক সুরটি, ধ্বনিব্যঞ্জনাটি যিনি কবিতায় সবচেয়ে বেশি ধরতে পেরেছিলেন তিনি বোধ করি শামসুর রাহমান। শিল্পীর পাঁচ আঙুলে নিষ্প্রাণ তানপুরা যেমন চূর্ণবিচূর্ণ বহুবিচিত্র মিহি শব্দের ঝংকার তোলে তেমনি বাংলা ভাষা রাহমানের হাতে সাংগীতিক ঝংকার ঢেলে দিয়েছে। কিন্তু মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ বা অপরাপর কবিদের থেকে রাহমানের বিশেষত্ব হচ্ছে, তিনি কথ্য বাংলার ঢঙের মধ্যে এই ধ্বনিব্যঞ্জনাটি তুলতে পেরেছিলেন। মৌখিক বাকভঙ্গির মধ্যেও সংগীতের এত টুংটাং আওয়াজের আবিষ্কার ও কাব্যভাষায় তার ব্যবহার বাংলা কবিতায় শামসুর রাহমানের বড় আবিষ্কার ও অবদান। সবচেয়ে কমসংখ্যক ধ্বনির ব্যবহার করে কবিতার একটি চরণ গড়ে তোলার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল রাহমানের হাতে। এবিষয়ক উদাহরণ বোধ করি অপ্রয়োজনীয়। এটি পরীক্ষার জন্য রাহমানের যেকোনো কবিতা টিপলেই বোঝা যায়।

শামসুর রাহমান © ছবি: সাহাদাত পারভেজ

এ তো গেল রাহমানের কবিতার ভাষার সহজতার এক দিক; টুংটাং আওয়াজের ব্যাপার। তাঁর স্বতন্ত্র কাব্যভাষার অন্য দিকও আছে। তিনি কবিতার উপমা, চিত্রকল্পকে আশ্চর্যজনকভাবে মানুষের প্রতিদিনকার জীবনের মধ্যে টেনে নামিয়ে এনেছিলেন। উপমা-চিত্রকল্পকে মানুষের খুব কাছে আনার সফলতা রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিশের কবিদেরও কম নয়। বিশেষত জীবনানন্দ দাশ এ ব্যাপারে বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছেন। কিন্তু জীবনানন্দ সেই সব উপমা-চিত্রকল্প ব্যবহার করতেন বেশি, যেগুলো মানুষ সাধারণত সূক্ষ্মভাবে দেখে না; আশপাশেই আলগোছে পড়ে থাকে। মানুষ এগুলো সম্পর্কে খুব বেশি সচেতনও থাকে না। জীবনানন্দ সেই সব চিরচেনা কিন্তু মনোযোগের অভাবে থাকা অনুষঙ্গগুলোকে উপমা-চিত্রকল্পের অনুষঙ্গ করতেন। কিন্তু রাহমান একেবারে প্রতিদিনকার যাপিত জীবনের অনুষঙ্গগুলোকে তাঁর কবিতার উপমা-চিত্রকল্পের বাঁধনে বাঁধেন। ফলে পাঠকের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ তৈরি করতে এই সব উপমা-চিত্রকল্প একমুহূর্তও সময় নেয় না। পাঠককে জটিল কল্পনার অবসর না দিয়ে এগুলো তার যাপন আর অস্তিত্বের অংশ হয়ে ওঠে। রাহমান যে কবিতাকে পাঠকের দোরগোড়ায় সহজভাবে হাজির করতে পেরেছিলেন, এটাও বোধ করি তার অন্যতম কারণ। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন

 রাতে খড়খড়িটা খুলে দেখি/ বুড়ো রাজমিস্ত্রীর চোখের মতো ছানি-পড়া আকাশে/ জ্যামিতিক চাঁদ শোনে তারার কথকতা, সেই মুহূর্তে/ রহমত ব্যাপারির রক্ষিতা হয়তো তার ক্লান্ত যৌবনটাকে/ কুঁচকে যাওয়া পোশাকের মতো/ এলিয়ে দিয়েছে রাত্রির আলনায়। [শামসুর রাহমান ২০১৭ : ৭২/১] এ রকম যাপিত জীবনের আটপৌরে আমেজে ভরা উপমা-রূপক-চিত্রকল্পের ছড়াছড়ি রাহমানের কবিতায়। যেমন, মাছের ঝোলের মতো জ্যোৎস্না, দাড়ি না-কামানো মুখের মতন দিন, পুরানো চটের থলির মতো শিথিল শরীর, শব্দ, রাজেন্দ্রানী শব্দ কেবলি পিছলে যায়, যেমন হাতের/ মুঠো থেকে স্তন

রাহমানের কবিতা মূলত বর্ণনাত্মক। তিনি তাঁর কথাগুলো সব সময় বর্ণনা করতে পছন্দ করেন। উপলব্ধির নির্যাস একটা অন্তর্ময় জমাট ভাষায় হাজির করা তাঁর বৈশিষ্ট্য নয়। অনেকটা গল্প বা উপন্যাসের বর্ণনার মতো করে কথা বলেন। এই বর্ণনাত্মকরীতি তাঁর কবিতার ভাষাকে এবং কবিতাকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি পাঠকের ঘরের বিষয় করে তুলেছে। বর্ণনার এই রীতি অসম্ভব নয় যে রাহমান রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে পেয়েছেন। অথবা হয়তো রাহমানের স্বভাবজাত। এই স্বভাবের কারণেই হয়তো তাঁর লেখকজীবনের শুরুতে ছোটগল্প লেখায় মেতেছিলেন বেশ কিছুকাল। এই তাড়নাতেই কি তিনি উপন্যাসও লিখেছিলেন! বর্ণনাত্মকরীতির সাথে তাঁর কবিতার একটা বড় অংশের আঙ্গিকেরও নিবিড় সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়। বর্ণনাত্মকরীতিতে কবিতার শরীর নির্মাণ করার দিকে বিশেষ ঝোঁকের কারণে কবিতায় তিনি ক্যাটালগিং বা তালিকা-পাত করতেও বিশেষ অভ্যস্ত ছিলেন। বলা দরকার, রাহমান বাংলাদেশের কবিতায় ক্যাটালগিং কবিতার সূত্রপাত করেন। ক্যাটালগিং হচ্ছে, কোনো একটি বিষয়কে কেন্দ্রে রেখে তাকে প্রকাশ করার জন্য একটির পর একটি ক্রমাগত উপমা-চিত্রকল্প-অনুষঙ্গ আওড়ে যাওয়া। অবিরল আওড়ানো ওই উপমা-চিত্রকল্প-অনুষঙ্গগুলোই কবিতা। এই তালিকাপাতী কবিতা মূলত একধরনের বর্ণনাই বটে। এটি তাঁর কবিভাষাকে যেমন সহজ-স্বচ্ছন্দ করেছে তেমনি পাঠকবান্ধব করেছে বলে মনে হয়। বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনার আধিক্য আর তালিকাপাতী আঙ্গিক প্রবর্তনার মধ্য দিয়ে রাহমান বাংলা কবিতাকে ড্রয়িংরুম থেকে সাধারণ্যে টেনে বের করে এনেছেন।১০ বাংলা কবিতার ইতিহাসে রাহমানের এ-এক বড় অবদানই বটে।

কবিতাকে রাহমান সাধারণের পাঠের আওতার মধ্যে যে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন, তার আরও এক বড় কারণ আছে। এই কারণটি নিহিত আছে রাহমানের কবিতার ভাষার চলনভঙ্গির মধ্যে। পৃথিবীর প্রত্যেকটি ভাষার একটা নিজস্ব চলন ও বলনরীতি থাকে। সব মানুষের চলার ছন্দ-লয়-তাল-গতি যেমন এক না, তেমনি সব ভাষার চলার ছন্দ-লয়-তাল-গতি এক নয়। ভাষার এই চলনভঙ্গিটি মূলত তৈরি হয় সংশ্লিষ্ট ভাষা ব্যবহারকারী মানুষের মুখে। কোনো ভাষার মানুষেরা বহুদিন ব্যবহার করতে করতে সংশ্লিষ্ট ভাষার কিছু শব্দের সাথে কিছু শব্দের গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে যায়। তখন ওই শব্দগুলো ভাষার মধ্যে একসাথে চলাফেরা করে। কখনো এই সব একসাথে চলাফেরা করা শব্দরা একটা পূর্ণাঙ্গ বাক্য গঠন করে। আবার কখনো কখনো বাক্যের একটা অংশজুড়ে থেকে বাক্যের কাঠামোতে একটা দখলদারি কায়েম করে। এভাবে ক্রমে একটা জনগোষ্ঠীর ভাষার একটা নিজস্ব অনিবার্য চলন ও কথনভঙ্গি দাঁড়িয়ে যায়। এটাই ওই ভাষার বাগভঙ্গি বা বাকরীতি। [কুদরত ২০২০ : ১১২] ভাষার চলনস্বভাব বা বাগবিধিটি ধরা পড়ে মূলত মুখে ব্যবহৃত চলিত বাংলায়। রাহমান চলিত বাংলার এই বাগবিধি বা নিজস্ব চলন-বলনকে মান্য করেই তাঁর কবিভাষা গড়ে তুলেছেন। শুধু ছন্দ আর শ্রুতির জন্য একটু এদিক-সেদিক করেছেন কখনো-সখনো। মাইকেল থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, জসীমউদ্‌দীন প্রমুখ সব বড় কবিই এই কাজ করেছেন। এই যে, বাংলার বাগভঙ্গি বা বাগবিধির সাবলীল ব্যবহার, এটি রাহমানের কবিতার ভাষাকে অনন্য করেছে। রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে এটি শামসুর রাহমানের এক বড় অবদান। রাহমান সম্পর্কে আমরা যখন এই মন্তব্য করছি তখন আবশ্যিকভাবে রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা কবিতার ইতিহাসকে মাথায় রেখেই বলছি। এই সূত্রে বলে রাখা দরকার যে, বাংলা কবিতায় ত্রিশের দশকে ভাষার প্রথাগত চলনস্বভাব প্রথম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়ে। এটি জীবনানন্দের কবিতায় লক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন ভাষা প্রভৃতি নিয়ে জবরদস্তি। [রবীন্দ্রনাথ ১৪১৪ : ২] রাহমান জীবনানন্দ দাশের অনুসারী হলেও ওই পথে হাঁটেননি। তিনি কথ্য বাংলার বাগবিধিকে সম্পদ গণ্য করে তার মধ্যেই শিল্পিতা দেখিয়েছেন। এটি ভাষার প্রশ্নে রাহমানকে অনন্য করেছে। বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে ষাটের দশক থেকে শুরু হয় ভাষার ওই প্রথাগত ভঙ্গিকে চুরমার করে দেওয়ার চেষ্টা। ফলে ভাষা বিচূর্ণিত হয়েছে। ভাষাকে তার চলনভঙ্গির মধ্যে রেখে, পীড়ন করে বা কান মলে রস বের করার যে-ব্যাপার, তা থেকে বাংলাদেশের কবিতা ক্রমে সরে গেছে। ছন্দভাঙা জীবনের মতোই তা নিশ্ছন্দ হয়েছে। একালের অন্তত আশির দশকের পর থেকেকবিতা যে দুরূহ ও পাঠকবিশ্লিষ্ট হয়েছে তার পেছনে ভাষার চলনস্বভাব থেকে কবিতার দূরে সরে যাওয়াও একটা কারণ বলে মনে হয়। ভাষাকে তার স্বভাব থেকে সরিয়ে দুমড়ানো-মোচড়ানোর এই ব্যাপারটা যুগ ও জীবনের সাথে গভীরভাবে যুক্ত কি না, তা অবশ্য ভিন্ন এক গবেষণার ব্যাপারই বটে। তবে একথা বলতেই হবে যে, কথ্যবাংলার চলনভঙ্গির মধ্যে স্বতন্ত্র কাব্যভাষার যে-নজির রাহমান দেখিয়েছেন, তা তাঁকে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার ইতিহাসে বিশেষ করে তুলেছে।

আরও বিশেষত্বের পালক শামসুর রাহমান তাঁর কবিতার বিষয় ও ভাষার সাথে যুক্ত করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রোত্তর যুগের আধুনিক কবিদের, বিশেষত ত্রিশের দশকের অধিকাংশ কবির, কবিতার আস্বাদনের জন্য নির্দিষ্ট দেশকাল বা ভূগোল জরুরি নয়। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের কবি হিসেবে রাহমানের একটা বড় বিশেষত্ব এই যে, কবিতাকে তিনি নির্দিষ্ট দেশকালের মধ্যে নামিয়ে এনেছেন। এই দেশকালের মধ্যে নামিয়ে আনা বলতে শুধু বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রাম এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়ে কবিতা লেখার কথা বলছি না। তা তো আছেই। এর বাইরেও তাঁর কবিতার সাথে নির্দিষ্ট দেশকালের সম্পর্ক আছে। দুই দিক থেকে বিষয়টা বোঝা যায়; প্রথমত, জীবনের উপস্থাপনের দিক থেকে; দ্বিতীয়ত ভাষার দিক থেকে। শামসুর রাহমান বাংলাদেশের কবিতার প্রথম দিককার সেই কবি, যাঁর কবিতায় উপস্থাপিত জীবনের একটা লোকাল ফ্লেবার আছে। সেই ঢাকাই ফ্লেবার। তাঁর কবিতায় মূলত ঢাকা শহরের পার্ক থেকে ফুটপাত হয়ে ড্রয়িংরুম পর্যন্ত সবই প্রায় বাক্সময় হয়ে উঠেছে। পুরাণ ঢাকার অলিগলি আর জীবনের কথা না-হয় বাদই দিলাম। যদিও অনির্দিষ্ট ভূগোলের কবিতাও রাহমানের কম নয়। তবু ঢাকার নাগরিক জীবনের খুঁটিনাটির উপস্থাপনে রাহমানের জুড়ি বোধ করি রাহমান নিজেই। ঢাকাই জীবনের কবিতার কলকাতাই সমীহ প্রথম বোধ করি আদায় করতে পেরেছিলেন শামসুর রাহমান।

জীবনের সাথে জবানের একটা গভীর সম্পর্ক থাকে। সেই হিসেবে রাহমানের কবিভাষার মধ্যে উপস্থাপিত ঢাকার জীবনের জবানের একটা নিবিড় যোগ আছে। তাঁর কবিতায় যেহেতু ঢাকাকে বোঝা যায়, সেহেতু ঢাকার জবানও নানাভাবে তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়েছে। এই মূর্তি যে খুব বেশি প্রত্যক্ষ তা নয়। যে-অর্থে জসীমউদ্‌দীন, আল মাহমুদ বা আসাদ চৌধুরীর ভাষার সাথে পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের ভাষার সম্পর্ক রাহমানের কবিতার ভাষার সাথে ঠিক সেই অর্থে নয়।১১ কিন্তু রাহমানের কবিতার ভাষার মধ্যকার চলনস্বভাব আর প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার এই ভাষাকে পূর্ব বাংলার সাথে গভীরভাবে যুক্ত করে দেয়।১২ পুরো পূর্ব বাংলা না হোক অন্তত ঢাকার চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট দশকের শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর সাথে রাহমানের ভাষার একটা গভীর যোগ আছে। উপনিবেশায়নের কালে বাংলা ভাষা যে সংস্কৃতায়নের শিকার হয়েছে এবং মুসলিম জবানের অপরায়ণের ভেতর দিয়ে গিয়েছে, রাহমানের কবিভাষা তা থেকে অনেকটা বের হয়ে এসেছে। বাংলা কবিতার ভাষায় এই প্রথম ঢাকার মালিকানা স্বত্বের প্রতিষ্ঠায়ন ঘটেছে। এর আগে চল্লিশের দশকে বাংলাদেশের কবিতার ভাষায় স্বাতন্ত্র্য আরোপের যে-চেষ্টা চলেছিল, তা বাংলাদেশের কবিতায় এবং বাংলা কবিতার মূলধারায় খুব বেশি সমীহ আদায় করতে পারেনি। কিন্তু রাহমান ঢাকার কথ্য বাংলার স্বভাব, শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের মুখ থেকে নেওয়া উল্লেখযোগ্য আরবি-ফারসি শব্দের প্রযোজনায় সেই সমীহটি আদায় করতে পেরেছিলেন। এই অর্থেও তিনি কলকাতার বাইরে বাংলা কবিতার নতুন রাজধানীর প্রতিষ্ঠাতা।

শামসুর রাহমান © ছবি: সাহাদাত পারভেজ

রাহমানের কবিতায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তাঁর ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার আরও স্পষ্ট বোঝা যায় তাঁর গদ্য পড়লে। তিনি তাঁর গদ্যে কবিতার মতোই ভাষার জবরদস্তি পছন্দ করতেন না। মুখে ব্যবহৃত আরবি-ফারসি শব্দ তিনি খুব সাবলীলভাবে দেদার ব্যবহার করতেন। খুব সচেতনভাবে যে তিনি এটা করতেন, তা মনে হয় না। এই যে সহজভাবে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার এর উৎস কি বাংলাদেশের গণ-মানুষের মুখ! এটা মনে করার যথেষ্ট সংগত কারণ আছে। কারণ, বাংলাদেশের বুলির মধ্যে বাঙালি মুসলমানের ধর্মীয় ও সংস্কৃতিগত একটা আলাদা প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাহমানের ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের একটা সলীল ব্যবহারের অন্য কারণও আছে বলে মনে হয়। এই কারণটি তাঁর পুরান ঢাকায় জন্ম ও বেড়ে ওঠার সাথে সম্পর্কিত। নবাব পরিবার এবং উত্তর ভারত ও বিহার থেকে আগতদের ব্যবহৃত উর্দু ভাষার অপভ্রংশ পুরান ঢাকার সাধারণ বাঙালির বাংলার মধ্যে কালক্রমে ঢুকে গিয়েছে। ফলে পুরান ঢাকার বাঙালির বাংলার মধ্যে আরবি-ফারসি শব্দের একটা বড় প্রভাব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। শামসুর রাহমানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল বলে মনে হয়।১৩ তাঁর বেড়ে ওঠার সাথে আরবি-ফারসি শব্দবহুল উর্দুর অপভ্রংশের১৪ সংশ্লিষ্টতা রাহমানের কাব্যভাষাকে একটা বিশিষ্টতা দিয়েছিল। তাঁর কবিভাষার ওপর উর্দু অপভ্রংশ বা উর্দু-সান্নিধ্যের এই প্রভাব সমকালের দুই বাংলার কবিতার ভাষা থেকে রাহমানের কবিভাষাকে আলাদা করতে বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে হয়।

শামসুর রাহমানের কাব্যভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি এটিকে রাহমানের কাব্যভাষার বিশেষত্ব হিসেবে না দেখে দেখেছেন নেতিবাচক প্রপঞ্চ হিসেবে। এমনকি তিনি রাহমানের কথ্য ও অতি-কথ্য ভাষা-প্রিয়তাকেও একই নিক্তিতে দেখেছেন।১৫ তিনি তাঁর পুরাণ ঢাকায় বেড়ে ওঠার কথাও বলেছেন। বলেছেন, তাঁর কবিতায় এ-শব্দরাশির প্রবেশের কারণ সম্ভবত তিনি বাল্য ও যৌবন কাটিয়েছেন এমন এক প্রতিবেশে, যেখানে আরবিফারসি শব্দের ব্যবহার বিপুল। [হুমায়ুন ২০০৮ : ২১৬] তবে আজাদ এ-ও উল্লেখ করেছেন যে, এই কথ্য-বাংলা আর আরবি-ফারসির প্রতি রাহমানের ব্যাপক অভিনিবেশ তাঁর কবিতার ক্ষতি করেছে। আজাদের বক্তব্যটি এ রকম

স্বাধিকারবশত যে-সমস্ত আরবিফারসি শব্দ এসেছে তাঁর কবিতায়, সে-গুলো স্থান পেয়েছে শামসুর রাহমানের কথ্য ও অতি-কথ্য ভাষা-প্রিয়তার জন্যে। কথ্য ভাষা যদিও জীবন্ত, তবুও অধিকাংশ সময় অশোধিত, অশিক্ষিত বাঙালির আরবিফারসি-আঞ্চলিক-সাধু-চলতি মিশ্রিত ভাষা ও শিক্ষিত বাঙালির ইংরেজি-আঞ্চলিক-সাধু-চলতি মেশানো ভাষা সমপরিমাণে অপরিস্রুত। উভয় ভাষার নির্বিচার ব্যবহার শিল্পকে পতনের দিকে ঠেলে দিতে পারে; দিচ্ছেও আজকাল। কথ্য আরবিফারসি শব্দাবলি শামসুর রাহমানে আরো কম ব্যবহৃত হতে পারতো তিনি ক্রমশ কথ্যতা থেকে যে অতি-কথ্যতার দিকে ভয়ঙ্করভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, এসব শব্দ স্বল্পতর পরিমাণে ব্যবহৃত হলে, তার বেগ হ্রাস পেয়ে তাঁর জন্যে মঙ্গল বয়ে আনতো। তাঁর অধিকতর ক্ষতি করেছে সাফল্যভিলাষী আরবিফারসি শব্দপুঞ্জ। [হুমায়ুন ২০০৮ : ২১৮]

আজাদের এই মূল্যায়ন অত্যন্ত অনিরীহ এবং ইতিহাস-খোদক। তিনি বাংলা ভাষার প্রশ্নে বরাবরই উনিশ শতকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের জঠরে জন্ম নেওয়া এবং বিদ্যাসাগরের পৌরোহিত্যে সুস্থিত হওয়া গদ্য রূপটিকেই আসল বাংলা মনে করতেন। বাংলা ভাষার উপনিবেশায়নের কালে প্রচুর সংস্কৃত শব্দের অনুপ্রবেশ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীসহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরীর কাছে অস্বাভাবিক ঠেকলেও আজাদ এটিকে যথার্থ বলে মনে করেন। বাংলা ভাষার সুস্থিতকরণের ওই কালে অর্থাৎ অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে আরবি-ফারসি শব্দকে যে অপর বানিয়ে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছিল তাকে আজাদ সঠিক মনে করতেন। তিনি বাংলায় ব্যবহৃত বিদেশি১৬ অর্থাৎ আরবি-ফারসি শব্দকে জোর করে চাপিয়ে দেয়া বলেই মনে করতেন

সংস্কৃতের সাহায্য ছাড়া বহু-আঞ্চলিক বাঙলা ভাষা আজকের বাঙলা হয়ে উঠতে পারত না। বিদেশি [পড়ুন আরবি-ফারসি], শব্দ সম্পর্কে বাঙলা ভাষাঞ্চলে অনেক দিন ধরেই চলছে একটি ভুল ধারণা : একদল বাঙলা ভাষায় বিদেশি শব্দের প্রাচুর্যকে সমৃদ্ধি বলে মনে করেন, তবে তা সমৃদ্ধি নয় দারিদ্র্য। বাঙলা ভাষায় বিদেশি শব্দ ঢুকেছে ভাষাসাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ায়, তার অধিকাংশই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বাঙলা ভাষার ওপর। বাঙলা ভাষা বিদেশি শব্দ নিজের প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় নেয় নি, রাজনীতিক কারণে ওগুলো ঢুকেছে বাঙলা ভাষায়। [হুমায়ুন ১৯৯৯ : ৭৩]

সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন প্রশংসাই তাঁদের প্রাপ্য বলে তিনি মনে করতেন। [হুমায়ুন ২০০২ : ৩২/১] এই একই সূত্রে গাঁথা বাংলাদেশের চল্লিশের দশকের কবিতার ভাষা সম্পর্কে আজাদের মূল্যায়ন। একই সূত্রে পড়েছে শামসুর রাহমানের কবিতায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে আজাদের মন্তব্য। জীবনের সাথে জবানের সম্পর্কের যে-সাংস্কৃতিক রাজনীতি, তার ব্যাপারে আজাদ ছিলেন বরাবরই অনীহ। ফলে তিনি রাহমানের কবিতায় ব্যবহৃত আরবি-ফারসি শব্দকে ক্ষতির কারণ হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে দেখা যাবে যে, ওই কথ্যবাংলার ভঙ্গির সাথে কথ্যবাংলায় ব্যবহৃত অব্যর্থ এবং স্বাভাবিক আরবি-ফারসি শব্দের মিশেল রাহমানের কবিভাষাকে প্রথাগত কবিভাষা থেকে আলাদা করেছে। এই কবিভাষাই রাহমানকে বাংলা কবিতার নতুন রাজধানীর প্রতিষ্ঠাতা হয়ে উঠতে অনেকটাই সাহায্য করেছে। রাহমানের সম্পদ আজাদের ক্ষতি

চল্লিশের দশককের কবিদের যদি বাংলাদেশের কবিতার প্রথম প্রজন্ম ধরি, তাহলে শামসুর রাহমান বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে দ্বিতীয় প্রজন্মের কবি। দ্বিতীয় প্রজন্মের এই কবি শুধু তাঁর রাজনৈতিক কবিতার মধ্যে হারিয়ে যান না। জাতীয়তাবাদী চেতনা আর জাতীয় রাজনীতিই রাহমানকে বিবেচনার একমাত্র নিক্তি নয়। রাহমানকে বিবেচনার আরও আরও রাজনৈতিকতা আছে। তিনি যাপিত জীবনের উপস্থাপন, রাজনৈতিক অভীপ্সা এবং কবিভাষার স্বাতন্ত্র্য দিয়েই বাংলা কবিতার ভোক্তা ও সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন ঢাকার দিকে। এইসব দিয়েই তিনি কলকাতার বাইরে বাংলা কবিতার নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। সম্ভবত এই কারণেই রাহমান বাংলাদেশের শুধু নয়, বাংলা কবিতার ইতিহাসে বহুদিন বেঁচে থাকবেন এবং কীর্তিত হবেন।

টীকা

১. অবশ্য শামসুর রাহমানের এবং তাঁর প্রজন্মের কবিদের আত্মপ্রকাশের আগেও ঢাকা নতুন কবিতাচর্চার সূতিকাগার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যেমন, বুদ্ধদেব বসুর নেতৃত্বে একদল নতুন কবি প্রগতি [১৯২৭] পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে তাঁদের নতুন কবিতার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন। বুদ্ধদেব বসু ও অজিতকুমার দত্ত ছিলেন নতুন সাহিত্য আন্দোলনের মুখপত্র প্রগতি পত্রিকার সম্পাদক। এ ছাড়া এর পরে ১৯৪০ সালের দিকে প্রগতি লেখক সংঘের ঢাকা শাখা প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকায় এই সংগঠনকে কেন্দ্র করে আরেক ধরনের নতুন সাহিত্য আন্দোলন দেখা দেয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এই দুটি সাহিত্য আন্দোলন কলকাতার সাথেই গভীরভাবে যুক্ত ছিল। এই দুটি পত্রিকা-সংগঠনের দেহ ঢাকাতে থাকলেও মন ছিল কলকাতা বা কলকাতারও আরও পশ্চিমে; পশ্চিমা দুনিয়ায়। ফলে ঢাকা সাহিত্যচর্চার জন্য তখন পর্যন্ত স্বকীয় ব্যক্তিত্বে প্রকাশিত হয়নি; বিকল্প রাজধানীর মর্যাদা পেয়ে ওঠেনি; সামষ্টিক সাহিত্য তৎপরতার জন্যও নয়, ব্যক্তির বাঁকবদলি বিরাট ভূমিকার জন্য তো নয়ই।

২. সৈয়দ শামসুল হক তাঁর এক লেখায় এমনটি দাবিও করেছেন যে, বাংলাদেশের কবিতার বাঁকবদল রাহমানের একার অবদানে ঘটেনি। আরও অনেকে ছিলেন এর নেপথ্যে। সৈয়দ হক হুমায়ুন আজাদের লেখা শামসুর রাহমানবিষয়ক গ্রন্থ শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপার সমালোচনা করে বলেন, শেরপা ও শেরপার হিমালয় আরোহণ যতই চমকপ্রদ উপমা হোক না কেন, সত্য এতে উপেক্ষিত; কারণ, শামসুর রাহমান নিঃসঙ্গ নন নিজেও নন তাঁর সাহিত্যিক অবস্থানও নয়; ... পঞ্চাশের কবি সকলে মিলেই আমরা এক রবীন্দ্রনাথ; ... [সৈয়দ শামসুল ২০১৬ : ৩৯] তবে তিনি একথা বলেছেন যে, শামসুর রাহমান সমকালের পূর্ববাংলায় সাধারণের কাছে এবং কবি প্রার্থীদের কাছেও হয়ে ওঠেন কবি ও কবিতা হয়ে ওঠা না ওঠার গজকাঠি।  [সৈয়দ শামসুল ২০১৬ : ৩৯]

৩. একথা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের পঞ্চাশের দশকের একটা বড় অংশ কবির ওপর ত্রিশের কবিদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। এ নিয়ে প্রায় সবাই একমত। সবাই এ বিষয়েও একমত যে, শামসুর রাহমান প্রথম দিকে ত্রিশের দশকের জীবনানন্দ দাশ দ্বারা খুব বেশি পরিমাণে প্রভাবিত ছিলেন। শব্দচয়ন থেকে শুরু করে চিত্রকল্প, উপমা, পরিপার্শ্ব সৃজন, কথা-প্রক্ষেপণ ইত্যাদিতে জীবনানন্দ দাশের প্রভাব খুব স্পষ্ট ছিল। রাহমান নিজেও বিচিত্র লেখায় তা স্বীকার করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় তাঁর আত্মজীবনীমূলক এক বইয়ের কথা। সেখানে তিনি বলছেন, রেডিওতে ১৯৫০ সালের দিকে একবার কবিতা পড়তে আমন্ত্রিত হন। একটি কবিতা জমা দেন প্রোগ্রাম অর্গানাইজার কবি আবুল হোসেনের কাছে। কিন্তু সম্ভবত কবিতাটি জীবনানন্দগন্ধী হওয়ায় তা গৃহীত হয়নি। রাহমান বলছেন, আমন্ত্রিত হয়ে আবুল হোসেনের কাছে একটি মুদ্রিত কবিতা জমা দিই। তিনি আমাকে অন্য একটি কবিতা আনতে বললেন, সম্ভবত জীবনানন্দগন্ধী কবিতাটি তাঁর ভালো লাগে নি। [শামসুর ২০০৭ : ৭৪] শুধু জীবনানন্দ দাশ নয়, ত্রিশের বুদ্ধদেব বসুও রাহমান এবং তাঁর সতীর্থ কবিদের কাছে ছিলেন অনুকরণীয়। তবে রাহমানের কবিতায় বুদ্ধদেব বসুর প্রভাব কম। তাঁর গদ্যে বরং বুদ্ধদেবের প্রভাব আছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। সৈয়দ শামসুল হক বলেন প্রথম দিকে তাঁর [শামসুর রাহমান] কবিতায় জীবনানন্দের কিছুটা আলো পড়লেও, কখনোই তাঁর কবিতায় কেবল রূপালি স্নান বা তাঁর শয্যার পাশে ধরনের ওই সময়ের কয়েকটি কবিতা বাদে বুদ্ধদেব বসুর কবিতার প্রভাব আমরা এমনকি দূর উপস্থিত বলেও দেখতে পাব না। তবে, হ্যাঁ, রচনার শারীরিক ক্ষেত্রে, রচনায় বাক্যবন্ধের কৌশল বিচার করলেও শামসুর রাহমানের কলমে বুদ্ধদেবের একটা দূরাভাস পাওয়া যাবে; শামসুর রাহমানের কবিতার ক্রিয়াপদ সংস্থাপনেও বুদ্ধদেব অবিরাম হানা দিয়েছেন বলেই আমার মনে হয়। [সৈয়দ শামসুল ২০১৬ : ৩০] ত্রিশের কবিদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু লেখক হিসেবে এবং সংগঠক হিসেবেও বাংলাদেশের পঞ্চাশের দশকের অনেক কবির কাছে ছিলেন আকর্ষণীয়। এই আকৃষ্ট হওয়া সম্পর্কে বিশেষত রাহমানের আকৃষ্ট হওয়া সম্পর্কে সৈয়দ হক বলেছেন, একেবারে প্রথম দিকে শামসুর রাহমান নীল কালি ব্যবহার করতেন তখন বল পয়েন্ট কলম বাজারে ওঠে নি, পাইলট, ঝরনা কলম কিংবা হ্যান্ডেলওয়ালা নিবের কলমে লিখতেন, পেনসিলেও দু-একটি কবিতা লিখেছেন বলে স্মরণ হয়। কিন্তু অচিরেই ওই নীল কালিটি তিনি ত্যাগ করেন, কালো কালি হয়ে ওঠে তাঁর পছন্দ। এই কালো কালির প্রতি পক্ষপাতটি কেবল তাঁরই নয়, আমারও আমার পরিষ্কার মনে আছে, বুদ্ধদেব বসুর কাছ থেকে পাওয়া। তখন শামসুর রাহমান নিয়মিত কবিতা প্রকাশ করছেন বুদ্ধদেবের কবিতা পত্রিকায়, আমিও ওই পত্রিকার অনেকগুলো সংখ্যায় তখন লিখছি; বুদ্ধদেবের কাছ থেকে আমরা যে-চিঠি পেতাম তা কালো কালিতে তাঁর অপরূপ হস্তাক্ষরে। সেই কালির কালিমাই আমাদের মজায়। শামসুর রাহমানের হস্তাক্ষরেও ছাপ পড়ে বুদ্ধদেবের মিলিয়ে দেখলেই চোখে পড়বে; মনে পড়ে, একদিন বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডায় তিনি কাগজে কালো কালির কলম ধরে বুদ্ধদেব বসুর স্বাক্ষর এমন অবিকল করে পাত করেছিলেন যে, উপস্থিত আমরা সবাই হুল্লোড় করে উঠি তাঁর দক্ষতা দেখে।  [সৈয়দ শামসুল ২০১৬ : ২৯-৩০] সৈয়দ হকের উল্লেখ করা এই ঘটনাটি আপাতদৃষ্টে হয়তো তেমন কিছু নয়। কিন্তু চৈতন্যের ঝোঁক আর ঘোর বোঝার জন্য এ এক অনন্য তথ্য বলেই মনে হয়। আরেক গবেষক অবশ্য জানাচ্ছেন, বসুর...গীতিধর্মী সুরের মায়া রাহমানকে বেশ কিছুদিন সম্মোহিত রেখেছিল বলেই মনে হয়।  [মোহাম্মদ আজম ২০২০ : ১৬৬]

৪. রাহমানের কবিতায় জীবনানন্দের প্রভাব যে খুব বেশিদিন কাজ করেনি সে সম্পর্কে সমালোচক বলেছেন, শামসুর রাহমানের বাকভঙ্গিতে ছিলো জীবনানন্দের প্রতিধ্বনি কিন্তু তাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। [আবু হেনা ২০০১ : ৪০৫/১] অন্য সমালোচক বলেছেন তিরিশের জীবনানন্দ ও বুদ্ধদেব বসুতে রাহমান কিঞ্চিত প্রলুব্ধ হয়েছিলেন। [আবিদ ২০১৫ : ৪২] আরেক সমালোচক বলেছেন, দ্বিতীয় গ্রন্থেই শামসুর রাহমান দেশ-কাল-সমাজের সমকালীন কালপুরুষের দিকে যাত্রা করেছেন। [আবদুল মান্নান ১৯৮৮ : ২১] আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, প্রথম কাব্যগন্থের একটা বড় অংশ কবিতাতেই রাহমান ত্রিশের প্রভাব কাটিয়ে বেশ কিছুদূর পর্যন্ত নিজের স্বর জানান দিতে পেরেছিলেন।

৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মদন ভস্মের পরে কবিতায় দেখিয়েছেন যে, মদন যখন সাকার ছিলেন তখন তিনি শারীরিকভাবে উপস্থিত হয়েই নারী-পুরুষকে প্রেমাতুর-কামাতুর করতেন। কিন্তু মদন যখন ভস্ম হলেন শিবের ত্রিয়নয়ের আগুনে, তারপর থেকে মদনের শ্বাস-প্রশ্বা পর্যন্ত বাতাসে মিশে সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়ে শুধু মানুষ নয় প্রকৃতিজগৎকেও প্রেমার্ত-কামার্ত করে তুলেছে। কবিতাটির একটি অংশ এমন

পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ এ কি সন্ন্যাসী
বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে!
ব্যাকুলতর বেদনা তার বাতাসে উঠে নিশ্বাসী,
অশ্রু তার আকাশে পড়ে গড়ায়ে।
ভরিয়া উঠে নিখিল ভব রতিবিলাপ-সংগীতে,
সকল দিক কাঁদিয়া উঠে আপনি।
ফাগুন মাসে নিমেষ-মাঝে না জানি কার ইঙ্গিতে
শিহরি উঠি মুরছি পড়ে অবনী।

৬. বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বর্ণনার বাহাদুর। রবীন্দ্রনাথ সাধারণত অনুভূতি প্রকাশ করেন পরিপার্শ্ব বর্ণনার মধ্য দিয়ে। এই বর্ণনার প্রতি রবীন্দ্রনাথের অতিরিক্ত ঝোঁক অনেক সময় তাঁর কবিতাকে দীর্ঘ করে তুলেছে বলে মনে হয়। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, আসলে বর্ণনাটাই মূল কবিতা। সেখানেই আকরিত হয়ে থাকে কবির কহতব্যের আকুলি-ব্যাকুলি। শামসুর রাহমানের কবিতাও মূলত বর্ণনানির্ভর। শুধু কবিতা নয় রাহমানের গদ্যও মূলত বর্ণনানির্ভর। বিশেষত তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা কালের ধুলোয় লেখা [২০০৪] পড়লে দেখা যায়, তিনি চারপাশের বিশদ বর্ণনাই মূলত দিয়েছেন। এই বর্ণনার মধ্য দিয়েই রাহমান তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতিটিকে প্রকাশ করতে চান। কখনো কখনো ব্যক্তিগত অনুভূতিটির প্রতিনিধিত্ব করে শুধু চারপাশের বস্তুবিশ্বের বর্ণনা। বর্ণনাই রুচি, চিন্তা, দর্শন ও ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে কথা বলে; নিজেকে জাহির করতে হয় না।

৭. রাহমানের প্রথম দিকের সাহিত্য-ঝোঁক সম্পর্কে বলতে গিয়ে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী জানিয়েছেন, ওই সময়ে শামসুর রাহমান ছোটগল্প লেখায় মন দিয়েছিল বেশি, তবে কবিতার দিকেও ঝোঁকছিল। [জিল্লুর রহমান ২০১০ : ১] রাহমান সাধারণত ছোটগল্পের মতো সাধারণ বর্ণনার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ শেষে এসে কবিতা জমিয়ে তোলেন; ধাক্কা দেন; পাঠককে বিস্ময়াবিষ্ট করেন। ওই যে ছোটগল্পসুলভ বর্ণনা, ওই বর্ণনাই তার ভাষাকে এমন সরল করেছে। উল্লেখ করা দরকার যে, ২০০২ সালে শামসুর রাহমানের ছোটগল্প নামে রাহমানের একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

৮. শামসুর রাহমানকে অধিকাংশ মানুষ জানেন মূলত কবি হিসেবেই। কিন্তু তিনি অন্তত চারটি উপন্যাসও রচনা করেছেন। এগুলো হচ্ছে, অক্টোপাস [১৯৮৩], নিয়ত মন্তাজ [১৯৮৫], অদ্ভুত আঁধার এক [১৯৮৫] এবং এলো সে অবেলায় [১৯৯৪]।

৯. শামসুর রাহমান বাংলাদেশের কবিতায় ক্যাটালগিং বা তালিকাপাতী কবিতার সূচনা করেন। সৈয়দ শামসুল হক আরেকটু এগিয়ে বলতে চেয়েছেন, রাহমানের হাতেই সমগ্র বাংলা কবিতায় প্রথম ক্যাটালগিং কবিতার সূত্রপাত হয়। তিনি বলেন, ক্যাটালগিং এর ধারায় শামসুর রাহমানের দুঃখ কবিতাটিই প্রথম বাংলা কবিতা। [সৈয়দ শামসুল ২০১৬ : ২৭]

১০. রাহমান বাংলা কবিতাকে সাধারণের মধ্যে নামিয়ে এনেছেন, একথা বলার সময় আমাদের একথাও স্মরণ রাখা দরকার যে, চল্লিশের দশকের সমাজবাদী বা মার্ক্সিস্ট কবিরাও একই কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁদের সাথে রাহমানের পার্থক্য হচ্ছে, রাহমান এই কাজটি করেছেন শুধু রাজনীতিতে ভর করে নয়। সার্বিকভাবে কবিতার ভাষা, ভাব আর আঙ্গিকের প্রশ্নেই তিনি এই কাজটি করেছেন। বিশেষ মতাদর্শে লীন না হয়েই সামগ্রিকভাবে কবিতাশিল্পকে সাধারণের পাঠের আওতায় নিয়ে এসেছেন।

১১. রাহমানের ভাষা কিছুতেই আল মাহমুদের কবিতার ভাষার অর্থে লোকাল নয়। রাহমানের ভাষা গ্রামবাংলাকে আলিঙ্গন করে না। রাহমান মূলত শব্দচয়ন আর অনুষঙ্গ চয়নেই চকিতে শেষ হয়ে যান। কিন্তু ঢাকার প্রমিত কথ্য বাংলার যে একটা আটপৌরে রূপ আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার দেখি তাঁর কবিভাষায়। গ্রামীণ শব্দ তিনি বেশ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তা জীবনযাপন পদ্ধতি আর তার আবহসুদ্ধ নয়। রাহমানের চেতনাটা বরাবরই নাগরিক বা নাগরিক ধাঁচের।

১২. রাহমানের কবিভাষার মধ্যকার যে-লোকাল ভঙ্গির কথা বলেছি, এটাকে ঢাকাই বলব না কি পূর্ব বঙ্গীয় বলব! বোধ করি এটার মধ্যে একটা ঢাকাইয়া ব্যাপার আছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষার মতো। কিন্তু ইলিয়াসের ভাষায় এটা যত র রাহমানের ভাষায় ততটা নয়। কারণ, রাহমান মূলত মূলধারার ভাষাকেই কেন্দ্র করে নিজস্ব কবিভাষাকে দাঁড় করিয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকা তাঁর মর্মে আসন পেতে ছিল। তাই ঢাকার বাকভঙ্গি এবং আরবি-ফারসির গন্ধ ও প্রতাপ ঢুকে গেছে। কিন্তু কোন আরবি-ফারসি শব্দ? যেগুলো ঢাকাইয়ারা প্রতিনিয়ত মুখের ভাষায় ব্যবহার করে। ঢাকার চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকের শিক্ষিত, বিশেষত অভিজাত, এমনকি সাধারণ মানুষ তার জবানে যে-ভাষা ব্যবহার করে রাহমানের কবিতার ভাষার সাথে ওই ভাষার একটা গভীর আঁতাত আছে বলে মনে হয়। হুমায়ুন আজাদ [২০১৪] অবশ্য তাঁর এক পর্যবেক্ষণে দাবি করেছেন অপ্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দের পরিমাণ রাহমানের কবিতায় দিনকে দিন বেড়েছে। [হুমায়ুন ২০১৪ : ২১৭-২১৮]

১৩. সৈয়দ শামসুল হক তাঁর মহান সতীর্থ শামসুর রাহমান গ্রন্থে দাবি করেছেন যে, রাহমান বাড়িতে জন্মকাল থেকে বলে এসেছেন পুরোনো ঢাকাবাসীদের জবানে প্রচলিত উর্দু, অথচ কবিতা লিখেছেন বাংলায় ...। আসলে পুরান ঢাকাবাসীদের মুখে যে ভাষাটি চালু ছিল এবং বর্তমানেও আছে তা উর্দু নয় বলে ভাষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এই ভাষাটির নাম সোব্বাসি ভাষা

১৪. উর্দুর অপভ্রংশ যে-ভাষাটি পুরান ঢাকার মানুষের মুখে মুখে ব্যবহৃত হয় সেই ভাষাটিই আসলে সোব্বাসি ভাষা

১৫. হুমায়ুন আজাদ অবশ্য তাঁর শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা [২০০৮] গ্রন্থে রাহমানের কবিতায় ব্যবহৃত কিছু আরবি-ফারসি শব্দের অব্যর্থতা সম্পর্কেও আলোকপাত করেছেন। কিন্তু আরবি-ফারসির অধিক সন্নিপাতকে তিনি রাহমানের কবিতার জন্য ক্ষতিকর বলে সাব্যস্ত করেছেন।

১৬. হুমায়ুন আজাদ তাঁর বিদ্যাসাগর বিষয় এক রচনায় বিদেশি শব্দ বলতে মূলত আরবি-ফারসি শব্দকেই বুঝিয়েছেন। [দ্রষ্টব্য হুমায়ুন আজাদের নির্বাচিত প্রবন্ধ [১৯৯৯] গ্রন্থের বাংলা গদ্যচর্চা ও বিদ্যাসাগর প্রবন্ধ। 

সহায়কপঞ্জি

আবদুল মান্নান সৈয়দ [১৯৮৮], বাংলাদেশের সাহিত্য, [সংকলন উপবিভাগ কর্তৃক সংকলিত], বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
আবিদ আনোয়ার [২০১৫], আমাদের আধুনিক কবিতার দুই দশক : বরেণ্য কবিদের নির্মাণকলা, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল [২০০১], আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল [২০১০], ‘শামসুর রাহমান’, শামসুর রাহমান স্মারকগ্রন্থ [সম্পা. শামসুজ্জামান খান ও আমিনুর রহমান সুলতান], বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
কুদরত-ই-হুদা [২০২০], ‘সে ভাষা ভুলিয়া গেছি : প্রসঙ্গ জসীমউদ্দীনের কবিতা’, বাংলা একাডেমি পত্রিকা, ৬৪ বর্ষ, প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা, জানুয়ারি-জুন ২০২০।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী [২০১০], ‘পরিচয়ের পঞ্চাশ বছর’, শামসুর রাহমান স্মারকগ্রন্থ [সম্পা. শামসুজ্জামান খান ও আমিনুর রহমান সুলতান], বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
বেগম আকতার কামাল [২০১৪], শামসুর রাহমানের কবিতা : অভিজ্ঞান ও সংবেদ, কথাপ্রকাশ, ঢাকা।
মোহাম্মদ আজম [২০২০], কবি ও কবিতার সন্ধানে, কবিতাভবন, ঢাকা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৪১৪], চিঠিপত্র, ষোড়শ খণ্ড, পুনর্মুদ্রণ, বিশ্বভারতী, কলকাতা।
শহীদ কাদরী [২০০৬], ‘শামসুর রাহমান : শিল্পে শহীদ’, কালি ও কলম [সম্পা. আবুল হাসনাত], শামসুর রাহমান স্মরণ সংখ্যা, তৃতীয় বর্ষ, নবম সংখ্যা, ঢাকা।
শামসুর রাহমান [২০০২], কবিতা এক ধরনের আশ্রয়, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা।
শামসুর রাহমান [২০০৭], কালের ধুলোয় লেখা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা।
শামসুর রাহমান [২০১২], কবিতাসমগ্র ১, তৃতীয় মুদ্রণ, অনন্যা, ঢাকা।
শামসুর রাহমান [২০১৭], শামসুর রাহমান রচনাবলি, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
হুমায়ুন আজাদ [১৯৯৯], নির্বাচিত প্রবন্ধ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।
হুমায়ুন আজাদ [২০০২], বাঙলা ভাষা প্রথম খণ্ড, সংশোধিত দ্বিতীয় সংস্করণ: দ্বিতীয় মুদ্রণ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।
হুমায়ুন আজাদ [২০০৮], শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা, দ্বিতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় পুনর্মুদ্রণ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।
সৈয়দ শামসুল হক [২০১৬], মহান সতীর্থ শামসুর রাহমান, চৈতন্য, ঢাকা।