মেঘের আড়াল
দিঘির স্থিরজলে কবে যেন নিজের মুখ আর মেঘের চিত্রকলাকে মিলেমিশে দেখেছিলাম, ঠিক মনে পড়ছে না। তবে এটা ঠিক যে, এক অন্তহীন অনুসন্ধান আমাকে এমন জাদুকরি সময়গুলোতে তীব্রভাবে তাড়িত করে। জলের দিকে তাকিয়ে মেঘের ছবির ভেতর দিয়ে এক আর্শ্চয নীরবতা জাল বুনে যায়। সে নীরবতার ভেতর নিজেকে অনুভব করে প্রশ্ন জাগে, তবে এই নিঃসঙ্গপ্রিয়তাই কি আমার গন্তব্য! অথবা এক ঘোরের ভিতর নিজের রূপকে দেখে প্রশ্ন জাগে, ‘তবে কি এই বাহ্যিক রূপের মানুষটাই আমি!’ নিজস্ব প্রকৃত রূপটিকে খুঁজতে খুঁজতে কখন যেন মেঘের ছায়া এসে আড়াল করে দেয় আমাকে। তখন আর আমার নিজেকে খুঁজে পাই না। বিহ্বলতা আর বিস্ময়ের খেলা নিয়ে মেঘ আমাকে আবিষ্ট করে রাখে। সকল ভিড় থেকে নিজেকে আলাদা করে, এক বিশাল নৈঃশব্দ্যের ভিতর মেঘের সঙ্গে, এক টুকরো আকাশের সঙ্গে গভীর অন্তরঙ্গতায় নিমগ্ন হতে থাকি।
কবি কালিদাস তাঁর মেঘদূত কাব্যে প্রাচীন নগরী, দেশ, মেঘ ও পর্বতের চিত্রকল্প এঁকেছেন নিপুণভাবে। রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত এক অভিশপ্ত যক্ষের বিরহগাথা বর্ষার উচ্ছ্বসিত আবেগের অনুভবে প্রেয়সীর কাছে বার্তা পাঠাচ্ছেন। সর্বকালের মানুষের অতলস্পর্শ বিরহ, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো মানুষেরা যেন আকাশের বুকে মেঘের যাত্রাপথকে অনুসরণ করছে। মেঘের দর্শনে কেন মনের ভিতর প্রেমের স্ফুরণ ঘটে, কেন এই নিবিড় উৎসবের প্রবাহ, কেন এক বিরহকাতর হৃদয় অন্য এক হৃদয়ের জন্য আকুল তা তিনি ছন্দোবদ্ধ করেছেন অপরিসীম বিরহবেদনার যন্ত্রণাবোধ থেকে।
নব মেঘ সন্দর্শনে সুখীদের ও সৌম্যমনে অন্যভাব সহসা ঘনায়
কন্ঠাশ্লিষ্ট কান্তা যার দূরে দূরে থাকে, দশা তার আর বুঝিবে কি হায়?
মেঘের কাছে যক্ষের মিনতি—মেঘদূতের যাত্রাপথে পড়বে এক খরস্রোতা রেবা নদী। শৈল পর্বতের নুড়ির ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা নদীটি হাতির গায়ে আঁকা এক মনোরম চিত্রলেখার মতো। চলার পথে মেঘদূত পাবে নতুন কদমের হলদে সবুজ বর্ণের বিকশিত হাসি। চলতে চলতে উজ্জয়িনীপুরের সৌধতলে দেখা পাবে সুন্দরী নারীদের। তাদের ব্যাকুল দৃষ্টির ভিতর দিয়ে মেঘদূতের হৃদয় ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে উঠবে।
মেঘদূতের যাত্রাপথের বর্ণনা এত মধুর আর উপভোগ্য যে, মেঘকেই মনে হয় জীবনের সারবত্তা। যা কিছু মুখর, অনুভূতিশীল, আর সময়ের তীব্র মূর্ছনা, অবচেতনের গন্তব্য, আদর-অপমান, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সকল বিন্দুকেই যেন বিশাল অবয়বে ব্যাপ্ত করে রাখে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্লেষণে—
মেঘদূতে যক্ষের বিরহ নিজের দুঃখের টানে স্বতন্ত্র হয়ে একলা কোনে বসে বিলাপ করছে না। বিরহ দুঃখেই তার চিত্তকে নববর্ষায় প্রফুল্ল পৃথিবীর সমস্ত নদনদী-অরণ্য-নগরীর মধ্যে পরিব্যাপ্ত করে দিয়েছে। মানুষের হৃদয় বেদনাকে কবি সংকীর্ণ করে দেখাননি, তাকে বিরাটের মধ্যে বিস্তীর্ণ করেছেন।
মেঘের সাহায্যে বার্তা পাঠানোর চিন্তাটির মধ্যে কি শুধুই আবেগ ছিল! আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, এক স্থির অবলোকন। যা শিল্প ও বিজ্ঞানের আয়নায় একাকার হয়ে মিশেছে। বায়ুমন্ডলের নানা স্তরকে ব্যবহার করে, জলে স্থলে মহাকাশে বার্তা পাঠানোর যে অবিশ্বাস্য আবিষ্কার আজকের পৃথিবীর সকল সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে দেবার দুঃসাহস দেখাচ্ছে, তার একটি ছোট্ট আভাস যেন ছিল দীর্ঘ বছর আগে লেখা এই সব নিবিড়কাব্যে।
মেঘনাদবধ কাব্যে মেঘনাদ যুদ্ধ করতেন মেঘের আড়াল থেকে। রামায়ণের রাবণপুত্রের মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যুদ্ধের কৌশল যেন অন্য এক আত্মপরিচয়কে উদ্ভাসিত করে। এই কৌশলে সে স্বর্গের রাজা ইন্দ্রকে হারিয়ে, ইন্দ্রজিৎ। মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধের আর্শ্চয কৌশল রামায়ণ ও মেঘনাদবধ কাব্যে কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে বিরাজিত সীমারেখাটিকে যেন এক রহস্যের দিকে নিয়ে যায়। প্রবল কৌতূহলী করে পাঠকের মননকে।
মেঘের ভিতর দিয়ে অদ্ভুত অলৌকিক উদ্ভাসন প্রত্যেক ব্যক্তিচেতনাতেই ম্যাজিকের মতো কাজ করে। বর্ষার কালো মেঘ, বা শরতের ছেঁড়া-ছেঁড়া তুলোর মতো ভেসে যাওয়া মেঘ, বা হেমন্তের দিগন্তে মেঘের অনেক রং আর বর্ণিলতা জীবনের তরঙ্গধারায় এমন তীব্র আলোড়ন তৈরি করে যে, তাকে উপেক্ষা করা দুঃসাধ্য। মানুষের কোমল মন শিকড়-বাকড় নিয়ে তাতে ডুবে যাবার আকাঙ্ক্ষায় তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। ভালোবাসা, বিরহ, সম্পর্ক, বিচ্ছেদ—সব মিলেমিশে মানুষের মনোজগতে অপার্থিব প্রতিক্রিয়া ঘটায়। মেঘের একটি ইশারাই যেন সমস্ত অনুভবকে উন্মুখ করে তোলে, বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে প্রতিদিনের রুটিন যাপন। মেঘের ঢেউয়ের ব্যাকুলতা যেন ব্যক্তির চেতনাকে এক ব্যাকুল বিস্ময়ে নিমগ্ন করে রাখে।
মেঘ নিয়ে লিখতে গিয়ে কিছু প্রিয় কবিতার কথা মনে পড়ছে—‘মেঘ সে বাষ্পগিরি, গিরি সে বাষ্পমেঘ,/ কালের স্বপ্নে যুগে যুগে ফিরি ফিরি/ এ কিসের ভাবাবেগ।’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছিন্নপত্রে মেঘের অজস্র রূপ দেখি। কবি শব্দের পর শব্দ গেঁথে অসাধারণ অনুভবে আর জীবনবোধে পূর্ব বাংলার প্রকৃতিতে মেঘের কথা লিখেছেন। সেসব লেখায় মেঘ যেন বিষণ্ন ভাটিয়ালি গানের মতো।
বুদ্ধদেব বসুর একটি কবিতা আমায় খুব টানে। কবিতাটির নাম ‘চিল্কায় সকাল’। চিল্কার হ্রদটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল দীর্ঘ বছর আগে। দক্ষিণ ভারতে যাবার সময়ে।
কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়,
কেমন করে বলি!
কী নির্মল নীল এই আকাশ,
কী অসহ্য সুন্দর!
যেন গুণীর কন্ঠে অবাধ উন্মুক্ত তান,
দিগন্ত থেকে দিগন্তে।
কেন চিল্কার সকাল বেলায় সর্বদর্শী কবিসত্তার ভিতর এমন কিছু বাক্যের ও অনুভবের স্ফুরণ ঘটে, আকাশের সব মেঘ নীল হয়ে কেন অপরিসীম ভালো লাগায় আবিষ্ট করে, তা সত্যিই রহস্যময়। কবিতাটির সামনে বসলে আজও সেই ভালো লাগার নিবিড় বোধে আচ্ছন্ন হয়ে থাকি। সমস্ত শরীরজুড়ে যেন নীল মেঘের নেশা হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে যায়।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের একটি কবিতা ‘কথা’। ‘তারপরও কথা থাকে;/ বৃষ্টি হয়ে গেলে পর/ ভিজে ঠান্ডা বাতাসের মাটি—/ মাখা গন্ধের মতন/ আবছায়া মেঘ মেঘ কথা/ কে জানে তা কথা কিংবা/ কেঁপে ওঠা রঙিন স্তব্ধতা।’ আবছায়া মেঘ মেঘ কথা—মায়াজাল বোনে স্নায়ুর গভীরে। এক মায়াবী দৃশ্যের ভিতর দিয়ে সেই অশরীরী মেঘকে দেখি। মেঘের অভিব্যক্তি ছাপিয়ে ওঠে অনেক প্রকাশের ব্যাকুলতায়।
জীবনানন্দ দাশের ‘অনেক আকাশ’ কবিতাটি আমাকে বৃষ্টির পরের আকাশের কথা মনে করিয়ে দেয়। বিকেলের শেষ আলোতে আধুনিক মানুষের আর্তনাদ যেন লুকিয়ে থাকে ওই সন্ধ্যার মেঘে। ‘গানের সুরের মতো বিকালের দিকের বাতাসে/ পৃথিবীর পথ ছেড়ে—সন্ধ্যার মেঘের রঙ খুঁজে/ হৃদয় ভাসিয়া যায়—সেখানে সে কারে ভালোবাসে!’
কবি রণজিৎ দাশের একটি কবিতা যার নাম ‘ইতিহাস’। ‘রাত্রির ঘননীল আকাশপথে অবিশ্রান্ত গতিতে উড়ে যাচ্ছে খন্ড খন্ড শাদা মেঘ।...বিরামহীন...যেন ’৪৭ সালের সীমান্ত পেরিয়ে আসা উদ্বাস্তুদের মিছিল। ঐ লম্বাটে মেঘটি আমার ঠাকুরদা, ঐ দ্রুতগামী মেঘটি আমার বাবা, ঐ পিছিয়ে পড়া ক্লান্ত মেঘটি আমার মা। অনেক রাতে ভেসে গেল সুঠাম, অভিজাত দুটি মেঘ পাশাপাশি—মনে হল নেহরু আর এডুইনা মাউন্টব্যাটেন।’
মেঘের অনেক রঙের ভিতর ইতিহাস, জীবন, কবিতা সবকিছুই রয়েছে। মেঘের কাছে পুরোনো সময় বা নতুন সময় বলে কিছু নেই। সেই রঙের দিকে তাকিয়ে আগ্নেয়গিরির মুখ খোলার মতো খুলে গেছে কবিদের হৃদয়। জ্বলন্ত লাভা টগবগ করে ফুটেছে। সৈয়দ শামসুল হকের ‘একুশের কবিতা’, আবুল হাসানের ‘অপরিচিতি’, আনিসুল হকের ‘৩২ নম্বর মেঘের ওপারে’, সিকদার আমিনুল হকের ‘সুলতা জানে’, জয় গোস্বামীর ‘মেঘবালিকা ও মেঘ’ নিয়ে লেখা কবিতাগুলো এক অসম্ভব মায়ায় শরীর, সত্তা ও প্রকৃতিকে দিয়েছে ব্যাপ্তি, মানব মনকে দিয়েছে মুক্তির আস্বাদ।
বোদলেয়ার অচেনা মানুষটিকে তুলে এনেছেন আকাশে, রূপান্তর করেছেন চলিষ্ণু মেঘে, মেঘমালায়। তিনি যেন হতে চান মেঘের মতোই ভ্রাম্যমাণ।
বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালবাসো তুমি?
আমি ভালবাসি মেঘ...চলিষ্ণু মেঘ...উঁচুতে...ঐ উঁচুতে...
আমি ভালবাসি আশ্চর্য মেঘদল!
কবিতার কথা লিখতে গিয়ে খুব সহজভাবেই এসে পড়ে চলচ্চিত্রের রসায়ন। কোনো কোনো চলচ্চিত্রের ভাষা ও পরিবেশ এমনই তীব্র যে তার আবেশ যেন নিয়ত ছুঁয়ে থাকে যাপনকালে। অপরূপ বিন্যাসের ভিতরে এমন একটি ছবির নাম ‘ড্রিমস’। ছবিটির পরিচালক জাপানের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়া।
ছবিটির শুরুতে আমরা দেখি অসাধারণ নীল আকাশে রঙধনুর নিচে চমৎকার রোদের ভিতর এক জাপানি বালক। সে ভয়ে ভয়ে এগোচ্ছে গভীর ফুলের বনের বর্ণিল শোভার দিকে। সেখানে এক ভয় আর রহস্যাবৃত খেঁকশিয়াল। পরিবেশ ও রঙের এক রহস্যময় সঙ্কেত, দৃশ্য ও নীরবতাকে মিলিয়ে দেয়। ছেলেটির মুখ থমথমে রাতের মতো, যেখানে সে ভীত। খেঁকশিয়ালদের সে দেখে ফেলেছে বনের গভীরে, আর প্রকৃতির এই গোপনীয়তা দেখে ফেলবার অপরাধবোধ তাকে তাড়িত করছে।
ড্রিমস ছবিতে পরপর অনেকগুলো স্বপ্নের প্রকাশ দেখতে পাই। পরের স্বপ্নটি হলো ‘দ্য পিচ অরচার্ড’। সব গাছের বিনাশের পর বৃক্ষহীন পৃথিবীতে আর কী অবশিষ্ট থাকে! পরের স্বপ্নে তুষারপাত। প্রতিটি স্বপ্নের ভিতর দিয়েই প্রতিফলিত হয়েছে মেঘের নানা রঙের আবেশ। কখনো নীল, কখনো ধূসর, কখনো সাদা। পরের স্বপ্নে রয়েছে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ আর ফুজি পর্বতের গায়ের চূড়ান্ত লাল রং। পুরো আকাশ তখন লাল। মানুষ ছুটছে, পালাচ্ছে।
তার পরের স্বপ্নে দেখা গেল ভিনসেন্ট ভান গঘকে। ‘ক্রো’ শিরোনামের গল্পের ভিতর দিয়ে হলুদ গমখেত, উড়ন্ত কাকেরা, গভীর নীলাকাশের মেঘের রঙের ভিতর, দৃশ্যের ভিতর থমকে স্থির হয়ে থাকি। প্রকৃতির এই মগ্নস্রোতের ভিতর বাজতে থাকে কোনো এক অদেখা সুর।
নাৎসি বন্দিশিবির নিয়ে নির্মিত ছবিগুলোর কথা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। কোনো গভীর কালো গহ্বরের ভিতর থেকে উঠে আসছে গ্যাস চেম্বারে, মানুষের মাংস পুড়ে যাওয়া ধোঁয়া। রাত্রি আর কুয়াশার অন্তরালে এই গণহত্যার কথা কেউ জানেনি সেদিন। বিশ্বযুদ্ধের শেষে বের হয়ে এল এই সত্য। শবদাহের চুল্লিগুলোর ভিতরের কালো ধোঁয়া ক্রমাগত কালো করেছে, আকাশের সাদা মেঘকে। মানবতার ক্ষান্তিহীন আর্তনাদ মিশেছিল ওই কালো মেঘে।
প্রখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ একটি অসাধারণ মনস্তাত্ত্বিক ছবি। ছবিটিতে রোদ, মেঘ আর কুয়াশায় মানুষের চরিত্রের গভীরের পরিবর্তনগুলো দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি। দার্জিলিংয়ের কুয়াশা, মেঘে ঘেরা আবহাওয়া, এর বিশালতার প্রভাব কীভাবে প্রাণের গভীরের গভীর সত্যকে অনিবার্যভাবে প্রকাশিত করে, এই ছবিটিতে এই বার্তাগুলোই রয়েছে।
তেমন ধারার আরেকটি চলচিত্র, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘তিতলি’। ‘মেঘ পিয়নের ব্যাগের ভিতর’ কত কী যে লুকিয়ে আছে। আমরা ছবিটির পরতে পরতে দেখি, মেঘের আলো-ছায়ার, আর কুয়াশার গভীর থেকে উদ্ঘাটিত হচ্ছে জীবনের অন্য আরেক রকম সত্য। জীবনের অন্য মানে, অন্য সারবত্তা। সম্পর্কগুলো ভেঙে যাবার তীব্র ঝাঁকুনি আমরা টের পাই, বিপরীত অনুভবগুলো আমাদের তাড়িত করে।
এই শতাব্দীতে মনে হয়, একমাত্র কালো মেঘের মতো মৃত্যুই বন্ধু। যেন সবকিছুই জন্মান্ধ, সর্বভুক। ঠিক এ রকম চিন্তা থেকে একটি পরাবাস্তবিক ছবির কথা মনে পড়ছে। ছবিটি স্প্যানিশ চলচিত্র নির্মাতা বুনুয়েলের। ছবিটি নির্মাণের সময়ে বুনুয়েল একদিন স্বপ্ন দেখলেন, ‘একটি মেঘ এসে চাঁদকে দুভাগ করে ফেলেছে’। যেন একটি রেজার ব্লেড দুভাগে স্লাইসিং করছে চোখের আইবলটিকে। ভাবনাটি তাঁকে এতই আলোড়িত করে, তিনি ছুটে যান তাঁর বন্ধু শিল্পী সালভাদর দালির কাছে। দালি তাঁর পরাবাস্তবিক ভাবনাকে যোগ করে, এই ছবির সংগে। ‘উন চিন আন্দালু’ নামে এই ছবি দুজনে মিলে তৈরি করেন। মেঘ নিয়ে পরবর্তীকালে বুনুয়েল আরও অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
আজকের জীবন বোধহীন, চেতনাহীন, সৃষ্টিহীন সময়। যান্ত্রিক মানুষ আরও বেশি অসহায়, আরও বেশি একা। কালো মেঘের দিকে তাকালে মনে হয় আমাদের যাত্রা যেন বিশাল অতল অন্ধকারমুখী। আবার শরতের অসাধারণ মেঘের খেলায়, মন ভুলে যায় সব অন্ধকার। জীবনের সবটুকু আলো তখন মুঠোর ভিতর। জীবনের সকল সত্য, সুন্দর আর অন্ধকারের ভিতর, প্রগাঢ় সৃষ্টি আর ধ্বংসের ভিতর—সর্বত্রই রয়েছে মেঘের সংকেত। তাকে ভালোবেসে, ভারহীনতার ঊর্ধ্বে যেতে চাই।