নূরুল হকের অপ্রকাশিত কবিতা
নূরুল হক [Nurul Haque]
বাংলা কবিতার ইতিহাসে কবি নূরুল হক লাবণ্য-উজ্জ্বল এক অনিবার্য নাম। ২০২১ সালের ২২ জুলাই অনন্তে মিশে যাওয়ার আগে কবিতায় তিনি সময় ও শান্তির ধ্যান ও পঙ্ক্তিমালা রেখে গেছেন। কবির লেখাগুলোই তাঁর আত্মপথের বিধান। এই যে অকূল পৃথিবী, অধরা পৃথিবী—তার সবটাই শান্তির পঙ্ক্তিমালায় তিনি রেখে গেছেন। শব্দের জগতে উন্মোচন করে দিয়েছেন জগতের মিহি আর মায়াবী ছায়া।
কবিতাকেই জীবনে প্রধান্য দিয়েছেন। যাপিত জীবনের আঘাত, অর্জন ও প্রজ্ঞানগুলোই ছড়িয়ে পড়ে কবির রক্তদানায়। সময় এবং সমাজ থেকে কবি কোনোভাবেই ফসকে যেতে পারেন না। হোক রাজনৈতিক, হোক অরাজনৈতিক প্রতিটা বিষয়কেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে কবিতায় নামাতে হয়। নূরুল হকের কবিতা তাই সময় ও যাপিত জীবনের অভিজ্ঞান।
একটা পরম দরদি ভাষায় জীবনের সৌন্দর্য ও অতলতাকেই স্পর্শ করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের মতে কবি দুই ধরনের: বিশ্বজগতের কবি এবং সাহিত্যজগতের কবি। বিশ্বজগতের কবিরা জগতের মূল প্রস্রবণ থেকে কবিতার সারবস্তু তুলে আনেন। আর সাহিত্যজগতের কবিরা কেবল রচনার কলাকৌশল ও আঙ্গিকের সমৃদ্ধি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। ভাষা ও শব্দ সুষমা, সাহিত্যতত্ত্বেই এঁদের মন ও প্রকৃতি। অন্যদিকে নূরুল হকের মতো বিশ্বজগতের কবিরা রক্তদানায় প্রবাহিত কথাকেই লিখতে থাকেন। শুধু কবিত্বের বিকিরণে তিনি সীমায়িত নন। একটা সহজ ও দরদি আবহ সৃষ্টির মাধ্যমে কবিতায় তিনি প্রতিদিনের চেনা জগৎকেই উপস্থিত করেছেন। অভিজ্ঞতার অপূর্বতায় তাঁর কবিতা জীবনের ছায়াতল। বাংলা কবিতার এই নির্জন কাব্যসাধুর ছোট ছোট দৃশ্যকল্প ও বর্ণনায় যেকোনো পাঠক নিজেকেই খুঁজে পাবেন। জীবনের সহজতায় প্রবেশ করতে করতে যে কারও মনে হতে পারে, এটা আমারই কবিতাশ্রম।
ষাটের দশকের সবচেয়ে গহিন ও নির্জন এই কাব্যসাধু প্রতিভা ঐশ্বর্যানুযায়ী স্বীকৃতি ও পরিচিতি পাননি। কবিতার বিচিত্র অভিজ্ঞান এবং ভাষার সহজতাই তাঁর শক্তি। এই শক্তিতেই তিনি নির্জনে থেকেছেন। নিজেকে চেনার একটা সহজ শক্তিও হয়তো কবিকে আড়ালে রেখেছে। কবিতার পথে থাকার ঘোরও হয়তো খ্যাতি-বিমুখতার অন্যতম কারণ। যাপিত জীবনের আঘাত, অর্জন ও প্রজ্ঞানগুলোই ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিতার রক্তদানায়। ২৫ নভেম্বর ১৯৪৪ সালে পূর্ব ময়মনসিংহ অঞ্চলের নেত্রকোনা জেলার বালালী গ্রামে। ২২ জুলাই ২০২১ সালে পৃথিবী থেকে প্রস্থানের আগে সেই বালাইল গ্রামে ফেরার অভিপ্রায়ে কবিতাও লিখেছেন ‘বালাইল যাব’। বাড়ির পুকুরপাড়ে ঘুমিয়ে আছেন কবি।
এই পাঁচটি অপ্রকাশিত কবিতা কবির সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘শাশ্বতের অন্তরাল’-এর পাণ্ডুলিপি থেকে গ্রন্থিত। গ্রন্থটি ২০২২ সালের বইমেলায় চৈতন্য থেকে প্রকাশিত হবে।
—ভূমিকা : সরোজ মোস্তফা
ঝলক
মাঝে মাঝে মনে হয়
আজকের দিনটাই
আমার যে বন্ধুময়তার দিন।
অথচ আমার কোনো
বন্ধুই তো
নেই।
সৌন্দর্য
সৌন্দর্য যেভাবে রাজি করায়
তোমাকে
সবকিছুতে,
ঠেলে দেয় অপ্রস্তুত অনিবার্যতায়,
গাছকে ফোটায়
পরিপূর্ণ ফুলে,
এক্কেবারে পাতার ঠোঁটের কাছে গিয়ে,
তাতে বোঝা যায়
সে যখন নিজেকে জানাতে দেয়
নিজ রূপে,
তখন তোমার তাকে না জেনে উপায় নেই।
না জেনে
উপায় নেই
গাছে পাখি-থাকা বনভূমি
যখন ঘেরাও করে
দলবলে
সর্বদিক থেকে।
নৈঃসঙ্গ্য
কবিতার আঙুলের মুঠি ধরে
সারাটি জনম হেঁটে
প্রতি মুহূর্তেই আমি
সয়ে গেছি নৈঃশব্দ্যের তোলপাড়।
কুঁড়েঘরে ছিন্ন চালার নিচে শুয়ে
একদিন মহাজীবনের শ্বাস নেব প্রাণে—
এ রকম ভাবনায় ঢোক গিলি কত,
আলো ও ছায়ার মাঝে দুহাতে চোবাতে থাকি
নির্জীব সময়।
বিচ্ছিন্ন বাতাসে
ভর দিয়ে
চলে আসে কাক
উড়ে যায় দূরের মন্থনে।
শুভ সকাল
তোমাকে দেখতে আসবে
একটি সূর্য
একটু পরেই,
কাকলি-শোভিত হয়ে,
ছোট্ট কুটিরের পাশে।
বলবে,
‘শুভ সকাল।
তুমি ভড়কে যেয়ো না, তৈরি থেকো।’
বালাইল যাব
পাখিগুলি গুনগুন করা
থামিয়ে দিলে,
পাতাগুলি পুচ্ছ নাচানো
হারিয়ে ফেললে,
গাছ থেকে ছায়া
করজোড়ে জবাব দিলে,
নদী থেকে ধারা
ফেরত গেলে,
পথে পথে কান্নাকাটি
মূর্ছিত হলে,
দুপুর বেলায় আগে
আমি বালাইল যাব,
আহা, বালাইল যাব
বাসে করে বালাইল যাব।