অস্তিত্ব আর প্রেমের মুখোমুখি রফিক আজাদ!
তুমি বেশ জেনে গেছো আমার স্বভাব:
পরবর্তী ভর্তির মতো আমিও অপ্রতিরোধ্য।
[আমিও অপ্রতিরোধ্য: রফিক আজাদ]
আশির দশকে ধানমন্ডির কাকলি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তাম। তখন ক্লাস থ্রি কি ফোর, ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। বিভিন্ন ক্লাসের ছেলেমেয়েরা একসাথে বসে পরীক্ষা দিচ্ছি। শিক্ষক নাম কল করছেন। নভেরা নামটি ডাকতেই দাঁড়িয়ে বললাম প্রেজেন্ট, প্লিজ। আমার পেছনে বেশ গোলগাল ফর্সা একটি মেয়ে, সেও বলল প্রেজেন্ট। এই নামের গন্ডগোল থেকে জানতে পারলাম, মেয়েটির নামও নভেরা। আর তার বাবা একজন কবি। তখনো কবি শব্দের তেমন কোনো অর্থ আমার মাথায় ঢোকেনি। এরপর আমার ক্লাসে পেয়ে গেলাম নভেরার ভাই ইয়াসির আরাফাত রাহুলকে। রাহুলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো। এরা দুজনেই কবি রফিক আজাদের ছেলে-মেয়ে। পড়ে জানতে পারলাম, উঁচু ক্লাসের লোপা আপাও কবির মেয়ে। নাইন/টেনে উঠে যখন বইমেলায় যেতাম, টিএসসির দুই পাশে উঁচু ভলিউমে কবিতার ক্যাসেট বাজতে শুনতাম। সেখানেই শুনি ‘ভাত দে হারামজাদা, না হলে মানচিত্র খাবো...’ আরও কিছু অসাধারণ কবিতা। ক্যাসেট কিনে এনে দিনরাত শুনতে লাগলাম রফিক আজাদসহ আরও কয়েকজনের কবিতা। সেই থেকে এই প্রতিভাবান কবির লেখার সাথে পরিচয়, তারপর ধীরে ধীরে সমসাময়িক শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরীসহ অনেকের কবিতার সাথেও সখ্য গড়ে উঠল। খুব বেশি কমিউনিকেটিভ বলেই হয়তো তিনি আলাদাভাবে মনে দাগ কেটেছেন।
টাঙ্গাইলের জাহিদগঞ্জে এই গুণী কবির জন্ম ১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা থেকে স্কুল-কলেজের পাঠ চুকিয়ে কবি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। সেখান থেকে স্নাতকোত্তর সমাপ্ত করেন। তারপর কবির দীর্ঘ কর্মময় জীবন সেই সাথে কবিতার পৃথিবীতে সন্তরণ। কাগমারী এম এম আলী কলেজের শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করে শেষ করলেন নেত্রকোনার বিরিশিরিতে অবস্থিত উপজাতীয় কালচারাল একাডেমিতে পরিচালকের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। মাঝে ১৯৭২-১৯৮৪ পর্যন্ত সময়ে বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকার পত্রিকার নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর রোববার পত্রিকায় ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের পদে কিছুদিন ছিলেন। বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের সাথেও কিছুদিন যুক্ত ছিলেন। মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের। এ তো গেল কবির পেশাগত জীবন। কিন্তু কবিতার শুরু শৈশবে এবং দিনে দিনে তাঁর কবিতা পৌঁছে গেছে সত্যিকারের কবিতার পৃথিবীতে। রফিক আজাদ এমন এক কবি, যিনি একই সাথে দ্রষ্টা এবং কবি। জীবনকে তিনি দেখেছেন নিজস্ব এক ভঙ্গিমায়, ভালোবেসেছেন গভীর অনুপম এক আনন্দ ও বেদনাবোধ থেকে। ভালোবেসেছেন প্রকৃতিকে, মিশে গেছেন তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। উন্নয়নের প্রয়োজনে না বুঝেই মানুষ সাঁড়াশি দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলেছে এ বসুন্ধরাকে। কবি তাতে আহত হন, ব্যথিত হন। কবির মনে প্রশ্ন জাগায় সোনালি কাঁকড়ার দাঁড়া, যাকে ঘিরে সময় বয়ে চলেছে। মানুষের লোভ আর বাসনার বলি হয় প্রকৃতি আর সেখানে সোনালি কাঁকড়ার দাঁড়া খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সভ্যতার উল্টো পিঠে। কবির চুনিয়া এক ছোট গ্রাম, যে এই প্রাণঘাতী মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে একখণ্ড জ্বলজ্বলে তারা হয়ে জ্বলছে। তথাকথিত সভ্যতার হিংস্রতা ছোঁয়নি চুনিয়াকে, সেখানকার মানুষদের। এখান থেকেই হতে পারে নতুন যাত্রা, এই হচ্ছে কবির অভিপ্রায়। অন্তরঙ্গে সবুজ সংসার, আগাছার কাহিনি, নবীন কাঠুরের উক্তি এই সব সম্ভাষণের আড়ালে কবি জেগে ওঠেন কুয়াশার ধূম্রজাল ভেদ করে। তিনি এমন এক শক্তিমান কবি, যিনি ভালোবাসার বহুমাত্রিকতায় বিশ্বাসী। তিনি জানেন, সব ফুরিয়ে গেলেও জানালায় জেগে থাকবে একটি তাজা ভোর, একটি কাকাতুয়া। মাধবীর গোপন ভালোবাসায় তিনি আয়ু পুঁতে রাখেন আর এক পলকের অবহেলায় তিনি হয়ে ওঠেন বাঙ্ময়। নীরবতা, হ্যাঁ, একমাত্র নীরবতার মাঝে তিনি খুঁজে পেতেন প্রচণ্ড মুখরতা।
ঢাকা শহরের ষাটের দশক। ছিমছাম শহর, ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনা, পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর নিষ্পেষণ, অপমান, বৈষম্য। রাজনৈতিক অঙ্গনের ক্ষোভ, পুরোনো অচলায়তনকে ভেঙে নতুন এক সবুজ আর্কেডিয়া তৈরির স্বপ্ন মানুষের মনে। এই রকম একটি ক্রান্তিকালে কবি, সাহিত্যিকেরাও নিজেদের ভেতরের উত্তেজনা, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পরাহত হতে দেখে হতাশায় নিমজ্জিত হন, সারা বিশ্বে তখন আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছেন লেখক, কবি ও শিল্পীরা। বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব বাংলার কবিদের মধ্যেও আলোড়ন, সেই সাথে ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারের শহরের ফ্যাকাসে নারী মুখ মজ্জায়। সবকিছু ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ার প্রত্যয় কিন্তু না পারার যন্ত্রণা বাংলার কবিদের করে তোলে হতাশাবাদী। তাঁরা কিছুদিন স্যাডনেসকে আশ্রয় করেন। আর এই মতবাদের নেতৃত্বে ছিলেন কবি রফিক আজাদ। তাঁর লেখা ইশতেহার–
We are poisoning us continuously. We are bearing dynamites in our blood. We have no other alternatives except. SELF DESTRUCTION. We are guilty. We have no friends. We have faithful friends CIGARETTE.
We are not sex-driven youth. We are faithful to ourselves and our sadness.
What do we want? Nothing. Nothing. Nothing. We want nothing from our bloody society. We are exhausted, annoyed, tired and sad.
এই রকম চরম বিক্ষুব্ধ এবং হতাশাপূর্ণ দ্বান্দ্বিক মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে লিখতে থাকেন সে সময়ের কবিরা। ঝকঝকে রোদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে এক একজন তুর্কি তরুণ কবি-যোদ্ধা, লেখকেরা। রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, হুমায়ুন কবির, সিকদার আমিনুল হকসহ বহু কবি, লেখক। কখনো তাঁরা গুলিস্তানের রেক্স রেস্তোরাঁয়, কখনো নবাবপুরের আরজু হোটেলে, কখনো লিবার্টি হোটেলে, কখনো মধুর ক্যানটিন, প্রহ্লাদ সাহার শিরীষ দাস লেনের বিউটি বোর্ডিং। নিউ মার্কেটেও চলত আড্ডা। হুমায়ুন আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, অসীম সাহা, শহীদ কাদরী—সবার সাথেই চলত রফিক আজাদের লাগামহীন আড্ডা। আরও আরও বহুজন। সময়টা ছিল বিক্ষুব্ধ, কিন্তু সবার মনে নতুন দিনের স্বপ্ন। সাহিত্যচর্চার জন্য উপযোগী। পড়া আর লেখা—দুটোতেই তারা সে সময়ে মনঃসংযোগ করতে পারতেন আর সেই সাথে জীবন-জীবিকা। এখনকার মতো অন্তর্জালের যুগ নয়। রফিক আজাদ সব সময় আড্ডার মধ্যমণি থাকতেন, তার বৈঠকি ঢঙের কথা বলা ও নানা বিষয়ের আলাপ সবাইকে চাঙা করে রাখত। শহীদ কাদরীও আড্ডাকে মাতিয়ে রাখত বিদেশি সাহিত্যের খোঁজখবর বন্ধুদের কাছে পৌঁছে দিয়ে।
রফিক আজাদের জীবন এবং কবিতা—দুটোই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নানা ধরনের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চলেছে জীবিকা ও লেখার কাজ। জীবন ও জীবিকা তাঁর লেখাকে প্রভাবিতও করেছে। সেই সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা ভাঙা-গড়া, অনুভূতি, প্রেম-দ্রোহ। এই সবকিছুই কবিতায় জায়গা করে নিয়েছে, জীবনের প্রতিটি বাঁক উঠে এসেছে কবিতায়।
প্রথম দিকের লেখায় প্রেম-প্রকৃতি একাকার হয়ে আছে। শতছিন্ন কাঁথায় বসে অবাস্তব স্বপ্নের বিন্যাস ঘটিয়ে চলেছেন কবি।
গর্ভিনী নারীর মতো মনে-প্রাণে প্রতীক্ষায় আছি।
দ্বিধা-দ্বন্দ্বে, কম্পিত হৃদয়ে প্রতিটি মুহূর্ত কাটে—
সূর্যোদয়: সুখ স্বপ্নে; দ্বিপ্রহর: গভীর উদ্বেগ;
[কায়-মনে তৈরি হয়ে আছি, রফিক আজাদ]
কবি সময়ের প্রতিচ্ছবি। একটি সময়কে সে ধারণ করে তার কোনো কবিতার স্তবকে, আর ভঙ্গিটি নিজস্ব হওয়াও জরুরি। রফিক আজাদের মধ্যে তেমন একটি নিজস্ব ভঙ্গি তৈরি হয়েছিল। বেশ সাদাসিধে লেখা, কিন্তু পড়লেই বোঝা যায় এটি রফিক আজাদের কবিতা। তিরিশের কবিদের ধারাবাহিকতায় তিনি লিখেছেন কিন্তু পরে নিজস্ব এক ভাষার জগৎ তৈরি করেছেন। আর তিনি যে সময়ে লিখতেন, সে সময়ে কবিতার দিকপাল শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদের পদচারণায় মুখরিত বাংলা সাহিত্যের প্রাঙ্গণ। ছন্দের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বরাবর। অক্ষরবৃত্তে বেশি লিখেছেন। একটি কবিতায় সূচনা পর্ব থেকে শুরু করে সমাপ্তি এই ধরনের ধ্রুপদিধারায় লিখেছেন বেশির ভাগ কবিতা। বিষয়বস্তুর দিক থেকে প্রেম, প্রকৃতি, মানবিকতা, হতাশা, যন্ত্রণা, নির্মম বাস্তবিক জীবন কবিকে বেশি লিখিয়ে নিয়েছে। টাঙ্গাইলের আদিবাসীদের প্রতি কবি সহজাত প্রেম অনুভব করেন, হয়ে ওঠেন মানবিক ও পরিবেশ সচেতন। চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া তাঁর একটি মহান সৃষ্টি, যেখানে বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে নিপাত শান্ত আদিবাসী গ্রাম-মানুষ-জীবন। যারা হিংসা করে না, রক্ত দেখে নাই তেমন জীবন।
সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে গ্রন্থে ‘ভাত দে হারামজাদা’, ‘মানুষেরা বড় ভয়াবহ প্রাণী’, ‘নৈরাশ্যবাদীর উক্তি’ এই শিরোনামের কবিতাগুলোতে বাস্তবতার ভয়াল রূপটি তিনি তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে, বাক্যে বাক্যে অভুক্তের আর্তনাদ। পেটের ক্ষুধা না মিটলে ছেড়ে দিতে চেয়েছেন অন্য সব ক্ষুধাকে। যৌন ক্ষুধা, আরাম-আয়েশ এমনকি ক্ষুধার্তের চাহিদা না মিটলে দেশে, রাষ্ট্রে দজ্ঞযজ্ঞ কাণ্ড ঘটিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়েছেন কবি। তখন থাকবে না তাঁর কোনো দায়দায়িত্ব, নিয়মের বালাই। সামনে যা কিছু পাবেন, তার সবই গলাধঃকরণ করবে সে অভুক্ত। গাছপালা, নদীনালা, গ্রামগঞ্জ, পথচারী, খাদ্যমন্ত্রী এবং তার গাড়ি—সবই চলে যাবে ক্ষুধার্তের পেটে। সর্বোপরি সে তার নিজের অস্তিত্বকেই খেয়ে ফেলবে অর্থাৎ মানচিত্রকেও খেয়ে ফেলবে, মুছে দেবে নাম-পরিচয়। কবি এখানে অত্যন্ত দক্ষতা এবং নির্লিপ্ততার সাথে প্রকৃত ক্ষুধার্তের মনের ইচ্ছাকে কবিতায় প্রকাশ করেছেন।
আপাতভাবে অ্যাজেন্ডাধর্মী মনে হলেও এ কবিতায় কবি সে ধরনের বৈশিষ্ট্যের বাইরে এসে ভাষার, দৃশ্যকল্পের আর অনুভূতির এক অসাধারণ মাত্রা তৈরি করেছেন। যেখানে বিশ্বের সর্বহারা, ক্ষুধার্ত, লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখা যায়। যেখানে কবি একটি কবিতার মধ্য দিয়ে একটি বিপ্লবকে সমাপ্ত করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ কবিতায় তিনি অত্যন্ত সৎ ও নির্ভীকতার সাথে একটি শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের নানা ভান-ভণিতা, নিয়ম-সংস্কার এসবকেও তিনি এ কবিতায় অগ্রাহ্য করেছেন। একজন সত্যিকারের ক্ষুধার্তের প্রকৃত চিত্রকল্পই এঁকেছেন। আর এখানেই কবি ব্যতিক্রম। কবিতার মতো এমন একটি সংযমী মাধ্যমে তিনি বিশিষ্ট একটি ফর্মকে নিয়ে কাজ করেছেন, বদলে দিয়েছেন তার ভাষা, বিষয় এবং অন্তস্থ অর্থময়তাকে। এই কবিতাটিকে যদি রূপকধর্মী হিসেবে দেখা হয়, তাহলেও যেকোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি ক্ষুধার্তের যেমন অনুভূতি হতে পারে, তা এখানে মূর্ত। একজন শিল্পী, গায়ক, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী মানুষের মনের ভেতর যেসব ক্ষুধা, চাহিদা রয়েছে তা পাওয়ার জন্য যে আকুতির জন্ম হতে পারে, তাকেও এ কবিতার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হতে দেখা যায়। সে জন্য বলা যায় ‘ভাত দে হারামজাদা’ প্রকৃত ক্ষুধার্তের একটি অনন্য দলিল। মানুষকে তিনি মাছিদের সাথে তুলনা করেছেন ‘মানুষেরা বড় ভয়াবহ প্রাণী’ কবিতায়। মানুষেরা মাছিদের মতো শুধু ক্ষতস্থান খোঁজে, মনুষ্য চরিত্রের খুঁত, দুর্বলতা এসবকে শনাক্ত করেছেন ঋণাত্মক স্বভাব হিসেবে। মাছির মতো মানুষেরা মারণ আঘাত মারে, বাছা বাছা শব্দ ছুড়ে মারে, তাতে কবি আহত হন, শবাহত হন। কিন্তু নিজে থাকেন ক্ষমাপরায়ণ।
গহন অরণ্যে আছি—মানবিক সংগঠন থেকে
দূরে, বহু দূরে;— যদিও বা এ দূরত্ব মানসিক
ভারসাম্যতায়,— বিশাল সমুদ্র নয় কোনো দ্বীপ,
শ্বাপদ-সংকুল আফ্রিকার প্রকৃত আঁধার নয়—
আদিগন্ত মরুভূমি নয়—মনের বাস্তব জুড়ে
মাইল-মাইলব্যাপী অনাবাদি আরণ্যক ভূমি।
[নৈরাশ্যবাদী উক্তি: রফিক আজাদ]
‘নৈরাশ্যবাদী উক্তি’ শিরোনামের কবিতায় কবি নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করেছেন তবে তা মানসিক ভারসাম্যময়। মাইল মাইলব্যাপী অনাবাদী আরণ্যক ভূমি। নিজেকে তিনি বর্ণনা করেন এভাবে, ‘আমি তো মানুষ নই, মানবিক নই মোটে আর তোমাদেরই স্বার্থে আজীবন অন্ধকারে রেখে দাও।’ নিজের মানবিক বোধ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন কবি। গ্রেনেডের মতো ক্রোধে ফেটে পড়ে প্রাসাদ ধ্বংসের হুমকিও দেন কবিতায়। কবি রফিক আজাদের কবিসত্তা বহুধা বিভক্ত। প্রেম, দ্রোহ, ক্ষুধা, যন্ত্রণা, প্রকৃতি, নৃশংসতা—সবকিছুকে কবি নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন।
আমার স্বপ্নের ঠিক উল্টো দিকে
যে বাড়ি রয়েছে
সেটি কার বাড়ি—সেকি তবে বাড়ি নয়
স্বপ্নের ভেতরে কোনো স্থির
সোনালী কাঁকড়ার দাঁড়া?
বাড়িটির ভেতরে যারা বাস করে
সুখী তারা খুব?
পৃথক মানুষ বটে, জানে নেই গোত্র পরিচয়,
সুখী তারা খুব ওই স্বপ্নের মহলে?
[পরাবাস্তব বাড়ি]
এই যে স্তবকের পর স্তবক জীবন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন কবি, তা কি খুব বেশি কল্পনা? দূর থেকে দেখা সুখী জীবনের ভাজে লুকিয়ে থাকে দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা। তাকে খুব সহজে দেখা যায় না, অনুভব করা যায় না। পরাবাস্তব ওই বাড়িটিকে কবি স্বপ্নে দেখেন।
বিরিশিরি পর্ব গ্রন্থে ‘মরে যাবো ঝরে যাবো থেকে অপার অরণ্যে’ বেশির ভাগ কবিতায় নিঃসঙ্গ কবির আর্তনাদ শুনতে পাই। শহরের কোলাহল থেকে অতি দূরে সোমেশ্বরীর তীরে বিরিশিরি গ্রামে কবি এক নির্বাসিত জীবন যাপন করেন। তার পাশে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, বন্ধু কেউ নেই। প্রচণ্ড আবেগি, আড্ডাবাজ কবির কাছে এই একাকিত্ব ছুরির ফলের মতো বেঁধে। তাই তো কবিকে বলতে শুনি—
দেবে কি আমাকে নির্বাসন?
নতুন ঘটনা নয়, নির্বাসিতজন
জন্মের মুহূর্ত থেকে নির্বাসিতজন
দাঁড়াবে কি নতুন এ নির্বাসনে অপর অরণ্যে।
হৃদয়ের কি বা দোষ গ্রন্থে ছোট ছোট দ্বিপদী, অনেক শের লিখেছেন কবি। মির্জা গালিব, মীর ত্বকি মীরের মতো নিঃসঙ্গতা আর যন্ত্রণাময় হৃদয়ের কথা শোনা যায় সেই শেরগুলোতে।
তেলহীন সলতেটুকু পুড়ছিতো শেষ রাতে,
রফিক, ঊষার আলো ভাগ্যে নেই তোর।।
—
হৃদয় উজাড়? হৃদয়ের কি বা দোষ?
উজাড় হতেই তো সে সর্বদা উন্মুখ।।
—
সামান্য আলোর জন্য
জ্বালাই মোমবাতি
কে জানতো—
পোড়াবে সে ঘরটি আমার?
কবি রফিক আজাদ একদিকে যেমন শত যন্ত্রণা হতাশায় ক্লান্ত আত্মা, তেমনি তিনি প্রেমময় এবং জেগে ওঠেন প্রেমের স্পর্শে। একটি দুপুর কবিতায় লেখেন—
চুম্বনে ও আলিঙ্গনে কাঁপে সিক্ত মিলন-মুহূর্ত—
মাধুর্যের সবটুকু তোমার শরীর, প্রাণমনে,
মাংসে ও মজ্জায় মিশে আছে—এই অভিজ্ঞতা খুব
জীবন সঞ্চারী
[একটি দুপুর]
এই যে প্রেম ও কামের মিশেল একে কবিতার ভাষায় অতি চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। নারী রফিক আজাদের কাছে স্বদেশ এবং মানবতার প্রতিচ্ছবি। কবি রফিক আজাদকে নিয়ে স্বল্প পরিসরে লেখা খুব কঠিন, তার মতো বিশাল ক্যানভাসে খুব কম কবি লেখেন। আমরা এখনো তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই বাংলা কবিতার আনাচে-কানাচে, সর্বত্র। কবি যেন নির্ঘুমভাবে লিখে চলেছেন আরও শত শত অধরা কাব্য।