রাষ্ট্রব্যাকরণ মুক্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

আফসানের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবোধ অবিরাম দেশজ; তাই লাগাতারভাবে জাতীয়তাবাদী প্রকল্পকে ভণ্ডুল করে দিতে সক্ষম। দেশ আর রাষ্ট্রের এই সম্বন্ধটা অতীব গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা কখনোই করা হয়ে ওঠেনি বিদ্যাজগতে, সাহিত্যজগতে কিংবা রাজনীতিজগতে। বরং দেশ কোথায় প্রশ্নগুলো জনসমাজে উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই প্রশ্নকারীর আধুনিক-প্রশাসনিক মানচিত্রের বোধের অভাব নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন মধ্যবিত্ত-শিক্ষিতরা। কিন্তু দেশকে দেখতে হবে দশের সম্মিলনস্থল হিসাবে। সেই অর্থেই আফসান দেশের ইতিহাস লিখতে থেকে গেছেন।

আফসান চৌধুরীর বইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় গ্রিক পুরাণের মতো অদৃষ্টতাড়িত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০৩ সালে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ, আফসান চৌধুরীর ছোটগল্প নিয়ে নিজের ইচ্ছাতেই লিখতে শুরু করি। আমার পরিচিত জীবনে একমাত্র ইংরেজি সম্পাদক তখন সবকিছুতেই দারুণ উৎসাহ দেন। এমনকি আমার আখাম্বা ইংরেজি মানুষ করতেও তাঁর কার্পণ্য ছিল না। উপরন্তু আফসান ছিলেন সেই সম্পাদকেরও প্রিয় লেখকদের একজন। প্রায় আড়াই দশক ধরে লেখা গল্পগুলো নিয়ে সেই গ্রন্থখানার ইংরেজি পর্যালোচনা বের হয় খাদেমুল ইসলাম সম্পাদিত ডেইলি স্টার সাহিত্যপত্রে। অনেক বছর বাদে ২০১৮-তে সম্ভবত, ওঁর উপন্যাস বিশ্বাসঘাতকগণ পুনঃপ্রকাশিত হয় ইউপিএল থেকে। পুস্তক প্রকাশ অনুষ্ঠানটি প্রকাশক আয়োজন করেছিলেন আলোচনা-অনুষ্ঠান দিয়ে। লেখকের বাছাই ছিলাম আমি। গভীর সম্মানিত আমি আফসান চৌধুরীর সঙ্গে সম্মুখালাপ করি বাতিঘরে। কপালগুণে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বই নিয়ে কিছু বলবার নিমন্ত্রণ আসেনি। ওই দীর্ঘ-গভীর-ভারী কাজ আমার পেশাগতভাবে পড়া লাগেনি। এ দফা তাঁর গবেষণাগ্রন্থ গ্রামের একাত্তর বইটি নিয়ে যে সম্পাদক নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তাঁর কোনোই ধারণা ছিল না আমার পূর্ববর্তী সংযোগগুলো নিয়ে। একে অদৃষ্টতাড়িত ছাড়া আর কী-ইবা বলা যেতে পারে! তাঁর লেখকজীবনের কপালে আমি অবধারিত হয়ে গেছি।

আফসান চৌধুরীকে পাঠ করতে গেলে তাঁর ইতিহাস গ্রন্থ থেকে উপন্যাস, মিডিয়া থেকে সমাজ-গবেষণামার্কা গ্রন্থসব একীভূতভাবে মাথায় রাখতে হয়। তবে এটা বাহুল্য কথা হলো। সকল লেখকের ক্ষেত্রেই তা হবার কথা। কিন্তু তিনি যে রকম সর্বভূতে বিরাজিত লেখক, তেমন খুব একটা সুলভ নয়। কিন্তু বাংলাদেশে কাউকে শংসন করাও খুব বিপদের কাজ। হিংসাবিদ্বেষ বাদ দিলেও, কাউকে কোনো একটা অভিধার মধ্যে আনার পর কাছাকাছি অভিধা আর কাউকে দিলেই ভক্তেরা ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফলে বলার সময় আমারও লক্ষ রাখতে হলো যেন কেউ ভেবে না বসেন যে আমি সৈয়দ হক সাহেবকে গদিচ্যুত করতে চাইছি। আমার বলার বিষয় হলো, তিনি উপন্যাসে ঠিক যে-যে ভাবনাসূত্র ধরে চিন্তিত ছিলেন, তাঁর গ্রামের একাত্তর-এও প্রায় অবিকল ভাবনাসূত্রই কাজ করেছে। দুয়ের ক্ষেত্রেই মাইক্রো-ইতিহাস আফসানের একান্ত চর্চিত-লক্ষ্যিত জায়গা। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা, প্রটাগোনিস্টকুল, ছিলেন পূর্বনির্ধারিত মার্ক্সবাদী এবং/বা বিপ্লবী সংগঠনগুলো থেকে আহরিত। আর এই গবেষণাগ্রন্থের নায়ক-নায়িকারা, পাত্র-পাত্রীরা, আরও আম আরও বহুবিধ পরিচয়মালাতে থাকতে পেরেছেন।

আফসান যে পাটাতন থেকে মুক্তিযুদ্ধকে অনুধাবন করেছেন, আসলে তাঁর সমগ্র জীবনেই, সেই পাটাতনটা নিয়ে আমার সত্তাশ্রয়ী/সাবজেক্টিভ যাত্রাপথকে আমি সামনে আনতে চাই। তাতে এটা প্রচলিত পর্যালোচনা-রচনা না হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আমি দুর্ভাবিত নই। বাংলাদেশের দ্বিবিভাজিত জাতীয় রাজনৈতিক মানচিত্র বিষয়ে আমার যতই বিরক্তি থাকুক, বাস্তবতা হলো প্রায় দুই দশকের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সিস্টেমেটিক নৈঃশব্দ্য আর গড়াপেটা-বিবরণী (ম্যানিপুলেটিভ ন্যারেশন) ছিল একদম মৌলিক। এমন একটা দশা ছিল যেখানে শিশুকিশোরেরা তাদের পাঠ্যপুস্তক থেকে উদ্ধারই করতে পারত না যে সংঘর্ষটা ছিল কাদের সঙ্গে। হানাদার বাহিনী নামক একটা ভূতের মতো প্রতিপক্ষ জানত তারা। তাদের পক্ষে পাকিস্তান কিংবা আরও বিশেষে রাষ্ট্রীয় মিলিটারি বাহিনীর প্রতিপক্ষতার আন্দাজ করাই মুশকিল হতো। অশিশু বয়স্ক মানুষজন যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরও জবান-অভিব্যক্তি যথাসম্ভব সতর্কতায় পরিচালিত হতো, যাতে মুখ ফসকে পাকিস্তানকে যথেষ্ট নিন্দা না করা হয়, যাতে যথাক্রমে শাসক জিয়াউর ও এরশাদের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে যেতে পারেন। ফলে এরশাদের পতনের পর যখন তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদ, লিয়ার লেভিনের ফুটেজ হাজির করলেন, চলচ্চিত্র আকারে, তখন সেটা একদম মুক্তবাতাসের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। অবশ্যই মধ্যবিত্তীয় পরিমণ্ডলে, অবশ্যই পাকিস্তানকে দোষারোপ করতে ইচ্ছুকদের মধ্যে। এই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তির পর মুক্তিযুদ্ধ-ইতিহাসচর্চাতে শ্রেণির প্রশ্ন, অন্ত্যজ মানুষের উপস্থিতির প্রশ্ন দু-চারজন ইতিহাস-প্রণেতা বা ভাবুক ছাড়া কারোরই মাথাব্যথার বিষয় ছিল বলে পরিলক্ষণ হয় না। আফসান সেই মানুষজনের মধ্যে যাঁদের ইতিহাসবোধ ৯০-এর এরশাদ-বিদায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি; কারণ ইতিহাস তাঁর কাছে পদ্ধতিগত মীমাংসা নিয়েই ছিল। একই ভাবে, মুক্তির গান দেখতে-দেখতে দু-চারজন দর্শক ভাবতে পারছিলেন মানুষের গল্প কই? এই কজনের ইতিহাসবোধের জন্য তখন আফসান প্রমুখ ছাড়া আর কেউ থাকেন নাই। এখন অবধি। আমি এ-ও মনে করি যে, কেবল নামকরণের মধ্য দিয়েও, আফসান গোড়াতেই চোখে-আঙুল দিয়ে নগর-মধ্যবিত্তের মুক্তিযুদ্ধের সৌধনির্মাণকারী বিবরণীচর্চার আত্মশ্লাঘার উন্মোচন ঘটিয়েছেন।  

বইটির অধ্যায় বিভাজন সুচিন্তিত অথচ আটপৌরে; এবং তাই দারুণ। খুব বেশি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইয়ে পাঠক ডাকাতকে বা বেঁচে যাওয়াকে শিরোনামে পাবেন না। এই দৈনন্দিনতাগুলোই এই গ্রন্থের, তথা এই দিকদর্শনের, পদ্ধতির মুখ্য পরিচায়ক। প্রথম অধ্যায় এক নজরে একাত্তরের গ্রাম দারুণ একটা সনাতনী ক্যামেরাপ্যানের মতো করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণ থেকে একবাক্যে ১৯৭০ সালের নির্বাচনী তৎপরতার সঙ্গে গ্রাম-স্পন্দনকে মিলিয়ে দিয়ে কোনো রকম ঝাঁকুনি ছাড়াই ঢুকে পড়েন তাঁর গ্রামদর্শনে। মহানগরকেন্দ্রিক ও মধ্যবিত্ত-শ্লাঘাকেন্দ্রিক মুক্তিযুদ্ধের বাইরে পা ফেলতে গিয়ে আফসানের এই নিস্পৃহ বিবরণীগুণ, নিস্তরঙ্গ প্রসঙ্গ-উত্থাপন মিলেমিশে বইটির বাঁধুনি তৈরি করেছে। এমনকি দাফন-সৎকারের ঘটনাটাও যেন বা ড্রোন ক্যামেরাতে দেখছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট কদাচিৎ নন, কিন্তু মমতাহীন নন আরও। এই রচনার স্বর খুব আলাদা তাঁর ছোটগল্প, উপন্যাস থেকে, যতদূর আমার মনে পড়ে। আফসানের রচনার খুঁটিনাটিত্ব বাংলাদেশের তদানীন্তন গ্রামগুলোকে এমন ছবির মতো নিয়ে আসে যেন বা আপনি উঠানে দাঁড়িয়ে, কিংবা গোয়ালঘরের পাশে, দেখছেন। কেইস-গল্পগুলো পরিমিত, আর সারা বইয়ে সংমিশ্রিতভাবে আছে। এই সংমিশ্রণকে আলাদা করে বলার কারণ আছে। খুব গুরুতর দক্ষ লেখকের বেলাতেও কেইস-হাজির করা প্রায়শই ভীষণ চ্যালেঞ্জিং একটা কাজ। তিনি কেইস-হাজির করেছেন কখনো কেইস না-জানান দিয়ে, আলগোছে। কখনো একটা শিরোনামের অধীনে কেইস-সাজানোতে আরাম পেয়েছেন; বিশেষত নারী নির্যাতন অধ্যায়ে। আবার কখনো কেইসের পদ্ধতিতেই, কিন্তু আরও ঘন-সংক্ষেপে, বিবরণীর মধ্যে নিয়ে এসেছেন কিছু উদাহরণ। আবার কখনো কেইসের মধ্যেই উপশিরোনাম দিয়ে আগিয়েছেন। পদ্ধতিগতভাবে ভাবলেও, কেইস যে কী বস্তু, তা মাস্টারি করতে গিয়েও বোঝাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। আফসানের এই বই অনায়াসে সেসব শিক্ষক ব্যবহার করতে পারেন, যাঁদের শিক্ষার্থীদের কেইস-প্রয়োগ শেখাতে কষ্ট হয়, বা নিজেরও হয়।

বইটির অধ্যায় বিভাজন সুচিন্তিত অথচ আটপৌরে; এবং তাই দারুণ। খুব বেশি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইয়ে পাঠক ডাকাতকে বা বেঁচে যাওয়াকে শিরোনামে পাবেন না। এই দৈনন্দিনতাগুলোই এই গ্রন্থের, তথা এই দিকদর্শনের, পদ্ধতির মুখ্য পরিচায়ক। প্রথম অধ্যায় এক নজরে একাত্তরের গ্রাম দারুণ একটা সনাতনী ক্যামেরাপ্যানের মতো করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণ থেকে একবাক্যে ১৯৭০ সালের নির্বাচনী তৎপরতার সঙ্গে গ্রাম-স্পন্দনকে মিলিয়ে দিয়ে কোনো রকম ঝাঁকুনি ছাড়াই ঢুকে পড়েন তাঁর গ্রামদর্শনে।

আবারও সত্তাশ্রয়ী হয়ে যাই। জন্মাবধি হিন্দু থাকাতে আমার পরিচয়ের এই অংশটার যাবতীয় ওজন-উত্তাপ টের পেতে-পেতে বড় হতে হয়েছে আমাকে। দৈবাৎ, আমার জন্ম ১৯৬৯-এ হওয়াতে ৭০-এর দশকে আমার শৈশব-কৈশোর না-কাটানোর উপায় ছিল না। ১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের সময় আমার বয়স নির্ধারণও আমার হাতে ছিল না। ফলত, তাঁতীপাড়ার নাম বদলে খাঁ-পাড়া বানানোর উদ্যোগগুলোকে শিশুকালে প্রশ্ন করে বসলে আমার পক্ষে আওয়ামী লীগের দালাল এমনকি ভারতের দালাল শিশু হয়ে পড়ার যাবতীয় উৎকণ্ঠা ও বিপদসমেত বড় হতে হয়েছে। এই দ্বিবিভাজিত বাংলাদেশে আমার হিন্দুত্বজনিত ইতিহাসকে কোন পাত্রে রাখা যেতে পারে, সেটা নির্ধারণ করাই একটা বেসম্ভব ব্যাপার ছিল। তার জন্য আরও শান্ত, আরও প্রজ্ঞাবান হতে হয়েছে; আরও পদ্ধতিগত মাথা অর্জন করতে হয়েছে। এবং তৎসত্ত্বেও তেমন কোথাও জিজ্ঞাসাগুলো রাখা যায়নি। আফসানের এই কিতাবখানা নিস্পৃহভাবে হিন্দুদের একাত্তরকে হাজির করেছে। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে তেমন না মিশলেও আমি জানি যে, তিনি সেই বিরল পরিবারগুলোর একটা থেকে এসেছেন যাঁদের পরিবার ১৯৪৭-এ তিন রাষ্ট্রে ছিটিয়ে গেছে। ব্যক্তি আফসানের ত্রিভাষী জীবনের সাথে ত্রিরাষ্ট্রীয় অভিজ্ঞতা তাঁকে আরও প্রাজ্ঞ বানিয়েছে। আর সে জন্যই আমি চেয়েছিলাম, ১৯৭১-কে দেখতে গিয়ে তিনি ১৯৬৫-এর যুদ্ধের অবধারিত্বকে বইটিতে আনবেন। আনেননি তিনি; অন্তত আমি ঠাহর করতে পারিনি।

বাংলাদেশে ইতিহাসবোধের সিংহভাগই প্রাক-১৯৪৭ সম্বন্ধে পারলৌকিক নিস্তব্ধতা বহন করে। যেনবা ১৯৪৭-এর আগে এই অঞ্চলটি তেমন কোথাও অস্তিত্বমান ছিল না। ভুস করে জেগে উঠেছে! কিংবা যদিও বা থাকে তা ছিল আবহমান কালে, কিংবা হাজার বছরে; মানে কালহীন। যেন বা ৬০-এর দশকের সেক্যুলার কর্মীটির আব্বাজান ৪০-এর দশকে মুসলিম পাকিস্তানের তথা মুসলিম লীগের অনুগ্রাহী ও কর্মী হিসেবে তৎপর ছিলেন না! যেনবা আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগের স্বপ্নের টুকরা কখনোই বহন করেনি! এই প্রাক-১৯৪৭ এর মতোই আরেকটা নিস্তব্ধতার কাল হলো ১৯৬৫-এর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ। যেনবা সেটা নিছকই অন্য দুটো অঞ্চলের বিষয়। যেনবা আমরা তার অক্ষতিগ্রস্ত শিশুদর্শক মাত্র। ছোটবেলার খেলাতে যাকে বলা হয় দুধভাত! শুনতে বেচক্কর লাগতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষিজ এবং অন্ত্যজ হিন্দুর জন্য ১৯৭১ ছিল ১৯৬৫ সালের সম্প্রসারণ মাত্র। এই বাস্তবতাটা আসলে কৃষিজ জীবনযাপনের যা অতীব মৌলিক সেই জমির অধিকার ও জমির বঞ্চনা দিয়ে বুঝতে হবে। ১৯৬৫-এর যুদ্ধটা হয়েছে এই দেশে। সেটা হয়েছে আফসান চৌধুরীর বইয়ের মলাটলিখনের ভাষায় বললে চিরচেনা প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরিতার প্রতিফলনে। হিন্দুর ১৯৭১ তাই আবশ্যিকভাবে হিন্দুর ১৯৬৫ সালের নিস্তব্ধ ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু আবারও, এই গ্রন্থকার নিস্পৃহ আটপৌরে স্বরে একটা বর্তমান কালের বিবরণী দেন, যা রাষ্ট্রানুগ ইতিহাসচর্চার, কিংবা মুখ্যধারার জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চার নগরকেন্দ্রিক বিরাট চিত্তে অনুপস্থিত থেকে গেছিল। ফলে এই বইতে ১৯৬৫-কে অনুধাবন না করার কারণে তাঁকে কাঠগড়ায় তোলা আমার আগ্রহ নয়; কিন্তু যদি কোনো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবিদ এই দুই যুদ্ধের সম্পর্ক নিবিড়ভাবে অনুধাবন করতে পারেন বাংলাদেশে, তিনি অনায়াসে আফসান। আমার অন্য বইটি পড়তে হবে যেটার নাম হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাত্তর। এই রচনাটির ফরমাশ না থাকলে আফসানের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আমার সাইবার-ছাঁকনি অভিযান দেওয়া হতো না। আর তা না দেওয়া হলে আমার ওই গ্রন্থটির নামও জানা হতো না।

আফসানের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবোধ অবিরাম দেশজ; তাই লাগাতারভাবে জাতীয়তাবাদী প্রকল্পকে ভণ্ডুল করে দিতে সক্ষম। দেশ আর রাষ্ট্রের এই সম্বন্ধটা অতীব গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা কখনোই করা হয়ে ওঠেনি বিদ্যাজগতে, সাহিত্যজগতে কিংবা রাজনীতিজগতে। বরং দেশ কোথায় প্রশ্নগুলো জনসমাজে উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই প্রশ্নকারীর আধুনিক-প্রশাসনিক মানচিত্রের বোধের অভাব নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন মধ্যবিত্ত-শিক্ষিতরা। কিন্তু দেশকে দেখতে হবে দশের সম্মিলনস্থল হিসাবে। সেই অর্থেই আফসান দেশের ইতিহাস লিখতে থেকে গেছেন। যেখানে জাগরূক মানুষজন নিজ নিজ জনপদে একান্তে আটপৌরে জীবনে থেকে যেতে-যেতে যুদ্ধ পরিলক্ষণ ও অবলম্বন করেছেন। পরিলক্ষণ যদি তাঁদের ইচ্ছানিরপেক্ষ হয়ে থাকে, অবলম্বনও প্রায় হকিকতের মতো। মুক্তিযুদ্ধ তাই আটপৌরে জীবনের মধ্যে একটা বিপজ্জনক যাপন ছিল, যার মধ্যে তাঁদেরসেই সব গ্রামের মানুষজনেরলাগাতার সব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে, কৌশলগত পথ খুঁজতে হয়েছে, কঠোর পরিস্থিতিগুলোর অভিজ্ঞতা নিতে হয়েছে। সেই যাপনকে নিছক একটা রাষ্ট্র-স্বপ্নে পর্যবসন ইতিহাসবিদগণের প্রকল্প, এমনকি ফ্যান্টাসি। গ্রামের একাত্তর এজাতীয় প্রকল্পের বাইরের ইতিহাস-চর্চার একটা দুর্দান্ত দলিল; তবে আফসানের বেলায় এটা একমাত্র কোনো দলিল নয়। আনুষ্ঠানিক সংগঠনকেন্দ্রিক বামপন্থীদের বাইরে বামপন্থী এবং/বা মার্ক্সবাদী যাঁরা জনসমাজের ইতিহাস নিয়ে ভাবিত, আফসানের এই বই তাঁদের জন্য দিকদর্শন দিতে পারে।

ইউপিএল-এর বই তেমন কোনো ব্যতিক্রম ছাড়া সকল সময়েই আকর্ষণীয়। ছাপা সোজা হয়, বাঁধাই টাইট হয়, প্রচ্ছদে ন্যূনতম নন্দনবোধ সাধারণত ফসকে যায় না। জরুরি বইপত্রে নির্ঘণ্টের ব্যবস্থা থাকে, যেমন এটাতেও আছে। এই বইয়ের প্রচ্ছদকার সব্যসাচী হাজরা হরফ বাছাইয়ে একাত্তরের সময়কার রাজনৈতিক পোস্টারের কথা মাথায় রেখেছেন, সম্ভবত। বইটা তাতে অদ্ভুত একটা চিন্তাসাজশ তৈরি করতে পেরেছে। তবে প্রচ্ছদের রং আর ধরনে কিছুটা মৃতবৎ বা মরবিড লাগতে পারে। লাগতে-লাগতেও যে অতটা লাগল না শেষমেশ, সেটার কারণ সম্ভবত একাত্তর হরফগুলোর বেশ নজরকাড়া মাপ। সব্যসাচী (হাজরা) তাঁর প্রচ্ছদে সারাক্ষণ নিজেকে উতরান। এটা আরেক ধরনের প্রচ্ছদ তাঁর। প্রচ্ছদজ্যাকেটে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আর পাঁচটা ইউপিএল-কিতাবের খবর দিয়েছেন প্রকাশক। সেটা উপকারী তথ্য, এবং আন্দাজ করা যায় প্রচ্ছদকারের সামান্যই কৃতিত্ব এতে। তবে বইগুলোর খবর জরুরি হলেও খবর/বিজ্ঞাপনটার স্থান নির্বাচন প্রকাশকের তরফে মালিকসুলভ ছিল, ডিজাইনারসুলভ ছিল না। তা না হলে তাঁরা বিজ্ঞাপনটি পাদরেখা বা বামরেখার দিকে ঘেঁষে দিয়ে প্রচ্ছদ-ডিজাইনের ক্ষতি লাঘব করতেন।

টীকা

১। ৭০-৮০ দশকের বিপ্লবী কর্মীদের সামাজিক-জনজীবন নিয়ে লক্ষণীয় ইতিহাস চর্চার সুবাদে নেসার আহমেদের কথা মনে পড়ল। আমার থেকে ভালো পাঠকদের নিশ্চয়ই এ রকম কিছু, বিরল হলেও, উদাহরণ মনে পড়বে।