সেনিন
রিউনোসকে আকুতাগাওয়ার সেনিন প্রসঙ্গে
জাপানি লেখক রিউনোসকে আকুতাগাওয়ার লেখা এই গল্পটি নেওয়া হয়েছে ভাইকিং প্রকাশনা সংস্থা থেকে ১৯৮৮ সালে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক গল্প সংকলন থেকে। দা বুক অব ফ্যান্টাসি নামের বইটি সম্পাদনা করেছেন আর্জেন্টিনার তিন লেখক হোর্হে লুইস বোর্হেস [১৮৯৯-১৯৮৬], সিলভিনা ওকাম্পো [১৯০৩-১৯৯৩] ও আদোলফো বিইয়ো কাসারেস [১৯১৪-১৯৯৯]। এই তিন সম্পাদকের মধ্যে বোর্হেস জগদ্বিখ্যাত। মানুষের কল্পনার রাজ্য নিয়ে তাঁর কৌতূহলের অন্ত ছিল না। তাঁর নিজের লেখা গল্পগুলি তো ফ্যান্টাসি জনরার বলেই আমার মনে হয়। সেই বোর্হেস যখন সারা দুনিয়ার বিভিন্ন ভাষায় লেখা ফ্যান্টাসি গল্পের বিপুল ভাণ্ডার থেকে কিছু গল্প বাছাই করে একটা বই সম্পাদনা করেন, তখন সে বই অবশ্যই রসিক গল্পপাঠকদের মন্যে ঔৎসুক্যময় উত্তেজনা জাগায়।
বইটিতে বোর্হেস বা অন্য দুই সম্পাদকের, কারোরই কোনো মুখবন্ধ, ভূমিকা বা এই রকমের কিছু নেই। কিন্তু বিখ্যাত মার্কিন সায়েন্স ফিকশন লেখক উরসুলা কে লে গিনের এক দীর্ঘ ভূমিকা আছে। বইটি সম্পর্ক তিনি জানাচ্ছেন, ১৯৩৭ সালে আর্জেন্টিনার এই তিন লেখক বুয়েনোস আইরেসে এই বইয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। লে গিন কাসারেসের এই কথাগুলো উদ্ধৃত করেছেন,
about fantastic literature... discussing the stories which seemed best to us. One of us suggested that if we put together the fragments of the same type we had listed in our notebooks, we would have a good book. As a result, we drew up this book... simply a compilation of stories from fantastic literature which seemed to us to be the best.
[The book of Fantasy: Jorge Luis Borges]
অর্থাৎ পৃথিবীর সেরা ফ্যান্টাসি গল্পগুলোর একটি অংশের প্রতিনিধিত্ব ঘটেছে এই বইতে, ‘সেনিন’ নামের জাপানি গল্পটি দিয়ে যার সূচনা। চীনা পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে ‘সেনিন’ হলো এমন একজন মুণি বা ঋষি, যাঁর বাস মূলত পাহাড়ে; ইচ্ছেমতো আকাশে উড়ে বেড়ানোর ক্ষমতাসহ অনেক রকমের অলৌকিক ক্ষমতা এবং অতি দীর্ঘ আয়ুর অধিকারী তিনি।
‘সেনিন’ গল্পের লেখক রিউনোসকে আকুতাগওয়া [১৮৯২-১৯২৭] জাপানি ছোটগল্পের জনক হিসেবে স্বীকৃত; বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত ‘রাশোমন’ নামের সুবিখ্যাত গল্পের জন্য। তিনি ১৯২৭ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন। কেন তিনি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ঠাণ্ডা মাথায় তাও লিখে রেখে গেছেন: ‘নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে অস্পষ্ট উদ্বেগ’।
আকুতাগাওয়া আত্মহত্যা করার আগে পৃথিবীর ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সংঘটিত বিখ্যাত আত্মহত্যার ঘটনাগুলির একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন; আত্মহত্যাকারীদের সেই তালিকায় তিনি যিশুখ্রিস্টকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। যে লেখক ঈশ্বরপুত্র যিশুর ক্রুসিফিকেশনকে আত্মহত্যা বলে মনে করতেন, তিনি যে বেশ কৌতূহল উদ্রেগকারী মানুষ ছিলেন, এতে অন্তত আমার কোনো সন্দেহ নেই। উদ্ভট কল্পকাহিনি তিনি অনেক লিখেছেন, কিন্তু বোর্হেস কেন তাঁর এই গল্পটিই বেছে নিয়েছিলেন, সেটাও একটা কৌতূহলের বিষয় বটে।
খোদ গল্পটির বিষয়ে আমি এখানে কিছুই বলতে চাই না, এই ভয়ে যে তাতে পাঠকের কৌতূহল পণ্ড হতে পারে। তা ছাড়া এটা এমন এক গল্প, যার ব্যাখ্যা অজস্র রকমের হতে পারে। তাই, কোনো ‘স্পয়লার’ ছাড়াই গল্পটি পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা হলো।
—ইংরেজি থেকে অনুবাদ ও ভূমিকা: মশিউল আলম
সেনিন
প্রিয় পাঠকবৃন্দ, এখন আমি ওসাকা শহরে যাত্রাবিরতি করতে যাচ্ছি। তাই আপনাদের একটা গল্প শোনাতে চাই; গল্পটার সঙ্গে এই শহরের সম্পর্ক আছে।
অনেক কাল আগে এক লোক গৃহকর্মী হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে এই ওসাকা শহরে এসেছিল। তার আসল নাম আজ আর আমার মনে নেই; লোকেরা তাকে স্মরণ করে গোনসুকে নামে, এটা চাকরদের কমন নাম; লোকটা তো আসলে সব কাজ করবে বলেই এসেছিল।
তো সেই লোক, আমরাও তাকে গোনসুকে নামেই ডাকব, একটা অফিসে গিয়ে ঢুকল, যার সাইনবোর্ডে লেখা ছিল: ‘আমরা আপনাকে যে কোনও কাজ পাইয়ে দিতে পারি’। সেখানে কর্তব্যরত কেরানিটি বাঁশের হুঁকায় তামাক খাচ্ছিল, গোনসুকে তাকে বলল, ‘অনুগ্রহ করবেন জনাব, আমি একজন সেনিন হতে চাই। আপনি কি দয়া করে আমাকে এমন একটি পরিবারের খোঁজ দিতে পারেন, যাদের গৃহকর্মী হিসেবে কাজকর্ম করতে করতে আমি সেনিন হওয়ার রহস্যটা জেনে নিতে পারব?’
কেরানিটি কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে রইল, যেন সে খদ্দেরটির দীর্ঘ বায়না শুনে একদম স্তম্ভিত হয়ে গেছে।
‘আপনি কি আমার কথা শুনতে পেয়েছেন, জনাব?’ গোনসুকে বলল, ‘আমি একজন সেনিন হতে চাই। আপনি কি আমাকে এমন একটা পরিবারের খোঁজ দিতে পারেন, যাদের গৃহকর্মী হিসেবে কাজকর্ম করতে করতে আমি সেনিন হওয়ার রহস্যটা জেনে নিতে পারব?’
‘আমরা খুবই দুঃখিত যে আমাদের কথা শুনে আপনি হতাশ হতে পারেন,’ কেরানিটি বলল, এবং যে হুঁকার কথা সে ইতিমধ্যে ভুলে গিয়েছিল, সেটা আবার টানতে শুরু করল। ‘আমরা বহু বছর ধরে এই ব্যবসা করছি, কিন্তু আপনার এই সেনিনগিরির সখ দেখার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি কস্মিনকালেও হই নাই! মনে হয় আপনার অন্য কোথাও খোঁজ করে দেখাই ভালো, হয়তো আপনি...’
এবার গোনসুকে লোকটার আরও কাছে এগিয়ে গেল, নীল প্যান্টালুন পরা তার দুই হাঁটুর একদম কাছে গিয়ে এইভাবে তর্ক আরম্ভ করে দিল:
‘দাঁড়ান, মিস্টার, দাঁড়ান! এটা তো সাক্ষাৎ প্রতারণা! আপনাদের সাইনবোর্ডে কী বলা হচ্ছে? সেখানে তো আপনারা রাজ্যের কথা লিখে রেখেছেন: ‘আমরা আপনাকে যে কোনও কাজ পাইয়ে দিতে পারি’। যেহেতু আপনারা আমাদেরকে যে কোনও কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেহেতু সেটাই আপনাদের করতে হবে; কী ধরনের কাজ আমরা চাচ্ছি সেটা কোনও ব্যাপারই নয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, আপনারা আগাগোড়াই মিথ্যা বলে আসছেন, এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবেই।’
তার কথাগুলোর যথেষ্ট যুক্তি আছে দেখে কেরানিটি এভাবে চিৎকার-চেঁচামেচির জন্য তাকে বেশি কিছু বলতে পারল না। সে তড়িঘড়ি করে বলল, ‘আগন্তুক সাহেব, আমি আপনাকে হলপ করে বলছি, এখানে আমাদের কোনো চালাকি নেই। ব্যাপারটা খুবই সোজা-সাপটা। কিন্তু আপনি যদি আপনার এই অদ্ভুত অনুরোধ থেকে একেবারেই পিছপা হবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে আমাদের অনুরোধ, আগামীকাল আর একবার আসুন। সম্ভাবনা আছে এমন সব জায়গায় আজ আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব।’
এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছাড়া কেরানি বেচারা লোকটির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোনো উপায় দেখতে পেল না; অন্ততপক্ষে সেদিনের জন্য তাকে বিদায় করার পথ ছিল ওই একটাই। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনো বাড়ির লোকেরা কী করে তাদের গৃহকর্মীকে সেনিন হওয়ার রহস্যটা শিখিয়ে দেবে, এ বিষয়ে কেরানি লোকটার সামান্যতম ধারণাও ছিল না। তাই আগন্তুকের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেল কাছেই এক ডাক্তারের কাছে।
সে তার অদ্ভুত খদ্দেরটার কাহিনি ডাক্তারকে বলল; তারপর উদ্বিগ্নভাবে অনুরোধের সুরে বলল, ‘ডাক্তার সাহেব, আপনার কী মনে হয়, কোন ধরনের পরিবার একটা লোককে সেনিন হওয়ার শিক্ষা দিতে পারে? এবং সেটা এত তাড়াতাড়ি?’
প্রশ্নটা শুনে ডাক্তার সাহেব দৃশ্যত হকচকিয়ে গেলেন। হাতদুটি বুকের কাছে বেঁধে বাগানের বড় পাইন গাছটার দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ করুণভাবে চুপ করে রইলেন। কেরানির প্রশ্নটার উত্তর দিলেন ডাক্তারের সাহায্যকারী মহিলাটি, অতি চতুর মহিলা তিনি, বেশি পরিচিত বুড়ি শিয়াল নামে। কেরানির গল্পটা শুনে তিনি আগ বাড়িয়ে উত্তর দিলেন: ‘এর চেয়ে সোজা আর কিছু নাই। ওকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন। আমরা বছর–দুয়েকের মধ্যেই ওকে সেনিন বানিয়ে ছেড়ে দেব।’
‘সত্যি, ম্যাডাম? দারুণ ব্যাপার! আপনার এই সদয় প্রস্তাবের জন্য কী বলে ধন্যবাদ জানাব আসলেই ভেবে পাচ্ছি না। তবে মন থেকে বলছি, প্রথম থেকেই আমার মনে হচ্ছিল, ডাক্তারি ও সেনিনগিরি যেন খুবই কাছাকাছি কাজ।’
মহিলাটির দূরভিসন্ধি সম্পর্কে কেরানির কিছুই জানা ছিল না বলে সে সানন্দে মাথা নুইয়ে বার বার তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মহানন্দে বেরিয়ে গেল।
তার চলে যাওয়ার পথের দিকে ডাক্তার সাহের যারপরনাই তিক্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন; তারপর ঘুরে স্ত্রীর দিকে চেয়ে বিরক্তিভরা ঘ্যাড়ঘেড়ে কণ্ঠে বললেন, ‘নির্বোধ বৃদ্ধা, তুমি কি জানো, এই মুহূর্তে তুমি কী ভীষণ বোকামিটা করে বসলে? ওই বর্বর লোকটা যদি একদিন অভিযোগ তোলে যে এতগুলো বছরেও আমরা তাকে কিছুই শেখাইনি, তাহলে তুমি করবেটা কী?
কিন্তু তাঁর স্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করা দূরে থাক, তাঁর দিকে নাক উচিঁয়ে বললেন, ‘ফুহ্! গর্ধভ কোথাকার! তুমি তোমার নিজের চড়কায় তেল দাও। এমনই একটা গবেট লোক তুমি, খাও-নয়তো-অন্যের-খাদ্য-হও বিধানের এই দুনিয়ায় নিজের শরীর-মনকে একত্রে ধরে রাখবে কীভাবে?’
মহিলার এই পালটা আক্রমণ বেশ ফলপ্রসু হলো, তাঁর স্বামী প্রবর একদম চুপ মেরে গেলেন।
যেমনটা কথা হয়েছিল, পরদিন সকালে সেই কেরানি তার বর্বর খদ্দেরটিকে নিয়ে ডাক্তারের বাড়িতে হাজির হলো। ওই বিশেষ দিনটিতে গাঁয়ে বেড়ে ওঠা গেঁয়ো লোকটার পরনে ছিল হাওরি আর হাকামা; জীবনের এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের প্রথম দিন উপলক্ষেই সম্ভবত সে আড়ম্বরের সঙ্গে ওই পোশাক পরেছিল। কিন্তু তাকে একজন সাধারণ চাষার চেয়ে মোটেও ভিন্ন রকম দেখাচ্ছিল না। তার এই সাধারণত্বই ডাক্তার সাহেবের কাছে খানিক বিস্ময়ের ব্যাপার মনে হচ্ছিল; হবু লোকটার মধ্যে অসাধারণ কিছু দেখতে পাওয়ার প্রত্যাশা উঁকি দিয়েছিল তাঁর মনে। তিনি কৌতূহলী চোখে তাকে দেখতে লাগলেন; সুদূর ভারতবর্ষ থেকে আনা কস্তুরি হরিণের মতো ভিন্নদেশি, অচেনা কোনো পশুকে লোকজন যেভাবে দেখে।
তারপর তিনি লোকটাকে, ‘শুনলাম, আপনি একজন সেনিন হতে চান। আমার জানার খুবই ইচ্ছা, এই ভাবনা আপনার মাথায় এল কীভাবে।’
‘হুজুর স্যার, এই বিষয়ে আমার তেমন কিছু বলার নাই,’ উত্তরে বলল গোনসুকে। ‘ব্যাপারটা খুবই সাধারণ। আমি যখন প্রথম এই শহরে এলাম, এসে যখন বিরাট প্রাসাদটার দিকে তাকালাম, তখন আমার ঠিক এইরকম মনে হলো: ওই প্রাসাদে থাকেন আমাদের মহান রাজা তাইকো, তাঁকেও একদিন মরতে হবে; মনে হলো, আপনি যতই জাঁকজমকের জীবন যাপন করেন না কেন, আপনাকেও একদিন আমাদের সবার মতোই মাটির সাথে মিশে যেতে হবে। তখন আমার যেরকম অনুভূতি হয়েছিল, তা সংক্ষেপে এটুকুই যে আমাদের প্রত্যেকের জীবন খুবই ক্ষণস্থায় একটা স্বপ্ন।
বুড়ি শিয়ালটি তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘সেনিন হওয়ার বিনিময়ে তুমি কি যে কোনো কিছু করতে রাজি আছ?’
‘হ্যাঁ, ম্যাডাম। সেনিন হতে পারলে যে কোনো কিছু করতেই আমি রাজি।’
‘খুব ভালো কথা। তাহলে আজ থেকে আগামী বিশ বছর তোমাকে এখানে থেকে আমাদের জন্য কাজকর্ম করতে হবে। তোমার কাজের এই মেয়াদ শেষ হলো তুমি সেইসব রহস্যের বিষয়ে একজন সুখি পণ্ডিত হয়ে উঠতে পারবে।
‘সত্যি, ম্যাডাম? আমি অবশ্যই আপনাদের ভীষণ অনুগত থাকব।’
‘কিন্তু এই বিশ বছরে তুমি মাইনে হিসেবে একটি পয়সাও পাবে না। বোঝা গেল?’
‘জি ম্যাডাম। ধন্যবাদ, ম্যাডাম। আমি আপনাদের সব কথায় রাজি।’
এইভাবে ডাক্তারের বাড়িতে গোনসুকের বিশ বছরের কর্মজীবন শুরু হলো। সে কুয়া থেকে পানি তুলত, রান্নার জ্বালানির জন্য কাঠ চেড়াই করত, পরিবারের খাবার তৈরি করত, ধোয়ামোছা, ঝাড়ু দেওয়া ইত্যাদি সমস্ত কিছুই সে করত। এতেই শেষ নয়, ডাক্তার যখন রোগী দেখতে যেতেন তখন গোনসুকে ওষুধের ঢাউস বাক্সটা পিঠে নিয়ে চলত তাঁর পিছু পিছু। কিন্তু এই সমস্ত কাজের বিনিময়ে সে কখনো একটি পয়সাও মাইনে চায়নি। নিশ্চয়ই জাপানের কোথাও এত সস্তায় তার চেয়ে ভালো গৃহকর্মী পাওয়া সম্ভব ছিল না।
অবশেষে দীর্ঘ বিশটা বছর পেরিয়ে গেল; গোনসুকে আবার সাড়ম্বরে তার সেই পারিবারিক হাওরি পরল, যেমনটা সে প্রথম পরেছিল ঠিক বিশ বছর আগে, এবং মালিক ও মালকিনের সামনে হাজির হলো। গত বিশ বছর ধরে তাঁরা তার প্রতি যে সদয় আচরণ করেছেন সে জন্য সে তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা ইত্যাদি জানাল। তারপর বলল, ‘হুজুর স্যার, বিশ বছর আগে আজকের এই দিনে আপনারা আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সে অনুসারে এখন কি আপনারা আমাকে শিখিয়ে দেবেন কীভাবে সেনিন হওয়া যায়? কীভাবে চিরযৌবন আর অমরত্ব লাভ করা যায়?’
‘এই যে শুরু হলো!’ ডাক্তার একটা হাই তুলে আপন মনে বললেন। দীর্ঘ বিশ বছর একদম বিনা মাইনেতে লোকটাকে কাজে খাটিয়েছেন, এখন কী করে তিনি চাকরটাকে বলবেন যে সেনিনগিরি সম্পর্কে তাঁর আসলে কিছুই জানা নেই?
ডাক্তার সাহেব আড়মোড়া ভেঙে নিজেকে এই সংকট থেকে বের করে আনলেন, তারপর বললেন, সেনিন হওয়ার রহস্যটা তাঁর জানা নেই, আসলে সেটা জানেন তাঁর স্ত্রী। ‘তাই ব্যাপারটা তোমাকে তাঁকেই বলতে হবে।’ ডাক্তার কথা শেষ করে কাঠের মতো নির্বিকার ভঙ্গিতে অন্য দিকে মুখ ফেরালেন।
তাঁর স্ত্রীর মধ্যে অবশ্য একটুও বিচলিত হননি।
মহিলা গোনসুকেকে বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব। কিন্তু মনে রেখো, আমি যা বলব, তোমাকে তা করতেই হবে, সেটা তোমার কাছে যত কঠিনই মনে হোক না কেন। তা না হলে তুমি কখনোই সেনিন হতে পারবে না; শুধু তাই নয়, আমি যা বলব তা না করলে তোমাকে বিনা মাইনেতে আমাদের এখানে আরও বিশ বছর কাজ করতে হবে। আর বিশ্বাস করো, তুমি যদি আমার কথামতো কাজ না করো তাহলে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ওই মুহূর্তেই তোমার মৃত্যু ঘটাবেন।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে ম্যাডাম। যত কঠিনই হোক, আপনি যা বলবেন আমি তাই করব,’ উত্তরে গোনসুকে বলল। ইতিমধ্যে তার মনটা ভীষণ খুশি হয়ে উঠল; সে তার মালকিনের আদেশের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
‘আচ্ছা বেশ,’ মহিলা বললেন, ‘বাগানের ওই পাইন গাছটাতে উঠে পড়ো।’
মহিলা সেনিনগিরি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না, সুতরাং কোনো সন্দেহ নেই যে তাঁর দুরভিসন্ধি ছিল গোনসুকেকে এমন কিছু করতে বলা যা করা কোনো পক্ষেই সম্ভব নয়; তার গোনসুকে যখন সেটা করতে পারবে না, তখন একদম বিনা মাইনেতে তাকে আরও বিশ বছরের জন্য চাকর হিসেবে পাওয়াটা একদম নিশ্চিত হয়ে যাবে।
কিন্তু তাঁর আদেশ পেয়ে গোনসুকে এক মুহূর্তও দ্বিধা না করে গাছটা বেয়ে ওঠা শুরু করে দিল।
‘আরও উপরে যাও,’ মহিলা তার দিকে চেয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘না, আরও উপরে, আরও উপরে, সবচেয়ে উঁচু ডালটার একদম ডগায় উঠে যাও।’
মহিলা বারান্দার কিনারে দাঁড়িয়ে লম্বা করে গলা বাড়িয়ে তাকালেন, যেন গাছের উপরে চাকরটাকে আরও ভালো করে দেখা যায়। তিনি দেখতে পেলেন, ভীষণ উঁচু পাইন গাছটার একদম শীর্ষে ঝোপের মধ্যে গোনসুকের হাওরি উপরের দিকে উড়ে উঠেছে।
‘এখন ডান হাত ছেড়ে দাও।’
গোনসুকে বাম হাতে ঝোপটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ডান হাতটা সাবধানে ছেড়ে দিল।
‘এবার বাম হাতটাও ছেড়ে দাও।’
‘আরে আরে, এই মহিলা!’ তাঁর স্বামী অবশেষে বলে উঠলেন; তিনি মহিলার পিঠের পেছন থেকে উদ্বিগ্নভাবে গাছটার দিকে দেখছিলেন। তিনি স্ত্রীকে বলল, ‘তুমি কি জানো না ওই ঝোপ থেকে বাম হাতটা ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা নির্ঘাত পড়ে যাবে? আর গাছটার নিচেই যে বড় পাথরটা আছে, তার উপর পড়ে সে যে অক্কা পাবে, ডাক্তার হয়ে আমি তোমাকে হলপ করে বলছি।’
‘এই মুহূর্তে আমি তোমার মহামূল্যবান উপদেশগুলোর কোনোটাই চাচ্ছি না। সবকিছু আমার উপরে ছেড়ে দাও। এই গোনসুকে, বাম হাত ছেড়ে দাও! শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?
তাঁর আদেশটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে গোনসুকে তার দ্বিধান্বিত বাম হাতটা ঝটকা মেরে সরিয়ে নিল। এখন দুই হাতে কিছুই না ধরে, সম্পূর্ণ খালি দুই হাতে সে গাছটার উপর দাঁড়িয়ে থাকবে কী করে? মুহূর্তেই ডাক্তার ও তার স্ত্রীর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল, আর গোনসুকে, হ্যাঁ, দেখা গেল, সে ও তার হাওরি গাছটার ওই ঝোপ থেকে খসে পড়ল, তারপর... তারপর, আরে আরে আরে, এ কী? থেমে গেল গোনসুকে, একদম থেমে গেল! একখণ্ড ইটের মতো ধপ করে মাটিতে না পড়ে সে থেমে গেল মাঝপথে, রয়ে গেল মধ্যদুপুরের ঝলমলে উজ্জ্বল আকাশে; ঠিক যেন এক পুতুলনাচের কুশীলব।
‘আমি আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আপনাদের দুজনকেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনারা আমাকে সেনিন বানিয়েছেন।’ অনেক উঁচু থেকে বলল গোনসুকে।
খুবই সমীহর সঙ্গে মাথা নুইয়ে তাঁদের সম্মান জানাতে দেখা গেল তাকে, তারপর সে আলতো করে পা ফেলে ফেলে নীল আকাশের উঁচুতে, আরও উঁচুতে উঠে যেতে লাগল; এইভাবে উঠতে উঠতে একসময় ছোট্ট একটা বিন্দুর মতো মিলিয়ে গেল পেঁজা তুলোর মতো মেঘমালার মধ্যে।
তারপর সেই ডাক্তার ও তাঁর স্ত্রীর কী হয়েছিল কেউ জানে না। কিন্তু জানা যায়, তাঁদের বাগানের সেই বিশাল পাইন গাছটা আরও বহু বছর বেঁচে ছিল; কারণ, লোকে বলে, তার দুইশ বছর পরে এক ইয়োদোইয়া তাৎসুগোরো যখন তুষারে ঢাকা গাছটা নিজের বাগানে দেখতে চেয়েছিলেন, তারপর সেটা ওই ডাক্তারের বাগান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নিজের বাগানে লাগানোর খরচ বয়েছিলেন এবং ঝামেলা সয়েছিলেন, তখন সেটার কাণ্ডের পরিধি হয়েছিল বিশ ফুটেরও বেশি।
মুগ্ধ হলাম।
Mandal Avijit
নভেম্বর ২৮, ২০২১ ০৭:৪৫
এই গল্পের আবহটা আলাদা- গল্পের পরিণতি অগুরুত্বপূর্ণ অনেকটা। গৃহকর্মীরা সেনিন হয় এমন একটা আপাত নিষ্পাপ টোপ লক্ষ্য করা যায় গল্পে। গেঁয়ো অজ্ঞতা, সরলতা হিসেবে গল্পটা পড়ে যাওয়া যায়। আবার অন্য একটা অ্যাঙ্গেল আছে, মানে আসলে একজন সেনিনই এসেছেন নিজে ঠকতে, তার প্রাপ্তি- আপাত লোভী একজন মানুষ নিজের ক্ষমতা নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে যাবে (যে ভাবছিল এটা সম্ভব না- কিন্তু তার নির্দেশনায় একজন উড়তে শিখল) এতটুকুই? গল্প শেষ হলে পরে ডাক্তারের স্ত্রীর চরিত্রটা কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে টের পাওয়া যায়।
ফারুক আব্দুল্লাহ
নভেম্বর ০২, ২০২১ ১৭:০৩