বিস্মৃতি

 

সে জেগে আছে না স্বপ্ন দেখছে ঠিক বুঝতে পারছে না। সে দেখে যে সে অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। সিঁড়িতে কোনো আলো নেই। কেবলই অন্ধকার। সিঁড়ির এক পাশের দেয়ালে কাচ লাগানো। সেই কাচ দিয়ে চাঁদনী রাতে বাইরে থেকে যেটুকু আলো ভেতরে আসছে, সেটুকু দিয়েই সে সিঁড়ির ধাপগুলো খেয়াল করে করে নিচের দিকে নামছে। সে কেন সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নামছে, তা সে নিজেও জানে না। শুধু জানে তাকে নিচের দিকে নামতে হবে। গভীর সমুদ্রের গাঢ় অন্ধকার তলদেশে তিমি শাবক জন্ম নেবার পর যেমন সে বুঝে যায়, তাকে শ্বাস নেওয়ার জন্য সাগরের উপরিভাগে যেতে হবে। কিন্তু কোন দিকে গেলে সমুদ্দুরের উপরিতলে যাওয়া যাবে, সেটা সেই আঁধারের মধ্যে থেকেও যেমন সে ঠিক ঠাহর করতে পারে, তেমনি তাকেও যেন তার পঞ্চেন্দ্রিয় বলে দিচ্ছে যে তাকে নিচের দিকে নামতে হবে। হঠাৎ তার চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠল। সে দেখতে পেল ঘাসশূন্য ছায়াচ্ছন্ন স্থানে কাঁঠালগাছের নিচে বেঞ্চিতে বসে এক ষোড়শী মাতা তার পুত্রকে স্তন্যপান করাচ্ছে। গাছের পাতাদের ফাঁক দিয়ে সোনালি আলোর তির্যক রেখাগুলো ছড়িয়ে পড়ছিল মা ও শিশুর শরীরে আর উঠানের সর্বত্র। মায়ের ঘোমটার ফাঁক দিয়ে সে খেয়াল করে দেখল মায়ের মুখটি। সুন্দর মায়াবী চেহারা। ঠোঁটের বাম দিকে একটি তিল আছে। এই ষোড়শীকে সে কি আগে কখনো দেখেছে? তার মনে পড়ছে না। ওই নারীর সাথে তার কী সম্পর্ক, সেটাও সে অনুমান করতে পারল না। সে ভালোভাবে লক্ষ করে দেখল যে, শিশুটির হাতে পাঁচটি নয়ছয়টি আঙুল। দৃশ্যটি তার চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেলে তার আবার মনে পড়ে গেল যে তাকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যেতে হবে।

সে নিচে নামতে নামতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু ওই সিঁড়ি দিয়ে বেরোবার কোনো পথ সে খুঁজে পাচ্ছিল না। হাল ছাড়ার পাত্র সে নয়। সে বিশ বছর বয়সী যুবক। তার শরীরের ক্ষমতা এত সহজেই নিঃশেষ হওয়ার নয়। সে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। নিচে নামতে নামতে তার চোখের সামনে আরেকটি দৃশ্যপট ভেসে উঠল। এক পৌরুষদীপ্ত অদ্ভুত সুন্দর যুবক তার বীণায় সুরের লহরি তুলেছে। সে এই যুবককে কোথায় দেখেছে সেটা মনে করার চেষ্টা করল। প্রথমে সে স্মরণ করতে পারল না। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে পড়ে গেল এর কথা সে বইয়ে পড়েছে। এ তো গ্রিক দেবতা অর্ফিয়্যুস। বনের পশুরা তার সুরের ঝংকারে ভুলে গেছে তাদের সমস্ত হিংস্রতা। মাছেরা তীরে এসে মুগ্ধ হয়ে শুনছে তার বীণার অপূর্ব মূর্ছনা। পাখিরা কলরব ভুলে হয়ে গেছে শান্ত, সমাহিত। বৃক্ষের একটি শাখাও দুলছে না। সে সংবিৎ ফিরে পেল হোঁচট খাওয়াতে। তখন তার নিচে নেমে যাওয়ার তাগাদার কথা আবার মনে পড়ে গেল। কিন্তু এই সিঁড়ির শেষ কোথায় সে জানে না। তার মনে হচ্ছে যেন সে অনন্তকাল ধরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে তো নামছেই। এই সিঁড়ির যেন কোনো শেষ নেই। এখান থেকে বেরোবার যেন কোনো পথ নেই। তবু সে সেই অন্তহীন সিঁড়ির ধাপগুলো পার হয়ে নিচে নেমে যেতে থাকল। একসময় সে অবসন্ন বোধ করতে লাগল। আর তখনই দেখা পেল একটি দরজার। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ভাবল তার অনন্ত যাত্রা শেষ হয়েছে।

তার উৎসাহ অচিরেই বাষ্প হয়ে উড়ে গেল। সে দেখল দরজায় একটি তালা লাগানো। সে তালাটিকে পরীক্ষা করল। বুঝতে পারল তালাটা অনেক পুরাতন আর তাতে মরিচা ও ধুলার আস্তরণ পড়ে আছে। সে তালাটি নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করল। হ্যাঁচকা টান মারল। কিন্তু কোনো ফল হলো না। তালাটি আগের মতোই শক্ত হয়ে ঝুলে রইল। এবার তার মাথায় একটি বুদ্ধি এলো। সে তালাটিকে লক্ষ্য করে খুব জোরে একটি লাথি মারল। এবার ফল ফলল। একটা শব্দ করে তালাটি কাড়াসহ খুলে মেঝেতে পড়ে গেল। সে দরজাটি ধাক্কা মেরে খুলল। দেখল ভেতরে প্রায় অন্ধকার। কিন্তু কিছুটা চাঁদের আলো কোনোখান দিয়ে যেন কক্ষটির ভেতরে প্রবেশ করছে। সে আলো প্রবেশের স্থান খুঁজতে লাগল। দেখে ঘরটি চতুষ্কোণাকার এবং তার খিলানগুলোর মাঝখানে একটি গম্বুজ রয়েছে। গম্বুজটি বিভিন্ন বর্ণের কাচের তৈরি। সেই কাচের গম্বুজ দিয়েই কক্ষের ভেতর আলো প্রবেশ করছে। মেঝেটি মোজাইক পাথরে নির্মিত। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকার ফলে মেঝেতে ধুলার স্তূপ জমে গেছে। দেয়ালের এখানে-ওখানে মাকড়সার জাল। এই কক্ষটিতেও আরও কয়েকটি দরজা রয়েছে। হঠাৎ দুটো জংলী কবুতর উড়ে একটি খিলান থেকে আরেকটি খিলানে গিয়ে বসল। ঘরটি থেকে কেমন সোঁদা গন্ধ আসছিল তার নাকে। সে একটা জিনিস খেয়াল করে দেখল যে এই চারকোণাকৃতির ঘরটিতে যে দরজাগুলো আছে, সেগুলোতে কোনো তালা ঝুলছে না। সে একটা দরজার কাছে গিয়ে ধাক্কা দিতেই সেটা কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই খুলে গেল। কেবল ক্যাঁচক্যাঁচ করে একটু শব্দ করল মাত্র। ঘরের ভিতরে কী আছে, সেটা দেখার জন্য সে উঁকি মারল। দেখল যে ঘরটি ছোট এবং সম্পূর্ণ শূন্য। সে এই দরজা থেকে সরে অন্য দরজার সামনে গেল।

ধাক্কা দিতেই দরজাটি খুলে গেল। আবছা আলোয় সে দেখতে পেল ঘরটির চারটি দেয়ালই আয়না দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। আয়নাগুলোর ওপর ধূলা জমে আছে। চতুষ্কোণ ঘরটির এক কোনায় মশালের মতো একটি বস্তু দেয়ালে গাঁথা আছে। ওই বস্তুটির পাশেই দেয়ালের একটি ছোট গর্তে  দেশলাইয়ের মতো একটি বস্তু রাখা আছে। সে বস্তুটিকে হাতে নিয়ে বুঝল এটি সত্যিই দেশলাই। সে একটি কাঠি বের করে দেশলাইয়ের পিঠে ঘষা দিতেই আগুন জ্বলে উঠল। সে ভাবতে লাগল মশালের মতো বস্তুটিতে আগুন দিলে সেটা জ্বলবে কি না। সে চেষ্টা করে দেখতে চাইল। মশালের মতো বস্তুটির মাথায় আগুন স্পর্শ করতেই সেটা দপ করে জ্বলে উঠল। সারা ঘরটি মিহি আলোয় আলোকিত হয়ে গেল। একটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে হাতের তালু দিয়ে সেটার ধুলা সাফ করল। আয়নাটি পরিষ্কার হওয়াতে সে তার মধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল। আলোছায়ার মধ্যে নিজের মুখটি দেখে তার অবাক লাগছিল। সত্যিই কি এটা তার মুখ। সে ভেংচি কাটল। প্রতিবিম্বও সাথে সাথে ভেংচি কাটল। সে এক হাত তুলল। কিন্তু প্রতিবিম্ব কোনো হাত তুলল না। বরং গম্ভীর হয়ে গেল। এতে সে বিস্মিত হলো। প্রতিবিম্বের মুখটা আস্তে আস্তে কঠিন হতে থাকল। অবশেষে প্রতিবিম্বটি মুখের গহ্বরটি দেখিয়ে একটি চিৎকার দিল। এই চিৎকার সে কোথায় দেখেছে সেটা মনে করার চেষ্টা করল। অবশেষে মনে করতে পারল। নরওয়ের শিল্পী মুঙ্ক স্ক্রিম নামে একটি ছবি এঁকেছিলেন। এই চিৎকার যেন হুবহু সেই চিৎকার। শব্দের তীক্ষ্ণতা তার কানে যন্ত্রণার সৃষ্টি করছিল। কানে ব্যথা অনুভব করছিল। একপর্যায়ে মনে হলো কানের পর্দা ফেটে যাবে। আর ঠিক তখনই ঝনঝন শব্দে ঘরের সব কটি আয়নাই ভেঙে যেতে থাকল। সে ভীত হয়ে পড়ল।

আয়নাগুলো ভাঙতে থাকলো আর কোত্থেকে যেন ঘরটির ভিতরে পানি আসতে লাগল। সে দৌড়ে গম্বুজসংলগ্ন ঘরটিতে ঢুকে পড়ল। অন্য দরজাগুলো পরীক্ষা করে দেখল। না, সব কটি কক্ষ দিয়ে খুব দ্রুত গম্বুজ আছে যে ঘরটিতে সে ঘরটিতে পানি প্রবেশ করছে। পানি দেখতে দেখতে হাঁটু পর্যন্ত হয়ে গেল। তারপর কোমর পর্যন্ত। এভাবে পানির গভীরতা তার উচ্চতাকে ছাড়িয়ে গেল। সে সাঁতার কেটে কেটে পানিতে ভেসে রইল। শেষ পর্যন্ত পানি কাচের গম্বুজকে ছুঁয়ে ফেলল। সে-ও সাঁতার কেটে গম্বুজ পর্যন্ত ভেসে রইল। অবশেষে গম্বুজটিও কানায় কানায় পানিতে পূর্ণ হয়ে গেলে সে আর দম নিতে পারছিল না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে ভাবছিল পানিতে ডুবে সে মারা যাবে কি না। এবার তাকে যে করেই হোক শ্বাস নিতেই হবে। বিষয়টি তার সহ্যের সমস্ত সীমাকে অতিক্রম করে গেল। সে ভাবল এখনই বুঝি তার মৃত্যু হবে। ঠিক সেই মুহূর্তে পানির প্রচণ্ড চাপে গম্বুজের কাচের ছাদটি ভেঙে গেল। সে বেরিয়ে দম নিল। কিন্তু কোন দিকে যাবে? যেদিকে তাকায় সেদিকেই পানি থইথই করছে। সাঁতার কেটে কিছুটা দূরে গিয়ে সে স্থলভূমি অনুসন্ধান করতে লাগল। পা দিয়ে পানির গভীরতা আঁচ করার চেষ্টা করল। দেখল পানির গভীরতা অনেক বেশি। সে জানে না সে এখন কোথায় আছে। নদীতে না সাগরে। না সুদীর্ঘ কোনো দীঘিতে। সে আকাশের দিকে চাইল। আকাশ তাম্রবর্ণ। অথই জলের ওপর দ্বিধাহীন চিত্তে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছিল পাণ্ডুর রঙের গোলাকার চাঁদ। বহুদূরে একটি বাতি জ্বলছিল বলে তার মনে হলো। সে ভাবলো ওদিকেই স্থলভূমি। তাই সে সেই বাতিটি লক্ষ্য করে সাঁতার কাটা আরম্ভ করে দিল। সে যতই সাঁতার কাটছে সে আলোকবর্তিকাটি ততই দূরে সরে যাচ্ছিল। সে মাঝে মাঝে একটু জিরিয়ে নেয় তারপর আবার সাঁতার কাটে। একপর্যায়ে ক্লান্তিতে সমস্ত দেহ অবসন্ন হয়ে পড়ল। কিন্তু সে দমে গেল না। সে সাঁতার অব্যাহত রাখল সেই বাতি অভিমুখে। অবশেষে তার শরীরের শেষ শক্তিবিন্দুটিও আর অবশিষ্ট রইল না। বাতিটি দূরেই রয়ে গেল। তার মনে হলো সে জ্ঞান হারাবে। সত্যি সত্যি সে জ্ঞান হারাল সেই সীমাহীন জলের অন্ধকারে।

তার যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখে সে ত্রিশোর্ধ্ব এক নারীর সাথে একই বিছানায় শুয়ে আছে। বিছানার পাশে একটি পিদিম জ্বলছিল। সেই পিদিমের ম্লান আলোয় সে সবকিছু দেখছিল। যে হাতটি রমণীটির বুকের ওপর ছিল, সে হাতটি সে আলগোছে সরিয়ে নিল। সে ভাবল যে সে তাহলে মারা যায়নি। সে বেঁচে আছে। সে দিব্যি বেঁচে আছে। বেঁচে আছে বলে সে কিছুটা পুলক অনুভব করল। সে ভাবতে লাগল, এটা কি বাস্তব না কল্পনা? সে কে? কী তার পরিচয়? তার ঠিকানা কোথায়? তার অতীত কী? ওই ঘুমন্ত রমণীর সাথেই-বা তার কী সম্পর্ক? সে কিছুই মনে করতে পারল না। কোনো কিছুই তার স্মরণে আসছে না। সে ঘুমন্ত নারীর মুখটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। সে একটি কামতৃপ্ত নারীর সুখী মুখচ্ছবি দেখল। অঘোরে ঘুমাচ্ছিল সেই নারী। সে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। তার পরনের শাড়ি বিস্রস্ত হয়ে আছে। সে খেয়াল করল এই রমণীর ঠোঁটের বাঁ দিকে একটি তিল আছে, যা পিদিমের অস্বচ্ছ আলোতেও বোঝা যাচ্ছে। কী সম্পর্ক তার ওর সাথে? সে জানে না। সে এটুকু জানে যে তাকে বেরোতে হবে। পথ চলতে হবে। সে বাড়িটির দিকে খেয়াল করল। বাড়িটি কাঠের তৈরি। এটা কোন আমল? পাল রাজাদের? না সেন রাজাদের? শায়েস্তা খাঁর? না আধুনিক যুগ? সে কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারল না। সে কেবল নিজের ভেতর থেকে এ বাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ার একটা দুর্দমনীয় তাগাদা অনুভব করল। সে নিঃশব্দে জামাকাপড় ও জুতা পরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বাইরে বেরিয়ে দেখে জ্যোৎস্নার রূপালী আলোর প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে মাঠ-ঘাট, প্রান্তর, ঘর-বাড়ি, সুস্বাদু ফলের বাগান আর ঘন বনানী। মেঘেরা আলোর তীব্রতায় লুকিয়ে পড়েছে যে যার মতো। ছাইরঙা আকাশের সীমানা জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে বাঁদুরের ঝাঁক। নক্ষত্রেরা অনেক দূরে মিটিমিটি আগুন জ্বেলে অবলোকন করছিল পৃথিবীর যাবতীয় দুর্জ্ঞেয় কর্মকাণ্ড। ঝিরিঝিরি বাতাসে দুলছিল উঠানে কাঁঠালগাছটির চকচকে পাতাগুলো। সে গাছেরই একটি ডালে বসে একটি প্যাঁচা খেয়ে যাচ্ছিল একটি মেঠো ইঁদুর। শিয়ালেরা ডেকে ডেকে রাত্রির নির্জনতা ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছিল। বাড়ির কুকুরটিও জানান দিচ্ছিল যে সেও ঘুমিয়ে নেই।

সে পা টিপেটিপে কাঠের বারান্দায় আসামাত্র একটি কর্কশ কণ্ঠস্বর বলে উঠল: এতো রাতে কোথায় যাচ্ছ? শব্দগুলো যেদিক থেকে এসেছে সে সেদিকে তাকাল। কোনো মানুষজন দেখতে পেল না। সে ভাবল মনের ভুল। তাই সে আরেক পা অগ্রসর হলো। কণ্ঠস্বরটি আবার একই কথা বলে উঠল। এবার তার দৃষ্টি গেল বারান্দায় ঝুলন্ত একটি খাঁচার দিকে। খাঁচাটিতে একটি টিয়াপাখি আছে। সেই টিয়াপাখিটাই কথা বলছে। সে নিঃশব্দে খাঁচাটির কাছে গেলে টিয়া পাখিটা আবারও একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল। সে বলল, আমি ভুলে গেছি আমি কে। আমার পরিচয় কী। আমার অতীত কী। এসব প্রশ্নের উত্তর বের করার জন্যই আমি বেরোচ্ছি। টিয়া পাখিটা তখন বলল, তাহলে পশ্চিমে যেয়ো না। ওদিকে আছে ঊষর ভূমি। তুমি পূর্ব দিকে যাও। তবে সাবধান। পূর্বে একটি মায়ার শহর আছে। সেই শহরকে পাশ কাটিয়ে পূর্বদিকে অগ্রসর হলেই তুমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। সে বলল, ধন্যবাদ। এই বলে সে উঠানে নামল। ঘরের বাম দিকে আছে গোয়ালঘর আর ডান দিকে আছে ঘোড়ার আস্তাবল। সে আস্তাবলে গিয়ে একটি ঘোড়ার দিকে তাকাল। আর ভাবতে লাগল, সে কি ঘোড়ায় চড়তে জানে। তার মন বলল যে, সে ঘোড়া চালাতে জানে। হয়তো সে কোনো দিন এর ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। আস্তাবলের দুটো ঘোড়া থেকে যেটি বেশি তেজী, সেটাকে বেছে নিয়ে তার পিঠে বসার আসন স্থাপন করে বেঁধে ফেলল। তারপর লাগাম ধরে ঘোড়াটিকে উঠানে এনে তার পিঠে নিঃশব্দে চড়ে বসল। পা দিয়ে ঘোড়ার পেটে আস্তে গুঁতো দিতেই সেটি চলতে শুরু করল। সে শুকতারা দেখে দিক নির্ণয় করে পূর্ব দিকে যাত্রা করল। চন্দ্রালোকে অশ্ব ও তার সওয়ারীর ছায়া পথের ওপর পড়ছিল। ছায়াকে সাথে করে সে প্রায় দুক্রোশ অগ্রসর হওয়ার পর দেখে, সামনে সত্যিই একটি শহর। সে শহরের বাঁ দিক ঘেঁষে যে রাস্তাটি পূর্ব দিক গেছে সেটি ধরে এগিয়ে চলল। তার কানে আসতে থাকল পানশালা থেকে মাতালদের হর্ষোল্লাস। রাস্তায় বেরিয়ে পড়া নেশাগ্রস্তদের কথোপকথন আর বাইজি বাড়ি থেকে সংগীত আর নূপুরের নিক্বণ ধ্বনি, গণিকা রমণীদের কামসিক্ত বিলোল আহ্বানও তার কানে এলো। সে তার ডান হাতের ছয় আঙুলে শক্ত করে লাগাম ধরে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে চাঁদের ঝকঝকে ফর্সা আলোয় পথ দেখে দেখে শহরটি পেরিয়ে সোজা পূর্ব দিক অভিমুখে ধেয়ে চলল।