হঠাৎ দরজায় ঠকঠক
এৎগার কেরেত [Etgar Keret]
এৎগার কেরেতের জন্ম ইসরায়েলের রামাত গান শহরে, ১৯৬৭ সালে। তাঁর মা ও বাবা—দুজনেই পোল্যান্ডের মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইহুদি নিধনযজ্ঞ থেকে বেঁচে গিয়ে ইসরায়েলে অভিবাসী হয়েছেন। কেরেত একই সঙ্গে ইসরায়েলের ও পোল্যান্ডের নাগরিক। তিনি পড়াশোনা করেছেন তেল আবিব শহরে; এখন তেল আবিব ইউনিভার্সিটি ও বির শেভার বেন—গুনিওন ইউনিভার্সিটি অব নেগেভে শিক্ষকতা করেন। কিন্তু তাঁর খ্যাতি গল্পলেখক ও গ্রাফিক বইয়ের লেখক হিসেবে। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দা বাস ড্রাইভার হু ওয়ান্টেড টু বি গড, নিমরোদ ফ্লিপআউট, দা গার্ল অন দা ফ্রিজ, সাডেনলি আ নক অন দা ডোর ও ফ্লাই অলরেডি। এ ছাড়া তিনি শিশুদের জন্য বই এবং স্মৃতিকথাও লিখেছেন।
গল্পকার হিসেবে ইসরায়েলি লেখক এৎগার কেরেতের খ্যাতি মধ্যপ্রাচ্য পেরিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। হিব্রু ভাষায় লেখা তাঁর অসংখ্য গল্প অনূদিত হয়েছে বিশ্বের ৪৫টি ভাষায়। তাঁর গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ৬০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র; স্বদেশে ও বিদেশে তিনি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পুরস্কার: প্রাইম মিনিস্টার্স অ্যাওয়ার্ড ফর লিটারেচার, চার্লস ব্রোনফম্যান প্রাইজ, সাপির প্রাইজ ফর লিটারেচার ও ন্যাশনাল জুইশ বুক অ্যাওয়ার্ড ফর ফিকশন ইত্যাদি।
তাঁর অন্যতম বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ সাডেনলি আ নক অন দা ডোর-এর নামগল্পটা পড়তে পড়তেই এটা অনুবাদ করার ইচ্ছা জাগে। অনুবাদের অনুমতি চেয়ে ইমেইলে চিঠি পাঠাই তাঁর ওয়েলি এজেন্টের কাছে। মাসখানেক চিঠি চালাচালির পর শুধু তর্ক বাংলায় প্রকাশের জন্য এৎগার কেরেতের দুটি গল্প ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করার অনুমতি পাওয়া গেল। তর্ক বাংলার পাঠকদের জন্য সাডেনলি আ নক অন দা ডোর গল্পটি প্রকাশ করা হলো।
ভূমিকা ও অনুবাদ: মশিউল আলম
হঠাৎ দরজায় ঠকঠক
‘একটা গল্প শোনাও,’ আমার লিভিং রুমের সোফায় বসে দাড়িওয়ালা লোকটা আমাকে হুকুম দিল। বলতেই হয় যে আমার জন্য এই পরিস্থিতি প্রীতিকর নয়। লোকজনকে আমি গল্প শোনাই না, গল্প লিখি। সেটাও কারও চাহিদা অনুসারে করি না। শেষবার যে আমাকে গল্প বলতে বলেছিল, সে আমার ছেলে। সেটা এক বছর আগের কথা। আমি ওকে পরির গল্প বলেছিলাম, না ফেরেটের গল্প বলেছিলাম, তা এখন আমার মনে নাই, কিন্তু মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ও গভীর ঘুমে ডুবে গিয়েছিল।
কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। কারণ, আমার ছেলের দাড়ি কিংবা পিস্তল নাই। কারণ, আমার ছেলে আমাকে গল্প বলতে বলেছিল সুন্দর করে, আর এই লোকটা স্রেফ ডাকাতের মতো আমার কাছ থেকে গল্প ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
আমি দাড়িওয়ালা লোকটাকে এই বলে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, সে যদি পিস্তলটা সরিয়ে নেয়, তাহলে তারই ভালো হবে, আমাদের দুজনেরই ভালো হবে। গুলিভর্তি পিস্তলের নল মাথায় তাক করা অবস্থায় মাথা খাটিয়ে গল্প বানানো কঠিন।
কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। বলল, ‘এই দেশে কিছু পেতে হলে জোর খাটাতেই হবে।’
সে সদ্যই সুইডেন থেকে এসেছে; সুইডেনে সবকিছু একেবারেই অন্য রকম। সেখানে কিছু চাইলে, ভদ্রভাবে চাইলে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই জঘন্য গরম আর ভ্যাপসা মধ্যপ্রাচ্যে তা হওয়ার নয়। এখানে কী করলে কাজ হয় আর কী করলে কাজ হয় না, তা বুঝতে লাগে মাত্র এক সপ্তাহ। ফিলিস্তিনিরা একটা রাষ্ট্র চেয়েছিল, সুন্দরভাবেই চেয়েছিল, ভদ্রভাবেই চেয়েছিল। কিন্তু তারা কি তা পেয়েছে? ঘোড়ার ডিম পেয়েছে। তাই তারা বোমা মেরে শিশুদেরসহ বাস উড়িয়ে দেওয়া শুরু করল। তখন ঠিকই লোকজন তাদের কথায় কান দিতে লাগল। সেটলাররা সংলাপ চেয়েছিল। কেউ কি ভ্রুক্ষেপ করেছিল? মোটেও না। তাই তারা জোর খাটাতে লাগল, সীমান্ত প্রহরীদের গায়ে গরম তেল ঢেলে দেওয়া শুরু করল। তখন হঠাৎ করেই তাদের কথা শোনার মেলা লোক জুটে গেল। এই দেশে জোর যার মুলুক তার। সেটা হোক রাজনীতিতে, হোক অর্থনীতিতে কিংবা গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায়। গায়ের জোরই একমাত্র ভাষা, যা আমরা বুঝতে পারি।
সুইডেন, দাড়িওয়ালা লোকটা যে দেশ থেকে এসেছে, সেই সুইডেন প্রগতিশীল এবং বেশ কয়েকটা দিকে খুব উন্নত। সুইডেন মানে শুধু গানের দল আবা বা আইকিয়া বা নোবেল প্রাইজ নয়। সুইডেন এক স্বতন্ত্র দুনিয়া, আর তাদের যা আছে তা তারা অর্জন করেছে শান্তিপূর্ণ পথে।
সুইডেনে থাকতে লোকটা যদি ‘এইস অব বেইজ’ গ্রুপের সোলোইস্টের কাছে যেত, তার দরজায় নক করত এবং তাকে একটা গান গাইয়ে শোনাতে অনুরোধ করত, তাহলে মেয়েটা তাকে তার বাসার ভিতরে আমন্ত্রণ জানাত এবং চা বানিয়ে খাওয়াত। তারপর খাটের তলা থেকে অ্যাকুইস্টিক গিটারটা বের করে লোকটাকে বাজিয়ে শোনাত।
আর এই দেশে? মানে, এখানে সে যদি পিস্তল না দেখাত, তাহলে আমি ওকে তৎক্ষণাৎ গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতাম।
আমি নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলাম।
‘তুমি নিজেই ঠিক করো,’ দাড়িওয়ালা লোকটা রাগে গরগর করে উঠল, পিস্তল কক করল। ‘হয় গল্প, নয়তো দুই চোখের মাঝখানে বুলেট।’
দেখলাম, আমার উপায় নাই। লোকট রসিকতা করছে না।
গল্প শুরু করে দিলাম, ‘দুইটা লোক এক ঘরে বসে আছে, হঠাৎ দরজায় ঠকঠক।’
দাড়িওয়ালা লোকটা শক্ত হয়ে গেল, মুহূর্তের জন্য আমার মনে হলো, গল্পটা সে শুনতে শুরু করেছে। কিন্তু তা নয়। সে শুনছে অন্য কিছু। কেউ দরজায় টোকা দিচ্ছে।
‘খুলে দাও,’ লোকটা আমাকে বলল, ‘কিন্তু উল্টাপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করো না। যে-ই আসুক, তাকে চলে যেতে বলো। জলদি করো, নইলে খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে।’
দরজায় এক যুবক; এসেছে একটা জরিপের কাজে। অল্প কয়েকটা প্রশ্ন নিয়ে। ছোট ছোট প্রশ্ন। এখানকার গ্রীষ্মকালের বেশি আর্দ্রতা আর আমার ওপর সেটার প্রভাব নিয়ে। তাকে বললাম, এ বিষয়ে আমার কোনো আগ্রহ নাই, কিন্তু সে ঠেলে আমাকে সরিয়ে দিয়ে বাসার ভিতরে ঢুকে পড়ল।
‘উনি কে?’ দাড়িওয়ালা লোকটাকে দেখিয়ে সে আমাকে জিগ্যেস করল।
‘আমার ভাতিজা, সুইডেন থেকে এসেছে।’ আমি মিথ্যা বললাম। ‘ওর বাবা তুষারপাতে মারা গেছে, ও এসেছে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য। আমরা উইল নিয়ে কথাবার্তা বলছিলাম। আপনি কি আমাদের এই পারিবারিক আলাপের মধ্যে না থেকে দয়া করে বিদায় নেবেন?’
‘কাম অন, ম্যান,’ জরিপওয়ালা আমার কাঁধে মৃদু চাপড় মেরে বলল। ‘জাস্ট অল্প কয়টা প্রশ্ন। এই অধমকে দুটো পয়সা আয় করার সুযোগটা তো দেবেন। ওরা আমাকে জনপ্রতি উত্তরদাতার হিসেবে পয়সা দেবে।’ সে তার বাইন্ডারটা চেপে ধরে সোফায় বসে পড়ল। সুইডিশ লোকটা বসল তার পাশে। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম, তাকে বোঝাতে চাইলাম যে আমি সত্যিই চাচ্ছি সে চলে যাক।
‘আমি আপনাকে চলে যেতে অনুরোধ করছি,’ আমি তাকে বললাম, ‘আপনি অসময়ে এসেছেন।’
‘অসময়ে এসেছি, তাই না?’ সে তার প্লাস্টিকের বাইন্ডারটা খুলে একটা পিস্তল বের করল। ‘কিন্তু কেন আমার আসাটাকে অসময়ে আসা বলা হচ্ছে? আমার গায়ের রং ফর্সা নয় বলে? আমি যথেষ্ট ভালো লোক নই বলে? সুইডিশদের জন্য তো আপনার দুনিয়ার সমস্ত সময়ই আছে, আছে না? কিন্তু মরক্কোর একটা লোকের জন্য, যুদ্ধফেরত যে লোকটা তার প্লীহার অনেকগুলো টুকরা লেবাননে ফেলে এসেছে, তার জন্য আপনি আপনার বালের একটা মিনিটও খরচ করতে পারবেন না?’
আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বললাম যে ব্যাপারটা মোটেও সে রকম নয়, সে এসে পড়েছে সুইডিশ লোকটার সঙ্গে আমার আলাপের খুবই নাজুক একটা মুহূর্তে। কিন্তু জরিপওয়ালা তার পিস্তলটা তুলে ঠোঁটের কাছে নিয়ে ইশারায় আমাকে চুপ করতে বলল।
‘আসেন,’ সে বলল, ‘অজুহাত রাখেন। বসেন ওখানে, আর ওটাকে বের করেন।’
‘কী বের করব?’ আমি জিগ্যেস করলাম। এখন আমার বেশ তটস্থ দশা। সুইডিশটার কাছেও একটা পিস্তল আছে। পুরা ব্যাপারটা একদম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। প্রাচ্য হলো প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য হলো পাশ্চাত্য, এই হলো শেষ কথা। ভিন্ন ভিন্ন মানসিকতা। নইলে সুইডিশটা এতক্ষণে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারত, এই কারণে যে সে গল্পটা শুনতে চেয়েছিল একাই।
‘আমাকে শুরু করতে বাধ্য করো না,’ জরিপওয়ালা বলল। আমার মেজাজের কিন্তু আগামাথা নাই। গল্পওয়ালাকে তাড়াও, জলদি করো!’
‘হুম্ম্।’ সুইডিশ লোকটা আমাদের কথার মধ্যে ঢুকে পড়ল, সে-ও তার জিনিসটা বের করল।
আমি গলা পরিষ্কার করে আবার গোড়া থেকে শুরু করলাম, ‘তিনজন লোক বসে আছে একটা ঘরে।’
‘কিন্তু তারপর কোনো ‘‘হঠাৎ দরজায় ঠক্ঠক্’’ চলবে না,’ সুইডিশটা ঘোষণা দিল।
জরিপওয়ালা ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারল না, কিন্তু সুইডিশটার সঙ্গে যোগ দিল। বলল, ‘বলে যাও, কিন্তু দরজায় কোনো ঠকঠকানি চলবে না। অন্য কিছু বলো। আমাদের তাক লাগিয়ে দাও।’
আমি থেমে লম্বা করে একটা নিশ্বাস নিলাম। ওরা দুজনই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। শুধু আমিই কী করে সব সময় এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ে যাই? আমি বাজি ধরে বলতে পারি, আমোস ওজ কিংবা ডেভিড গ্রসমানের জীবনে এ রকম পরিস্থিতি কখনো আসেনি।
হঠাৎ দরজায় ঠকঠক। ওদের দুজনের চাহনি বিপজ্জনক হয়ে উঠল। আমি কাঁধ ঝাঁকালাম। আমার কিছু করার নাই। আমার গল্পটাতে এমন কিছুই নাই, যার সঙ্গে দরজায় ওই টোকার কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাবে।
‘লোকটাকে তাড়াও,’ জরিপওয়ালা আমাকে হুকুম করল।
আমি দরজাটা একটুখানি খুললাম। বাইরে পিৎজা ডেলিভারি দিতে আসা এক লোক।
‘আপনি কেরেত?’ সে বলল।
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি তো পিৎজার অর্ডার করিনি।’
‘কিন্তু ঠিকানা তো চৌদ্দ সামেনহোফ স্ট্রিট।’ ছাপা ডেলিভারি স্লিপ দেখিয়ে সে আমাকে বলল, তারপর আমাকে ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ল।
‘তাতে কী হয়েছে? আমি বললাম, ‘আমি কোনো পিৎজার অর্ডার দিইনি।’
‘ফ্যামিলি সাইজ,’ সে নাছোড়বান্দা, ‘হাফ পাইনঅ্যাপল, হাফ অ্যানচৌভি। প্রিপেইড। ক্রেডিট কার্ড। জাস্ট আমার টিপসটা দিলেই আমি চলে যাই।’
‘তুমিও কি গল্প নিতে এসেছ এখানে?’ সুইডিশটা জেরার সুরে বলল।
‘কিসের গল্প?’ পিৎজাওয়ালা বলল। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছিল যে সে ভান করছিল। কিন্তু ভান-ভণিতায় সে খুব পটু নয়।
‘বের করো,’ জরিপকারী লোকটা পিৎজাওয়ালাকে একটু গুঁতো মেরে বলল, ‘পিস্তলটা বের করো।’
‘আমার পিস্তল নাই,’ পিৎজাওয়ালা আনাড়ির মতো স্বীকার করল, তারপর তার কার্ডবোর্ডের ট্রের তলা থেকে বের এক আনল একটা মাংস কাটার ছুরি। ‘কিন্তু সে যদি একটা ভালো গল্প না বলে, তাহলে আমি তাকে কুচি কুচি করে কেটে ফেলব, একদম চোখের পলকে।’
সোফায় বসে আছে তিনজন: ডানে সুইডিশটা, তারপর পিৎজাওয়ালা, তারপর জরিপওয়ালা।
‘এভাবে আমি পারব না,’ আমি তাদের বললাম। ‘আপনারা তিনজন আপনাদের অস্ত্রপাতি আর সবকিছু নিয়ে এভাবে বসে থাকলে তো আমি কোনো গল্প বলতে পারব না। আপনারা বরং বাইরে গিয়ে বিল্ডিংটার আশপাশে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসেন; যখন ফিরে আসবেন, ততক্ষণে আপনাদের জন্য কিছু একটা তৈরি হয়ে যাবে।’
‘এই হারামজাদা পুলিশ ডাকার ফন্দি আঁটছে,’ জরিপওয়ালা বলল সুইডিশ লোকটাকে। ‘কী ভেবেছে সে? আমাদের জন্ম হয়েছে গতকাল?’
‘আসেন তো! আমাদের একটা গল্প দিয়ে দিলেই আমরা যে যার মতো চলে যাব,’ অনুরোধের সুরে বলল পিৎজাওয়ালা। ‘ছোট্ট একটা। এ রকম একগুঁয়ে হতে নাই। জানেনই তো, দিনকাল কঠিন। বেকারত্ব, সুইসাইড বোম্বিং, ইরানিগুলা। মানুষ অন্য রকমের কিছুর জন্য তৃষ্ণার্ত। কী মনে হয় আপনার? আমাদের মতো আইন-কানুন মেনে চলা সুবোধ লোকেরা এতকাল কী করেছে? আমরা কিন্তু ডেসপারেট, বুঝলেন? আমরা ডেসপারেট।’
আমি খাঁকরে গলা পরিষ্কার করে আবার শুরু করলাম।
‘চারজন লোক বসে আছে একটা ঘরে। গরম পড়েছে। তাদের একঘেয়ে লাগছে। এয়ারকন্ডিশনারটা গোলমাল করছে, গরম বাতাস বেরোচ্ছে। একজন একটা গল্প বলতে বলল। দ্বিতীয়জন যোগ দিল তার সঙ্গে, তারপর তৃতীয় জন...।’
‘এটা গল্প হচ্ছে না,’ জরিপওয়ালা প্রতিবাদ করে উঠল, ‘এটা তো প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান হচ্ছে। এই মুহূর্তে এখানে যা ঘটছে, হুবহু তারই বিবরণ। আমরা যা থেকে পালানোর চেষ্টা করছি ঠিক তা-ই। তুমি আর বলো না, আবর্জনার ট্রাকের মতো আমাদের ওপর বাস্তবতা ঢেলে দিয়ো না। মিয়া, কল্পনা কাজে লাগাও! সৃষ্টি করো, উদ্ভাবন করো; অকপটে, নিজেকে একদম খুলে দিয়ে।’
আমি মাথা নাড়ি, তারপর আবার শুরু করি।
‘এক লোক একটা ঘরে বসে আছে, আর কেউ নাই। সে একা। সে একজন লেখক। সে একটা গল্প লিখতে চাইছে। সে শেষ গল্পটা লেখার পরে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে, সে জন্য তার খারাপ লাগছে। কিছু-একটা থেকে কিছু-একটা সৃষ্টি করার অনুভূতিটা সে ফিরে পেতে চাইছে। হ্যাঁ, কিছু-একটা থেকে কিছু-একটা। কারণ, কিছু-নয় থেকে কিছুর মানে হলো, যা নাই তা থেকে কিছু বানানো, অর্থাৎ তার কোনো মূল্যই নাই। যে-কেউ তা করতে পারে। কিন্তু কিছু-একটা থেকে কিছু-একটা মানে হলো আসলে তা পুরোটা সময়জুড়েই সেখানে ছিল, তোমার ভিতরে; তুমি তা আবিষ্কার করেছ নতুন একটা-কিছুর অংশ হিসেবে, সেটা আগে কখনোই ঘটেনি। লোকটা সিদ্ধান্ত নিল সে একটা গল্প লিখবে অবস্থা নিয়ে। রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে নয়, সামাজিক অবস্থা নিয়েও নয়। সে সিদ্ধান্ত নিল গল্পটা লিখবে মানুষের অবস্থা নিয়ে, মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে। তার অভিজ্ঞতায় এই মুহূর্তে মানবিক পরিস্থিতি যেভাবে ধরা পড়ছে। কিন্তু তার মনে কিছু এল না। কোনো গল্প আসছে না। কারণ, এই মুহূর্তের মানবিক পরিস্থিতি যেভাবে তার অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ছে, তা কোনো গল্প হওয়ার যোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। তাই সে হাল ছেড়ে দিতে যাচ্ছে, ঠিক তক্ষুনি হঠাৎ...’
‘আমি কিন্তু তোমাকে আগেই সাবধান করে দিয়েছি,’ সুইডিশটা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘দরজায় কোনো ঠকঠকানি চলবে না।’
‘কিন্তু আমার উপায় নাই,’ আমি জেদি সুরে বললাম, ‘দরজায় টোকা ছাড়া কোনো গল্প হবে না।’
‘ওকে বলে যেতে দাও,’ নরম সুরে বলল পিৎজাওয়ালা, ‘বেচারাকে একটু দয়া করো। তুমি দরজায় টোকা চাও তো? ঠিক আছে, থাকুক তোমার দরজায় টোকা। চালিয়ে যাও, যতক্ষণ দরজার ঠকঠকানি থেকে গল্প আসতে থাকে।’
© 2021, Etgar Keret, used by permission of The Wylie Agency (UK) Ltd.