জীবনের অর্থ কোথায় খুঁজতে হয়?
বইটা যখন প্রথম হাতে পাই, তখন মাসুক হেলালের আঁকা ল্যু সালোমের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। ল্যু সালোমের যেসব ছবি পাওয়া যায়, সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি আমি, আঁকার চেষ্টাও করেছি। এই রকম শান্ত মায়াবী মুখ সেটা নয়। বইটি যাঁরা পড়েছেন বা পড়বেন, তাঁরা ল্যু সালোমেকে নিজেদের মতো চিনবেন, ছবি হবে একেকজনের কাছে একেক রকম। ল্যু সালোমে সেই হীরকখণ্ড, যাতে আলো পড়লে, ভিন্ন ভিন্ন এঙ্গেলে ভিন্ন ভিন্ন রং দেখা যায়। যাঁরা ল্যুকে একদমই জানেন না, বইটির নামই তাঁদের অনেক কিছু বলে দেবে। অবাক হয়ে ভাববেন নিৎশে, রিলকে ও ফ্রয়েডের নামের সাথে একজন ল্যু সালোমের নাম!
ল্যু ফন আন্দ্রিয়াস সালোমে তাঁর পুরো নাম। জন্ম ১৮৬১ সালে, আর মৃত্যু ১৯৩৭ সালে। ৭৬ বছরের একটা জীবন পুরোপুরি নিজের পছন্দে কাটিয়েছেন লেখক ল্যু সালোমে। রাশিয়ার জারের আর্মি জেনারেল গুস্তাফ ফন সালোমের আদরের কন্যা ল্যু। বাবা মা আর ভাইদের নিয়ে সুখী একটা পরিবারে কাটিয়েছেন মধুর শৈশব। শৈশবের সেই সেন্ট পিটার্সবার্গ, বাকি জীবন ইউরোপের দেশে দেশে কাটানো ল্যুকে বারবার হাতছানি দিয়েছে।
বইটা সেই অর্থে ল্যু সালোমের জীবনী নয়, লেখক আনোয়ারা সৈয়দ হক ল্যুর জীবনের খণ্ড খণ্ড অংশে আলো ফেলেছেন। তবে পুরো বইটি পড়ার পর পাঠকের মনে একজন ল্যু সালোমে স্পষ্ট ছাপ রাখবেন। বইটি লিখতে নিশ্চয়ই আনোয়ারা সৈয়দ হককে প্রচুর বইপত্র ঘাঁটতে হয়েছে, কিন্তু বইয়ের সঙ্গে কোনো রেফারেন্স বইয়ের তালিকা যুক্ত নেই। থাকলে সেসব সূত্র ধরে আগ্রহী পাঠক ল্যুকে আরও বিশদে জানতে পারতেন। তবে ল্যুর লেখা বইগুলোর নাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এই বইয়ে। বইটিতে আরও আছে ল্যুর জীবনে আসা বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাজ ও তাঁদের জীবনে ল্যুর প্রভাব সম্পর্কে। প্রথমা প্রকাশনের এই বইয়ের জন্য আনোয়ারা সৈয়দ হক অবশ্যই সাধুবাদ পাবেন।
পর পর পাঁচ ছেলের পর জেনারেলের ঘরে এসেছিলেন ল্যু সালোমে। জাঁদরেল পিতা কন্যা পেয়ে হয়ে গিয়েছিলেন কোমল পিতা। ভাইদের আদরে, বাবা-মায়ের আহ্লাদে আনন্দময় জীবন শুরু হয়েছিল। ধার্মিক এবং অভিজাত পরিবারে ধর্ম ও এটিকেট মেনে চলার বাড়াবাড়ি ছিল। তবু সেসব তার স্বাধীনতায় বাধা হয়নি। বাবা ছিলেন বন্ধুর মতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে কাটাতেন দুজন। বাবার সঙ্গে থাকলে এক গর্বিত আত্মবিশ্বাস ঘিরে থাকত তাকে। অবাক ব্যাপার হলো, এত ধার্মিক পরিবেশে বড় হতে হতেও কৈশোরে তার লেখা প্রথম গল্পের নাম ‘ঈশ্বরবিহীন একটি সময়’। বিশাল বাড়ির কোনো একটি কোণে বসে লিখে চলতেন গল্প। চারপাশের পরিচিত মানুষদের সাথে কাল্পনিক মসলা মিশিয়ে মনে মনে বানিয়ে ফেলতেন ভিন্ন মানুষ। সমবয়সীদের সঙ্গে রচিত হতে লাগল দূরত্ব।
সতেরো বছর বয়সে পরিচয় হলো ধর্মযাজক গিলোটের সঙ্গে। চল্লিশের গিলো, ল্যুর জীবনে একসঙ্গে আশীর্বাদ ও অভিশাপ হয়ে এলেন। শুরু হলো পড়া; ধর্ম, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব; গিলোটের হাত ধরেই পরিচয় হলো বিখ্যাত সব দার্শনিকের দর্শনতত্ত্বের সঙ্গে। পড়লেন দেকার্তে, পাসকাল, কান্ট, কিয়ের্কেগার্দ, রুশো, ভলতেয়ার, স্পিনোজা, শোপেনহাওয়ার। পাশাপাশি হেনদ্রিক গিলো তাকে পড়তে শেখালেন ফরাসি ও জার্মান সাহিত্য। গ্যেটে, ভিক্টোর হুগো, বালজাক, গীতা, উপনিষদ, কনফুসিয়াস। এমন ছাত্রী পেয়ে খুব খুশি ছিলেন হেনদ্রিক গিলো। দিনরাত উন্মাদের পড়তে লাগলেন ল্যু। কান্ট পড়ার জন্য ডাচ ভাষা শিখলেন। স্পিনোজা হয়ে উঠলেন তার প্রিয় দার্শনিক, প্রিয় সাহিত্যিক গ্যেটে।
পড়ার আনন্দে তার মন ভরে থাকলেও ক্রমাগত অনিয়মে শরীর দুর্বল হতে লাগল। এ সময়ে মারা গেলেন প্রাণপ্রিয় বাবা। সেই শূন্যতা তাকে একেবারে কাবু করে ফেলল। পিতার মতো গিলো ল্যুর প্রেমে পড়ে নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে বিয়ে করতে চাইলেন ল্যুকে! নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গির্জার এক কোণে ল্যুকে জোর করে চুমু খেতে গেলেন। টলে উঠল ল্যু সালোমের দুনিয়া। অসুস্থ হয়ে গেলেন। জন্মভূমি থেকেই মন উঠে গেল, মাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন সুইজারল্যান্ডে, ল্যুর তখন কুড়ি। মেয়ের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করেই জুরিখে যেতে রাজি হয়েছিলেন মা। চিকিৎসার পাশাপাশি মেয়েকে ভর্তি করিয়ে দিলেন জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। তখনকার ইউরোপে এই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা ভর্তি হতে পারত। কিন্তু জুরিখের ঠাণ্ডা স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় ল্যুর অসুস্থতা বেড়েই যাচ্ছিল। দুই বছর পর গ্রীষ্ম কাটাতে ইতালিতে গেলেন মা মেয়ে। রোমে বাড়ি ভাড়া করে খানিক থিতু হলেন, সুস্থ হয়ে উঠলেন ল্যু।
রোমে এসেই ল্যু পেয়ে গেলেন মনের মতো পরিবেশ। একের পর এক পড়ুয়া লোকজনের সাথেই পরিচয় হতে লাগল। পল রি তখন অ্যারিস্টটলের নৈতিক দর্শনের ওপর থিসিস লিখছিলেন। বন্ধুত্ব হয়ে গেল রির সঙ্গে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত দর্শনের আলোচনা। এই পল রির বন্ধু ফ্রেডারিক নিটশে। ল্যু সালোমের কথা তাঁকে চিঠিতে লিখলেন রি। রোমে চলে এলেন নিটশে। তিনজনে একসঙ্গে চলল লেখাপড়া। কিন্তু যা হয় আরকি, দুজনেই সালোমের প্রেমে পড়লেন। সালোমে স্পষ্ট বললেন, বন্ধুত্ব হতে পারে, প্রেমও হতে পারে কিন্তু সবই হবে মানসিক, শারীরিক নয়। ল্যু সালোমে বিশ্বাস করতেন, কুমারীত্ব হলো সেই শক্তি, যা তাকে জ্ঞানের পথে স্থির রাখবে।
বইটাতে কয়েক জায়গায় সময়ের ধারাবাহিকতা মানা হয়নি। আগের ঘটনা পরে আর পরের ঘটনা আগে এসে গেছে। নিটশে ও নিটশের বোন এলিজাবেথের সঙ্গে ল্যু সালোমের তিক্ত সম্পর্ক নিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। লেখকের পেশা যেহেতু মনোরোগ নিয়ে কাজ করা, ফলে কোথাও কোথাও নির্মোহভাবে ঘটনাগুলো এগিয়ে যায়নি, কোথাও কোথাও আরোপিত মন্তব্য আছে।
নিটশে, পল রি ও ল্যু—এই তিনজনের বন্ধুত্ব, তাঁদের তিনজনের লেখালেখিতে তিনভাবে প্রভাব ফেলেছিল। প্রচুর সময় তাঁরা একসঙ্গে কাটিয়েছেন। নিটশে সেই সময় দাস স্পোক জরাথুস্ত্র নিয়ে ভাবছিলেন। ল্যু তাঁর অনেক পরে, ১৮৯৪ সালে, তেত্রিশ বছর বয়সে নিটশের দর্শন নিয়ে, ‘নিটশে ও তাঁর দর্শন’ লেখেন, সেখানে ব্যক্তি নিটশের অসুস্থতা ও আরোগ্যের সময়ের দুই ধরনের মানসিক অবস্থার সঙ্গে তাঁর দর্শনের যোগসূত্র দেখিয়েছেন।
মেয়েকে রোমে বেশ ভালো থাকতে দেখে আশ্বস্ত হয়ে পিটার্সবার্গে ফিরে যান মা। ল্যুর স্বাধীনতার পালে আরেক দফা হাওয়া লাগে। চলে আসেন জার্মানি। সঙ্গে বন্ধু পল রি। এই সময় ল্যু শুরু করেন তাঁর তিনশো পৃষ্ঠার উপন্যাস—স্ট্রাগলিং ফর গড। তেইশ বছর বয়সে লেখা এই উপন্যাস লেখক হিসেবে তাঁকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। এই বইয়ের সূত্রেই তাঁর জীবনে এসে হাজির হন ফ্রিডরিশ আন্দ্রিয়াস নামে বহুভাষাবিদ তুখোড় মেধাবী এক লোক। পরিচয়ের এক বছরের মধ্যে চল্লিশের শিক্ষক আন্দ্রিয়াসকে বিয়ে করে ফেলেন পঁচিশের ল্যু। সকলেই অবাক হয়েছিল, হৃদয় কতজনের ভেঙেছিল কে জানে। বিয়ের আগেই ল্যুর শর্ত ছিল যৌন সম্পর্কে না জড়ানোর। আন্দ্রিয়াস ভেবেছিলেন, বিয়ের পর এই প্রতিজ্ঞা আর রাখতে পারবেন না ল্যু। কিন্তু আদতে দেখা গেল, ল্যু নিজের মতোই রইলেন। বিয়ে তাঁকে একজন ভালো মানুষ বন্ধু দিল, আর কোনো পরিবর্তন হলো না তাঁর জীবনের। নিজের লেখাপড়া নিয়েই ডুবে রইলেন ল্যু। যেখানেই যান, যখনই ফেরেন, দেখেন বাড়িতে একজন তাঁর অপেক্ষায় আছে। এটা তাঁর জন্য খুব শান্তির ছিল। আন্দ্রিয়াসের জন্য বার্লিনের দিনগুলো, প্রবল বিস্ময়ের ছিল বলেই মনে হয়। এই সময় ল্যু খুব নাটক দেখতেন আর নাট্য সমালোচনা লিখতেন। বার্লিনের নাট্য জগতে দারুণ গতি এনেছিল ল্যুর আগমন।
উনত্রিশ বছর বয়সে লিখলেন আরেকটি উপন্যাস—রুথ। এটিও পাঠকপ্রিয় হলো। সেই খুশিতে স্বামীকে নিয়ে কিছুদিন ঘুরে বেড়ালেন মিউনিখ, প্যারিস, ভিয়েনা। একের পর এক লিখে চললেন প্রবন্ধ। ধর্ম, নারী ও সাহিত্য ছিল সেসব প্রবন্ধের বিষয়। ক্রমাগত লিখে চললেন গল্প ও উপন্যাস। সে সময় আরও একটি সমালোচনামূলক কাজ তাঁকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। ইবসেনের ডলস হাউজ পড়ে লিখলেন ইবসেনস হিরোইনস। ল্যু সালোমে তখন একত্রিশ।
এরপরের কয়েকটি বছর একের পর এক স্বামীর সঙ্গে নিষ্কাম সম্পর্কের জটিলতা, বন্ধু পল রি ও নিটশেকে হারানো, পত্রিকায় এলোমেলো লেখা, নিটশে বোনের বিষোদ্গার ইত্যাদি নিয়ে খুব ঝামেলার সময় কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে বন্ধু ফ্রিডাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ইউরোপ সফরে।
ছত্রিশ বছর বয়সে ঘটে গেল সেই ম্যাজিক। বাইশ বছরের তরুণ কবি রাইনার মারিয়া রিলকের সঙ্গে দেখা হয় ছত্রিশের ল্যু সালোমের। প্রেম এলো প্রলয়ের মতো। এত দিন ধরে বন্ধুত্ব, প্রেম, বিয়ে—সবকিছুই ছিল মানসিক। এবার শরীর-মন একসঙ্গে মিলে গেল। সবকিছু হয়ে গেল কবিতাময়। ল্যুর লেখা ‘জিসাস দ্য জু’ রিলকের মনকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। একের পর এক রিলকের কবিতা এডিট করছিলেন ল্যু। কবিতা থেকে অপ্রয়োজনীর শব্দ সরিয়ে দিতেই কবিতা হয়ে উঠছিল প্রাণবন্ত। ল্যুর সেই সময়ে লেখা উপন্যাস ‘ফেনিসকা’য় দেখা যায় জীবনকে পরিপূর্ণরূপে উপভোগ না করার অনুশোচনা।
বইটা সেই অর্থে ল্যু সালোমের জীবনী নয়, লেখক আনোয়ারা সৈয়দ হক ল্যুর জীবনের খণ্ড খণ্ড অংশে আলো ফেলেছেন। তবে পুরো বইটি পড়ার পর পাঠকের মনে একজন ল্যু সালোমে স্পষ্ট ছাপ রাখবেন। বইটি লিখতে নিশ্চয়ই আনোয়ারা সৈয়দ হককে প্রচুর বইপত্র ঘাঁটতে হয়েছে, কিন্তু বইয়ের সঙ্গে কোনো রেফারেন্স বইয়ের তালিকা যুক্ত নেই। থাকলে সেসব সূত্র ধরে আগ্রহী পাঠক ল্যুকে আরও বিশদে জানতে পারতেন। তবে ল্যুর লেখা বইগুলোর নাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এই বইয়ে। বইটিতে আরও আছে ল্যুর জীবনে আসা বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাজ ও তাঁদের জীবনে ল্যুর প্রভাব সম্পর্কে। প্রথমা প্রকাশনের এই বইয়ের জন্য আনোয়ারা সৈয়দ হক অবশ্যই সাধুবাদ পাবেন
‘এন রুট’ নামের একটা গল্পও লেখেন এ সময়ে, যৌনতা বিষয়ে নতুন বোধের কথা উঠে আসে এই গল্পে। তখনো ফ্রয়েডের সাথে দেখা হয়নি ল্যুর। রিলকের সঙ্গে স্ত্রীর প্রেম নিয়ে শুরুতে মাথা ঘামাননি আন্দ্রিয়াস। নিশ্চিত ছিলেন যে যৌনতার দিকে তো যাবেই না। কিন্তু যখন জানলেন, তখন সেটা তাঁর জন্য বেদনার চেয়ে বেশি ছিল বিস্ময়ের। এবং তাঁদের বিয়ে ভাঙল না; বরং রিলকের প্রতি যেন স্নেহই বোধ করলেন আন্দ্রিয়াস। তিনজনে মিলে রাশিয়ায় ঘুরতেও গেলেন।
রিলকের ছেলেবেলার দুঃখময় জীবন নিয়ে এই সময় ল্যু লিখলেন একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস—ডিভিয়েশন। রাশিয়া ঘুরে এসে লিখলেন ভোলগা। দিনরাত একাকার করে লিখে চলেছেন। এই সময় রিলকের উন্মত্ত প্রেম তাঁকে খানিক বিরক্ত করে তুলল। বুঝতে পারলেন, কঠিন হওয়ার সময় এসেছে। ডায়রিতে লিখলেন—আমার নিষ্ঠুর হতে বাধবে না, রিলকেকে অবশ্যই চলে যেতে হবে! রিলকের সঙ্গে চার বছরের প্রেম তাঁকে লেখাপড়া থেকে খানিক দূরে সরিয়ে ফেলছিল, প্রচুর সময় নষ্ট হচ্ছিল, অখণ্ড মনঃসংযোগ বিঘ্নিত হচ্ছিল। ফলে তাঁকে কঠোর হতে হয়েছিল।
আবার প্রবন্ধে ফিরলেন। লিখলেন ওল্ড এজ অ্যান্ড ইনটারনিটি। চল্লিশের পর একে একে লিখলেন অনেকগুলো গল্প, বইয়ের নাম—আ ল্যান্ড ইন বিটুইন। শৈশবের রাশিয়া উঠে এলো এসব গল্পে।
রিলকে বিয়ে করলেন অন্য একজনকে। আর ল্যুর প্রেম হলো ডাক্তার, সাইকো অ্যানালিস্ট জেমকের সঙ্গে। ডায়েরিতে লিখলেন—প্রতিটি সম্পর্কই যেন বর্ষব্যাপী বসন্তের বিস্তার। দীর্ঘ সময়ের জন্য সংসার ছেড়ে জেমেকের সঙ্গে পাহাড়ে-সাগরে বেরিয়ে পড়তেন। আবার লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে ফিরে আসতেন নিজের ঘরে। প্রতিবারই ফিরে দেখতেন, অপেক্ষা করে আছে আন্দ্রিয়াস। আগের মতোই স্ত্রীর বইয়ের প্রুফ দেখে দিতেন আর সকালের ঘুম ভাঙলেই ল্যু দেখতেন কফি হাতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আন্দ্রিয়াস।
শুরু হয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। নিজের দেশের জন্য চিন্তিত হলেন ল্যু। সঙ্গে আরও খবর অনেক কিছু ঘটে গেল। রিলকে কন্যাসন্তানের বাবা হলেন, নাম রাখলেন ল্যুর উপন্যাসের নামে—‘রুথ’। বাসার কাজে সহায়তাকারী মেয়েটি গর্ভবতী হলো আন্দ্রিয়াসের সঙ্গে। প্রথমে বিস্মিত হলেও স্বামীর এই সন্তানকে আপন করে নিলেন ল্যু, নাম রাখলেন—মেরি। এই সময় উপন্যাস লিখলেন—ম্যারেজ।
এবং ১৯১১ সালে ল্যু সালোমের পঞ্চাশ বছর বয়সে দেখা হলো ফ্রয়েডের সঙ্গে ভিয়েনায়। তার আগেই লিখে ফেলেছেন অ্যানাল ইরোটিক। সাহসের সঙ্গে ঘোষণা দিলেন, তিনি ফ্রয়েডের সঙ্গে কাজ করতে চান। ফ্রয়েড যাঁকে বলতেন নোংরা কাপড় পরিষ্কার করা, সেই সাইকো অ্যানালিসিসের মতো নোংরা কাজ করতে চান ল্যু সালোমে। ল্যুর আগ্রহে রাজি হলেন ফ্রয়েড। এ সময় প্রবন্ধ লিখলেন ল্যু—দ্য হিউম্যান অ্যাজ ওম্যান। নারী-পুরুষ পরস্পরের পরিপূরক এই ধারণা বাতিল করলেন। স্পষ্ট করে বললেন, দুটি সম্পূর্ণ আলাদা সত্তা। এই প্রবন্ধ নিয়ে সেই সময় বিতর্ক হয়েছিল। বাড়িতে রোগী দেখা শুরু করলেন ল্যু। ফ্রয়েডের কাছে যা শিখেছিলেন আর নিজের লেখাপড়া—সব মিলিয়ে যুদ্ধকালীন অস্থিরতার সময়ে সাইকোথেরাপির কাজ শুরু করলেন। ফ্রয়েড খুশি হয়েই উৎসাহ দিয়েছিলেন। ফ্রয়েডের সঙ্গে নিয়মিত চিঠিতে যোগাযোগ ছিল।
১৯৩০ এ মারা গেলেন স্বামী আন্দ্রিয়াস। অবসান হলো দীর্ঘদিনের জটিল নিষ্কাম দাম্পত্যের। বন্ধু হারানোয় কষ্ট পেলেন ল্যু। তাঁর সবচেয়ে স্বস্তিদায়ক সঙ্গী ছিলেন আন্দ্রিয়াস।
১৯৩২ সালে সত্তর বছর বয়সে জীবনী লিখতে শুরু করলেন ল্যু—স্কেচ অব মাই এক্সপেরিয়েন্স অব মাই লাইফ। খবর পেয়ে ফ্রয়েড লিখলেন, ‘আমি শুনে খুশি হয়েছি যে তুমি জীবনী লিখতে শুরু করেছ। নিটশের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা আমাকে সর্বদা বিরক্ত করেছে এই ভেবে যে তোমার প্রতি একটা বিরাগভাজন দৃষ্টিতে ব্যাপারটা দেখা হয়, যা আদতে ঠিক নয়। তুমি সবকিছু সহ্য করেছ এবং সর্বদাই বিনীত থেকেছ। আশা করি, অন্যায় দোষারোপ থেকে তুমি অবশেষে নিজেকে বের করে আনবে।’ জবাবে ল্যু সালোমে লিখলেন—‘ওই সব কাদা-ছোড়াছুড়িতে আমি নেই, নিটশের বোন এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ঝামেলা করেছে। এসব প্যাঁচাল আমার আত্মজীবনীতে আনব না আমি।’
১৯৩৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ছিয়াত্তর বছরে পা দেওয়ার মাত্র সাত দিন আগে হাসপাতালের বিছানায় মারা যান ল্যু সালোমে। শেষ হয় জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল এক স্বাধীন জীবন।
শোকগাথায় ফ্রয়েড লিখলেন, ‘তিনি ভালো করেই জানতেন, জীবনের সত্যিকার অর্থ কোথায় খুঁজতে হয়। অধিকাংশ মানবিক দুর্বলতাকে জয় করতে পেরেছিলেন ল্যু সালোমে।’