নেটিভ আমেরিকান হত্যার ইতিহাস!

 

থ্যাংকস গিভিং ডে আমেরিকার খুব জনপ্রিয় একটি উৎসব। কোনো সন্দেহ নেই। এই দিনে আমেরিকানরা মহাধুমধামে টার্কি রোস্ট করে খায়। বন্ধুদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করে আর হই-হল্লোড় করে সময় কাটায়। মূলত নেটিভ আমেরিকানদের সঙ্গে বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবেই এই উৎসব। এই বিশেষ দিনটিকে আমেরিকার আদিবাসীদের সঙ্গে আমেরিকার দখলদার সাম্রাজ্যবাদীদের পারস্পরিক ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের স্মৃতির বন্ধন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সত্যি কি তাই? ইতিহাস কি তাই বলে?

একসময় যে আমেরিকা ছিল নেটিভ ইন্ডিয়ানদের বাসভূমি অথচ এখন এই আমেরিকার মাটিতে তাদের খুঁজে পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার! ইউরোপ এবং আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের তাণ্ডবে তাদের সংস্কৃতি, ভাষা, স্বপ্ন এখন আমেরিকার জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। সুকৌশলে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে তাদের জাতিগত সংস্কৃতি আর হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তারা এখন তাদের নিজ ভূমি থেকে নিশ্চিহ্ন। নেটিভ আমেরিকানদের খোঁজ পেতে আপনাকে এখন যেতে হবে ওকলাহোমা, ইন্ডিয়ানা, নেভাদা বা নিউ মেক্সিকোর কোনো গ্রামে, যেখানে তাদেরকে একটি ছোট জায়গায় জাদুঘরের মতো করে অ্যাকুরিয়ামে মাছের মতো বন্দী করে রাখা হয়েছে। সেখানে এখন পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। নেটিভদের প্রতিদিনের জীবনাচরণ, তাদের খাবার, পরিধেয় কাপড়, ভাষা, তৈজষপত্র, এখন পর্যটকেরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। কেউ কেউ ভালোবেসে তাদের কিছু টাকাপয়সাও দেয়। তাদের হাতের তৈরি শখের জিনিসপত্র কিনে বাড়িতে নিয়ে যায়। এদিকে নেটিভদের নতুন প্রজন্মরাও এখন মূল জনস্রোতে মিশে গিয়েছে। ধীরে ধীরে মুছে গেছে নেটিভদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। মুছে গেছে মানে মুছে ফেলা হয়েছে। এখন রেড ইন্ডিয়ানদের অস্তিত্ব দেখা যায় কোনো পাও উৎসবে অথবা বিশেষ কোনো দিনগুলোতে। এখন থ্যাংকস গিভিং ডে পালিত হয়। মহা উৎসবে এই দিনটিতে ঔপনিবেশিক শাসকেরা ভালোবাসার মালা বানিয়ে দিনটি স্মরণ করে। লেখক আর.জে রবার্টসনের Rotting Face: Smallpox and the Amrican Indian গ্রন্থের পাতায় পাতায় রয়েছে নেটিভ আমেরিকানদের ওপর নানা রকম নির্যাতনের লোমহর্ষ গল্প।

প্রায় ৩০০ বছর আগে ঔপনিবেশিক শাসক ব্রিটিশরা নেটিভ আমেরিকান জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে আমেরিকায় ঠিক এমন একটি গণহত্যাই ঘটিয়েছিল। তারা গুটি বসন্তের রোগীদের ব্যবহৃত কম্বল হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করে দরিদ্র নেটিভ আমেরিকানদেরকে বিলিয়ে হাজার হাজার নেটিভ আমেরিকান হত্যা করেছিল। জানা যায়, এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তিনটি নেটিভ আমেরিকান গৌত্র প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। যারা মারা যাননি তাদের অনেকেই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ হয়েছিলেন চিরতরে পঙ্গু। উদ্দেশ্য ছিল একটাই। গুটি বসন্তের ভাইরাস ছড়িয়ে নেটিভ আমেরিকানদের ধ্বংস করে দেওয়া। ব্রিটিশরা বুঝতে পেরেছিল এই সহজ পদ্ধতিতেই আমেরিকার মাটি থেকে দ্রুত নেটিভ আমেরিকানদের নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব। আমেরিকার মাটি থেকে ব্রিটিশরা চলে গেলে সেই গুরুদায়িত্বটি পালন করেছিল আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ শাসক দল।

ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১৭৬৩ সালে আমেরিকার ডেলাওয়ার রাজ্যে ব্রিটিশ কামান্ডার এলমহার্স্ট তার নিজের লোক দিয়ে এই হীন কাজটি করেছিলেন। অবশ্য অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, এই কাজ আরও অনেক আগেই আমেরিকায় নানা উপায়ে হয়েছিল। ১৭৬৩ সালে লোকসমাজ বিষয়টা জানতে পেরেছে, এই যা! উনিশ শতকের শেষর দিকে ১৮৫১ সালে আমেরিকার এই বর্বরোচিত অধ্যায়টিকে প্রথম জনসম্মুখে নিয়ে আসেন ইতিহাসবিদ ফ্রান্সিস পার্কম্যান। পার্কম্যানের গবেষণায় প্রথম ধরা পড়ে ১৭৬৩ সালে কীভাবে স্যার জেফরি এলমহার্স্ট নামের এক বিলেতি কমান্ডার ইন চিফ সুকৌশলে আমেরিকার নেটিভ আমেরিকাদের মাঝে গুটি বসন্তযুক্ত কম্বল বিলিয়ে হত্যা করেছিল, সেই ভয়াবহ গল্প!

এবার মূল ঘটনায় প্রবেশ করা যাক। ১৭৬৩ সালের বসন্তের শেষ দিকে আমেরিকার ডেলওয়ার রাজ্যে শনী এবং মিংগো সৈনিকরা [Shawnee and Mingo warriors] অটোওয়া [Ottawa] যুদ্ধে নেটিভ আমেরিকান পোনটিয়াক নেতার আহ্বানে যুদ্ধে অংশ নেয়। ব্রিটিশদেরকে উৎখাত করতে পিটসবার্গের পিট দুর্গ নিয়ে লড়াই করে। কিছুদিন পরেই নেটিভ আমেরিকানদের সঙ্গে ব্রিটিশদের একটি শান্তিচুক্তি হয়। সেই চুক্তিতে ব্রিটিশরা নেটিভ আমেরিকানদের আমাদের বন্ধু বলে সম্বোধন করে। ষড়যন্ত্রটা শুরু হয় এখান থেকেই। কিছুদিন পরই নেটিভ আমেরিকানদের অনেকেই গুটি বসন্তের মতো ভয়াবহ ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হয়ে পিট দুর্গের হাসপাতালে ভর্তি হতে শুরু করে। ১৭৬৩ সালের ১৬ জুন ফোর্ট পিটের কমান্ডার ক্যাপ্টেন সিমন একুয়ার তাঁর স্মৃতিকথায় লেখেন, হঠাৎ কোনো এক অজানা কারণে পিট দুর্গের হাসপাতালে প্রচুর নেটিভ ইন্ডিয়ান ভর্তি হতে থাকে এবং সন্ধান মেলে, তারা সবাই গুটি বসন্তে আক্রান্ত।

সিমন প্রথম আশঙ্কা করেছিলেনএই গুটি বসন্ত জীবাণু অন্য কোনো নেটিভগোষ্ঠীদের কাছ থেকেই হয়তো আসতে পারে। সঙ্গে সঙ্গেই দুঃসংবাদটি দুর্গের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। খবরটি চলে যায় ব্রিটিশ কমান্ডার ইন চিফ এলমহার্স্ট-এর কানেও। এলমহার্স্ট এই সংবাদে আনন্দিত হয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কর্নেল বেকেটকে একটি চিঠি লেখেন, যেকোনো মূল্যে আর উপায়ে ইন্ডিয়ান নেটিভদের জনসংখ্যা আমাদের কমাতে হবে। গুটি বসন্ত ভাইরাস ছড়িয়ে নেটিভদের একহাত দেখাতে অসুবিধা কোথায়? এদের শায়েস্তা করতে আমাদের যা যা করার, তা-ই করতে হবে। পরিকল্পনা কাজ করছে জেনে ভালো লাগছে।

ঘটনা যেভাবে শুরু। ১৭৬৩ সালে ডেলওয়ার রাজ্যে নেটিভ আমেরিকাদের নেতা পোনটিয়াকের নেতৃত্বে বিদ্রোহ শুরু হলে সেখানকার ব্রিটিশ কমান্ডার ইন চার্জ এলমহার্স্ট নেটিভ আমেরিকানদের শায়েস্তা করতে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করেন। তাঁদের পিট দুর্গটি নেটিভদের দখল হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি বেশ চিন্তিত ছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে তীর-ধনুক হাতে নিয়ে এই দুর্দান্ত যোদ্ধাদের সাথে সামনাসামনি সমরে অংশ না নিয়ে একটু সুকৌশলে তাদের শায়েস্তা করতে পারলে ক্ষতি কী! এই ভাবনা থেকেই তিনি অধস্তন সেনা কর্মকর্তা কর্নেল হেনরি বাকেটকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটি বর্তমানে ব্রিটিশ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। চিঠিতে তিনি লেখেন, নেটিভ আমেরিকানদের শায়েস্তা করতে তাদের সঙ্গে সন্ধি বা বন্ধুত্বের দাবিতে গুটি বসন্তযুক্ত কম্বল বিতরণ করলে কেমন হয়? মনে রাখবেন তাদের ক্ষমতা ধ্বংস করতে আমাদের যত রকম কৌশল আছে সবকিছুর সফল প্রয়োগ ঘটাতে হবে।

কর্নেল বাকেট বিষয়টি নিয়ে কয়েক দিন চিন্তাভাবনা করে উত্তর দেন, আপনার পরিকল্পনার প্রশংসা করতে হয়! আমি চেষ্টা করব খুব শিগগির নেটিভদের মাঝে কিছু গুটি বসন্তের ভাইরাসযুক্ত কম্বল বিতরণ করতে। তার আগে স্থানীয় হাসপাতাল থেকে গুটি বসন্তযুক্ত কম্বল সংগ্রহে আমাদের প্রকল্পে নামতে হবে। এ নিয়ে মোটেই ভাববেন না। কাজটি খুব গোপনেই হবে। বিষয়টা আমার ওপর ছেড়ে দিন। কিন্তু এলমহার্স্ট শুধু নির্দেশ দিয়েই বসে থাকেননি বা বাকেটের ওপর নির্ভর না করে তিনি নিজেও সরেজমিনে বিষয়টার কার্যকারিতা দেখার জন্য মাঠে নামলেন। তিনি কর্নেল বাকেটকে নির্দেশ দিলেন, দ্রুত হাসপাতালে খোঁজ লাগান। সেখানে যেসব গুটি বসন্তের রোগী আছে, তাদের গায়ের কম্বলগুলো সংগ্রহ করুন। তারপর সেগুলো আপনি নেটিভদের মধ্যে বিলিয়ে দিন। তিনি আরও লেখেন, শুধু কম্বল বিতরণ করেই থেমে থাকবেন না আবার! এর চেয়েও ভালো এবং সহজ যদি কোনো পদ্ধতি আপনার জানা থাকে, সেটিও দ্রুত কার্যকর করুন আর আমাকেও জানান।

একসময় যে আমেরিকা ছিল নেটিভ ইন্ডিয়ানদের বাসভূমি অথচ এখন এই আমেরিকার মাটিতে তাদের খুঁজে পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার! ইউরোপ এবং আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের তাণ্ডবে তাদের সংস্কৃতি, ভাষা, স্বপ্ন এখন আমেরিকার জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। সুকৌশলে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে তাদের জাতিগত সংস্কৃতি আর হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তারা এখন তাদের নিজ ভূমি থেকে নিশ্চিহ্ন

১৭৬৩ সালের ১৩ জুলাই এমহার্স্টের বিশ্বস্ত সৈনিক বাকেট তখন পেনসিলভানিয়ায় অবস্থান করছিলেন। তিনি এলমহার্স্টকে আরেকটি চিঠি লেখেন। তিনি লেখেন, কাজটি আমি নিজের হাতেই সম্পাদন করব। স্থানীয় হাসপাতালে লোক লাগিয়েছি। গুটি বসন্তে যেসব রোগী মারা যাচ্ছে তাদের কম্বলগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে। খুব শিগগির আমরা কাজে নেমে যাচ্ছি। বেকেটের উত্তর পেয়ে এলমহার্স্ট কিছুটা ভারমুক্ত হলেন। ১৬ জুলাই তিনি বাকেটকে আরেকটি চিঠি লিখলেন, আমাদের মূল উদ্দেশ্য নেটিভদের বংশ আমেরিকার মাটি থেকে সমূলে ধ্বংস করা। কথাটা আবারও আপনাকে মনে করিয়ে দিলাম।

১৭৬৩ সালে উইলিয়াম ট্রেন্ট নামের একজন ব্যবসায়ী, ভূমি জরিপ বিশেষজ্ঞ এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত অফিসার ২৩ জুন তাঁর ডায়েরিতে লেখেন, ডেলাওয়ার রাজ্যে উচ্চপদস্থ দুজন ব্রিটিশ কর্মকর্তা নেটিভদের সঙ্গে দেখা করতে পিট দুর্গ পরিদর্শন করেন। দুর্গের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি করার ইচ্ছা তাঁরা জানান। নেটিভ আমেরিকানদের পক্ষ থেকে একটি দল ব্রিটিশদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় বসেন। আলাপের বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে তাঁরা নেটিভদের কম্বল আর কিছু গায়ের চাদর দেবেন বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। আমি মনে করি এটা ছিল নেটিভদের সঙ্গে ব্রিটিশদের একধরনের চাতুরী।

মোটকথা, ব্রিটিশ শাসকেরা হাসপাতাল থেকে গুটি বসন্তে আক্রান্ত রোগীদের গায়ের কম্বল আর চাদর উপহার হিসেবে দিয়েছিল স্থানীয় দরিদ্র নেটিভদের কাছে। নেটিভদেরকে ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের অভিনয় করে তারা সুকৌশলে গুটি বসন্তের ভাইরাস দিয়ে গোটা নেটিভ জাতিকে ধ্বংস করে ফেলার চক্রান্ত করেছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না এই চক্রান্তের মূল শক্তি ছিলেন ব্রিটিশ কমান্ডার এলমহার্স্ট। ব্রিটিশ জেনারেল থমাস গেইজ এমহার্স্টের এই কর্মের জন্য রাতারাতি একটি বড় ধরনের অর্থে তহবিল গঠন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

ইতিহাস গবেষক পার্কম্যানের মতে, ব্রিটিশ সেনারা জানত, গুটি বসন্তযুক্ত কম্বল বিলাতে হলে শীতকাল হলো সবচেয়ে ভালো সময়। কারণ, হতদরিদ্র নেটিভরা এই সময়টায় একটু অলস হয়ে নিজেদের কুটিরে সময় কাটাতে ভালোবাসে। আর শীতের সময় কম্বল পেলে তারা উপকৃত হবে আবার আনন্দিতও হবে। বিশেষ করে বয়স্ক আর শিশুদের কনকনে শীত থেকে বাঁচাতে কম্বলের কোনো জুড়ি নেই। আর এই সুবর্ণ সুযোগ তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী পুরোপুরি ব্যবহার করেছিল। গুটি বসন্তের মোড়ক একবার শুরু হলে মৃত্যুর মিছিল থামতে থামতে বসন্তকাল চলে আসবে। এর মধ্যেই হাজার হাজার নেটিভ মারা পড়বে।

ইতিহাস বিশেষজ্ঞ পার্কম্যান আরও দেখান, কোনো জাতিগোষ্ঠীকে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ইতিহাস এটিই প্রথম নয়। আমেরিকাসহ পৃথিবীর নানা দেশ নানা কৌশলে এ ধরনের হীন পদ্ধতি অবলম্বন করে বিশেষ একটি গোত্র বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আমেরিকানরা যখন মেক্সিকো দখল করেছিল, তখন তারাও ঠিক একই কাজ করেছিল। স্থানীয় নেটিভদের সাথে বন্ধুত্বের অভিনয় করে সুকৌশলে তাদেরকে ভাইরাসযুক্ত কম্বল উপহার দিয়ে হত্যা করেছিল।

গুটি বসন্তের ভয়াবহ ভাইরাসটি আমেরিকার মাটিতে প্রবেশ করে ইউরোপ থেকে। প্রথম দিকে আমেরিকার পশ্চিম অঞ্চলে গুটি বসন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে তা আমেরিকার অন্যান্য রাজ্যেও ছড়িয়ে যায়। ১৭৭০ সালে মিনেসোটা রাজ্যের নেটিভদের সঙ্গে ব্রিটিশদের একটি শান্তিচুক্তি হয়। সেই শান্তিচুক্তিতে ব্রিটিশরা আমেরিকার পতাকা মুড়িয়ে নেটিভদেরকে মদের বোতল উপহার দিয়েছিল। সেই পতাকায় মেশানো ছিল বিষাক্ত গুটি বসন্তের ভাইরাস! তার পরের চিত্রটি সহজেই অনুমেয়।

১৭৫৭ সালে আমেরিকার যেসব নেটিভ আমেরিকান ফরাসিদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল, ব্রিটিশরা তাদের সঙ্গে কৌশলে সন্ধি করে বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে তারা অটোয়া নেটিভদেরকে ছোট ছোট উপহার ভর্তি টিনের বাক্স দিয়ে। সেই টিনের বাক্সে ছিল কাপড়, টুপি, মাফলার আর ছিল অদেখা উপহার ভয়াবহ গুটি বসন্তের ভাইরাস!

ইতিহাসের আরও একটু পেছনে গেলেও সেই একই দৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। ১৪৯৩ সালে পেরুর স্থানীয় নেটিভদের [Inca] একহাত দেখাতে ঠিক এ ধরনেরই একটি উপায় খুঁজে বের করেছিল তৎকালীন ঔপনিবেশিক স্প্যানিশ শাসকেরা। তারা নেটিভ ইন্ডিয়ানদের রাজাকে মূল্যবান পাথর আর মণিমাণিক্য খচিত একটি বাক্স উপহার দিয়েছিল। ইনকা রাজা বাক্সটি খুলে দেখতে পেলেন, সেখানে রয়েছে দামি পাথর আর নানা রকম গয়না! পরে জানা গেল, সেই পাথর আর মূল্যবান উপহারসামগ্রীতে সুকৌশলে মেশানো ছিল ভয়ংকর গুটি বসন্তের ভাইরাস!

গুটি বসন্তযুক্ত কম্বল বিলিয়ে নেটিভ ইন্ডিয়ান হত্যার যে নীলনকশা ব্রিটিশরা শুরু করেছিল, পরবর্তী সময়ে আমেরিকানরা সেই গুরুদায়িত্বটি অনেক আনন্দের সঙ্গেই পালন করেছিল। কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরছি। ১৮৩৭ থেকে ১৮৩৮ সালএই একটি বছর ছিল আমেরিকার নেটিভদের জন্য দুর্গত একটি বছর। এ বছর আমেরিকার ম্যানডানস, আরিকারাস এবং হিডাটসাস নেটিভ গোষ্ঠী প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। মিসৌরি নদীর পাড়ে ছিল তাদের বসবাস। হতদরিদ্র এই নেটিভদের জীবন চলত ভুট্টা, সয়াবিন, স্কোয়াস চাষ করে। আর ছিল বুনো মহিষ শিকার। কিন্তু সেটি ছিল তাদের মৌসুমভিত্তিক। কিন্তু এরই মধ্যে শুরু হয় ভয়াবহ ছোঁয়াচে গুটি বসস্তের প্রকোপ! সে বছর ঠিক কতজন নেটিভ ইন্ডিয়ান গুটি বসন্তে মারা গিয়েছিল, তার সঠিক হিসাব এখনো অজানা। তবে অনুমান করা হয়, দেড় লক্ষ নেটিভ সেই বছর এই ভয়াবহ ছোঁয়াচে ভাইরাসে মারা গিয়েছিল। অন্তত তিনটি নেটিভ গোত্র ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এটুকু বলা যায়।

১৮৩৭ সালের জুলাই মাসের ১৪ তারিখ ফ্রান্সিস চারডন নামের এক ফরাসি আমেরিকান লেখেন, একজন তরুন ম্যানডান যুবক গুটি বসন্তে মারা গেছে। আরও অনেকের মধ্যেই এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। চারডন তাঁর সহকর্মী এবং বন্ধুজন জেমসকেও ঠিক একই রকম কথা একটু ভিন্নভাবে বলেছিলেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ীসেন্ট পিটার্স নামের একটি নৌকা ক্লার্ক দুর্গের ভিড়তেই নেটিভ আমেরিকানরা গুটি বসন্তে মারা যেতে থাকে। ধারণা করা হয়, সেই নৌকায় হয়তো গুটি বসন্তযুক্ত কম্বল ছিল। আর সেই কম্বল তারা নেটিভ আমেরিকানদের মাঝে বিলিয়েছিল। নেটিভ আমেরিকানবিষয়ক ইতিহাসবিদ ওয়ার্ড চার্চিল দাবি করেন, আমেরিকানরা মিসৌরি নদীর পারে ম্যানডান নেটিভদের কাছে কম্বল বিতরণ করে প্রায় এক লক্ষ পঁচিশ হাজার লোক হত্যা করেছিল।

ভাবা যায়, মানুষ কী ধরনের হিংস্র হলে গুটি বসন্তযুক্ত কম্বল বিলিয়ে একটি জাতিগোষ্ঠী ধ্বংস করার মতো এমন বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে? কে জানে? ক্ষমতার জন্য মানুষের পক্ষে হয়তো সবকিছুই সম্ভব! কোনো সন্দেহ নেই, নেটিভ আমেরিকানদের ওপর ঔপনিবেশিক শাসক এবং আমেরিকানদের এই হীন ষড়যন্ত্র শুধু হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সঙ্গেই তুলনা করা যায়। সভ্যতার নামে এই ঔপনিবেশিকতাবাদ চর্চার ঘৃণ্য ইতিহাস আমাদের মানবিক আত্মায় কাঁপন ধরিয়ে দেয়!

       সূত্র

  • Diamond, Arther: Smallpox and American Indian, Cengage Gale [September 1991], USA.
  • R.G. Robertson: Rotting Face, Smallpox and the American Indian, Caxton Press [March 2001], USA.
  • https://www.britishmuseum.org.