একটি রক্তাক্ত কবিতার ইতিহাস

 

মায়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের আগের রাত, নামজাদা কবি ক জে উইন ঘুমিয়ে ছিলেন কাই জাও আয়ের বাড়িতে। কাই মায়ানমারের গুরুত্বপূর্ণ কবি। উইনের বন্ধু। তারা একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের কাজ করছিলেন। ঘুম ভাঙার পর জানতে পারেন ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়ে গেছে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে মায়ানমারের। সেদিন ছিল ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারির সকাল। সামাজিক ও সংবাদ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের কারণে যদিও খবর আসছিল ধীরে ধীরে। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে উইন ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করছিলেন। সেদিন তিনি বন্ধু কাইকে বলেছিলেন, আমাদের সামনে যে যুদ্ধ আসছে, আমাদের তাতে সামিল হতে হবে। এবং তারা দুজনেই রাজপথে নেমে ছিলেন গণতান্ত্রিক মুক্তির লড়াইয়ে।

ক জে উইন মোনায়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন নামজাদা শিক্ষক। তবে কবি খ্যাতি তাঁর তারচেয়ে বেশি। সে যাই হোক, ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর মোনায়া অশান্ত হয়ে ওঠে। জনগণের তরফ থেকে শুরু হয় সংগ্রাম ও প্রতিরোধ। তারপর থেকে সামাজিক মাধ্যমে তাঁর সববার্তা ছিল জান্তা বিরোধী লড়াইয়ের উদীপ্ত স্লোগান। উইনের সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিও হয়ে ওঠে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার। ২১ ফেব্রুয়ারি এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, আপনার সঙ্গে আমার মতের পার্থক্য থাকতে পারে, তবে আপনাদের মুক্তির জন্য আমি জীবন বাজি ধরতে পারি। ২৩ ফেব্রুয়ারি উইন ফেসবুকে সর্বশেষ কবিতা পোস্ট করেন। কবিতার শিরোনাম খুলির সম্পর্কে। কবিতায় তিনি বলেছিলেন,

বিপ্লব প্রস্ফুটিত হবার আগে
রাজপথে আবক্ষের খুলি থেকে
কি বাণী আসে আমাদের জন্য?  
যখন শয়তানেরা মুখোমুখি হয়
তখন তো বিবৃতিও গুরুত্বপূর্ণ?

কিংবা

দ্বিধাবিভক্ত হয়ো না
বিপ্লবের বিষ্ফোরক তবে
ঠিক তুমি কিংবা আমি

ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখ সকাল বেলা। সামরিক জান্তা বিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল মোনায়া। সেদিন রাজপথে ছিলেন ক জে উইন। সঙ্গে ছিলেন উইনের বইয়ের প্রকাশক ও চিত্রশিল্পী লিন হেত হায়িং। ২০০৩ সাল থেকে উইনের ঘনিষ্ট বন্ধু লিন। রাজধানী ইয়াঙ্গুনের সাহিত্য আন্দোলনের কর্মী দুজনই। উইন ছিলেন মায়ানমার লেখক ইউনিয়নের সভ্য। লড়াই-সংগ্রামের অনুপ্রেরণার ভূমিকায় ছিলেন উইন। লিন বলেছেন, কোনো দলমতের পক্ষে নয়, উইন ছিলেন ন্যায় বিচারের পক্ষে। মুক্তির প্রশ্নে তারা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক ৩ মার্চ। মিছিল যখন উত্তুঙ্গে লিন তখন পাশে ছিলেন। জান্তা বাহিনী মিছিলে বুলেট আর টিয়ার সেল ছুড়ছিল। উইন তাঁকে হাত ধরে বললেন, নিরাপদে ফিরে যেতে। উইন আরও বলেছিলেন,ভাই আপনার গ্যাস প্রতিরোধী মুখোশ নেই, আপনি চলে যান।

অত্যন্ত সংবেদনশীল কবি, বন্ধুবৎসল আর জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা তাঁকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল অবিরল। ২০১৫ সালে মায়ানমানের শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনে করতে গিয়ে তিনি কারাবরণ করেন। অং সান সুচি ক্ষমতা আরোহণের পর তিনি মুক্তি পান ২০১৬ সালে। সত্য এই, মানুষের মুক্তির প্রশ্নে জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি তিনি।

মিছিলের সামনেই ছিলেন উইন। পাশে ছিলেন কবি বন্ধু খেত থাই। জান্তা বাহিনী মারমুখি হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। এমন সময় হঠাৎ উইন পেছনে আসলেন ছাত্রদের সাহায্য করতে। জান্তা বাহিনীর প্রবল আক্রমণে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সে সময় অসংখ্য প্রতিবাদকারী আহত হন। থাইয়ের ভাষ্যমতে, তখনই আক্রমণের শিকার হন উইন। পরে ছত্রভঙ্গ মিছিল আবারও জমায়েত হতে থাকে। কিন্তু তারা কেউ উইনের কাছে পৌঁছাতে পারেননি আর। বন্ধুরা চেষ্টা করেছিলেন ফোনে যোগাযোগ করতে। কিন্তু সারাদিন তাঁকে ফোনেও পাওয়া যায়নি। তাঁর বন্ধুরা হাসপাতালে খোঁজ নিতে থাকেন। ঠিক সারাদিন পর হাসপাতালের মর্গে প্রবেশ করতে দেয় উইনের স্বজনকে। তারাই হাসপাতালে শনাক্ত করেন উইনের রক্তাক্ত লাশ। বন্ধু থির মতে, তাঁর মতো বিশ্বস্ত বন্ধু কম ছিলেন।

মার্চের ৪ তারিখে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইউটিউবে একটি ভিডিও প্রচার করে। সেখানে দেখা যায়, মোনায়ার রাজপথে সারি সারি আহত আর নিহত জনতার দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মীরা একজনের লাশ টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। সেদিনই হাসপাতালের মর্গে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। সেটি উইনের নিথর দেহ কিনা কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি। তবে যেখানে উইন মৃত্যু বরণ করেন, মোনায়ার সেই এলাকার রাস্তার নাম এখন শহীদ স্কয়ার। মৃত্যুকালে কবি ক জে উইনের বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৯ বছর। অত্যন্ত সংবেদনশীল কবি, বন্ধুবৎসল আর জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা তাঁকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল অবিরল। ২০১৫ সালে মায়ানমানের শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনে করতে গিয়ে তিনি কারাবরণ করেন। অং সান সুচি ক্ষমতা আরোহণের পর তিনি মুক্তি পান ২০১৬ সালে। সত্য এই, মানুষের মুক্তির প্রশ্নে জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি তিনি। ক জে উইন একবিংশ শতাব্দির গণতান্ত্রিক আন্দোলন আর মুক্তিকামী মানুষের মহানায়ক। দেশে দেশে মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা হয়ে থাকবেন তিনি। আমরা তাঁর কারারুদ্ধ জীবনের একটি কবিতা পাঠকের উদ্দেশ্যে হাজির করছি। কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন উইনের বন্ধু ও কবি কো কো থেত। আর তর্ক বাংলার পাঠকদের জন্য জেলের গরাদ থেকে চিঠি নামীয় কবিতার অনুবাদ করেছেন লেখক ও অনুবাদক অভিনু কিবরিয়া ইসলাম।   

[লেখাটি প্রস্তুত করতে শহীদ ক জে উইনের বন্ধু কবি ও অনুবাদক কো কো থেত, পেন ইন্টারন্যাশনাল, ভয়েস পত্রিকাসহ সামাজিক মাধ্যমের নানাসূত্রের সহায়তা নিয়েছি। আমরা সংশ্লিষ্ট সবার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ।]                             

ভূমিকা : সাখাওয়াত টিপু

 

জেলের গরাদ থেকে চিঠি

ক জে উইন 

প্রিয় বাবা,
যে নদীর পেট চিরে ফেলা হয়েছিল,
সে নদী যুদ্ধ করেছে ঘোষণা
আমাদের নদীতীরের ছোট্ট বাড়ির সাথে, সে কি নয়?
বাড়ির ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে 
তুমি নিশ্চয়ই খুঁজে চলেছো এমন কাউকে
যে তোমায় সাহায্য করতে পারে
বাঁধের খুঁটিগুলো একের পর এক বসিয়ে
নদীটাকে শাসন করতে,
আর তার গর্তগুলোকে 
ভরাট করতে বালুর বস্তায়।
বাঁশের বল্লমের মতো বেড়ে চলা
ঘোলা পানির ভেতর,
তুমি নিশ্চয়ই তাকিয়ে দেখছ 
তিলের আবাদ— 
ফলে ফলে ভরা
গোলায় তোলার ফসল!
নিশ্চয় এমনও ভাবছো তুমি
যেন একমুঠো মুখের ভাত
আঙুলের ফাঁক গলে
বেরিয়ে আসতে চাইছে।
এখন হয়তো তুমি 
ধর্মের মাঝে খুঁজছো সান্ত্বনা, ভাবছ 
আমাদের পাঁচ শত্রুর কথা।
হয়তো তুমি ভাববে
সে শূন্যতার কথা, 
যে শূন্যতা ভরত সন্তানের শ্রমে।

এক ছেলে, দুই মেয়ে আর এক ছেলে;
সবচে বড়জন, এক কারাবন্দি কবি,
প্রথম কন্যা, একজন স্কুল শিক্ষিকা,
দ্বিতীয়জন, পাক্কা রাঁধুনী
সবচে ছোটজন, সেজন ছাত্রী। 
তোমার কবিপুত্র,
সে আর লাগে কি কাজে
তোমার আগাছা সাফ করা দায়ের মতো?
কিছুই কোরো না ক্ষমা, বাবা,
কিছুই না!
‘বাছা, পো চান,
কেন আমি তোমার আশেপাশে
হাউকাউ শুনতে পাচ্ছি?’,
তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে টেলিফোনে।
আমি মিথ্যে বলেছিলাম,
‘বাসস্টপে আছি, 
একটি জার্নালে লেখা পাঠাতে যাচ্ছি।’ 
তোমার মিথ্যেবাদী পুত্র থেকে শুরু করে 
যেসব খুনিরা তাদের জিহ্বা দিয়ে
পেছন থেকে আঘাত করবে বলে
‘উপকারী চাষি’ সম্বোধন করে
মিষ্টি কথায় ভোলায় তোমায়, 
তাদের সবাইকে ঘৃণা করো, বাবা,
সবাইকে ঘৃণা করো।
চোর নিরস্ত্র থাকে,
খুনি থাকে অস্ত্রে সজ্জিত।
যদি চোরদের শাসন করা না যায়
যদি খুনিদের শাসন না করা যায়,
তবে কী দরকার এমন সরকার?
বনবাদাড়ে
 যাই ঘটুক,
যাই ঘটুক পাহাড়ে 
যাই ঘটুক নদীতে
কিছুই তাদের যায় আসে না। 
দেশ ভালবাসে তারা 
ভালবাসে তারা ঠিক এইভাবে ছাকা এক নারকেল,
চারপাশ ছিঁড়েখুঁড়ে
মিলে যেন নারকেল দুধ। 
বংশের পর বংশ, তাদের মগের মুল্লুক বাড়াতে
তাদের বন্দুকগুলো তাক করা উর্না বরাবর
ভগবান বুদ্ধের কপালের উপর।  
তাদের শ্রেণিটাই এমন নিষ্ঠুর!
সেই শ্রেণিকে অভিশাপ দিতে
তোমার ধর্ম যদি মানা করে, 
আমাকে তবে সে ধর্ম ত্যাগ করতে দাও,
আমি তোমার হয়ে
আকাশ নীল করে দেব।
তুমি হয়তো এখনো জানো না,
তোমার ছেলেকে 
ধরে আনা হয়
কথিত ‘পুলিশ’ যেন
জনসাধারণের ক্ষতি না করে
সেই দাবি তোলার জন্য।
একদিন
তোমার ছেলে, যে চোর নয়
খুনিও নয়,
হয়ে উঠবে মজদুর সে
তোমার আগাছা তোলা দায়ের মতো ভালো। 
তবে এসময়, বাবা, 
তুমি ফসলের দিকে তাকিয়ে থেকো
যে ফসল তুমি আবাদ করেছ উদোম কাঁধে
আর গেয়ে যাও
কৃষক সমিতির 
গান।
  
ইতি তোমারই,
ক জে উইন
সেল ১, সেকশন ১০
থায়াওয়াদ্দি কারাগার।  

নোট
১. উর্না বৌদ্ধ মিথ। বুদ্ধের শুভ চিহ্ন। মহাত্মা স্বরূপ বুদ্ধের একত্রিশতম শারীরিক বৈশিষ্ট্য। উর্না শব্দের অর্থ তৃতীয় নয়ন। পালি মূল শব্দ উন্না [uṇṇa]। দুই ভ্রূ’র মাঝখানে যা বুদ্ধের কপালে শুভ চিহ্ন আকারে থাকে। দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে বৌদ্ধ ভাস্কর্যে প্রতীক রূপে ব্যবহৃত হয় উর্না। 

ইংরেজি অনুবাদ : কো কো থেত
বাংলায়ন:
অভিনু কিবরিয়া ইসলাম