পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি

 

১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয় ফ্রেদরিখ এঙ্গেলসের অন্যতম অবদান পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি। এ গ্রন্থে আদিম সমাজ থেকে কীভাবে মানবেতিহাসে মালিকানা সম্পর্কের পরিবর্তনের [সামষ্টিক থেকে ব্যক্তিগত] মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরিবারের উৎপত্তি, পুঁজির আবির্ভাব এবং পরিবর্তিত সামাজিক প্রেক্ষাপটে কী করে জন্ম নিল রাষ্ট্র, তা উঠে এসেছে। এখানে ইতিহাসের আলোকে নারীর অবস্থান, প্রেম-যৌনতা এবং পরিবারের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়। বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বে এ বিষয়গুলো যেভাবে আছে, অতীতে এমন ছিল না, ভবিষ্যতেও একই রকম থাকবে না।

পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি [The Origin of the Family, Private Property, and the State: in the Light of the Researches of Lewis H. Morgan] গ্রন্থটির মোট ১১টি অধ্যায় রয়েছে। গ্রন্থটি রচনায় মরগান, মমসেন, ম্যাক-লেলান, স্কটের মতো লেখকদের কাজ এবং মার্ক্সের বেশ কিছু লেখা থেকে সাহায্য নিয়েছেন এঙ্গেলস। তবে প্রধানত লুইস মরগানের ৪০ বছরের গবেষণা আদিম সমাজ এবং মার্ক্সের রেখে যাওয়া নোটসই এঙ্গেলসের অনুসিদ্ধান্তগুলো টানতে রসদ জুগিয়েছে। এটি একটি আকর রচনা।

পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং রাষ্ট্রকে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমাজবিজ্ঞানীগণ মানবজীবনের অপরিহার্য এবং চিরন্তন বাস্তবতা বলে প্রচার করে আসছিলেন। এর বিপরীতে মার্ক্সবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় বস্তুগত কারণ ও দ্বন্দ্বতত্ত্বের নিয়মেই সমাজের রূপ পাল্টেছে, যা নতুন চিন্তার মানুষ গড়ে তুলেছে। নতুন বাস্তবতায় নতুন দ্বন্দ্ব হাজির হয়েছে। সমাজ বিকাশের মার্ক্সবাদী ব্যাখ্যার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি রচনা করেছে এই গ্রন্থ।

১৮৮৪ সালের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস লিখেছেন, পরিকল্পনাটি ছিল স্বয়ং কার্ল মার্ক্সের, আর কারও নয়; তিনি তাঁর নিজের বলা যেতে পারে আমাদের দুজনের পর্যালোচিত ইতিহাসের বস্তুবাদী শিক্ষার অনুষঙ্গে মরগানের গবেষণার ফলগুলো তুলে ধরতে এবং এভাবে তার সামগ্রিক তাৎপর্য ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কারণ, মর্গান তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে আমেরিকায় ইতিহাসের সেই একই বস্তুবাদী ধারণা পুনরাবিষ্কার করেন, যা মার্ক্স চল্লিশ বছর আগেই আবিষ্কার করেছিলেন, এবং বর্বরতা ও সভ্যতার তুলনামূলক বিচারে ওই ধারণা থেকে তিনি প্রধান প্রধান বিষয়ে মার্ক্সেরই সমসিদ্ধান্তে পৌঁছান।

ওই ভূমিকায় তিনি লুইস হেনরি মরগানের অবদান তুলে ধরে বলেন, মার্ক্সবাদী মতে, আদিম সাম্যবাদ হচ্ছে মানবসৃষ্ট সমাজের প্রথম রূপ। আমাদের লিখিত ইতিহাসের এই প্রাগৈতিহাসিক ভিত্তির মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আবিষ্কার ও পুনরুদ্ধার এবং উত্তর আমেরিকার ইন্ডিয়ানদের গোত্রীয় বন্ধনের মধ্যে প্রাচীন গ্রিক, রোমান ও জার্মান ইতিহাসের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ এবং অদ্যাবধি দুর্বোধ্য ধাঁধার চাবিকাঠির সন্ধানলাভমরগানের মহৎ কৃতিত্ব। তাঁর গ্রন্থটি এক দিনের রচনা নয়। প্রায় চল্লিশ বছর তাঁর ওই বিষয়বস্তুর গবেষণায় শেষ পর্যন্ত তিনি সেগুলোকে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করেন। এ জন্যই তাঁর রচনা আমাদের কালের যুগান্তকারী অল্প কয়েকটি গ্রন্থের অন্যতম।

তিনি মরগানের সীমাবদ্ধতার কথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন গ্রন্থটির ভূমিকায়, বর্তমান রচনার কোন উপাদানগুলো মরগান থেকে নেওয়া এবং কোনগুলো আমার নিজস্ব, পাঠক মোটামুটি সহজেই তা অনুমান করতে পারবেন। গ্রিস ও রোমের ইতিহাস সম্পর্কিত অংশে আমি মরগানের তথ্যে আবদ্ধ থাকিনি, উপরন্তু আমার জানা তথ্যও যোগ করেছি। কেল্ট ও জার্মানদের সম্পর্কিত অংশগুলো মূলত আমার নিজের; এ ক্ষেত্রে মরগানের অবলম্বন ছিল প্রায় একান্তই অপরের কাছ থেকে নেওয়া তথ্যাদি এবং জার্মানদের সম্পর্কে ট্যাসিটাসের রচনা বাদ দিলে তিনি শুধু ফ্রিম্যানের নিম্নমানের উদারনৈতিক অপব্যাখ্যার ওপরই নির্ভর করেছিলেন। যেসব অর্থনৈতিক যুক্তি মরগানের উদ্দেশ্য সিদ্ধির পক্ষে যথেষ্ট; কিন্তু আমার পক্ষে একেবারেই অনুপযোগী ছিল। সেগুলো আমি নতুনভাবে উপস্থাপন করেছি। এবং সর্বশেষ, যেখানে মরগানকে প্রত্যক্ষভাবে উদ্ধৃত করা হয়নি, বলা বাহুল্য, সেসব সিদ্ধান্তের জন্য আমিই দায়ী।

এঙ্গেলস ব্যক্তিগত মালিকানা এবং শ্রেণিগত অবস্থান পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ব্যক্তিগত মালিকানার ওপর স্থাপিত শ্রেণিগত সমাজ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া। আর এভাবেই ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে পারিবারিক সম্পর্কের বিকাশ। রাষ্ট্রের উৎপত্তির বাস্তবতা যেমন তুলে ধরা হয়েছে; তেমনি শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সমাজের চূড়ান্ত বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রের বিলোপের ঐতিহাসিক অনিবার্যতাও তুলে ধরা হয়েছে এ গ্রন্থে।

শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের স্তর সম্পর্কে পুঁজিবাদী সমাজের গবেষকদের করা বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন গবেষণায়ও এঙ্গেলসের মূল যুক্তির সঠিকতা প্রমাণিত হয়েছে। এসব গবেষণা বলছে, গড়পড়তা ৩০-৪০ জনের দলে বাস করত আদিম মানুষেরা, যারা কখনোবা শ দুয়েকের দলেও পরিণত হতো। এসব গোষ্ঠীতে শ্রেণিবিভাজন ছিল না, এমনকি নেতৃত্বের খুব সুস্পষ্ট চিহ্নও ছিল না। এ প্রসঙ্গে মার্কিন নৃবিজ্ঞানী আর্নেস্টিন ফ্রিডল বলেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পুরুষ ও নারী উভয়েরই ছিল। তারা কার বা কাদের সঙ্গে দিনের খাদ্য আহরণের কাজে বেরোবে নিজেরাই ঠিক করত। আরেক মার্কিন নৃবিজ্ঞানী এলিনর লিকক বলেন, জমির মালিকানা এবং শ্রমবিভাজন না থাকায় সম্পদের প্রতি কারও কম, কারও বেশি অধিকার- এমন ধারণা বা অনুশীলন ছিল না ওই সমাজে। সামাজিকতার ধাঁচ এমন ছিল, যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ফলে স্বার্থপরতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিন্তু দেখা দেয়নি।

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় দেখা যায়, একদিকে জীবনধারণের উপকরণখাদ্য, পরিধেয়, আশ্রয় এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি উৎপাদন; অপরদিকে খোদ মানুষের উৎপাদন, প্রজাতির প্রসারসাধন। একদিকে শ্রমের বিকাশের স্তর, অপরদিকে পরিবারের বিকাশের স্তরসেগুলো এই দুই ধরনের উৎপাদনের শর্তাধীন। শ্রমের বিকাশ যত কম হয়, সমাজের সম্পদ যত সীমাবদ্ধ থাকে; গোষ্ঠীগত সম্পর্কের ওপর সমাজব্যবস্থার নির্ভরশীলতা ততই বৃদ্ধি পায়। তবে গোত্রগত বন্ধনের ভিত্তিতে গঠিত এই সমাজকাঠামোর মধ্যে শ্রমের উৎপাদনশীলতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়; বৃদ্ধি পায় আনুষঙ্গিক ব্যক্তিগত মালিকানা ও বিনিময়, সম্পদের বৈষম্য, শ্রমশক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনা। ফলে অবধারিতভাবে গড়ে ওঠে শ্রেণিসংগ্রামের ভিত্তিনতুন সামাজিক উপাদানগুলো পুরোনো সমাজব্যবস্থাকে নতুন বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করে। তবে বিকাশের একপর্যায়ে নতুন উপাদানগুলো পুরোনো সমাজব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক শক্তির বিপরীতে দাঁড়ায়। যা থেকে শুরু হয় নতুন সমাজের। এই নতুন সমাজ দীর্ঘদিন পুরোনো সমাজের ক্ষতচিহ্ন বা পুরোনো উপাদানগুলো বয়ে চলে। একপর্যায়ে আবারও নতুন দ্বন্দ্বের বিকাশ ঘটে। এভাবে সমাজের পরিবর্তনে পরিবারও আর আগের মতো থাকে না। তা পরিবর্তিত হয় নতুন ধরনের পরিবারে। শ্রেণিবিরোধ ও শ্রেণিসংগ্রামই যেখানে বিকাশের অবধারিত বাস্তবতা।

পরিবারের উদ্ভব নিয়ে সে যুগের নৃতত্ত্ববিদদের বহু মত ছিল। যেগুলোর হাজারটা সূত্রও ছিল; কিন্তু এঙ্গেলস পরিবারের উদ্ভবের পেছনে কয়েকটি সাধারণ কারণ সূত্রবদ্ধ করেছিলেন। এঙ্গেলস দেখিয়েছেন, আদিম সাম্যবাদী সমাজের একপর্যায়ে মানুষ অনেক দক্ষভাবে পাথরের নতুন নতুন সরঞ্জাম ব্যবহার শুরু করল, খাদ্য রাখার এবং রান্না করার জন্য মাটির পাত্র ব্যবহার শুরু করল, চাষ শুরু করল এবং সেই চাষের দেখভালের জন্য স্থায়ী বসতি করে গ্রাম গড়তে শুরু করল। লোহার ব্যবহার যখন শুরু হলো, তখন অনেক বেশি জমি চাষ করা সম্ভব হলো, ফলে খাদ্য সরবরাহ বাড়ল। জনসংখ্যাও বাড়তে লাগল। এ সময়ে খাদ্য মজুত ও উৎপাদনের উপকরণগুলোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখাকে কেন্দ্র করেই প্রথম ব্যক্তিগত মালিকানার বিষয়টি সামনে আসে। এর সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের ভিত্তিও স্থাপিত হলো।

ইতোমধ্যে পশুকে গৃহপালিত করে এবং তাদের বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে মানুষের হাতে অপ্রত্যাশিত সম্পদ জমা হয়েছে। আগে ছিল কিছু ঘরবাড়ি, পরিধেয় অলংকার- এখন এসেছে বিশাল পশুবাহিনী নিয়ে অগ্রসর দল। এই সম্পদ কাদের অধিকারে যাবে? প্রথমে তা ছিল দল বা গোত্রের হাতেই। যেখানে দলপতির পদমর্যাদা সবচেয়ে বেশি; কিন্তু তারা আধুনিক অর্থে সম্পত্তির মালিক তখনো নন। এই অতিরিক্ত সম্পত্তি গোত্রগত সামষ্টিক পরিবারের ভিত্তিকে ভেঙে দিল। এভাবেই নতুন ধরনের পরিবারের উদ্ভব হলো। একই সঙ্গে তিনি দেখিয়েছেন, যেহেতু পরিবারের উদ্ভব ঘটা সম্ভব হয়েছে, সেহেতু এর বিলুপ্তি করাও সম্ভব। সেটি কীভাবে সম্ভব, তারও ব্যাখ্যা তিনি টেনেছেন।

 

দুই

একটি সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো দেখেই অনুধাবন করা যায় সে সমাজের সার্বিক প্রেক্ষাপট। কারণ, অর্থনীতিই সমাজের ভিত্তি। যার ওপর গড়ে ওঠে রাজনীতি, সংস্কৃতির মতো উপরিকাঠামো। এঙ্গেলস মানবেতিহাসের অর্থনৈতিক বিকাশটা খুব পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছেন। এর সঙ্গে সম্পর্কিতভাবে বিবাহ ও পারিবারিক সম্পর্কের বিবর্তনের বিষয়টি সাবলীলভাবে টেনেছেন। পরিবার প্রথার ঐতিহাসিক তাৎপর্য তুলে ধরেছেন।

এ গ্রন্থ শুধু শ্রেণি ও রাষ্ট্রের উত্থান নিয়ে লেখা হয়েছে এমন নয়। সেই সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়েছে নারী অবদান ও শোষণ নিয়ে। কেননা, শ্রেণির উত্থান দেখাতে হলে, তার সঙ্গে নারীদের পরাজয় দেখাতে হয়। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের উত্থানের আগে নারী পুরুষের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল না। তিনি খুব পরিষ্কারভাবে বইটিতে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ব্যাখ্যা টেনেছেন।

এঙ্গেলস বৈবাহিক সম্পর্কের এক জটিল বিবর্তন ব্যাখ্যা করেছেন। আদি পর্বে তিনি একরকম গোষ্ঠী বিবাহের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এর পরে তিনি আরও দুটো স্তরের কথা বলেনদুই ব্যক্তি [এক নারী ও এক পুরুষ] মিলে গড়া পরিবার, যাতে পরবর্তীকালের মতো পুরুষপ্রাধান্য ছিল না। তবে কালক্রমে সমাজে পরিবারের প্রধান রূপ হিসেবে উঠে আসে পিতৃতান্ত্রিক একগামী পরিবার, যেখানে একগামিতা হলো স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর ওপর চাপানো নিয়ম, যা স্বামীর ওপর খাটত না। ফলে একই সঙ্গে তৈরি হলো বেশ্যাবৃত্তি। আগের যুগের যৌন স্বাধীনতা রূপান্তরিত হলো, একদিকে বিবাহিত নারীদের জন্য একগামিতার পাশে এল বেশ্যাবৃত্তি। অর্থাৎ একগামিতা শুধু মেয়েদের জন্য, আর সবার যৌন স্বাধীনতা রূপান্তরিত হলো পুরুষের একপেশে যৌন স্বাধীনতায়।

এভাবেই নারী জাতির এক ঐতিহাসিক পরাজয় সূচিত হয়েছিল। পরিবারের মধ্যে নারীর চেয়ে পুরুষের গুরুত্ব বাড়তে লাগল। কারণ, গৃহস্থালির কাজের থেকে বাইরে খাদ্য সংগ্রহের কাজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে নারীর সম্পৃক্ততার বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন এঙ্গেলস।

কার্ল মার্ক্স বলেন, শ্রমের প্রথম শ্রমবিভাগ হচ্ছে সন্তান উৎপাদনের জন্য নারী ও পুরুষের শ্রমবিভাগ। এঙ্গেলস এর সঙ্গে যুক্ত করে পুরুষতান্ত্রিকতাকে শ্রেণীশোষণ এবং নারী প্রতিরোধকে শ্রেণীসংগ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ইতিহাসে এক-বিবাহ প্রথা ব্যাপারটা নারী ও পুরুষের সম্প্রীতির মধ্য থেকে উদ্ভূত হয়নি। আর নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্প্রীতির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ হিসেবে এক বিবাহ প্রথাকে তো কোনোমতেই ধরা যায় না। অপরপক্ষে নারীর ওপর পুরুষের প্রাধান্যের রূপ হিসেবেই এ প্রথা প্রবর্তিত হয়। এ এক-বিবাহ প্রথার মধ্যে নারী ও পুরুষের পরস্পরের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ঘোষণাও দেখতে পাওয়া যায়। যে দ্বন্দ্ব কিনা প্রাগৈতিহাসিক যুগে ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। ১৮৪৬ সালে আমার (এঙ্গেলস) ও মার্ক্সের লেখা একটি পুরোনো অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিতে লেখা ছিলনারী ও পুরুষের মধ্যে সন্তান জন্ম ও লালন-পালনের ক্ষেত্রে যে শ্রমবিভাগ হয়, সেটাই হলো সর্বপ্রথম শ্রমবিভাগের সৃষ্টি। তার সঙ্গে এখন আরও যুক্ত করতে পারি যে, এক-বিবাহ প্রথার মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও ইতিহাসে শ্রেণিদ্বন্দ্ব ঠিক একই সময়ে দেখা দেয়। আর এক শ্রেণির দ্বারা অপর শ্রেণিকে শোষণ এবং পুরুষের দ্বারা নারীকে শোষণও ঠিক ওই সময়েই দেখা দেয়।

নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্কএকগামিতা, বহুগামিতার প্রশ্নটি পরিবার গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মধ্যেই নিহিত নারীকে অধস্তন করে পুরুষের সম্পত্তি রূপে স্থাপনের চেতনা, যার ভিত্তি নিশ্চিতভাবেই অর্থনৈতিক। পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি গ্রন্থে ফ্রেদরিখ এঙ্গেলস বলেন, একেবারে খাঁটি একগামিতা যদি সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ বলে বিবেচিত হয়, তবে তো সুতোলি ক্রিমি পোকাগুলোই সবচেয়ে ভালো বলতে হবে। এই পোকাগুলোর দেহে ৫০টা থেকে ২০০টা পর্যন্ত অংশ আছে। প্রতিটার মধ্যেই সম্পূর্ণ পুরুষ অঙ্গ ও স্ত্রী অঙ্গ আছে। তাই এ পোকারা সারা জীবন ধরে নিজের সঙ্গেই নিজে যৌন সঙ্গম করে থাকে। কিন্তু আমরা যদি স্তন্যপায়ী জীবদের বিষয়ে আলোচনা করি, তবে দেখতে পাব যে, তাদের মধ্যে বিচিত্র যৌন সম্পর্ক রয়েছেঅবাধ যৌন সম্পর্ক, দলগত যৌন সম্পর্ক, বহুগামিতা, একগামিতা।

...বর্বর যুগের মধ্যস্তর থেকে উচ্চস্তরে পরিবর্তনের সময় এ একবিবাহ প্রথার প্রবর্তন হয়। এ প্রথার ভিত্তিতে আছে পুরুষ প্রাধান্য। এ ব্যবস্থার স্পষ্ট উদ্দেশ্য হলোসন্তানদের পিতৃত্ব যাতে অবিসংবাদিত হয়। এর প্রয়োজন হলোযাতে সন্তানেরা যথাসময়ে পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে ভোগদখল করতে পারে। জোড় পরিবারের বিবাহ প্রথার সঙ্গে এক-বিবাহ প্রথার পার্থক্য হলোএকবিবাহ প্রথায় বিবাহের বন্ধন অনেক শক্ত। এখন আর স্বামী বা স্ত্রী যেকোনো একজনের ইচ্ছে হলেই বিবাহবন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না। এখন নিয়ম হলোকেবল পুরুষই ইচ্ছে করলে বিবাহবন্ধন ছিন্ন করতে পারবে। দাম্পত্য জীবনে ব্যভিচারের (বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক) অধিকারও পুরুষের বেলায় কার্যক্ষেত্রে রয়ে গেল।...কিন্তু স্ত্রী যদি প্রাচীন যুগের যৌন সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে স্বাধীন যৌনজীবন যাপন করতে চায়, তবে তাকে আগেকার যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে।

...একবিবাহ প্রথার সঙ্গে গোলামীর অস্তিত্ব, পুরুষের অধিকারের অন্যান্য সম্পত্তির সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতদাসীর অস্তিত্বএসবই গোড়া থেকেই একবিবাহ প্রথার ওপর এক বিশেষ ধরনের ছাপ মেরে দিয়েছে যে, একবিবাহ ব্যাপারটা শুধু নারীদের জন্যই পুরুষদের জন্য নয়, আজ পর্যন্ত সে অবস্থায়ই রয়ে গেছে।

...এ প্রথা ব্যক্তিগত প্রেম-যৌনতার ফলে হয়নি, আর ব্যক্তিগত প্রেম-যৌনতার সঙ্গে এর একেবারেই কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, বিবাহ প্রথা ব্যাপারটা আগের মতো এখনো সুবিধা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। এ পরিবার প্রথা কোনো স্বাভাবিক কারণে উদ্ভূত হয়নি। অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে, অর্থাৎ সম্পত্তির ওপর স্বাভাবিক যৌথ অধিকারের স্থলে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রথার প্রবর্তনের ফলেই এ একবিবাহমূলক পরিবার প্রথার প্রবর্তন হয়।

 

তিন

যেসব দেশে বিপ্লব হয়েছে, সেখানে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণই বিপ্লবী অগ্রযাত্রাকে নির্দেশ করে। যেমনটা চীন বিপ্লবের নেতা মাও সে-তুঙ বলেছেন, নারী অর্ধেক আকাশ, আর জনগণের অর্ধেক অংশের স্বার্থ সরাসরি পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত শ্রেণিসংগ্রামে জড়িত।

বিপ্লব-পরবর্তী পুনর্গঠনে যে পরিবার এবং প্রেম-যৌনতার পুরোনো ধারণা ভেঙে পড়তে বাধ্য, এ প্রসঙ্গে ১৯২০ সালে আলেকজান্দ্রা কোলনতাই বলেন, এ সত্যটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, পুরোনো ধরনের পরিবারের দিন শেষ, পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্র কর্তৃক বলপূর্বক ধ্বংস সাধনের কারণে নয়, বরং এই জন্যে যে, পরিবারের প্রয়োজন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের কাছে পরিবারের প্রয়োজনীয়তা নেই, কারণ ঘরোয়া আর্থিক কাঠামো আর সুবিধাজনক নয়পরিবার শ্রমিককে আরও কার্যকরী ও উৎপাদনশীল হওয়া থেকে বিরত করে। পরিবারের সদস্যরা আর পরিবারের কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না, কারণ বাচ্চাকে বড় করার যে দায়িত্ব এত দিন তাদের ওপর ছিল, তা আরও বেশি বেশি করে সমষ্টির হাতে চলে যাচ্ছে। নর-নারীর পুরোনো সম্পর্কের জায়গায় বিকশিত হচ্ছে নতুন এক সম্পর্কঅনুরাগ ও কমরেডশিপের মিলন, যারা দুজনেই মুক্ত, দুজনেই স্বাধীন, দুজনেই শ্রমিকসাম্যবাদী সমাজের এমন দুই সমকক্ষ সদস্যের মিলন। নারীর আর গার্হস্থ্য বন্ধন নেই, পরিবারের ভেতরে আর বৈষম্য নেই। সাহায্যহীন পরিত্যক্ত অবস্থা এবং সঙ্গে বাচ্চাকে মানুষ করতে হবে, এসবে নারীদের আর ভয় পাবার দরকার নেই। কমিউনিস্ট সমাজে নারীকে আর তার স্বামীর ওপর নির্ভর করতে হয় না, বরং নির্ভর করতে হয় নিজের কাজের ওপর। তিনি তার নির্ভরতার জায়গা খুঁজে পাবেন আপন কর্মক্ষমতার মধ্যে, স্বামীর মধ্যে নয়। সন্তানের জন্য তার উদ্বিগ্ন হবার দরকার নেই। তাদের দায়িত্ব নেবে শ্রমিক রাষ্ট্র। বিবাহ, পারিবারিক জীবনকে পঙ্গুকারী যাবতীয় বস্তুগত হিসাব-নিকাশের উপাদানসমূহ হারাবে। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বাস আছে, এমন দুজন মানুষের মিলনই হবে বিবাহ। এই মিলন নিজেদের এবং চারপাশের জগৎকে বোঝে এমন শ্রমজীবী নারী-পুরুষকে পরিপূর্ণ সুখ এবং সর্বোচ্চ পরিতৃপ্তি দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। অতীতের বৈবাহিক দাসত্বের পরিবর্তে কমিউনিস্ট সমাজ নারী ও পুরুষকে এক মুক্তমিলনের সুযোগ করে দেয়, যা সেই কমরেডশিপে সমৃদ্ধ, যা এই সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছে।

শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্রের প্রয়োজন যেকোনো লিঙ্গের মধ্যে নতুন সম্পর্কের, যেমন নিজের সন্তানের প্রতি মায়ের সংকীর্ণ ও সংরক্ষিত স্নেহকে অবশ্যই ছড়িয়ে দিতে হবে, মহান সর্বহারা পরিবারের সমস্ত সন্তানের প্রতিও, যেমন নারীর দাসত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা অবিচ্ছেদ্য বিবাহের জায়গা নেবে শ্রমিক রাষ্ট্রের দুই সমকক্ষ সদস্যের মধ্যকার এমন এক মুক্তমিলন, যা ভালোবাসা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার বন্ধনে আবদ্ধ। ব্যক্তিগত ও আত্মবাদী পরিবারের জায়গায় শ্রমিকশ্রেণির এক বিরাট সর্বজনীন পরিবার বিকশিত হবে, যার অভ্যন্তরে সর্বোপরি সমস্ত শ্রমিক নারী-পুরুষনির্বিশেষে কমরেড বলে বিবেচিত হবেন। এই হলো কমিউনিস্ট সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্কের ধরন। এই নতুন ধরনের সম্পর্কগুলো মানবতাকে, যাবতীয় আনন্দসহ এমন এক ভালোবাসাকে সুনিশ্চিত করবে, যে ভালোবাসা বাণিজ্যিক সমাজে ছিল অধরা, যে ভালোবাসা হবে মুক্ত এবং সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সত্যিকারের সামাজিক সাম্যনির্ভর। [কমিউনিজম এবং পরিবার]

একবিংশ শতাব্দীতে এসেও অনেক নারী ভাসা-ভাসা সংগ্রামে লিপ্ত হন, তাদের আদি ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে কোনো জানা-বোঝা না থাকার কারণে, অথবা ঐতিহাসিক বাস্তবতার উপলব্ধির অভাবে শুধু পুরুষবিদ্বেষী মনোভাবের প্রকাশ ঘটে। যাতে সমাজে বিভক্তি বাড়ে; কিন্তু সমাজ-সভ্যতা পরিবর্তনের কোনো মৌলিক ভূমিকা রাখা সম্ভব হয় না। এখানেই পরিবার ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি গ্রন্থের গুরুত্ব বেড়ে যায়। 

 

চার

পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি গ্রন্থে পরিষ্কারভাবে তিনটি সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে, যা মার্ক্সবাদের বিকাশ ও বিপ্লবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। ফ্রেদরিখ এঙ্গেলস দেখিয়েছেন

১. পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং রাষ্ট্রএগুলো মানুষের সমাজে কোনো চিরন্তন বিষয় নয়, অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এবং একটা পর্যায়ে এসব সংস্থার উদ্ভব ঘটেছে। যে কারণে এটিকে চিরস্থায়ী ধরে এবং অপরিবর্তিত মনে করার কোনো অবকাশ নেই।

২. রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ক্ষমতাসীন শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া। রাষ্ট্র বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে। রাষ্ট্রের আইন, বাহিনী, বিচারব্যবস্থাএসব কাঠামো হচ্ছে সেই বলপ্রয়োগের কার্যকর মাধ্যম বা যন্ত্র।

৩. সমাজ অনড় এবং অপরিবর্তনীয় নয়। সমাজের অর্থনীতি বিকশিত হচ্ছে। শোষক এবং শোষিত হিসেবে মানুষের শ্রেণিবিভাগ ঐতিহাসিক ঘটনা হলেও তা অবিনশ্বর নয়। সমাজের বিকাশের নিয়মেই একদিন শ্রেণি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। একদিন যেমন তার উদ্ভব ঘটেছিল, তেমনি একদিন তার বিলোপ ঘটবে। শোষকশ্রেণি না থাকলে রাষ্ট্রও তার প্রয়োজনীতা হারাবে। এভাবেই রাষ্ট্র বিলুপ্ত হবে।

মার্ক্সবাদের এই মৌলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে রুশ বিপ্লবী ভ্লাদিমির লেনিন রাষ্ট্র ও বিপ্লব গ্রন্থে মূর্তভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, বিপ্লবের পর প্রথম কাজ প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রের সংস্কার করা নয়; বরং সমূলে উপড়ে ফেলা এবং সেখানে নতুন রাষ্ট্র গড়ে তোলা। এই নতুন রাষ্ট্র সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ ও সমবায় গঠনের মধ্য দিয়ে সম্পদের সামাজিকীকরণের দিকে অগ্রসর হবে। এ সময়ে রাষ্ট্র ক্রমেই ক্ষয় হতে থাকবে। বিশ্বব্যাপী যখন সব প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রের অবসান ঘটবে, তখন শ্রেণিশোষণের হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্র তার প্রয়োজনীয়তা হারাবে। গড়ে উঠবে শোষণমুক্ত মানবিক সাম্যবাদী সমাজ।