বাদশাহ সিকান্দারের অসিয়ত
গ্রিসের এক প্রান্তের ছোট্ট দ্বীপ সান্তরিনি। পর্যটকে সয়লাব শৈলনিবাসটির কত যে অলিগলি। খেই হারাবার অবস্থা। তবু উৎসুক মন নিয়ে জনস্রোতকে অনুসরণ করে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। পথে-ঘাটে-রেস্তোরাঁয় নানান কিসিমের ভ্রামণিক। আগুয়ান পথচারীদের মাথায় বাহারি হ্যাট আর চোখে রোদচশমা। আমিও চশমার আড়ালে দেখি, বিকেলের সোনাঝরা রোদ এসে ঠিকরে পড়েছে মৌন পাহাড়ের গায়ে। এদিকে আবাস, রেস্তোরাঁ আর গির্জার বিন্যাস। এদের রং দুগ্ধধবল। কিছু স্থাপনায় আবার নীল অবতল মস্তক। প্রাসাদ-লাগোয়া গম্বুজজুড়ে তাজা আঙুরলতা আর বাগানবিলাসের বিস্তার। পথে পথে ঝলমলে অপ্সরাদের যেন মেলা বসেছে। দিন-দুপুরে এত খোলামেলা বেশবাস আমার গেঁয়ো চোখে বিসদৃশ ঠেকে। এ দেশে কি কাপড়চোপড় দামে আক্রা?
অন্যমনস্ক হয়ে চলতে চলতে নুড়িপাথরে আচমকা হোঁচট খেয়ে নিচের দিকে চেয়ে দেখি, সাগরের নীল কিনারা তাজিম করে লালচে পাহাড়ের চরণ ধুয়ে দিচ্ছে। আর শেষ বিকেলের সোনালি ঝালর সাগরের বুকে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। তৃষ্ণার্ত কেউবা সেদিকে তাকিয়ে দ্রাক্ষারসে গলা ভেজায়। একজন বিচিত্র সাজের মানুষ দীর্ঘ বাঁশিতে বিরহের সুর তুলল। এক ঘোড়সওয়ারি দম্পতি পাহাড়ি উঁচু পথে অবলীলায় এগোয়। অশ্বখুরের খটখট আর ঘণ্টার টুংটাং ছাপিয়ে তরুণীটি কপট ব্রীড়ায় সঙ্গীর গায়ে আঁকড়ে ধরে। হঠাৎ করেই বাতাসের পরশ লেগে আরেক অসতর্ক শ্বেতাঙ্গিনীর মিনিস্কার্ট উড়ে যাবার উপক্রম হয়। চকিতেই নীলাভ চোখের মেয়েটি লাজুক হেসে চম্পক আঙুল চালিয়ে স্কার্টের হাশিয়া নিচের দিকে টেনে ধরে। তার সহচরীরা শরীরে কাঁপিয়ে খিলখিল করে হাসে। সে হাসির ঢেউ পাশের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে আমাদের দিকে ফিরে আসে। আমি মনে মনে ধন্য হয়ে উঠি, তবে সঙ্গিনীর ভয়ে নিশ্চুপ হাঁটি। উল্টো দিক থেকে আসা এক প্রৌঢ় পর্যটক মুচকি হেসে বললেন, ঠিক যেন মেরিলিন মনরো! বিপন্ন সেই পর্যটিকার চোখে কটাক্ষ আর খুশির জোয়ার ওঠে। এসব এড়িয়ে নিরিবিলি দেখে পাহাড়ের কন্দরে হেলান দিয়ে সমুদ্রমুখী হয়ে আমরা একটু জিরিয়ে নিলাম। ওপরে নীল আসমানের চাঁদোয়া। এর নিচে গাংচিলের ঝাঁক উড়ে উড়ে হারিয়ে যায় দূরে-অনেক দূরে। ঝুপ করে একটা মাছখেকো পাখি পানিতে হামলে পড়ে। নরডিক মেয়েদের চোখের চেয়েও নীল এখানকার জলধী। এখন আবার আবিররঙা সূর্যদেব জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে ছড়িয়ে পড়েছে। লেবু-পানিতে একটু চুমুক দিয়ে এই মায়াপুরীতে আমরা নিরুদ্দেশ হাঁটি। কোত্থেকে একটা মায়াবী বিড়াল এসে আমাদের পায়ে পায়ে ঘোরে।
সন্ধ্যা একটু জেঁকে বসলে অতিথিশালার সমান্তরালে এক ছোট্ট রেস্তোরাঁয় গিয়ে হাজির হলাম। লক্ষ্য খাঁটি গ্রিক খাবার। লাল শামিয়ানা-শোভিত পাথরের বেঞ্চিতে বসলাম। পাহাড়ে শাবল-বাটালি খুদে বেশ মনোহর করে এই দোকানের কাঠামো বানানো হয়েছে। রেস্তোরাঁটির টবে কয়েকটা অনিন্দ্যসুন্দর বনসাই। এক কোণে কয়েকটা রঙিলা কাগজ হাওয়ায় দোলে। এক শক্ত-সামর্থ্য বৃদ্ধ দোকানি আধশোয়া গদিয়ান হয়ে নিবিষ্ট মনে আলবোলা মুখে আরামসে ধূমপান করছেন। কোনো দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি শুভাশিস জানিয়ে ‘হাই’ বললাম। তিনি ম্লান চোখ মেলে ‘হাই’ তুললেন। বুড়ো কি আমাদেরকে দেখে কিছুটা বিরক্তই হলেন? না, এবার মৃদু হাসলেন। দোকানে খদ্দের মাত্র চার/পাঁচজন। এক পৃথুলা তরুণী এসে ঝুঁকে সেলাম জানাল। তার মাথায় একরাশ স্বাস্থ্যবান চুলের বন্যা। ধন্যবাদ জানিয়ে খাবার তালিকায় হাত দিয়ে দেখি তেল চিটচিটে ভাব। খাবার অর্ডার করলাম বেশ দ্বিধা নিয়ে।
জাহাজ আর ক্ষুদে দ্বীপ সাগরের বুকে ঝিমোয় : ছবি © লেখক
অনেকটা সময় পর খাবার এলো। আমার স্ত্রী হাসিমুখে বলল, বিলম্বে খাবার পরিবেশন উন্নত ভোজনালয়ের লক্ষণ। প্রথমে খাঁটি জলপাই, রসুনের সস, মাখন আর শুষ্ক পাউরুটি। সাথে মৌরির পানীয়। আমার স্ত্রী শক্ত পাউরুটিতে এক কামড় বসিয়ে রাগী চোখে তাকাল। আমি মনে মনে দোয়াদরুদ পড়ে বললাম, এটা স্টার্টার, মুফতে এসেছে। সে খেপে বলল, ফ্রি পেলেই যদি খেতে চাও, তাইলে সামনে কচ্ছপের মতো শুয়ে থাকা পাথরের চাঁই খেলেই পারো। একদম হক কথা, সক্রেটিসের মতো চুপ থাকাই হিরণ্ময়। কী বিপদ, অদূরের বাগানে জলসেচার বালতিও দেখা যাচ্ছে! মনে পড়ল, একবার তরুণী স্ত্রী জানথিপি ভুলোমনা স্বামী সক্রেটিসকে বকাঝকা করে সাংসারিক দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। দার্শনিক সক্রেটিস তবু চুপটি করে আছেন দেখে স্ত্রী শেষে রেগে-টেগে বেচারার মাথায় এক বালতি পানি ঢেলে দিলেন। স্মিত হেসে নির্লিপ্ত স্বামী বললেন, এত তর্জনগর্জনের পর একটু বারিবর্ষণ না হলে কী চলে!
এক ফাঁকে হুড়মুড় করে একদল তরুণ ছেলেমেয়ে এসে রেস্তোরাঁয় ঢুকল। প্রাণের উচ্ছ্বাসে ঝলমল শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে যেন ম্রিয়মাণ দোকানে সাড়া পড়ে গেল। দোকানি বেশ ব্যস্তসমস্ত হয়ে এদেরকে সম্ভাষণ জানালেন। আমাদের এদিকে ফেটা চিজ, অলিভ, শসা, চিকেন, বিস্কুটের টুকরা, শাকপাতা, খুদে টমেটোর মিশ্রণের সালাদ আর স্কুইড ফ্রাই নিয়ে হাজির হলো রূপবান ওয়েটার। একটু পরেই এলো মাশরুম সুপ। ছেলেটির মুখে মিটি মিটি হাসি লেগেই আছে। তার বুকপকেটের নেমপ্লেটে এসক্লোপিয়াস নাম দেখে মজা পেলাম। বলা দরকার, হেমলক বিষ পান করে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে সক্রেটিসের আচমকাই স্মরণ হলো, প্রতিবেশী এসক্লোপিয়াসের কাছে তিনি একটা মোরগ ঋণ করেছিলেন। মৃত্যুপথযাত্রী দার্শনিক কাতরকণ্ঠে এক সহযোগীকে বললেন, যেভাবেই পারো, আমার মৃত্যুর পর এই ঋণ পরিশোধ করে দিয়ো। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে মহাকালে মিশে যাবার আগে এটাই ছিল সক্রেটিসের শেষ উক্তি। স্মর্তব্য, এ নিয়ে কবি আল মাহমুদ তাঁর যৌবনকালে ‘সক্রেটিসের মোরগ’ শিরোনামে একটা কবিতা রচনা করেছেন। অমর গ্রিক দার্শনিককে নিয়ে কবি শামসুর রাহমানও লিখেছেন অপূর্ব এক সনেট—
এ কথা সবাই জানে গ্রিক দার্শনিক সক্রেতিস
ব্যতিক্রমী মত প্রকাশের দায়ে নিজ হাতে বিষ
করেছেন পান। কারাগারে মৃত্যু উঠেছিল নেচে
যখন সে প্রাজ্ঞ ওষ্ঠে কালো মোরগের মতো, বেঁচে
ছিলেন গৃহিণী তাঁর, ছিল ছেঁড়াখোঁড়া সংসারের
স্মৃতিচিত্র, হাট বাজারের সংলাপ, তরুণদের
নিয়ত সত্যাভিসারি দৃষ্টিপাত তখন কি তার
পড়েছিল মনে এইসব খুঁটিনাটি? নাকি জগত সংসার
কুটোর মতোই ভেসে গিয়েছিল তন্দ্রাচ্ছন্ন স্রোতে
অথচ সহজ ছিল আত্মরক্ষা; যদি সত্য হতে
ফিরিয়ে নিতেন মুখ, তাহলে বিশ্বাস নির্বাসনে
যেতনা তখনই, আরও কিছুকাল নিকানো উঠোনে
পড়ত তাচ্ছাপ। সবই অধিবাস্তবের প্রহেলিকা
জেনে নিলেন বেছে হেমলকিস্বাদ অকম্পিত শিখা।
—শামসুর রাহমান
গ্রিসের এক প্রান্তের ছোট্ট দ্বীপ সান্তরিনি: ছবি © লেখক
এক ফাঁকে ওয়েটারকে বললাম, তোমার নামের একজন ধনাঢ্য প্রতিবেশীর কাছ থেকে দার্শনিক সক্রেটিস বাকিতে মোরগ কিনতেন। সক্রেটিস মারা যাবার পর তাঁর সহচর ক্রিটো এ ঋণ পরিশোধ করেছিলেন। সে অবাক হয়ে বলল, সত্যি? জানতাম না তো। সক্রেটিস এত গরিব ছিলেন!
আমি স্ত্রীর হালকা ঝাড়ি খেলাম। সে বলল, কী আক্কেল রে, বাবা। তুমি অশিক্ষিত হোটেলবয়ের সাথেও দর্শন আলোচনা করো? আমি বললাম, শুধু গজদন্ত মিনারে বসে থাকা শিক্ষিত মানুষদেরই দর্শন থাকবে, সাধারণ মানুষের কোনো দর্শনচিন্তা নেই? তাহলে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ অধ্যাপক জিসি দেব কেন লিখেছেন এই আকর গ্রন্থ- ‘সাধারণ মানুষের দর্শন’? আমি চুপ হলে স্ত্রী বলল, শোনো, সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় দর্শন ক্ষুধা। মুখে একটু সালাদ পুরে সে বলল, খেতে খারাপ না, তবে কেমন যেন গন্ধ। আমি মুখে দিয়েই বললাম, এটা পাঁঠা ছাগলের গায়ের গন্ধ। আমাদের বাড়িতে পাঁঠার মাংস খাবার চল ছিল। ঝাল ঝাল পাঁঠার মাংস আমার খুব প্রিয়। তবে তা রাঁধতে হবে মাটির চুলায় বাটা মসলা দিয়ে। স্ত্রী বলল, পাঁঠার মাংস তো শুনেছি হিন্দুদের পূজার নৈবেদ্য। আমি যোগ করলাম, শুধু তা-ই নয়, শিশুকালে আমরা গাঁয়ের সবুজ আইল ধরে বেশ উল্লাস করে কোরবানির ছাগলও চরাতাম। সহধর্মিণী বলল, তা কখনো বলো নি তো। আমি হেসে বললাম, ছাগল চরানো বেশ একটা পুরোনো পেশা। একে হেলাফেলা করো না। দেখো, অনেক মশহুর পয়গম্বরকেই উন্মুক্ত আকাশের নিচে অসংলগ্ন মেষের পালের রাখালি করে হাত পাকিয়ে পরে মানুষের পালকে মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত করতে হয়েছে। এক চামচ সুপ খেয়ে স্ত্রী বলল, সব সময় ফিলসফি। তুমি কি নিজেকে সাধু-সন্ত টাইপ ভাবো নাকি? আমি তো জানি, তুমি কে। আমি হেসে বললাম, তুমি তো দেখি জব্বর উস্তাদ, মহামতি সক্রেটিস নিজেই জানতেন না যে—তিনি কে।
সালাদ পর্ব শেষ না হতেই বিশাল ডিশে হাজির হলো কয়লার আগুনে ঝলসানো আস্ত মাছ। বিশাল আকার। ভাজা তেল, মেথি, পেঁয়াজ-রসুন-আদা আর নানা কিসিমের মসলার গন্ধে চারদিক ম-ম করছে। সাথে আলুর ভর্তা [যাকে পরিশীলন করে এরা বলে মাসড পোটেটো] আর ঘিয়ে ভাজা নরম রুটি। মাছের এক টুকরো মুখে পুরে বেশ আফসোস হলো, কেন বিস্বাদ সালাদ আর শক্ত পাউরুটি খেয়ে পেট ভরলাম। এক ফাঁকে রঙিন ঘাগরা পরা এক সুডৌল নারী কুর্নিশ করে বেহালা বাজিয়ে গান গাইতে শুরু করেছে। গানের কথা অবোধ্য হলেও গায়িকা একেবারে কিন্নরকণ্ঠী। উল্লম্ব শাদা টুপিপরা এক পাচক এসে ইংরেজি উচ্চারণে বেশ খানিকটা ‘আর’ মিশিয়ে জিজ্ঞেস করল, খাবার কেমন হয়েছে? আমার স্ত্রী তৃপ্তির হাসি দিলে সে আশ্বস্ত হলো। আমিও বললাম, খাবার হয়েছে অমৃতের মতো। সে বিগলিত হাসিতে কুর্নিশ করে ফিসফিস করে জানাল, এখনকার মূর্ছনাটি ম্যাগ্নাম আলেকজান্দ্র বা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর শেষ বিদায়ের কথা। কান খাড়া করলাম, অনেকটা তুর্কি আর মিসরীয় সুরের মাখামাখি। গ্রিক না জানার জন্য আবারও আক্ষেপ হলো। একেবারে শেষের দিকে বেহালার সুর ধীরলয়ে করুণ হয়ে হাহাকারের রূপ নিল, যা মাতাল হাওয়ায় মিশে হারিয়ে যাচ্ছে নীল সাগরে।
খদ্দেরদের অনেকেরই ভোজনপর্ব শেষ হয়েছে। আমিও জুতার ফিতে বেঁধে অতিথিশালায় ফেরার প্রস্তুতি নিলাম। এক মোটাসোটা মেয়ে হঠাৎ করেই শরীরের আড়মোড়া ভেঙে আবার দ্রাক্ষারসে পেয়ালা পূর্ণ করে ঢকঢক করে খেয়ে নিল। বলে রাখি, এখানে ডিনার করলে পানীয় ফ্রি। শেষের দিকে হিড়িম্বারূপী মেয়েটি থাবা মেলে শিল্পীর দিকে কয়েকটা ডলারও ছুড়ে দিল। ঝনঝন শব্দে সবাই সচকিত হয়ে অকারণ হাসল। হাসি সংক্রামক বলে আমিও হেসে ফিসফিস করে বললাম, মেয়েটি যেমন সমৃদ্ধ, দিলও তেমনি দরাজ। আমার স্ত্রী বলল, খবরদার, ওদিকে তাকিয়ো না, ছুড়ি মনে হয় কুস্তিগির। ভয়ার্ত চোখের দৃষ্টি এঁকে একটু এগিয়ে ক্রিস্টালের বাটিতে আলগোছে কিছু বকশিশ রাখলাম। ভারতীয় কায়দায় কপালে বেহালা ঠেকিয়ে শিল্পী ধন্যবাদ জানাল। রেস্তোরাঁ হতে বের হবার পথে এক তরুণ এসে আমাদের সাথে পরিচিত হয়ে বলল, তোমাদেরকে লবিতে দেখেছি। চলো, একসাথেই অতিথিশালায় যাব। বাতচিত করে অবাক হলাম, সে নাকি যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্যদেশীয় দর্শন পড়ায়! একটা বইয়ের খসড়ায় সমাপনী তুলির আঁচড় দিতে এখানে এসেছে। বিজলিবাতির আলো গায়ে মেখে ফেরার পথে মহামতি আলেক্সান্ডারের কাহিনি শোনালে সেই তরুণ শিক্ষক।
সাগর আর পাহাড়ের সংগমে স্হাপিত রেঁস্তোরায় লেখক ©
আলেকজান্ডারের তখন বয়স ষোলো। দিগ্বিজয়ে বেরোবার আগে তিনি এথেন্সের প্রাজ্ঞ মানুষ ডায়াজিনস-এর সাথে দেখে করতে গেলেন। পাইপে বিশ্রামরত দার্শনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এই সুঠাম যুবককে দেখে বিষণ্ন মুখে বললেন, তুমি কে? অশ্বারোহী উদ্ধত তরুণ বললেন, আমি ফিলিপের পুত্র—আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট। দার্শনিক মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, তোমার ভুল দৃষ্টিভঙ্গি; তুমি গ্রেট হলে সেটা তো লোকজন বলবে, তুমি না। তুমি বিজয়ী হবে ঠিকই, তবে আগে নিজের ওপর বিজয়ী হও। ডায়াজিনস আবার বললেন, যুদ্ধের পোশাক পরে কোথায় যাচ্ছ? তরুণ বললেন, আমি প্রথম এশিয়া মাইনর জয় করব। ডায়াজিনস বললেন, তারপর কি করবে? আলেকজান্ডার বললেন, পারস্য জয় করব। দার্শনিক প্রশ্ন করলেন, তারপর? যোদ্ধা বললেন, সব জনপদ জয় করে শান্তিতে ঘুমাব। ডায়াজিনস বললেন, শান্তিতে ঘুমাতে চাইলে এত যুদ্ধ-বিগ্রহের কী প্রয়োজন? তুমি চাইলে এখুনি এথেন্সেই শান্তির ঘুমে ঘুমিয়ে পড়তে পারো। তোমার অভিযাত্রায় আমার আশীর্বাদ থাকছে। তবে আমার ধারণা, তুমি আর এথেন্সে ফিরবে না।
আলেকজান্ডার এবার দিগ্বিজয়ে বেরোলেন। তাঁর নেতৃত্বে জনপদের পর জনপদ অর্জিত হলো। টানা ষোলো বছর যুদ্ধ করে এশিয়া মাইনর, পারস্যসহ সব জয় করে আলেকজান্ডার ভারতের প্রবেশদ্বারে সসৈন্যে পৌঁছালেন। তখন তাঁর বয়স বত্রিশ। ঘরবাড়ি ছেড়ে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত সেনাদের উজ্জীবিত করতে তিনি যে স্বগতোক্তি দেন, তা পৃথিবীর সবচেয়ে উদ্দীপক ভাষণ। হায়দরাবাদের এক খুদে রাজকীয় বাহিনীকে হারাতে গ্রিক সুদক্ষ বাহিনীর অল্পক্ষণই লাগল। পরাজিত স্থানীয় রাজা পুরুকে আটক করে আলেকজান্ডারের সামনে আনা হলো। বিজয়ী আলেকজান্ডার বললেন, আপনি আমার কাছে কী চান? পরাজিত পুরু স্পষ্ট স্বরে বললেন, যতই ছোট হোক, আমি একজন স্বাধীন রাজ্যের রাজা। একজন রাজা অপর রাজার কাছে যে মার্গের তাজিম পায়, আমি তা-ই চাই। কথাটা আলেকজান্ডারের মনঃপুত হলো। বন্দী পুরুকে শৃঙ্খল মুক্ত করে অধিকৃত রাজ্যের দায়িত্ব দিয়ে তিনি আবার ফিরে চললেন জন্মভূমি এথেন্সে। আলেকজান্ডার এই অঞ্চলে বাদশাহ সিকান্দার বা ইস্কান্দার নামেই অধিক পরিচিত হলেন। হাঁটতে হাঁটতে ততক্ষণে আমরা হোটেলের লবিতে পৌঁছে গেছি। এখানে বসেই ইয়াঙ্কি প্রভাষকের কাছে শুনলাম মহামতি সিকান্দারের জীবনের অন্তিম দিনগুলোর কথা।
এথেন্সে ফেরার তোড়জোড় শুরু হলো। সে সময়টায় সব্যসাচী সিকান্দারের মাথায় ভারতীয় যোগ, ধ্যান, অমরতা এ বিষয়গুলো বেশ ঘুরপাক খাচ্ছিল। একসময় তিনি অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন, জন্মভূমিতে একজন ভারতীয় যোগী নিয়ে যাবেন। সিকান্দারের আদেশে কয়েকজন উদ্ধত সেনা গিয়ে গাছের ছায়ায় ধ্যানমগ্ন নগ্নপদের এক সন্ন্যাসীকে কর্কশ কণ্ঠে বলল, সম্রাট বলেছেন আপনাকে নিয়ে যেতে। গায়ের কৌপিন বস্ত্রের জীর্ণ প্রান্ত খুঁটে যোগীপ্রবর হালকা চোখ মেলে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আমার কোথাও যাবার তাড়া নেই, কারও প্রয়োজন থাকলে এখানেই তাকে আসতে বলো। গ্রিক সেনারা এমনধারা কথা কখনো শোনেনি। একজন সৈন্য উগ্রচণ্ডী হয়ে তলোয়ার নিয়ে সামনে এগোল। নির্লিপ্ত সন্ন্যাসী চোখ পিটপিট করে বললেন, এ কেমন অসংস্কৃত আচরণ। মরণে আমার ভয় নেই। আমার মাথা কাটতে পারলেও মস্তিষ্কের বিদ্যা তো কেউ নিতে পারবে না। সিকান্দারের জীবনীকাররা এই যোগীর নাম লিখেছেন দান্দামিস। পারিষদের কাছে যোগী দান্দামিসের এই ব্যতিক্রমী জবাব শুনে উৎসুক সিকান্দার নিজে ঘোড়ায় চড়ে হাজির হলেন অকুস্থলে। বেশ চড়া মেজাজেই বললেন, হে নিঃস্ব মানুষ, তুমি জানো, আমি কে? তুমি আমার সাথে এথেন্সে যাবে, সোনাদানা যা চাও, তাই পাবে। যোগী বললেন, এসবে আমার একদম আসক্তি নেই। তবে আমি তোমাকে চিনেছি, তুমি আমার দাসানুদাস। কারণ, তুমি বেশ রেগে আছ। রাগ আমার দাস, আর তুমি রাগের দাস। মহামতি সিকান্দার বুঝলেন, সব জায়গায় তলোয়ার চালানো বৃথা। এই বেয়াড়া যোগীকে রাজি করাতে না পেরে অগত্যা আরেক তান্ত্রিককে নিয়ে সিকান্দার এথেন্সের পথে রওনা দিলেন। নতুন সাধকের নাম কালানস। তবে কালানস পথিমধ্যে একসময় আত্মহত্যা করেন। তিনিই সম্ভবত দিগ্বিজয়ী সিকান্দারকে মরমিবাদের দিকে কিছুটা অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তেত্রিশ বছর বয়সী মরণপথ যাত্রী সিকান্দার তাঁর নিথর দেহখানি গোরস্তানে নিয়ে যাবার অসিয়ত করে যান এভাবে—
বাহির পানে ছড়িয়ে দিও সিকান্দারের হাত দুখানি
রিক্তহাতে এসেছিলাম, রিক্তহাতেই ফিরব জানি।
ইয়াঙ্কি প্রফেসর গা তুললে আমরা নিজ কক্ষে ফিরে এলাম। অদূরের কোঠর থেকে তক্ষক ডেকে উঠলে দৃষ্টি মেলে দেখি মায়াবী চাঁদনীতে বিশ্বচরাচর ভেসে যাচ্ছে। আমরা আজ সমুদ্রমুখী বারান্দায় বসে জ্যোৎস্নাধোয়া প্রকৃতির রূপে বিভোর হবো।
এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম প্রেম মিলেনা শুধু সুখ চলে যায়
Mohammad Jaglul huq
সেপ্টেম্বর ০১, ২০২১ ১৭:৫৫
বাহির পানে ছড়িয়ে দিও সিকান্দারের হাত দুখানি রিক্তহাতে এসেছিলাম, রিক্তহাতেই ফিরব জানি।
mamun mahbub
ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২২ ১৭:১০