দেশের বুদ্ধিজীবীরা আসছে মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে

 

যতীন সরকার [Jatin Sarker]

লেখক, চিন্তাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। জন্ম ১৮ আগস্ট ১৯৩৬ সালে, নেত্রকোনা জেলায়। নিজের লেখা ও সম্পাদনা মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা ৬২ টির অধিক। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা। সর্বশেষ ২০১৯ সালে প্রকাশিত বই প্রত্যয় প্রতিভা প্রতিজ্ঞা। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মাধ্যে রয়েছে পাকিস্তানের জন্ম মৃতু-দর্শন, বাংলাদেশের কবিগান, বাঙালীর সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সংগ্রাম, মানবমন মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব, গল্পে গল্পে ব্যাকরণ, দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞানচেতনা, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবী সমাচার, ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভূত ভবিষ্যৎ, আমার নজরুল অবলোকন, আমাদের চিন্তাচর্চার দিক-দিগন্ত, ভাষা সংস্কৃতি উৎসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা, মুক্তবুদ্ধির চড়াই-উৎরাই, প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন, সত্য যে আমার যেটুকু সাধ্য, প্রান্তিক ভাবনাপুঞ্জসাঁকো বাঁধার প্রত্যয় ইত্যাদি। ২০০৮ সালে তিনি গবেষণা ও প্রবন্ধের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। তারও আগে পান ‘ডাক্তার মোহাম্মদ এনামুল হক স্বর্ণ পদক’। ২০০৬ সালে পাকিস্তানের জন্ম মৃতু-দর্শন প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১১ নির্বাচিত হয়। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ শ্রুতি স্বর্ণপদক, ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাব লিটারারি অ্যাওয়ার্ড, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার এবং মনিরুদ্দিন ইউসুফ সাহিত্য আওয়ার্ড। আজীবন তিনি ময়মনসিংহে থেকেছেন। প্রধানত নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। উদীচীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তর্ক বাংলার জন্য তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কথাকার ও প্রাবন্ধিক শাখাওয়াত বকুল।    

শাখাওয়াত বকুল:  করোনাকালের এই সময়ে কেমন আছেন? শারীরিক ও মানসিকভাবে কেমন বোধ করছেন? আপনার ভাষায় দার্শনিক হিসেবে করোনাকালকে কীভাবে দেখেন?  

যতীন সরকার: করোনাকালীন অন্যান্য মানুষ যে রকম উদ্বেগের মধ্যে আছে, আমিও তেমন উদ্বেগের মধ্যেই আছি। এ ছাড়া আমি তো বের হতে পারি না, আর্থ্রাইটিস এমন এক ব্যাধি, যার ফলে আমি ঘর হতে সামনে বের হতে পারি না।  বস্তুত আমি করোনার আগে থেকেই ঘরবন্দি, এর মধ্যে গত পরশু দিন আমার মেয়ে আসছিল, প্রায় এক বছর পর আমি রাস্তায় বের হইছিলাম। আমার বইয়ে আমি দার্শনিক ব্যঙ্গার্থে ব্যবহার করেছি, একদল লোক পুকুরে মাছ ধরা দেখছিল, অনেক ভিড়ের কারণ জিজ্ঞাসা করলে একটি অনক্ষর লোক হেসে বলেছিলেন, না, যারা মাছ ধরছে, তাদের চেয়ে দার্শনিকের সংখ্যাই বেশি। দর্শন যারা করে, তারা সবাই তো দার্শনিক, এই অর্থে দার্শনিক। করোনাকালকে আমি এইভাবে দেখি, পৃথিবীতে মাঝে মাঝে এমন সব বিপর্যয় ঘটে, তা থেকে উত্তরণ ঘটানো কঠিন হয়ে পড়ে। করোনাভাইরাস হচ্ছে এমন একটি ধারণা, যা আগে কখনো ঘটেনি। আমি রবীন্দ্রনাথের কথায় বিশ্বাস করি। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, আমি মনে করি সংকট আসবে, মানুষই সেই সংকটের উত্তরণ ঘটাবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, এই জগতে ভালোটারই প্রাধান্য, মন্দ যদি তিন-চল্লিশ, ভালোর সংখ্যা সাতান্ন। 

বকুল: আপনার সময়কাল আলোচনার পূর্বে পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু দর্শন বইটি সম্পর্কে একটু আলোচনা করতে চাই।

সরকার: শোনো, আমার ৮৫ বছর চলছে, এই কত বছরে, ৮৫ বছরের মধ্যে এমন সব পরিবর্তন ঘটেছে, আমি জানি না, শতাব্দীকাল ধরেও এত পরিবর্তন ঘটেছে কি না? আমি ছোটবেলায় আমার ঠাকুরদাদার কাছে লেখাপড়া শিখেছি, উনার নাম রামদয়াল সরকার। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তিনি আমাকে রামায়ণ, মহাভারত, গীতা সম্পর্কে একেবারে ছোটবেলায় জ্ঞান দান করেছেন। আমি ইঁচড়ে পাকা হয়ে উঠেছিলাম, এই কথা আমি আমার বইয়ের মধ্যে লিখেছি। সেই জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতেই আমার চেতনাকে নিজের মতো করে নিতে পেরেছি। ঠাকুরদার কাছে যদি ওই জ্ঞানটা না পেতাম, তাহলে সেটা সম্ভব হতো না। এই সময়ের পরিবর্তনের সূত্রে সবকিছুরই পরিবর্তন ঘটেছে। আমি বলেছি, পাকিস্তান হবার মধ্য দিয়ে হিন্দু, হিন্দু হয়েছে, এ কথা শুনতে কেমন লাগে! কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে হিন্দুকে হিন্দু বললেই বোঝা যেত না। তিনি কায়স্থ, না ব্রাহ্মণ; ব্রাহ্মণ হলে সে কোন রকমের ব্রাহ্মণ! না বৈশ্য না শুদ্র? পাকিস্তানের জন্ম-মুহূর্তে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়েছিল, সেখানে সব হিন্দুকেই একসূত্রে দেখা হয়েছিল, এই সূত্রে, হিন্দুরাও নিজেদের এক ভাবতে শুরু করেছিল। ওই পাকিস্তানের এক ধাক্কাতেই, সেই সময় হিন্দু মহাসভা কিছু কাজ করেছিল। হিন্দু মহাসভা একটি প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সময় হিন্দু মহাসভা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সবাইকে একত্র করে পূজা-অর্চনা করেছে, এটা আগে ছিল না, এটা পাকিস্তানের ধাক্কায় এসেছে। এইভাবে হিন্দু মহাসভার মতো একটা প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন, কিছু প্রগতিশীল কাজ করেছে।

তারপর আবার পাকিস্তান আন্দোলন একভাবে আমাদের মধ্যে হিন্দুত্বকে নিয়ে এসেছে, আবার যখন পাকিস্তান ভাঙে, তখন প্রকৃত প্রস্তাবে হিন্দু মুসলমানদের ভেদাভেদ অনেক ক্ষেত্রে দূর হয়ে গিয়ে, আমরা সবাই যে বাঙালি, তা প্রচণ্ডভাবে উপলব্ধি করতে দেখা গেছে। তো, আমার এ বইয়ের মধ্যে অনেক কথাই আছে, যেমন ধুতি লুঙ্গি দ্বন্দ্ব-সমাস। ধুতি ছিল হিন্দুদের আর লুঙ্গি হলো মুসলমানের পোশাক। পাকিস্তান যখন ভাঙে এবং সংগ্রাম হয় তখন সবাই এক হয়ে গেল। মানে মুসলমানদের বাড়িতে অনেক হিন্দু আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। আগে এটা কখনোই সম্ভব ছিল না। এই অবস্থায় স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের অনেক উত্তরণ ঘটেছে। সেখানে আমরা হিন্দু-মুসলমান যে বাঙালিতে পরিণত হয়েছি। ব্রাহ্মণ্যবাদ বলতে গেলে এখন আর কিছুই নেই, ব্রাহ্মণরা এসে হিন্দুদের বাড়িতে পূজা করেছে। তাদের কথায় চলার মতো আর কিছুই নাই।

বকুল: লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান এই স্লোগানের মাধ্যমেই কি বিভেদ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল?

সরকার: ১৯৪৭ সালের দ্বিজাতিতত্ত্বের যে প্রভাব, তা প্রচণ্ডভাবে দেখা দিয়েছে। এর আগে পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য বলা বাহুল্যই ছিল। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানে মারামারি-কাটাকাটি, আমি যে এলাকায় বসবাস করেছি, সেখানে অন্তত ঘটে নাই। এমনকি ১৯৪৬ সালেও এ ঘটনা ঘটে নাই। কিন্তু এই সব কেলেঙ্কারিতে পাকিস্তানের এক ধারা এখানে চলে এসেছিল। দেখা গেল আমার মতো অল্প বয়সী ছেলেরাও কেলেঙ্কারিতে পাকিস্তান বলা শুরু করেছিল। তখন হিন্দুদের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল, সেটা আমি চোখের সামনে দেখেছি।

বকুল: আপনার বর্ণনা অনুযায়ী সাপ্তাহিক মোহাম্মদী আর আনন্দবাজার পত্রিকা কি সাম্প্রদায়িক?

সরকার: সাপ্তাহিক মোহাম্মদী একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের কথা বলত, মূলত পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলত। তবে এই কথাকে সেই অর্থে সাম্প্রদায়িক বলাই যায়। আনন্দবাজারকে যে প্রকৃত প্রস্তাবে অসাম্প্রদায়িক বলব, তা-ও বলতে পারি না। কিন্তু মোহাম্মদীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে হিন্দুদের ঝুল টানত এ অবস্থাতে দ্বিজাতিতত্ব জোরদার হয়ে উঠেছিল বলে আমি মনে করি।

বকুল: কবি ইউনুস আলীর সেই সময়কার অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও পরিচয় সম্পর্কে কিছু বলেন।

সরকার: একটা ব্যাপার হচ্ছে ওই বইতে আমি যে সময়ের কথা বলেছি, পাকিস্তান তখনো হয়ে ওঠেনি। ৪৬ সালের শেষ ৪৭ সালের গোড়ায় আমি আমার মামার বাড়িতে থাকতাম পরুলতলা গ্রামে। তো ওইখানে আমি আমার বইয়ের মধ্যে লিখেছি, পাকিস্তান হচ্ছে এবং হিন্দুরা এই দেশে থাকতে পারবে না। হিন্দুদের মালাউন নামে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, এই সমস্ত কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। তবে ওই এলাকাতে কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে এমন কোনো খবর আমার কাছে নেই। কিন্তু একটা দাঙ্গা-দাঙ্গা ভাবওই জিনিসটা ওখানে বজায় ছিল। এই পাকিস্তান হবে, পাকিস্তানে হিন্দুরা থাকতে পারবে না। এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে । ওই সময় আমার মামার বাড়িতে যাঁরা জড়ো হতেন, তাঁরা এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। ওই সময় আমার অল্প বয়স থাকা সত্ত্বেও সেই সকল বিষয় যে আমাকে প্রভাবিত করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমিও ভাবছিলাম, এই দেশে থাকা যাবে না। পাকিস্তান মুসলমানের রাষ্ট্র হবে। সেই সময়েই একদিন মুক্তাগাছার গাবতলী বাজারে কবিতা শুনলাম। তখনকার দিনের মতো আজকের দিনে এই ধরনের কোনো কবিতা আছে কি না, আমার জানা নেই। ওই আট পৃষ্ঠার কাগজের মধ্যে লেখা ছিল, শুনেন ভাই বলে যাইপ্রথমবারের কথাটি দ্বিতীয়বার আবার  আবৃত্তি করা হতো। গাবতলী বাজার থেকে সেই সকল কবিতা গ্রামে গ্রামে বিক্রি করা হতো। সেই সময় গাবতলী বাজারে গিয়ে দেখলাম, একটা লোক মুখের ভেতরে চোঙ লাগিয়ে কবিতা বলছে। মানুষ জড়ো হয়ে তার কবিতা শুনছে, আর কেনার জন্য উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। দাম সম্ভবত ১ আনা। সকলেই সেখান থেকে কবিতা কিনল এবং আমিও সেখান থেকে একটা কবিতার বই কিনলাম। সেখানে কবিতার মধ্যে তিনি উল্লেখ করেছিলেন

ঢাকায় রাজধানী হবে, উন্নতি হবে বাংলাদেশের ভাই, 
হিন্দু মুসলিম মিলে মিশে থাকতে যেন পাই

এই বিষয়টা ইউনুছ আলীর মুখ দিয়ে বের হয়েছিল বটে। প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের গ্রামীণ জনগণ, প্রাকৃতজন যারা, তারা এই ভাবনায়ই ভাবিত। ওপর থেকে এখানে সাম্প্রদায়িকতা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে এ দেশের প্রাকৃতজন যারা, তারা কখনোই সাম্প্রদায়িক ছিল না। ইউনুছ আলীর মতো কবি সেখান থেকেই বেরিয়ে এসেছিল। পাকিস্তান হওয়ার জন্য যে হিন্দুরা ভয় পেয়ে যাচ্ছে। সেই জন্যই তিনি তাঁর কবিতায় বলেছিলেন, ঢাকায় রাজধানী হবে উন্নতি হবে বাংলাদেশের ভাই, হিন্দু মুসলিম মিলে মিশে থাকতে যেন পাই। কথাটা মনে রাখতে হবে সেখানে তিনি বাংলাদেশ লিখেছিলেন। সেই  সাতচল্লিশের গোড়ার দিকের কথা, তখনো পাকিস্তান হয়ে ওঠেনি। তখনো ব্রিটিশ শাসন চলছিল, কিন্তু জানা ছিল পাকিস্তান হয়েই যাবে। কিন্তু ওই অবস্থাতেও তিনি বাংলাদেশের কথাই বলেছেন। বইটিতে তিনি আরও অসাম্প্রদায়িক কবিতা লিখেছেন, দেখ ফজর আলী ঠাকুর দাসের এক উঠাইন্না বাড়ী। ফজর আলী মুসলমান আর ঠাকুরদাস হিন্দু, থাকা সত্ত্বেও ঈদে ও পূজায় একে অপরের উৎসবে অংশগ্রহণ করত। এইভাবে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রাকৃতজনের মধ্যে বিরাজিত ছিল বলে আমি বিশ্বাস করি। তাহলে পাকিস্তান হোক আর যা-ই হোক, আমরা একসাথেই থাকব। ইউনুছ আলীর কবিতা পড়ে আমার মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিস্তার লাভ করল।  আমার দার্শনিক চিন্তার বিস্তার লাভ করল।  

বকুল: আপনি জসীমউদ্‌দীনকে পল্লীকবি বলতে নারাজ, তার ব্যাখ্যাও আপনি দিয়েছেন, কিন্তু রাষ্ট্র তো এখনো সেই খেতাব/উপাধি বজায় রেখেছে। সে ক্ষেত্রে আপনি কী বলবেন?

সরকার: রাষ্ট্র বজায় রাখছে না তো! কিন্তু বিভিন্ন সাহিত্য সমাজে এই কথাটা চালু আছে। জসীমউদ্‌দীন যে পল্লীকবি, একেবারে মিথ্যা কথা তো নয়, আমি তো মিথ্যা কথা বলি না। পল্লীকবি বলতে আসলে যাঁদেরকে বোঝা যায়, সেই অর্থে জসীমউদ্‌দীন পল্লীকবি নন।

যতীন সরকার: ছবি © অর্ণব দাস

বকুল: মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস হিসেবে আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত, আহমদ ছফার ওঙ্কার অলাতচক্র, আল মাহমুদের উপমহাদেশ, সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়এগুলো নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী? 

সরকার: এতগুলোর সম্পর্কে আমি মূল্যায়ন করব না। আমাদের দেশের সাহিত্যিকেরা সকলেই যে নিজেদের বিক্রি করে দেননি, এ বইগুলোর মধ্যে তা বিবৃত হয়ে আছে। এর মধ্য দিয়াই সাহিত্যিকদের যে আদর্শ, সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই ধরনের সাহিত্যিকেরা জীবিত থাকবে। অন্যেরা যারা এর বিরোধিতা করে, তারা জীবিত থাকবে না। আহমদ ছফার ওঙ্কার একবার শুধু চোখ বুলিয়েছিলাম, এটা ভালো করে পড়ি নাই।  সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় আমি পড়েছি। আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত উপন্যাসকে আমি একটি অসাধারণ গ্রন্থ বলি। আল মাহমুদের উপমহাদেশ বইটি ভালো বই, অসাধারণ না। কিন্তু রাইফেল রোটি আওরাতকে আমি অসাধারণ বলি এই কারণে যে, তখনো পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটে নাই, তিনি পালিয়ে পালিয়ে এই বইটি লেখেছিলেন। আনোয়ার পাশার এই বইটি আমি অত্যন্ত মূল্যবান বই বলে মনে করি।

বকুল: আপনার সমকাল সম্পর্কে জানতে চাই, আহমদ ছফার দ্রোহী চেতনার সাথে আপনার ব্যক্তিগত সংস্রব ছিল কি? তাঁর সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই?

সরকার: আহমদ ছফার সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। পরিচয় পর্যন্তই, মাঝে মাঝে কথাবার্তা হয়েছে। তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক যে খুব একটা ভালো ছিল তা না, তার সাথে অনেক বিষয়েই আমার দ্বিমত হয়েছে। তার অনেক কথাই আমি মানতে পারি নাই, সেটা নতুন করে বলার কিছু নাই। বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পর্কে তিনি যে সমস্ত লেখা লিখেছেন, তা আমার মতের সঙ্গে মিলে নাই। ফলে উনার সম্পর্কে আর কিছু বলতে চাই না।

বকুল: বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান তাঁর একটি বইতে বলেছেন, অধ্যাপক সরকার আমাদের কালের এক তুখোড় পণ্ডিত, তীক্ষ্ণ মেধা ও উদ্ভাবনী সৃজনীশক্তির অধিকারী লেখক ও চিন্তাবিদ এবং আকর্ষণীয় বক্তা। আমার বিবেচনায় আমাদের প্রজন্মের তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তক ও সমাজ-সংস্কৃতি ভাষ্যকার। এটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

সরকার: শামসুজ্জামান খান আমার বিশিষ্ট বন্ধু। তিনি যখন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, সেই সময়ই তাঁর সাথে আমার পরিচয়। অনেক বছর আমরা একত্রে কাটিয়েছি। আমাদের পারিবারিকভাবেও একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তারপর তিনি ঢাকায় চলে গেলেন, বাংলা একাডেমিতে কাজ করলেন, বিভিন্ন জায়গায় কাজ করলেন। তাঁর সাথে আমার অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি আমার সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছেন, সেটি বন্ধুর প্রতি বন্ধুকৃত্য বলে মনে করি। কাজেই আমি সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে যাব না।

বকুল: মার্ক্সবাদ আর সাম্যবাদের মধ্যে সাযুজ্য আছে কি? একজন মার্ক্সবাদী লেখক এবং চিন্তক হিসেবে আপনি কী মনে করেন, বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যের কোনো রেনেসাঁস ঘটবে ভবিষ্যতে? 

সরকার: আমি হচ্ছি একজন অশোধনীয়ভাবে আশাবাদী মানুষ, কোনো কিছু দিয়েই এটাকে সংশোধন করা যাবে না। আমি তো মনে করি মার্ক্সবাদ আর সাম্যবাদের মধ্যে যে কথাগুলো আছে, সেই কথাগুলো হছে বৈজ্ঞানিক। বিজ্ঞানসম্মত কথা। ডায়ালেকটিক্যাল ম্যাটেরালিজম হচ্ছে আমার জীবনদর্শন। সেই ডায়ালেকটিক্যাল ম্যাটেরিয়ালিজম জীবনদর্শন আমাকে বলে, পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রের একটা বিপর্যয় ঘটেছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই কিন্তু ডায়ালেকটিক্যাল ম্যাটেরিয়ালিজম আমাকে জানায়, পৃথিবী সব সময় সামনের দিকে যায়, সেটা সামনের দিকে যেতে গিয়ে সোজাসুজি চলে না, এটা ঘোরানো সিঁড়ির মতো আছে। আমি এটাকে উপমা দিই আমাদের নেত্রকোনার মগড়া নদী দিয়ে। আপনি লক্ষ করবেন, নেত্রকোনা থেকে মদনপুর দূরত্ব মাত্র ৬ মাইল, কিন্তু  মানুষজনকে মদনপুর যেতে হলে তিনবার মগড়া নদী পার হতে হয়। এর মানে এই নয় যে, নদী এমনভাবে ঘুরে যায় মনে হয় সে যেন পেছন দিকে ফিরে যাচ্ছে। যেমনমনে হতে পারে  মগড়া নদীটি তার উৎসস্থলের দিকে ফিরে এসেছে, সে তো তার উৎসস্থলের দিকে ফিরে যায়নি, বারবার  ঘুরপাক খেয়েও সে কিন্তু তার লক্ষ্যস্থল সাগরেই পৌঁছেছে। কাজেই আমাদের লক্ষ্যস্থল যে সাম্যবাদী জীবনব্যবস্থা, সেটা হবেই কিন্তু এর আগের যে জীবন ব্যবস্থা, সেটা এ রকমভাবে পাক খেতে থাকবে। সেটা ভুলপথে পাক খেতে থাকা একটা অবস্থা বলে আমি মনে করি।

বকুল: সরদার ফজলুল করিম সম্পর্কে জানতে চাই?

সরকার: আমি সরদার ফজলুল করিমের স্নেহধন্য হতে পেরেছিলাম বলে নিজেকে ধন্য মনে করি। আমি তাঁকে সরদার ভাই বলে ডাকতাম, আমি তাঁকে তুমি বলতে বলতাম, কিন্তু তিনি আমাকে আপনিই ডাকতেন। আমি সরদার ফজলুল করিমকে জিজ্ঞাসা করতাম, সরদার ভাই, কেমন আছেন? উনি বলতেন, বাদ দেন, বাদ দেন। বলেন, কেন আছি? কথাটা প্রথমে বুঝতে পারি নাই, কেমনের বাদ দিলে কেন থাকে অর্থাৎ বলেন কেন আছি? আমার যা করার ছিল, যা করা উচিত ছিল, তার কোনোটাই আমি করতে পারিনি। সুতরাং কেন আছি, তা কি বলতে পারি না? অসাধারণ কথা। এবং সরদার ফজলুল করিম আমাকে যে কীভাবে ভালোবাসতেন... আমার মনে আছে আমি তো কমিউনিস্ট পার্টি করতাম, কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও হয়েছিলাম। তবে আমি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হতে চাইনি। কমিউনিস্ট পার্টি যখন ভেঙে গেল, অর্থাৎ বেশসংখ্যক সদস্য রয়ে গেল আর বিরাটসংখ্যক লোক দল ছেড়ে চলে গেল, অন্য দলগুলোতে। কমিউনিস্ট পার্টির লোকজন অন্য পার্টিতে গেল। তবে কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণগঠনে সরদার ফজলুল করিমের অবদান ছিল অসামান্য।

বকুল: পার্টি ভেঙে এনারা কি আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে গেলেন? 

সরকার: শুধু আওয়ামী লীগ-বিএনপিতেই গেল না, আরও আরও খারাপ জায়গায়ও গেল। আওয়ামী লীগে যাওয়া মানুষজনের মধ্যে নূহ-উল-আলম লেনিন ডায়ালেকটিসের বিরুদ্ধে ছোট্ট একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যে ডায়ালেকটিকস ভুল। তিনি সারা জীবন কমিউনিস্ট পার্টি কইরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইছিলেন যে, এটা আমি কোনোমতেই মানতে পারি নাই। তারপর অনেক পরে ঢাকায় আমার বোনের বাসায় তিনি নিজে ইচ্ছা করে আমার সাথে দেখা করেছিলেন। আমি বলেছিলাম, আপনি তো বলেছিলেন, আপনার ডায়ালেকটিকস ভুল? তিনি হাতজোড় করে বলেছিলেন, যতীনদা, এই প্রশ্ন আমাকে আর করবেন না। আবার একজন প্রাক্তন কমিউনিস্ট বলেন, আমরা এখন যে অবস্থায় আছি, শোনেন আমি বলি, আমরা কমিউনিস্ট পার্টি ছাইড়া দিলে কী হবে, আমরা যে কয়জন আওয়ামী লীগে গেছি, তাদেরকে তারা কমিউনিস্ট বলেই আখ্যায়িত করেন। আমরা রাস্তায় যখন বেরিয়ে এসেছি একজন আরেকজনের সাথে দেখা হইছে, তখন একজন আরেকজনকে বলে, এই যে দেখো কমিউনিস্ট তিনজন এক হইছে!

বকুল: সরদার ফজলুল করিমের আরও সখ্যর কথা বলেন।

সরকার: সরদার ফজলুল করিমের সাথে আরও আরও ঘটনা আছে, যেমন আগেও বহুবার আমাকে সেন্ট্রাল কমিটির মেম্বার হতে বলেছিলেন, আমি হইনি। সেদিন, কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য অধিবেশনে বসে ছিলাম। একজন পার্টির সদস্য এসে বলল, সরদার ভাই আপনাকে খুঁজছে। এই সময় সরদার ফজলুল করিম হঠাৎ এসে আমার ডান হাতটি ধরে বললেন, যতীন, আমি আপনাকে একটা আদেশ করছি, আপনাকে সেন্ট্রাল কমিটির মেম্বার হতে হবে। আমি বললাম, আপনার আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা আমার নাই।

বকুল: উনার গুরুত্বপূর্ণ রচনা দি কনফেশানস, আমি রুশো বলছি সম্পর্কে বলুন?  সরদার ফজলুল করিমের কোন কর্মকে আপনি শ্রেষ্ঠ মনে করেন? 

সরকার: সরদার ফজলুল করিমের সকল কর্মকেই আমি শ্রেষ্ঠ মনে করি। সরদার ফজলুল করিম যখন রাজনীতি ছেড়ে দিলেন, তারপরে তিনি বাংলা একাডেমিতে চাকরি নিয়েছিলেন। তিনি সেখানেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন, এমনকি সুকান্তজয়ন্তী পর্যন্তও করেছিলেন। তিনি এই সমস্ত কাজ বাংলা একাডেমি থেকে করেছিলেন। উনি বাংলা একাডেমিতে চাকরি করা অবস্থাতেই আমি একটা পুরস্কার পাই। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের ওপর প্রবন্ধ লিখে ডা. এনামুল হক স্বর্ণপদক পাই। সরদার ভাইয়ের সাথে পরিচয় কিন্তু আমার সেই সূত্রেই। তিনি পারিবারিক কারণে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু আমাদের সাথে তার কথাবার্তায় ও লেখালেখিতেও, ডায়ালেকটিকস অর্থাৎ মার্ক্সবাদ ফুটে উঠত। তিনি তাঁর আদর্শ থেকে কখনোই বিচ্যুত হননি।

বকুল: অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককেন্দ্রিক ষাটের দশকে বুদ্ধিজীবী সমাজ গড়ে উঠেছিল? কিন্তু এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেন এমন দেখা যায় না বলে আপনি মনে করেন?

সরকার: এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া খুব কঠিন। কঠিন হবে এই কারণে যে, বর্তমানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে খাত, সেটি হচ্ছে শিক্ষা খাত। করোনা পরিস্থিতির কারণে তো হয়েছেই, এ ছাড়া নানাভাবে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি জানি, এখানে যারা ক্ষমতাসীন, তারা এমনভাবে এই শিক্ষা খাতকে অধীনস্থ করে ফেলেছে। নিজেদের চিন্তাচেতনার দ্বারা এমনভাবে তল্পিবাহক বানিয়ে ফেলেছে, এই সম্পর্কে বেশি কথা না বলাই ভালো। এই অবস্থাতে সত্যিকারের বুদ্ধিজীবী সমাজ বেরিয়ে আসা সত্যি কঠিন, সেটার সম্ভাবনাও নেই। তবে আমি আবারও বলি, আমি অসংশোধনীয়ভাবে যে আশাবাদী, এর মধ্যেও কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা আছেন, সংখ্যায় তাঁরা কম হতে পারেন, এবং দেখা যায় না তাঁদের। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে যেসব ছোটখাটো লেখক আছেন, তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে আমি বুঝতে পারি, বুদ্ধিজীবীদের একটা সমাজ বেরিয়ে আসবে। হয়তো সেটা দেরি হবে, কিন্তু আসতে বাধ্য। অবশ্য এখন নাই, এখন খুবই খারাপ অবস্থা। তবে আমি বিশ্বাস করি, অতীতের চেয়ে নিশ্চয়ই ভালো হবে ভবিষ্যৎ এটা কিন্তু ইসলামের কথা। ভবিষ্যতে সেই বুদ্ধিজীবীদের অভ্যুদয় ঘটবেই।

বকুল: আব্দুর রাজ্জাকের চিন্তাভাবনার কোন দিকটি আপনার ভালো লাগে?

সরকার: আমার সাথে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের আলাপ আলোচনা হয় নাই। উনার সম্পর্কে আমি আহমদ ছফার একটি বই, যদ্যপি আমার গুরু পড়ে জেনেছি। বইটি আহমদ ছফার একটি অসাধারণ গ্রন্থ। সত্যিকারের জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক। আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে অনেক কথা সরদার ফজলুল করিমও লিখেছেন। আব্দুর রাজ্জাক হচ্ছেন এই রকম একজন জ্ঞানতাপস, প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁর কোনো বই নাই। তাঁর কাছে মানুষ বারবার যেতেন, তিনি কথার মাধ্যমেই নিজেরে প্রকাশ করেছেন। এবং অসাধারণ মানুষ, তাঁর কাছে গেলে যে কত কিছু পাওয়া যেত, সেটা বিস্ময়কর। আমি তাঁকে দেখেছি মাত্র, কিন্তু আলাপ পরিচয় হয় নাই। আহমদ ছফা আর সরদার ফজলুল করিমের লেখা পড়ে আব্দুর রাজ্জাকের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মস্তক অবনত করি।

বকুল:  বাংলাদেশের বর্তমান প্রবন্ধ সাহিত্যে, সমালোচনামূলক অসংখ্য পাঠক থাকা সত্ত্বেও একে ইগনোর করা হয় বহুলাংশে। প্রকাশনাশিল্প আদৌ কি শিল্প হয়ে উঠেছে? 

সরকার: প্রকাশনাশিল্প যথার্থ অর্থে শিল্প হয়ে ওঠেনি। যদি হয়ে উঠত, তাহলে একজন লেখক সার্বক্ষণিক লেখক হয়ে উঠতে পারত। আপনি প্রবন্ধ সাহিত্যের কথা প্রশ্ন করেছেন, বাংলা একাডেমিতে যে বইমেলা হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয় কবিতার বই। কিন্তু এই যে কবিতার বই বের হয়, তার ৯৮% বের হয় নিজের পয়সায়। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহার মতো কিছু কবি নিজের পয়সায় বই বের করেন না। তাঁরা নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত, ফলে তাঁদেরকে নিজের পয়সায় বই বের করতে হয় না। আর অধিকাংশ কবির সম্পর্কে সুকুমার বড়ুয়ার একটি ছড়া আমি বলি

এক কবিতে কাব্য লেখেন,
আরেক কবি বুঝেন,
বাদবাকিরা খাটিয়ে মাথা মর্মবাণী খুঁজেন,
মর্মবাণী খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ যদি হন, 
কবি বলেন, কাব্য বোঝার যোগ্য সবাই নন
 

সুকুমার বড়ুয়াকে এই কবিতার জন্য আমি অজস্র ধন্যবাদ জানাই। কবিতার বই সবচেয়ে বেশি বের হয়, সবচেয়ে কম বিক্রি হয়। পরস্পরের মধ্যে, একজন কবি আরেকজন কবিকে আদান-প্রদান করেন, এটাকে আমি বলি পারস্পরিক পৃষ্ঠপুন্ডয়ন  সমিতি। পাপড়িকস। আমি কবিদের সম্পর্কে আরও দু-একটা কথা বলি। বিপিন পাল, একজন বিপ্লবী, সত্যের বচন বলে তাঁর একটা আত্মজীবনী আছে, সেখানে তিনি লিখেছেন, ১৮ বছরের আগে যে কবিতা লেখে না সে মানুষই নন, আর ১৮ বছর পর যে কবিতা লেখেন, সে না হয় পাগল, না হয় কবি। বিপিন পালের এই কথা স্মরণে রাখা যায়। বের হয় বেশি কবিতার বই কিন্তু বিক্রি হয় বেশি উপন্যাস। তারপরেই দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে প্রবন্ধ ও গবেষণা। সংখ্যায় কম হলেও বিক্রি হয় বেশি উপন্যাস, কিন্তু সেই তুলনায় গল্প বিক্রি হয় না। গল্প পড়ার ক্ষেত্রে যে শেষ হইয়াও হইলো না শেষ, এটা পাঠক মেনে নিতে রাজি না। পাঠক শেষ দেখতে চায়, এই শেষ দেখার জন্যই উপন্যাস পড়ে।

যতীন সরকারের সঙ্গে শাখাওয়াত বকুল: ছবি © অর্ণব দাস

বকুল: সত্যেন সেনের সাহিত্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? কিংবা রণেশ দাশগুপ্তর কাজকে আপনি কীভাবে বিচার করবেন?

সরকার: আমি সত্যেন সেনের আগে রণেশ দাশগুপ্ত সম্পর্কে বলব। আমি নিজে রণেশ দাশগুপ্তর অত্যন্ত অনুরাগী। এবং রণেশদার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিতে গিয়েছি, সভা করতে গিয়েছি। ময়মনসিংহে রণেশদা এলে আমার বাসায়ই উঠতেন, এবং সেটা পাকিস্তান আমলে। সেই রণেশদার সাথে আমার যে সম্পর্ক, সেটা অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক। সেই পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সালে লেনিন জন্মশতবার্ষিকী যখন হয়, আমি তখন রণেশদার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে লেনিন শতবার্ষিকীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়েছি। এখানে একটি ছবি আছে, যেখানে আমি জামালপুর টাউন হলে একটি বক্তৃতা দিচ্ছিলাম। ছবিতে এখানে প্রথম যে মানুষটি দেখতে পাচ্ছেন, ইনি ইমামুর রশিদ, দ্বিতীয় মানুষটিকে আমি চিনতে পারছি না, তারপরে যে মানুষটিকে দেখতে পাচ্ছেন ইনি বজলুর রহমান [মতিয়া চৌধুরীর হাজবেন্ড], তারপরে যে মানুষটিকে দেখতে পাচ্ছেন, তিনি নাসির সরকার। নাসির সরকারের মতো জাতীয়তাবাদী মুসলমান প্রকাশ্যে আমি আর দেখি নাই। আব্দুর সাত্তার আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু ছিলেন। রণেশ দাশগুপ্তের উপন্যাসের শিল্পরূপ বইটি পড়ে আমি নিজেকে নতুনভাবে প্রস্তুত করি, মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে উপন্যাসকে দেখার। উপন্যাস সম্বন্ধে আমি প্রবন্ধ লেখেছি, উপন্যাসকে আমি দেখেছি, সেই উপন্যাসকে দেখা দৃষ্টিভঙ্গিটি আমি অর্জন করেছি রণেশ দাশগুপ্তর কাছ থেকে। তাঁর কাছ থেকেই আমি ক্রিস্টোফার কর্ডওয়েলের ইল্যুশন অ্যান্ড রিয়েলিটি, রাল্ফ ফক্সের দ্য নভেল অ্যান্ড দ্য পিপলস্‌ পেয়েছি। বই দুটো আমি ভালোভাবে মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। এই দুটি বই পড়ে আমার উপন্যাস সম্পর্কে যে ধারণা পুষ্ট হয়েছে, সেটাই রণেশদার কাছ থেকেই আমি পেয়েছি।

সত্যেন সেন পাকিস্তান আমলে ময়মনসিংহে আমার বাসায় এসে থাকতেন। রণেশদাও যেমন থাকতেন, সত্যেনদাও থাকতেন। সত্যেনদাকে সবাই ভয় পেত; কারণ, ওই কমিউনিস্ট। সত্যেনদা শেষ জীবনে অন্ধই প্রায় হয়ে গিয়েছিলেন এবং ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিলেন। তিনি যে চোখে দেখেন না, এটা তিনি স্বীকার করতেন না। বলতেন, আমি তো চলছি, চলতে পারছি। তিনি বলতেন, আমার উপকার করেছে সেই মানুষটি বেশি, যে দেশের ওপর সবচেয়ে বেশি অত্যাচার করেছে। সেই মানুষটার নাম আইয়ুব খান। আইয়ুব খানের শাসনামলে আমি ৬ বছর জেলখানায় ছিলাম, আমি যদি ৬ বছর জেলখানায় না থাকতাম, তাহলে আমার এই উপন্যাসগুলো লেখা হতো না।

অদ্ভুত সব উপন্যাস, সত্যেন সেনের উপন্যাস নিয়ে আমার দীর্ঘ আলোচনা আছে। আমার একটি বই আছে যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে ও বাংলাদেশের উপন্যাস। মার্ক্সবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ যদি উপন্যাস লিখে থাকেন, তাহলে সেটা সত্যেন সেন লিখেছিলেন। এই রকম লেখা এর আগেও কেউ লেখেননি এবং পরেও আমার চোখে পড়ে নাই।

বকুল: ইউরোপে সিভিল সোসাইটি বলতে বোঝাত জাতীয় সমাজ। কিন্তু বাংলাদেশে এটার অর্থ দাঁড়িয়েছে সুশীল সমাজ! কেন কথিত সুশীল সমাজ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে জাতীয় চরিত্র দাঁড় করাতে পারেনি?

সরকার: খুব কঠিন প্রশ্ন! কঠিন প্রশ্ন এই কারণে যে, আমাদের যে বুদ্ধিজীবীরা, তাঁরা প্রকৃত প্রস্তাবে সংগঠন গড়ে তুলতে পারেননি। বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী যে বিভিন্নভাবে চিন্তা করেন। সেই বুদ্ধিজীবীরা যদি পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করেন, পরস্পরের মনোভাবটি জানতেন, পরস্পর যদি একই সাথে বসতেন, তাহলে একটা বুদ্ধিজীবী সমাজ গড়ে উঠত, তার মধ্যে মেলা বৈচিত্র্য ঘটত। তাঁরা যে বুদ্ধিজীবী, এটা প্রচারিত হতো কিন্তু এই জিনিসটা আমাদের দেশে হয় নাই। ইউরোপে সেই রকমের বুদ্ধিজীবী আছে, এর ঐতিহাসিক কারণও আছে। ঐতিহাসিকভাবে গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠেনি। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা আসছে মূলত মধ্যবিত্তের একটা শ্রেণি থেকে। তার মধ্যে দুঃশীল, দুর্জন এই রকমের বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা অনেক বেশি। তারা নানা রকমভাবে এস্টাবলিশমেন্টের সাথে নিজেকে যুক্ত করে, কিছু সুবিধা-সুযোগ গ্রহণ করতে চায়। এর বাইরের যে বুদ্ধিজীবীরা আছেন, তারা আসলে অপাঙ্‌ক্তেয় হয়েই আছেন। তাদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। এ জন্যই এখানে জাতীয় চরিত্র দাঁড়াতে পারেনি। এস্টাবলিশমেন্টের বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁরা বলেন। যেমনসলিমুল্লাহ খানরাও বলেন, তাঁরা তাদের মতো করে বলেন। এস্টাবলিশমেন্টের বাইরে অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট যে একটা দর্শন, সেটা তাঁরা গ্রহণ করতে পারেননি। বরং দর্শনের ভুল চিন্তাগুলো তারা অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছেন। ফরহাদ মজহার এখন নাই বললেই চলে এইটা আপনি লিখতেও পারেন আবার না-ও লিখতে পারেন।

বকুল: সংস্কৃতির রূপান্তর বলতে আপনি কী বোঝেন? বাংলাদেশে আদৌ কি সংস্কৃতির রূপান্তর হচ্ছে?

সরকার: সবকিছুর রূপান্তর ঘটে, প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে, তবে সেটা কখনো বিস্তৃতভাবে ঘটে আবার কোনো সময় অন্যভাবে রূপান্তর ঘটে। তবে ডায়ালেকটিকসকে একথা বলা হয়, পরিমাণমতো রূপান্তর ও গুণগত রূপান্তর। পরিমাণমতো রূপান্তর যেভাবে ঘটে, তা চোখের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু গুণগত রূপান্তর তা চোখের মধ্যে পড়ে। পরিমাণগত রূপান্তর আমরা যেভাবে বোঝাই, এই দুই হাত দিয়ে নাড়িয়ে আসলে রূপান্তর ঘটে জন্মের মধ্য দিয়ে। আমরা এমনভাবে বোঝাই যে ডান হাতটা বাম দিকে আসতেছে, বাম হাতটা ডান দিকে আসতেছে। এই পরিবর্তন হচ্ছে এটা আসলে পরিমাণগত রূপান্তর। পরিমাণগত রূপান্তর হইতে হইতে যখন গুণগত পরিবর্তন হয়, তখন নতুনের সৃষ্টি হয়। কাজেই আমাদের সমাজের যে পরিবর্তনটা, তা পরিমাণগত রূপান্তরই, গুণগত রূপান্তর বলা চলে না। তবে পরিমাণগত পরিবর্তন যেহেতু হচ্ছে, এটা প্রতিনিয়ত চলতে চলতে গুণগত রূপান্তর হবেই। যেহেতু আমি অসংশোধনীয়ভাবে আশাবাদী মানুষ, সেহেতু আমি মনে করি, গুণগত পরিবর্তন ঘটবেই। 

বকুল: আমাদের চিন্তা-চর্চায় বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট কোথায়? আপনার দীর্ঘদিনের চিন্তাচর্চার অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাখ্যা করবেন কি?

সরকার: এই প্রশ্নের জবাব তো আমি নানাভাবেই দিয়েছি, সুতরাং নতুন করে আর দেবার প্রয়োজন মনে করি না।

বকুল: আপনার প্রকাশিত বইগুলো থকে সেরা কর্ম কোনটি মনে করেন?

সরকার: আমার নিজের অভিমত হচ্ছে এই যে প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন বইটি আমার শ্রেষ্ঠ কর্ম বলে মনে করি। আমার নিজের অভিমত, সাধারণভাবে অনেকেই তা মনে করেন না। তবে কেউ কেউ আমাকে ফোন করে বলেন, প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন একটি অসাধারণ গ্রন্থ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমি নিজে এই বইটাকে মূল্যবান মনে করি। আপনি নিজে মূল্যবান শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আমি নিজেও এটিকে মূল্যবান গ্রন্থ মনে করি। আমি প্রাকৃতজনের মধ্য হতে বড় হয়ে উঠেছি, আমি নিজেও একজন প্রাকৃতজন। আমার অঞ্চলে বিখ্যাত কবি ছিলেন জালাল উদ্দিন খাঁ। জালাল উদ্দিন খাঁর অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলাম আমি। জালাল উদ্দিন খাঁর মৃত্যুর পরে একটা বই বেরিয়েছে, সেটির ভূমিকা আমি লিখেছি। এই জালাল উদ্দিন খাঁদের মধ্য থেকে প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন দেখেছি।

বকুল: আপনি স্বপ্ন দেখেন কি? আপনার স্বপ্নের জগৎ কেমন?

সরকার: আমার স্বপ্নের জগৎটা এমন যে, এই র্পযন্ত আপনি যতগুলো প্রশ্ন করেছেন, তার মধ্য দিয়ে এসেছি এবং আমার স্বপ্ন নয় এটা আমার বিশ্বাস। স্বপ্ন নানান রকম হয়, যেমনদিবাস্বপ্ন, যেটাকে আমি একটি গল্প বলে বোঝাতে চেষ্টা করব। একটা গল্প আছে একটু বলি, কাচের বাসন ইত্যাদি বিক্রি করে এমন একজন, সে একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছে, বিশ্রাম নিচ্ছে। আরও বাসন কিনব, সেই বাসন বিক্রি করব, আমি এই বাসনের ব্যবসা ছেড়ে দেব। তারপর বড় একটা বিজনেস করব। তখন আমি ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হয়ে যাব। তারপর আমি আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় লোক যে, তার মেয়েকে বিয়ে করব। বিয়ে করার পরে আমি আবার নতুন করে থাকব। আমার স্ত্রী এসে যখন বলবে, তুমি খেতে আসো, আমি তখন বলব নেহি খায়েংগা, সঙ্গে সঙ্গে তার সব কাচের বাসন ভেঙে যায়, এটাই হচ্ছে দিবাস্বপ্ন।

আমার স্বপ্নের জগৎ হচ্ছে বৈজ্ঞানিক স্বপ্ন, যেমনপদ্ধতির মধ্য দিয়ে আমি ডায়ালেকটিক বিশ্বাস করি। ডায়ালেকটিকে বলে, পৃথিবীতে পরিবর্তন আসবে বলে বর্তমানে সমাজতন্ত্রের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে কী এসেছে? এসেছে একটা তথাকথিত বিশ্বায়ন। বিশ্বায়ন মানে সাম্রাজ্যবাদের সর্বত্র বিস্তার। কিন্তু আমি দেখছি যে পরিমাণগত পরিবর্তন হচ্ছে ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট দখল করে। সাম্রাজ্যবাদের মধ্য থেকেই একশ্রেণির লোক বের হয়ে আসে ওয়ার্ল্ড স্ট্রিটে। এবং শতকরা ৯৯ ভাগের পড়ে এবং শতকরা ১ ভাগের বিরুদ্ধে এসব কথাবার্তা ধর্মতান্ত্রিক দেশের মধ্যে থেকে অতি অল্পসংখ্যক লোক বলেছে। এসব কথা কখন বলত? আগে এসব কথা বললে বলত সোভিয়েতের দালাল। এখন তো আর সোভিয়েত নাই। এবং এইখানের মধ্য থেকে যে পরিমাণগত একটা অবস্থান দাঁড়িয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সমাজের এই বর্তমান ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলার মতো একটি গুণগত পরিবর্তন দেখা দেবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এবং সেই বিশ্বাস উপমা আমার সত্য নয়, এটা আমার ডায়ালকেটকিসের কথা। 

বকুল: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, কম সময় দেবার কথা বলেও আপনি যথেষ্ট সময় দেওয়ার জন্য।

সরকার: তোমাকেও ধন্যবাদ।