তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, আর টোকাই আঁকবেন না!
কথোপকথন প্রসঙ্গে
বাংলাদেশের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী [রনবী] ভাইয়ের কাছে যাওয়া হয়েছিল ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে। এটা ২০০৮ সালের ঘটনা। দেশে তখন সেনা-ছত্রছায়ায় সুশীল শাসনের নয়া রূপ, রাজনীতিবিদরা কেউ জেলে, কেউ আত্মগোপনে, কেউবা মুখে এঁটেছেন কুলুপ। রাজনীতি সংস্কার, দুর্নীতি দমন, বেসামরিক প্রশাসনে সামরিক উপস্থিতির স্ফীতি—এ সবকিছুই যেন আমাদের নিকট ইতিহাসের দিকে মুখ ফেরাতে উদ্বুদ্ধ করে। চলমান অবরুদ্ধতা থেকে মুক্তির হদিস যেখানে স্পষ্ট। আমরা ভাবলাম, এখনই সময় সামরিক স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের বীর শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের। মূলত অগ্রজ সংগীতশিল্পী ও প্রযোজক হাসান আবিদুর রেজা জুয়েলের পরিকল্পনা এবং আমার পরিচালনায় কাজটি [ডক্যুফিল্ম: বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়] শুরু হলেও এতে গবেষক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বরেণ্য কবি সাখাওয়াত টিপু এবং সাংবাদিক মিল্টন আনোয়ার। আর পুরো প্রকল্পে সার্বিক সহযোগিতা করছিলেন অভিনেতা ইমতিয়াজ বর্ষণ। পাশাপাশি আরও অনেকের সাথে চারুকলাকেন্দ্রিক তরুণ শিল্পীদের একটি বড় দল এ কাজে যুক্ত হয়ে যান। যাঁদের মধ্যে শিল্পী জাফর ইকবাল জুয়েল, নাসিমুল খবির ডিউক এবং এস এম সাইফুল ইসলামের সক্রিয় অবদান উল্লেখযোগ্য। তবে, নামের এই তালিকা শুধু তরুণদের মধ্যে সীমিত ছিল না। ঐতিহাসিক ভূমিকার কারণেই প্রবীণ শিল্পীরাও এতে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েন। যার মধ্যে দেশের অন্যতম চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী আর শিশির ভট্টাচার্য্য। একদিন আমি এবং টিপু অকস্মাৎ প্রবেশ করি নবী ভাইয়ের চারুকলার দপ্তরে। কোনো পূর্বানুমতি ছাড়াই দপ্তরে আমাদের এমন অনুপ্রবেশ তাঁকে বিস্মিত করেছিল সেদিন! তিনি আমাদের উদ্দেশ্য এবং কাজের সাথে মুহূর্তের আলাপেই নৈকট্য বোধ করেন। কারণ হয়তো আমাদের নির্মাণের বিষয় স্বয়ং নূর হোসেন—যেন ইতিহাসের ফিরে দেখা মুখ, ন্যুব্জ আর লড়াকুদের মধ্যে তুলে দেওয়া দেয়াল, সমকাল আর ভবিষ্যতের সংযোগ সেতু।
সমকালীন ফরাসি দার্শনিক জাক রাঁচিয়েরই [Jacques Rancière] আমাদের সে সময় নূর হোসেনকে এক নতুন আঙ্গিকে দেখতে উদ্বুদ্ধ করেন। জাক রাঁচিয়ের বলেন, রাজনীতির যেমন একটি নিজস্ব নন্দনতত্ত্ব আছে, তেমনি নন্দনতত্ত্বেরও আছে একটি রাজনৈতিক রূপ। যেন একই তলেরই এপিঠ-ওপিঠ। আর এই তল বা পাটাতনই যেন নূর হোসেন স্বয়ং। তাঁর রাজনৈতিক উচ্চারণের প্রকাশ শৈল্পিক ভঙ্গিমায় আর শিল্পবোধের গোঁড়া যেন রাজনৈতিক অঙ্গীকারে। নূর হোসেনের বুক আর পিঠে আঁকা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান আর তাঁর স্বৈরাচারবিরোধী সম্মুখ মিছিলে জীবন দান আজও দীপ্যমান সাক্ষ্য। শিল্পের গণতান্ত্রিক রূপায়ণেও নূর হোসেন এক সমার্থক নাম। সুতরাং সমকালীন দর্শনের এই তত্ত্বই আমাদের নবী ভাইয়ের কাছ নিয়ে যায়। একজন প্রথিতযশা শিল্পী কীভাবে একজন সর্বহারা নূর হোসেনের শৈল্পিক বোধের স্বীকৃতি বা ব্যাখ্যা দেন, সেটা জানাবোঝার জন্যই মূলত এই সাক্ষাৎকার। আশির দশকে তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি ‘টোকাই’ চরিত্রকে ঘিরে সংগঠিত নানা রটনা, ঘটনা এবং বিশ্লেষণ দিয়ে আলাপের শুরু। আর এই আলাপচারিতায় শিল্পী রফিকুন নবীর শিল্পের রাজনৈতিক দায় এবং অঙ্গীকার পাঠকদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সত্যিকার অর্থে, বাংলাদেশের চিত্রকলার জগৎ ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে টোকাই চরিত্র এখন মিথ। কবি-সম্পাদক সাখাওয়াত টিপুকে ধন্যবাদ ১০ নভেম্বরকে সামনে রেখে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারটি তর্কবাংলায় প্রকাশের জন্য, যিনি নিজেই এই আলাপচারিতার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
—মঈনুল শাওন
রফিকুন নবী © ছবি: ঢাকা অপেরা
প্রশ্ন: আপনার টোকাইয়ের শুরুটা সত্তর দশকের শেষে। কিন্তু সেটা একটা সময় বড় জায়গায় চলে যায়। আশির দশকে সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় টোকাই কার্টুন। তৎকালীন যে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার একটা মুখপাত্র হয়ে যায় টোকাই। সমাজের নিচু স্তর থেকে সকল স্তরেরই প্রতিনিধিত্ব করে টোকাই। এর শুরুটা কীভাবে হয়?
রনবী: টোকাই, আমি টোকাইকে দিয়ে কাজটি করিয়েছি। আমাদের সমাজের নানা রকম যে অসঙ্গতি, রাজনৈতিক যে অসঙ্গতি, অর্থনৈতিক যে অসঙ্গতি, বৈষম্য ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই শ্রেণির যে ব্যাপারগুলো রয়েছে, সেসব নিয়ে মোটামুটিভাবে কাজ করেছি। এটা তো সত্যি, ওই রকম একটা বৈরী সময়ের মধ্যে তখন কিছু বলতে পারাটা তো কঠিন ছিল। তো আমি তখন ঠিক করেছিলাম যে, একটা ভিন্ন আঙ্গিকে কাজটা যদি করা যায়, তাহলে অনেক কথা আহ্লাদ করে প্রতিস্থাপন করা যাবে। আদুরে একটা চরিত্র যদি থাকে, তার মুখ দিয়ে সেটা বলানোটা কোনোভাবে ভারী কিছু তো মনে হবে না। ভারী কথা যদি সহজ করে বলতে পারা যায়—খুব সাধারণভাবে—খুব শিশুতোষ করে যদি রাখা যায়, তাহলে হয়তো কথাগুলো বলা হবে, মজাও হবে। পাঠকদের মধ্যে যাঁরা এই নিয়ে ভাবেন তাঁদের কাছে এটা পৌঁছাতে পারে। সেই কাজটা শুরু করেছিলাম, এবং হয়েও ছিল মোটামুটি। তবে এটাও ঠিক—যত করা উচিত ছিল, যতখানি করলে আরও ভালো হতো—আরও সলিড একটা দিকে যেতে পারত, ততখানি কিন্তু করা হয়নি। করা হয়নি কারণ, এটা খুব স্বাভাবিক যে আমাদের দেশে সবকিছু করা যায় না। এমনকি ভাবলেও করা যায় না। কারণ, এটা একটা পর্যায়ে গিয়ে চারদিক বিবেচনা করে একটা সেলফ সেন্সরশিপের মধ্যে চলে যেতে হয়। এটাও ঠিক যে সেদিকটাও আমাকে নজরে রাখতে হয়েছে। তবু আমি খুশি যে তার মধ্য দিয়ে অন্তত কিছু একটা হয়েছে।
প্রশ্ন: কিছু একটা যে হয়েছে তা বোঝা যায়। তৎকালীন যিনি সরকারপ্রধান বা অন্য ভাষায় বললে সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতায় ছিলেন, উনি কিন্তু টোকাইকে পিক করেছিলেন। টোকাইয়ের নাম বদলে দিতে চেষ্টা করেছিলেন। দেখাতে চেয়েছেন, সমাজে এমন শ্রেণিবৈষম্য ওভাবে নেই কিংবা থাকলেও সেটা ওই সরকার চেষ্টা করেছে নাম পাল্টে দিতে। তারা চমৎকার একটা নাম দিয়েছিল ‘পথকলি’। এই ব্যাপারটা নিশ্চয় আপনার মনে আছে...
রনবী: হ্যাঁ, মনে আছে, মনে থাকতেই হবে, কেননা ব্যাপারটা তো ঘটেছিল। আমার জন্য ওটার দুটো দিক আছে বলে আমি মনে করি। একটা হলো, দেশের প্রধান লক্ষ্য করলেন টোকাইয়ের যে তুমুল জনপ্রিয়তা জনগণের মধ্যে—যে গ্রহণযোগ্য একটা অবস্থা, সেটাকে পিক করা…। সেটা করলে যে—টোকাই সম্বন্ধে কিছু বললে নিশ্চয় একটা আমজনতার ব্যাপার, এটার একটা দিক আছে। তার জন্য জনসভায় [কোথায় যেন…] বলা হলো—টোকাইয়ের নাম উল্লেখ করে, আমার নাম উল্লেখ করে। আমি মনে করি, সেটা ছিল আমার জন্য একটা ভালো দিকই। কেননা যতখানি না মানুষ ভাবত, ওই ঘটনার পরে সাধারণ মানুষ আরও বেশি ভেবেছে টোকাইকে নিয়ে।
‘পথকলি’ নামে যেটা করেছিল, হয় কী যে টোকাইকে তো আমি ইতিবাচক চরিত্র হিসেবে নিয়েছি, ওর ভিতরে একটা ইতিবাচক রূপ আছে। এটা কিন্তু বানোয়াট কোনো চরিত্র না। আমাদের সামনেই কিন্তু সেটা রয়েছে। বলা যেতে পারে, এটা একটা শিল্প-অলংকরণ। চোখে যা দেখি, সেটা তুলে আনলাম। তো কোনো নেতিবাচক অর্থে কিন্তু টোকাই আসেনি। সে তার চারপাশটা দেখে—একটা ছেলে ঘর নেই, গৃহহীন। পরিবার আছে কি নেই, রাস্তায় রাস্তায় থাকে, এই ছেলেরা আমাদের সমাজে রয়েছে। আমরা তো তাদেরকে তুলে আনতে পারিনি! তো তাদের মুখ থেকে কথাগুলো বলানো। আমি বলতে চেয়েছি যে, এরা কিন্তু সবকিছু দেখছে সব সময়। একটা শ্রেণি উঠে যাচ্ছে ওপরে, আরেকটা শ্রেণি পড়ে যাচ্ছে নিচে। ওরা এগুলো কিন্তু দেখে। সেই দেখার ভিতর থেকে নিজেদের কথাও বলে, অন্যদের কথাও বলে ওরা। বৈষম্যের কথাও বলে, সবটাই আসে সেখানে। বৈষম্যের কথা বললেই রাজনীতি আসে সেখানে। রাজনীতি না আসলে তো সবটা পরিষ্কারও হবে না। আমরা তো সবাই অসুস্থ রাজনীতির একটা আবর্তের মধ্যে থাকি। রাজনীতির সাথেই থাকি। যাবতীয় যা কিছু হয়, এই যে শ্রেণিবিন্যাস, যাবতীয় যা কিছু, এগুলো নিয়ে তো রাজনীতি চলতে থাকে। আমরা যে খুব গরিব একটা দেশ, ছোট্ট একটা দেশ। সারা বিশ্বের কাছে দেশটি ও রকম, খুব ছোট একটা দেশ। তো এটাকেও কিন্তু আমরা ধুয়ে খাই যে আমরা গরিব, আমাদের পয়সা দাও। আমরা গরিব, আমাদের দেশ চলছে না, আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যাটা ঠিক করে দাও। পয়সা আনে, পয়সা আসে। উন্নয়নের জন্য আনে। এসব বৈষম্য দূর করার কথা বলে, শ্রেণিগুলো ঠিক করার কথা বলে, এই সব বলে আনলেও কিন্তু কিছুই আর ঠিক করা হয় না। রাজনৈতিকভাবে ব্যাপারটা দেখলে, আমরা করি কি—আমরা গরিব দেশ বলে আনি। আনার পর আবার এটাকে ঢেলে সাজাই আমাদের নিজস্ব কাঠামোয়। কী আর বলব—আমাদের যে অসুস্থ রাজনীতি...তার মধ্যে ওটাকে ঘোঁট পাকিয়ে তারপর খাওয়া-দাওয়া...এটা-সেটা হয়ে যায়। আমরা সাম্প্রতিক কালের নানান ঘটনায়ও এটা দেখলাম। এই যে, কী হয়েছিল আর কী হতে পারত, সমস্ত কিন্তু আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। কিন্তু তারপরেও যে সমাজব্যবস্থা খুব বদলেছে, তা-ও না।
যাহোক, এই যে বাচ্চাটা, একটা প্রতীকী চরিত্র টোকাই। তার যে জনপ্রিয়তা, তার যে শ্রেণি, তার চারপাশের পরিবেশ, তার দেখা যে ব্যাপারগুলো, সেগুলো নিয়েই তো কথাবার্তা হয়। সেটার জন্য কিন্তু টোকাই চরিত্রের জনপ্রিয়তা হল। এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাবার একটা ইচ্ছা সামরিক সরকারের তো হতেই পারে। সে রকম বোধ হয়, একটা ঘটনা হয়েছিল। কিন্তু যেটা খারাপ হলো, যে দিকটি, সেটা হলো যে ওকে নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে ভাবা হলো। যে এটা ঠিক না, ওদেরকে খুব সুন্দর একটা নাম দেওয়া উচিত। ওদেরকে ‘পথিকলি’ নাম দেওয়া হলো। কিন্তু টোকাই যে খারাপ নাম, কে বলেছে? অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, টোকাই মানে কী? ওটা অর্থহীন নাম! এরা কাগজ টোকায়, জিনিসপত্র টোকায় রাস্তাঘাটে—এভাবে বলা যেতে পারে। কিন্তু ওটা টোকাই না…‘পথকলি’ বললে কি খুবই অর্থপূর্ণ হয়ে যেত তখন? কিন্তু নামটা রেখেছি আমি, যাতে পরিচিত না হয়। পরিচিতির মধ্যে না পড়ে। যেমন, একবার ভেবেছিলাম, টোকন রাখলে কেমন হয়?
মধ্যবিত্ত সংসারের টোকন একটা খুব আদরের নাম। পরিচিত এক নাম। যে পরিবারে আছে বা যারা চেনে টোকনদের, ওই চেহারা কিন্তু ভেসে আসবে। আমি সেটা চাইনি। আমি চেয়েছি যে, এমন একটা নাম যেটা কোনো অর্থ বহন করবে না, কিন্তু আদরের হবে। একটা ধ্বনি থাকবে, আর ওই ধ্বনিটা হলো প্রতীকী ধ্বনিসর্বস্ব নাম। ওটাই আসল। ধ্বনিটাই তো আসল। তো সেভাবেই টোকাই হলো। এটা আমি পথশিশু বললাম, নাকি পথকলি বললাম বা আরও সুন্দর সুন্দর করে অনেক কিছু বলতে পারি, কিন্তু এতে তাদের শ্রেণি বদলে যাচ্ছে, তা তো না। কিছুই বদল হচ্ছে না! বরং পথকলি বললেই মনে হতো, যেন বেশ আদরযত্ন করে তাদের কোথাও খাওয়ানো হচ্ছে, তাদের পরিধেয় বস্ত্র দেওয়া হচ্ছে, সমাজ-সংসারে তাদের একটা ভালো অবস্থানে নিয়ে গেছে। তা তো না। কিছুই না। তো তাহলে আর লাভটা কী হলো।
প্রশ্ন: আসলে কী ঘটেছিল সে সময়? সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে কি এই নামকরণের কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল?
রনবী: না, তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, আর টোকাই আঁকবেন না! এখন থেকে টোকাইরা সব পথকলি। আমিও তখন কোথায় যেন সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, টোকাই আর আঁকব না যেদিন টোকাই থাকবে না। এই শ্রেণি যদি না-ই থাকে, তাহলে আঁকার তো কোনো প্রয়োজনই হবে না। আমরা দেখতে চাই, আমরা সবাই এক হয়ে গেছি একদম। তবে এত শ্রেণি বিভাজন আছে আমাদের, হিসাব করে দেখেছি অনেক! আমাদের দেশে যদি শ্রেণি বিভাজন করি, তাহলে দেখব—অতিবিত্ত, তারপর বিত্তবান। তারপর কি বলে মধ্যবিত্ত—উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, তারপর নিম্ন মধ্যবিত্ত। তো আরও আছে নিম্নবিত্ত, তারপর নিম্নবিত্তের পরে আছে বিত্তহীন। এভাবে হতে হতে আমাদের অনেকগুলো শ্রেণি! তো সেই শ্রেণির বিলোপ কখনো আমরা দেখিনি কিন্তু। ওসব সমস্যাও সব সমাধান হয়ে গেছে, ও রকম ঘটনাও তো কখনো ঘটেনি। অতএব, টোকাই বন্ধ করতে বললেই কী? না বললেই-বা কী?
রফিকুন নবীর সঙ্গে মঈনুল শাওন ও সাখাওয়াত টিপু
কেন, টোকাই করলে অসুবিধাটা কোথায়? কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমি দেখেছি, ধীরে ধীরে সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে নানা কথা হলো! এত বেশি ব্যঙ্গাত্মক লাইনে নিয়ে গেল টোকাই নামকে, ব্যঙ্গ করে। তখন দেখা গেল যে—সন্ত্রাসীদের নামের সামনে টোকাই বসিয়ে দিচ্ছে। একটা বাজে ছেলের নামে টোকাই বসিয়ে দিচ্ছে। একটার পর একটা…এই যে টোকাই নামটাকে যত্রতত্র নানান জায়গায় এমনভাবে ব্যবহার করেছে, যাতে একটা অপমানজনক জায়গায় চলে যায় ধীরে ধীরে। ওটা কীভাবে হয়েছে জানি না আমি। আমার মনে হয়েছে, এটা একধরনের হীন চেষ্টা, মানে খারাপ চেষ্টা আরকি!
প্রশ্ন: এরশাদ যেটা পথকলি নাম রাখতে চেয়েছিলেন, টোকাইকে পরিবর্তন করে—তা যে মূল শ্রেণি ভেদাভেদ বন্ধ করা না, সেটা স্পষ্ট! ওটা তো তার ওপর-চালাকি। অন্য দশটা ধূর্ত চালের মতো জনপ্রিয় একটা চরিত্রকে দখল করা...
রনবী: হতে পারে, কেন যে করেছিলেন ওটা…
প্রশ্ন: আপনার সাথে কখনো যোগাযোগ করেছিলেন?
রনবী: না, না...আমার সাথে কখনো সেভাবে কোনো যোগাযোগ হয় নাই। কখনোই কোনো সম্পর্ক ছিল না। আর আমাকে নিয়েও অনেকে বলেছিলেন, ‘টোকাই আঁকাটা নিশ্চয় উনি বন্ধ করে দিবেন, রাগের চোটে হলেও বন্ধ করে দিবেন, মাইন্ড করে হলেও হয়তো বন্ধ করে দিবেন।’ কিন্তু আমি আঁকা বন্ধ করিনি। কারণ, এই কথা যে কেউ যে কোনো রকমে বলতেই পারেন। নাম যে যেভাবে যাকে খুশি দিতেই পারে। ওই আর কী বলে…। ধরেন, আমার নাম রফিকুন নবী। এই নামটা রফিকুন নবী না-ও হতে পারত। অন্য নাম যদি দিত, তাহলেই সেই নামেই ডাকত। তাতে কিছু যায় আসে না। নামটা...
প্রশ্ন: টোকাই...আচ্ছা, নামের প্রসঙ্গে যখন আসল, টোকাই সিরিজের মাধ্যমে বোধ হয় আপনার রফিকুন নবী নামটা শর্ট করে রনবীর টোকাই...
রনবী: রনবী তো আমি আগেই লিখেছি। এটা সাইন সিগনেচার। ছবিতে ইনিশিয়াল সাইন দিতে গেলে আগে থেকে লিখতাম রফিকুন নবীকে রনবী। ভুল করে অনেকে বোধ হয় এমনটা ভাবেন। কথা হলো যে টোকাইকে ঠিক না বোঝার একটা ব্যাপার আছে। আমার ধারণা, জেনে হোক বা না জেনে হোক—ওকে [টোকাই চরিত্র] ঠিক বুঝতে পারেনি হয়তো। সেটা হতে পারে। যে এই চরিত্রকে শিল্পের একটা প্রতীকী চরিত্র বলতে চাই। তো স্বৈরাচার কী করতে চায়, তাকে লেখাপড়া শেখানো হবে। অনেকগুলো পথকলি স্কুল বানানো হয়েছিল তখন...
প্রশ্ন: পথকলি ট্রাস্ট বলে একটা ট্রাস্ট করেছিল...
রনবী: কিন্তু তারপরে কোথায় যে গেল! সবই ভেস্তে গেছে। এগুলো তো ব্যাপার নয়। টোকাই স্কুল দিলেই-বা কী হতো? সদিচ্ছাটা থাকলে রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে…আমরাও যারা অন্যভাবে নানান ধরনের কাজ করি, নানাজন যার যার ক্ষেত্র থেকে, যার যার প্ল্যাটফর্ম থেকে যদি এসব নিয়ে কাজ করি, তাহলে তো হতেই পারে একটা বড় কিছু। তার জন্য খুব একেবারে বেঁধে সেধে, কোমর বেঁধে নামা যে কালকে থেকে আমি পথকলি দিয়ে শুরু করলাম। কিন্তু উদ্দেশ্য সৎ না হলে এসবের কোনো দরকার নেই...
প্রশ্ন: তবে এরশাদের এসব লোকদেখানো কর্মকাণ্ডের বিপরীত চিত্রটা যদি দেখি…৮০-র দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কিন্তু টোকাইরা একটা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। শুধু এরশাদবিরোধী আন্দোলন না, ৬৯ সালেও...
রনবী: আমি ‘টোকাই’র যে ধারণাটা পেয়েছিলাম, সেটার বুনিয়াদ কিন্তু অনেক আগে। কী রকম আমি বলি—অনেক আগে আমি তখন, ষাটের দশকে পূর্বদেশ পত্রিকায় কাজ করতাম। তো সে সময় আন্দোলন হতো। সে সব আন্দোলনে মিছিল-টিছিল বেরোলে ফটোগ্রাফস যেগুলো আসত, দেখা যেত যে ওই শিশুরা একদম সামনে। তারা ছোট ছোট বাচ্চা সব, লুঙ্গি-টুঙ্গি পরা, কোনোটার ছেঁড়া লুঙ্গি খসে গেছে, কোনোটা ন্যাংটা, ওরা সবার আগে। এটা কিন্তু আজকের বলে নয় বা ৬০ দশকের বলে নয়। আমার মনে আছে, কাজী ইদ্রিস সাহেব পূর্বদেশের সম্পাদক ছিলেন। খুব বড় নামকরা মানুষ এবং নামকরা এডিটর তখন। তার কথাতেই একদিন আমরা ওই ছবিগুলো বাছাই করছিলাম। আমি কিন্তু তখন চাকরি করি। পূর্বদেশ দিয়ে আমার চাকরি শুরু হয়েছিল, খণ্ডকালীন, আমি কিন্তু তখনো চারুকলার ছাত্র। তো এডিটর বলছিলেন, দেখ দেখ এই যে বাচ্চাগুলো—মনে হয় যেন এদের বয়স বাড়ে না। মনে হয় যেন একই বাচ্চাকে আমি ব্রিটিশ আমলের সেই মিছিলেও দেখেছি। সেই বাচ্চারাই যেন আবার এখানে। যখন ৬৯-এর গণ-আন্দোলন, তখন দেখি যে সেই বাচ্চারাই সামনে। তখন থেকেই কিন্তু আমার বারবার মনে হতো, কথাটা সত্যিই তো! ব্রিটিশ আমলের বাচ্চাগুলো বারবার আসে...বারবার আসে...এদের কোনো শেষ নেই। মানে একই চেহারা মনে হয়, যেন একই চেহারার সব চলে আসছে আদিকাল থেকে। এটা আমাদের এই যে আন্দোলনমুখী অবস্থান হয়ে যায়, আমাদের পুরো দেশে তখন দেখা যায়, এদের যুক্ততা। এবং এভাবেই তারা আসে। ৬৯-এ কিন্তু আমরা, ওই যে রশীদ তালুকদারের ছবি তো ভুলতে পারি না। একটা বাচ্চা হাত উঁচু করে সবার আগে এগিয়ে আসছে। তো টোকাই শুরুর পেছনে আমার মাথায় সব সময় এসব চিন্তাই এসেছে—এগুলো কিন্তু চরিত্র নির্মাণের একেকটা ধাপ। সেই ইদ্রিস সাহেবের কথা, রশীদ তালুকদারের ছবির কথা, আর আমার নিজের স্মৃতি—নারিন্দার যে পাড়ায় আমি থাকতাম, তখন থেকে এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে দেখতাম। তাদের যে কার কী নাম সেটা জানা হতো না। কিন্তু এদের কথাই আমার সব সময় মনে হয়েছে। এখনো অনেকে প্রশ্ন করে, টোকাইয়ের বয়স কত হলো? কিন্তু এখনো যখন আমরা মিছিলে তাকাই, যেকোনো মিছিলে এই বাচ্চারা থাকে।
প্রশ্ন: বয়স থেকে যদি অন্যদিকে যাই, টোকাইর বয়স যদি ধরি যে, সে বড় হয়েছে। সে বড় হওয়া থেকে বিভিন্ন কিছু হতে পারে, বিভিন্নভাবে একেকজন একেক জায়গায় যেতে পারে। তো আমরা যদি এভাবে দেখি যে, টোকাইদের একজনই বড় হয়ে বা টোকাই না বলে যদি গরিব শিশুদের একজন বড় হয়ে নূর হোসেন হলেন, একদিন…। আর ছোটবেলা থেকেই তার এই যে মিছিল বা রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ, সেটা কিন্তু অব্যাহত থেকেছে। তাহলে বিষয়টি আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
রনবী: এটা ভালো প্রশ্ন। নূর হোসেন কিন্তু আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য যুদ্ধ করা একজন, এটার জন্য সোচ্চার হওয়া একজন। গণতন্ত্রের জন্য তাঁর জীবন দিতে পারার যে ইচ্ছা, এই যে ঘটনা—এটার একটা প্রতীকী চরিত্র যদি আমরা ধরি, তাহলে নূর হোসেনের কথা বলা যায়। কারণ, একটা মানুষ খালি গায়ে তাঁর নিজের শরীরে কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন—‘স্বৈরাচার নিপাত যাক...’। এই যে ঘটনা এবং সেই দিকে টার্গেট করে…। লেখার কারণে তার টার্গেট হয়ে যাওয়া, তারপর মরে যাওয়া—এই যে আত্মাহুতি, সেটা এক বিশাল প্রতীকী ঘটনা। সেই ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন থেকে শুরু করে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের এক কাতারেই নূর হোসেন। একথা কিন্তু আমাদের মানতে হবে। এই বেচারা কিন্তু এমনি এমনি যায়নি। এমনকি, ফটোগ্রাফি তোলার জন্য বা একটা কিছু হিরোইক কাজ করতে গেলেন, তা নয় কিন্তু। ওই রকম একটা উত্তাল মিছিলের সময়, আন্দোলনের সময় এমন দুঃসাহসী হতে পারা কিন্তু কম কথা নয়। নূর হোসেন সেই দুঃসাহসী একজন মানুষ। যে এটা ঘটিয়েছিল এবং সে এটা লিখেছিল। লেখার পরে মিছিলে গিয়েছিল। মিছিলে তাঁকে শেষ পর্যন্ত মরতেই হলো। সব ঘটনা যদি আমরা দেখি তাহলে দেখব—নূর হোসেন বিশাল একটা ব্যাপার। কিন্তু নূর হোসেন যে মরে গেলেন, জীবন দিলেন, কী লাভ হয়েছিল? তখন রাজনীতিবিদেরা বা আমরা তো ঝাঁপিয়ে পড়লাম, না? হ্যাঁ, সর্বক্ষেত্রের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল। কোনো ব্যক্তি নয়, স্বৈরতন্ত্র থাকবে না। এটা নিপাত যাক, এই কথা বলে সবাই আসল। কামরুল হাসান তিনিও কিন্তু মরে গেলেন। তিনিও ঠিক মৃত্যুর আগে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে এঁকে গিয়েছিলেন। তাঁর ওই যে সেই বিখ্যাত ছবি, [দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে], হ্যাঁ...সেটা করার কিছুক্ষণ পরেই তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন এবং সাথে সাথে মারা গেলেন। এই যে মৃত্যুগুলো নূর হোসেন বলি কিংবা কামরুল হাসান বলি বা আরও অনেকে আছেন, ডা. মিলন মরেছেন, এই যে মৃত্যুগুলো যাঁদের আত্মত্যাগ গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ক্রমশ একটা জায়গায় নিয়ে এসেছিল। পরে কী হলো? আবার সেই ঘুরেফিরে দেখা গেল, যাঁদের মরে যাওয়ার, তাঁরা মরে গেছেন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে যাঁদের বিরুদ্ধে ব্যাপারটা ছিল, তাঁদেরকেই দেখি আবার কোলেপিঠে নেওয়ার চেষ্টা হলো। তার মানে—ওই যে বলছিলাম—অসুস্থ রাজনীতি। কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে, কোথা থেকে কী হচ্ছে সব! এখন তো কেউ যদি মিছিলে যেতে বলে—আমাকে কিন্তু ১০ বার ভাবতে হবে, ১০০ বার ভাবতে হবে—রাজনীতিবিদদের কথা, ওদেরকে বিশ্বাস করব কি করব না! কিছু একটা...এ্যাঁ...আমিও নিজেকে মনে করছি, এই ক্ষেত্রে আমি প্রতীকী কথা বলছি।
অনেকেই এ কথা ভাবছে, তাহলে, এই যে আন্দোলন হলো—পাকিস্তান আমলে আন্দোলন হয়েছে, ভাষা আন্দোলন হয়েছে, ভাষা আন্দোলন থেকে আমরা আস্তে আস্তে তো একটা জায়গায় পৌঁছেছি। সে আন্দোলনের তো একটা অর্থ ছিল—কোথায় যাচ্ছি! সে সময় অনেক দায়িত্ববোধের রাজনীতি হয়েছে। হতে হতে মুক্তিযুদ্ধে এসেছি, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে...যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি, মুক্তি পেয়েছি, স্বাধীন হয়েছে দেশ। হয়েছে না? এখানে এই পর্যন্ত আমাদের খাঁটি একটা ব্যাপার, একটা ঘটনা ঘটেছে আমাদের দেশের জন্য, আমাদের জন্য, সবার জন্যে। তারপর থেকে বাকি সবই হলো একদম ওই রাজনীতি—যা আমরা কিন্তু বুঝতে পারি না। আন্দোলনের ডাক দিলে আমরা আন্দোলন করি, সাধারণ মানুষের কথা বলছি, সবাইকে ডাক দিলেই যাই। হাজার হাজার লোক রাজপথে নামে...মারপিট করে, হুলুস্থুল করে, কিন্তু স্বার্থটা কার চরিতার্থ হয়? ওই যে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের বদল হয় না বলতে গেলে, হয় ওই ওদের—রাজনীতিবিদদের। কিন্তু জনগণের...
রফিকুন নবী © ছবি: ঢাকা অপেরা
প্রশ্ন: সংগ্রাম এবং জীবনদান...
রনবী: না, আমি সেটা বলব না। জনগণের ঘাড়ে চড়ে চড়ে একটা জায়গায় আসে। তারপরে দেখা যায় যে,...সব ভুলে গেল। আবার যেটা হয়, যাঁদের বিরুদ্ধে এসব ঘটনা হয়, তাঁদেরকে আবার টেনে নিয়ে আসেন তাঁরা। এটা, ওই যে রাজনীতিবিদেরা বলেন, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছুই নেই’। এ কথা আমরা শুনি সব সময়। আবার সব সময় সেই কথাটা শোনা যায়, ‘রাজনীতি বলে কিছুই নাই’। তো এটাই আমাদের দেশ। এই এমনি অভাগা দেশ, যেখানে কিন্তু—নাই বললেই তো চলবে না, আমাদের তো কিছু করতে হবে। শেষ বলেই তো, কিছুই নাই বলেই তো, স্বাধীন হয়েছিল দেশ। একটা জায়গায় তো পৌঁছেছিলাম আমরা। পৌঁছে তারপরে তো একটা নতুন দেশ আমরা পেয়েছি। সে দেশ চলছে। সেই দেশটা পরিচালনার ব্যাপারে যে রাজনীতিটুকু হয়, সেই রাজনীতিটা অন্য রকম হয়ে গেছে।
প্রশ্ন: একটু আরেকবার আশির দশকে ফিরে যাব, সে সময় শিল্পীদের কোনো সুনির্দিষ্ট আন্দোলনের কথা, আপনার মনে আছে কি না? এরশাদবিরোধী আন্দোলন, শেষের দিকে সব পেশাজীবী যুক্ত হয়েছিলেন...
রনবী: সেটা তো...সবাই ছিল। শিল্পীরা তার থেকে দূরে নয়। শিল্পীরা বাংলাদেশে কিন্তু, আমাদের দেশের অন্য পেশাদারদের চেয়েও অনেক বেশি অগ্রণী ভূমিকায় থাকেন। একেবারে প্রথম থেকেই দেখা যায়, শিল্পীদের সম্পৃক্ততা বড় হয়ে আসে। এবং শিল্পীরা সরাসরি ছিলেন, আগেও ছিলেন, ওই সময়ে ছিলেন। এবং ছিলেন বলেই তো আমাদের কামরুল হাসান—তিনি ওইটা করতে পেরেছিলেন।
প্রশ্ন: ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’...
রনবী: হ্যাঁ, তো সেভাবেই হয়েছে। আমি তো কম দেখলাম না। অতএব এই দেখাদেখির মধ্য থেকে ওই উপলব্ধিটুকু হয়েছে, আমাদের আন্দোলনে ডাকলে আমরা আন্দোলনে চলে গেছি। যখন ভাবনাটা ভালোর দিকেই থাকে, দেখানোটা তো ভালোই হয়। আমাদের সামনে যখন দাবিগুলো দেওয়া থাকে যে কেন এই আন্দোলন হচ্ছে? সেগুলো দেখলে গা গরম তো সবারই হয়ে যাবে। কারণ, আমরা তো শান্তি চাই, শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে চাই, ভালো থাকতে চাই এবং সবাই মিলে খুব সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই, দেশ গড়তে চাই। কত কথা আমরা বলি না এগুলো সব নানান কথা...। তখন তো আন্দোলনে যাই, শিল্পীরাও যাই, আমরা সবাই যাই, বিশেষভাবে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় আমরা গিয়েছি।
প্রশ্ন: আপনি যেমনটি বলছিলেন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের একটি প্রতীকী চরিত্র হলেন নূর হোসেন। রাজনৈতিক এই প্রতীক হবার সাথে তাঁর দ্রোহের নান্দনিক উপস্থাপনা কিন্তু ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। এর আগে আমরা রাজনৈতিক দেয়াললিখন, সড়কে আলপনা—এসব দেখেছি। তো, নূর হোসেনের বুকে-পিঠে লেখাকে কি আপনি শিল্প হিসেবে বিবেচনা করেন? এটা তো একধরনের চলন্ত পোস্টার। শরীরকে ক্যানভাস বানানোর এই পদ্ধতির শিল্পমূল্য কি?
রনবী: আমাদের এমনিতে শিল্পকলায় একটা দিক রয়েছে, মানুষের যে শরীরটা এটা কিন্তু একটা সারফেস। ছবির ক্ষেত্রে—যে জিনিসের ওপর আমরা ছবি আঁকি, ক্যানভাস হোক, দেয়াল হোক বা যেকোনো সারফেসে ছবিটা আঁকি, সেটাকে আমরা সাপোর্ট বলি। তো মানুষের শরীর কিন্তু একেবারে আদিকাল থেকে একটা পট বা ক্যানভাস আকারে ছিল এবং আছে। এটা এমন একটা ক্ষেত্র, যার ওপরে ছবি আঁকার মতো একটা সারফেস। এটা একেবারে আদিকাল থেকে গুহামানবদের মধ্যে আমরা দেখতে পাই। মানুষ গুহার দেয়ালে ছবি আঁকত সারফেস আকারে। তখন কে জানে, হয়তো তাদের শরীরে এমন ছবি আঁকত কি না, এটা তো কিছু জানি না। গুহারটা তো রয়ে গেছে বলে আমরা এখন দেখতে পাই। কিন্তু পরবর্তীকালে আমরা জানি, ধাপে ধাপে সারফেসের উপাদান বেড়েছে। মানুষের দেহটাই শিল্প আকারে হাজির হয়েছে। তো সেই বিবেচনায় এই যে একটি সুনির্দিস্ট উদ্দেশ্য নিয়ে এটা করা, যেমন, নূর হোসেনের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম।
এই যে খালি গায়ে তাঁর দেহের মধ্যে আঁকা, সেটা আমার কাছে মনে হয়েছে, যিনি এঁকে দিয়েছেন তার ভেতরে শৈল্পিক কিছু করার একটা প্রবণতা ছিল। এমনিতে খালি দেহে আঁচর-টাঁচর দিয়ে একটা কিছু লিখে দিলেই তো হতো। কিন্তু তা না করে, একটু সুন্দর লেখনী যেন হয়, যাতে সবার চোখে পড়ে, সব মিলিয়ে ওইভাবে করেছে। লেখনীতে হয় কি—গায়ে লিখলে, শরীরের মুভমেন্টটার সাথে কিন্তু ওই লেখাটাও মুভ করে বা ছবিটাই মুভ করে। সব মিলিয়ে একটা আমেজ তৈরি হয়, এই জিনিসগুলো কিন্তু শিল্প হয়ে ওঠে। সেই আমেজ দেখতে গিয়ে যে—একজন গুলি করবে, কী করুণ একটা নৃশংস ঘটনা ঘটেছিল। আমরা তো তখন এটার শৈল্পিক দিকটি দেখে নানাজন নানা কথা বলেছি। যারা তাকে সামনাসামনি দেখেছে তারা বলেছে, বাহ্!
কিন্তু যাদের সেটা পছন্দ হয়নি, তারা তো এন্টি আর্ট তো বটেই, এন্টি সমাজ, এন্টি রাজনীতি, এন্টি হিউম্যানিজম মানে মানবিকতার একেবারেই বাইরে। মেরে ফেলল! কী রকম নৃশংসতা হতে পারে এটা...
প্রশ্ন: তাহলে কি শিল্পটাই বেঁচে গেল...
রনবী: ওরা তো আর শিল্পকে গুলি করেনি...গুলি তো করেছে ব্যক্তিটিকে। শরীরের আর্ট যদি কেউ মুছে দিই আমরা, তাহলে তো নূর হোসেনের সেই রক্তাক্ত শরীর থাকবে। নূর হোসেনের ওই ছবি যদি মুছেও দিই, আরও মানুষের শরীর তো আছে। আবারও নূর হোসেন আসবে, হয়তোবা অন্য কোথাও। সেটা কোনো ব্যাপার নয়। মানুষ কখন এটাকে প্রয়োজনে নিয়ে আসবে, কে জানেন?
রফিকুন নবী [Rafiqun Nabi]
খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী-কার্টুনিস্ট ও লেখক। ক্যানভাসের স্বাক্ষরে রনবী নামে খ্যাত। জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৮ নভেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছত্রাজিতপুর গ্রামে। তিনি দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, ডিনসহ নানা দায়িত্ব পালন করেন। দেশ-বিদেশে তাঁর শিল্পকর্মের অসংখ্য প্রদর্শনী হয়েছে। ১৯৭৮ সালের ১৭ মে টোকাই শিরোনামে প্রথম স্ট্রিপ কার্টুনটি ছাপা হয় সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। বাংলাদেশে টোকাই-ই প্রথম কার্টুন চরিত্র। এটি বাস্তবে এমন ছিন্নমূল পথশিশুর প্রতিনিধিত্ব করে, যারা মানুষের ফেলে দেওয়া আবর্জনা কুড়িয়ে নিয়ে যায় বা টুকিয়ে নিয়ে যায়। বাংলা ভাষায়ও শব্দটি তিনি সংযোজন করেন।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি, জাতীয় জাদুঘর, বঙ্গভবন, গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাঁর শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। তিনি গ্রিস, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, যুগোস্লাভিয়া, চেকোশ্লাভিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক, মিসর, ওমান, জর্ডান, ভারত, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
রফিকুন নবী শিল্পকলায় অবদানের জন্য ১৯৯৩ সালে একুশে পদক, চারুকলায় জাতীয় সম্মাননা শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, বুক-কভার ডিজাইনের জন্য ১৩ বার ন্যাশনাল একাডেমি পুরস্কার পান। ২০০৮ সালে তাঁর আঁকা খরা শীর্ষক ছবির জন্য ৮০টি দেশের ৩০০ জন চিত্রশিল্পীর মধ্যে ‘এক্সিলেন্ট আর্টিস্টস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে মনোনীত হন৷ তিনি ২০১৫ সালে ‘শেল্টেক্ পদক’ লাভ করেন।
—সম্পাদক