শাস্তি

 

আমি মরে গেলে তুমি কিন্তু বিয়ে করবে না, হিমেল।

ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়! আবার! তা কেন? কী এমন অসুখ হয়েছে তোমার, মাত্র ত্রিশ বছর বয়সের এই তাগড়া শরীরে মারা যাবে তুমি!

মরার জন্য কোনো অসুখ-বিসুখ লাগে নাকি। মৃত্যু সারাক্ষণ মানুষের পিছু ধাওয়া করে, যাকে পায় তাকেই টুপ করে গিলে ফেলে। আমার বড় চাচার কি কোনো অসুখ-বিসুখ ছিল? দিব্যি সুস্থ মানুষ। সারা দিন কাজ করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে জ্ঞান হারালেন। আর জ্ঞান ফিরল না। মাত্র চল্লিশ বছর বয়স ছিল চাচার। কিছুদিন আগে আমার এক ফ্রেন্ডের ভাবি মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে সুস্থ অবস্থায় মারা গেলেন। রাতে ঘুমিয়েছেন, সকালে উঠে বললেন, বুকটা হালকা একটু ব্যথা করছে। গ্যাস হয়েছে ভেবে, গ্যাসের ওষুধ খাওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মারা গেলেন তিনি। সে কারণেই তোমাকে বলে রাখছি, কোন দিন হঠাৎ মরে যাব। তুমি আর একজনকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে! আমি মারা যাওয়ার পর তুমি বিয়ে করলে আমি কিন্তু জ্বলেপুড়ে ছারখার হবো, বুঝলে!

এমনিতে মৃত্যুটা আমার কাছে কোনো সমস্যা নয়। মনে হয়, কত মানুষই তো প্রতিদিন মারা যায়, আমিও মারা যাব, তাতে সমস্যা কী। কিন্তু যখনই ভাবি, আমি মারা গেলে তুমি আর একটা বিয়ে করবে, সেই মেয়ে এসে আমার কষ্ট করে জমানো টাকায় কেনা সুন্দর সোফাটায় বসে তোমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে, আমার বাসরঘরের খাটে শুয়ে শুয়ে তোমরা সেক্স করবে, আমার সাজানো সংসারটা ওর দখলে চলে যাবে। তখনই মৃত্যুটা আমার কাছে বিরাট একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, বুঝলে।

জানো, আমার পরিচিত অনেককেই বলতে শুনি, আমি মরে গেলে স্বামীকে বলে যাব, বিয়ে করে সংসার করতে। শুধু শুধু একা একা জীবনটা কষ্টে কাটাবে কেন। আসলেই কি ওরা মন থেকে কথাটা বলে? জানো, আমার না ওদের কথাটা বিশ্বাস হয় না। একদম বিশ্বাস হয় না। তার স্বামীকে অন্য একটি মেয়ে জড়িয়ে ধরবে, তার সাজানো সংসারে আর একজন আসবেএই বিষয়টি কোনো মেয়েই মন থেকে মেনে নিতে পারবে না।

সবাই কি তোমার মতো হিংসুট্টি নাকি! নিজের মতো করে সবাইকে চিন্তা করো কেন তুমি!

আমি তো আমার মতো করেই চিন্তা করব তাই না?

শোনো, বিয়ে যদি করতেই হয়, তুমি কিন্তু ওই মেয়েকে নিয়ে আমার এই সংসারে উঠবে না। আমার খাটে শোবে না। নিজেদের এই ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে অন্য একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিবে, না হলে এই ফ্ল্যাট বিক্রি করে অন্য একটি ফ্ল্যাট কিনবে, তারপর বিয়ে করবে। না, তা-ও হবে না। সেটাও সহ্য করতে পারব না আমি। আসলে অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে তোমাকে কল্পনা করলেই আমার হাত, পা ঠান্ডা হয়ে আসে। মনে হয় ওই মেয়েকে একদম খুন করে ফেলি। কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলি।

বিয়ে করলাম আমি আর খুন করবে ওই মেয়েকে! ওই মেয়ের কী দোষ বলো! খুন করলে তো আমাকেই করা উচিত তোমার!

শায়লা হিমেলকে জড়িয়ে ধরে উম্মা শব্দে তার ঠোঁটে একটা দীর্ঘ চুমু খেয়ে বলে, না, তোমার শরীরে কাঁটার আঘাতও আমি সহ্য করতে পারি না হিমেল।

তোমার আগে আমিই মারা যাব বুঝলে! যে যত বেশি মরার চিন্তা করে। তার আয়ু তত গুণ বাড়ে। তুমি এক শ বছর বাঁচবে। আমি মরে ভূত হব। ছেলেরাই আগে মরে। খেয়াল করে দেখো, আমার দাদির আগে দাদা মারা গেছে, নানির আগে নানা মারা গেছে। তোমারও তো তাই। তা ছাড়া বয়সের একটা বিষয় তো আছেই। তুমি আমার চেয়ে সাত বছরের ছোট। যদি বয়স ধরেই হিসাব করি, তাহলেও বলতে পারি, তোমার সাত বছর আগে আমি মারা যাব। তার মানে আমি মারা যাওয়ার সাত বছর পর তুমি মারা যাবে। সাত বছর তো অনেকটা সময়। তুমি চাইলে বুড়ি বয়সে একটা বুড়াকে জুটিয়ে দিব্বি সংসারধর্ম করতে পারো।

হিমেল হাই তুলতে তুলতে আবার বলে, অনেক রাত হয়েছে, তোমার আগে আমিই মারা যাব, এটা ভেবে, নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ো।

 

শোনো, আমি না একটা বুদ্ধি পেয়েছি।

কী?

পাঁচ ফিট চার ইঞ্চি, ঠিক আমার সমান উচ্চতার আমার একটা ছবি প্রিন্ট করিয়ে আমাদের এই শোবার ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখব। বিশাল ছবিটির দিকে তাকালে আমার নিষেধটা মনে পড়বে, তোমার আর বিয়ে করা হবে না। আমার ছবিটার দিকে তাকিয়ে চাইলেও বিয়ে করতে পারবে না তুমি। 

বাহ্‌! তুমি তো দারুণ বুদ্ধিমতী! এত বুদ্ধি তোমার, জানলে তোমাকে বিয়েই করতাম না। বেঁচে থাকতে সারাক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখো। মরেও শান্তি পেতে দিবে না! মুক্তি নাই! আমার মুক্তি নাই, তোমার হাত থেকে! হিমেল হাসতে থাকে।

শোনো, আমি কিন্তু খুব সিরিয়াস! হাসির বিষয় নয়। আমি যদি নিশ্চিত জানতাম, আমি মরলে তুমি বিয়ে করবে না। তাহলে কালই মরতে পারব। আমি মরলে তুমি বিয়ে করবে ভেবে, সারাটা সময় আতঙ্কে কাটে আমার। অনেক ভেবে ভেবে তোমার বিয়ে আটকানোর জন্য এটাই আমার কাছে সবচেয়ে ভালো উপায় মনে হয়েছে। অবশ্য যদি আমার নিষেধের কথা তোমার মনে থাকে। আমি তো আমার দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব, তাই না। বাকিটা তোমার ওপর নির্ভর করবে। মারা যাওয়ার আগে আমার সান্ত্বনা হবে, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।

কদিন পর রাতে চেম্বার থেকে ফিরে শোবার ঘরে ঢুকে হিমেল দেখল, কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই করা শায়লার সমান উচ্চতার বিশাল একটা ছবি দেয়ালে টাঙানো আছে।

হিমেল ছবিটার দিকে খুব অবাক হয়ে তাকাল।

শায়লা মিটি মিটি হাসছে। কিছু বলছে না।

হিমেল বুঝতে পারছে না শায়লা এমন কেন করছে! সত্যি সত্যি সে এত বড় ছবি প্রিন্ট করিয়ে আনবে সে ভাবেনি। বাসাবাড়িতে নিজের এত বড় ছবি কেউ দেয়ালে টাঙায়! যাহোক সে চুপচাপ বেশ গম্ভীরভাবে রাতের খাবার খেয়ে শোবার জন্য রুমে ঢুকল। শায়লা এসে তার ছবিটির সামনে দাঁড়াল, এরপর হিমেলকে কাছে ডাকল। হিমেল কাছে গেলে ওর ডান হাতটা শায়লার মাথায় রেখে বলল, এই ছবিটির সামনে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় হাত রেখে তুমি শপথ করো হিমেল, আমি মারা গেলে তুমি কখনো বিয়ে করবে না।

হাতটা শায়লার মাথায় রেখে হিমেল বিস্মিত হয়ে বলল, শায়লা তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছ?

শায়লা নাছোড়বান্দার মতো বলল, আমি পাগল হইনি হিমেল। আমি একদম ঠিক আছি। প্লিজ, তুমি আমার মাথায় হাত রেখে কথা দাও, আমি মারা গেলে তুমি কখনো বিয়ে করবে না।

হিমেল ঢোঁক গিলে কোনোরকমে নিরুপায়ের মতো বলল, ঠিক আছে, কখনো বিয়ে করব না।

আমি মারা গেলে এই ছবিটা এখান থেকে সরাবে না হিমেল। এই ছবির দিকে তাকালে আমাকে দেওয়া কথাটা তোমার মনে পড়বে।   

আমি মারা গেলে তুমি কখনো বিয়ে করবে না, এ কথাটা শায়লা মাঝে মাঝে হিমেলকে বলে। এ ধরনের একটা কথা বারবার বলার কারণে কখনো কখনো হিমেল অবাক হয়েছে। কিন্তু হিমেল কথাটাকে কখনোই গুরুত্ব দেয়নি। ভাবে, এমনি ইয়ার্কি করছে। কিন্তু শায়লার এখনকার এই আচরণে হিমেলের মনে হলো, শায়লার মানসিক কোনো সমস্যা হয়েছে। ওকে খুব শিগগির একজন সাইক্রিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে। ভাবে, কালই সাইক্রিয়াট্রিস্ট বন্ধু রফিকের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে কথা বলব।

বিছানায় শুয়ে হিমেলের ঘুম আসছে না। হিমেল ভাবে, শায়লার কি সত্যিই মানসিক কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে? বাচ্চা না নেওয়ার কারণে ওর কি এই সমস্যা হচ্ছে? মাত্র তো চার বছর হলো বিয়ে হয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছর বাচ্চা নেওয়ার প্ল্যান আছে ওদের। বিয়ের পর একটু গুছিয়ে নিতে এটুকু সময় প্রয়োজন বলে হিমেল মনে করে। শায়লা চাকরি করে না। একার ইনকাম তার। বাচ্চা এলে তো অনেক খরচ। তাই গুছিয়ে নিতে একটু সময় তো লাগবে। তা ছাড়া শায়লাও তো কখনো বাচ্চা নেওয়ার জন্য চাপাচাপি করেনি। বিয়ের পর ওরা দুজন মিলেই প্ল্যান করেছে, এখনই বাচ্চা নিবে না। বিয়ের পঞ্চম বছরে যেয়ে বাচ্চা নিবে। ওরা তো সেভাবেই এগোচ্ছে। শায়লা তো কখনো আর এ বিষয়ে কোনো কথা বলেনি।

পরদিন হসপিটালে যেয়ে হিমেল সাইক্রিয়াট্রিস্ট বন্ধু রফিকের খোঁজ নিয়ে জানল, রফিক মাসখানেকের জন্য দেশের বাইরে গিয়েছে। রফিক এলেই শায়লার বিষয়টি নিয়ে কথা বলবে সে। হিমেল ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে রোগী দেখায় মনোযোগ দিল।

বছরখানেক ধরেই শায়লার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। দুর্বল লাগে। মাঝে মাঝে বুকে চাপ লাগে। নিশ্বাস নিতেও হালকা কষ্ট হয়। শায়লা ভাবে, আর দেরি করা উচিত নয়। অনেক খাওয়াদাওয়া করে দেখলাম, দুর্বলতাটা কিছুতেই কাটছে না। ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। হিমেলকে বলতে হবে কথাটা। প্যাথলজিস্টের হাতে ধরা রক্ত নেওয়ার সিরিঞ্জটা চোখে ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শায়লার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। থাক বাবা, আর কিছুদিন নিজে নিজেই চেষ্টা করি। খাওয়াদাওয়া আরও বাড়িয়ে দেই। প্রতিদিন একটার জায়গায় কাল থেকে দুটা করে ডিম খাওয়া শুরু করব। কোনো সমস্যায় তো সিভিয়ার নয়। দুর্বল লাগে ঠিকই কিন্তু সব কাজই তো করতে পারি। শ্বাসকষ্টও তো সিভিয়ার নয়, মাঝে মাঝে হালকা একটু হয়। কোনো কোনো দিন তো হয়ই না। ঢাকার যে দূষিত বাতাস! হাঁপানি না হয়ে কি আর পারে। হাঁপানিই হবে হয়তো কিছুদিন পর। তার পূর্বাভাস মনে হয়।

ছোটবেলা থেকেই ডাক্তারের সিরিঞ্জ-ফোবিয়া আছে শায়লার। সে যে ভিতু স্বভাবের মেয়ে তা নয়। কিন্তু ডাক্তারের হাতে বা প্যাথলজিস্টের হাতে কোনো সিরিঞ্জ দেখলেই তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। রক্ষা এই যে শায়লার ছোটবেলা থেকেই তেমন কোনো অসুখ-বিসুখ নেই। ক্লাস ফোরে পড়ার সময় একবার বেশ কিছুদিন ধরে জ্বর ভালো না হওয়ার কারণে ডাক্তার কিছু ব্লাডের টেস্ট দেয়। শায়লা তার বাবার সঙ্গে সেই টেস্ট করতে গিয়ে সিরিঞ্জ দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। টেস্ট আর করা হয়নি। পরে এমনি এমনি কিছুদিন পর জ্বর ভালো হয়ে যায়। সেই শেষ। এরপর আজ পর্যন্ত ত্রিশ বছরের এই জীবনে আর কোনো টেস্ট করতে হয়নি শায়লার।

সমস্যাগুলো সিভিয়ার নয় ভেবে আর সিরিঞ্জের ভয়ে সে হিমেলের কাছে চেপে গেল বিষয়টি। কিন্তু মাঝে মাঝে তার দুশ্চিন্তা হয় ঠিকই। পরক্ষণেই দুর্বল মনের চিন্তাগুলোকে সে ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়, ধ্যাৎ! এই ত্রিশ বছর বয়সে কী এমন রোগ হবে! সিভিয়ার হলে তো ট্রিটমেন্ট করবই। তা ছাড়া হিমেল তো নিজেই ডাক্তার। ঢাকার সবচেয়ে ভালো মেডিকেলগুলোর একটিতে সে আছে। বেস্ট ট্রিটমেন্টই সে পাবে। যদি সিভিয়ার হয় তখন দেখা যাবে।      

 

কিছুদিন ধরে শায়লার জ্বর। শরীর খুব দুর্বল। হিমেল যেহেতু ডাক্তার, তাই নিজেই অনেক রকম ওষুধপত্র দিচ্ছে কিন্তু জ্বর ভালো হচ্ছে না। প্রায় পনেরো দিন হয়ে গেল, জ্বর ভালো হচ্ছে না। হিমেল শায়লাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে গেল। যাওয়ার সময় শায়লা সিরিঞ্জের কথা ভেবে অনেক টালবাহানা করেছিল, কিন্তু হিমেল শোনেনি। তা ছাড়া শায়লাও বুঝতে পারছিল, এখন ভালো চিকিৎসা করাতে হবে। অনেক টেস্ট করানোর পর দেখা গেল, শায়লার ব্লাড ক্যানসার! লাস্ট স্টেজে! ইন্ডিয়ার টাটা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলো, কিন্তু বাঁচানো গেল না শায়লাকে। টাটা মেডিকেল থেকে ফিরে আসার মাস দুয়েকের মধ্যে শায়লা মারা গেল। শায়লা মারা যাওয়ার আগে হিমেলকে বারবার বলেছিল, আমার ছবিটা তুমি এঘর থেকে সরাবে না হিমেল। তুমি কিন্তু কখনো বিয়ে করবে না। কক্ষনো বিয়ে করবে না তুমি। আমি কিন্তু সহ্য করতে পারব না! 

শায়লার মৃত্যুর পর হিমেল সিদ্ধান্ত নিল, সে বিয়ে করবে না। কখনোই করবে না। শায়লাকে দেওয়া কথা সে রাখবে। কীভাবে সে শায়লার নিষেধ ভুলবে!

হিমেলের বয়স এখন সাঁইত্রিশ। হিমেল ভাবে, প্রায় অর্ধেকের বেশি জীবন তো কেটেই গেছে। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে সে সত্তর বছর পর্যন্ত বাঁচলেই খুশি। এর বেশি বাঁচার ইচ্ছে নেই হিমেলের। বুড়ো থুত্থুড়ে হয়ে বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ নিয়ে শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে কোনোরকমে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না তার কাছে। শায়লার স্মৃতিগুলো নিয়েই সে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে।

চোখের সামনে সব সময় শায়লাকে স্পষ্ট দেখতে পায় হিমেল। চোখ বন্ধ করলেও সে শায়লাকে দেখতে পায়। ঘুমাতে গেলে দেয়ালে টাঙানো শায়লা গুটি গুটি পায়ে হেঁটে এসে হিমেলের পাশে শোয়। হিমেল অনুভব করে শায়লা, হ্যাঁ শায়লাই তার পাশে শুয়ে আছে। চেম্বার থেকে ফিরে অভ্যাসবশত সে কলবেলে চাপ দেয়। হিমেল তালা খোলে কিন্তু সে দেখতে পায় শায়লা চাবির গোছাটি ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে রিনঝিন শব্দ তুলে হাসতে হাসতে তালা খুলছে। খেতে বসলে মনে হয় শায়লা তার পাশে টেবিলে বসে খাচ্ছে। এত জলজ্যান্ত স্মৃতি! হিমেলের মনেই হয় না শায়লা নেই। শায়লা আছে, হ্যাঁ, শায়লাকে নিয়ে সে অনায়াসে জীবনের বাকি দিনগুলো পার করতে পারবে। রাতে ঘুমানোর সময় মাঝে মাঝে হিমেল দুহাতে শায়লার মুখটা বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। শায়লার গরম নিশ্বাস হিমেলের বুকে আছড়ে পড়ে।

 

শায়লা মারা গেছে প্রায় চার বছর হলো। শায়লার ছবিটার কাঠের ফ্রেমে ঘুণপোকা ধরেছে। গুঁড়া গুঁড়া ঘুণ মেঝেতে পড়ে। হিমেল একদিন চারপাশের কাঠ খুলে ফেলার জন্য ছবিটা নামাল। হিমেলের কানে বাজতে থাকে, জানো হিমেল, দোকানি বলেছে, এই ছবিটার কাঠের ফ্রেম নাকি কোনো দিন নষ্ট হবে না, একদম লাইফ লং।

কিন্তু কী আশ্চর্য! এই কয়েক বছরে চারপাশের পুরো কাঠ ঘুণে এমন ঝরঝরে করেছে! হিমেল সহজেই কাঠগুলো খুলে ফেলল। চারপাশের কাঠ খুলে হিমেল ছবিটা যত্নসহকারে রোল করে সুতা দিয়ে বেঁধে আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখল। হিমেল মনে মনে ভাবল, একদিন সময় করে গিয়ে ছবিটা ভালো কাঠ দিয়ে বাঁধাই করে আনবে।

আরও দুবছর পার হলো। যাব যাব করেও শায়লার ছবিটা বাঁধাই করার জন্য হিমেলের আর যাওয়া হয়নি। আলমারির মধ্যেই আছে ছবিটা। একটু একটু করে শায়লা হিমেলের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করেছে। এখন সে শায়লাকে দেখতে পায়, কিন্তু অস্পষ্ট। সামনে নয়, মনে হয় যেন অনেক দূরে। শুতে গেলে শায়লাকে সে আর অনুভব করে না। শায়লার কথা মনে হলে সে শায়লাকে দেখার প্রাণপণ চেষ্টা করে, সে দেখতে পায়, কিন্তু খুব আবছা, মনে হয় যেন আকাশের মেঘের মধ্যে শায়লার মুখটা ভেসে আছে। শায়লার মুখের ওপর দিয়ে হালকা ফেনার মতো সাদা সাদা মেঘগুলো অবিরাম চলছে। শায়লার মুখটা এই দেখা যায়, এই দেখা যায় না। রাতে ঘুমানোর সময় মাঝে মাঝে দুহাত জড়িয়ে বুকের মধ্যে রাখে কিন্তু হাতজোড়ার মধ্যে শায়লার মুখটা নেই! তার তপ্ত নিশ্বাসের শব্দ হিমেল শুনতে পায় না।

দেখতে দেখতে নয় বছর পার হয়ে গেল। এখন হিমেলের বয়স ছেচল্লিশ বছর। কিছুদিন হলো ওর ডিপার্টমেন্টে সীমা নামের একজন মহিলা ডাক্তার জয়েন করেছে। সীমার বয়স প্রায় চল্লিশ বছর। বয়স চল্লিশ হলেও এখনো দেখতে বেশ সুন্দরী, স্মার্ট। ঠিক হিমেলের পাশের রুমেই বসে সীমা। নতুন হওয়ায় কোনো সমস্যায় পড়লে সীমা হিমেলের দ্বারস্থ হয়। হিমেলও খুব আন্তরিকতার সঙ্গে সীমাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এভাবে কিছুদিনের মধ্যে দুজনের মধ্যে বেশ ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। হিমেল জানতে পারে, সীমার স্বামী প্রায় আট বছর আগে রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। ওদের কোনো বাচ্চা হয়নি। বছর তিনেকের মধ্যেই দুজনের ঘনিষ্ঠতা প্রেমে রূপ নেয়। চতুর্থ বছরে তারা বিয়ে করে। বিয়ের পর হিমেল সীমাকে নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটেই ওঠে। দাম্পত্য জীবন ভালোই চলছে দুজনের। বিয়ের পর শায়লা সম্পর্কে সীমার আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। সে হিমেলের কাছে শায়লা সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছে। মোবাইলে শায়লার ছবিও দেখেছে। শায়লা বেশ সুন্দরী। হিমেলকে বিয়ে করতে বারবার নিষেধের কথা শুনেছে সীমা। দেয়ালে টাঙানো নিজের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে হিমেলকে শপথ করানোর কথাও শুনেছে সীমা। শায়লার এমন পাগলামোর গল্প শুনে সীমার মনে হয়েছে, শায়লা খুব আবেগী মেয়ে, বাস্তববাদী নয়।

হিমেল খুব অবাক হয়ে খেয়াল করে, সীমার কাছে সে যখন শায়লার গল্প করে, তখন মনেই হয়না শায়লা একসময় তার জীবনেরই অংশ ছিল। বিয়ের পর মনে হতো শায়লাকে ছাড়া সে বাঁচবেই না। শায়লার মৃত্যুর পর মনে হতো, শায়লার স্মৃতি নিয়েই বাকি জীবনটা সে পার করে দিতে পারবে। কী আশ্চর্য! এখন আর দশটা সাধারণ গল্পের মতোই সে সীমার কাছে শায়লার গল্প করে। শায়লাকে সে বুকের ভেতরে অনুভব করার চেষ্টা করে, কিন্তু না, শায়লাকে সে আর অনুভব করতে পারে না। সে বুঝতে চায়, শায়লার কথা মনে করে কি তার মনের কোথাও একটু কষ্ট হয়, না সে খুব ভালোভাবে খেয়াল করে, শায়লা নামটির সঙ্গে তার কোনো কষ্ট, কোনো অনুভূতি মিশে নেই। আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই এখন শায়লা তার কাছে।

হিমেল ঢাকা মেডিকেলের ডিউটি শেষে একটা প্রাইভেট মেডিকেলে রোগী দেখে বিকেল পাঁচটা থেকে রাত নয়টা-দশটা পর্যন্ত। সীমা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে না। ঢাকা মেডিকেলের ডিউটি শেষে দুজনে একসঙ্গে বাসায় ফেরে। হিমেল দুপুরে খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে চেম্বারে যায়। সীমা বাজার করা, রান্নাবান্নাসহ সংসারের কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

 

বিভিন্ন শপিং মল ঘুরে শপিং করবে বলে এক সন্ধ্যায় সীমা ধানমন্ডির উদ্দেশে রিকশায় উঠল। ড্রাইভার ছুটিতে গেছে। হিমেল চেম্বারে। সীমা অফিস থেকে ফিরে তাড়াহুড়া করে রান্না শেষে বেরিয়েছে। হিমেল চেম্বার থেকে ফেরার আগেই ফিরবে সে। সীমা ধানমন্ডির আট নাম্বার ব্রিজটা ক্রস করছে। হঠাৎ উল্টা দিক থেকে আসা একটা রিকশায় সে হিমেলকে দেখতে পায়, পাশে বসা শায়লা, তার আগের স্ত্রী। দুজন বেশ হেসে হেসে কথা বলছে। না, কোনো ভুল হচ্ছে আমার, সীমা ভাবে। সীমা চোখটা ভালোভাবে রগড়িয়ে আবার তাকাল। না, ভুল নয়। সে স্পষ্ট দেখছে, হিমেল আর শায়লা রিকশায় পাশাপাশি বসে গল্প করছে আর হাসছে। রিকশাটা যখন শায়লার রিকশাকে ক্রস করছে, তখন সীমা হিমেল বলে চিৎকার দিল। কিন্তু হিমেল তার ডাক শুনতে পেল না। সীমা সঙ্গে সঙ্গে হিমেলের মোবাইলে ফোন দিল। কিন্তু নাম্বার বন্ধ।

সে হিমেলের অ্যাসিস্ট্যান্টকে ফোন দিয়ে জানতে চাইল, স্যার কোথায়?

সে বলল, স্যার তো নামাজে গেছেন।

সীমার খেয়াল হলো, একটু আগেই মাগরিবের আজান পড়েছে।

সীমা বেশ ধন্দে পড়ল। সে আর শপিংয়ে গেল না। রিকশাওয়ালাকে রিকশাটি ঘুরিয়ে যেখান থেকে এসেছে সেখানে নিয়ে যেতে বলল।

হিমেল বাসায় ফিরে সীমার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? কোনো সমস্যা? মুখটা এমন থমথমে করে রেখেছ কেন?

না, কোনো সমস্যা নয়। সীমা রাতের খাবারের আয়োজন করতে গেল। খেতে খেতে সীমা বলল, তুমি কি আজ চেম্বার থেকে বেরিয়ে ধানমন্ডির দিকে গিয়েছিলে?

না, কেন? আমি পুরো সময় চেম্বারে ছিলাম। কেন বলো তো? শামীমও (তার অ্যাসিস্ট্যান্ট) বলল, আমি নামাজে গেলে তুমি নাকি ফোন করেছিলে?

না, এমনিই। শায়লা আমতা আমতা করে বলল।

এমনি কেউ এমন কথা বলে? নিশ্চয় কিছু হয়েছে, খুলে বলো কী হয়েছে।

সীমা বেশ দ্বিধা নিয়ে বলল, না, মানে, আসলে, আমি আজ সন্ধ্যায় ধানমন্ডির দিকে গিয়েছিলাম, অন্য একটি রিকশায় তোমার মতো একজনকে দেখলাম। আমি মনে হয় ভুল দেখেছি। সে শায়লার কথাটি চেপে গেল।

হিমেল এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলল না। এমন তো হতেই পারে।

সীমা কিছুদিনের মধ্যে বিষয়টি ভুলে গেল।

একদিন হিমেল চেম্বারে যাওয়ার আগে সীমাকে বলল, আজ গুলশানের জিলংয়ে রাতের ডিনার করব দুজনে। আমি চেম্বার থেকে আগে আগে বের হয়ে নটার মধ্যে ওখানে চলে যাব। তুমি বাসা থেকে চলে যেয়ো সময়মতো।

জিলংয়ের সামনে সীমা গাড়ি থেকে রাত নটা দশ মিনিটে নামল। জিলংয়ে ঢুকে সীমা দেখল, ডান দিকের দুই সিটের একটা টেবিলে হিমেল আর শায়লা মুখোমুখি বসে খাচ্ছে আর গল্প করছে। সীমা চোখ রগড়াল, ভালোভাবে দেখল। না, ভুল নয়। হিমেল আর শায়লাই বসে আছে। শায়লা হাত নেড়ে নেড়ে হিমেলের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করছে।

সীমা রাগে ছটফট করতে করতে টেবিলটির কাছে গিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল, হিমেল, কী হচ্ছে এসব?

টেবিলে বসা ভদ্রলোকটি খুব আশ্চর্য হয়ে বলল, কে আপনি? কী হচ্ছে মানে কী? আশ্চর্য! আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমি কথা বলছি। আর আপনি বলছেন, কী হচ্ছে এসব?

সীমা আগের মতোই চিৎকার দিয়ে উঠল, হিমেল, আমি সীমা, তোমার স্ত্রী।

ভদ্রলোকটির পাশে বসা মহিলাটি এবার বলল, এক্সকিউজ মি, আপনার মনে হয় কোনো ভুল হচ্ছে। আপনি মনে হয় অসুস্থ। বাসায় গিয়ে রেস্ট নেওয়া উচিত আপনার।

সীমা রাগে কাঁপতে কাঁপতে গাড়িতে উঠে বসল। সাড়ে নটার সময় হিমেল সীমাকে ফোন করল। সীমা ফোন ধরল না। একটু পর ড্রাইভারকে হিমেল ফোন দিয়ে জানল, সীমা বাসায় ফিরে যাচ্ছে। হিমেল সীমার সঙ্গে কথা বলতে চাইল ড্রাইভারের ফোন থেকে কিন্তু সীমা কোনো কথা বলল না।

সীমা বাসায় এসে ডাইনিং রুমের বেতের সোফাটায় স্থির হয়ে বসার চেষ্টা করল, কিন্তু সে কিছুতেই স্থির থাকতে পারছে না। বুকের ভেতর ধক ধক করছে। হাত-পা অবশ অবশ লাগছে। কিছুই সে বুঝতে পারছে না। অনেক প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু কোনো প্রশ্নেরই উত্তর পাচ্ছে না সে। হিমেলকে যদি অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে দেখত, তাহলে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হতো। হয়তো সে অন্য মেয়ের প্রেমে পড়েছে। কিন্তু শায়লা! শায়লা তো মৃত! তার কি ভুল হলো! না, ভুল তার হয়নি। সে স্পষ্ট দেখেছে। মনে পড়ল কিছুদিন আগেও ধানমন্ডি ব্রিজের ওপর রিকশায় সে স্পষ্ট দেখেছিল দুজনকে। আজ তো একদম কাছে গিয়ে দেখল। হিমেলের পরনে ছিল চেম্বারে যাওয়ার সময় পড়া ছাইরঙা শার্ট আর জিনস। নেভি ব্লুর মধ্যে সাদা সুতার কারুকাজ করা প্রিয় শাড়িটি পরে ছিল শায়লা। হিমেল তাকে বলেছে, এটি নাকি শায়লার খুব প্রিয় শাড়ি ছিল। এই শাড়ি পরে শায়লার প্রচুর ছবি দেখেছে সীমা। যদিও শাড়িটি বাসায় নেই। কারণ, সীমার বিয়ের আগেই শায়লার ব্যবহার করা জিনিস সব গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছে হিমেল। এত কিছু কোনোভাবেই ভুল হতে পারে না। কিন্তু শায়লা এলো কোথা থেকে! তাহলে কি শায়লা মারা যায়নি! হিমেল কি আমাকে মিথ্যে বলেছে। ওরা কি সেপারেশনে আছে! না, তা হয় কীভাবে। একজন মানুষ স্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে এত বড় মিথ্যে গল্প বলবে! সীমা আর কিছু ভাবতে পারছে না। মাথাটা দপ দপ করতে শুরু করল তার। ধীর পায়ে বাথরুমে ঢুকে ঝর্না ছেড়ে দিয়ে সে কতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল।

হিমেল বাসায় ঢুকেই উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইল, ব্যাপার কী বলো তো! ইমার্জেন্সি একটা রোগী দেখার কারণে আমার পৌঁছাতে দেরি হয়েছিল। তবে খুব বেশি দেরি হয়নি তো। আমি সাড়ে নটার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। তুমি আমাকে ফোন না দিয়ে রাগ করে ফিরে এলে কেন? এত রাগ কেন করেছ বলো তো? তুমি তো ডাক্তার, ইমার্জেন্সিটা তোমার বোঝা উচিত।

সীমা হতোদ্যম হয়ে হিমেলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে বিছানায় যেয়ে শুয়ে পড়ল। সীমার বুকের ধক ধক শব্দটা কিছুতেই থামছে না। সে বুকটা দুহাতে চেপে শুয়ে পড়ল। ওর আর হিমেলকে কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না। আর বলবেই-বা কী! মৃত বউয়ের সঙ্গে হিমেলকে সে জিলংয়ে দেখেছে! এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা!

হিমেল কিছুতেই বুঝতে পারছে না, সীমা ডাক্তার হয়েও কেন তার ইমার্জেন্সিটা বুঝতে পারছে না। এমন রেগে যাওয়ার কী আছে মাথায় ঢুকছে না হিমেলের। বিছানায় এসে হিমেল সীমাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু সীমা নিস্তেজের মতো বিছানায় পড়ে আছে, কোনো কথা বলছে না। হিমেল ভাবল, সীমা অনেক বেশি রেগে গেছে, থাক, এখন আর কিছু না বলাই ভালো। রাগটা কমলে পরে বুঝিয়ে বলব।

জিলংয়ের সেই ঘটনার পর থেকে সীমা ঝিম মেরে থাকে। সব সময় কী জানি চিন্তা করে। হিমেল মাঝে মাঝেই অনেক প্রশ্ন করে। কিন্তু সীমা এড়িয়ে যায়। কিছু বলে না।

একদিন অফিসে যাওয়ার জন্য দুজনে রেডি হচ্ছে। শাড়ি পরা শেষে সীমা শাড়িতে লাগানোর বড় সেপটিপিনটা হাতে নিয়ে হিমেলের কাছে যেয়ে বলল, এটা একটু আঁচলে লাগিয়ে দাও তো।

সীমা দেখল, হিমেল সেপটিপিনটা হাতে নিয়ে সীমার আঁচলে না লাগিয়ে তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে।

সীমা বলল, কী হলো, সেপটিপিনটা লাগাও।

হিমেল এবার সেপটিপিনটা আঁচলে না লাগিয়ে বাম হাত দিয়ে সীমার গলাটা শক্ত করে চেপে ধরে ডান হাতে ধরা সেপটিপিনটা দিয়ে সীমার গলা এফোঁড়-ওফোঁড় করতে লাগল। সীমা ব্যথায় চিৎকার করে উঠে এক ধাক্কায় হিমেলকে সরিয়ে দিয়ে এক দৌড়ে বাথরুমে ঢুকল। বাথরুমে যেয়ে সে দেখতে পেল, তার গলা বেয়ে টপ টপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সে ট্যাপ ছেড়ে গলার রক্ত পরিষ্কার করল। গলার বেশ কিছুটা জুড়ে কালসিটে দাগ হয়ে আছে। কাটা জায়গাগুলোর চারপাশ দিয়ে একটু একটু করে রক্ত গড়াচ্ছে। তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা হাতেই সীমা আফটার সেভের বোতলটা খুলে গলার ক্ষতস্থানে লাগল। এরপর সে মুখে চোখে পানির ঝাপটা দিতে শুরু করল। একটু পর সে মেঝেতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল।

আচমকা সীমার ধাক্কা খেয়ে হিমেল টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে ছিটকে পড়ল। সে লাফ দিয়ে উঠে বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সীমার উদ্দেশে বলছে, সীমা, আমি তো সেপটিপিনটা আঁচলে লাগাচ্ছিলাম। হঠাৎ তোমার কী হলো, তুমি আমাকে ধাক্কা মেরে বাথরুমে ছুটে গেলে কেন? সীমা দরজা খোলো, কী হয়েছে তোমার?

অনেকক্ষণ ধরে অনেক অনুনয় করেও সীমা দরজা খুলছে না দেখে হিমেল দরজাটা ভেঙে ফেলল। বাথরুমের দরজাটা ঘরের অন্যান্য দরজার চেয়ে হালকা হওয়ায় সে একাই দরজা ভাঙতে পারল। নিচে থেকে সিকিউরিটিকে ডাকার প্রয়োজন হলো না।

হিমেল বাথরুম থেকে সীমাকে কোলে করে তুলে এনে বিছানায় শুইয়ে দিল। মুখে-চোখে পানির ঝাপটা দিল। ফ্যান ছেড়ে দিল। কিছুক্ষণ পর সীমার জ্ঞান ফিরল। হিমেলের দিকে চোখ পড়তেই সীমা চিৎকার দিয়ে উঠল, তুমি আমাকে মেরো না। প্লিজ হিমেল, তুমি আমাকে মেরো না। সীমা বিছানা থেকে নেমে ছুটে অন্য ঘরে যেয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। হিমেল এবার নিচ থেকে সিকিউরিটিকে ডেকে আনল। দুজনে মিলে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকল। হিমেলের দিকে চোখ পড়তেই সীমা চিৎকার দিয়ে উঠল, প্লিজ, হিমেল আমাকে মেরো না।

সীমাকে ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করানো হয়েছে। চিকিৎসা করানো হচ্ছে কিন্তু সীমার অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। সারাক্ষণ সে চিৎকার করে বলে, প্লিজ, হিমেল আমাকে মেরো না। ডাক্তার এলেই সে বারবার বলে, দেখুন, ডাক্তার সাহেব আমার গলাটা সেপটিপিন দিয়ে কীভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে হিমেল, দেখুন। এখনো টপটপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, দেখুন। ডান হাত দিয়ে গলা মুছে সে ডাক্তারের মুখের সামনে হাতটা মেলে ধরে বলে, এই যে, গলা দিয়ে আমার কত রক্ত ঝরছে। দেখুন, ডাক্তার সাহেব আমার রক্তমাখা হাতটা দেখুন। জানেন, ডাক্তার সাহেব, হিমেল শায়লার সঙ্গে রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়ায়, রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। জানেন, আমি নিজের চোখে দেখেছি, জিলংয়ে ওরা একসঙ্গে বসে খাচ্ছিল।

ছয় মাস পেরিয়ে গেল কিন্তু সীমার কোনো উন্নতি হলো না। অবশেষে ঢাকা মেডিকেল থেকে সীমাকে পাবনা মানসিক হসপিটালে ভর্তি করিয়ে ফিরে এলো হিমেল।

 

জানো হিমেল, আমার মনে খুব কষ্ট, খুব যন্ত্রণা! হিমেল ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে দেখতে পেল, শায়লা বিছানার এক পাশে বসে আছে।

হিমেল বলল, কেন?

সীমা যে তোমার পাশে এই বিছানায় শুয়ে ছিল, তোমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছে আরও কত কিছু করেছে! আমি যে সহ্য করতে পারছি না হিমেল, আমার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে!

তার জন্য ওকে তো শাস্তি দিয়েছ। পাগল বানিয়েছ। এখন তো তোমার শান্তি পাওয়া উচিত, ভালো থাকা উচিত।

না, আমি শান্তি পাচ্ছি না। সীমাকে কেটে টুকরা টুকরা করলেও আমি শান্তি পাব না হিমেল। কেটে টুকরা টুকরা করলেও সীমা যে এই বিছানায় শুয়ে তোমার সঙ্গে...। সেই দৃশ্য তো মুছে যাবে না হিমেল।

ওকে শাস্তি দিলে কেন তুমি? তোমাকে দেওয়া কথা না রেখে, অপরাধ তো করেছি আমি। আমাকে শাস্তি দিতে। আমার অপরাধের শাস্তি তুমি সীমাকে দিলে কেন?

আমি যে তোমাকে ভালোবাসি হিমেল!

চুপ! একদম চুপ! এমন মিথ্যে আর বানোয়াট কথা আর কখনো বলবে না তুমি, হিমেল চিৎকার দিয়ে ওঠে।

আমার নিঃসঙ্গতা দেখে শান্তি পাও তুমি। আমার কষ্ট দেখে চোখ জুড়ায় তোমার। আমাকে সুখে থাকতে দেখে গা জ্বলে তোমার। আর বলছ, তুমি আমাকে ভালোবাসো!

পৃথিবীতে সবার ভালোবাসা একরকম হয় না হিমেল। আমার ভালোবাসা এমনই!