ভুলে যাওয়া গল্প
একদিন সকালের পত্রিকার ভেতরের পাতায় ছোট্ট এক সংবাদ আমাদের অস্থির করে তোলে। যদিও এই পুঁজিবাদ সমাজে টিকে থাকার জন্য অর্থকড়ি উপার্জনের সংগ্রামে আমাদের ব্যস্ত হয়ে যেতে হয়। আমরা সকালে পড়া সংবাদটা ভুলে থাকি সারা দিন। কেউ চাকরিতে, কেউ ব্যবসায়, কেউবা কোনো না কোনো ধান্দাবাজিতে সময় পার করে রাতে ঘরে ফেরার পর আবার সংবাদটা মাথায় এসে ঝাঁকুনি দেয়। আবার আমরা দিনের পচে যাওয়া পত্রিকাটি খুলি বসে থাকি। চলে যাই ভেতরে ছোট্ট সেই সংবাদে। যার শিরোনামে লেখা– ‘রাজাকারের নাতিকে হত্যা, পুলিশ বলছে ক্লুলেস’।
আমরা সংবাদটা পড়ি। কারণ, সেখানে নাম থাকে ইদ্রিস তালুকদারের। সে আমাদের চেনা, আমরা একই গ্রামের।
ইদ্রিস তালুকদারকে মশকরা করে ‘বাটপার’ বলে ডাকা হতো। কেউ কেউ তাকে ‘বলদ ইদ্রিস’ বলেও ডাকত। তবে ‘বাটপার’ শব্দটা সংবাদে দেখে আমাদের সবার মন খারাপ হয়। এ শব্দটা কি জরুরি ছিল সংবাদে? আমাদের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়।
সংবাদে তার দাদা ইসহাক তালুকদার একজন রাজাকার সেটা বলা থাকে। সংবাদের কোথাও অবহেলাক্রমেও নাম বলা হয়নি তার পিতার। কিন্তু আমরা জানি, ইদ্রিসের পিতার নাম ইব্রাহিম তালুকদার। তিনি মারা যান ১৯৭১ সালে।
ইদ্রিস তালুকদারের মৃত্যুসংবাদে আমরা সবাই মুষড়ে পড়ি। মনে পড়ে মদনপুর গ্রামে আমাদের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিগুলো। তাকে দেখে দেখেই আমরা বড় হয়েছিলাম।
গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোর ভিড়ে মিশে যাওয়া সেই ইদ্রিস তালুকদারের মুখচ্ছবি আমাদের মানসপটে আবার ভেসে ওঠে। ক্রমাগত তার ‘বাটপার’ কিংবা ‘বলদ’ বিশেষণটি আমাদের মগজে অনুরণন তোলে। এই অর্থনৈতিক বিপত্তির মধ্যে টিকে থাকার লড়াইয়ে গ্রামের সেই ইদ্রিসকে আমরা কবেই ভুলে গিয়েছিলাম, তা-ও মনে করা দুষ্কর হয়ে ওঠে।
ইদ্রিসের সঙ্গে নানান সময় আমাদের আড্ডার স্মৃতিগুলোও মনে পড়তে থাকে। মনে পড়ে নিতান্ত গরিব ঘরের হওয়া সত্ত্বেও ইদ্রিস কীভাবে উপজেলা পর্যায়ের রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিল। তার সুবিধাবাদী রাজনীতি তাকে আলাদা পরিচয়ও এনে দিয়েছিল। আমাদের মনে পড়ে, ইদ্রিস বলত, সে নিতান্ত এক রাজনৈতিক কর্মী। কিন্তু রাজনীতিতে তার কোনো আদর্শ ছিল না। তার নীতি ছিল—ক্ষমতা যার আদর্শও তার।
আমাদের মদনপুর গ্রামে যে লাল দল আর সাদা দল আছে তাদের সঙ্গেই ইদ্রিসের সম্পর্ক গভীর। যখন যেই দল ক্ষমতায় ইদ্রিস তাদের দলেরই। তাদের মিছিলেই গলা ফাটাত। নিজের পরিচয় লাল থেকে সাদা কিংবা সাদা থেকে লাল মুহূর্তেই বদলে ফেলার এক মুনশিয়ানা ছিল ইদ্রিসের। এ জন্য দুই দলের কেউ যে তার ওপর নাখোশ ছিল, বিষয়টা এমনও নয়। সবাই বরং তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে সময় পার করত। তারাই ইদ্রিসের নামের আগে ‘বাটপার’ শব্দটা সেটে দিয়েছিল।
একবার আমরা ইদ্রিসকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা ভাই, আপনি যে এমন বেহায়াদের মতো ক্ষমতার পেছন পেছন ছোটেন, এটা কেন?
ইদ্রিস ছিল লম্বা-চওড়া। দেখতেও মন্দ ছিল না। অপরিষ্কার পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরা না থাকলে তাকে এলাকার ধনীদের কেউ বলেই মনে হতো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার হাজার চেষ্টা ছিল তার। শুধু অর্থাভাবে পেরে উঠত না। তার পাঞ্জাবিটা দেখলেই লোকে বুঝত—ব্যাটা একটা ফকিন্নি।
ইদ্রিস আমাদের বলত, বাইরে, রাজনীতির খেলটা তো ক্ষ্যামতারই। আইজ এই দল ক্ষ্যামতায় তো কাইল ওই দল। বুইজ্জোস্যি? আঁই এলাকার হোলা দে-ই দোনো দলের লগেই থাই। সমইস্যা আছেনি কোনো? আঁই তো চুরি-ডাতি করি নো, ক্যান?
ইদ্রিসের এই সহজ স্বীকারোক্তি আমাদের অদ্ভুত লাগত। সহজ-সরল তার নিজস্ব একটা ব্যাখ্যা সে সব সময়ই দিত।
একবার লাল দল যখন ক্ষমতায় এলো, তখন তাদের নেতা বলল, এবার বাটপার ইদ্রিসকে দলে নেওয়া হবে না। শালা ইলেকশনে আমাদের ভোট দেয় নাই।
এটা কোনো না কোনোভাবে ইদ্রিসের কানে গেল। সে দৌড়ে যায় লাল দলের প্রধান ইকবাল আহমেদের কাছে।
হাসতে হাসতে অভিনন্দন জানিয়ে বলে, ইকবাল বাই, মাইনষে কয় বোট বলে অয় নো এবার। রাইতেই বলে ছিল মারি রাইকছে আন্নের লোকজন। আঁই কইনো বাই, মাইনষে কয় আরি।
সদ্য ক্ষমতায় আসা ইকবাল এ কথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছিল।
—হাউয়ার হোলা হাউয়া, বিরুদি দলের বাটপার তুই। এগিন তো তুই কইবিই। ইয়ানতুন বারুই যা।
—ইকবাল বাই। আঁই তো কইনো। আন্নে আঁর উপরে চেতেন কিল্লাই? আমনের মতো ফাবলিকের বোট-মোট লাগেনি? আরে বাই, আমরা কি এগিন বুঝিনানি? এলাকার জনগণ তো জানে আন্নে অইলেন জিতোনের ফাবলিক। হেতাগোরে আঁই কই দিছি- তোগো লগে আঁই আর নাই। হালা হারুপাট্টির দল।
ইকবাল আহমেদ তার কথায় কিছুটা দুর্বল হয়। সে ভাবে, ইদ্রিসকে সাথে রাখলে দোষের কিছু নেই। সে তো কারও ক্ষতি করে না। শুধু যখন যে ক্ষমতায় তার সাথে থাকে। এটা তো দোষের না, অপরাধের না। বরং ইদ্রিস পাশে থাকলে বিরোধী দলের কৌশল জানা যায়। যোগাযোগ ভালো তার সবার সাথে।
ইকবাল হাসতে হাসতে ইদ্রিসকে কেন যেন জড়িয়ে ধরে। তারপর বলে, হালার ঘরের হালা, তেল মারাছ, ক্যান? ল’ ১০০ টিঁয়া ল’।
এটাই ইদ্রিসের কাজ। ক্ষমতার সঙ্গে বসে থাকা। এর বেশি তার কোনো কাজ নেই। এটাই তার চাকরি। সে বিরোধী দলের সঙ্গেও আড্ডা দেয়। এসব কারণে তাকে কেউ কেউ পাগলা ইদ্রিস, কেউ টাউট ইদ্রিসও ডাকে। তবে ‘বাটপার’ই তার আসল পরিচয়। এই নামেই সে বিখ্যাত।
তবে আমরা যখন কিশোর বয়স পার করে তারুণ্যে ঢুকেছি কেবল, তখন আমাদের কাছে ইদ্রিস মোটেও বাটপার হয়ে ছিল না। আমাদের কাছে মনে হতো সে একটা ‘বেকুব’। ছোটবেলা থেকে সংগ্রাম করে কোনোমতে টিকে থাকার লড়াইয়ে সে তার সহজ-সরল অবয়বটাকে সামনে এনে হাজির করে মাত্র। সে সবাইকে আপন ভাবে, সে মনে করে এটা তারই মাটি, তারই এলাকা, তারই গ্রাম। তাই এখানে মিলেমিশে থাকাটাই তার জন্য পেটে-ভাতে টিকে থাকার একমাত্র উপায়।
আমরা জানি, ইদ্রিস কারও ক্ষতি করে না। আমরা জানি, কারও হক মেরে খাওয়ার মতো ক্ষমতাও তার ছিল না। আমরা জানি ইদ্রিস নিয়মিতভাবে রাজনৈতিক নেতাদের, কর্মীদের, গ্রামের মুরব্বিদের চড়-থাপ্পড় খেয়ে খেয়ে বয়স বাড়াচ্ছে। পার্টি অফিস ঝাড়ু দেয়া, চা-শিঙাড়া এনে দেয়া, নেতাদের বাজার সদাই করে দেওয়া ছাড়া ইদ্রিসের তো আর কোনো কাজই ছিল না। এলাকায় রাজনৈতিক সভার মাইকিং হবে—তো সারা দিন এ কাজটা নিরলসভাবে করবে কে? তখন ডাক পড়ত ইদ্রিসের। রাজনৈতিক সভার পর পুরো মাঠটা পরিষ্কার করবে কে? ডাক পড়ত ইদ্রিসের। বিনিময়ে তার ঘরে হয়তো চুলা জ্বলত। এটা আমরা ধারণা করতাম। সারা দিন বলদের খাটনি খাটত বলে আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে ইদ্রিসের পরিচয় ছিল ‘বলদ ইদ্রিস’।
ইদ্রিসকে একবার আমরা জিজ্ঞেস করি, আপনি পড়েছেন কত দূর? এই প্রশ্নে ইদ্রিস হাসে আর বলে, হইড়ছি, এই ধর হাইব সিক্স হর্যন্ত। এর বেশি হড়ি ন। গরিবের আবার হড়া কী আর লেয়া কী। না জাইনলেও গরিব, জাইনলেও গরিব।
আমাদের মধ্যে সবচাইতে মেধাবী ছেলেটা বলে উঠত, এটা তো ঠিক না ইদ্রিস ভাই। আপনি পড়াশোনা করলে বড় হতে পারতেন। ভালো চাকরি-বাকরি কিংবা ব্যবসাও করতে পারতেন। দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে পারতেন।
এ কথারও উত্তর ইদ্রিসের কাছে থাকে। সে বলত, চ্যাটের কথা কইতে আইছো, ক্যান? এ দেশের সরকারি অপিসে তো সবই শিক্ষিত। ফাবলিকের ট্যাক্সের টিঁয়ায় বেতন হায়। তো, হালারপুতেরা জনতার কাম করে না কিল্লাই? কাম কইত্যে গুষ চায় কিল্লাই? হেতারাই তো আঁর-তনো বড় বাটফার। হেগুনরে কেউ কিছু কয় না, ডরায়। বড় অপিসার, চোর তো অইছে কী। হেতারা হইড়ছে চুরির লাই। হাছানি কও?
ইদ্রিসের কথার উত্তর আমাদের কাছে নেই। তার যুক্তি সঠিক কি বেঠিক, তা আমাদের মাথায় ঢোকানোর সাহস নেই। ইদ্রিস যা অবলীলায় বলতে পারে, আমরা সভ্য তরুণ সমাজ তা বলতে পারি না। আমরা তো ভিতু-কাপুরুষ।
একবার পড়া শেষ করে গ্রামে গেলে ইদ্রিসকে দেখেছিলাম চা-দোকানে বসে বসে আড্ডা দিতে। আমাদের কয়েকজনকে দেখে দৌড়ে আসে।
—কী রে হড়া-ল্যা শেষনি তোগো?
আমরা যখন হ্যাঁ বলে মাথা নাড়াই। ইদ্রিস তখন হাসে আর বলে, আইচ্ছা, তই অন কি বস্তা টস্তা বরি বেগ্গিন নিতি আইছোস, ক্যান?
আমরা জানতে চাই সে এই কথা কেন বলল। তখন হাসতে হাসতে বলে, এ-ডাই তো সিস্টেম। গেরামে ফয়দা অইবা, শহরে শিক্ষিত অই চাকরি কইরবা, ব্যবসা কইরবা—গেরামে ঈদ কইত্যে আইবা। ইয়ারহর বাপ-মা মরি গেলে বছর দুই বছরে একবার আইবা। এ-ডাইতো সিস্টেম। এ-ডাই তো দেই আইসতেছি।
তার কথা আমাদের শরীরে কাঁটার মতো বিঁধে। ইদ্রিস যেন আমাদেরও বাটপার বলতে চায়। আমরা যখন বলি, এ কথা বলেন কেন? গ্রামে তো চাকরি নেই। তাই সবাই শহরে যায়।
ইদ্রিস হাসে। কিন্তু এবার সে কোনো কথা বলে না। সে হাসতে হাসতে চলে যায়।
এ ঘটনার কয়েক মাস পর গ্রামে পুরোনো এক কথা নতুন করে চাউর হলো। আমরা জানতাম এর মীমাংসা বহু আগেই গ্রামে হয়ে গেছে। মুরব্বিরা এসব নিয়ে কথা বলাই ছেড়ে দিয়েছিল। তো, সেই নতুন করে চাউর হওয়া কথাটা হলো, ইদ্রিসের দাদা ছিল রাজাকার। ৭২ সালে সেই রাজাকার মারা যায়।
আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি–রাজাকার হলেও ইসহাক কারও কোনো ক্ষতি করেনি। কেউ অভিযোগ আনতে পারেনি বলে ইসহাক তালুকদারকে দেশ স্বাধীনের পরে কেউ সমস্যা করেনি। যদিও তার রাজাকার হওয়ার বিষয়ে অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও নানান পক্ষ-বিপক্ষ আছে।
কেউ বলত, বাধ্য হয়ে ইসহাক রাজাকার লিস্টে নাম লিখিয়েছিল। ইসহাকের ঘরে ছিল তার স্ত্রী, তিন কন্যা, এক পূত্র ও পুত্রবধূ। এই কন্যাদের ও পুত্রবধূর নিরাপত্তা দিতেই রাজাকার লিস্টে নাম দিয়েছিল ইসহাক। কেউ কেউ বলত, ইসহাক ছিল নিতান্তই গরিব। ছেলেও সাহায্য-সহযোগিতা করে কুলাতে পারত না এই বড় সংসার। পেট বাঁচাতে, সংসার বাঁচাতে ইসহাক হয়েছিল রাজাকার। আবার কেউ কেউ বলত, রাজাকার নামের আড়ালে আসলে ইসহাক মুক্তিযোদ্ধাদেরই সাহায্য করত। ঘরে অস্ত্র লুকিয়ে রাখত। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার পাঠাত।
সবই ছিল গালগপ্প। এসবের কোনো প্রমাণ কখনো কেউ দেখাতে পারেনি। শুধু গল্প হয়েই ছিল। গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারাও কখনো এসব বিষয়ে বলেনি; বরং ইসহাককে রাজাকারই বলত।
মুক্তিযুদ্ধের বছর রাজাকার ইসহাকের বয়সও ছিল ৭১। রাজাকার লিস্টে নাম থাকায় এবং বয়সের কারণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে বিরক্ত করেনি। তার বাসায় কখনো কেউ উঁকি দেয়নি।
কেউ কেউ বলে, সে গরিব হোক আর মিসকিন কিংবা তার তিন কন্যা থাকুক কিংবা এক পুত্রের স্ত্রী। তাতে তার রাজাকার তকমা মুছে যায় না। বড় কথা হলো– তার দেশপ্রেম ছিল না। দেশপ্রেম থাকলে কেউ রাজাকার হয় না।
এই নানান পক্ষ-বিপক্ষ যুক্তি-তর্ক ওই আমলে নাকি তেমন ছিল না। এমনকি ইসহাক তালুকদার যখন মারাও যায়, তখনও তার রাজাকার হওয়া নিয়ে কেউ টুঁ-শব্দও করেনি বলে মুরব্বিরা বলত। বরং সবাই তখন মেনেই নিয়েছিল– নিতান্ত গরিব ইসহাক অর্থকষ্ট ও ঘরের মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্যই রাজাকার লিস্টে গিয়ে নাম দিয়ে এসেছিল।
তবে গ্রামে এত কাল পর হঠাৎ এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হলো। কেন হঠাৎ শুরু হলো কিংবা কারা এসব শুরু করল, তার কিছুই আমরা জানি না।
বলা শুরু হলো, ইসহাক রাজাকার লিস্টে ছিল এটাই হলো আসল সত্য। তো, এই সত্যই শক্তিশালী হয়ে উঠল। আর ইদ্রিস যে রাজাকারের নাতি, সেটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।
রাজাকার ইসহাকের নাতি হওয়ার অপরাধে তাকে টাকাপয়সা দিয়ে যারা সাহায্য-সহযোগিতা করত, তারা বন্ধ করে দিল। ক্ষমতায় যারা ছিল তারা তাকে দূর করে দিল। বিরোধী দল ভাবল, এই রাজাকারের নাতিকে দলে ভিড়ালে আদতে রাজনৈতিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাই তাকে না নেওয়াই ভালো। কিছু করে যে খাবে সেসব পথ ধীরে ধীরে রুদ্ধ হয়ে গেল। সবাই ভাবতে লাগল, ইদ্রিসকে সাহায্য করলে যদি তাদেরও রাজাকার বানিয়ে দেওয়া হয়।
শুরু হলো ইদ্রিসের নতুন কষ্ট। সেটা হলো অর্থকষ্ট।
এ নিয়ে মহা বিপাকে ইদ্রিস একদিন মসজিদের পুকুর পাড়ে বসে একদৃষ্টে ঠায় তাকিয়ে ছিল। সে কী ভাবছিল আমরা জানি না।
আমরা যখন ইদ্রিসের পাশে বসি। তখন তার এক চোখ দিয়ে পানিও পড়েছিল। মনে হয়েছিল, এক বিশাল সমুদ্র থেকে হুট করে এক ফোঁটা পানি ছিটকে পড়ে গেল। ইদ্রিসকে আমরা তার দাদার কথা জিজ্ঞেস করি। সে বলে, দাদারে কি দেখছিনি আঁই? বাপেরেও তো দেই ন। দাদা মইচ্ছে ৭২ সালে, বাপ মইচ্ছে ৭১ সালে। বাপ যন মইচ্ছে তন আছিলাম মার হেডে, দাদা যন মইচ্ছে তন যে বয়স আছিল, হেইডা কি আঁর মনে আছেনি?
শুনে আমাদেরও খারাপ লাগে। কিন্তু তবু তার দাদা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস না করে বাবা সম্পর্কে জানতে আমরা আগ্রহী হয়ে উঠি। আমাদের মনে হয় ৭১ সালে তার বাবা ইব্রাহিম তালুকদার কীভাবে মারা গেল, তা জানা দরকার।
ইদ্রিসকে আমরা জিজ্ঞেস করি, আপনার বাবা কীভাবে মারা গেছে জানেন নাকি?
ইদ্রিস বলে, মার কাছে হুইনছি, তার লাশ হাওন গেছে নদীর হাড়ে। কেউ গুলি টুলি করি গেছে আরকি।
কে গুলি করল এই প্রশ্ন আমরা আর করি না। আমরা ভাবি রাজাকারের সন্তানকে হয়তো কোনো মুক্তিযোদ্ধা কিংবা গ্রামেরই কেউ গুলি করে হত্যা করেছিল।
আমরা ধরে নিলাম ‘ইদ্রিস রাজাকারের নাতি’—এটাই তার পরিচয়। এর বেশি তার সম্পর্কে জানার কোনো দরকার নেই। দেশপ্রেম থাকলে কেউ তো রাজাকারের তালিকায় নাম লেখাবে না। আমরাও ছিলাম ওই পক্ষেরই। বাকি পক্ষদের আমরা নাম দিয়েছিলাম সংশয়ী পক্ষ। এরা ইতিহাস নিয়ে বেশি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। ইতিহাসে নিয়ে এত কথা চলে না। ইতিহাস হলো লিখিত বিষয়। ইতিহাসের কাগজে ইসহাক তালুকদার একজন রাজাকার। তাই সে রাজাকার। আমরা এই বাস্তব সত্যটাই মেনে নিই। আর আমরাও বলা শুরু করি, ইদ্রিস রাজাকারের নাতি।
ইদ্রিসের প্রতি আমাদের মায়া-দরদ যতটুকু ছিল সেটা কমে গেল।
আমরা সবাই যখন শহরে চাকরি কিংবা ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম, ঠিক ঠিক ঈদ ছাড়া বাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। আমরা যখন ঈদে বাড়ি যেতাম তখন আর ইদ্রিসকে দেখা হতো না। আমরা শেষ কবে তার খোঁজ নিয়েছিলাম, তা আর মনে পড়ে না। শেষ কবে দেখা হয়েছিল তা-ও মনে পড়ে না। শুধু পুকুরে নিঃসঙ্গ ইদ্রিসের এক চোখ বেয়ে পানি পড়ার ঘটনাটাই আমাদের মনে পড়ে।
জীবিত থাকতে যে মানুষটা স্মৃতিতে মৃত ছিল, মৃত হওয়ার পর জীবিত হয়ে উঠল। কী অদ্ভুত এক জীবনসংসার আমাদের।
তবু রাজাকারের নাতির জন্য কেন এত বিচলিত হলাম– সেটাও বিরাট প্রশ্ন তৈরি করে।
এসব ভাবতে ভাবতেই আমাদের চোখে ঘুম লেগে আসে। রাত গভীর হতেই আমরা ঘুমিয়ে যাই। সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার ভুলে যাই ইদ্রিসকে। কিন্তু ভুলতে দেয় না। পরদিন পত্রিকার ভেতরে আরেকটা বিবৃতির সংবাদ আমাদেরকে কুঁকড়ে দেয়।
আমাদের মানসপটে এবার আবার ‘বাটপার ইদ্রিস’ হাজির হয়। এক অনুতপ্তবোধ অপরাধবোধ আমাদের ছেয়ে ফেলে। মনে হয় ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা কিছুই দেখিনি। আমরা জ্ঞানহীন, পাপী, অভিশপ্ত।
এক মুক্তিযোদ্ধা যিনি এখন প্রবাসী। তাঁর এক বিবৃতি আগের দিনের সংবাদের প্রতিবাদে ছাপা হয়। যেখানে বলা হয়, মদনপুর গ্রামের কৃষক ইব্রাহিম তালুকদার একজন মাঝি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় গভীর রাতে নৌকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নদী পার করে দেওয়াই ছিল তার কাজ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বহুবার সে এ কাজ করেছে। এক রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী খবর পেয়ে ঘাটে এসে গুলি করে হত্যা করে ইব্রাহিমকে। ইতিহাসের কোথাও ইব্রাহিম নামটা লেখা নেই। কিন্তু আমার মনের গহিনে লেখা আছে—একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম তালুকদারের নাম। তার রক্ত মিশে আছে এ দেশের মাটিতে। ইদ্রিস তালুকদার রাজাকারের নাতি নয়, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আপনাদের সংবাদের শিরোনামের তীব্র প্রতিবাদ জানালাম। একই সঙ্গে ইদ্রিস তালুকদারের হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারও দাবি করলাম।
এই বিবৃতি পড়ে ইদ্রিসকে আমরা আর ভুলতে পারি না। আমাদের মধ্যে তৈরি হয় হাজারো প্রশ্ন। ইদ্রিস কি জানত না তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল? মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কাগজ-কলমে নাম ছিল না বলে ইদ্রিস কি কখনো বলেনি? নাকি রাজাকারের ছেলে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধা হয়, সেটাই সে বিশ্বাস করতে পারেনি?
ইদ্রিসের মা, এলাকার লোকজন, এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা—এরা কেউ কি জানত না এই মাঝি মুক্তিযোদ্ধাদের নদী পার করে দেওয়ার কাজ করত? নাকি তারা ভাবত নদী পার করে দেওয়া তো যুদ্ধ করা নয়। তার হাতে তো অস্ত্র ছিল না। সে তো নিতান্তই গরিব মাঝি। এদের কেউ একজনও কি জানত না—এই লোকটাকে পাকিস্তানি কুৎসিত সেনাবাহিনী হত্যা করেছিল?
এসবের কিছুই আমাদের আর জানা হয় না। আমরা ধরে নিই, ইতিহাসের পাতায় এমন হাজার হাজার ইদ্রিস আছে। কত মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের ভাত খাইয়েছে, ঘরে আশ্রয় দিয়েছে, কত কৃষক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজের জমিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র লুকিয়েছে, কত মাঝি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নদী পার করে দিয়েছে। এরা কি মুক্তিযোদ্ধা নাকি?
তবু আমরা আশ্বস্ত হই, ইব্রাহিমের মতো শত শত হাজার হাজার দরিদ্র জনগোষ্ঠীও এই যুদ্ধের অংশ ছিল। তারাও যে মুক্তিযোদ্ধা, এটা একজনই হয়তো বুঝতে পেরেছিল। আর তাই সুদূর প্রবাস থেকে স্বাধীনতার এতকাল পর কেউ একজন ইদ্রিসের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল তার মৃত্যুর পর। এবার আমরা ভাবতে থাকি, তবে ইদ্রিসকে কারা, কেন হত্যা করল?
এসব ভাবতে ভাবতে আবার রাত চলে এলো। আমরা ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে ইদ্রিসকে আর মনে পড়ল না।