প্রাচ্য কাব্যতত্ত্বে কাঠামোবাদ এবং নিজেদের দিকে ফেরা

 

সাহিত্য তত্ত্বের অনুগামী নয়। বরং তত্ত্বই সাহিত্যকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠে। টেরি ঈগলটন তো মনেই করতেন, সাহিত্যতত্ত্ব সাহিত্যবিরোধী। তত্ত্বের কীটসদৃশ বৈশিষ্ট্য সাহিত্যকে ভিতর থেকে ধ্বংসই করে। তথাপি গত শতাব্দী থেকে সাহিত্যালোচনায় তত্ত্বকে নানা প্রাসঙ্গিকতায় খুব জোরালোভাবেই উঠে আসতে দেখি। সেই আলোচনায় গঠনবাদ বা কাঠামোবাদ সম্ভবত সর্বাধিক পাত্তা পেয়ে আসছে। যদিও সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্য সমালোচনার একটা প্রভেদরেখা কখনো বজায় থেকেছে অথবা একাকার হয়ে গেছে। পাঠকদের বোঝার স্বার্থে একটি কথা বলে রাখা ভালো যে, গঠনবাদ বা কাঠামোবাদ পর্যালোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হলো একটা বিস্ময়কর ব্যাপারকে সামনে আনা। তা হলো গঠনবাদ, উত্তর-গঠনবাদ এবং বিনির্মাণবাদ ইউরোপে প্রবর্তিত হবার বহু পূর্বে প্রাচ্য কাব্যতত্ত্বে সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু কোনো ইউরোপীয় তাত্ত্বিক সেই ঋণ স্বীকার করেননি বা প্রয়োজন বোধ করেননি সামান্য আলোকপাতের। এমনকি প্রাচ্যের তাত্ত্বিকদের মধ্যেও সম্ভবত ঔপনিবেশিক মানসিকতা জোরালো হওয়ায় পাশ্চাত্যের তত্ত্ব গ্রহণে আত্মতুষ্টির প্রবণতা আছে। হাস্যমুখে দাস্যবৃত্তি পরিত্যাগ করে নিজেদের তাত্ত্বিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ আহরণে নিজের দিকেই যে মুখ ফেরানো দরকার, তা জোরালোভাবে প্রমাণ করেছেন গোপীচন্দ নারঙ তাঁর বিখ্যাত উর্দু সমালোচনাগ্রন্থে। গ্রন্থের নাম সখতিয়ত্, পস্ সখতিয়ত্ আউর মশরিকি শরিয়ত। বইটি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত। গঠনবাদ, উত্তর-গঠনবাদ এবং প্রাচ্য কাব্যতত্ত্ব শিরোনামে বাংলায় অনুবাদ করেছেন সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুবাদ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য অকাদেমি।

অধ্যাপক নারঙ প্রাচ্য অর্থাৎ উর্দু, ফারসি, আরবি ও সংস্কৃত এবং পাশ্চাত্য কাব্যতত্ত্বের বিশদ আলোচনা করেছেন। তুলনামূলক আলোচনায় দেখিয়েছেন গঠনবাদ, বিনির্মাণবাদ এবং উত্তর-গঠনবাদ পাশ্চাত্য কাব্যতত্ত্বে তত্ত্ব হিসেবে আলোচিত হওয়ার বহু আগেই প্রাচ্য কাব্যতত্ত্বে বিদ্যমান ছিল। পরিসর বিবেচনায় আমার আলোচনা কাঠামোবাদেই সীমিত রাখব। আলোচনার সুবিধার্থে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইংরেজি সাহিত্য অন্তর্ভুক্তির প্রেক্ষাপট এবং কাঠামোবাদের নানা দিক নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলবার প্রয়োজন বোধ করছি।

১৮২৮ সালের আগে ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি সাহিত্য পড়ানোই হতো না। গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব এবং গণিত পড়ানো হতো। কেবল পুরুষ এবং এঙ্গলিকানপন্থীরাই এসব পড়ার সুযোগ পেত। অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছোট ছোট কলেজে পাঠদান হতো ধর্মীয় বিদ্যালয়ের মতোই। সর্বময় ক্ষমতা ছিল চার্চ অব ইংল্যান্ডের হাতে। পরে নারী-পুরুষ ও সকল ধর্মের মানুষ কলেজগুলোতে ডিগ্রি নেবার অধিকার পায়। ১৮২৮ সালে ইংরেজি পাঠ্যবিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু মুখ্য ছিল ইংরেজি ভাষা। সাহিত্য ভাষার প্রয়োজনে যতটা প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে আসত, অতটুকুই ছিল তার গুরুত্ব। ১৮৩৯ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন প্রথম ইংরেজি সাহিত্য পড়ানো শুরু হয় তার পেছনে একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কার্যকর ছিল। মধ্যবিত্তের নিচের শ্রেণিভুক্ত তেমন কেউ গির্জায় যেত না। ফলে তাদের জাতীয়তাবোধ, দেশের প্রতি অংশীদারত্বের ধারণা, নৈতিকতার ভিত্তি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজ নৈতিক শিক্ষার অভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে, বিপ্লব ঘটে যেতে পারে অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে। ইংরেজি সাহিত্যপাঠ দেশের রাজনৈতিক অবস্থা অপরিবর্তিত রাখতে ভূমিকা রাখবে বলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের ধারণা ছিল। ফলে ইংরেজি সাহিত্যপাঠ ছিল ধর্মীয় শিক্ষার বিকল্প হিসেবে একটা প্রতিস্থাপন মাত্র। যদিও অ্যারিস্টটলের পোয়েটিকস সাহিত্যতত্ত্বের প্রাচীনতম ভিত্তি, ইংরেজি সাহিত্যেতত্ত্বের আনুষ্ঠানিক প্রবেশ ঘটে উদার মানবতাবাদের মাধ্যমে। এর আগে নিউ ক্লাসিসিজম বা রোমান্টিসিজমের মতো বিষয়াদি তাত্ত্বিক গুরুত্বসহ কবিরা প্রস্তাবনা আকারে ব্যক্তিগতভাবে বা জোটবদ্ধভাবে মেনে চলতেন।

কলোনিয়াল হ্যাঙ ওভার পরিহার করে অনুবাদের মাধ্যমে ভারতীয় অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের দিকে আমাদের নজর দেওয়া দরকার। এশিয়ান অঞ্চলের শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের ভাব বিনিময় এবং আদান-প্রদান খুবই কম। হতে পারে কোরিয়ান সাহিত্যের মতো এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নিজস্ব ভাববস্তু এবং গড়ন নিয়ে মূল্যবান সাহিত্য গড়ে উঠছে। হাতের নাগালে হলেও যার খবর আমরা রাখি না। এসব নিকটবর্তী দেশের শিল্প-সাহিত্যই হতে পারে স্বকীয়তা নিয়ে দাঁড়াবার প্রণোদনা

ইংরেজি পাঠ্যবিষয় হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জায়গা পাওয়াতে এবং সকল ধর্মের নারী-পুরুষকে ডিগ্রি দেবার মতো বিধান প্রতিষ্ঠা হওয়ায় উদার মানবতাবাদের পথ প্রশস্ত হয়। ফলে কেমব্রিজের শিক্ষক আই. এ. রিচার্ডস ১৯২০ সালের দিকে ভাষা ও সাহিত্যকে ভিন্ন পাঠ্য বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সাহিত্য সমালোচনা ভাষাতত্ত্ব, সুনির্দিষ্ট সামাজিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আত্মজৈবনিক বিবেচনা থেকে মুক্ত ছিল। সমালোচক মুদ্রিত সাহিত্যকে নিবিষ্ট পাঠের মাধ্যমে বিবেচনা করতেন। মহৎ সাহিত্যের একটা শাশ্বত রূপের প্রতি সমালোচকদের বিশ্বাস দৃঢ়মূল ছিল। ১৯৬০ সাল থেকে সাহিত্য সমালোচনা আবার ভাষাতত্ত্ব, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিত, ইতিহাস ও দর্শনের আলোকে বিবেচ্য হতে থাকে। কাঠামোবাদ এবং উত্তর-কাঠামোবাদ সেই বিবেচনার পরিণতি।

নৃতাত্ত্বিক ক্লড লেভি স্ট্রস এবং সাহিত্য সমালোচক রলাঁ বার্থ, ফার্নানান্দো দ্য সস্যুর ভাষাতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ফ্রান্সে কাঠামোবাদ আন্দোলন শুরু করেন। সস্যুর মতে কোনো শব্দের অর্থ নির্বাচন একটা স্বেচ্ছাচারী প্রক্রিয়া। শব্দ ও প্রকাশিত অর্থের মধ্যে কোনো ঐতিহাসিক সংযোগ নেই। প্রথাগতভাবে আমরা শব্দের অর্থকে বজায় রাখি। শব্দ কতগুলো সঙ্কেতের ধারক মাত্র। সেই সঙ্কেত বা চিহ্নের এক পার্শ্ব হলো সঙ্কেতক [signifier] অন্য দিকটি হলো সঙ্কেতিত [signified]। শব্দের মধ্যে বস্তুর গুণ নিহিত নেই। শব্দ হচ্ছে part of a system of relation অর্থাৎ বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কের বিরাট ব্যবস্থার অংশ মাত্র। বস্তুর পরিচয় সম্পর্কের এই বিরাট ব্যবস্থার ফলেই জন্ম নেয়। তার মতে, language is a form, not a substance.
ভাষার প্রক্রিয়াকে বোঝানোর জন্য সস্যুর
লাঙ [langue] এবং পারোল [parole] শব্দদ্বয় ব্যবহার করেন। লাঙ [ভাষা] হচ্ছে সামগ্রিক ভাষাব্যবস্থা, যা ভাষার যেকোনো বাস্তব উদাহরণের আগেই উপস্থিত ছিল। আর কথিত যে কোনো ঘটনা হলো পারোল বা বাক্লাঙ বা ভাষার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা ছাড়া পারোল বা বাক্ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। লাঙ ভাষার অমূর্ত অবস্থা এবং পারোল তার সীমিত ব্যক্তিগত রূপ। কোনো ভাষার বক্তা ভাষা-ব্যবহারে এই সীমিত রূপটাই ব্যক্ত করেন।

কাজেই সস্যুর মত হলো ভাষাই পৃথিবীকে নির্মাণ করে, তাকে শুধু প্রতিফলিতই করে না। মানুষ কোনো বস্তু বা বিষয়ের ওপর তার অর্থ আরোপ করে এবং তাই ভাষায় সংগঠিত করে মনোভাব প্রকাশ করে। মূল বস্তু বা ভাব নিজে কোনো অর্থ বহন করে না। সস্যু এমন এক স্বয়ংসম্পূর্ণ কাঠামো উপস্থিত করেন, যার ভেতরে ভিন্ন বিষয়গুলো স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকেও একটি পূর্ণাঙ্গতা সৃষ্টি করে। লাঙ-এর ভিতরে পারোল যেমন।

সস্যুর বিখ্যাত উক্তি হলো In a language there are only differences without positive terms. যার মর্মার্থ হলো, বিপরীতার্থক জোড়া শব্দকে পাশাপাশি রাখলে শব্দ দুটোর অর্থ আরও স্পষ্ট হয়। day, night বা good, bad পাশাপাশি রাখলে বোঝা যায় একটি শব্দে যে বৈশিষ্ট্য আছে তা অন্যটিতে নাই।

পিটার ব্যারি তার বিগিনিং থিউরিতে সাহিত্য প্রসঙ্গে কাঠামোবাদ বিশদ আলোচনা করেছেন। বেছে নিয়েছেন জন ডানের Good Morrow কবিতাটি। কাঠামোবাদের শর্তানুযায়ী এই কবিতার বিশ্লেষণে সেই যুগ এবং সাহিত্যধারা সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে, যাকে জন ডান ব্যঙ্গ করেছেন। যেকোনো স্বতন্ত্র কবিতা তার বৈশিষ্ট্যসহ সেই যুগের সাহিত্য ধারায় অন্তর্ভুক্ত। জন ডানের ক্ষেত্রে সেই ধারা হচ্ছে alba অর্থাৎ প্রভাতী সঙ্গীত। এটি একটি কাব্য প্রথা যা দ্বাদশ শতাব্দী থেকে প্রচলিত। সেই প্রথাকে অনুসরণ করে প্রেমিক-প্রেমিকা প্রভাতকে নিয়ে অনুশোচনা করে। কেননা প্রভাত তাদের বিচ্ছেদ ঘটায়। আবার alba বুঝতে হলে প্রচলিত প্রেম প্রস্তাবনা এবং এ-সম্পর্কিত কাব্যচর্চা সম্বন্ধে জ্ঞান থাকতে হবে।  কাঠামোবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ডানের কবিতা মূল কবিতা থেকে পাঠককে ক্রমশ বৃহত্তর সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাস, দর্শন ও যুগের সাহিত্যধারার বৃহৎ কলেবরের সঙ্গে যুক্ত করছে কবিতাটিকে। অথচ উদার মানবতাবাদীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কেবল কবিতাটি। পিটার ব্যারি alba, প্রেম, কাব্যধারা এসবকে মুরগির ছানা এবং জন ডানের মূল কবিতাকে ডিমের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কাঠামোবাদীরা মুরগির ছানার স্বভাবের স্বরূপ নির্মাণের দিকে আগ্রহী। আর উদার মানবতাবাদীরা ডিমকে নিয়েই ব্যস্ত।

আমরা যদি জীবনানন্দ দাশের আবার আসিব ফিরে কবিতাটি বিবেচনা করি, কাঠামোবাদী সমালোচনার ধারায় সেখানে পুনর্জন্মবাদ আবিষ্কার একটা স্বাভাবিক ঘটনা। কেননা মানুষ নয়, শঙ্খচিল, শালিখ, বা ভোরের কাক হয়ে ফিরে আসবার যে আকুতি, তা ভারতীয় সমাজের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষের নিয়তিকেন্দ্রিক যে-দর্শন প্রচলিত, তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে খাপ খায়। আবার আল মাহমুদের সোনালি কাবিনগ্রন্থে কাবিন শব্দের মধ্য দিয়ে মুসলিম সমাজের বৈবাহিক নীতি যে একটা সামাজিক চুক্তি, সেই ধারণার ইঙ্গিত বহন করে। কবুল কবুল বাঙালি মুসলিম সমাজে প্রথাসিদ্ধ শব্দযুগল যা নববধূ বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার শর্তস্বরূপ নিজের মত প্রদানের অর্থে বলে থাকে। আল মাহমুদ তাঁর কবিতায় এই শব্দ সংযুক্তির মাধ্যমে বাঙালি মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক আবহমানতাকে ধারণ করেছেন। কাজেই কাঠামোবাদ কাব্যের শিল্পতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না হয়ে আরও প্রসারিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে বিবেচনায় নিতে চায়। সস্যুর ভাষাতত্ত্বে এই বৈচিত্র্যের ইঙ্গিত আছে।

সস্যুর যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছেন তা হলো, যদি সঙ্কেতের সঙ্কেতক [signifier] এবং সঙ্কেতিত [signified] তাদের সম্পর্ক নির্দিষ্ট বা স্বতন্ত্র রাখত, তাহলে বৃক্ষ শব্দকে প্রত্যেক ভাষায় বৃক্ষই বলা হতো। পৃথিবীতে মাত্র একটি ভাষাতেই হতো ভাববিনিময়। কিন্তু তেমনটা হয়নি। সঙ্কেতক এবং সঙ্কেতিতর মধ্যে যে সম্পর্ক, তা কিন্তু প্রকৃতির প্রতি স্বাধীনভাবে স্থাপিত। সংস্কৃতির প্রতি নয়। ধরা যাক যেকোনো সঙ্কেতক’ ‘সঙ্কেতিত করার অভিপ্রায়ে বৃক্ষকে বাছাই করলো। কিন্তু যে সংস্কৃতিতে ইংরেজি ভাষা চালু আছে সেখানে বৃক্ষকে Tree বলা যেতে পারে, বৃক্ষ নয়। গঠনবাদী ভাষাতত্বের আরও একটি বিখ্যাত উক্তি হলো: Language speaks, not man. এখানে Language মানে ভাষা ব্যবস্থা। অর্থাৎ মানুষ যা বলে তা ভাষাগত ব্যবস্থার অধীন। অন্যথায় মানুষ কথা বলতে পারে না। রোঁলা বার্ত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ডেথ অব দি অথর-এ বিরোধাভাসের ভাষায় বলেছেন:
Writing writes, not author. যার অর্থ হচ্ছে কোনো রচনা আজ পর্যন্ত তার সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা ও সাহিত্য-ব্যবস্থার বাইরে রচিত হয়নি, হতে পারেও না।


অধ্যাপক নারঙ গ্রন্থের প্রাককথন শুরুর আগে একটা আরবি প্রবাদ উদ্ধৃত করেছেন। যার অর্থ হলো: দেখো কী বলা হয়েছে, কে বলেছে দেখো না।

রলাঁ বার্ত অথরের মৃত্যু ঘোষণার বহু পূর্বেই এই আরবি প্রবাদ প্রচলিত ছিল। বার্তের Writing writes, not author কিংবা গঠনবাদীদের সেই বিখ্যাত উক্তি Language speaks, not man উল্লেখিত আরবি প্রবাদের সঙ্গে একটা ভাবগত নৈকট্য রক্ষা করেই এগিয়েছে। প্রবাদের মধ্যে যে-বলে বা যে-অথর, তাকে গুরুত্বহীন করা হয়েছে। গুরুত্বারোপ করা হয়েছে যা বলা হয়েছে তার ওপর। আর তা হচ্ছে সামগ্রিক ভাষা-ব্যবস্থা কিংবা সাহিত্য-ব্যবস্থা। অধ্যাপক নারঙ আরবি প্রবাদের এই বিশেষ দিকটিকে ইঙ্গিত করতেই প্রাককথন শুরুর আগে প্রবাদটি উল্লেখ করেছেন বলে অনুমান করি। অধ্যাপক নারঙ অর্থের ওপর শব্দের প্রাথমিকতা ও মান্যতা সম্পর্কে ২৫৫ হিজরিতে মৃত্যুবরণকারী আব্বাসী আমলের আরবি কাব্যতাত্ত্বিক জাহিজের মতামত উল্লেখ করেন। জাহিজ বলেছেন: শব্দের প্রকৃত গুরুত্ব প্রয়োগে, অর্থ বশবর্তী মাত্র। লেখার শৈলীর ব্যাপারে ইবনে খালদুন একই অভিমত ব্যক্ত করেন। ভাষাতাত্ত্বিক জায়গা থেকে সস্যু তো প্রায় এই কথাই বলেছেন যে, শব্দের অর্থ আমরা খেয়ালখুশিমতো করে থাকি। শব্দের অর্থ নির্বাচন স্বেচ্ছাচারিতা মাত্র। অর্থাৎ আমাদের শব্দ নির্বাচনের মধ্যে অর্থ বশীভূত হয়। আরববাসীরা অন্য অনেক বিজ্ঞানের মতোই ভাষাবিজ্ঞানেরও প্রবর্তক হিসেবে হজরত আলী[রা:]কেই গণ্য করেন। অধ্যাপক নারঙ ভাষার কেন্দ্রীয়তার স্পষ্ট সঙ্কেত পেয়েছেন হজরত আলীর দুটি উক্তিতে:

১. অলমরউ মখবুউন তহত-লিসানিহি অর্থাৎ মনুষ্য তার জিহ্বার নিম্নে প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে।
২. অলমরাউ বি অসগরৈহি বিকল্বিহি ওয়া লিসানিহি। যার অর্থ: মনুষ্য তার দুটো লঘু বস্তুর কারণেই বর্তমান, একটি তার হৃদয়, অন্যটি জিহ্বা [নহজুল বলাগত]।

এখন দেখা যাচ্ছে, সস্যুর ভাষাদর্শন এই মতের কাছাকাছি। ভাষা মনুষ্য তথা পৃথিবীকে নির্মাণ করে। ভাষার নিচেই প্রচ্ছন্ন থাকে মনুষ্য তথা পৃথিবী। এই দুই মতের অন্বয় প্রসঙ্গে অধ্যাপক নারঙ বলেন: ঐতিহ্য যা-ই হোক না কেন, ভাষার বিষয়ে চিন্তাভাবনার প্রধান উৎস কোথাও না কোথাও গিয়ে এক হয়ে যায়।


অধ্যাপক নারঙ এত বিস্তৃত প্রক্ষাপটে আলোচনা করেছেন যে, শুধু সারবস্তু নিয়ে কথা বললেও বহু সময় লেগে যাবে। সংস্কৃত কাব্যত্ত্বের প্রসঙ্গকে মুখ্য ধরে আমি আমার আলোচনা সমাপ্তির দিকে নিতে চাই। উর্দু এবং ফার্সি কাব্যতত্ত্বের আলোচনা না করলেও আমার উদ্দেশ্য সাধিত হবে বলে মনে করছি। তার গ্রন্থের অনুবাদ থেকে প্রয়োজনীয় অংশ সরাসরি উদ্ধৃত করলে আমার জন্য সহজ হবে। তিনি লিখেছেন:

ভারতীয় চিন্তন-পরম্পরা ও কাব্যতত্ত্বের বিশ্লেষণ করলে যে দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমানে গঠনবাদী ও বিনির্মাণবাদী চিন্তাধারার মাধ্যমে আমাদের সামনে আসে, বহু শতাব্দী পূর্বেই তার সমতুল্য দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের ভারতীয় চিন্তন ও দর্শনে, বিশেষ করে বৌদ্ধদর্শনে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল।

বৌদ্ধ তার্কিকদের মধ্যে নাগার্জুন ও দিঙনাগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দুটি নাম, যাঁদের শূন্য ও অপোহ তত্ত্বের বিশ্লেষণের সঙ্গে বিংশ শতাব্দীর সোস্যুর ও দেরিদার বিশ্লেষণের অভূতপূর্ব মিল পাওয়া যায়। নাগার্জুনের সময় দ্বিতীয় শতাব্দী ও দিঙনাগের সময় ৪০৫ খ্রিস্টাব্দ। বৌদ্ধ অপোহ তত্ত্বকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় ধর্মকীর্তি ও রত্নকীর্তির [অপোহ-সিদ্ধি] অবদান নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যাপক নারঙ গৌতম ঋষির মতকে বিস্তৃত করে তুলে ধরেন।

গৌতম ঋষির মতে, শব্দ ও অর্থের মধ্যে সোজাসুজি কোনো সম্পর্ক নেই। যদি অগ্নি শব্দটির অর্থ আমরা সেই বস্তু যা জ্বালিয়ে দেয়, এবং গোরু অর্থে একটি পশু-বিশেষ মনে করি তাহলে সেটি এই কারণে নয় যে অগ্নি শব্দটিতে জ্বালাবার ও গোরু শব্দটিতে পশু হওয়ার গুণ আছে, বরং তা এই কারণেই যে পরম্পরা ও প্রয়োগ অনুসারে এই শব্দ দুটির অর্থ নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। নৈয়ায়িকেরা একে শব্দের শক্তি বা অভিধা বলে বর্ণনা করেছেন এবং যেহেতু এটি রীতি অনুযায়ী স্থাপিত হয়েছে, তাই একে পরিভাষাও বলা হয়েছে। এ-ও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে শব্দ ও অর্থের সম্পর্ক যদি নৈসর্গিক হতো, তাহলে শব্দঅর্থ একই সঙ্গে উপস্থিত থাকত। তলোয়ার বললে জিহ্বা কেটে যায় না, আবার মধু বললে মুখ মিষ্টি হয়ে যায় না। নৈয়ায়িকেরা এই নিয়েও তর্ক করেছিলেন যে যদি শব্দ ও অর্থের সম্পর্ক স্বাভাবিক ও নিত্য হতো, তাহলে প্রতিটি স্থানে ও প্রতিটি ভাষায় শব্দের অর্থ ও বস্তুর নাম একই হতো।

সস্যুর ভাষাতত্ত্ব আলোচনাকালে আমি বৃক্ষ এবং Tree-এর সাংস্কৃতিক পার্থক্য তুলে ধরে একই কথা বলেছি। অর্থাৎ শব্দের মধ্যে বস্তুর গুণ নিহিত নাই। অধ্যাপক নারঙ এ বিষয় আরও ব্যাপকভাবে সামনে আনেন। তিনি বলেন, নৈয়ায়িকদের দৃষ্টিভঙ্গি সেই একই যা আধুনিক ভাষাতত্ত্ব অর্থাৎ সোস্যুরের ভাষা-দর্শনে আছে: শব্দঅর্থ-এর মধ্যে কোনো অন্তর্নিহিত সম্পর্ক নেই। এই সম্পর্ক যাদৃচ্ছিক [আর্বিট্রারি] এবং মনুষ্য দ্বারা নির্ধারিত।’ ‘নৈয়ায়িকদের বিশ্লেষণে শব্দঅর্থ বলতে সেই ভাবই বোঝানো হচ্ছে যে দুটির জন্য সোস্যুর তার দুটি বিশেষ পদ, সংকেতিত[সিগ্লিফাইড] ও সংকেতক' [সিগ্লিফাইয়ার] প্রয়োগ করেছেন, এবং এই তথ্যের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন যে দুটিরই সম্পর্ক ব্যক্তিনিষ্ঠ, অর্থাৎ মানবমনের দ্বারা নির্ধারিত ও ইচ্ছাকৃত গড়ে নেওয়া। নৈয়ায়িকেরা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে শব্দ শুধু সেই ধ্বনিগুলোর পুঞ্জ নয়, যা আসলে বলা হয়েছে [অর্থাৎ পারোল]; বরং শব্দ সেই ধ্বনিতাত্ত্বিক বা আক্ষরিক ছাঁচে স্থাপিত যা আসলে একটি মানসিক অবধারণ ও ভাষাব্যবস্থার [সোস্যুরের লাঙ] অঙ্গ। [ন্যায়-সূত্র ২, ১, ৫৫]

বৌদ্ধ বৈয়াকরণদের এবং পতঞ্জলির [সূত্র ৫,১১,১১৯] দ্রব্য ধারণার মধ্যেও সস্যুর লাঙ এর অবধারণ খুঁজে পেয়েছেন তিনি। বৌদ্ধ দার্শনিক দিঙনাগের বক্তব্যও উঠে এসেছে তাঁর গবেষণায়। দিঙনাগের মতে: শব্দ হলো এমন এক বিকল্প যার প্রধান বৈশিষ্ট্য তার নেতিবাচক প্রকৃতি। শব্দের জাতি-র অন্যান্য সমস্ত তত্ত্বের সঙ্গে শব্দের সম্পর্কের স্বরূপটি হলো প্রভেদমূলক। গোরু শব্দটির অর্থ গোরু নয়, বরং তা সেই সমস্ত বস্তুকে অস্বীকার করছে যেগুলি গরু নয় অধ্যাপক নারঙ বিস্ময় প্রকাশ করে আরও বলেন:

বৌদ্ধ দার্শনিকেরা শূন্যের যে ব্যবহার শব্দার্থ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে করেছেন তা গঠনবাদী ও উত্তর-গঠনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেমন কৌতূহলোদ্দীপক তেমনই বিস্ময়কর। এমনটিও সম্ভব যে সোস্যুরের ভাষার বৈপরীত্যের প্রত্যয় বৌদ্ধদের তত্ত্ব থেকেই গৃহীত হয়েছিল। অপোহ শব্দটির অর্থই হলো নিষেধ করা, বর্জন করা। ফলে কোনো শব্দ, অভিব্যক্তি বা অবধারণ থেকে যেকোনো অর্থ শুধু ততটাই প্রকট হয় যতটা তার অর্থ অনর্থ-এর বৈপরীত্যের দ্বারা স্থাপিত হয়। অর্থাৎ গোরু শব্দটি থেকে সেই অবধারণই প্রকাশ পায়, যা অ-গোরু নয়। এর বাস্তব-বোধ শব্দের পার্থক্যজনিত সম্পর্কগুলোর বৈশিষ্ট্যের দ্বারা স্থাপিত হয়; অন্যভাবে বললে, যেকোনো বস্তুর অস্তিত্বের পরিকল্পনা তার অস্তিত্বের দ্বারা গঠিত হয়, ঠিক সেভাবেই যেভাবে জগৎ অ-জগৎ থেকেই অস্তিত্বে এসেছে। এখন পাঠকের মনে সস্যুর উক্তিটি মনে আসা স্বাভাবিক যেখানে তিনি বলেছেন, In language there are only differences without positive terms

এখন প্রশ্ন হলো, জীবনের অর্থ খুঁজতে বারবার পশ্চিমা বিশ্বের দ্বারস্থ হয়ে নিজেদের গুলিয়ে ফেলব কি না। পশ্চিমা চৈতন্য আমাদের আত্মিক প্রয়োজনের সঙ্গে কতটা অন্বয় রক্ষা করে চলে? নাকি আমাদের হৃদয়বৃত্তির চাহিদা পূরণে এবং বুদ্ধিবৃত্তির আকাঙ্ক্ষার সমাধানে প্রাচ্য-পৃথিবীর দিকেই মুখ ফেরাব? আমাদের আত্মার দাবি পূরণে প্রাচ্যের ভাববিশ্বই তো বেশি যত্নশীল হবার কথা। আমরা যা কিছু পেয়ে পশ্চিমাদের প্রতি খুব আপ্লুত হয়ে পড়ি, বিস্ময়ে গদগদ হই, গভীর মনোনিবেশ করলে তা হয়তো প্রাচ্যের প্রান্তরেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব


অধ্যাপক গোপীচন্দ নারঙ আফসোস করে লিখেছেন, গঠনবাদ ও উত্তর-গঠনবাদ নিয়ে যে শত শত প্রশ্ন রচিত হয়েছে, সেগুলোর একটিরও মূল পাঠে ভারতীয় ভাষা-দর্শন বা কাব্যতত্ত্বের সঙ্গে কোনো সমন্বয়ের কথার উল্লেখ নেই। এশীয় বৌদ্ধিক মতবাদের প্রতি পাশ্চাত্য চিন্তনের যে ধরনের মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে আর যে কারণে তা হয়েছে, তা নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার প্রয়োজন নেই। পাশ্চাত্য চিন্তনের কাছে এশীয় বৌদ্ধিক মতামতের কোনো অস্তিত্ব নেই; এই ধরনের দার্শনিক শত্রুতা শতাব্দী-প্রাচীন। এই ব্যাপারটি অত্যন্ত দুঃখজনক এই কারণেও যে এই ধরনের মানব দর্শনের যে ইতিহাস আমাদের সামনে উপস্থিত হয়, তা পক্ষপাতদুষ্ট ও একপেশে হতে বাধ্য। যেহেতু এর দায়িত্ব কিছুটা আমাদের বিশেষজ্ঞদের ওপরও বর্তায়, সেহেতু এই পরিস্থিতি অধিক কষ্টপ্রদ হয়ে ওঠে। নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীনতা প্রকট করায় আমাদের জুড়ি মেলা ভার।

যে উদাসীনতার কথা অধ্যাপক নারঙ উল্লেখ করলেন, তা কাটানোর পথ হলো নিজের দিকে ফেরা। নিজের দিক বলতে আমি নিজস্ব সাংস্কৃতিক বোধ এবং ঐতিহ্যের আলোয় শিল্প-সাহিত্যের পরিচর্যা দান এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাকে শাণিত করার কথা বলছি। ঔপনিবেশিক আমল থেকে যে ইউরোপকেন্দ্রিক মনোবৃত্তি শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে ধারণ করে বসে আছি আমরা, সেই পরনির্ভরশীলতা থেকে আমাদের বেরিয়ে পড়া জরুরি। ইউরোপের চিন্তাবিশ্ব তার সীমার বাইরে জোরপূর্বক হলেও পৌঁছাতে চায়। কিন্তু গ্রহণের বেলায় খুবই অনুদার এবং আত্মকেন্দ্রিক। ঔপনিবেশিক অহং বজায় রাখা ইউরোপের মজ্জাগত। অধ্যাপক নারঙ সে বিষয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন। একথা ঠিক রেনেসাঁ-পরবর্তী সময় থেকে ইউরোপ সভ্যতা ও প্রগতির এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যার চোখ ধাঁধানো উন্নয়নের মোহ থেকে নিজেকে উদ্ধার করা মুশকিল। কিন্তু সেই উন্নয়নের পেছনে শোষণ প্রক্রিয়ার ঔপনিবেশিক কলঙ্ক আমাদেরও মনে রাখা দরকার। সভ্যতা ও প্রগতির সঙ্গে যুক্তি-বুদ্ধির ক্রম উৎকর্ষের একটা সম্পর্ক হয়তো আছে। কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের উন্নয়ন সভ্যতার সমান্তরাল নয়। কেননা শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই এগোয়। আর সংস্কৃতি পেছনে তাকায়। কেননা সংস্কৃতি শিকড়সন্ধানী। সেই শিকড় ধরেই নিজের তত্ত্ববিশ্বকে তালাশ করা সম্ভব। শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, সমালোচক এবং বুদ্ধিজীবীদের ওপর সেই দায়দায়িত্ব বর্তায়। আলীয়া আলী ইজেতবেগোভিচ একটা সুন্দর কথা বলেছেন, আমরা কেন এ বিশ্ব সংসারে জীবন যাপন করছিএ প্রশ্ন সংস্কৃতির আর কীভাবে জীবন যাপন করছিএ প্রশ্ন সভ্যতার। একটি জীবনের অর্থ সম্পর্কিত, অপরটি জীবনের যাপন প্রণালি সম্পর্কিত।

এখন প্রশ্ন হলো, জীবনের অর্থ খুঁজতে বারবার পশ্চিমা বিশ্বের দ্বারস্থ হয়ে নিজেদের গুলিয়ে ফেলব কি না। পশ্চিমা চৈতন্য আমাদের আত্মিক প্রয়োজনের সঙ্গে কতটা অন্বয় রক্ষা করে চলে? নাকি আমাদের হৃদয়বৃত্তির চাহিদা পূরণে এবং বুদ্ধিবৃত্তির আকাঙ্ক্ষার সমাধানে প্রাচ্য-পৃথিবীর দিকেই মুখ ফেরাব? আমাদের আত্মার দাবি পূরণে প্রাচ্যের ভাববিশ্বই তো বেশি যত্নশীল হবার কথা। আমরা যা কিছু পেয়ে পশ্চিমাদের প্রতি খুব আপ্লুত হয়ে পড়ি, বিস্ময়ে গদগদ হই, গভীর মনোনিবেশ করলে তা হয়তো প্রাচ্যের প্রান্তরেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। অধ্যাপক গোপীচন্দ নারঙ গঠনবাদ ও উত্তর-গঠনবাদ বিশ্লেষণ করে তার প্রমাণ দেখিয়েছেন। ভারতীয় কাব্যতত্ত্বের অনেক প্রাচীন বিষয়ের সঙ্গে ফিলিপ সিডনির এপোলজি ফর পোয়েট্রির কাব্যচিন্তার এবং ম্যালার্মের শব্দতাত্ত্বিক ধারণার মিল পাওয়াও অসম্ভব কিছু না। সাম্প্রতিক কালে উজান প্রকাশনি থেকে কোরিয়ার গল্প এবং কোরিয়ার কবিতা নামে যে দুটো বই বেরিয়েছে, তা পাঠ করবার সুযোগ হয়। কোরিয়ার গল্প ও কবিতায় লেখকদের মধ্যে কোনো শিল্পতাত্ত্বিক চাপ নাই বলে মনে হলো। স্বতঃস্ফূর্ত এবং সাবলীল বলার ভঙ্গিতে কোথায় যেন পশ্চিমা রীতির বাইরে নিজেদের সোজাসাপ্টা কথাগুলো বলে ফেলবার প্রবণতা আছে। এরই মধ্যে শ্লেষ, কৌতুক, বিদ্রূপ, দার্শনিকতা, ঐতিহ্যিক প্রবণতা সব একাকার হয়ে আছে। এমন কিছু সর্বজনীন আবেগ নিয়ে লেখক কবিরা কারবার করছেন, যা আমাদের সাথে মিলে যায়। হিয়ন চিন-গন রচিত দাদির মৃত্যু গল্পটি সম্পর্কের গাঢ়তা স্পষ্ট করে তুলেছে। আত্মীয়-পরিজন এসে অসুস্থ দাদির যেভাবে যত্ন নেয় এবং পরিচর্যা দেয়, তা রীতিমতো উদযাপনের মাত্রা পায়। কিন্তু শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার সূত্রে দাদির ব্যক্তিত্ব সেখানে মহিমান্বিত হয়ে ওঠে। ইউরোপের বিচ্ছিন্নতাবোধ এখানে নেই।

সংবেদনশীলতার যে ছাপ রেখে যায় গল্পটি, তা মূলত এশিয়ান সংস্কৃতির স্বাক্ষর। পরিচর্যায় সুস্থ হলেও সবাই যখন নিশ্চিন্তে যার যার কাজে ফিরে গেল, গল্পের কথক সকালে টেলিগ্রাম পেলেন: দাদিমা রাত তিনটায় মারা গেছেন। এই মৃত্যুকে কোনো ইউরোপবাসী বৃদ্ধার নিঃসঙ্গ ও মর্মান্তিক মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করা যায় না। বালির প্রাসাদ গল্পটি লিখেছেন চো চঙ-রায়। তিনি একজন নারী লেখক। উত্তম পুরুষে লেখা এই গল্পে কথক নিজে একজন চিত্রকর। ভালোবেসে একজন চিত্রকরকেই বিয়ে করেন। পশ্চিমা রীতিতে যারা ছবি আঁকতে পছন্দ করে, তাদের আরাধ্য স্থান, প্যারিস থেকে তিনি হঠাৎ করেই এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। দেখা গেল চিত্রকর স্বামীর শর্ত সাপেক্ষে তার নিজের শিল্পসত্তা ব্যাহত হলো। ছবি আঁকা ছাড়তে হলো তাকে। সে স্বামীর কাছে নিতান্তই গৃহিণী। স্বামীর বন্ধুদের আড্ডায় স্বামীর নির্দেশে শুধু মদ পরিবেশনের সহায়ক ভূমিকা ছাড়া তার কোনো কাজ থাকল না। পশ্চিমা শিল্পরীতির প্রতি অতি ভক্তির কারণে চিত্র প্রদর্শনীতে কেউ কেউ স্বামীটিকে কোরিয়ান জাতির শত্রু হিসেবেও আখ্যা দিয়েছে। যাহোক, চিত্রকর হলেও স্বামীর পুরুষতান্ত্রিক অনুদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বারবার সে নিগৃহীত হয়েছে। অতঃপর দৃঢ়তার সঙ্গেই সে তার স্বামীকে পরিত্যাগ করে। কিন্তু কোথাও কোনো নারীবাদী উচ্চবাচ্য নেই। পাশ্চাত্য শিল্পচেতনার প্রতি কোথাও একটু শ্লেষাত্মক হয়ে থাকবে গল্পটি। কোরিয়ান লেখক-কবিদের বলার ভঙ্গিতে বেশ একটা এশিয়ান ভব্যতা এবং পরিশীলন আছে। ইউরোপের লেখার ভাববস্তুতে যেমন রগরগে কাঁচামাল শিল্পের ভাঁপ দিয়ে পরিবেশন করা হয়, কোরিয়ার গল্প ও রকম মনে হলো না। গল্পের মধ্যে কোনো বাঁক বা মোচড়, ইংরেজিতে যাকে টুইস্ট বলে, এমন কিছু পেলাম না। তার মানে শিল্পের চমক নাই। কিন্তু বিদ্ধ করবার মতো বহু বিষয় সহজ সারবত্তা নিয়ে ঠিকই পাঠককে আকৃষ্ট করে। মনে হলো বেশ উপাদেয় একটা রান্না করা বস্তু। সব পাঠক যার স্বাদ পেতে পারে।

কলোনিয়াল হ্যাঙ ওভার পরিহার করে অনুবাদের মাধ্যমে ভারতীয় অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের দিকে আমাদের নজর দেওয়া দরকার। এশিয়ান অঞ্চলের শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের ভাব বিনিময় এবং আদান-প্রদান খুবই কম। হতে পারে কোরিয়ান সাহিত্যের মতো এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নিজস্ব ভাববস্তু এবং গড়ন নিয়ে মূল্যবান সাহিত্য গড়ে উঠছে। হাতের নাগালে হলেও যার খবর আমরা রাখি না। এসব নিকটবর্তী দেশের শিল্প-সাহিত্যই হতে পারে স্বকীয়তা নিয়ে দাঁড়াবার প্রণোদনা। গোপীচন্দ নারঙের গবেষণা গ্রন্থটি প্রাচ্যের সমুদ্রে ডুব দিয়ে মুক্তা খুঁজবার সেই অনুপ্রেরণাই দিয়েছে।

ঋণ স্বীকার

১. গঠনবাদ, উত্তর-গঠনবাদ এবং প্রাচ্য কাব্যতত্ত্ব, গোপীচন্দ নারঙ, অনুবাদ: সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্য অকাদেমি
২.
Beginning theory: An Introduction to Literary and Cultural Theory, Peter Barry
ভাষান্তর: ড. রুহুল আমীন, ফ্রেন্ডস বুক কর্নার
৩. প্রাচ্য পাশ্চাত্য ও ইসলাম [
Islam Between East and West], আলীয়া আলী ইজেতবেগোভিচ, রূপান্তর: ইফতেখার ইকবাল, আমান পাবলিশার্স ঢাকা
৪. ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব, নরেন বিশ্বাস, বাংলা একাডেমি
৫. কোরিয়ার গল্প, সম্পাদনা: ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ, উজান
৬. কোরিয়ার কবিতা, অনুবাদ: ছন্দা মাহবুব, উজান