বড় জাতির রাজত্বে ছোট জাতির কবিতা

 

বাংলায় ছোটলোক বা ইতরজন বলতে লোকে একধরনের গালি বোঝে। হতে পারে এই কারণেই বিখ্যাত ইতালিয়া মহাত্মা গ্রামসি প্রস্তাবিত ‘সাবল্টার্ন’ মুদ্রার বাংলা নকল হয়েছে ‘নিম্নবর্গ’। জিবের সামান্য অসাবধানতায় ‘নিম্নবর্গ’ শব্দটি ‘নিম্নবর্ণ’ শোনাবার আশঙ্কায় ভরা। রণজিৎ গুহ শুদ্ধ আন্তনিয়ো গ্রামসির প্রধান প্রধান বাংলা অনুবাদকর্তা তারপরও এই ঝুঁকিটাই নিয়েছেন। বরং ‘নিম্নবর্ণ’ কবুল করবেন, তাঁরা ‘ছোটলোক’ শব্দটা এস্তেমাল করবেন না। নিম্নবর্গের এই ঝুঁকি বিংশ শতাব্দীর ভাষাশাস্ত্রের সংস্কার অনুসারে লক্ষণার বা মেটোনিমির ঝুঁকিবিশেষ। (চট্টোপাধ্যায় ও ভদ্র ১৯৯৮)

এই সমতলে ‘ছোটলোক’ বলার ঝুঁকিটা রূপকের কিংবা মেটাফরের ঝুঁকি। এতে বোঝা যায় ভদ্রলোকেরা শেষ বিচারে কবিতাই বোঝেন না। তাঁরা বিষয়ী লোক, তাঁরা গদ্য ব্যবসায়ী, তাঁদের স্ফূর্তি লক্ষণায়। বাংলায় বর্ণাশ্রম ধর্মের দান ব্রাত্য, পতিত, অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য, দাস, শুদ্র প্রভৃতি শব্দ। কেহ কেহ ‘দাস’ শব্দের বানান লেখেন ‘দাশ’। তাতে হীনমন্যতার হাত থেকে বাঁচা যায় এমন প্রমাণ অল্প। এসব শব্দে দিয়েও কাজ হয়ত চলত কিন্তু এয়ুরোপ থেকে আমরা তো শুদ্ধমাত্র ইংরেজি শিখি নাই, আদি সংস্কৃতও আরেকবার শিখতে বাধ্য হয়েছি। তাই শেষ তক নিম্নবর্গই লিখতে হয়েছে আমাদের। এই নতুন আর্যামি আমাদের মাথায় চড়েছে জেনেও আমি ছোটলোকের লক্ষণা বা মেটোনিমি ‘ছোট জাতি’ কথাটিই প্রস্তাব করলাম। দেখি বড় জাতির মানুষজন কতখানি সহ্য করেন। এই নিবন্ধের শিরোনামায় লিখিত ‘ছোট’ কথাটি ইংরেজি ‘সাবল্টার্ন’ পদের তর্জমা জ্ঞানে পড়া হোক—বর্তমান লেখকের এইমাত্র আবদার।

কিছুদিন হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে অবাঙ্গালি আর অমুসলমান জনগণ কিছুটা সাবল্টার্ন—মানে ছোটলোক—মর্যাদায় বসবাস করছেন। ১৯৭২ সালে প্রণীত পবিত্র সংবিধানের বিধিবিধান অন্তত সেই বিবরণই দেয়। যে জাতের লোকজন আজিকালি এদেশের রাষ্ট্রসমাজে হাটেবাজারে অধিপতির ভূমিকা গ্রহণ করেছেন—এলিট বনেছেন—তারাই বাংলা অর্থে এদেশের বড়লোক। মাত্র কিছুদিন আগেও অবশ্য এঁদের ছোটলোক বলা হত। আরব্য পারস্য তুর্কি কুলজী কি ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ প্রভৃতি কুলীন পাঁজি তাঁদের ইজ্জত ষোল আনা বাঁচায় নাই।

নেহায়েত নতুন পাওয়া স্বাধীনতার জোরে নয়, অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশি এলিটের চোখে চাকমাদি ছোট জাতির সাহিত্য ‘ছোটলোকের সাহিত্য’ মর্যাদা পেয়ে এসেছে। চাকমা রাজ-পরিবার ইংরেজ জাতের সঙ্গে বিয়েশাদির সম্পর্ক স্থাপন করেছে, চাকমা জাতির এলিট শ্রেণী ইংরেজি বোলচাল মাখে, আর কাঁটাচামচে খানাপিনা সারে দেখে ঢাকার এক পণ্ডিত ইংরেজি ১৯৯৭ সনেও চোট খেয়েছিলেন। পণ্ডিত মহাশয় ভুলে গিয়েছিলেন ইংরেজ জগদীশ্বর বাংলাশুদ্ধ ভারত খামারের সকল ভাষার নাম রেখেছিলেন ‘বার্নাকুলর’। ‘বার্নাকুলর’ মানে ‘বর্ণের জবান’। লাতিন চামড়াটা খুললে এর সোজা অর্থ দাঁড়ায় ‘দাসের জবান’। পুরানা দিনের রুমদেশে বাদশাহের রাজ্যে লাতিনেতর তাবত জবানকেই এই সম্মানটা দেয়া হয়েছিল। পরাধীন ভারতের আধুনিক নেতারাও এই সত্যটা ভালো জানতেন। (আজাদ ১৯৯৭; নেহেরু ১৯৮৪: ৪৫২)

বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রওনক জাহান তাঁর আমেরিকান শিক্ষকদের পথ ধরে শেখ মুজিব শুদ্ধ বাংলাদেশের অভিজাত শ্রেণীর নতুন প্রতিনিধিদের নাম রেখেছিলেন ‘বার্নাকুলর এলিট’ বা দাসশ্রেণীর বড়লোক। (জাহান ১৯৭২) গত অর্ধ-শতাব্দী জুড়ে ভারতের পূর্বাঞ্চলে আর বাংলাদেশের একপ্রান্তে ছোট জাতিপুঞ্জের নানান সংগ্রাম ও জাগরণ তাদের নিজ নিজ ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির কিছুটা হলেও সহায়ক হয়েছে। বাংলাদেশে অবাঙ্গালি ছোট জাতিগুলির ভাষা বিশেষ রাষ্ট্রীয় সুবিধা তো পায়নি, বরং পীড়নের শিকার হয়েছে। চাকমা (বানানান্তরে ‘চাঙমা’) ভাষার নবীন কবি কবিতা চাকমা কয়েক বছর আগে ঢাকা থেকে শীর্ণকায় একটি কবিতার বই ছাপাতে পেরেছিলেন। আমার আজকের আলোচনা এই বইকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে। (চাকমা ১৯৯২)

 

শুনতে পাই, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় একদা এই রায় প্রকাশ করেছিলেন যে চাকমা জবানটা বাংলা ভাষার উপভাষা বিশেষ। শুনে বিস্মিত হইনি। একই যুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাকে আজ যদি কেউ হিন্দুস্থানি বা হিন্দির উপভাষা প্রমাণের চেষ্টা করেন সে চেষ্টা ঠেকানও জানি খুব সহজ হবে না। বাংলায় উনিশ শতকের নবজাগরণ একটা কথার কথা মাত্র তো নয়। এর শ্রেষ্ঠ নেতারা—এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—এই যুক্তির বলেই দাবি করছিলেন অহমিয়া আর উড়িয়াও বাংলার উপভাষা বৈ নয়। রাজনীতির দৌলতে উড়িয়া আর অহমিয়া এখন স্বতন্ত্র ভাষা। দুঃখের মধ্যে, বৃহৎ বঙ্গের জাতীয় অভিমান থেকে দীনেশচন্দ্র সেনও অব্যাহতি পাননি। উনিও উড়িয়াদি ভাষার দিকে কটাক্ষ কম ক্ষেপণ করেননি। (চন্দ্র ১৯৯২; সেন ১৯১১)

ভাষার জাতীয় ও আঞ্চলিক চরিত্র—ভাষাত্ব আর উপভাষাত্ব—সম্পূর্ণই ক্ষমতার ব্যাপার; এর মধ্যে স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক কিছুই নাই। কবিতা চাকমার বইটিতে বাংলা তর্জমাসহ চাকমা ভাষার কবিতা ছাপা হওয়ায় আমার মতো চাকমা ভাষায় আনাড়ি বাংলা পড়ুয়ারও কিঞ্চিৎ সুবিধা হয়েছে। স্বর্গীয় মুনীর চৌধুরী—শুনেছি—আঞ্চলিক ভাষার দাপাদাপি একেবারেই সইতে পারতেন না। তাঁর অদৃশ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য নিবেদন করার পর বলব আঞ্চলিক ভাষাই বাংলা ভাষার প্রাণ, তাহার সত্যকারের দম। পণ্ডিতেরা যেটা পাহারা দেন সেটা তো ভাষার লাশ মাত্র, তাতে প্রাণের লেশও থাকে না। যেমন বহু বছর স্কুলে আর কলেজে পড়েও আমার মতন বিস্তর ছোট লোক মুনীর চৌধুরীর নাহান ‘শুদ্ধ’ বাংলা বলতে অপারগ—তেমনি কবুল করি চাকমা বা চাটগাঁইয়া ভাষা বহু বছর ধরে শেখার পরও ‘শুদ্ধ’ প্রকরণে বলতে মুনীর চৌধুরীর মতন পণ্ডিত দরকার। (চৌধুরী ১৯৮৪)

আজ চাটগাঁইয়া বাংলার উপভাষা—অথচ উড়িয়া নয়—এ তথ্য জেনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন আধিপত্যবাদী দীনেশচন্দ্র সেন। এদিকে দীনেশবিদ্বেষী সুনীতিবাবুর রায়ে চাকমা ভাষা যে বাংলার উপভাষার মর্যাদা অন্তত পেয়েছিল তাও একই রাজনীতির ফসল। ব্যাকরণ বা ভাষাতত্ত্বের দোহাইটা অজ্ঞাতসারের তাড়নায় তৈরি। এ দোহাই বাসনার ভদ্রপ্রকার। জাতি তৈরির পেছনেও এই প্রক্রিয়া কার্যকর।

আজ চাটগাঁইয়া বাংলার উপভাষা—অথচ উড়িয়া নয়—এ তথ্য জেনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন আধিপত্যবাদী দীনেশচন্দ্র সেন। এদিকে দীনেশবিদ্বেষী সুনীতিবাবুর রায়ে চাকমা ভাষা যে বাংলার উপভাষার মর্যাদা অন্তত পেয়েছিল তাও একই রাজনীতির ফসল। ব্যাকরণ বা ভাষাতত্ত্বের দোহাইটা অজ্ঞাতসারের তাড়নায় তৈরি। এ দোহাই বাসনার ভদ্রপ্রকার। জাতি তৈরির পেছনেও এই প্রক্রিয়া কার্যকর।

কবিতা চাকমা জানিয়েছেন: ‘বইটিতে মূলতঃ চাঙমা কবিতাগুলো বাংলা ভাষায় রূপায়ন করেছি। কখনো বা উল্টোটিও করেছি।’ আমি কৌতুহলবশত দুচারটা কবিতার বাংলা ও চাকমা ভাষ্য মিলিয়ে দেখেলাম। মনে হল কোন কোন জায়গায় কবিতা চাকমা একটা চাকমা আর একটা বাংলা—উভয় ভাষায় দুটো—স্বাধীন কবিতা তৈরি করেছেন। পরে আমি নমুনা দেখাব; তার আগে বলে রাখি আমি কোনদিন চাকমা ভাষার ধরাবাঁধা শিক্ষালাভ করি নাই। আমার জ্ঞানের মধ্যে যৎসামান্য চাটগাঁইয়া। চাটগাঁর ভাষা যে রাঢ়বঙ্গের ভাষা থেকে বহুলাংশে স্বতন্ত্র মেজাজের তার কারণ সন্ধানী মনীষী ও ভাষাজ্ঞানীরা স্থানীয় আর্যপূর্ব ভাষার মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন। চাটগাঁইয়ার সাথে চাকমার আত্মীয়-সম্পর্ক দেখে আন্দাজ করা চলে দুই ভাষারই গোড়ায় একদা না কোন এক আদ্যভাষা জারি ছিল। মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে ছাড় দিলে বলতে হবে বাংলাদেশে তথাকথিত আর্য-ভাষার আগের ভাষারূপ সম্পর্কে এ যাবত কোন বড়মাপের গবেষণাই হয়নি। (শহীদুল্লাহ ১৯৯৫; ম্যালোনি ১৯৮৪)

ছিটেফোঁটা যাওবা হচ্ছে তা থেকে সন্দেহ করার কারণ আছে মুণ্ডা গোষ্ঠীর মুণ্ডারি, সাঁওতালি প্রভৃতি ভাষার সঙ্গে বাংলার আত্মীয়তার দিকটি এখনো তার প্রাপ্য যথাযথ গুরুত্বটা পায় নাই। চাকমা ও চাটগাঁইয়ার সাথে বাংলাদেশের আর আর অঞ্চলের ভাষার ভেদ বহুলাংশে এই সব ভাষার মধ্যে উপস্থিত অপর বা পুরাতন ভাষার জোরকেই দেখিয়ে দেয়। বাংলা কেন হিন্দি নয়, তার জবাব এই আর্যপূর্ব ভাষার মধ্যেই পাওয়া যাাইবে। শুদ্ধ তাই নয়, বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে এত ভাষা বৈচিত্র্য কেন—বিশেষ সিলেটি আর চাটগাঁইয়া কেন অন্যান্য অঞ্চলের লোকজনের পক্ষে বিদেশিস্বরূপ—তার উত্তরও এখানেই মেলে।

 

কবিতা চাকমার কবিতা যতখানি কবিতা ততখানি চাকমাও। বইয়ের নামেই তার প্রমাণ। জ্বলি ন’ উধিম কিত্তেই! অর্থাৎ ‘রুখে দাঁড়াব না কেন!’—এই তর্জমাটা মূলের একটা ভাল ব্যাখ্যা তবে পুরো ব্যঞ্জনাটা এতে পাওয়ার অবকাশ নেই। এই কবির কবিত্ব নিয়ে সন্দেহ নাই আর কবির বিষয়-বাসনাও বেশ ঝকমকে। একটি কবিতার প্রসঙ্গ নিবেদন করা যাক এক্ষণে। কবিতার নাম ‘কনদিন’ (বা ‘কোনদিন’)। তার কিয়দংশ এইমতো:

কোনদিন বুকের জমিন
আলোকিত হবে সূর্যে
আলোয় আলোয় ভরে যাবে
এই জুম, এই গভীর অরণ্য।
এক কাজলঙ অভিমান
মুছে যাবে এপার ওপার
এই মাটি, এই বুকের অরণ্য
ভালবাসার বর্ষায় ভিজে যাক, ভিজে যাক।
        (চাকমা ১৯৯২: ২৭)

কিংবা ‘এক্কান পূর্ণ নির্মাণত’ (একটি সম্পূর্ণ নির্মাণে) কবিতায় পড়ি:

রক্তপলাশ বুকে পদে পদে সহযোদ্ধা,
সমর্পিত হয় সহস্র রক্তকরবী।
...
কবে সময় হবে জঙ্গী
কর্ষিত হবে মাটি,
বীজ থেকে জন্ম নেবে কাংখিত অংকুর—
একটি সম্পূর্ণ নির্মাণে...।
        (চাকমা ১৯৯২: ২৯)

এই কিসিমের বাসনাকে বোধ করি প্রেম বলাই অধিক সংগত। কারণ এর বাসনা কোন ক্ষুদ্র বিষয় বা শুদ্ধ দ্রব্যের (‘লোবজে পুতি আ’) বাসনা নয়। এ বাসনা দখলদারির নয়, হয়ে ওঠার আহাজারি মাত্র। এই বাসনার বোধ নিপীড়িত জাতির বোধ—মোটেও প্রাকৃতিক নয়, নিতান্ত ঐতিহাসিক অর্থাৎ মানুষের হাতগড়া সত্য। তবে এই বোধ প্রকৃতিতে দ্রুত ভর করে। ‘কোচপাঙ’ (বা ভালবাসি) কবিতায় পড়া যাচ্ছে এই বাক্যবাণ:

অযুত বছর ধরে—
হেঁটে যাই এই বুনোপথ, জুম,
আঁকাবাঁকা পথ কাজলঙ—
ঝর্ণা, নদী।

মমতায় ভেজা চোখে দেখি
এই গ্রাম, উঁচু মাচা ঘর,
বহুদূর দরিয়া পাড়ি দেওয়া
নৌকোয় আমার ছেলেবেলা।

মায়ের কল্যাণী মুখ, বুদ্ধদেবের দিকে প্রণত—
বাবার স্নেহময় প্রসারিত দু’হাত,
অন্ধকার পাহাড়ের খাদে অবহেলায়
কেঁদে মরা আমার বর্ণমালা-কধাতারা।
...
অযুত বছর ধরে ভালবাসি।
        (চাকমা ১৯৯২: ২৫)

চাকমা লেখার আলাদা বর্ণমালা আছে—এটা বাংলা মুলুকে জানাবার মতন খবর বটে। অন্তত বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে খবরটা শোনানো যায়। কিন্তু বুদ্ধদেব? জাতিবোধের মধ্যে খোদ গৌতম বুদ্ধের এহেন হাজিরা অশান্ত এবং অনিবার্য জ্ঞানের আকার ধরেছে—বলা যায় এখানে জাতি বুদ্ধদেবের মধ্যে সাকার হয়েছেন। বুনোপথ, জুম, কাজলঙ্গ নদী, গ্রাম, উঁচু মাচাঘর, দরিয়াপাড়ি দেওয়া নৌকা, মায়ের মুখ, বাবার হাত, বুদ্ধদেবের মূর্তি, বর্ণমালা—এই জাতীয় সাকারের মধ্যে মনে হয় খোদ ভাবই ত্রিভুবন গড়েছেন। ধর্মের সাকার ছেড়ে এখন জাতির আকারে তার চমৎকার ভাব দেখা যাচ্ছে। ‘তলবিচ’ (বা পদাবলী) কবিতায় এই আদি পায়ের চিহ্ন পড়েছে:

ম জন্মভূমি ধক আর কন পূণ্যভূমি নেই
কাজলঙ ধক আর কন গাঙ নেই এ সংসারত।

[জন্মভূমির মত আর কোন পূণ্যভূমি নেই
নদীর মত আর কোন সুন্দর নেই, নেই কোথাও।]
        (চাকমা ১৯৯২: ১০-১১)

কাজলঙ্গ সংসারের সুন্দরতম দরিয়া অর্থাৎ নদী বলে আমি তার পাড়ে বসত গড়ি নাই, আমি বসত গড়েছি তাই সে সংসারের সবচেয়ে সুন্দর গাঙ্গ। আমরা দেখি জাতীয় অধিকার এই নদীর মধ্যে সাকার হয়েছে। এ যুক্তি মুদির দোকানির নিক্তিতে নিষ্পন্ন হবার মতন সওদা নয়। ‘জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’ বলে একটা কথা বাংলা ভাষায়ও কাগজে-কলমে জারি আছে। কিন্তু জাতি কি বস্তু তার তর্কাতীত কোন সংজ্ঞা নাই। জন্মস্থান, ভাষা, ধর্ম যে কোন কিছুই জাতির পাত্র হতে পারে।

জাতিকে যে পাত্রে রাখা হয় তা সে পাত্রেরই আকার ধারণ করে। জাতির মূর্তিগড়ার কাজে কবি খানিক কুমারের কাজ করেন। সাম্রাজ্যহারা ক্ষিপ্ত বা সংক্ষিপ্ত সাহেব জাতির লোকেরা যেমন বলেন জাতি তেমন কোন স্বপ্নে পাওয়া মহৌষধ, ‘ইমানিজন্ড কমিউনিটি’ বা ‘অলীক উম্মাহ’ মাত্র নয়। মানুষ দলবদ্ধ পশু—আরস্তুর এই পুরানা আবিষ্কার নব নব রূপে প্রকাশিত হয়। পৃথিবীতে নতুন নতুন জাতির জন্ম হয় কিভাবে? জাতির আবির্ভাবে সাকার ও আকার বিশেষ সময়ে দেখা দেয়। এই সময়ের নাম ইতিহাস। (অ্যান্ডারসন ১৯৮৩)

বড় আপন এ ভূমি
অতল গহীন কাজলঙ,
শর্ষে, কবরগ ভুঁই
ফুজি, ধান সাবারাঙ।
...
মার প্রিয় তাঁত
আলাম, বিয়ং, তাঘলক
নিখুঁত সুতো রেশম
এলো খোপা, কুদুক কাদাক।

বাবার প্রিয় বাঁশের হুকা
নিপুণ বামহাতে কোদাল,
শুটকি, শূকরের মাংস
দোচুয়ানির স্বচ্ছ বোতল।
...
ঠাকুমার রূপার হাসুলী
পায়ে খারু ঝন্ ঝন্,
এমন মধুর সুর নিক্কন
হৃদয় ভরে অনুরণন।
        (চাকমা ১৯৯২: ২২-২৩)

মাতৃভূমি শুধু প্রকৃতি নয়, প্রকৃতির ইতিহাসও। ইতিহাসে নদীর নাম বদলায়, গতিপথ আটকায়, হ্রদ হয় পথ। বদলে যায় নদীর পাড়ের ছবি, মানুষের পেশা, রূপচর্চার ধরণ। ‘স্মৃতি’ নামা যে কবিতার কয়েকটি শ্লোক উপরে তুলে দিয়েছি তা এক ঐতিহাসিক উৎপাদন প্রণালীর স্মৃতিবিশেষ এখন যা ক্রমে ক্রমে বিস্মৃতি।

সেইদিন মনে পড়ে—
চোখ দীঘল সাগর হয়,
নিশীথ একাকী বরষায়
অন্তর ভিজে রয়।
        (চাকমা ১৯৯২: ২৩)

 

ইতিহাসের ধাবমান ছায়ার পেছনে আছে শাসকের ক্ষমতা আর মজুরের মেহনতের লড়াই। পার্বত্য চট্টগ্রামের এক বিশাল প্রদেশে আজ ‘বসত বিরান ভূমি নিবিড় অরণ্যে মরুভূমি।’ সেখানে মানুষ ‘জন্মভূমে পরবাসী’ আর নারী ‘ক্রীতদাসী’। সেখানে ‘দৃষ্টিকে অন্ধ’ আর ‘সৃষ্টিকে বন্ধ’ করে রাখা। এখানেই জাতি অর্থাৎ ভাব আকার পাচ্ছে। জাতীয় ভাবের পরিচিত উপকরণ জলের মতো ঘুরে ঘুরে একই কথা বলে, রূপকের সাথে প্রতীক মেশামেশি করে, মেটাফরের সঙ্গে লেগে থাকে মেটোনিমি। ‘জ্বলি ন উধিম কিত্তেই!’ (রুখে দাঁড়াব না কেন!) কবিতায় এই ইশতেহারের শুরু। (চাকমা ১৯৯২: ৭) 

পরের কবিতা ‘প্রার্থনা’:
আজন্ম আপন এ গাঢ় অরণ্যে
প্রাচীন ঋষি কবি শিবচরণ আমি
খুঁজে ফিরি সেই সূর্য—
যে আলোয় আলোয় ভাসিয়ে দেবে
এই ভূম, জুম, কাজলঙ, ...

সেই অসীম অন্তরের পানে 
আমি বার বার ছুটে যাই
        (চাকমা ১৯৯২: ৯)

কবিতা চাকমার বিষাদসিন্ধু উনিশ শতকের আদ্যভাগের এয়ুরোপিয়া রোমান্টিক কবিতার বিষাদের মতন। এ বিষাদ এখনো আকারপ্রাপ্ত হয়নি, সাকারই রয়ে গেছে। বিষাদের কবিতা লিখেছেন তিনি অপ্রচুর:

আমার জুমের দিকে চেয়ে দেখ,
দুহাতে এ ভূমি ছুঁয়ে দেখ
কেমন রক্তে রাঙানো।

আমার ধানী জমিন দেখ,
শকুনের ছোবলে ক্ষতবিক্ষত
কেমন পীড়িত শূন্য।

আমার ভিটা জমিন দেখ
ধোঁয়া, কয়লা ধ্বংসস্তুপ
কেমন পোড়া শ্রীহীন।

আমার স্মৃতির ঘর দেখ
প্রাণ জুড়ানো হাসি, শান্তি
কেমন সোনারঙ সকাল।
...
আলো হাতে নিয়ে দেখ
মানুষের মিছিল কেমন
আগুনহীন তপ্ত বারুদ।
        (চাকমা ১৯৯২: ১৬-১৭)

এই বিষাদই রূপ নেয় সংহতির। এয়ুরোপখণ্ডে কল-কারখানা বসানোর যুগে নগর-কুড়ানো কবিরা—যথা মহান শার্ল বোদলেয়ার—গ্রামকে ঘৃণা করেছেন। তাঁর পেছনে বিপ্লব, সামনে বুর্জোয়া সভ্যতার আবর্জনা। পশ্চাদভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামের কবির তাতে পোষায় না। তাঁর পেছনে বিপ্লব সামনেও বিপ্লব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস তাঁর আপনকার স্বাধীনতার আয়না বৈকি।

১৭৯০ সালের দশকে হাইতির কৃষ্ণাঙ্গ বিপ্লবী জাকোবাঁর দল যেমন ফরাশি বিপ্লবের আর ১৯৪০ সালের দশকে ভিয়েতনামীরা যেমন আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণার আয়নায় নিজেদের ছবি দেখেছেন, তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরযোদ্ধা রুমীর মার বেদনায় নিজের বেদনার ভাষা আবিষ্কার করেন চাকমা ভাষার কবি।

‘সব মুখ এক হয়ে হয় আমার মা’।
    ...
আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায় এক দীর্ঘ নদী
গোমতী, কীর্তনখোলা, কাজলঙ, রূপসা।’
সব দুঃখে ভালবাসা বেদনায় 
সব নদী একাকার হয়ে হয় এক নদী।
            (চাকমা ১৯৯২: ৩৪)

কবিতার নাম ‘বিপ্লব’। এখানেই বিদ্রোহের আদিপর্ব লিখিত হয়:

আমার সমস্ত অস্তিত্বে ঝাঁকুনি লাগে,
সমস্ত তন্ত্রে নিঃশ্বাসে কাঁপুনি লাগে,
বিপন্ন বোধে আমার ক্রোধ জাগে, জাগে তারুণ্য,
সম্মুখে আগত এক প্রজন্মের অহংকার জাগে—
জাগে সাহসী সময়, জাগে প্রেম,
জাগে দীপ্ত ভালোবাসা—বিপ্লব।
        (চাকমা ১৯৯২: ৩৫)

শেষ দুই চরণের চাকমা ভাষ্য এই রকম:

জাগি উধে রণকাল, জাগে প্রেম,
জাগে পহর কোচপানো—লাড়েই।
        (চাকমা ১৯৯২: ৩৩)

তার অজেয় প্রতিরোধের যুক্তি ক্ষুরের মতো কাটে বটে, কিন্তু কবিতা যুক্তির বিজ্ঞাপন কিংবা বীমা কোম্পানির পলিসি নয়। কবিতা সোনার চেয়ে দামী স্বাধীনতার চাবি।

রুখে দাঁড়াব না কেন!
যা ইচ্ছে তাই করবে—
বসত বিরান ভূমি
নিবিড় অরণ্যে মরুভূমি,
সকালকে সন্ধ্যা
ফলবতীকে বন্ধ্যা।
        (চাকমা ১৯৯২: ৭)

শেষ পর্যন্ত জাতীয় ভাবের আকার দেখা দেয় এই সংক্ষিপ্ত ইশতেহারে: ‘স্বাধীনতা ধক শুদ্ধ হরপ আর নেই’ যা বাংলায় দাঁড়ায় ‘স্বাধীনতার মতো শুদ্ধ আর কোন শব্দ নেই।’ কবি অধিক গাহেন:

যদি তার সম্মান দিই পারঙ,
কোচপানা ধক দোল আর কিচ্ছু নেই
যদি চিত দিঘোল কোচ পেই পারঙ,
জিংকানী ধক মনত পয্যে আর কিচ্ছু নেই
যদি জিংকানীত এক্ক ফুল ফুদেই পারঙ।
(যদি তার সম্মান দিতে পারি,
ভালবাসার মত আর কোন সুন্দর নেই
যদি তার মর্যাদা দিতে পারি,
জীবনের মত বিকশিত আর কিছু নেই
যদি জীবনে ফুল ফোটাতে পারি।)
        (চাকমা ১৯৯২: ১০-১১)

সেকালের পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশিত প্রেমাংশুর রক্ত চাই নামক কিতাবের উৎসর্গ পাতায় নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন; ‘সবাই যদি আমাকে আমার বাবার মত স্বাধীনতা দিত।’ সে অনেকদিন আগের—মোতাবেক ১৯৭০ সালের—গল্প। কবিতা চাকমাকে সে ভানটা করতে হয় নাই। কেননা তাঁর কর্তব্য ১৯৯২ সনের। তাঁর চারিদিকে যুদ্ধ।


জ্বলি ন’ উধিম কিত্তেই নামের ব্যাখ্যা—আগেই বলেছি—‘রুখে দাঁড়াব না কেন!’ এর নিকটতম ব্যাখ্যা চাটগাঁইয়া ভাষায়—‘জ্বলি ন’ উইট্টম কিল্লাই!’ স্থানভেদে—অর্থাৎ রোহিঙ্গা জবানে—‘উইট্টম’ হতে পারে ‘উড়িয়ম’। এই উদাহরণেই আকেলমন্দের চোখে পড়বে—কি চাকমায় কি চাটগাঁইয়া ভাষায়—না-বোধক পদবিন্যাস বাংলার মতন নয়—বরং উর্দু আর হিন্দির কাছাকাছি।

আর একটা মেসাল লওয়া যাক: ‘যিয়েন পরানে কয় সিয়েন গরিবে’—কথাটার বাংলা দেয়া হয়েছে ‘যা ইচ্ছে তাই করবে’। এর একটি চাটগাঁইয়া চেহারা হবে—‘যিয়ান পরানে চা’র ইয়ান গরিবা’। এই দুই ভাষার মিল-অমিলে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
আরেকটি উদাহরণ দিই বরং। খোদ ‘জ্বলি ন’ উধিম কিত্তেই!’ পদ্যটির দুইটি চরণ এরকম:

‘সকালকে সন্ধ্যা
ফলবতীকে বন্ধ্যা।’

এর চাকমা বয়ান—

‘গাভুর বেলরে সাঝ
সরয মিলেরে ভাচ।’

চাটগাঁইয়া ভাষায় ‘গাভুর’ শব্দের অর্থ—‘লিঙ্গুয়িস্টিক সার্বে অব ইন্ডিয়া’ সম্পাদক, বিখ্যাত জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন, দীনেশচন্দ্র সেনকে এক চিঠিতে জানিয়েছিলেন—‘জোয়ান’। এই কথাটায় চলতি অর্থে ‘জোয়ান মজুর’ বা কামলা বোঝায়। ‘গাভুর’ বা ‘গাবুর’ উচ্চারণভেদে ‘গাউর’ বা ‘গউর’ হয়ে দাঁড়ায়। চাকমা ভাষায়ও এর আদ্য অর্থ ‘জোয়ান’ বা ‘কচি’। সে হদিশ এখনো পাচ্ছি। ‘গাভুর বেলরে’ মানে ‘বেলা যখন জোয়ান’ অর্থাৎ সকালবেলা। ‘সরয মিলেরে’ মানে ‘সরজ নারী’ অর্থাৎ ‘রজস্বলা নারী’। আর ফলবতী মানে যে বন্ধ্যা বা বাঁজা নয়। ‘সরয’ আর ‘ভাচ’ বিপরীতার্থক শব্দ বটে। চমৎকার অনুবাদ। (সেন ১৯১১: ১০১)

আরেকটি দৃষ্টান্ত: ‘আমার সম্পূরক একমাত্র আমিই’ এই বাক্যের চাকমা ভাষ্য: ‘মর পরিপূরক গায় মুই-ই।’ ‘একলা’ অর্থে ‘গা গা’ কথাটি আজও চাটগাঁইয়া ভাষায় বিস্তর চলে। ‘মুই’ শব্দটি এখনকার ‘শুদ্ধ’ বাংলায় একপ্রকার উঠেই গেছে, ‘পর’ অবশ্য বাংলায় এখনো কায়েমমোকাম বসেই আছে। চাকমা ভাষার ‘রিনি চা’ বাংলায় হয়েছে ‘চেয়ে দেখ’। এটাকেও অনুবাদ না বলে ব্যাখ্যা বলাই বেহতর। ‘রিনি রিনি চা’ মানে যেনতেন দেখা নয়, বিশেষ কায়দায়, ‘তী²দৃষ্টিতে দেখা’। বাংলায় ‘দৃষ্টি হানো’ বললে ব্যাখ্যাটা একটু ঘন হয়, পুরো তর্জমা হয় না।

বাংলার মতন চাকমায়ও সংস্কৃতসম বা সংস্কৃতভব শব্দ এন্তার মেলে। কবিতা চাকমার কিছু সমস্যাও হয়েছে এতে। যেমন:

হাজার বযরর তৃষিত চোগ
হাজার বযরর তোচ্যে পরাণ,
ইন্দি রিনি চা, রিনি চা, রিনি চা।

বাংলায় দাঁড়ালো—

হাজার বছরের তৃষিত চোখ,
হাজার বছরের তৃষিত হৃদয়,
চেয়ে দেখ, চেয়ে দেখ, চেয়ে দেখ।
        (চাকমা ১৯৯২: ১৫-১৭)

মাঝের চরণের ‘তোচ্যে’ আদতে পয়লা চরণের ‘তৃষিত’। বাংলা তিয়াষ, তিয়াষা ক্রমে ক্রমে ‘তোচ্যে’র দিকে যাবার একটা রাস্তা মাত্র, ‘তৃষিতে’ সে পথ কাটা হয় নাই। চাকমা ‘পরাণ’ বাংলায়ও ছিল, কোনদিন কিভাবে সে ‘হৃদয়’ হল খবর নেয়ার  দরকার আছে। শুনেছি উনিশ শতকে পণ্ডিতেরা কিছুদিন কষ্টস্বীকার করে ‘হাজার’ শব্দের জায়গায় ‘সহস্র’ লিখতে চেয়েছিলেন—কিন্তু আর যাই হোক জয়ী হন নাই তাঁরা। বাংলায় এখনও চলে ‘হাজার’, তা চাকমায়ও বেশ চলেছে দেখা গেল। বাংলা ভাষার ইতিহাসে আরবি-ফারসি শব্দ কেবল ধর্মে নয়, জিরাফেও চলে। কবিতাদেবী বাংলায় ‘সহস্র’ লিখতে বেগ পেয়েছেন বলেই আমি অনুমানটা করলাম।

এক চরণে ‘তৃষিত’ আর অন্য চরণে ‘তোচ্য’ লেখার বোধ হয় হয়েছে খানিক অনিচ্ছায় বা ফ্রয়েডের ফস্কায়। তাতে মুনাফাই বেড়েছে আমাদের। বাংলা ভাষার উপর সংস্কৃতের ঢেউ একবার মাত্র নয়, বারবার আছড়ে পড়েছে। বাংলা মুলুকে তুর্কি হানাদার ঘোড়সওয়ারদের আগমনের পর পয়লা এক ঢেউ আর পলাশির ইংরেজ বাহাদুরদের বিজয়ের পর আর এক ঢেউ। (সেন ১৯৮৬)

এই প্রক্রিয়াকে আজও কিছু কিছু পণ্ডিত ‘স্বাভাবিক’ প্রভাব বলে একটা ভুল আদেশ জারি রেখেছেন। চাকমার সঙ্গে বাংলা মিলিয়ে দেখলে এখনো একটা মজা পাওয়া যায়। সংস্কৃতের ঢেউ পদ্মা-মেঘনায় যতটা আছাড় খেয়েছে কর্ণফুলি আর কাজলঙ্গে ততটা পৌঁছে নাই। ‘দীপ্ত’ শব্দটি এখন দিব্য চলে বাংলায়। এমনকি টেলিভিশন কোম্পানির নামেও উঠেছে শব্দটি। চাকমা ‘পহর’ চাটগাইয়া ভাষায় চলে, বাংলায়ও একদা চলত। চাকমায় ‘হরপ’, বাংলায় ‘অক্ষর’ অর্থে না হোক ‘শব্দ’ অর্থে চলে। এখানেও চাটগাঁইয়া চাকমা ভাই ভাই। চাকমা ‘ইন্দি’, চাটগাঁইয়াতেও ‘ইন্দি’—অথচ বাংলায় ‘এদিকে’ মাত্র। প্রত্যয় বিচারেও তাই। বাংলায় যাহা ‘সংসারে’, চাটগাঁইয়ায় আর চাকমায় তাই ‘সংসারত’।

কবিতা চাকমার বাংলা ভারি প্রাঞ্জল, এই প্রাঞ্জলতা স্বাধীন রচনার মতন। একটা উদাহরণ দিই।

ম জন্মভূমি ধক আর কন পূণ্যভূমি নেই 
কাজলঙ ধক আর কন গাঙ নেই এ সংসারত।। 
            (চাকমা ১৯৯২: ১০)

এই শ্লোকের বাংলাটি কবিতা চাকমার স্বাধীন হাতে দাঁড়িয়েছে এরকম:

জন্মভূমির মত আর কোন পূণ্যভূমি নেই
নদীর মত আর কোন সুন্দর নেই, নেই কোথাও 
            (চাকমা ১৯৯২: ১১)

দোসরা চরণের ব্যাখ্যা আরও একটা হতে পারতো: ‘কাজলঙ্গের মত আর কোন গঙ্গা অর্থাৎ নদী নেই এই সংসারে।’ কবিতা চাকমা তা করেন নাই। তিনি বিশেষকে সামান্যে পরিণত করেছেন আর বিশেষ্যকে ব্যাখ্যা করেছেন বিশেষণ বা গুণপদ দিয়ে। কাজলঙ্গ একটি নদীর নাম—সে কথাবিশেষ তিনি তর্জমা নয় তফসীরই করেছেন। ‘গাঙ্গ’ যুগপদ সামান্য নামপদ এবং বিশেষ নামপদও (বা বিশেষ্য) বটে। আদিতে গাঙ্গ মানে ছিল নদী—যে কোন নদী। গাঙ্গ থেকেই গঙ্গার উদ্ভব—একটি বিশেষ নদী। বলা বাহুল্য এই শব্দটি সংস্কৃত হওয়ার আগে মুণ্ডারি ছিল। যেমন ছিল পাড়া, আণ্ডা, আড্ডা প্রভৃতিও। ভাষায় এই বিপর্যয় হরহামেশাই ঘটে চলেছে। ‘সুন্দর’ পদটা একটা গুণপদ (বা বিশেষণ)। কবি সহজেই ইহাকে বিশেষ্য বানাতে পারেন। এই পদবিপর্যয় মূলের না অনুবাদের জানা নাই আমাদের। সবিনয় নিবেদন করি চাকমা ভাষ্যটাই আমাদের পছন্দ।


কবিতা চাকমার বাংলা ও চাকমা কবিতা পড়ে আমার ভাল করে চাকমা ভাষাটা শিক্ষা করার অভিলাষ একটা জেগেছিল। বাংলা সংস্কৃতের দুহিতা—এই মহাজন সংস্কার থেকে পণ্ডিতসমাজ ও তাদের রক্ষিতগণ আজও পুরাপুরি মুক্ত নন। মনে হয়, চাকমাদি প্রতিবেশী ভাষায় অল্পস্বল্প পড়াশোনা থাকলেও তাদের এই সংস্কারে অন্তত একটা সংশয় দেখা দিত।

বাংলা যে একদা প্রাকৃত বা শুদ্ধ কথিত ‘ভাষা’ ছিল আর আর্যভাষার আগে যারা এ দেশের জলে-মাটিতে চলাফেরা করতেন তারা নিতান্ত বোবা ছিলেন না—এই দুই অনুমানের ভিত্তিতে খোঁজখবর করলে মনে হয় কিছু সোনাদানা পাওয়া যেত। আঞ্চলিক ভাষার বৈচিত্র্য এই দিকে কিছু দিশা দেয়।

চট্টগ্রামের ভাষার সঙ্গে চাকমা ভাষার বিবিধ মিল—শব্দের ভাঁড়ারে আর পদের আসনে—দেখে অনুমান করতে সাধ হয় বাংলা প্রচারের আগে প্রদেশ চাটগাঁয় যে ভাষা চলত আজকের চাকমা মুল্লুকেও সে ভাষা বা তার কাছাকাছি কোন ভাষাই চলত। চাটগাঁইয়ার উপর বাংলার যতটা আছর আজকের চাকমা ভাষার উপর সে আছর মাত্র একমাত্রা কম। চাকমাকে বাংলার উপভাষা উপাধি দান করে জাত্যাভিমানী গোঁড়া পণ্ডিত কুটুম্বিতার গোড়ার সুতাটি দেখার সুযোগ থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছেন মাত্র। শুদ্ধ রাষ্ট্রে নয়, জাত্যাভিমান দেখি জিরাফেও আছে।

‘সাঁই কে বোঝে তোমার অপার লীলে!’

[১৯৯৮—২০২১]


দোহাই

১.   পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও গৌতম ভদ্র সম্পাদিত, নিম্নবর্গের ইতিহাস (কলিকাতা: আনন্দ, ১৯৯৮)।
২.   হুমায়ুন আজাদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম: সবুজ পাহাড়ের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরণাধারা (ঢাকা: আগামী, ১৯৯৭)।
৩.   কবিতা চাকমা, জ্বলি ন’ উধিম কিত্তেই: জ্বলে উঠব না কেন! (ঢাকা: নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা, ১৯৯২)।
৪.   মুনীর চৌধুরী, ‘বাংলা গদ্যরীতি’, মুনীর চৌধুরী রচনাবলী, ৩য় খণ্ড, আনিসুজ্জামান সম্পাদিত (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৮৪)।
৫.   মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ এবং ‘Munda Affinities of Bengali’, শহীদুল্লাহ রচনাবলী, ৩য় খণ্ড, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ সম্পাদিত (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৫)।
৬.  দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, ১ম ও ২য় খণ্ড, ৯ম সংস্করণ, অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায় সম্পাদিত (কলিকাতা: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ,     ১৯৮৬)।
৭.    Dinesh Chandra Sen, History of Bengali Language and Literature, (Calcutta: [Calcutta] University, 1991).
৮.   Jawaharlal Nehru, An Autobiography (New Delhi: Oxford University Press, 1984).
৯.    Benedict Anderson, Imagined Communities (London: Verso, 1983).
১০.  Sudhir Chandra, The Oppresive Present: Literature and Social Consiousness in Colonial India (Delhi: Oxford University Press, 1992).
১১.   Rounak Jahan, Pakistan: Failure in National Integration (New York: Columbia University Press, 1972).
১২.  Clarence Maloney, ‘Tribes of Bangladesh and Synthesis of Bengali Culture,’ in Mahmud Shah Qureshi, ed., Tribal  Cultures in Bangladesh (Rajshahi: Institute of Bangladesh Studies, 1984), pp. 5-52.