রবীন্দ্রনাথ-জগদীশচন্দ্র-অবলা বসুর বন্ধুত্ব ও টানাপোড়েন
ফরাসি কবি জাক দেলিয়ে বলছেন, ‘নিয়তি তোমার আত্মীয় বেছে দেয়, আর তুমি বেছে নাও তোমার বন্ধু।’ আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, সেই বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে—মমতা, সমবেদনা আর সাহায্যের আধার। বন্ধু তাঁর কাছে ‘এক বিশেষ জাতের মানুষ’। এমন বিশেষ জাতের মানুষ তাঁর জীবনে খুব বেশি ছিল না। আর যাঁরাও ছিলেন, তাঁরাও তাঁদের বিশেষত্বে ছিলেন অতুলনীয়। যেহেতু বন্ধুত্বে বেছে নেওয়ার বিষয়টা থাকে, তাই অ্যারিস্টটলের ভাষায় এসে দাঁড়ায় ‘যতই পুরাতন, ততই উৎকৃষ্ট ও দৃঢ়’।
বাংলায় নবজাগরণের সেই সময় কলকাতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নগরী হলেও বঙ্গদেশ যে অত্যন্ত পশ্চাৎপদ ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারপরও সেই বঙ্গদেশের দুজন ব্যক্তি প্রমাণ করেছিলেন, বাঙালিও অসামান্য হতে পারে, বিশ্বমাপের মানুষ হতে পারে। তাঁরা দুজন আর কেউ নন, একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অপরজন জগদীশচন্দ্র বসু। এই দুজনের কর্মক্ষেত্র ছিল একেবারে বিপরীত; একজন কবি, অন্যজন বৈজ্ঞানিক। কর্মক্ষেত্র অনুযায়ী তাঁদেরকে যতটা দূরের মনে করা হয়, আসলে তাঁরা তা ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একজন বিজ্ঞানী যেমন বাস করতেন, তেমনি জগদীশচন্দ্রের মধ্যে ছিলেন একজন কবি। রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানমনস্কতা ও বিজ্ঞানপ্রীতির কথা আমরা জানি; যদিও জগদীশের কবিস্বভাব ততটা পরিচিত নয়। একটি খুবই মূল্যবান বাঙলা প্রবন্ধে জগদীশচন্দ্র লিখেছিলেন যে, ‘বৈজ্ঞানিক ও কবি, উভয়েরই অনুভূতি অনির্বচনীয় একের সন্ধানে বাহির হইয়াছে। প্রভেদ এই যে, কবি পথের কথা ভাবেন না, বৈজ্ঞানিক পথটাকে উপেক্ষা করেন না।’
কবি ও বৈজ্ঞানিক উভয়ই সত্যের সন্ধানী। ব্যবধান শুধু পথের। এদিক থেকে এই দুই মনীষীর মধ্যে অবশ্যই মিল রয়েছে। তাঁরা উভয়েই নিজ নিজ পথে সত্যের সন্ধান করেছিলেন বৈকি। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের এই মহান দুই দিকপালের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়। তাঁদের সম্পর্ক শুধু বন্ধুত্বের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না, তা ছড়িয়ে গিয়েছিল নিজ নিজ ক্ষেত্রে নব নব সৃষ্টির অনুপ্রেরণায়। জগদীশচন্দ্র বিদেশে বসে রবীন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা নিজ উদ্যোগে অনুবাদ করে তা প্রচার করেছেন এবং নতুন নতুন গল্প-কবিতা লেখার জন্য অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। সময় পেলেই দুই বন্ধু মিলিত হতেন। রবীন্দ্রনাথের বহু গল্প-কবিতা-গান ও উপন্যাসের প্রথম শ্রোতা ছিলেন জগদীশচন্দ্র। দুজনই দুজনের গুণমুগ্ধ ছিলেন। এ মুগ্ধতা থেকেই একসময়ে গভীর বন্ধুত্বের জন্ম নেয়। জগদীশের যাবতীয় সংকট মোচনে বিজ্ঞানী বন্ধুর প্রতি কবির হাত প্রসারিত ছিল। বিশ্বের বিজ্ঞানসভায় ভারতের বিজয় জগদীশচন্দ্র বসুর মাধ্যমেই যে অর্জিত হবে, এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের অনুরোধেই জগদীশচন্দ্র সূচনালগ্নে বিশ্বভারতীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। জগদীশচন্দ্র বিদেশে অর্থ সংকটে পড়লে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর টাকা ধার করে তাঁকে দিয়েছেন। তাঁর বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। উদ্বোধনী সংগীত রচনা করে দিয়েছেন। তাঁর কথা কাব্যগ্রন্থ জগদীশচন্দ্রকে উৎসর্গ করে লিখেছেন, ‘সত্যরত্ন তুমি দিলে, —পরিবর্তে তার কথা ও কল্পনা দিনু উপহার।’
জগদীশচন্দ্র তাঁর অব্যক্তর একটি কপি রবীন্দ্রনাথকে উপহার দিয়ে লিখেছেন, ‘সুখে দুঃখে কত বৎসরের স্মৃতি তোমার সহিত জড়িত, অনেক সময় সেসব কথা মনে পড়ে। আজ জোনাকির আলো রবির প্রথম আলোর কাছে পাঠাইলাম।’
বই হাতে পেয়ে কবি যা লিখলেন, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি লিখলেন, ‘তোমার অব্যক্তর অনেক লেখাই আমার পূর্ব পরিচিত এবং এগুলি পড়িয়া বারবার ভাবিয়াছি যে, যদিও বিজ্ঞানবাণীকেই তুমি তোমার সুয়োরানী করিয়াছো তবু সাহিত্য সরস্বতী সে পদের দাবী করিতে পারিত, কেবল তোমার অনবধানেই সে অনাবৃত হইয়া আছে।’
রবীন্দ্রনাথের সাথে জগদীশচন্দ্রের পত্র বিনিময় শুরু হয় ১৮৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে। শেষ চিঠি ১৩৪৩ সনের পঁচিশে বৈশাখ। সব চিঠিই সাধু রীতিতে লেখা। জগদীশকে লেখা রবীন্দ্রনাথের প্রথম চিঠি পাওয়া যায় ২রা মে ১৮৯৯ সালে। সর্বশেষ ২৪ অক্টোবর ১৯১৪। রবীন্দ্রনাথ জানুয়ারি ১৯১৩ পর্যন্ত সাধুরীতিতে লেখেন। ১৮ এপ্রিল ১৯১৪ থেকে তিনি চলিত রীতিতে লিখতে শুরু করেন। এর মধ্যে বাংলা ভাষারীতির নবরূপ সাধন করে ফেলেছেন প্রমথ চৌধুরী। চলিত ভাষার সাহিত্য পত্রিকা সবুজপত্র প্রকাশনা শুরু করেন বৈশাখ ১৩২১ বঙ্গাব্দে ১৯১৪। এ কাগজের জন্য লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ চলিতরীতি গ্রহণ করেন।
বই হাতে পেয়ে কবি যা লিখলেন, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি লিখলেন, ‘তোমার অব্যক্তর অনেক লেখাই আমার পূর্ব পরিচিত এবং এগুলি পড়িয়া বারবার ভাবিয়াছি যে, যদিও বিজ্ঞানবাণীকেই তুমি তোমার সুয়োরানী করিয়াছো তবু সাহিত্য সরস্বতী সে পদের দাবী করিতে পারিত, কেবল তোমার অনবধানেই সে অনাবৃত হইয়া আছে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর © ছবি: britannica.com
রবীন্দ্রনাথের সাথে জগদীশচন্দ্রের বন্ধুত্ব শুরু হয় ১৮৯৭ সাল থেকে। আমৃত্যু সে সম্পর্ক অটুট ছিল। তাঁদের বন্ধুত্ব পেশাগত ছিল না, ছিল শ্রেণিগত। রবীন্দ্রনাথ সমাজের যে শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করতেন, জগদীশও সে শ্রেণিরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাই বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতায় কোনো টান পড়ে নাই। একই শ্রেণিভুক্ত না হলে দুজনার মধ্যে এতোটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হতো কি না এমন একটা প্রশ্ন অনেকের মনেই ছিল।
জগদীশচন্দ্র বসুর বাবা ভগবানচন্দ্র বসু সমাজের উঁচুতলার লোক ছিলেন। পুত্র জগদীশের জন্মের পর তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদ গ্রহণ করে ফরিদপুর চলে যান। চিঠিতে দেখা যায়, জগদীশ ২রা অক্টোবর ১৯০০ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে ‘আপনি’ সম্বোধন করে লেখেন। ২০শে নভেম্বর ১৯০০ থেকে ‘তুমি’তে নেমে আসেন। বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে ‘তুমি’ বলা শুরু করেন জগদীশচন্দ্রই। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘স্যার জগদীশের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য যখন আমার হয় তখন তিনি যুবক এবং আমিও প্রায় তাঁহার সমবয়সী।’
জগদীশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা বিদেশে বসে ইংরেজিতে অনুবাদ ও তা প্রচারের ব্যবস্থা করেন। তাঁদের কয়েকটি চিঠিতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
লন্ডন
২০ নভেম্বর ১৯০০
বন্ধু
তোমার দুখানা পত্র পাইয়া অতিশয় সুখী হইয়াছি। আজ প্রায় দুমাস যাবৎ অহোরাত্রি মনের ভিতর সংগ্রাম চলিতেছে। এখানে থাকিব কি দেশে ফিরিয়া যাইব। তুমিও কি আমাকে প্রলুব্ধ করিবে?
এখন তোমার বিষয়ে দু-একটি কথা লিখিব। তুমি যে কাটিং পাঠাইয়াছো তাতে আমি একটুও সন্তুষ্ট হই নাই। তুমি পল্লীগ্রামে লুকাইয়া থাকিবে তা আমি হইতে দিব না। তুমি তোমার কবিতাগুলিকে এরূপ ভাষায় লিখো যাহাতে অন্য কোনো ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব? কিন্তু আমি তোমার গল্পগুলি এদেশে প্রকাশ করিব। লোকে তাহা হইলে কতক বুঝিতে পারিবে। আর ভাবিয়া দেখিও তুমি সার্বভৌমিক। এদেশের অনেকের সাথে তোমার লেখা লইয়া কথা হইয়াছিল। একজনের সহিত কথা হয়ে আছে (শীঘ্রই তিনি চলিয়া যাইবেন।) যদি তোমার গল্প ইতিমধ্যে আসে তাহা প্রকাশ করিব। মিসেস নাইটকে অন্য একটি দিব। প্রথমোক্ত বন্ধুর দ্বারা লিখাইতে পারিলে অতি সুন্দর হইবে। তারপর লোকেনকে ধরিয়া অনুবাদ করাইতে পার না? আমি তাহাকে অনেক অনুনয় করিয়া লিখিয়াছি।
তোমার নতুন লেখা অনেকদিন যাবৎ পাঠাও নাই, পাঠাইও। আমি মনে করি তোমার কবিতা চীরকালের জন্য।
তোমার
জগদীশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বরেণ্য একজন কবির সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য তিনিও সাহিত্যের কাছাকাছি থেকেছেন। নিজে বাংলা ভাষায় লেখালেখি শুরু করার আগে জগদীশচন্দ্র বিদেশে থাকতে তাঁর বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গল্প ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। তিনি চাইতেন রবীন্দ্রনাথও তাঁর মতো বিশ্বসেরা হয়ে উঠুন।
বন্ধু
৬৫, কর্নহিল, লন্ডন
৬ই জানুয়ারি ১৯০১
তোমার পত্র পাইয়া সুখী হইলাম। তোমার দাদার পুস্তকখানা পাইয়াছি, তোমার গল্পের পুস্তক ২য় খণ্ড কবে পাইব? প্রথম খণ্ড হইতে তিনটি গল্প তর্জমা হইয়াছে। ভাষার সৌন্দর্য ইংরেজিতে রক্ষা করা অসম্ভব। কি করিব বলো? তবে গল্পের সৌন্দর্য তো আছে। এখন নরওয়ে, সুইডেন, ইতালি দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্প এ দেশে আগ্রহের সহিত পঠিত হয়, সে সবের সঙ্গে তুলনার জন্য তোমার লেখা বাহির করিতে চাই। এ দেশের লোক আজকাল অতিমাত্রায় রক্তপিপাসু হইয়াছে। ক্লিপিংই গুরু, সুতরাং পপুলার হইবে কি না জানি না। কয়েকটি গল্প একত্র করিয়া এখানকার একজন পাবলিশারের কাছে পাঠাইতে চাই। ...অনেক দর দস্তুর করিতে হইবে। প্রথমে লোকসান পূরণের জন্য টাকা চাহিবে। অথবা কোনো ম্যাগাজিনে পাঠাইতে পারি।
তোমার
জগদীশ
আরেক চিঠিতে লেখেন, ‘তোমার পুস্তকের জন্য আমি অনেক মতলব করিয়াছি। তোমার লেখা তর্জমা করিয়া এদেশীয় বন্ধুদিগকে শুনাইয়া থাকি, তাহারা অশ্রু সম্বরণ করিতে পারে না। তবে কী করিয়া পাবলিশ করতে হইবে এখনো জানি না। পাবলিশাররা ফাঁকি দিতে চায়।... ৬টি গল্প বাহির করিতে চাই।’
বিলেতে জগদীশ প্রথমে মিরিয়াম এস নাইটের সাথে রবীন্দ্রনাথের গল্প অনুবাদের বিষয়ে যোগাযোগ করেন। মিসেস নাইট তখন বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ ও প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্পগুলোর অনুবাদক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মিসেস নাইটের অনুবাদ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁর এ বিষয়ে যথেষ্ট খুঁতখুঁতানি ছিল। তাঁর কোনোটা মনমতো হতো তো কোনোটা মনমতো হতো না।
এ বিষয়ে জগদীশ কবিকে অনুযোগ করে বলতেন, ‘তুমি এমন সব সূক্ষ্ম অনুভূতি সম্পন্ন গল্প রচনা কর যার ইংরেজি অনুবাদ করা এখানে দুরূহ।’
জগদীশচন্দ্রকে লেখা এক চিঠিতে কবি সাফ জানিয়ে দেন যে, ‘মিসেস নাইটের রচনা নৈপুণ্যের প্রতি আমার বিশেষ আস্থা নেই।’
রবীন্দ্রনাথ জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে যখন শিলাইদহে অবস্থান করছিলেন তখন দুদিনের সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে জগদীশ ছুটে যেতেন তাঁর কাছে। কখনো কখনো তাঁর স্ত্রী অবলাও সঙ্গে থাকতেন। কবির কাছে জগদীশের দাবি থাকত সপ্তাহে অন্তত একটি করে ছোটগল্প চাই। কবি যথাসাধ্য সে দাবি পূরণ করতেন।
কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্রের সস্ত্রীক শিলাইদহে যাওয়া প্রসঙ্গে এক স্মৃতিচারণে লেখেন, ‘এই সময়ে পিতার ওপর জমিদারি দেখার ভার ছিল। তাঁকে প্রায়ই শিলাইদহে যেতে হতো। শীতের সময়ে তিনি পদ্মানদীর বালির চরের ধারে বোট বেঁধে বাস করতেন। তখন তিনি প্রথমে সাধনার পরে ভারতীর সম্পদনা করছেন। প্রতিমাসেই গল্প বা প্রবন্ধ লিখতে হচ্ছে। পদ্মার দিগন্তব্যাপী বালির চরে খুব নিভৃত কোনো স্থানে বোট বাঁধা থাকত, লোকজন সেখানে যেতে পারত না। গল্পের পর গল্প লিখে গেছেন এই পরিবেশে। ছোটগল্প লেখাতে উৎসাহ দিতেন জগদীশচন্দ্র। প্রতি সপ্তাহের শেষে শনিবার তিনি আসতেন। তাঁর জন্য আর একটা বজরা সর্বদাই প্রস্তুত থাকত। দু’রাত শিলাইদহে কাটিয়ে সোমবার কলেজের কাজে তিনি আবার কলকাতা ফিরে যেতেন।... আমার পিতার কাছে পৌঁছেই তিনি দাবী জানাতেন, গল্প চাই। প্রতি সপ্তাহে একটি করে নতুন গল্প পড়ে শোনানো যেন বাঁধা দস্তুর হয়ে গিয়েছিল।... পদ্মাচরে বসবাস জগদীশের বড় ভালো লাগত। দেশে বিদেশে কত সুন্দর জায়গা তিনি দেখে এসেছেন। তবু আমাদের বলতেন, পদ্মাচরের মতো এমন সুন্দর স্বাস্থ্যকর স্থান পৃথিবীর আর কোথাও নেই। তিনি আমাকে নিয়ে কচ্ছপের ডিম সংগ্রহ করতেন, এবং সেই ডিম রান্না করে খাওয়া হতো। নদীর চরে বালির ভেতরে কচ্ছপের বাসা খোঁজার কৌশল তিনি আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। স্নানের পূর্বে তিনি আমাকে দিয়ে বালির মধ্যে কয়েকটি গর্ত করিয়ে রাখতেন। সকলকে এক-একটি গর্তের মধ্যে আকণ্ঠ বালি চাপা দিয়ে শুয়ে থাকতে হতো। সমস্ত শরীর গরম হয়ে প্রায় সেদ্ধ হয়ে উঠত তখন পদ্মার ঠাণ্ডা জলে ঝাঁপিয়ে পড়া যেত। তিনি বলতেন, ‘এতে স্বাস্থ্যের বিশেষ উন্নতি হয়’।
কবিকন্যা মীরার প্রতি ছিল বসু দম্পতির অপত্যস্নেহ। এ স্নেহের আড়ালে ছিল অবলার সন্তান হারানোর বেদনা। কবির এ কন্যাটিকে বসু দম্পতি বিশেষ চোখে দেখতেন। রবীন্দ্রনাথ একবার বন্ধুর অনুরোধে মীরার একটি ছবি বিলেতে পাঠান। ছবি পেয়ে জগদীশ লেখেন, ‘ছবি পাইয়াছি, বড় সুখি হইয়াছি। আমার অনেক কালের রুদ্ধ স্নেহ তোমার কন্যার মুখ দেখিয়া জাগিয়া উঠিয়াছে।’ কবির চিররুগ্ণ কন্যা রেনুকার শ্বাসকষ্ট উপশমের জন্য জগদীশ একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিলেন। যন্ত্রটির নাম ‘ওজনের কল’।
অবলা বসু একজন বিদুষী নারী ছিলেন। অবলা বসুর বাবা দুর্গামোহন দাশের একান্ত ইচ্ছা ছিল মেয়েকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়াবেন। কিন্ত কলকাতা মেডিকেল কলেজে মেয়েদের পড়ার কোনো সুযোগ না থাকায় তিনি অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে মেয়েকে মাদ্রাজের বাঙ্গালোরে নিয়ে গিয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। দ্বিতীয় বর্ষে মেডিকেল কোর্স শেষ করার পরে অবলা বসু এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েন যে, তাঁর পক্ষে আর ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয় নাই।
অবলা বসু © ছবি: semanticscholar.org
সংগত কারণেই এঁদের বন্ধুত্বের সাথে জড়িয়ে আছেন অবলা বসুও। কবিগুরুর কাছে লেখা অবলা বসুর অসংখ্য চিঠি থেকেও আমরা এর প্রমাণ পাই। তবে অবলা বসুর দুয়েকটা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ আহত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের চিঠি থেকে আমরা এমনটি দেখতে পাই।
অবলা বসু একজন বিদুষী নারী ছিলেন। অবলা বসুর বাবা দুর্গামোহন দাশের একান্ত ইচ্ছা ছিল মেয়েকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়াবেন। কিন্ত কলকাতা মেডিকেল কলেজে মেয়েদের পড়ার কোনো সুযোগ না থাকায় তিনি অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে মেয়েকে মাদ্রাজের বাঙ্গালোরে নিয়ে গিয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। দ্বিতীয় বর্ষে মেডিকেল কোর্স শেষ করার পরে অবলা বসু এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েন যে, তাঁর পক্ষে আর ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয় নাই। পরবর্তীকালে সদ্য বিলেতফেরত প্রেসিডেন্সি কলেজের তরুণ বিজ্ঞানী অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।
নারী শিক্ষার প্রসার ও বিধবা নারীর কর্মমুখী শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে অবলা বসু বিশেষ অবদান রাখেন। ১৯১৯ সালে তিনি কলকাতা ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপ্রসাদ বসাকের সহযোগিতায় নারী শিক্ষা সমিতি গঠন করেন। অবলা বসুর প্রচেষ্টায় পরবর্তীকালে বাংলাদেশে শ দুয়েক বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। এই সব স্কুলের শিক্ষকের অভাব পূরণের জন্য তিনি বিধবা মহিলাদের ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ১৯২৫ সালে ‘বিদ্যাসাগর বাণীভবন’, ১৯২৬ সালে ‘মহিলা শিল্পভবন’ আর ১৯৩৫ সালে ‘বাণীভবন ট্রেনিং স্কুল’ তাঁর প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বামীর উইলের টাকা দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘এডাল্টস প্রাইমারি এডুকেশন সেন্টার’। দীর্ঘ দুই যুগ তিনি ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রবীন্দ্রনাথের প্রতি অবলা বসুর আন্তরিকতা ও হৃদ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের গীতি সংকলন গান বইতে কবির অবসাদগ্রস্ত মুখের ছবি দেখে আমেরিকা থেকে অবলা একটি পত্র লেখেন রবীন্দ্রনাথকে।
প্রিয়বরেষু,
২০শে নভেম্বর ১৯০৮
লন্ডন ছাড়িয়া আপনাকে পত্র লিখি নাই বটে কিন্তু সর্বদাই আপনার কথা ভাবিতেছি এবং আমরা কত সময় আপনাকে নিকটে পাইবার জন্য উৎসুক হইয়াছি। এ সময়ে আপনি আমাদের সাথে আমেরিকা থাকিতে পারিলে কত সুখী হইতাম। রথীর ফেরত যাইবার সময় হইয়াছে। আপনি কি আসিতে পারেন না? এত কথা জমিতেছে যে, আপনি এখানে থাকিলে সুখে থাকা যাইত। চিঠিতে কিছু লেখা যায় না। গানের বহিতে আপনার ছবি দেখিয়া আমরা বড় দুঃখিত হইয়াছি। এত খারাপ দেখাইতে চেষ্টা করা কি আপনার উচিৎ? আমি দেশে থাকিলে কখনই আপনাকে ঐ ছবি ছাপাইতে দিতাম না। আপনাকে জোর করিবার কেউ নিকটে নাই বলিয়া আপনি ওই ছবি ছাপাইতে দিয়াছেন। এবার দেশে গিয়া আপনাকে প্রতিজ্ঞা করাইব যে আপনি আমাকে না দেখাইয়া কোনো ছবি কাহাকে দিবেন না। আমি জানি, আপনি বৃদ্ধ বয়সের ভান করিবেন কিন্তু আমার কাছে তাহা করা সঙ্গত হইবে না—কারণ আমার স্বামী আপনা হইতে বড় অথচ তাঁহাকে আমি কিছুতেই বৃদ্ধ সংজ্ঞায় অভিহিত হইতে দিব না। আমেরিকা আসিলে আপনি নিজেকে বৃদ্ধ বলিতে লজ্জাবোধ করিবেন, কারণ তখন মনে হইবে আলস্য ইহার কারণ।...ঐ ছবি দেখিয়া আপনাকে মানসিক ও শারীরিক অবসাদের প্রতিমূর্তি মনে হয়, কিন্তু আমাদের কবিকে এই অল্প বয়সে অবসন্ন দেখিতে পারিব না। আপনাকে আরো কাজ করিতে হইবে জানেন?
কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমি যখন আমেরিকায় কলেজে পড়ছি, জানতে পারলুম জগদীশচন্দ্র আমেরিকা পরিভ্রমণে আসছেন। কয়েকটি ইউনিভার্সিটি বক্তৃতা দেয়ার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ করেছে। এই খবর পেয়ে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলুম। তখনই ছুটলুম আমাদের কলেজের ডীনের কাছে। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে আনতেই হবে আমার এই সনির্বন্ধ অনুরোধ তাকে জানালুম। ডীন ড্যাভেনপোর্ট পণ্ডিত মানুষ। বিজ্ঞান জগতের যথেষ্ট খবর রাখেন। তিনি সহাস্যে বললেন, ‘তুমি যা চাও তাই হবে।’ সেই শুনে আমি জগদীশচন্দ্রকে চিঠি লিখলুম যে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চিঠি পেলে তিনি যেন উপেক্ষা না করেন। হার্ভার্ড, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিখ্যাত না হলেও তিনি অপেক্ষাকৃত ছোট এই বিদ্যায়তনে সমঝদার শ্রোতা হয়ত বেশি পাবেন।’
অবলা বসু রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেন, ‘রথীদের সাথে এখনো দেখা হয় নাই। জানুয়ারিতে দেখা হবে। রথী ওঁর লেকচার দেয়া সম্বন্ধে খুব খাটিয়াছে। ফলে এত নিমন্ত্রণ আসিয়াছে যে উনি সব রাখিতে পারিলেন না। কেবল ৫ প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেবেন। এখানে বোস্টনসহ যে দুইটা বক্তৃতা দিয়াছেন তাহাতে সকলেই খুব প্রশংসা করিয়াছেন। এখানে ওঁর বই অনেক লোক পড়িয়াছে। ওঁ ওঁর ‘লাইন অফ থট’-এর এক মস্ত শ্রেণী আছে, তাহারা ওঁকে খুব অভ্যর্থনা করিতেছে।’
অবলা বসু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ যে বহু প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন, কখনো কখনো সেই সব প্রতিষ্ঠানের সাথে রবীন্দ্রনাথকেও যুক্ত করতে চেয়েছেন, তাঁর সহযোগিতা চেয়েছেন। ১১ এপ্রিল ১৯১০ সালে লেখা একটি চিঠি তেমনই ইঙ্গিত দেয়।
কবিবরেষু,
...আপনার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে কিছু লেখেন নাই। আশাকরি ভালো আছেন।...আপনি অবসর মতো আমাদের স্কুলের মেয়েদের জন্য যদি কোনোরূপ লেখা লিখিয়া দেন তাহা হইলে উপকার হয়। আপনাকে ইংরেজি কয়েকখানা বই পাঠাই তাহা হইতে বুঝিবেন কিরূপ আমি চাই। আপনার ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষার’ মতন কোনো লেখা হইলেই হইবে। আর আপনি যখন কলকাতা আসেন তখন কি একবার ব্রাহ্ম মেয়েদের স্কুলের শিক্ষার্থীদের সহিত দেখা করিয়া শিক্ষা সম্বন্ধে কিছু বলিবেন? বোলপুরে যেসব বই পড়ান তাহা কোথায় পাওয়া যায়? আমাকে একটা সিলেবাস পাঠাইয়া দিতে পারেন কি? সন্তোষকে যদি বলেন তবে সে পাঠাইয়া দিবে। আমি মেয়েদের স্কুলে আপনাদের পড়া দেখাইতে চাই।
তবে এই মধুর সম্পর্কের মধ্যেও কোথায় যেন সুর কেটে গিয়েছিল। মানুষমাত্রই রহস্যময় প্রাণী। কোথায় কখন নিত্য নিয়মের ছন্দপতন হয় বলা মুশকিল। এই দুই পরিবারের আন্তরিকতা ও সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যেও কোথায় যেন এক তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল। জগদীশচন্দ্রের আচরণে প্রকাশ না পেলেও অবলা বসুর আচরণে এটি স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে।
নিঃসন্তান দম্পতি জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসু তাঁদের ভাগ্নে অরবিন্দ মোহনকে পুত্রের মতো লালন পালন করেছিলেন এবং কবিবন্ধুর আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাবশত তাঁকে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মাশ্রমে পাঠান। রবীন্দ্রনাথ পুত্রসম যত্নে তার শিক্ষার বন্দোবস্ত করেন। কিন্তু ব্রহ্মাশ্রমের প্রতি অরবিন্দ মোহনের অতিরিক্ত আকর্ষণ অবলা বসুর পছন্দ ছিল না। অরবিন্দের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে অবলা বসু তাঁকে নিজের কাছে এনে রাখার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। অরবিন্দ সে চিঠি রবীন্দ্রনাথকে দেখান। চিঠি পড়ে রবীন্দ্রনাথ বন্ধুপত্নীর প্রতি বিরূপ হন। তিনি অরবিন্দের কাছে এক চিঠিতে লেখেন—
তোমার মামীর চিঠি পড়ে দেখলুম। তিনি আমার সম্বন্ধে এতটা বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছেন যে, আমার মত কি তা ভালো করে পড়েও দেখেননি। আমি কোনো প্রবন্ধে কোনো জায়গাতেই বলিনি যে ‘বয়কট’ বন্ধ করা উচিৎ। আমি কোথাও আভাসেও বলিনি যে ভারতবর্ষে সব জাতিকেই ঠিক একই ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। পৌত্তলিকতার দোষগুণ সম্পর্কে কোনো কথা এ পর্যন্ত আমি উত্থাপন করিনি। আমি কেবলমাত্র এই কথাটুকু বলিয়াছি যে, ‘বয়কট’ই করি আর যাই করি অন্যায় অসত্য অধর্মকে অবলম্বন করে চললে কিছুতেই আমাদের শ্রেয় হবে না। যা সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ সত্য যা সর্বোচ্চ মঙ্গল, তাকে কোনো উপস্থিত প্রয়োজন সাধনের কাছে খর্ব করে কাজ উদ্ধারের চেষ্টা করতে পারব না, তা সে চেষ্টাকে যত বড় দামই দাও না।
আর এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ অরবিন্দকে লিখেছেন, ‘তোমার মামী যে আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছেন সেটা কেবল বর্তমান সময়ের উত্তেজনাবশত। এই জন্য আমার উপরে অনেকে বিরক্ত হয়েছেন। এ সমস্তই আমাকে গ্রহণ করতে হবে।’
এ ঘটনার কয়েক দিন পর রবীন্দ্রনাথ বন্ধু জগদীশচন্দ্রকে একটি পত্র লেখেন। এই পত্র পাঠ করে অবলা বসু রবীন্দ্রনাথকে লেখেন, ‘অনেকদিন পর আপনি অধ্যাপক মশায়কে পত্র দিয়াছেন। তার চিঠির উত্তর তিনি নিজেই দেবেন।...আপনি যে আমাদের বোলপুরে চান না, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ আমাদের যাইতে লেখেন নাই।’
একজন বিজ্ঞানীর সাথে একজন সাহিত্যিক ও কবির কত সুন্দর সম্পর্ক হতে পারে তা জগদীশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের কথোপকথন ও ফটোচিত্র দেখলে বোঝা যায়। বসু বিশ্বকবির খুব কাছের মানুষ ছিলেন। জীবনের বিশেষ মুহূর্তগুলোতে পরম অমৃতের জন্য ছুটে যেতেন একে অপরের কাছে। জগদীশের প্রেরণাতে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য লিখেছিলেন বিজ্ঞানভিত্তিক বই বিশ্ব-পরিচয়।
জগদীশচন্দ্র বসু © ছবি : বোস ইন্সটিটিউটের সৌজন্য
এ প্রসঙ্গে জগদীশচন্দ্র বসুকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এবারে আপনাকে বোলপুরে আসার কথা বলিনি তার কারণ, কিছুদিন থেকে আমি অনুভব করছিলুম এই বিদ্যালয়ের প্রতি আপনার হৃদয় অনুকূল নয়। অথচ এই বিদ্যালয়টি আমার জীবনের সাধনার ক্ষেত্র, আমার দেবতা এইখানে; এ সামান্য স্কুল মাত্র নয়। আপনি মনে লেশমাত্র বিমুখতা নিয়ে আসবেন, এখানে এসে কেবলমাত্র কৌতূহল চরিতার্থ করে যাবেন, এ আমার পক্ষে অসহ্য। অনেক লোক তেমনভাবে এখানে আসে যায়। আমি পৃথিবীর সকল লোকের কাছেই সহানুভূতির কাঙালবৃত্তি করতে তো চাইনে...কিন্তু আপনাদের তেমন উদাসীন দেখতে পারিনে। সে জায়গায় আমি সকলের চেয়ে পার্থক্য লাভ করেছি। সে জায়গায় আপনাদের যদি কোনো বিরোধ থাকে তবে সেখানে খেলাচ্ছলেও আমাদের কোনো মিলন হতে পারে না।’
কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ-জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসু নানা স্থানে ভ্রমণে যেতেন। বৌদ্ধ গয়ায় ভগিনী নিবেদিতাও সঙ্গী হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
বুদ্ধদেবের বোধিলাভের পুতস্থান জগদীশচন্দ্র, নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথ তিন মনীষীর একমাত্র সমাবেশে অপূর্ব এক পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল।
মাত্র দু-তিনদিনের তীর্থধাম কিন্তু তারই মধ্যে কত গল্প, কত আলোচনা, কত পরামর্শই না হয়েছিল। অনেক রাত পর্যন্ত জগদীশচন্দ্র, ভগিনী নিবেদিতা ও পিতৃদেব বৌদ্ধ ধর্ম, ইতিহাস নিবিষ্ট মনে আলোচনা করতেন। নিবেদিতা এক একটি তর্ক তোলেন আর পিতা চেষ্টা করেন তার যথাযথ সমাধানে পৌঁছুতে।
এর মধ্যে অনেকটা সময় কেটে গেছে। ৩০ নভেম্বর ১৯৩৬ সালে অবলা বসু রবীন্দ্রনাথকে একটা চিঠি লেখেন, যেখানে অভিযোগের সুর স্পষ্ট। চিঠিটি নারী শিক্ষার প্যাডে লেখা—
আপনার পত্র যথা সময়ে পাইয়াছি। আপনার বহুমূল্য জীবন। তাহা এই সামান্য কাজের জন্য পীড়িত হয়, আমরা কেহই তাহা করিতে পারি না। কাগজে আবার আমরা নোটিশ দিতেছি যে আপনি আসিবেন না। অনর্থক আমাদের অবিবেচনার জন্য আপনাকে উৎপীড়িত করিলাম। নিজগুণে ক্ষমা করিবেন। মাঘোৎসবের পর যদি কলকাতা আসেন তখন আশা করি বাণী ভবনে আসিবেন।
কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ স্মৃতিচারণে লেখেন, ‘গ্রীষ্মকালে দার্জিলিঙের মায়াপুরীতে জগদীশচন্দ্র থাকিতেন। তার কাছেই গ্লেন ইডেনে আমাদের বাসা। যে বছরের কথা বলছি তখন জগদীশচন্দ্রের স্বাস্থ্য ভগ্নপ্রায়। আমার পিতা ঘন ঘন তাঁর কাছে যেতেন। কাব্যালোচনা বিশেষ হতো না। পিতৃদেবের কাছ থেকে তখন জগদীশচন্দ্র শুনতে চাইতেন দার্শনিক প্রসঙ্গ। বেশ বোঝা যেত, তাঁর মনের মধ্যে জীবন-মৃত্যুর রহস্য নিয়ে তুমুল আন্দোলন চলছে। বৈজ্ঞানিক যুক্তিবিচার তাঁকে যেন সম্পূর্ণ তৃপ্তি বা শান্তি দিতে পারছে না। প্রচলিত ধর্মমতও পুরোপুরি গ্রহণ করতে তাঁর বৈজ্ঞানিক মন সায় দিচ্ছে না। তাই ক্রমাগত কবিকে প্রশ্ন করতেন, তাঁর সাধনার ফলে তিনি কি উপলব্ধি করছেন। বিজ্ঞানির বা তত্ত্বজ্ঞানিরা অনেক বিচার প্রমাণের জটিল রাস্তায় ঘুরে ফিরেও যে মিমাংসায় পৌঁছতে পারে না-কবি বা সাধক হয়ত তাঁদের সহজ অন্তর্দৃষ্টির গুণে অনায়াসে তার সন্ধান পেয়েছেন, এই ধরনের একটি বিশ্বাস হয়ত তাঁর হয়েছিল এবং এই জন্যই আমার পিতাকে এ বিষয়ে তিনি ক্রমাগত প্রশ্ন করতেন।’
সময়, ব্যস্ততা, ভিন্ন দর্শন, খ্যাতি অনেক সময় মানুষের ব্যক্তিক সম্পর্ককে বদলে দেয়। এই বদল পরিবার, পরিজন, বন্ধু, ভক্ত সব ক্ষেত্রে ঘটতে পারে। এমন অনেক মান অভিমান সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের সাথে জগদীশচন্দ্রের বন্ধুতা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর অবলা এই বন্ধুতা সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘জীবনের শেষ বৎসরও উনি প্রত্যহ গ্রামোফোনে কবির স্বর—
আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহল ভরে
আজি হতে শতবর্ষ পরে
শুনিয়া শয়ন করিতে যাইতেন। উনি আজীবন কবির গুণগ্রাহী এবং সর্বদাই বলিতেন যে, ‘কবির মত সর্বোতমুখী প্রতিভা বিরল, প্রায় দেখা যায় না।’
একজন বিজ্ঞানীর সাথে একজন সাহিত্যিক ও কবির কত সুন্দর সম্পর্ক হতে পারে তা জগদীশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের কথোপকথন ও ফটোচিত্র দেখলে বোঝা যায়। বসু বিশ্বকবির খুব কাছের মানুষ ছিলেন। জীবনের বিশেষ মুহূর্তগুলোতে পরম অমৃতের জন্য ছুটে যেতেন একে অপরের কাছে। জগদীশের প্রেরণাতে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য লিখেছিলেন বিজ্ঞানভিত্তিক বই বিশ্ব-পরিচয়।
দুজন বড় মানুষের সম্পর্কের মধ্যে নিজ নিজ দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গির কারণে হয়তো মতপার্থক্য ঘটতে পারে। কখনো কখনো দ্বন্দ্ব এসে ভর করতে পারে। দুজনের মধ্যে পারস্পরিক তুলনা হয়তো সাময়িক অস্বস্তির জন্ম দিতে পারে। কিন্তু তাঁদের হৃদ্যতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় ফাটল ধরাতে পারে না।
তথ্য সূত্র
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: জগদীশ চন্দ্রকে লেখা পত্র; তারিখ ২৪ নভেম্বর ১৯২১, রচনা সংগ্রহ: দেজ পাবলিশিং; কলকাতা, ২০১৩।
২. জগদীশচন্দ্র বসু: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা পত্র; তারিখ ২৩ নভেম্বর ১৯২১, রচনা সংগ্রহ: দেজ পাবলিশিং; পৃ ১২৫, কলকাতা ২০১৩।
৩. অরুণ কুমার মুখোপাধ্যায়; প্রমথ চৌধুরী সবুজপত্র, দেশ সাহিত্য সংখ্যা, কলকাতা, ১৩৯৭।
৪. জগদীশচন্দ্র বসু; প্রাণ প্রজ্ঞার পথিক; সম্পাদক সফিক ইসলাম: বিজ্ঞান চিন্তা, ২০১৫।
৫. জগদীশচন্দ্র বসু স্মারক গ্রন্থ: সম্পাদক সালাম আজাদ, কোনার্ক প্রকাশনী, বাংলাবাজার ঢাকা, ২০০৩।
৬. সুব্রত বড়ুয়া; রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্র, মুর্ধন্য, ঢাকা, ২০১১।
৭. অবলাবান্ধব দ্বারকানাথ ও কাদম্বিনী: নারায়ন দত্ত, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা ২০০৬।
৮. জগদীশচন্দ্র বসু, অব্যক্ত, শুদ্ধস্বর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১২।