ম্যাক্সিম গোর্কি ও আমাদের এই সময়

 

উপলক্ষ ম্যাক্সিম গোর্কির মৃত্যুদিবস। তবে আজকের এ আলোচনার মূল লক্ষ্য এই দিনটিকে কেন্দ্র করে গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী আন্দোলনে সাহিত্য-সংস্কৃতির ভূমিকার দিকে ফিরে তাকানো; খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা সাহিত্যিক-সংস্কৃতিজন এই কালে এই দেশে সঠিক ভূমিকা রাখতে পারছেন কি না। এ প্রসঙ্গও অবশ্য অনেক পুরোনো। কিন্তু কিছু পুরোনো প্রসঙ্গের দিকে বারবার ফিরে তাকাতে হয়। বিশেষত আমাদের মতো দেশে, যেখানে কখনো কখনো সামরিক স্বৈরাচারী শাসন সবার কাঁধে চেপে বসে থাকে, কখনোবা বেসামরিক বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ছদ্মাবরণে কার্যত একনায়কতান্ত্রিক শাসনই বহাল থাকে, চালু থাকে গণতান্ত্রিক কায়দায় নির্ভেজাল অগণতন্ত্রই। ম্যাক্সিম গোর্কির মতো সাহিত্যিকদের অনুপস্থিতি এখানে আমরা বারবার অনুভব করি।

ম্যাক্সিম গোর্কি সম্পর্কে আপনাদের সামনে কোনো কিছু বলতে যাওয়া এক অর্থে চর্বিতচর্বণ মাত্র। সবারই কম-বেশি গোর্কিকে জানা আছে। হতদরিদ্র ঘরের মানুষ ছিলেন তিনি। বেড়ে উঠেছেন এমন অসহনীয় দারিদ্র্যে, এমন এক অমানবিক পরিবেশে যে, সেসব ভাবতে গেলে গা শিউরে ওঠে। পৃথিবীতে অনেক দরিদ্রই সাফল্যের শীর্ষে উঠেছেনকিন্তু গোর্কির মতো ঘাত-প্রতিঘাত তাদের আর কাউকেই বোধ করি সহ্য করতে হয়নি। তাঁর লেখা আত্মজীবনীমূলক বই আমার ছেলেবেলা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা বোধ করি এর সঙ্গে দ্বিমত করবেন না যে, এ রকম নির্দয় শৈশবের লিখিত বিবরণ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। তাঁর আত্মজীবনীমূলক তিনটি বই আমার ছেলেবেলা, পৃথিবীর পথে আর পৃথিবীর পাঠশালা পড়তে গেলে বারবার ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়। এমন ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে ব্যক্তিগত জীবনে অনেকেই সচ্ছলতা এনেছেন, সাফল্য এনেছেন, নিজের শ্রেণি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন এক শ্রেণি-সোপানে নাম লিখিয়েছেন; কিন্তু নিজের শ্রেণির মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন, পাশাপাশি কোটি কোটি মানুষের মনে মানবমুক্তির স্বপ্ন রোপণও করেছেনএমন সাহিত্যিক ছিলেন কেবল ম্যাক্সিম গোর্কি।

গোর্কি কেন এখনো প্রাসঙ্গিক? প্রাসঙ্গিক এ কারণেই যে, গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী আন্দোলনে সাহিত্য ও সংস্কৃতি যে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারে, এই সত্যের সঙ্গে গোর্কির কর্মযজ্ঞ লীন হয়ে আছে। গোর্কি দাঁড়িয়ে আছেন মানবসমাজের মুক্তিকামী পুরোধা সাহিত্যিকদের সারিতে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একজন সাহিত্যিক বা সংস্কৃতিকর্মীর সম্পৃক্তি ও সম্পর্ক কেমন হতে পারে, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতেও গোর্কি আমাদের পথ দেখান। সোভিয়েত রাশিয়ার বলশেভিক পার্টির সঙ্গে গোর্কির সম্পর্ক নিবিড় ছিল, এটি যেমন সত্য, তেমনি এ-ও সত্য যে নিজের শৈল্পিক সত্তাকে তিনি কখনো বিসর্জন দেননি, পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকার পরও তার সাহিত্যের অনুশীলন ছিল পার্টি-রাজনীতির প্রভাবমুক্ত

ম্যাক্সিম গোর্কি এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছিলেন, কেননা তিনি বইয়ের সংস্পর্শে এসেছিলেন আর জীবনকে জানার চেষ্টা করেছিলেন। বস্তির মানবেতর পরিবেশের মধ্যে থাকলেও বই পড়ার মধ্য দিয়ে তিনি আলাদা একটি জগৎ খুঁজে পেয়েছিলেনতাঁর লেখা তিনজনা উপন্যাসে যেমন আমরা দেখি, তিন বন্ধুর মধ্যে দুই বন্ধু ব্যর্থ হচ্ছেন নতুন একটি পথ খুঁজে নিতে, কিন্তু পাভেল আবিষ্কার করছে, জীবনকে ঢেলে সাজানো সম্ভব, জীবনকে ঢেলে সাজাতে হবে। ঠিক তেমনি তিনি ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে থেকেও নিজের একটি আলাদা জগৎ তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। নিজের একটি স্বপ্নযাত্রা তৈরি করেছিলেন। বই পড়ার মধ্য দিয়ে তিনি চিনেছিলেন সমকালীন সমাজ আর সেই সমাজের মানুষদেরও। বই পড়ার যে সীমাবদ্ধতা আছে, সেটিও অবশ্য বলে গেছেন তিনি,

বইয়ের মাধ্যমে দুনিয়ার যে নতুন রূপ ও আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য আমার চোখের সামনে ফুটে উঠেছিল, তার প্রভাবে মত্ত হয়ে আমি মানুষের চেয়ে বইকেই অধিকতর হৃদয়গ্রাহী ও আপন বলে মনে করতে আরম্ভ করেছিলাম। জীবনের বাস্তব ঘটনাবলিকে বইয়ের আতশি কাচের মধ্য দিয়ে দেখার ফলে কিছুটা অন্ধত্বও ঘটেছিল আমার চোখে। যাহোক, জীবন, যা প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞতম ও কঠোরতম শিক্ষক, সে-ই আমার এই আনন্দময় অন্ধত্বকে ঘুচিয়ে দিল।

তিনি বলেছেন,

মানুষ ব্যতীত অন্য কোনো কিছু জানবার আগ্রহ আমার বিন্দুমাত্র নেই। এবং এর জন্য বই-ই বন্ধু এবং মহানুভব পথপ্রদর্শকের কাজ করে। যে নিরহঙ্কার বীর মানুষেরা দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর ও মহান বস্তুনিচয় সৃষ্টি করেছে, তাদের জন্য আমার অন্তরে রয়েছে অপরিসীম গভীর শ্রদ্ধা।

মানুষের প্রতি এই গভীর শ্রদ্ধাবোধ আছে বলেই গোর্কি সমাজতন্ত্রের পথিক হওয়ার পরও শ্রেণিনির্বিশেষে সব পাঠকের কাছেই এখনো বিস্ময়করভাবে জনপ্রিয়। ১৯৩৩ সালে ইভান বুনিনের হাত ধরে প্রথমবারের মতো নোবেল পুরস্কার আসে সোভিয়েত রাশিয়ায়। অথচ ওই বছর গোর্কির নামও পুরস্কারের জন্য উত্থাপন করেছিলেন একজন। কেবল ১৯৩৩ সালেই নয়, এর আগে ১৯১৮ ও ১৯২৩ সালে একজন করে এবং ১৯২৮ সালে দুজন মনোনয়নকারীর কল্যাণে পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় উঠে আসে তাঁর নাম। কিন্তু একবারও শেষ পর্যন্ত তিনি চূড়ান্তভাবে মনোনীত হননি। বোঝাই যায়, পশ্চিমা শিল্প-সাহিত্যবোদ্ধারা শেষ পর্যন্ত এই উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে, তাঁর সাহিত্যের সুদূরপ্রসারী প্রভাব শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদের জন্য প্রীতিকর কিছু হবে না।

গোর্কির সাহিত্যের এই সুদূরপ্রসারী প্রভাবের চেহারাটি কেমন? বেশি দূর যেতে হবে না, আমাদের দেশের দিকে তাকালেই তা অনুভব করা যায়। গোর্কির মৃত্যু ঘটেছিল ১৯৩৬ সালে। কিন্তু এর আগেই অনুবাদের সুবাদে বাংলা সাহিত্যের অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের মন কেড়ে নেন তিনি। প্রসঙ্গত বলে নেওয়া ভালো, গোর্কি সারা বিশ্বে তাঁর প্রায় প্রতিটি গ্রন্থের জন্যই সুপরিচিত; কিন্তু এসবের মধ্যে আত্মজীবনীভিত্তিক ত্রয়ী উপন্যাস আমার ছেলেবেলা, পৃথিবীর পথে এবং পৃথিবীর পাঠশালায় ও উপন্যাস মার আবেদন কেবল সর্বস্তরস্পর্শীই নয়চিরকালীনও। যদিও পশ্চিমা সাহিত্য আলোচকেরা বরাবরই বিশেষত তাঁর মা উপন্যাসটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছেন এই বলে যে, এটি রাজনৈতিকতার দোষে দুষ্ট। কিন্তু তাই যদি হয়, তা হলে চার্লস ডিকেন্স-এর ধ্রুপদি উপন্যাস আ টেলস অব টু সিটিসকেও এই বলে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় যে, এটি বুর্জোয়া রাজনীতি-সংস্কৃতির মহীয়ানতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার দোষে দুষ্ট। কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে থেকে মানুষ খুঁজে পেতে চায় নিজের ক্ষয় আর ক্রন্দন, খুঁজে পেতে চায় ত্যাগ-তিতিক্ষা আর হৃদয়ের দহন; চায় নিজেকে বদলে ফেলার আবাহন। পশ্চিমা সাহিত্য সমালোচকদের অব্যাহত সমালোচনার পরও মার পাঠকপ্রিয়তা তাই আদৌ কমেনি। কারণ, একটি উপন্যাসের যে অন্যতম বৈশিষ্ট্যমানুষের বেড়ে ওঠা, চড়াই-উতরাই আর টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে চলমান এক দূরযাত্রার বয়ান, তা এ উপন্যাসকে নতুন এক মাত্রা দিয়েছে। লেওনিদ লেওনফকে এক চিঠিতে গোর্কি লিখেছিলেন, আমি দেখতে ভালোবাসি মানুষের বেড়ে-ওঠা, তা এ উপন্যাসের পাতায় পাতায় সুস্পষ্ট। মায়ের বেড়ে ওঠার ও বদলে যাওয়ার বিস্ময়কর অথচ বিশ্বস্ত বর্ণনার মধ্য দিয়ে গোর্কি পাঠকদের মন জয় করেছেন। জালালউদ্দীন রুমীর একটি কথা অনেকেরই জানা। বলেছিলেন তিনি, অতীতে তিনি চালাক ছিলেন, তাই পৃথিবীটাকে পাল্টাতে চেয়েছিলেন; এখন তিনি জ্ঞানীও হয়ে উঠেছেন, তাই নিজেকে পাল্টে ফেলতে শুরু করেছেন। দেখার ব্যাপার হলো, গোর্কির এই উপন্যাসে আমরা দেখছি, মায়ের রূপান্তর ঘটছে, তিনি মনে করছেন পৃথিবীকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন, ঢেলে সাজানো সম্ভব আর পৃথিবীকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে তিনি প্রথমে নিজেকেই ঢেলে সাজাচ্ছেন। পৃথিবীকে পাল্টাবেন বলে তিনি চাইছেন নিজেকেও পাল্টে ফেলতে। গোর্কির সৃষ্টি পাভেলের মা নিলভ্না রুমীকেও অতিক্রম করে হাঁটেন পৃথিবীর পথে।

আর কে না জানে, গোর্কি নিজেও সারা জীবন এই জন্মবদলের সংগ্রাম করে গেছেন। মা ছিল না, বাবা ছিল না; থাকতেন নানাবাড়িতে, আর প্রচণ্ড নিষ্ঠুর নানা তার ওপর যে নির্যাতন চালাতেন, তার বিবরণ পড়তে গেলে শিউরে উঠতে হয়। আমরা যেন ভুলে না যাই যে গোর্কি ছিলেন স্বশিক্ষিত, আত্মপ্রশিক্ষিত। আমরা যেন ভুলে না যাই, এত হতাশাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন তিনি যে, আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, জীবন জয়ের পথেই হেঁটেছেন। মুচির দোকানে কাজ করেছেন, স্টিমারে রসুইখানার বাসনপত্তর ধুয়েছেন, খেতমজুরির কাজ করেছেন, রাজমিস্ত্রিগিরি করেছেন, কাজ করেছেন রুটির দোকানে, চেষ্টা করেছেন ড্রাফটসম্যান হওয়ার। এমনকি চোর-ছ্যাচ্চরদের সঙ্গেও দিনের পর দিন জীবনযাপন করেছেন তিনি। কারাভোগ করেছেন তিনি ১৮৮৯, ১৮৯৮ এবং ১৯০১ সালে একবার করে এবং ১৮৯১ সালে দুবার। জীবনকে ঢেলে সাজানো সম্ভবদেখিয়ে গেছেন তিনি।

ভারতবর্ষে ম্যাক্সিম গোর্কির সুদূরপ্রসারী প্রভাবের শুরু পরাধীনতার কাল থেকেই। ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে আমরা বাংলায় তাঁর বিখ্যাত মা বইটি পড়ে আসছি। যত দূর জানা যায়, সেই ১৯৩৩ সালে এ বইয়ের প্রথম পর্ব নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। তাঁর পুত্র মনোরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় পরিচয় পত্রিকায় পিতাকে নিয়ে গত ১৯৯৪ সালে একটি লেখা লিখেছিলেন। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, এই অনুবাদকর্মটি সে যুগে একেবারে অপরিকল্পিতভাবে হয়নি। এর পেছনে সে যুগে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজটির সম্পর্ক ছিল নিবিড়। এই নিবিড় সম্পর্কের কথা তিনি জানিয়েছেন কমিউনিস্ট নেতা, বিদ্রোহী কবির বন্ধু মুজফফর আহমদের বক্তৃতাকে উদ্ধৃত করে। গোর্কির জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৬৮ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে দেওয়া ভাষণে মুজফ্‌ফর আহমদ বলেছিলেন:

১৯২৫ সালের ২৫শে ডিসেম্বর তারিখ। বাঙলা সাপ্তাহিক লাঙল প্রথম বার হয়েছিল। এখানা ছিল, লেবার স্বরাজ পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র। তার মলাটের ওপর লেখা থাকত, প্রধান পরিচালকনজরুল ইসলামলাঙলের প্রথম সংখ্যা হতেই তাতে মার অনুবাদ বার হতে থাকে। অনুবাদ করেছিলেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। অল্প-অল্প করে এই অনুবাদ বেশ [কিছু] দিন লাঙলে বার হয়েছিল। তারপরে অনুবাদ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণের প্রচণ্ড অর্থাভাব ছিল। কিন্তু লাঙল তাকে কিছু দিতে পারছিল না।

আর আমাদের এই ভূখণ্ডে, বাংলাদেশে মা-এর মঞ্চায়ন ঘটে সেই ১৯৬৭ সালে। মঞ্চনাটকের রমরমা দিনগুলোয় প্রায় নিয়মিত মঞ্চস্থ হতো তাঁর অবিরাম পাউরুটি ভক্ষণ। এসব ঘটনা থেকে পরিষ্কার, বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী আন্দোলনের প্রাথমিক পর্ব থেকেই এর সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত রচনার ক্ষেত্রে গোর্কির সাহিত্যকর্ম ভূমিকা রেখে আসছে। ব্রিটিশ শাসনামলেই মা উপন্যাসের দুটি পর্বের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ গ্রন্থাকারে প্রকাশ পেলে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পরে আরও কয়েকজন বাংলায় এটি অনুবাদ করেন। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পায় পুষ্পময়ী বসুর অনুবাদ। যা প্রকাশিত হয়েছিল প্রগতি প্রকাশন থেকে।

গোর্কি যে ভারতবর্ষের মুক্তি আন্দোলনের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত, এর আরেকটি উদাহরণ চেতন আনন্দ পরিচালিত হিন্দি সিনেমা নিচা নগর। এটিই ভারতবর্ষের প্রথম চলচ্চিত্র, যা কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পেয়েছিল। ১৯৪৫ সালে নির্মিত এ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন রফিক আনোয়ার, কামিনী কৌশল, উমা আনন্দ, রফি মীর প্রমুখ। রবিশঙ্কর এ ছবিতেই প্রথম সংগীত পরিচালনা করেছিলেন। ছবিটি নির্মাণ করা হয়েছিল ম্যাক্সিম গোর্কির দ্য লোয়ার ডেপথ [১৯০২] নাটক অবলম্বনে।

গোর্কি যদি আমাদের দেশের অধিকাংশ সাহিত্য-সংস্কৃতিজীবীর মতো হতেন, তাহলে কী ঘটত? আমাদের দেশের কোনো কোনো সাহিত্যিক-সংস্কৃতিজীবীকে প্রায়ই বলতে শুনি, এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার। এর কোনো বিকল্প নেই। এর বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। বললে তা জঙ্গি-মৌলবাদীদের পক্ষে যাবে। তাদের উত্থান ঘটবে। সরকারের সমালোচনা করা মানেই তার পতনের বুদ্ধিবৃত্তিক পথ তৈরি করা। গোর্কি কিন্তু এ রকম করেননি। হ্যাঁ, তিনি বলেছেন, সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের একমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী জোট একযোগে চক্রান্ত করছে। পতন ঘটানোর ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু তিনি এ কথা বলেননি, সরকারের সমালোচনা করা চলবে না। বলেননি, সরকারের সমালোচনা করার মানেই ষড়যন্ত্র

কথা হলো, গোর্কি কেন এখনো প্রাসঙ্গিক? প্রাসঙ্গিক এ কারণেই যে, গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী আন্দোলনে সাহিত্য ও সংস্কৃতি যে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারে, এই সত্যের সঙ্গে গোর্কির কর্মযজ্ঞ লীন হয়ে আছে। গোর্কি দাঁড়িয়ে আছেন মানবসমাজের মুক্তিকামী পুরোধা সাহিত্যিকদের সারিতে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একজন সাহিত্যিক বা সংস্কৃতিকর্মীর সম্পৃক্তি ও সম্পর্ক কেমন হতে পারে, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতেও গোর্কি আমাদের পথ দেখান। সোভিয়েত রাশিয়ার বলশেভিক পার্টির সঙ্গে গোর্কির সম্পর্ক নিবিড় ছিল, এটি যেমন সত্য, তেমনি এ-ও সত্য যে নিজের শৈল্পিক সত্তাকে তিনি কখনো বিসর্জন দেননি, পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকার পরও তার সাহিত্যের অনুশীলন ছিল পার্টি-রাজনীতির প্রভাবমুক্ত। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের সময় গোর্কির বয়স ছিল ৪৯-এর মতো। বিপ্লবের পর লেনিন এক নির্দেশে বলেছিলেন, গোর্কিকে স্বাধীনভাবে থাকতে দাওওই নির্দেশ কিন্তু আমাদের এ-ও উপলব্ধি করতে শেখায় যে, একজন সত্যিকারের সাহিত্যিককে পার্টি-রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হয়ে চলতে হবে। ভূমিকা রাখতে হবে। সাহিত্যিককে যেমন এই উপসংহারটিকে ধারণ করতে হবে, তেমনি ধারণ করতে হবে রাজনীতিকদেরও। এবং গোর্কি এই সত্যকে ধারণ করেছিলেন। ধারণ করেছিলেন বলেই যোশেফ স্ট্যালিনের শাসনামলে তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে বলতে গেলে গৃহবন্দি অবস্থাতে। বিপ্লবী সরকারের সব সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নিতে পারেননি, পত্রপত্রিকায় ভিন্নমতও প্রকাশ করেছেন একাধিকবার। লেখক-বিজ্ঞানীদের গ্রেপ্তার করার ঘটনায় প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন তিনি। বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে নানা আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধেও বারবার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান তিনি। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই মৃত্যু ঘটে যক্ষ্মায় আক্রান্ত গোর্কির। মৃত্যুর পর প্রশ্ন ওঠে, তাঁর মৃত্যু সত্যিই স্বাভাবিক কি না। অভিযোগ ওঠে, বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে তাঁকে। এ জন্য কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়। অবশ্য পরবর্তী সময়ে স্ট্যালিনবিরোধীরা এ রকম অভিযোগ করে আসছেন যে, স্ট্যালিন এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তার অপছন্দের, কয়েকজন রাজনৈতিক বিরোধিতাকারীকে শাস্তি দেওয়ার নামে উৎখাত করেছেন। প্রকৃত ঘটনা যা-ই হোক না কেন, এতে কোনো সংশয় নেই যে, গোর্কি বাকস্বাধীনতা না থাকার পরও ঝুঁকি নিয়ে নিজের অভিমত প্রকাশ করেছেন, বাক-ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণের প্রতিবাদ করেছেন।

গোর্কি যদি আমাদের দেশের অধিকাংশ সাহিত্য-সংস্কৃতিজীবীর মতো হতেন, তাহলে কী ঘটত? আমাদের দেশের কোনো কোনো সাহিত্যিক-সংস্কৃতিজীবীকে প্রায়ই বলতে শুনি, এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার। এর কোনো বিকল্প নেই। এর বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। বললে তা জঙ্গি-মৌলবাদীদের পক্ষে যাবে। তাদের উত্থান ঘটবে। সরকারের সমালোচনা করা মানেই তার পতনের বুদ্ধিবৃত্তিক পথ তৈরি করা। গোর্কি কিন্তু এ রকম করেননি। হ্যাঁ, তিনি বলেছেন, সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের একমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী জোট একযোগে চক্রান্ত করছে। পতন ঘটানোর ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু তিনি এ কথা বলেননি, সরকারের সমালোচনা করা চলবে না। বলেননি, সরকারের সমালোচনা করার মানেই ষড়যন্ত্র। বলেননি তিনি স্ট্যালিন সরকারের নিঃশর্ত অনুগত সমর্থক। বলেননি বলেই তাঁকে মৃত্যুর আগে গৃহবন্দী জীবনযাপন করে যেতে হয়েছে। এখানেই গোর্কির সঙ্গে, তাঁর সমসাময়িক সাহিত্য-সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে আমাদের এসব সাহিত্যিক-সংস্কৃতিজনের বড় তফাত।

এখন বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে গেলে, এমন কোনো সংস্কৃতিজন কিংবা সাহিত্যিক খুঁজে পাওয়া ভার, যিনি বা যাঁদের অবস্থান আমাদের এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভরসা জোগাবে। অতীতে, যেমন ধরা যাক, আমাদের স্মরণকালেই, বিভিন্ন সামরিক শাসনামলে রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হলে, সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন আয়োজন ধীরে ধীরে এর প্রতিবাদ করার পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করে দিত। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোও প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠার পথ ও মাঠ খুঁজে পেত। কিন্তু এখন আপাতদৃষ্টে রাজনৈতিক অধিকার থাকার পরও চারপাশে মানুষের অধিকারহীনতার যে বিস্তৃতি ঘটেছে, তাকে রুখে দেওয়ার কোনো প্রস্তুতি দূরে থাক, বরং সেই অধিকারহীনতাকে সাড়ম্বরে মেনে নেয়াটাই যেন সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিজনদের নিয়তি হয়ে উঠেছে। দুই দশক ধরে খুব সন্তর্পণে আমাদের সবার মধ্যে একটি ভয় জাগিয়ে তোলা হয়েছেপ্রতিক্রিয়ার চক্রে জীবন চলে যাওয়ার ভয়, সারা দেশ মৌলবাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ার ভয়, প্রতিকূল শাসনের কারণে এক দীর্ঘ অন্ধকার সময়ে প্রবেশের ভয়। এসব ভয়ের বাস্তবতা নিশ্চয়ই আছে; কিন্তু সেই বাস্তবতাকে ব্যবহার করা হচ্ছে গণতান্ত্রিক কায়দায় একটি অগণতান্ত্রিক সময়কে প্রলম্বিত করার/করবার স্বার্থে। ভয় দেখিয়ে অনুগত আদর্শবানদের কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে নির্বিবাদে অগণতন্ত্রের চাষাবাদ করা হচ্ছে।

এই ঘটনা আমাদের সবাই জানেন, আসামের জাটিঙ্গা গ্রামে পরিযায়ী পাখিরা দল বেঁধে মরে যায়। কেউ কেউ বলেন, অন্ধকার রাতে তারা দিক হারিয়ে ফেলে, তখন সবাই মিলে আলোর দিকে তীব্র বেগে যাত্রা শুরু করলে কোনো কিছুর সঙ্গে লেগে তাদের মৃত্যু ঘটে। ঘটনাটি যেভাবেই ঘটুক না কেন, এটি এখন মনে করছি এ কারণে যে, এখন চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি, বলা চলে একেবারে ঝাঁক বেঁধে দলবদ্ধভাবে শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মীদের বলতে গেলে প্রায় সবাই মেতে উঠেছেন, কে কার আগে অনুগত হতে পারবেন, সেই প্রতিযোগিতায়। বড় বেশি প্রশ্নহীন তারা। অথচ সাহিত্যিক-সংস্কৃতি কর্মীদেরই সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করার কথা এমন সময়কে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের এই জবাবদিহি করতে হবে, কার্টুনিস্ট কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদ যখন গ্রেপ্তার হন, মুশতাকের যখন মৃত্যু ঘটে তখন আমরা কতটুকু প্রতিবাদ করতে পেরেছি? মুশতাক আহমেদের কুমিরের খামার পি কে হালদারদের দখলে চলে গেছেপি কে হালদার সুন্দরভাবে বিদেশে পাড়ি জমাতে পেরেছেন আর মুশতাকের জামিন আবেদন বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, শেষ পর্যন্ত কারাগারেই মৃত্যু ঘটেছে তাঁর। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আবির্ভূত হয়েছে সাহিত্যিক, সংস্কৃতিজন, সাংবাদিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে নিপীড়নের নতুন এক হাতিয়ার হিসেবে। অথচ এই আইনের পক্ষে সাফাই গাওয়ার মতো মানুষেরও দেখছি অভাব ঘটছে না। আমরা যখন সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করেছি, তখন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ভূমিকা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। এখন সেই জোট মানুষের কাছে কেন সমালোচিত, কেন উপহাসের পাত্র, তা কি কখনো এর পরিচালকেরা ভেবে দেখেছেন? আমাদের একটি শিল্পকলা একাডেমি আছে, সেখানে দুর্নীতি-অনিয়মের যেসব খবর আমরা সংবাদপত্রে পড়ি, তাতে বিস্মিত হতে হয়, সমাজের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অংশ হিসেবে পরিচিত সংস্কৃতিসেবীরা এমন দুর্নীতিবাজ হন কী করে!

এমন পরিস্থিতিতে এটি ভাবতে অবাকই লাগে, এই পৃথিবীতে ম্যাক্সিম গোর্কি নামের একজন মানুষ ছিলেন, লেখক ছিলেন। যিনি আমাদের একদা উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, কাজী নজরুল ইসলামের মতো একজন মানুষ জন্মেছিলেন আমাদেরই এই দেশে। যিনি বলে উঠেছিলেন, আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ। এ তো খুব বেশি দিন আগের ঘটনা নয়, যখন সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীরা অধিকার আদায়ের দাবিতে, গণতন্ত্রের দাবিতে রাজপথে সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। গোর্কির এই মৃত্যুদিবস আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, আমাদের সেই ঐতিহ্য আর ধারাবাহিকতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। বড় বেশি সংকটাপন্ন। আর সে কারণে মানুষও বোধ করি সাহিত্যবিমুখ। গণতান্ত্রিক আর সাম্যবাদী আন্দোলন সংকটাপন্ন হওয়ার এটিও যে একটি বড় কারণ, তা বোধ করি বলার অপেক্ষা রাখে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, এমন দুঃসময়ে আমাদের গোর্কির কাছেই ফিরতে হবেযিনি দেখিয়ে গেছেন, জীবনকে ঢেলে সাজানো সম্ভব, জীবনকে ঢেলে সাজাতে হবে।

 

লেখকের নোট

নিবন্ধটি লেখা হয়েছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ৫০ বছর পূর্তিতে ম্যাক্সিম গোর্কির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১৮ জুন আয়োজিত গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী আন্দোলনে সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভূমিকা শীর্ষক আলোচনা সভায় দেওয়া বক্তৃতার ভিত্তিতে।