নানাজানের খোয়াব

 

মাকে নিয়ে নানাবাড়িতে পৌঁছে দেখি, মেঘভাঙা আলো তেরছা হয়ে নানাজানের পায়ের পাতা ছুঁয়ে আছে। বুড়ো মানুষটি কাকঘুমে এলিয়ে আছেন মড়ার মতন। মাতামহের আবাস এখন ঈশান কোনের অপাঙ্‌ক্তেয় ঘরে। স্যাঁতসেঁতে উঠোনে আধ-খাওয়া কলা, ঝরা পালক আর পুরোনো জুতা। কাঁঠালচাঁপা আর কলাপাতায় ছোট্ট ঘরটিকে বেশ নিঝুম দেখায়। কালোজিরে ধানের স্তূপ পেরিয়ে আমার মা সোজা চলে যান পুরোনো ঘরের দিকে। নানাভাই চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ডেকে উঠলেন, ফাতেমা, ফাতেমা! মা দৌড়ে গিয়ে অশ্রুজলে নানাকে কদমবুচি করল। অশীতিপর মানুষটি বছর কয়েক আগ থেকেই প্রায় অন্ধ। আমি ভেবে পাই না, দুহিতার আগমন দৃষ্টিহীন পিতা টের পেলেন কী করে? বৃদ্ধের মুণ্ডিত মস্তকে কদমফুলের রোয়ার মতন অপুষ্ট চুল। তার বরফ-রঙা দাড়ি নেমেছে বুক অবধি। ঘন ভুরু-জোড়া পেকে ঝুনা হয়ে গেছে। তার বাদামি মুখে ছোপ ছোপ তিল আর অজস্র বলিরেখার মানচিত্র। এক ঝি এগিয়ে এসে বলল, খালা আইছে, খালা আইছে! নানাভাইয়ের পুরোনো তক্তপোশে বসে আমি বাপ-বেটির আবেগী কথা শুনি।

মলিন শয্যায় নির্জীব হয়ে পড়ে থাকা মানুষটিই আমার মাতামহ? আগে যদিও কিছু আবছা আবছা দেখতে পেতেন, কয়েক বছর ধরে বলতে গেলে নানাজান অন্ধই। চলনশক্তিও রহিত প্রায়। তবে তার স্বাস্থ্য বেশ ভারিক্কি হয়েছে। বয়স আর দৃষ্টি-বন্ধ্যত্বের কারণে ডাকসাইটে মানুষটি হয়ে এখন গেছেন সবার করুণার পাত্র। নানাজানের একমাত্র কন্যা আমার মা ব্যস্ত থাকেন নিজের সংসার নিয়ে। নানার তিন পুত্রদুজন বিভিন্ন মফস্বল শহরে বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। তারা মাঝে মাঝে আর্থিক সংকটে পড়ে কিংবা তাদের ছেলেরা কেউ ইউরোপ-আমেরিকা যাবে এই অজুহাতে বাড়িতে এসে কিছু জমি বিক্রি করে। আবার ব্যস্ততার ভান করে কর্মস্থলে কেটে পড়ে। বড় মামাও ইদানীং বাতের ব্যারামে কষ্ট পাচ্ছেন খুব। তার ছেলেরা ঢাকায় থাকে, তবে কী করে ব্যাপারটা স্পষ্ট নয়। নতুন তরুণী বউ-ঝিরা নানার কোঠার দিকে খুব একটা পা মাড়ায় না। জানালার কার্নিশে মাকড়সার জালে একঝাঁক মশা আটকা পড়েছে। সনাতনী পালঙ্কে বিবর্ণ বালিশ-তোশক আর ক্লথ দেখে একটু খারাপ লাগল এই জন্য যে, নানাভাইকে কখনো ধপধপে নরম চাদর ছাড়া ঘুমাতে দেখিনি। বিপত্নীক নানাজানের কাজ শুধু খাবার খাওয়া, টয়লেটে যাওয়া, হা-হতাশ করে শুয়ে থাকাসর্বোপরি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা। বৃদ্ধের বিনোদন ছন্দময় জিকির। অবশ্য দমকা কাশি এলে একসময় নিরস্ত হতে বাধ্য হন।

গত এক দশকে ব্যস্ততা বা কিছুটা বেখেয়ালে নানাভাইকে দেখতে আসা তো দূরের কথা, ভালো করে খোঁজখবরও নেওয়া হয়নি। আজ বৃদ্ধ পূর্বপুরুষকে এই অবস্থায় দেখে দৌহিত্র হিসেবে নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হলো। বুড়ো মানুষটি সেই আগের মতো ঝানু কুমোরের মতন পরম মমতায় আমার মুখে আলতো করে খসখসে হাত ছোঁয়ান। তার দীর্ঘ শ্বেতশ্মশ্রুর নরম কিনারা এসে আমায় মুখে চামরের দোলা দেয়। কাতুকুতুর মতো লাগে। বৃদ্ধের দৃষ্টি নেই, তবু মিইয়ে যাওয়া চোখ বেয়ে অশ্রুজল ঝরে পড়ে। পরম মমতায় আমার পিঠে হাত দিয়ে আগের মতন দেশবিদেশের খবর জানতে চান। শ্লেষ্মাজড়িত কণ্ঠে হাঁক দেন, তোরা কই গেলি? আমার নাতির জন্য কচি ডাব পাড়। বার্ধক্যের কারণে তার মুখের ভাষা বেশ ফেসফেসে, তবে অতিথি সৎকারের দায়িত্বজ্ঞান বেশ টনটনে। এক মুখরা ঝি ঘোমটার আড়াল থেকে টিপ্পনী কাটে, বাব্বা, বিলেতের নাতির জন্য কত দরদ! নানাজানের দাঁত নেই, তবু তিনি উচ্চস্বরে হাসেন। আবার উবু হয়ে খুক খুক কাশেন।  

বৃদ্ধ নানা আমার করতলে আঙুল রেখে বললেন, আমার নাতি কত বড়ো সাহেব হইছে, বিলেতে থাকে। আগে নানার বাড়িতে কত আসলে যাইতে চাইত না। আমি হেসে সায় দিই। সত্যিই তো, কিশোরকাল অবধি এ বাড়িতে কত রকম আমোদে দিন কেটেছে। তালুকদার পদবির নানাভাই ছিলেন অপেক্ষাকৃত সম্পদশালী। কয়েকটা বৃহৎ ধানের গোলা, দীর্ঘ বাংলোঘর, গরুর পাল, কয়েকজন বাঁধা ঝি আর আশ্রিত দু-একজন মানুষ নিয়ে এই বাড়িতে ছিল এলাহি কারবার। নিলামে উঠা সাবেক কালের তালুকদারির জন্য হাহাকার না করে নানার পিতা পরিশ্রমে আর সততায় সম্পদ রক্ষা আর বৃদ্ধিতে মনোযোগী হয়েছিলেন। সূক্ষ্ম রুপার কাজের আলবোলা আর রঙিন শতরঞ্চিতে এই বাড়ির বৈঠকখানা বনেদি সৌন্দর্যে ঝলমল করত। নানাভাই এমনিতে ছিলেন মিতবাক মানুষ। জলদকণ্ঠে ঝি-চাকরদের হুংকার দিতেনপান দে, তামুক দে। আমরা উঠোনে এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতে দেখতাম, পরিচারিকা শরবতি বা অন্য কোনো ঝি লম্বা ঘোমটা টেনে জলভরা কাচের জগ আর আলপনা-আঁকা পানদানি দিয়ে আসত। ছোটখাটো মানুষটি বিষণ্ন মুখে পিতলের রেকাব থেকে ছোট্ট চামচ দিয়ে পানপাতায় খয়ের, চুন, জর্দা মাখতেন। আবার এলাচির গন্ধ শুঁকে মুখে পান পুরতেন। চারদিকে খুশবাই ছড়িয়ে পড়ত। পায়ের কাছে বসে গোমস্তা তাজিমের সাথে আলবোলার নল এগিয়ে দিলে তিনি দুয়েক চুমুক দিয়েই বিশাল কাজের ফিরিস্তি বলে ক্ষান্ত হতেন। কর্তামানুষটির ব্যক্তিত্ব তার অনামিকার আকিকের আংটির মতোই জ্বলজ্বল করত। নিঃশব্দে প্রচুর খেয়ে-টেয়ে অল্পক্ষণ জিরিয়ে তিনি বাইরে চলে যেতেনসালিস-দরবার, সামাজিক কাজকর্ম আর জমি-জিরাতের হিসাব নিয়ে তার বিরাট যজ্ঞ। মানুষটির ভয়ে সবাই নিশ্চুপ থাকত, কিন্তু নানির কাছে এসে এই রাশভারী প্রৌঢ় মানুষটিও শিশুর মতো গলিয়ে গলিয়ে পড়তেন। এ নিয়ে অনেকে হাসাহাসিও করত।

 

অশীতিপর নানাভাই হাসিহাসি মুখ করে বেঢপ বালিশে হেলান দিয়ে বসেছেন। তিনি ডাবের পানিতে চুমুক দেন। চুকচুক শব্দ হয়। কিছু পানি গড়িয়েও পড়ে তার ফতুয়ায় গলাবন্ধে। মা গামছা দিয়ে তার বুক মুছে দেন। নানাজান এবার বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র হয়ে আমাকে টুকটাক প্রশ্ন করেন। আবার হেসে বলেন, মনে আছেভাই, ছোট্টবেলায় একবার নৌকা থেকে নদীতে পড়ে গেছিলা!

এবার স্মৃতিকাতর হওয়া ছাড়া আমার উপায় থাকে না। আহা রে, সোনারঙা শৈশব। একবার নানাভাই এলে আনন্দে ঝলমল হয়ে মাসহ আমরা তিন ভাইবোন নৌকায় চড়ি। গন্তব্য নানার বাড়ি। দুগ্ধপোষ্য বোনটি ছইয়ের ভিতর গম্ভীর হয়ে ঘুমায়। কানে বিড়িগোঁজা মাঝির কাছে গিয়ে অগ্রজ লুলু নাও বাইবার কসরত জানতে চায়। ঘাম ঝরে পড়ে বিরক্ত মাঝির উদোম গায়। বইঠা থামিয়ে মাঝি রোদেপোড়া গামছা দিয়ে মাথা মোছে। মাঝির সহকারী পেছন থেকে নিঃশব্দে এসে বাতাস বাঁচিয়ে করতলে কুণ্ডলী পেঁচিয়ে বিড়ি জ্বেলে উস্তাদের মুখে পুরে দেয়। মাঝি লম্বা টান দিয়ে বিষণ্ণ মুখে ধোঁয়া ছাড়ে। এই ফাঁকে অগ্রজ লুলুর মাঝি হবার সাধ জাগে। একটু চোরা চাহনিতে এদিক-ওদিক চেয়ে সে ডান হাতে বইঠা স্পর্শ করে। মায়ের বারণে লুলুকে অনিচ্ছায় পিছু হটতে হয়। মাঝি নির্বিকার হয়ে আবার নৌকা বাইতে শুরু করে। আমি মায়ের গা ঘেঁষে পক্ষীছানার মতো বসে জলকন্যার কিসসা শুনি। রূপসী মায়ের মুখে জলপরীর অবয়ব শুনে মনে হয় তিনি বুঝি সেই অশরীরীর যমজ বোন। আবার উবু হয়ে জলতরঙ্গের দিকে চেয়ে থাকি এই বুঝি মাথা উঁচিয়ে ভেসে আসবে অপার্থিব সৌন্দর্যের জলপরী। লুলু এসব ছাইপাঁশ এড়িয়ে সারা নৌকায় ঘুরে বেড়ায়। মা বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকান, পানিতে পড়বি রে, লু-লু। প্রলম্বিত সে ডাক নদীর ঢেউয়ে আছড়ে পড়ে, কিন্তু লুলুর কানে যায় না। আর এদিকে বাঁক ঘুরতে গিয়ে নদীতে দোলা লাগে, বোকা আমি গলুই বেয়ে ছিটকে পড়ি নদীর জলে। মাঝির সহকারী ছোকরা সাথে সাথেই লম্ফ দিয়ে নেমে আমায় নৌকায় উঠিয়ে দেয়।

নানাভাই মাঝির চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে বেশ গম্ভীর হয়ে অজিফা পড়েন। একটু পরে খাজা খিজিরের গল্প শুরু করেন। শৈশবের অনুসন্ধিৎসায় গল্পের মাঝখানে আমি প্রশ্ন করি, নানু, সারেং কী? মাতামহ এক টুকরো জবাব দেন, সারেং হলো অকূল দরিয়ায় চলা বিশাল বিশাল জাহাজের নাবিক। মা মুখ বাড়িয়ে আজ্ঞা দেন, বাবারা, তোরা কেউ কিন্তু সারেং হবি না; সারেং-সুকানিরা মাসের পর মাস সাগরে পড়ে থাকে। আমি তোদেরকে না দেখে এক দিন থাকতে পারি না। লুলু প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়ে বসল, সে বড় হয়ে সারেংই হবে। মা হাহাকার নিয়ে বলেন, এ তো দেখি ছোটখাটো জলদস্যু! একটুও দয়ামায়া নাই। আমাদের কথার ছেদ কাটে দূরাগত কীর্তনের মায়াময় সুরে। প্রেমময় সুর গাঙের ঢেউয়ের মতো আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে আবার হারিয়ে যায় চরাচরে। আনমনা মায়ের দৃষ্টি চলে যায় মেঘের পানে। আমিও আবদার করি, মা, আমিও নাবিক হবো। মা শিশুকন্যা কোলে নিয়ে ধীরলয়ে ছড়া কাটেন

আমি সাগর পাড়ি দেবো আমি সওদাগর
সাত সাগরে ভাসবে আমার সপ্ত মধুকর।
চলবে আমার বেচাকেনা বিশ্বজোড়া হাটে
ঢেউ-এর দোলায় মরালসম চলবে দুলে দুলে।

হবু সারেং লুলু পেয়ারা কামড়ে কোমলস্বরে বলে, মা, জাহাজে আমরা তোমাকেও নিয়ে যাব। মুহূর্তেই মায়ের মুখে অপার্থিব হাসি ফোটে। নানাজানও গাম্ভীর্য ভেঙে উচ্চস্বরে হেসে ওঠেন। মাঝি ঠোঁট উঁচিয়ে পানের ফিক ফেলল নদীর জলে। চলমান নৌকা থেকে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, কোমল জলে রাশি রাশি লাল শাপলার মেলা বসেছে। যত দূর দৃষ্টি যায়, ঢেউয়ের তালে মৃদুলয়ে নৃত্য করে গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকমল। শান্ত কিনারের দিকে পান্নাসবুজ কেয়া, হোগলা আর পাটিগাছের ঝাড়। অচেনা ফুলের গন্ধ ভেসে নাকে লাগে। আমার উৎসুক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে নানাভাই সস্নেহে জানিয়ে দেন, কেয়ারবনে ফুল ফুটছে।

মা ভিতর বাড়িতে চলে গেলে নানাভাইয়ের পাশে বসি সেই ফেলে আসা দিনের গল্প শুনি। আচমকাই দুর্গন্ধ এসে নাকে লাগল। সচকিত হয়ে পরিচারিকা বলল, আমনে বড় ঘরে চইলা যান। বুঝলাম, অসময়ে খাওয়া ডাবের পানি বুড়ো মানুষের হজম হয়নি। বড় দালান পেরিয়ে দেখি, ঢেঁকিশালের বেঢপ কেদারায় বসে বড় মামি ভোজের আয়োজনে ব্যস্ত। সোনার রুলি ছাপিয়ে তার করতলে বড়সড় রুপালি চামচ। মুখে হাসি মেখে তিনি কাকে যেন ডাক দেন, কেদারায় তোয়ালে বিছাই দে। লক্ষ করলাম, তালুকদার বাড়িটিতে এখনো সাবেকি ঐশ্বর্যের থকথকে ছাপ। খাটের নিচে বসে আরামসে মাছভাজা খায় জ্বলজ্বলে চোখের হুলো বিড়াল। বাড়ির বউ-ঝিরা মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমি বাগান পেরিয়ে বাঁশবন-ছাওয়া গোরস্তানের দিকে এগোই। শ্রীহীন এই জায়গা দেখে কে বলবে, এটাই ছিল আমাদের আমাদের বৃন্দাবন। এককালের অনিন্দ্যসুন্দর বাগানটি শরিকদের মধ্যে ভাগ হয়েছে। আমার পরিচিত লতাগুল্ম-গাছগুলো কি একটাও নেই। কোথায় গেছে সেই কাঁঠাল, বিলেতি গাব, আমড়া আর আমগাছের সারি? পাতাশূন্য মরা গাছের গা বেয়ে কাঠবিড়ালি দৌড়ে পালায়। তেড়াবেড়া গুঁড়িতে লালচে পিঁপড়ার মেলা বসেছে। ছালওঠা অর্জুনগাছকে কেমন বিবর্ণ দেখায়। এই বাগানে সফেদা, জামরুল, কাউ, গোলাপজাম গাছের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। পুকুরপাড়ের টসটসে আকন্দবনে উড়ে বেড়ায় নিশঙ্ক প্রজাপতি। কোথায় সেই ছায়াময় কুঞ্জবন যেখানে চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে কিশোর-কিশোরীরা গলদগর্ম হতাম। কয়েকটা বিশ্রী বাদুর উড়ে গিয়ে ভাঙা পাঁচিলে বাড়ি খেয়ে আবার কলাবনে থামল। একটু-আধটু কিচিরমিচির শুনি। কী যেন ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ঝুপ করে নালায় পড়ল। ঘোলা জল ছিটকে পড়ল লতাপাতায় গায়ে। সম্ভবত এটি দীর্ঘজীবী গুইসাপ। স্যাঁতসেঁতে কচুবনের পাশে ঝিম ধরে আছে আঁশটে গাছ। মনে পড়ে, একবার এক যুবতী ঝিকে ভূতে ধরেছিল। ঝাঁকড়া চুলের ওঝা এসে ধোঁয়া উড়িয়ে মন্ত্রতন্ত্র পড়ে এই গাছের ডাল দিয়ে পিটিয়ে ভূত ছাড়িয়েছিলেন। কিশোরবেলার সেই ভূতগাছ কি আজও রহস্যময় রয়ে গেছে? গা ছম ছম করে উঠলে সামনে যাই। কত বছর পর নিবিড় ঢেঁকিশাক আর স্বর্ণলতার ঝাড় দেখলাম। কালচে মাটির বুকে জীর্ণ পাতা আর কড়ই ফুলের পরাগ, দু-একটি বাসি শিমুল। অই তো, পুকুরপাড়ে হলদে পাতার ফাঁকে থেঁতলে যাওয়া আধ-খাওয়া হলুদ ফলঠিক যেন পুরীষ! হ্যাঁ, এই তো আমার ছেলেবেলার ডেউয়া ফল। দেখতে কেমন যেন ঘিন ঘিন লাগে, তবু বেশ লাগত লবণ-মরিচ মেখে ডেউয়া খেতে। আলগোছে ঢোক গিললাম। নানাভাই এই অপাঙ্ক্তেয় ফলের এক বাহারি নাম দিয়েছিলেনবনকাঁঠাল! লতাপাতার আড়ালে দেখলাম, এক গম্ভীর ঘাতক কুঠার কাঁধে নিয়ে নিবিড় বাগানে ঢুকল। আরেকটু চলতেই উঁচু ঢিবি আর কাঁচাপাকা গোরের সারি। স্তব্ধতা চূর্ণ করে দিয়ে দূরে কোথাও দাঁড়কাক কাঁদে করুণস্বরেকা, কা।  

কবর জিয়ারত শেষে ফিরে এলে নানাজান আমার সাথে আলাপচারিতায় মগ্ন হন এভাবে

ভাইজান, এত দিনেও বিবাহ করলা না, শাদা মেমও কি মনে ধরে না?
নানাভাই, বিলেতি স্বর্ণকেশীদের সাথে ঘুরা যায়, নাচা যায়। কিন্তু বিয়ে তো আসলে জটিল বিষয়।
বেশি পইড়া, বেশি ঘুইরা তোমরা বেশি বোঝো। এবার একটা লক্ষ্মী মাইয়া বিবাহ করো। মরার আগে নাতবউয়ের মুখ দেখি। তোমার বয়স তো হয়েছে। ভালো রোজগার করো। তুমি সুপাত্র। সঙ্গী হিসেবেও তো একজন নারী দরকার। আর বুড়ো বয়সে তোমাকে দেখবে কে?
নানিজান মারা গেছেন কত আগে। আপনাকে কে দেখে, নানাজান?
সবাই এখন ব্যস্ত। তোমার বড় মামা অসুস্থ। অন্যদের কত কাজ। তাদের নিজেদের সংসার আছে, চাকরি আছে। একটা নাতি বিদেশ যাইব। কত খরচ। চাইলেও আমাকে দেখতে আসতে পারে না। এখন আমারে আর কে দেখবে? নাচার হয়েছি। চোখেও দেখি না। তোমার নানিজান ইন্তেকাল করায় ভালোই হইছে। নইলে বুড়ি বেশ মুশকিলে পড়ত। আমি এখন অচল পয়সা।
নানিজানের কবর জিয়ারত করে এসেছি।
আচ্ছা, বিলেতে বুড়ো-বুড়িদের কে দেখে? শুনলাম, ওইখানে তো মানুষজন আরও ব্যস্ত। পারিবারিক বন্ধন-টন্ধন নাই।
ওখানে বুড়োরা সাধারণত থাকেন বৃদ্ধাশ্রমে। বুড়োদের উপযোগী প্রাতিষ্ঠানিক সেবাদানকারী লোক, নার্স, ওষুধ, পার্ক, বিনোদনসবই আছে। বেশ পেশাদারত্ব গড়ে উঠেছে এসব ওল্ডহোম ঘিরে। বৃদ্ধদের থাকবার সুন্দর বন্দোবস্ত। নিঃসঙ্গ মানুষজন একেবারে অপাঙ্ক্তেয় থাকেন না, হোমে বুড়োদের বন্ধুতা বা একটা সমাজ গড়ে ওঠে। বৃদ্ধাশ্রমে থাকে বলে তাদের কোনো হা-হুতাশও দেখিনি।
আচ্ছা, ব্যস্ত ছেলেমেয়ে-নাতিনাতনি কি সেই সব বুড়োকে দেখতে আসে?
বিশেষত জন্মদিন, ক্রিসমাস বা বিভিন্ন পার্বণে ফুল-কেক উপহার দিতে ভুল হয় না। পরিবারের লোকজন মাঝে মাঝে চকোলেট আর কার্ড নিয়ে বুড়োদের দেখতে আসে।

মামির বড় দালান থেকে ভোজের এত্তেলা আসায় উঠতে যাচ্ছি এমন সময় নানাভাই সন্তর্পণে বললেন, ভাই, দেখো, একটা বৃদ্ধাশ্রম বানাইতে পারো কি না। জায়গা যা লাগে আমি দিব। অচল বৃদ্ধদের নিয়া ব্যস্ত লোকজনের সমস্যা হবে না।

ফিরতি পথে আমি মায়ের কাছে নানাজানের বৃদ্ধাশ্রম বানানোর স্বপ্নের কথা বলি। মা টিপ্পনী কাটেন, আমাকেও কি তোরা সেই বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসবি? লাকসাম রেলওয়ে সিগন্যালে আমাদের গাড়ি থামলে এক ফকির থালা বাজিয়ে গান গায়, বাবা ভাণ্ডারি, লাইন ছাড়া চলে না রেলগাড়ি..। মা ম্লান গলায় বললেন, তোর নানার বাড়িতে নয়, আমাদের এদিকে একটা আশ্রম বানা যেখানে অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা থাকবে। তোর নানা বৃদ্ধাশ্রমের জন্য জায়গাই-বা দেবে কোত্থেকে? সব জায়গা-জমি লিখে-পড়ে দিয়ে তিনি তো এখন নিঃস্ব-অপাঙ্ক্তেয়।

আমি কিছু বলবার আগেই যানবাহনের মুহুর্মুহু ভেঁপু বেজে উঠেছে। ঊরু চুলকাতে চুলকাতে এসে এক উষ্কখুষ্ক লাইনম্যান ট্রেন চলার সবুজ সংকেত জ্বালিয়ে দিয়েছে।