ফিনিক্স পাখির সাথে এক সন্ধ্যা

 

ঠিক সময় ট্রেন ছাড়ছে না। অলরেডি প্রায় দুঘণ্টা লেট। তীব্র কুয়াশার কারণে নাকি দেরি হচ্ছে। গত বছর কুয়াশার কারণেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছিল। শ খানেক মানুষ সেদিন বাড়ি ফিরতে পারেননি। তারপর থেকে রেল কর্তৃপক্ষ সাবধান হয়ে গেছে। আমার খারাপ লাগছে না। এ জে কুইনিলের রগরগে থ্রিলার দ্য পারফেক্ট কিল পড়ছি। লেখকের সৃষ্ট ক্রেসি চরিত্রটি আমার খুব প্রিয়। তাকে ঘিরে লেখা প্রায় সব বই-ই আমার পড়া। আবার একটু মন খারাপ হচ্ছে,; কারণ, হাতের বইটি শেষ হওয়ার পর ক্রেসি বিদায় নেবে। তাকে নিয়ে লেখা আর কোনো উপন্যাস পড়ার বাকি থাকবে না। একটি প্রিয় চরিত্র বিদায় নেওয়া মানে আপনজন দূরদেশে চলে যাওয়ার মতোই বেদনাদায়ক।

তূর্ণা নিশীথার একটি ডাবল কুপে বসে আছি। কিন্তু যাত্রী দুজন। ওপরের সিটে কোনো যাত্রী নেই, একটু অবাকই লাগছে। এমনিতে টিকিট কিনতে গেলে কাউন্টার থেকে বলা হয়, টিকিট নেই, কিন্তু প্রায়ই দেখি, ট্রেনে প্রচুর সিট খালি!

সামনের সিটে বয়স্ক এক ভদ্রলোক চুপচাপ বসে আছেন। ট্রেন দেরির জন্য তাঁকেও তেমন বিরক্ত মনে হচ্ছে না। শুধু একবার বললেন, 'রেলওয়ের টাইমটেবল সব সময় অন্য টাইম জোনের ভাববেন। এটি বাংলাদেশ রেলওয়ে কিন্তু ধরে নেবেন আসলে বিলেতের। তাহলে ছয় ঘণ্টা লেটকেও লেট মনে হবে না। কারণ, এখানে যে ট্রেন সকাল সাতটায় ছাড়বে বলে বেলা একটায় ছাড়ছে, তখন কিন্তু লন্ডনে সকাল সাতটাই।

ভদ্রলোকের রসবোধ চমৎকার। রুচিও। বেশ বয়স হয়েছে, কিন্তু পরেছেন বাদামি রঙের পুরু জ্যাকেট, গলায় বারবারির স্কার্ফ, কালো ঢিলেঢালা কটন প্যান্ট, সাথে চকচকে কালো লোফার। চোখে চশমা, রিমলেস, সোনালি ফ্রেম। এ বয়সেও বেশ সুদর্শন। আমি তাঁর কথায় হাসলাম, কিন্তু উত্তর দিলাম না। যাত্রায় কথা বলতে ভালো লাগে না, এসময় নিরিবিলি হালকা কোনো বই পড়াটাই আমার পছন্দের। আলাপ তাতে বিঘ্ন ঘটায়। অবশ্য আজ বেশিক্ষণ পড়ার উপায় নেই। বাতি নিভিয়ে দিতে হবে নয়তো ভদ্রলোকের ঘুমের সমস্যা হবে। এ জন্য সিঙ্গেল কুপ চেয়েছিলাম, যাতে দুটো সিটই রিজার্ভ করে যেতে পারি। পাওয়া যায়নি।

নির্জন রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে চুরমার করে তীব্র হুইসেল বাজিয়ে অবশেষে ট্রেন ছাড়ল। উঠে গিয়ে নিজেই বাতি নেভানোর আয়োজন করতে গেলাম। ভদ্রলোককে ঘুমাতে দেওয়া উচিত। আরও আগেই দেওয়া উচিত ছিল, জিজ্ঞেসও করেছিলাম। তিনিই বলেছিলেন, ট্রেন চলা শুরু করার আগে তিনি ঘুমাবেন না, অস্বস্তি লাগে। এবারও তিনি বললেন, আপনি পড়তে চাইলে বাতি জ্বালিয়ে রাখতে পারেন। আলোতে আমার ঘুমের সমস্যা হয় না। আমি হচ্ছি সুখী মানুষ, যাদের কোনো অবস্থাতেই ঘুমাতে অসুবিধা হয় না। হা হা হা হা।

ভদ্রলোককে ধীরে ধীরে পছন্দ করে ফেলছি। ভদ্রতা ও রসবোধএ দুটোর যৌথ উপস্থিতি আজকাল খুব কম মানুষের মাঝে দেখি।

আমি হেসে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললাম, অনেক ধন্যবাদ। তাহলে আমি আরও কিছুক্ষণ পড়ি। আমার আবার ঘুমের সমস্যা আছে, মনে হয় আমি আপনার মতো সুখী মানুষ নই।

তিনি আবার প্রাণখোলা হাসলেন, হা হা হা হা।

আমি পড়ায় মন দিলাম।

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। শুধু ট্রেনের ঝিকির ঝিকির শব্দ। আড়চোখে দেখলাম ভদ্রলোক উশখুশ করছেন, মনে হয় কিছু একটা বলতে চাইছেন, কিন্তু পারছেন না।

আমি নিজেই বললাম, আপনি কি কিছু বলবেন? কোনো সমস্যা?

'ঠিক তা না, আচ্ছা, আপনি কি বাদল সাহেব? বাদল সৈয়দ? চট্টগ্রাম থাকেন?'

বেশ অবাক হলাম। এ ভদ্রলোক আমাকে চিনেন কীভাবে? আমি ওনাকে এর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

জি, ঠিক ধরেছেন, কিন্তু আপনাকে ঠিক...

আমাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, 'আপনার আমাকে চেনার কথা না; কিন্তু আপনাকে আমি চিনি। আমার বাচ্চারা আপনার বেশ ভক্ত। ফেসবুকে আপনার লেখা পড়ে। আমিও মাঝে মাঝে পড়ি। বাসায় আপনার বইও আছে কয়েকটি, আমি অবশ্য বই পড়িনি। আমার বই পড়তে ভালো লাগে না। আমার দৌড় ফেসবুকে ছোট ছোট পোস্ট পড়া পর্যন্ত।'

তাই নাকি? আপনার কয় ছেলেমেয়ে?

দুটো। বড়টি মেয়ে। ছোটটি ছেলে। দুজনেই ডাক্তার। মেয়ে ইউনাইটেডে আছে, ছেলে পিজিতে। দুজনেরই বিয়ে দিয়েছি। ছেলেটা আমার সঙ্গেই থাকে। মেয়ে প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে চলে আসে। দুজন নাতিও আছে। ভয়ংকর দুষ্ট। হা হা হা হা।

বা হ্‌, চমৎকার তো! আপনি তো খুব সফল একজন বাবা।

আসলে ওদের ভালো করার পেছনে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই, যা করার ওদের মা-ই করেছেন। আমি ছিলাম ব্যাংকার। ইউনাইটেড ব্যাংকের এমডি হিসেবে রিটায়ার করেছি তা-ও প্রায় পনেরো বছর হয়ে গেল। করপোরেট জগতে যারা কাজ করে, তারা আর যা-ই পারুক বাচ্চাদের সময় দিতে পারে না। তাই যা ক্রেডিট তা আপনার ভাবিকে দিতে হবে। হা হা হা।

একটু অবাক হলাম। পনেরো বছর আগে রিটায়ার করেছেন মানে প্রায় পঁচাত্তর বছর বয়স। সে তুলনায় ভদ্রলোকের ফিটনেস খুবই ভালো। দেখে মনে হয় খুব বেশি হলে ষাটের সামান্য ওদিকে বয়স হবে। বিস্ময় গোপন রেখে বললাম, আপনার ছেলেমেয়ের কথা শুনে খুব ভালো লাগল। আর হ্যাঁ, ভাবি অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন।

ধন্যবাদ বাদল ভাই, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগছে। যদি কিছু মনে না করেন, এবার আমি ঘুমাব। আপনি বাতি জ্বালিয়ে বই পড়ুন। ওই যে বললাম না, আমি সুখী মানুষ, ঘুমের সমস্যা নেই। হা হা হা হা হা।

আসলেই দেখলাম ভদ্রলোকের ঘুমের কোনো সমস্যা নেই। জামা-জুতাসহ গায়ে হালকা কম্বল জড়িয়ে পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছেন।

তবে ভদ্রলোকের অসাধারণ একটি গুণ আছে, তা হলো নাক ডাকছেন না। এবয়সের অধিকাংশ মানুষ তাই করেন। ঘুমের ভঙ্গিটাও সুখী মানুষের।

পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিজেও জানি না। তা ভাঙল কুলিদের চিলচিৎকারে। জেগে দেখি ঢাকা পৌঁছে গেছি। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি, কারণ ট্রেন নির্ধারিত সময়ের প্রায় তিন ঘণ্টা পর উত্তরা বিমানবন্দর স্টেশনে এসে পৌঁছেছে।

পাশের ভদ্রলোক মনে হয় বেশ আগেই জেগেছেন। বেশ পরিপাটি ভাব। হাতমুখ ধুয়ে এসেছেন, চুল আঁচড়ানো। দীর্ঘ ভ্রমণের কোনো চিহ্ন তাঁর চেহারায় নেই। জিজ্ঞেস করলাম, কী ভাই, ঘুম কেমন হলো?

খুব ভালো, বাদল ভাই। আলহামদুলিল্লাহ।

এ বয়সে ভদ্রলোককে এত ফিট দেখে একটু হিংসেই হলো।

দুজনে প্ল্যাটফর্ম পেরোচ্ছি। হঠাৎ তিনি বললেন, যদ্দুর জানি আপনি অনেকের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামান। আমাকে একটা ব্যাপারে হেল্প করতে পারেন?

আচমকা এ কথা শুনে থমকে গেলাম, অবাক কণ্ঠে বললাম, বুঝলাম না।

আমাকে একটা ব্যাপারে হেল্প করা যাবে? না, না ভয় পাবেন না, টাকাপয়সার হেল্প না, ওটা আমার যথেষ্ট আছে।

একটু লজ্জা পেলাম, বিব্রত কণ্ঠে বললাম, ঠিক তা না, আমি আপনাকে কীভাবে হেল্প করতে পারি তা আসলে বুঝতে পারছি না।

পারেন, একটা সত্যি কথা বলি, আমি অনেকদিন থেকে আপনার সাথে যোগাযোগ করব ভাবছিলাম। করা হয়নি, আপনি কীভাবে নেবেন ভেবে অস্বস্তি হচ্ছিল। এখন যখন দেখা হয়ে গেল তাই বলেই ফেললাম। কে জানে হয়তো এজন্যই খোদা আপনার সাথে আমার দেখা করিয়ে দিলেন। করবেন এ বুড়ো মানুষটাকে একটু সাহায্য?

কী করতে হবে?

সেটা তো এখানে বলা যাবে না৷ সময় লাগবে। আপনি ঢাকায় কোথায় থাকবেন বললে আমি সন্ধ্যায় আসব।

আগুপিছু না ভেবে বলে ফেললাম, হোটেল লং বিচ, গুলশান ২।

আমি চিনি ওটা। তা কটায় আসবো?

এখন নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে হুট করে ঠিকানা দেওয়ায়, কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই।

আটটায় আসুন।

ওকে, উই শ্যাল হ্যাভ ডিনার ওভার দেয়ার অ্যান্ড ইউ উইল বি মাই গেস্ট।

তাড়াতাড়ি বললাম, সে কী করে হয়! আপনি আসবেন আমার কাছে, ডিনার তো করাব আমি।

হা হা হা। আরে ভাই, ওটা হোটেল, আপনার বাড়ি নয়। আপনি এসেছেন আমার শহরে, সো বি মাই গেস্ট। এরপর চট্টগ্রাম গেলে আপনি খাওয়াবেন।

কথা বলতে বলতে স্টেশনের বাইরে এসেছি। দুজনের জন্যই গাড়ি অপেক্ষা করছে। তবে তাঁরটা অনেক বেশি ঝকমকে। তিনি গাড়িতে উঠে হাত নেড়ে বিদায় দিলেন।

আমি ক্লান্ত পায়ে নিজের গাড়িতে উঠলাম।

ভদ্রলোক কাঁটায় কাঁটায় রাত আটটায় হোটেলে এসে পৌঁছালেন। রিসেপশন থেকে জানানো হলো, তিনি অপেক্ষা করছেন। আমি দ্রুত নিচে এলাম। তিনি হাত বাড়িয়ে বললেন, সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। চলুন, আগে ডিনার সেরে নিই।

একটু অবাক হয়ে বললাম, আপনার না কী কথা ছিল?

হ্যাঁ, বলব। তার আগে ডিনার সেরে নেই। আমার আর্লি খাওয়ার অভ্যেস। সেটা সেরে আপনি অনুমতি দিলে আপনার রুমে একান্তে ব্যাপারটি বলতে চাই।

আমি ইতস্তত করে রাজি হলাম। কোন ঝামেলা ডেকে আনলাম কে জানে!

ডিনার শেষে তিনি আমার রুমে ব্যাপারটি বললেন।

বলা শেষে আচমকা আমার হাত চেপে ধরে বললেন, করবেন ভাই সাহায্যটা? আমার জন্য এটা খুব জরুরি, খুউব... এ কাজটা না হলে আমি মরেও শান্তি পাব না।

করব।

করবেন? আসলেই করবেন?

জি, করব। কারণ, আমার গাট ফিলিং হচ্ছে, ইউ মিন ইট। কাজটা আপনার জন্য জরুরি। এটা করতে পারলে আমার ভালো লাগবে।

কিন্তু আমার শর্তটা... তিনি ইতস্তত করে বললেন।

আই আম প্রমিজড টু কিপ ইট। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

ধন্যবাদ, আই ডু ট্রাস্ট।

বলতে বলতে তিনি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।

তবে যাওয়ার আগে একটি টেলিফোন নাম্বার আমার সেলফোনে সেভ করালেন, একটি ঠিকানা লেখা চিরকুট দিলেন, তারপর নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, এ নাম্বার থেকে আপনাকে ফোন করা হবে, সেটা আগামীকালও হতে পারে, দশ বছর পরও হতে পারে৷ তারপর আপনার কাজ শুরু হবে।

যদি ফোন আসে আমি দায়িত্ব পালন করব।

আসবে, নিশ্চিত থাকুন। দরোজার ওপারে এক পা বাড়িয়ে পেছন ফিরে তিনি জবাব দিলেন।

তিন বছর পর।

ফেসবুকে কাজ করছি। টুপ করে ইনবক্সে মেসেজটি ডুব মারল, ল্যাপটপের নিচে এক কোনায় প্রেরকের নাম ফুটে উঠল। স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে মেসেজটি খুললাম। কদিন ধরে এর জন্য অপেক্ষা করছি। দিন তিনেক আগে আমিই তাঁকে টেক্সট করেছিলাম। খুব একটা আশা করিনি উত্তর পাব, তবে চাইছিলাম উত্তর আসুক। নয়তো হাসিখুশি ভদ্রলোককে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখা যেত না।

তাঁর সাথে আমার সে রাতের পর আর দেখা হয়নি, এমনকি টেলিফোনে আলাপও নয়। একসময় ভাবতে শুরু করেছিলাম পুরো ব্যাপারটা হয়তো তাঁর মনের দুর্বল একটি সময়ে না ভেবে করে বসা কাণ্ড, তাই তিনি এটা নিয়ে আর এগোতে চাইছেন না। স্বস্তিও পাচ্ছিলাম, কারণ এ রকম হলে আমাকে তাঁর অনুরোধ করা কাজটি করার দরকার হবে না; কিন্তু ব্যাপারটি শেষ পর্যন্ত সে রকম ঘটল না।

দিন পনেরো আগে রাতে ঘুমুতে যাব, এমন সময় ফোন বেজে উঠল। একটু অবাক হলাম, কারণ, আমি ঘুমাতে যাই রাত সাড়ে এগারোটায়, এর আধঘণ্টা আগে থেকে কোনো ফোন রিসিভ করি না। নিকটজনেরা তা জানেন, তাই ফোন করেন না। একটু বিরক্ত হয়ে ফোন হাতে নিয়ে চমকে উঠলাম। কলারের নাম রেসপন্ড’—ভদ্রলোক সে রাতে কে ফোন করবেন, তা বলতে চাননি, বলেছিলেন, কেউ একজন করবে তাই অজ্ঞাত কলারের নাম সেভ করে রেখেছিলাম রেসপন্ড হিসেবে। অর্থাৎ যার কল আসলে আমাকে সাড়া দিতে হবে।

হ্যালো, একটু উত্তেজনা নিয়ে বললাম।

ওপার থেকে খুব কিছুটা ভেজা গলা ভেসে এলো, তিনি আজ সকালে মারা গেছেন, এবার আপনি এগোতে পারেন। সম্ভবত আপনাকে একটি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যা তিনি চলে যাওয়ার পর পালন করার কথা।

ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’—মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, চোখের সামনে হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুষটিকে দেখতে পাচ্ছি।

কী হয়েছিল?

বছরখানেক ধরে উনি ক্যানসারে ভুগছিলেন।

আহা! খুব চমৎকার মানুষ ছিলেন।

ইয়েস। হি ওয়াজ আ ওয়ান্ডারফুল সৌল।

আপনি কে বলছেন জানতে পারি? এতক্ষণে মনে পড়ল যিনি ফোন করেছেন তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করা হয়নি।

আমি হাসান। আপনার মতো ওনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী, আমার দায়িত্ব ছিল উনি মারা যাওয়ার পর আপনাকে ফোন করা।

কাজটি কি আপনি জানেন হাসান সাহেব?

না, উনি বলেননি, আমিও জিজ্ঞেস করিনি, শুধু বলেছিলেন আপনাকে যাতে কাজটির কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়।

অনেক ধন্যবাদ ভাই।

আপনাকেও’—বলে ভদ্রলোক ফোন রেখে দিলেন।

আমি নিশ্চুপ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। অনেক রাত হয়েছে, প্রায় বারোটা বেজে গেছে। তারপরও একটি ফোন করলাম। কলটি যাচ্ছে দেশের বাইরে।

ইনবক্সে আসা মেসেজটি খুললাম, তাতে লেখা,

নমস্কার।

প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি উত্তর দিতে দেরি হলো বলে, আপনার টেক্সট স্প্যামে জমা ছিল তাই আগে চোখে পড়েনি। তবে আপনার মেসেজ আমাকে বিস্মিত করেছে। প্রথম প্রশ্ন হলো, আমি আপনাকে চিনি না, আপনি আমার ফেসবুক আইডি কীভাবে খুঁজে পেলেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, যার সাথে আপনি দেখা করতে চাইছেন, তিনি নিউইয়র্কে আমার সঙ্গেই থাকেন, তবে বেশ অসুস্থ।

আপনার সাথে দেখা করতে রাজি হবেন কি না বলতে পারছি না। সবচে বড় কথা হলো কেন দেখা করতে চান তা কিন্তু বলেননি। আমি তাঁকে কী বলব? বাংলাদেশের এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান এটা বলব? ব্যাপারটা শুধু তাঁর জন্য নয় আমার জন্যও খুবই বিস্ময়ের, কারণ ওদেশের সাথে আমাদের কখনোই কোনো যোগাযোগ ছিল না, কোনো বন্ধু বা আত্মীয় থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তাই যদি আপনার বিস্তারিত পরিচয়সহ কারণটি জানান আমি তাঁকে বলে দেখতে পারি।

শুভেচ্ছা জানবেন।

পুনশ্চ: আপনি ওনার সাথে দেখা করার জন্য বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্ক আসবেন! ব্যাপারটি কি এতই জরুরি? অবাক লাগছে। তা ছাড়া আমার খোঁজ কীভাবে পেলেন সেটাও একটা বড় প্রশ্ন তৈরি করেছে।

শুভেচ্ছা।

সুনেত্রা।

উত্তরে লিখলাম,

শুভেচ্ছা জানবেন।

আমার পরিচয় তেমন উল্লেখ করার মতো কিছু না। ছোটখাটো ব্যবসা করি, সাথে টুকটাক লেখালেখি। ব্যাপারটা আমার কাছে জরুরি, কারণ এতে কমিটমেন্ট রাখার প্রশ্ন জড়িত। আর নিউইয়র্কে যে আমি শুধু এ কাজে আসব তা না, আমার স্ত্রী এবং কন্যা সেখানেই থাকেন। লং আইল্যান্ডে। আমার বিজনেস কার্ডের একটি স্ক্রিনশট পাঠালাম। এতে কিছুটা ধারণা পেতে পারেন। যদি সম্ভব হয় তাঁকে জিজ্ঞেস করবেন, দেখা করবেন কি না? তাঁর জন্য একজন একটি মেসেজ রেখে গেছেন। মারা যাওয়ার আগে তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল ওটি যাতে আমি ওনার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করি। ধরে নিন একজন মৃত মানুষের অপূর্ণ ইচ্ছেপূরণে আপনি সাহায্য করছেন। ও, হ্যাঁ, যার অনুরোধে তাঁর সাথে দেখা করতে চাইছি, তিনি আপনাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে রেখেছিলেন। আমি স্থানীয় এক বন্ধুকে অনুরোধ করে আপনাদের বাড়ি পাঠিয়েছিলাম। যদিও পুরোনো বাড়িটি নেই, সেখানে বহুতল দালান উঠেছে, কিন্তু আমার বন্ধুর পক্ষে আশপাশের লোকজনের সাথে কথা বলে আপনার ফেসবুক আইডি বের করা খুব কঠিন হয়নি। আফটার অল ইটস আ স্মল ওয়ার্ল্ড।

ভালো থাকবেন।

পরদিন উত্তর এলো,

শুভেচ্ছা।

আমি ওনার সাথে কথা বলেছি, কিন্তু সিদ্ধান্ত পাইনি।

কিছু মনে করবেন না, আমি আপনার ব্যাপারে কিছুটা খবর নিয়েছি। না জানিয়ে কাজটি করার জন্য ক্ষমা চাইছি। তবে আমার ধারণা হঠাৎ অচেনা কারও কাছ থেকে এ রকম অদ্ভুত অনুরোধ পেলে আপনিও একই কাজ করতেন। ফিডব্যাক পজিটিভ।

ওনার সাথে কী দরকার জানালে বাধিত হবো। ওটা জানালে ওনার সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে।

সুনেত্রাকে উত্তর দিলাম,

অনেক ধন্যবাদ আপনার উত্তরের জন্য। তবে দরকারটি কী, তা আগেই বলেছি। তা হলো ওনার জন্য একজন একটি মেসেজ রেখে গেছেন অ্যান্ড আই আম প্রমিজড টু ডেলিভার দ্যাট। তবে ব্যাপারটি কী, তা আপনাকে বলতে পারছি না বলে দুঃখিত। আই আম প্রমিজড নট টু ডু দ্যাট। সেটা শুধু ওনাকে বলা যাবে। আশা করি ভুল বুঝবেন না। নিশ্চয় আপনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ব্যাপারটি সমর্থন করবেন না।

শুভেচ্ছা।

এরপর দুদিন সব চুপচাপ। সুনেত্রা কোনো যোগাযোগ করলেন না। ধরেই নিলাম তাঁরা আমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন। মন খারাপ হলেও ভাবলাম, আমি তো চেষ্টা করেছি, অনুমতি না পেলে কী আর করা?

তিন দিনের দিন সন্ধ্যায় বারবার একটি টেলিটকের নাম্বার থেকে ফোন আসছে, কিন্তু অপরিচিত নাম্বার বলে আমি রিসিভ করছি না। বেশ কয়েকবার ফোন আসার পর মনে হলো, নিশ্চয় কেউ জরুরি কারণে ফোন করছেন, নয়তো এতবার করার কথা না। তাই অবশেষে রিসিভ করলাম,

হ্যালো, সৈয়দ বলছি।

যাক শেষ পর্যন্ত আপনাকে পাওয়া গেল। আমি তো মনে করেছিলাম ভুল নাম্বার দিয়েছেন। আমি সুনেত্রা বলছি, নিউইয়র্ক থেকে। চিনেছেন?

একই সাথে বিস্ময় ও আনন্দ আমার মগজে ধাক্কা খেল, হ্যাঁ, অবশ্যই চিনেছি। তবে আপনি ফোন করবেন ভাবিনি। তা ছাড়া আপনার ওভারসিজ কল এসেছে লোকাল একটি অপারেটরের কাঁধে ভর করে, তাই ভাবছিলাম লোকাল কল। অপরিচিত নাম্বার বলে ধরিনি। সরি ফর দ্যাট। তবে আমি খুব খুশি আপনি কল করায়।

ওপার থেকে হালকা হাসির শব্দ ভেসে এলো। ভদ্রমহিলা কী গান গান? তা জানি না, তবে এ রকম কিন্নরকণ্ঠীর গান না গাওয়াটা ক্যাপিটাল অফেন্স।

মনে হলো আপনার সাথে সরাসরি কথা বলা দরকার। মেসেঞ্জারে সব ক্লিয়ার করা যায় না। আসলে কি আপনি কেন তাঁর সাথে দেখা করতে চান তা বলা যায় না?

আই অ্যাম সরি, এটা আগেও বলেছিআমি উনি ছাড়া এটা আর কেউকে না বলার ব্যাপারে কমিটেড। তা ছাড়া আমার ধারণা তিনি নিজেও ব্যাপারটা অন্য কেউ জানুক তা চাইবেন না।

আমি খুব অবাক হচ্ছি, আমি তার মেয়ে না, কিন্তু মেয়ের আদরেই তাঁর কাছে বড় হয়েছি। একা নিঃসঙ্গ মানুষটির এমন কোনো কথা নেই যা আমি জানি নাআপনি এমন কী বলবেন...

আমরা খুব কাছাকাছি থেকেও একজন আরেকজনকে পুরোপুরি আবিষ্কার করতে পারি না। তা ছাড়া উনি যেহেতু এত ঘনিষ্ঠ হওয়ার পরও ব্যাপারটি আপনাকে বলেননি, তাই ধরে নিতে পারেন তিনি নিজেও চান না ব্যাপারটি আপনি জানুন।

সেটা অবশ্য ঠিক বলেছেন, দেয়ার ইজ গুড লজিকএভাবে তো ভাবিনি।

উনি কি আমার সাথে দেখা করবেন?

জি, করবেন। সেটা জানানোর জন্যই ফোন করা। তবে আমিও ওনাকে রাজি হতে দেখে অবাক হয়েছি। বাংলাদেশে ওনার পরিচিত কেউ থাকার কথা না। তবে আপনি যেটা বললেন, সেটাও হতে পারে, হয়তো আমি সব জানি না।

আমি খুব খুশি হয়েছি তিনি রাজি হওয়ায়। তবে বাংলাদেশে তাঁর পরিচিত থাকাটা একেবারে অসম্ভব নয়।

কীভাবে? তাঁর কণ্ঠে বিস্ময়।

ভুলে যাচ্ছেন কেন তিনি একজন চিকিৎসক এবং কলকাতায় অসংখ্য বাংলাদেশি রোগী যান।

সুনেত্রা মৃদু হেসে বললেন, ঠিক তো! আসলে আমার বুদ্ধি কম তাই এ অ্যাঙ্গেলে ভাবিনি। ওপার বাংলায় তাঁর অসংখ্য  রোগী ছিল।

তাঁর কণ্ঠ সহজ হয়ে আসছে। আমি হাসতে হাসতে বললাম, যদ্দুর জানি আপনি নিউইয়র্কের গভর্নরের পলিটিক্যাল অ্যাডভাইজার। বুদ্ধিহীন কেউ এ কাজ পেতে পারে না। ব্যাপারটা হচ্ছে, হয়তো আপনি এ বিষয়টি নিয়ে খুব ডিপলি চিন্তা করেননি।

মে বি ইউ আর কারেক্ট। তাঁর শরীরটা খুব খারাপ। অনেক দিন শয্যাশায়ী। আমাকে খুবই ব্যস্ত থাকতে হয়, যদিও বাসায় সার্বক্ষণিক কেয়ার গিভার আছে, তারপরও ওকে নিয়ে আমি খুব দুশ্চিন্তায় থাকি। আফটার আই আম মেইড বাই দ্যাট পারসন।

সুনেত্রা কথা শেষ না করে চুপ করে রইলেন।

আমি কথা কাটানোর জন্য বললাম, আমি আগামী মাসে নিউইয়র্কে আসব। আপনার ফোন নাম্বারটা দিলে ভালো হয়, তাহলে টাইম ঠিক করে ওনার সাথে দেখা করতে যাব। আপনার নাম্বার আমার এখানে ডিসপ্লে হয়নি, তা তো আগেই বলেছি।

ঠিক আছে, আমি ইনবক্স করছি। লাস্ট একটি অনুরোধ আছে।

কী?

ওনার শরীর খুব খারাপ। কোনো খারাপ খবর নিতে পারবেন না। তাঁকে দেখে আপনার যদি মনে হয় যে খবরটা দেওয়া উচিত হবে না, তাহলে দেবেন না। মাঝে মাঝে প্রতিশ্রুতি না রাখাটাও জরুরি। সেটা শপথ রক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ।

আমি একটু চিন্তা করে বললাম, ডান, যদি মনে হয় খবরটা দেওয়া উচিত হবে না, আমি দেব না। অন্য কোনো অজুহাত তৈরি করব। ইয়েস সামটাইমস প্রমিজেস আর মেইড নট টু কিপ।

অনেক ধন্যবাদ। আগামী মাসের ক তারিখ আসবেন?

সতেরো তারিখ পৌঁছাবো আশা করছি।

ওকে, এসে কল করবেন। বাই।

ডিসেম্বরের সতেরো তারিখ দুপুরে নিউইয়র্কে পৌঁছে রাস্তায় জমে থাকা কয়েক ইঞ্চি বরফের মুখোমুখি হলাম। জনজীবন প্রায় অচল। ঝিরঝির করে তুষার ঝরছে।

জেএফকে এয়ারপোর্ট থেকে লং আইল্যান্ডে আমার বাসায় পৌঁছাতে সাধারণত সময় লাগে ঘণ্টা দেড়েক; কিন্তু আজ লাগল প্রায় দুঘণ্টা। রাস্তায় জমে থাকা বরফের কারণে গাড়ি স্পিড তুলতে পারছে না, উইন্টার টায়ার না লাগানোয় বেশ কিছু গাড়ি এখানে-সেখানে আটকে আছে।

তুষারপাতের কারণে প্রায় এক সপ্তাহ বাসায় আটকে রইলাম। তবে সময়টা ভালোই কাটল। অনেক দিন পর মেয়ে আর তার মায়ের সাথে নিরিবিলি গল্প করতে পারছি, বই পড়ছি, মুভি দেখছি, গরম গরম খিচুড়ি রান্না হচ্ছেসব মিলিয়ে চমৎকার একটি সময়।

অষ্টম দিনে আবহাওয়া ভালো হতে শুরু করেছে, সামান্য রোদও মাঝে মাঝে দেখা দিচ্ছে, টেলিভিশন বলছে সমস্ত নিউইয়র্কাররা নাকি ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেছেন, এর ওপর শুরু হয়ে গেছে বড়দিনের ছুটি, সব মিলিয়ে পুরো নগরে আনন্দ কল্লোল বইছে। তবে আবহাওয়া দপ্তর বলছে বরফপাত পুরোপুরি বন্ধ হবে না, যেকোনো মুহূর্তে আবার শুরু হবে। এবার সবাইকে সম্ভবত স্নো ক্রিসমাসই পালন করতে হবে।

২৪ ডিসেম্বর বিকেলে সুনেত্রাকে ফোন করলাম। প্রথম রিং বাজার সাথে সাথেই ওপার থেকে কিন্নর কণ্ঠ শোনা গেল, আপনি এসে পৌঁছেছেন? কোনো খবর না পেয়ে ভাবছিলাম হয়তো আসেননি।

এসেছি প্রায় এক সপ্তাহ হলো, আবহাওয়া খারাপ, বের হওয়া যাবে না, তাই ফোন করিনি, তা কেমন আছেন?

ভালো, আপনি নিশ্চয় ফ্যামিলির সাথে খুব আনন্দে আছেন?

হা হা হা হা। তা আছি। আচ্ছা, উনি কেমন আছেন?

উনি ভালো আছেন। আপনি চাইলে দেখা করতে পারেন।

আই আম সো গ্রেটফুল।

আপনি কবে আসতে চান?

সম্ভব হলে আগামীকাল।

তা পারা যাবে না, আমার অফিসের ক্রিসমাস পার্টি আছে। আপনি পরশু দিন আসতে পারেন?

জি, পারি।

কটায় আসতে চান?

আপনিই বলুন।

সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায়। আমি আপনাকে ঠিকানা পাঠাচ্ছি। তবে বাসার ঠিকানা নয়, একটি রেস্টুরেন্টের ঠিকানা।

মানে? আমি একটু অবাক হলাম, আপনি বলেছিলেন উনি অসুস্থ, শয্যাশায়ী।

ঠিকই বলেছি। আপনাকে আগে রেস্টুরেন্টে ডেকেছি; কারণ, তাঁর সঙ্গে কথা বলার আগে আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই। আপনি যেহেতু কেন ওনার সঙ্গে দেখা করবেন বলবেন না, তাই তাঁর সাথে দেখা করার আগে আমিই আপনাকে একটি বিষয়ে বলতে চাই, এটার দরকার আছে। তারপর আপনাকে বাড়িতে নিয়ে আসব।

ঠিক আছে।

ধন্যবাদ, আমি ঠিকানা পাঠাচ্ছি। এস্টোরিয়ায় আমি থাকি, বাড়ির কয়েক ব্লক আগেই কফিশপটি। ওখানকার কফি আপনার ভালো লাগবে। হা হা হা হা। তাঁর হাসিতে কাচ ভাঙার টুংটাং আওয়াজ।

রেস্টুরেন্টটি খুব ছোট, কিন্তু আরামদায়ক।

আমরা কফি নিয়ে বসেছি। সুনেত্রা কফি মগের হাতলে না ধরে দুহাতে তা চেপে ধরে আছেন, যেন উষ্ণতা নিচ্ছেন। সে ভঙ্গিতেই মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছেন, কিন্তু কিছু বলছেন না।

অনেকক্ষণ পর আমি বললাম, আপনার কী যেন বলার কথা ছিল।

তিনি চোখ তুললেন, সেখানে রাজ্যের মায়া এবং বিষণ্ণতা। তিনি মৃদু হাসলেন, তাতেও বেদনার ছাপ।

আপনাকে বোধ হয় বলেছিলাম, আমি তাঁর আপন মেয়ে নই। তিনি অবিবাহিত।

হ্যাঁ, বলেছিলেন।

তিনি কিছুটা ঝুঁকে এসে বললেন, আমাকে তিনি অ্যাডাপ্ট করেছিলেন কলকাতা মাদার তেরেসা আশ্রম থেকে। ১৯৭৫ সালে। তখন আমার বয়স চার বছর। আপনি কি কিছু আন্দাজ করতে পারছেন?

না, আমার কণ্ঠ কেমন অসহায় শোনাল।

একটু মেলালেই সূত্র পেতে পারেন। আমার জন্ম একাত্তর সালে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। তখন সেখান থেকে প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেক গর্ভবতী মহিলাও ছিলেন। এদের অনেকেরই শরণার্থীর দুর্বিষহ জীবনে নবজাত বাচ্চা পালনের ক্ষমতা ছিল না। তাই কলকাতার রাস্তায় সে সময় প্রচুর পরিত্যক্ত শিশু পাওয়া যেত। আমার কেন জানি মনে হয়, আমি তাদের একজন।

আসলে আপনি কী বলতে চাইছেন, আমি বুঝতে পারছি না।

আমার মনে হচ্ছে, আমাকে আমার অসহায় বাবা-মা মাদার তেরেসা আশ্রমে রেখে দিয়ে এসেছিলেন। এত দিন পর আমার বায়োলজিক্যাল ফ্যামিলির হয়তো আমার কথা মনে পড়েছে, তাই তাঁরা আশ্রম থেকে ডিটেইল নিয়ে আমার খোঁজ করছেন এবং আপনি এসেছেন সে কাজে। হয়তো আপনি সে পরিবারেরই একজন। তাই তাঁর সঙ্গে আমার ব্যাপারে কথা বলতে চান?

আপনার এ ধারণার কারণ?

তাঁকে এত সহজে আপনার সঙ্গে কথা বলতে দেখে আমার এ ধারণা হয়েছে। এটাই হয়তো বাংলাদেশের সাথে তাঁর একমাত্র যোগসূত্র।

আমি বললাম, কিন্তু বাংলাদেশে তাঁর অনেক পেশেন্ট ছিল।

তা ছিল, কিন্তু একজন পেশেন্ট এত দিন পর তাঁর খোঁজ করবেন এটা অস্বাভাবিক। তিনি প্র্যাকটিস ছেড়েছেন, তা-ও প্রায় পনেরো বছর হয়ে গেল। তাই কেন জানি আমার মনে হচ্ছে, আপনার তাঁর সঙ্গে দেখা করার কারণ আমি। ধারণাটি কি ঠিক?

আমি মুখ না খোলার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যা বলার কেবল তাঁকেই বলতে হবে।

আই আন্ডারস্ট্যান্ড। শুধু একটা অনুরোধ।

বলুন, প্লিজ।

ব্যাপারটি যদি আমাকে নিয়ে হয় তবে দয়া করে ওনার সঙ্গে প্রসঙ্গটি ওঠাবেন না৷ আমরা দুজনের কেউ তা সহ্য করতে পারব না। তিনিই আমার সব, আমার আর কেউ নেই। তাঁরও আমি ছাড়া আর কেউ নেই। কেউ না। তাই আমার ব্যাপার হলে তা বলবেন না, প্লিজ, আমি হাতজোড় করছি। সে ক্ষেত্রে আপনি যেকোনো কিছু একটা বলে পাশ কাটাবেন।

আমি অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি, কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, ওকে, ডান। আপনার ধারণা সত্য কি মিথ্যা তা আমি বলব না, তবে কথা দিচ্ছি এমন কিছু বলব না যা তিনি নিতে পারবেন না।

তাঁর রুমে হাসপাতালের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। তিনি একটি মেডিকেল বেডে আধশোয়া ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন। সাদা ধবধবে কম্বলে তাঁর শরীর ঢাকা। বয়স এবং অসুস্থতার কারণে স্বাস্থ্য কিছুটা কুঁকড়ে গেছে; কিন্তু খেয়াল করলে বোঝা যায় যৌবনে খুব রূপবতী ছিলেন। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণ কিন্তু কোথায় যেন সুচিত্রা সেনের সাথে চেহারায় মিল আছে।

আমাকে দেখে ভদ্রতাসূচক হাসলেন, হাসিতেও ক্লান্তভাব, তারপর বললেন, বসো।

আমি তাঁর বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসছি এমন সময় বললেন, তোমাকে তুমি করে বলছি বলে কিছু মনে করো না, আমি বয়সে ছোটদের আপনি বলতে পারি না।

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, না, না, ঠিক আছে, অবশ্যই তুমি বলবেন। আপনি যে আমার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছেন, সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

ধন্যবাদ, আবার ক্লান্তি ফুটে উঠেছে তাঁর কণ্ঠে।

আমি ইতস্তত করছি, তাঁর শরীরের অবস্থা মোটেও ভালো না, যে কথাটি বলতে এসেছি তা বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না। আমার অস্বস্তি তিনি খেয়াল করলেন, তারপর অবাক করে দিয়ে বললেন, তুমি কেন এসেছ আমি জানি। এদিনটির জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম। আমি জানতাম আমার প্রশ্নটির উত্তর আমি পাবই, ওটা পাওয়ার আগে ভগবান আমাকে তুলে নেবেন না।

আপনি জানেন? আমার কণ্ঠ থেকে তীব্র বিস্ময় বদ্ধ রুমে ছড়িয়ে পড়ল।

হ্যাঁ, তুমি কে আমি তা জানি না, কিন্তু কেন এসেছ তা জানি।

কীভাবে?

ওই যে বললাম মনের ভেতর থেকে কেউ ডাক দিয়ে জানান দিচ্ছে। তারপর বলো তিনি কেমন আছেন?

কার কথা বলছেন?

যিনি তোমাকে পাঠিয়েছেন। কেমন আছেন তিনি?

একদিকে হতভম্ব ভাব আমাকে যেমন ঘিরে ধরে আছে, অন্যদিকে তীব্র দ্বিধাও পুরো গ্রাস করেছে। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি তিনি কার কথা বলছেন, কিন্তু খবরটি কীভাবে তাঁকে দিই? তিনি কি তা সহ্য করতে পারবেন? তাই কিছু না বলে নিজের পায়ের দিকে চোখ নামিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম।

তিনিই নিস্তব্ধতা ভেঙে বললেন, উনি বোধ হয় চলে গেছেন তাই না? তোমার চুপচাপ ভঙ্গি তাই ইঙ্গিত করছে।

আমি কিছু না বলে ওপর-নিচ মাথা ঝুঁকালাম ।

তিনি কিছুটা কেঁপে উঠলেন, তারপর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, হা, ভগবান, কষ্ট পাননি তো?

না, ঘুমের মধ্যে চলে গেছেন।

এবার তিনি থরথর করে কাঁপতে লাগলেন, মনে হচ্ছে এতক্ষণ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছেন, আর পারছেন না। আমি দ্রুত উঠে গিয়ে তাঁর হাত ধরে বললাম, প্লিজ, শান্ত হোন, আপনার শরীর খারাপ করবে।

তিনি নিজেই ধীরে ধীরে সামলে নিলেন, তারপর বললেন, একটু জল খাওয়াতে পারো?

আমি দ্রুত পাশে টেবিলে রাখা পানিভর্তি গ্লাস দিতে গিয়ে দেখি তাঁর হাত কাঁপছে, তাই নিজেই যত্ন করে পানি খাওয়ালাম।

কিছুটা সুস্থির হয়ে বললেন, তিনি কি তোমাকে কিছু বলেছেন?

জি, উনি আমাকে সব বলেছেন। জুলাইয়ের শেষ দিকে আখাউড়ায় একটি পাকিস্তানি ক্যাম্প উড়িয়ে দিতে গিয়ে তিনি গুলি খেয়েছিলেন। তাঁর তিনজন সহযোদ্ধা সেদিন মারা যান। যে তিনজন বেঁচে ছিলেন, তাঁরা অনেক কষ্টে তাঁকে নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলায় ফিরে আসেন। সেখানেই তাঁদের ক্যাম্প ছিল। মেজর হায়দার ছিলেন তাঁদের কমান্ডার। সেখানে ফিরে তাঁকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়; কিন্তু আঘাত গুরুতর হওয়ায় সেখানকার ডাক্তাররা তাঁকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে রেফার করেন। সেখানেই আপনার সাথে তাঁর পরিচয়। আপনি তখন সেখানে ইন্টার্নশিপ করছিলেন।

হ্যাঁ, তার মাত্র এক মাস আগে আমার এমবিবিএস শেষ হয়। উনি যেদিন ভর্তি হন, সেদিন আমার ডিউটি ছিল সার্জারি ওয়ার্ডে। ওনার ইমিডিয়েট অপারেশন দরকার ছিল। প্রফেসর স্যার আমাকেও অপারেশন থিয়েটারে রেখেছিলেন। অপারেশনের কয়েক ঘণ্টাতেই যা হওয়ার হয়ে গিয়েছিল। আমি বুঝে গিয়েছিলাম, এইমাত্র সামনে শায়িত অজ্ঞান লোকটির সাথে আমার জীবন গেঁথে গেছে। এ থেকে ছোটার সাধ্য আমার নেই, অন্য কারোরও আমাকে ছুটিয়ে আনবে, সে ক্ষমতা নেই। আই ওয়াজ হুকড। বড়শিতে যেভাবে মাছ আটকে যায়, ঠিক সেভাবে আমি আটকে গিয়েছিলাম। বলতে বলতে তিনি হাঁপাতে লাগলেন।

আমি আবার উঠে গিয়ে তাঁর হাত ধরলাম, মুখ নামিয়ে বললাম, থাক, ও প্রসঙ্গ বাদ দিন। আমি সব জানি। আপনার শরীর খারাপ করবে।

তিনি খুব নরমভাবে আমার হাত সরিয়ে বললেন, না, আমাকে বলতে দাও, না বললেই বরং আমার শরীর খারাপ করবে। আমি সারা জীবন অপেক্ষা করেছি, কেউ না কেউ আসবে, যাকে আমার গল্প শোনাব।

আমি অপারগ হয়ে আবার চেয়ারে গিয়ে বসলাম।

তিনি বলতে লাগলেন, তাঁর অপারেশন হচ্ছে, আমি সিনিয়রের নির্দেশমতো এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু আমার মন পুরোপুরি শূন্য, ফাঁকা, হাহাকারে ভরা। আমি নিঃশব্দে শুধু প্রার্থনা করছি, হা ভগবান, এ মানুষটিকে তোমার বাঁচাতেই হবে। হবে, হবে, হবে। এরপর আমি তোমার কাছে আর কোনো দিন কিছু চাইব না, কখনোই না, শুধু একটিবার আমার কথা রাখো ভগবান। এ মানুষটির আয়ু ফিরিয়ে দাও। কখন যে অপারেশন শেষ হলো তা-ও জানি না, আমার সংবিৎ ফিরে এলো প্রফেসরের হাতের স্পর্শে, তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বলছেন, কাঁদছ কেন মা? ডাক্তারের কাজ কান্না করা নয়, তার কাজ লড়াই করা, মানুষের প্রাণ বাঁচানোর লড়াই।

তারপর? নিজের অজান্তেই আমার মুখ থেকে প্রশ্নটি বেরিয়ে এলো।

তাঁর জ্ঞান ফিরল প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা পর। এ সময় আমার আচরণ হলো বদ্ধ উন্মাদের মতো।

আমি পোস্ট-অপারেটিভ রুমে এ আটচল্লিশ ঘণ্টা মূর্তির মতো তাঁর পাশে বসে রইলাম। সবাই আমার আচরণ দেখে অবাক। প্রফেসর স্যার, আমার সহপাঠীসবাই বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করছে, রোগীকে আমি চিনি কি না? তিনি কি আমার কেউ হন?

আমি কারও প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। বাসা থেকে বাবা এলেন, প্রথমে অনেক আদর করে বোঝালেন বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য, তারপর রাগারাগি। মা এসে চেষ্টা করলেন কিছু খাওয়ানোর। আমি শক্ত হয়ে বসে আছি, কারও প্রশ্ন, অনুরোধ কিংবা রাগারাগি আমার মাথায় নেই, সেখানে আছেন কেবল তিনি এবং ভগবান। একমাত্র পরেরজনই পারেন আমাকে মানুষটিকে ফিরিয়ে দিতে।

তিনি আবার হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, জল...

আমি দ্রুত উঠে গিয়ে আবার তাঁকে পানি খাওয়ালাম।

তিনি চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ আধশোয়া হয়ে রইলেন। আমি তাঁর হাত ধরে আছি।

একসময় তিনি চোখ খুললেন, আবার বলা শুরু করলেন, তিনি পুরো সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়লেন আগস্টের শেষ দিকে। সেদিনই আমরা গঙ্গার পাশে দাঁড়িয়ে হাতে হাত রাখলাম, সামনে বিশাল জলরাশিকে সামনে রেখে আমি উচ্চারণ করলাম

We hold each other from this day forward, for better or for worse, for richer or for poorer, in sickness and in health, to love.

অনাগত দিনগুলোর জন্য আমরা একজন আরেকজনের সাথে জড়িয়ে গেলাম। আনন্দ-বেদনা, সুস্থতা কিংবা অসুস্থতাআমরা একসাথে ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকব।

উত্তরে তিনি আমার হাত ধরে স্থির কন্ঠে উচ্চারণ করলেন,

We shall live together and rise from the ashes as one.

সারাটি জীবন একসাথে থেকে আমরা আবার ছাই থেকে এক হয়ে জন্মাব।

তিনি আবার হাঁপাচ্ছেন, আমি এখন তাঁর কপালে হাত বোলাচ্ছি, কখন যে তিনি খুব কাছের হয়ে গেছেন বুঝতেও পারিনি।

তাঁর চোখ ছাদের দিকে, যেন পরিষ্কার সেদিনটি দেখতে পারছেন, যেদিন গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে তাঁরা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সুখ কিংবা দুঃখ, স্বাস্থ্য কিংবা অস্বাস্থ্য, সচ্ছলতা কিংবা দরিদ্রতাসব তাঁরা পাড়ি দেবেন হাতে হাত রেখে।

এর পরদিনই তিনি আবার রণাঙ্গনে ফিরে যান। মূলত আখাউড়া, কুমিল্লাএসব এলাকায় তিনি ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর চলে যাওয়ার পর থেকে আমার দিন কেটেছে প্রবল জরাক্রান্ত রোগীর মতো, গায়ে সব সময় গরম ভাব, চোখ লাল, চুল উষ্কখুষ্ক, মেডিকেলে মন দিতে পারি না, সারা দিন রেডিও শুনি, আখাউড়া-কুমিল্লার দিকে কোনো অপারেশনের খবর শুনলে বুক ধকধক করে। তিনি কেমন আছেন, নিরাপদ আছেন তো? যখনই সময় পাই মন্দিরে গিয়ে পড়ে থাকি, ভগবানের কাছে আকুতি জানাই তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।

এবার আমি নিজে থেকেই উঠে গিয়ে এক গ্লাস পানি তাঁকে এগিয়ে দিই, মনে হচ্ছে তাঁর আবার তেষ্টা পেয়েছে। তিনি গ্লাসে ঠোঁট নামিয়ে তা পান করলেন, তারপর আবার শুরু করলেন, তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন উনিশ ডিসেম্বর। আঠারো তারিখ আমাদের বাড়িওয়ালার বাসায় ফোন করে বলেছিলেন, পরদিন সকাল এগারোটায় যাতে ভিক্টোরিয়া পার্কে যাই। সেদিন ওই পার্কে আসা লোকজন হতবাক হয়ে দেখলেন, এক তরুণী পাগলের মতো ছুটে গিয়ে দাড়িগোঁফে ঢাকা, ময়লা শাল গায়ে দেওয়া এক যুবকের বুকে লোকলজ্জা ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

এ জায়গায় এসে তিনি প্রথমবারের মতো হাসলেন, কী মিষ্টি তাঁর হাসি! তারপর বললেন, কী পাগলই না ছিলাম তখন।

তারপর আবার অসহ্য বেদনা জমতে থাকল তাঁর কণ্ঠে, চব্বিশে ডিসেম্বর তিনি ঢাকায় ফিরে গেলেন। কথা ছিল পরের মাসে ফিরে আসবেন, আমরা তখন বিয়ে করবো, হা ভগবান...

তাঁর কণ্ঠ থেকে তীব্র আর্তি সারা ঘরে ভেসে বেড়াচ্ছে, সে-ই যে গেলেন আর ফিরলেন না। আমি কত চিঠি দিলাম, উত্তর এলো না, সবচে খারাপ ব্যাপার ছিল তাঁর ঠিকানা আমি রাখিনি, প্রয়োজনবোধ করিনি, মনেই যাঁর বাস, তাঁর ঠিকানা জানা কী দরকার? এরপর নিজেই ঢাকা গেলাম, মনে খুব ভয়, কারণ খবর পাচ্ছিলাম, স্বাধীনতার পরেও অনেক তরুণ বাংলাদেশে এদিকে-ওদিকে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকা পাকিস্তানিদের হাতে মারা যাচ্ছেন। সেখানে গিয়ে কোনো লাভ হলো না। কেউ তাঁর খোঁজ দিতে পারলেন না। আমি কলকাতায় ফিরে এলাম। তারপর আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম তাঁর জন্য। আমি জানতাম তিনি ফিরে আসবেন, কিন্তু এলেন না। প্রায় এক বছর পর কলকাতা মেডিকেল কলেজের ঠিকানায় আমার কাছে একটি চিঠি এলো। এই প্রথম দেখলাম তাঁর চোখ থেকে জলের ধারা নামছে, তা গড়িয়ে সাদা কম্বলে উল্কি ফোটাচ্ছে। আমি পাশ থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে পরম যত্নে তা মুছে দিতে লাগলাম।

তিনি দম নিয়ে আবার শুরু করলেন, সে চিঠিতে মাত্র দুটো বাক্য লেখা, সু, সরি, আমি পারলাম না। তুমি তোমার মতো সিদ্ধান্ত নাও। কী নির্মম তাই না? একটি মেয়ে তার জীবন উৎসর্গ করে অপেক্ষা করছে তাকে দুটো বাক্যে ডিসমিস করে দেওয়া হলো! কোনো কারণ নেই, ব্যাখ্যা নেই, কিছু নেই! মেয়েটির ভালোবাসা কি এতটাই তুচ্ছ, এতই নগণ্য? এবার তিনি হু হু করে কেঁদে উঠলেন।

আমি নরম গলায় জিজ্ঞেস করলাম, আপনি জবাব চাননি কেন?

জবাব, কিসের জবাব? প্রত্যাখ্যান কেন করা হলো তার জবাব চাইব আমি? প্রশ্নই আসে না।

আমি মৃদু কণ্ঠে বললাম, তাঁর কিন্তু একটা জবাব ছিল। আপনি গ্রহণ করবেন কি না সে ভয়ে দেননি এবং তাই চেয়েছেন তিনি চলে যাওয়ার পর যাতে জবাবটি আপনাকে জানিয়ে তাঁকে ক্ষমা করতে অনুরোধ করা হয়।

কী জবাব? তাঁর কণ্ঠে রাগ ছাপিয়ে ফুটে উঠেছে হালকা কৌতূহল।

তিনি তাঁর গ্রামে ফেরেন ডিসেম্বরের আটাশ তারিখ এবং সেখানে তাঁর এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়।

কী অভিজ্ঞতা?

গ্রামে ফিরে তিনি দেখেন, দুদিন আগে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে উদ্ধার করা তাঁদের গ্রামের একটি মেয়েকে মুক্তিযোদ্ধারা বাড়ি ফিরিয়ে এনেছেন; কিন্তু সমাজের মাতবররা মেয়েটিকে গ্রহণ করছেন না। তাঁদের ভাষ্য হচ্ছে মেয়েটি ‘‘পতিত’’, হোক তার অনিচ্ছায়, তারপরও পতিত। তার ওপর সে গর্ভবতী। এ মেয়ে গ্রামে থাকলে পরিবেশ নষ্ট হবে আর তার পিতৃপরিচয়হীন বাচ্চাটিকে  তো গ্রামে থাকার অনুমতি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তিনি সবাইকে জনে জনে বুঝালেন, কিন্তু কেউ বুঝল না, এমনকি মেয়েটির পরিবারও তাকে গ্রহণ করতে রাজি না। তখন তিনি খুব সাহসী একটি সিদ্ধান্ত নেন, যার অপর প্রান্তে অপেক্ষা করছিল আপনার জন্য বঞ্চনা।

হা ভগবান।

তিনি মেয়েটিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন এবং বাকি জীবন তাঁকে ও তাঁর গর্ভে থাকা সন্তানকে তিনি পূর্ণ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মুড়ে রেখেছিলেন।

হা ভগবান, হা ভগবান, তাঁর আর্তস্বর কেমন যেন অপার্থিব শোনাচ্ছে।

আমি তাঁর ডান হাত দুমুঠোয় নিয়ে বললাম, তিনি তীব্র অপরাধবোধ থেকে জীবদ্দশায় আপনাকে ব্যাপারটি জানাননি; কিন্তু আমাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন তাঁর অবর্তমানে আপনাকে যাতে পুরো ব্যাপারটি জানিয়ে তাঁকে ক্ষমা করে দিতে অনুরোধ করি।

হা ভগবান, হা ভগবান।

আপনি কি দয়া করে তাঁকে ক্ষমা করবেন?

তিনি কিছু না বলে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছেন, দুচোখের জল টুপটাপ করে নিচের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে।

আমি আকুল নয়নে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি, আমার চশমা ঝাপসা, তাতে বাষ্প জন্মেছে।

প্রায় এক যুগ কেটে গেল, তারপর সিলিংয়ের দিকে চোখ রেখে তিনি আপন মনে উচ্চারণ করলেন,

We shall rise from ashes againআমরা ছাই থেকে আবার একসাথে জন্মাব...

বাষ্পে পুরোপুরি ঢেকে যাওয়া চশমার কাচে আমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু অনুভব করছি তীব্র বেদনা ফেনা হয়ে আমার চারপাশে উড়ছে, হাত বাড়ালেই ধরা যাবে।