আর্তি ও অন্যান্য কবিতা

 

আর্তি

তোমাকে দেখলে মনে হয়, কোনো দিন তোমার শরীরে নীরব দীর্ঘাঙ্গ এক পুরুষ হেঁটে এসেছিল। তোমার যে এখন রহস্য ফুরোনো স্তন, বিভিন্ন উত্তাপে পুড়ে গুটিয়ে যাওয়া মাথার চুল অথবা সম্মুখে এই যে সময়োচিত আবরণ, এর আড়ালে রয়ে গ্যাছে নীরব দীর্ঘাঙ্গ কোনো পুরুষের মন্থর পায়ে হেঁটে আসার দাগ। আজ যে তুমি ছাগশিশুর মতো মাথা তুলে তোমার আত্মার সঙ্গে খুনসুটি করো, স্নেহভরা চুম্বন দাওসেই দীর্ঘাঙ্গ পুরুষের সামনে শিহরিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকোনি? সে তোমাকে নিজের ধোঁয়ার মধ্যে, নিজের গন্ধের মধ্যে উন্মুক্ত করেছিল। তার লৌহনির্মিত দুই হাত রাখা ছিল তোমার কাঁধে। আরও অজ্ঞাতে সে তার নিজের প্রস্ফুটিত অন্ধকার দিয়ে তোমার অন্ধকার স্পর্শ করেছিল। এখন তোমার রহস্য ফুরোনো স্তনে কখনো দিনান্তের বীতকাম রোদ পড়ে। তার ছায়া কিছুটা প্রলম্বিত হয়ে লেগে থাকে হয়তো দেয়ালে অথবা হয়তো বালিশে বা হয়তো টান পড়া চাদরের কোনো ভাঁজে। তখন কেমন আশ্চর্য লাগে! আমার চোখের এ প্রান্তে এসে একবার নিজেকে তাকিয়ে দ্যাখো, দ্যাখো কেমন অতীতের পেতলের মূর্তি তুমি! তোমার রহস্য ফুরোনো স্তন, যারা এখন শুধু জোয়ারের জল এসে এসে ভারী, তোমার গলার শিরাযাদের শেকড় এখন কেবলই ধাতুদ্রব্য পাথর আর মাটিতে নামানো। আজ এই যে তুমি ছাগশিশুর মতো মাথা তুলে নিজেরই আত্মার সঙ্গে খুনসুটি করো, স্নেহভরা চুম্বন নিয়ে তার পিছু পিছু ছোটমনে হয় এ যেন ভয়ংকর ঝড়ের পরে ইতিউতি চলকে ওঠা পাখিদের ডাক?

আমি কখনো সময়োচিত আবরণ সরিয়ে তোমার স্তনের কাছে যাই। দেখি সেখানে উঁচু ছাদের গির্জার মতো কী গুমোট পবিত্রতা! তোমার সুগোল কাঁধে খাপছাড়া কয়েকটি নিষ্পত্র গাছ। ভাবি দীর্ঘাঙ্গ পুরুষটির ঘামে রোমে তুমি কখনো নোনতা হয়ে গিয়েছিলে। তার ছটফটে বীর্য যাত্রা করেছিল। এ যেন বনান্তরালে যে আরেকটি বন থাকে, তার মতো অথবা দৈত্যাকার চেহারার আড়ালে যে ভীরু, সলজ্জ একটি মানুষ লুকিয়ে থাকেতার মতো বা যে শাসক শুধু অস্ত্র সাজিয়ে পেছনে নিজের দৈন্য রক্ষা করে তার মতো। আহা, দিনান্তের এই শেষ সুরেলা রোদটি এখন কেমন তোমার গালে, বাহুমূলে উড়ে এসে বসেছে! পৃথিবীর হিসাব থেকে একটি দিন চিরকালের মতো খরচ হয়ে যাচ্ছে, ভাবো তো? আমার যে দৃষ্টি এই এখন তোমার দিকে স্থির, সেও তো খরচ হয়ে যাচ্ছে! এভাবেই তো কোনো দিন নীরব দীর্ঘাঙ্গ পুরুষটি তোমার দিকে উন্নত সূর্যকরোজ্জ্বল বীর্য নিয়ে হেঁটে এসেছিল! এখন শুধু সেই কবেকার ছন্দোময় পদচ্ছাপ ছাড়া আর কিছু আছে? ছাগশিশুর মতো মাথা তুলে তুমি তোমার আত্মার সঙ্গে খুনসুটি করো, গায়ে গা ঠেকিয়ে তাকে আদর দাও, এই দৃশ্য রঙিন বিজ্ঞাপনের মতো ধান খেত, আলি জমি বা মুখে রঙমাখা শহর পেরিয়ে আরও আরও কোথাও উড়ে যায়। কিন্তু আমার চোখের এ প্রান্তে এসে একবার নিজেকে তাকিয়ে দ্যাখো, দ্যাখো কেমন অতীতের পেতলের মূর্তি তুমি! ছাগশিশুর মতো মাথা তুলে নিজেরই আত্মার সঙ্গে এমন খুনসুটি কেমন জরিসলমাহীন! ভেতরের সব ফোঁড়, সব সেলাই কেমন কাতর আর্তির মতো জ্বলজ্বল করছে!

 

শিশু

তোমাকে আঁকড়ে ধরে শিশুর মতো ঘুমোব। কী দৈত্যাকার সব স্বপ্ন! কী দৈত্যাকার সব গাছ আকাশ থেকে নেমে নরম জঙ্গল তৈরি করেছে! সেখানে কী অফুরন্ত ভয়াল ভয়াল ফুল! ভোরবেলা জানালা ছাড়িয়ে এই একটুকরো সূর্য শুধু। ঠাণ্ডা ফয়েলের মতো বাতাস কেমন নির্মমভাবে নিরীহ পর্দাগুলিকে ফালাফালা করে উড়িয়ে দেয়। দেওয়ালে যে বুদ্ধ চোখ বুজে আছে, তাঁর চোখ সহসাই কী রক্তিম হয়ে খুলে যায়। তাঁর গোঁফের রেখা ঘন, আরও ঘন হয়ে ওঠে। পৃথিবীকে ক্ষুদ্র দানার মতো আঙুলে বসিয়ে মুখের খুব কাছে নিয়ে আসে কারা? তাদের গায়ে কী রঙের জামাকাপড়? ভগবান করুক, আর যেন কোনো প্রবল ঝোড়ো হাওয়া আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে না যায়। হাওয়াকে অনুসরণ করে যেসব নির্ভার পাথরগুলো উড়তে উড়তে আসে, তারা যেন না আসে। আমার শিশ্ন ছুঁয়ে দ্যাখো কী কোমল, কী কোমল যেন মরমে মরে আছে! আমার বাহু ধরো, দেখবে ক্ষীণ কয়েক পরত পেশীই শুধু বেয়াদপের মতো টান হয়ে আছে। আমার মাথায় হাত রাখো, দেখবে চুলের শেষাংশই শুধু তীক্ষ্ণকায়। পৃথিবীকে যারা অতি যত্নে আঙুলে বসিয়ে মুখের খুব কাছে এনে শুঁকে দ্যাখে, তারপর হলুদ শ্বদন্ত বের করে এ অন্যের দিকে তাকিয়ে পাঁজর ফাটিয়ে হেসে ওঠেতারা চায় লম্বা সুতোয় আর যেন চাঁদ ঝুলে না পড়ে এই মল-মূত্রে ভরা জগতের ওপর। ধারালো আনন্দের মতো যাতে চিকচিক না করে ওঠে অন্ধকার পেরোনো নদীর জল

আমার শিশ্ন ছুঁয়ে দ্যাখো কী কোমল, কী কোমল যেন মরমে মরে আছে! কিন্তু তবুও আমি তোমার অপরিচিত নই। আমার খুলির মোড়ক হরিনাম সংকীর্তনে বসা মানুষের মতো হলেও আমি একটি নক্ষত্র থেকে আরেকটি নক্ষত্রের ব্যবধান লক্ষ করতে করতে পেচ্ছাপ করি। কূট অভিসন্ধির তাড়নায় ভাবি, আহ এখন যদি কয়েকটি বাঘ প্রত্যেকটি গাঢ় শোবার ঘরে এসে গর্জন করত! সবাই কি মেনে নিত বাঘের বিস্রস্ত গন্ধ? আমি তোমার অপরিচিত নই। এই ভাবনা, এই কূটের আবর্ত, এই নীরব স্পর্শাতীত নক্ষত্রের সমাবেশ তো তাই-ই প্রমাণ করে। যারা পৃথিবীকে আঙুলে বসিয়ে মুখের খুব কাছে এনে শুঁকে দ্যাখে, তারা ঈশ্বরের অধিক ঈশ্বর হয়তো। তাদের ভারী অলংকার, তাদের জুতোর মসমস কিম্বা তাদের অধীনস্থ ঘোড়া এই মল-মূত্রে ভরা জগতের কেউ নয়। বসন একটু ঢিলে করে দিলে, পেছন থেকে নিঃশব্দে এসে আমার পিঠে মুখ ঠেকিয়ে রাখলে বা আমার চোখে তোমার দ্যুতিময় চোখ রাখলে এখনো সব রহস্য কেমন মুহূর্তে সরল হয়ে যায়। কেমন ভয়মুক্ত হয়ে বলা যায় চলো আজ খাওয়াদাওয়া সেরে বারান্দায় একটু বসি। হ্যাঁ, ওই দুটো বেতের চেয়ারে। না না, বেড়ালটিকে তাড়িয়ে দিও না। ও হয়তো আস্তাকুঁড়ের দিকে যাচ্ছে। দ্যাখো, এইসব দৈত্যাকার গাছগুলিকে কেমন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরা লতার মতো লাগছে! নরম যে জংগল, তা তোমার অত্যন্ত গভীর নন্দিত দুই স্তনের মতোই

 

চরণকমলে

এই যে আমার ঊরুসন্ধি, দ্যাখো সেখানে অন্ধকার ঘাসে নেতিয়ে পড়ে আছে ঢোড়া সাপের মতো আমার লিঙ্গ। এই যে আমার উপুড় করা দুটি বাটির মতো নিতম্ব, চামড়ায় হেজে যাওয়া ঘাপাঁচড়ার দাগ অথবা মনে হতে পারে যেন কোনো নক্ষত্র চামড়া ফুটো করে কখনো ভেতরে ঢুকেছে। এই যে আমার গুহ্য, চারিধারে করুণ ফার্নের ঘের, কীটপতঙ্গ। এই যে আমার ঢলঢলে হাঁটু। এরপরেই যাকে আমরা ঠ্যাঙ বলি, তা শুরু হয়ে একেবারে স্যাঁতা পড়া আঙুলে গিয়ে শেষ হয়েছে। এই যে আমার তলপেট। এখানে শৈশবে তাগা বাঁধা ছিল তাই শ্যাওলা শ্যাওলা একটা ছাপও রয়ে গেছে হিরের আংটির মতো। ওপরের দিকে দ্যাখো, কতগুলি লাল, খয়েরি তিল যেন নিঃশব্দে পথে পড়তে পড়তে যাওয়া গম বা সর্ষের দানা। নাভির কোটরে দ্যাখো, কিছু নেই শুধু একটা নিরেট দেওয়াল ছাড়া। এই যে এখানে আমার ভুষি ভুষি হয়ে যাওয়া পাঁজরের বর্ম। এই যে এর ঠিক বিপরীতে আমার বেত-বাঁশে টেকসই হয়ে ওঠা পিঠ। ব অক্ষরের মতো দুটো ডানা এবং এই যে, এই যে দুটি অসাধ্যসাধনে পটু হাত, করজোড়। ভুরুর নীচে ছুঁচলো আলোর মতো দুই চোখ এবং ভুরুর ওপরে কপালে সুখাদ্য হতে পারে এমন ছোটো ছোটো সাপের মতো কিলবিল করতে করতে ভবিতব্যে যাত্রা করা অসংখ্য শিরা

এই দ্যাখো আমি শুয়ে শুয়ে আকাশে পেচ্ছাপ করছি, মণিমুক্তোময় চাঁদোয়ার দিকে কেমন একটি ফোয়ারার মতো উঠে পড়ছে আমার দেহনিঃসৃত জল। দ্যাখো, তার কাছাকাছি একটি ধাতবদণ্ডে সোনালি ঝালর দেওয়া কিসের একটি নিশান উড়ছে। আমার হিসুতে ভিজে প্রতাপ হারিয়ে দণ্ডটির গায়ে সে এখন ওতপ্রোত। দ্যাখো ঢোরা সাপের মতো নেতানো লিঙ্গটিকে আমি দুহাতে চেপে ধরেছি ঠিক যেন হোসপাইপ অথবা ব্রাশ ফায়ারের রাইফেল! তোমার সৈন্য আছে, ঘোড়া আছে, হাতির কাফেলা আছে, পাত্রে জমানো বিষ আছেআমার তো এই, এই লিঙ্গই ভরসা। এই উপুড় করা দুটি বাটির মতো নিতম্ব ভরসা। ভুষি ভুষি পাঁজরের বর্মের আড়ালে যে সমাজবিরোধীরাতারাই ভরসা। দ্যাখো দেহাতি ভাষায় মুতে আমি সুপ্রাকার চাঁদকেও ভিজিয়ে দিলাম। আহা, সৌন্দর্যপ্রিয়রা এখন সহসা চাঁদের কাছে গেলে দেখবে চাঁদে আমার হিসুর নোনতা নোনতা গন্ধ! কবিই বা তার পার্ষদদের কোন মুখ দেখাবে? আহা কত গ্রন্থ, কত স্তুতি, কত প্রতিষ্ঠা আর গৌরবের ঈর্ষণীয় আলপনা! কত শ্বেতবসনা! তাদের দাঁত না বসানো সুসজ্জিত স্তন, তাদের শুকিয়ে শুকিয়ে আমসি হয়ে যাওয়া অদৃশ্য যোনি বা পুষ্পপল্লবে মাটি পাওয়া কাম! খাদ্যনালি ধরে ঠিকরে ঠিকরে গলা অবধি এসে আটকে যাওয়া কত না চিৎকার