প্যারিসের সাঁজেলিজে সরণিতে সামরিক কুচকাওয়াজ
মেট্রোর ভূতল থেকে বেরিয়ে আমি ও ম্যানুয়েল সামান্য হেঁটে চলে আসি সাঁজেলিজে বলে প্যারিস নগরীর সারি সারি বৃক্ষের সবুজ শোভায় পল্লবিত সরণিতে। ম্যানুয়েলের সাথে আজকাল আমার অন্তরঙ্গতা বাড়ছে। আমেরিকার যুবক ম্যানুয়েল হেরিটেজের দিক থেকে মেক্সিকান। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সাবমেরিনের গানার হিসেবে কয়েক বছর কাজ করে ডিসিপ্লিনারি কারণে সে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছে। প্যারিসের কোনো না কোনো হোটেলে বসবাস করে বিত্তশালী মহিলা পর্যটকদের সে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সঙ্গ দেয়। ম্যানুয়েলের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পয়লা দিকে বিষয়টি বিস্তারিত শুনে আমি তার পেশাকে ‘এস্কট সার্ভিস’ অভিহিত করলে, সে তা শুধরে দিয়ে বলে এ ধরনের পেশার সঠিক টার্ম হচ্ছে ‘জিগলো’। ম্যানুয়েল আজ হাতে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটি গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ, তাতে রাখা আছে হরেক রকমের সেক্স-টয়। সে গ্রিক নারী আগাথার কাছে তার সার্ভিস বিক্রি করতে যাচ্ছে। এ ঘটনা সম্পর্কে আমি কৌতূহল প্রকাশ করলে ম্যানুয়েল মৃদু হেসে রাজি হয়েছে আমাকে পর্যবেক্ষক হিসেবে তার অভিসারে শরিক করতে।
আজ জুলাই মাসের ১৪ তারিখ, পালিত হতে যাচ্ছে বাস্তিল দিবস। দিনটি ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৭৮৯ সালের এই দিনে প্যারিসের আমজনতা আক্রমণ করেছিল বাস্তিল দুর্গ। এ কেল্লায় রাজা চতুর্থ দশ লুইয়ের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে যাঁরা লেখাজোখা করেছিলেন, এসব প্রতিবাদী মানুষকে বিনা বিচারে আটক রাখার প্রথা ছিল। বিদ্রোহী জনতা দুর্গে ঢুকে পড়ে তাবৎ কিছু তছনছ করে। মুক্ত হন রাজবন্দীরা। জনতার দখলে আসে গোলাবারুদ ও গাদা-বন্দুক। প্যারিসের সর্বত্র শুরু হয় ফরাসি বিপ্লব। ঘোষিত হয় মানবাধিকারসংক্রান্ত বিখ্যাত ইশতেহার।
আজ বাস্তিল দিবসের স্মৃতিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সামরিক কুচকাওয়াজ। তাই সাঁজেলিজের প্রশস্ত সরণিতে জড়ো হয়েছে প্যারিসের নাগরিক সমাজ। যে বৃক্ষশোভন ফুটপাত ধরে আমি ও আমার সুহৃদ ম্যানুয়েল হাঁটছি, তার পাশের সুপ্রশস্ত অ্যাভিনিউ জুড়ে অগ্রসর হচ্ছে অশ্বারোহী সৈনিকদের জমকালো একটি দল। তাদের কুচকাওয়াজ উপভোগ করতে করতে আমরা হেঁটে আসি একটি সুদর্শন ইমারতের সামনে। সরণিতে আজ গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাজপথে ক্যাজুয়েল পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছেন বেশ কিছু মানুষ। তাঁদের কেউ কেউ এসেছেন বাইসাইকেল চড়ে। সকলে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছেন দূরে।
আমরা হেঁটে যেতে যেতে দেখি, শর্টস্ পরা এক মাঝ-বয়সী পুরুষ স্কুটারে বসে হাই তুলছেন। চোখাচোখি হতেই তিনি মৃদু হেসে সম্ভাষণ করেন। তাঁর সাথে কথাবার্তা হয় টুকটাক। জানতে পারি, যুদ্ধবিমানের মহড়া শুরু হতে যাচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে। তো আমরা আগ বাড়ি বিজয় তোরণের দিকে। আমাদের পাশে সমান্তরালভাবে চলছে দুটি বেজায় বড়, তবে এ মুহূর্তে জনবিরল রাজপথ। তাতে আদুল গতরে—মুখে রঙিন খড়ি দিয়ে মুখোশের মতো চিত্র আঁকা নওজোয়ানরা নানা কিসিমের বর্শা ও আদিম সমরাস্ত্র নিয়ে—শরীরের ম্যাসোল মুচড়িয়ে দেখাচ্ছে বিবিধ রকমের কেরদানি। ম্যানুয়েল মৃদুস্বরে বলে—আজব কিসিমের এ আদিবাসী মাওরি গোত্রের মানুষেরা এসেছে নিউজিল্যান্ড থেকে। কুচকুচে কালো কোনো পশুর লোমে তৈরি লেবাস পরা এক মাওরি যোদ্ধা গদা হাতে দর্শকদের তাড়া করার ভঙ্গি করলে, পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পর্যটকেরা হাততালি দিয়ে তাকে উৎসাহিত করে।
বিজয় তোরণের সামনের চত্বর স্টিলের ফেন্স দিয়ে ঘেরা। ওখানে দাঁড়িয়ে পর্যটকেরা পথদৃশ্যের ছবি তুলছে। গ্র্যান্ডমাদের সঙ্গে বাচ্চারাও এসেছে আজকের অনুষ্ঠান দেখতে। তাদের হাতে ফরাসি পতাকা। গ্রিক-নারী আগাথার এখানে দাঁড়িয়ে কথা। ম্যানুয়েল চারদিকে তাকাতাকি করে তাকে কোথাও স্পট করতে পারে না। সে আগাথাকে টেক্সট্ পাঠায়। বুঝতে পারি, আজকের অভিসারে তার কাঙ্ক্ষিত নারীটি এখনো অকুস্থলে এসে পৌঁছেনি। আমরা সময় কাটানোর অছিলায় সাঁজেলিজের সরণিতে হাঁটাচলা করি।
ম্যানুয়েল এ কুচকাওয়াজ সম্পর্কে বেশ খানিকটা ওয়াকিবহাল। আমি চাঁদতারা আঁকা ঝান্ডা হাতে ধবধবে সাদা হ্যাট-কোট পরা তিনজন চৌকস সৈনিকের পেছন পেছন মার্চ করে আসা সামরিক ট্রুপের দিকে দারুণ কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছি দেখে সে বলে, ‘মাই ডিয়ার বাডি, বাস্তিল ডে ইজ আ বিগ টাইম ফেস্টিভ্যাল ইন প্যারিস। আজকের শোভাযাত্রায় শরিক হয়েছেন পৃথিবীর তেহাত্তরটি দেশ থেকে আগত বাছা বাছা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। তুমি যাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছ—এরা এসেছে আলজেরিয়া থেকে।’
‘থ্যাংক ইউ সো ভেরি মাচ বাডি,’ বলে ম্যানুয়েলের পিঠ চাপড়িয়ে দিয়ে আমি আবার খেয়াল করে দেখতে শুরু করি, মহড়া দেখতে আসা হরেক কিসিমের মানুষজনকে। আমাদের সামনে বেবি-বাগি ঠেলে ঠেলে হাঁটছে এক শক্তসমর্থ পুরুষ। ম্যানুয়েল মৃদুস্বরে বলে, ‘লুক অ্যাট দিস গাই কেয়ারফুলি। ডু ইউ সি হোয়াট ইজ রং উইথ হিম?’ আমি নিরিখ করে তাকে দেখি। মানুষটি বেবি-বাগির ফ্রেমে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ভিড়ে নজর ফেলে কী যেন খোঁজে। তারপর গলায় ঝোলানো বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে তা সাবধানে ফোকাস করে। ঠিক বুঝতে পারি না তার আচরণে অ্যাবনরমালিটি কোথায়? ম্যানুয়েল একটু অধৈর্য হয়ে বলে, ‘ইউ রিয়েলি নিড টু লুক অ্যাট কেয়ারফুলি, দৃষ্টিকে একটু ক্রিটিক্যাল করো বাডি, ইউ উইল সি মাচ মোর।’
এ ধরনের লেকচার আমার পছন্দ হয় না। তাই বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালে সে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘মনোযোগ দিয়ে তার বেবী-বাগিটি দেখো মাই ডিয়ার বাডি, ওখানে কোনো শিশু নেই। পুতুল, ঝুমঝুমি, দুধদানি, বিভ—সবই আছে কিন্তু! এসব দিয়ে ইমপ্রেশন দেওয়া হচ্ছে, এ বেবী-বাগিতে আসলেই শুয়ে আছে একটি শিশু। যাতে বাচ্চার চোখেমুখে রোদ না লাগে, এ জন্য তার ওপরের শেডটিও নামানো। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, আজকের মহড়ার মতো সফ্ট টার্গেট হয়তো টেররিস্টরা ব্যবহার করতে চাইবে। তাই ফ্রেঞ্চ সিক্রেট সার্ভিস এখানে নজরদারির জন্য নিয়োগ করেছে সাদাপোশাকে অজস্র এজেন্ট। দিস বেবি-বাগিওয়ালা ইজ ওয়ান অব দেম। তার বাগির ফ্রেম থেকে ঝুলছে যে কয়েকটি খেলনা, এগুলো আসলে সার্ভিলিয়েন্স টুলস্। তাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি তোলা হয়ে যাচ্ছে।’ বেবি-বাগিওয়ালা আমাকে খেয়াল করে দেখতে শুরু করলে আমরা দ্রুত হেঁটে তাকে অতিক্রম করে চলে আসি বৃক্ষ ছায়ায় স্নিগ্ধ সড়কদ্বীপটির কাছে।
ম্যানুয়েল তার লেকচারকে কনটিনিউ করে বলে, ‘মাই ডিয়ার বাডি, প্লিজ লিসেন ওয়ান থিংগ্... প্যারিসের নারীরাও তাদের সফ্ট ফ্যাব্রিকে তৈরি স্বল্প ঝুলের পোশাক, আকর্ষণীয় অনাবৃতি, সৌরভ ও মেকাপে তাদের শরীরের চার দিক ছড়িয়ে রাখে বেবি-বাগির সেট-আপের মতো কৃত্রিম আবহ। তুমি যখন তাদের দিকে তাকাবে, উদ্দিষ্ট নারীর চলাচলের দৃষ্টিনন্দন ভঙ্গি, কিঞ্চিৎ পাউটি ঠোঁট বা পারফিউমের ছটায় প্রথমেই মুগ্ধ হয়ে পড়বে না, ডোন্ট বি স্পেলবাউন্ড উইথ দেয়ার লুকস্, চার্মস্ অ্যান্ড অল দ্যাট। ইউ রিয়েলি হ্যাভ টু অবজারভ্ দেম ক্রিটিক্যালি, সাদাপোশাকের সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্টরা যে রকম নজর করে—ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কার ধোপদুরস্ত স্যুটের ভেতর লুকানো আছে এক্সপ্লোসিভ; ঠিক সে রকমভাবে তোমাকেও বুঝে নিতে হবে এ নারী বাস্তব সংসারে কতটা অতৃপ্ত, দ্যাটস্ দ্য ম্যাজিক কি টু ওপেন হার সিক্রেট ওয়ার্ল্ড।’
আমি ম্যানুয়েলের লেকচারে বিরক্ত হলেও তাকে ইনটেনশনালি তোয়াজ করে চলি। মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে আমি তার যৌনস্বভাব নিয়ে মন্তব্য করে বিরাগভাজন হয়েছি। আমি অবগত যে, তার মাঝে ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠার অমিত শক্তি প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। আপাতত তাকে ঝাঁপিতে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা গোখরা সাপের মতো শান্ত দেখালেও তার ছোবল মারার শক্তিকে আমি সমীহ করি। তাই তাকে এক্সপ্লয়েট করার জন্য পরবর্তী চাল হিসাব-নিকাশ করে নির্বাচন করি।
ম্যানুয়েল কী যেন ভেবে জানতে চায়, ‘তুমি আরও দু-একজন সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্টকে খুঁজে বের করতে চাও কি… বাডি?’ আমি জবাব দিই, ‘ইয়েস, অব কোর্স, তবে ভুলে যাওয়ার আগে অত্যন্ত ফ্র্যাংকলি একটি মন্তব্য করতে চাই। ম্যানুয়েল, ওই যে ম্যাজিক কি-র বিষয়টা তুমি ব্যাখ্যা করলে, আ হিউজ থ্যাংক ইউ ফর দ্যাট, তোমার জাদুময় চাবি খুঁজে বের করার দক্ষতাকে আমি সত্যিই এডমায়ার করি।’ আমার তোয়াজে কাজ হয়, সে আন্তরিকভাবে হেসে জবাব দেয়, ‘ডোন্ট ম্যানসন ইট ম্যান। আজকে আরেকটু সময় আমার সাথে কাটাও, খেয়াল করে দেখো কীভাবে আমি আগাথার কাছাকাছি হই, আই লাইক টু ব্রেক দ্য আইস অব হার স্ট্রেস ফার্স্ট, তারপর বালুচরে যে রকম ঢেউ ভেঙে পড়ে, সে রকম সেও আছড়ে পড়বে আমার পাঁজরে... ইউ উইল উইটনেস দিস ইন ইয়োর অউন আইজ বাডি।’
প্রতিক্রিয়ায় আমি বলি, ‘আগাথাকে চাক্ষুষ করার জন্য আমিও রেস্টলেস হয়ে আছি। ইজ দ্যাট ও-কে টু টক উইথ হার আ লিটিল বিট।’ সে উদার হেসে বলে, ‘লেটস্ মি মেক দিস পয়েন্ট ক্রিস্টাল ক্লিয়ার, আমি তাকে সার্ভিস দিচ্ছি, আমার সময় সে ক্রয় করেছে, বাট শি ইন নট মাইন, তার ওপর আমার কোনো অউনারশিপ নেই। ইন আ ওয়ে শি ইজ আ ফেয়ার গেম। গো অ্যাহেড অ্যান্ড ফ্লার্ট উইথ হার আ বিট, আই ডোন্ট মাইন্ড।’ আমি ধন্যবাদ জানিয়ে হাই ফাইভ-এর ভঙ্গিতে তার করতলে আমার করতল বাজিয়ে বলি, ‘বাট হোয়ার ইজ আগাথা?’ ‘শি উইল বি হিয়ার সুন। হয়তো মেট্রোর আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন চড়ছে, তাই সিগন্যালের অভাবে টেক্সট্ করতে পারছে না।’ বলে ম্যানুয়েল তার আইফোন বের করে স্ক্রিনে চলমান নারীদেহের ছবি স্ক্রল করতে করতে জানতে চায়, ‘বাডি, তুমি তার কিছু ইরোটিক ছবি দেখে ওয়ার্ম আপ হতে চাও কি?’
আমি হাত নাড়িয়ে প্রস্তাবটি নাকচ করে দিয়ে বলি, ‘আই প্রেফার টু ওয়েট, আমার আগ্রহ বাস্তবে তাকে চাক্ষুষ করা। কথাবার্তা বলে দেখতে চাই গ্রিক-নারীটি কতটা সংবেদনশীল।’ ম্যানুয়েল কাঁধ শ্রাগ করে জবাব দেয়, ‘অল রাইট দেন, চলো ডিটেক্ট করি আরেকটি সিক্রেট সার্ভিসের আন্ডার-কাভার ওয়াচারকে। এতে কিছুটা সময় কিল করা যাবে।’
আমরা আবার সাঁজেলিজের সরণিতে পায়চারি করি। আমাদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে একজন মানুষ ভারি মিষ্টি হেসে ‘হ্যালো’ বলেন। তার বুকে বাঁধা হারনেস থেকে উঁকি দিচ্ছে—ধবধবে সাদা পশমের তুলতুলে একটি ল্যাপডগ। ছোট্ট এ কুকুরটিকে এতো কিউট দেখায় যে—আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। বয়সে প্রৌঢ় মানুষটি কাছে এসে খুব ইনভাইটিং ভাবে বলেন, ‘মঁশিয়ো, আমার ছোট্ট ডগটির নাম ডেইজি বু-বু, স্বভাবে সে খুবই সামাজিক। তুমি চাইলে তার তার পশম স্পর্শ করে আদর করতে পারো।’
আমি কুকুরটির উলগুঁটির মতো লোমে হাত বুলিয়ে ক্যামেরার দিকে ইশারা করলে তিনি মৃদু হেসে বলেন, ‘নো প্রবলেম। ইউ মে টেক আ পিকচার।’ ডেইজি বু-বু-র ছবি-টবি তুলে ভদ্রলোককে জোরালো রকমের ধন্যবাদ দিয়ে আমরা আবার ফিরে যাই বিজয় তোরণের দিকে। বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে আমি এক্সাইটেড্ ভাবে ম্যানুয়েলকে বলি, ‘আমার ধারণা, এ কুত্তা ক্যারি করা লোকটি হচ্ছে সিক্রেট সার্ভিসের গুপ্ত ওয়াচার।’
সে আমার পর্যবেক্ষণের প্রশংসা করে বলে, ‘ইউ আর ড্যাম রাইট।’ আমি এবার জানতে চাই, ‘ম্যানুয়েল, তুমি এত শিওর হচ্ছ কীভাবে।’ সে পেশাদারি ভঙ্গিতে হেসে জবাব দেয়, ‘লিসেন বাডি, তোমার অরিজিন ভারতবর্ষে হলেও তুমি দেখতে অনেকটা মধ্যপ্রাচ্য বা পারস্যের মানুষজনদের মতো। ওয়াচারদের কাজ হচ্ছে তোমার মতো চেহারার মানুষদের ওপর নজরদারি করা। এই লোক কিন্তু ইনটেনশনালি তোমার কাছাকাছি হয়েছে। ডেইজি বু-বু হচ্ছে গন্ধ শুঁকে বোমা-বারুদের উৎস আবিষ্কারের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর। তোমার জামাকাপড়ের তলায় খতরনাক কোনো এক্সপ্লোসিভ লুকানো থাকলে সে আওয়াজ করে তার হ্যান্ডালারকে সতর্ক করে দিত।’
ম্যানুয়েল স্পষ্টত অধীর হয়ে আছে। তার চোখে ঝোড়ো মেঘের মতো জমছে প্রতীক্ষার স্ট্রেস। সে আমার দিকে এক শলা সিগারিলো অফার করে বাতাস বাঁচিয়ে তাতে আগুন দেয়। তখনই সরণির অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে আসে শরীর-মন চনমন করে ওঠা বাদ্য-বাজনা। পর্যটকেরা ওদিকে তাক করে ট্রাইপডে বসানো ভারী সব ক্যামেরা। এয়ারফোর্স ব্যান্ডের বাদ্য যেন পাঁজরে সৃষ্টি করছে খরস্রোতা নদী সাঁতরে পাড়ি দেওয়ার উদ্যম। পুরুষদের কেউ কেউ তাদের নারীসঙ্গীর কোমর এক হাতে প্যাঁচিয়ে নেচে ওঠে। আমাদের সামনে কিন্তিলী চুলের এক কৃষ্ণাঙ্গ নারী তার অর্ধ-উন্মোচিত স্তনে দারুণ দোল তুলে খানিক কাঁধ ঝাঁকায়। দর্শকদের কেউ কেউ তার দিকে ফিরে মুখে আঙুল দিয়ে শিস দিলে তার ড্যান্সে চলে আসে আফ্রো-ক্যারেভিয়ান জোশ। খুব সুচারু ভঙ্গিতে বঙ্কিম হতে থাকে তার শরীর। ঠিক খেয়াল করিনি কখন যে যুবতীটি মুখে পরে নিয়েছে কুমিরের মুখোশ। এখন তার হাতের মুদ্রায় তৈরি হচ্ছে বুকে হেঁটে বেজায় ক্ষুধার্ত এক কুমিরের নদীর ঢালু পাড় বেয়ে চরে উঠে পড়ার দৃশ্যপট। তার দোদুল্যমান শরীরে পথচারী দর্শকদের দৃষ্টি যেন শিলাবৃষ্টির মতো ঝরে।
এয়ারফোর্সের ব্যান্ড চলে আসে আমাদের খুব কাছে। এরা ফরাসি বিপ্লবের ধ্রুপদি কোনো সিম্ফনি জমিয়ে বাজাচ্ছে। দর্শকেরা দুপাশে সরে দাঁড়িয়ে তাদের কুচকাওয়াজের সুযোগ করে দেয়। বাজনাওয়ালাদের সামনে মার্চ করছে তরুণ ক্যাডেটদের একটি চৌকস দল। তাদের সাদা গ্লাভস্ পরা হাতের কবজিতে বসে একটি করে ঈগল পাখি। বাদ্যবাজনার সুরলয়ে বিশাল খেচরগুলো ডানা ঝাপটিয়ে বজায় রাখছে তাল-মান। ম্যানুয়েল জ্বলন্ত সিগারিলো হাতে টেলিফোনে কথা বলতে বলতে ভিড়ে বাউলি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। ফাৎনায় টান পড়লে বড়শি বাওয়া মানুষের চোখেমুখে যে রকম ছড়ায় উদ্দীপনা, সে রকম আগ্রহ নিয়ে ম্যানুয়েল স্ক্যান করছে ভিড়ের তাবৎ কিছু। গাছপালার ছায়াতল থেকে বেরিয়ে আসতেই চোখ চলে যায় আকাশে। উড়ে আসে এগারোটি জঙ্গিবিমানের নজরকাড়া ফরমেশন। তাদের লেজের ধোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে ফরাসি পতাকার গোলাপি-নীল বর্ণবিভা।
আকাশে উড়ে আসছে একটার পর একটা ধীরগতি প্রপেলার প্লেন। মাথার ওপরে ডিসপ্লে হচ্ছে গেল একশ বছরে বিবর্তিত হওয়া নানাবিধ বিমানের মডেল। ম্যানুয়েল এক্সাইটেড ভাবে আমার কাঁধে চাটি মেরে বলে, ‘ম্যান, আগাথা ইজ হিয়ার। কিন্ত তাকে স্পট করতে পারছি না।’ সে আইফোনের স্ক্রিনে তার ছবিতে ইঙ্গিত করে বলে, ‘বাডি, পে অ্যাটেনশন, লুক ফর হার।’ আকাশে নিচু হয়ে উড়ে আসা জঙ্গিবিমানগুলোর মডেল থেকে আমি চোখ ফেরাতে পারি না। ম্যানুয়েল আবার কনুইয়ের খোঁচা দেয়। এবার ভালো করে দেখে না নিলে এন্টিক ক্যাটাগরির এ বিমানগুলোকে আর কখনো উড্ডীন হালতে দেখার মওকাও আসবে না। এদিকে আমার সুহৃদ তাড়া দিচ্ছে অভিসারে আসা তার উদ্দীষ্ট নারীকে স্পট করার। ঠিক বুঝতে পারি না—কুল বজায় রাখব, নাকি শ্যামকে তুষ্ট করা এ মুহূর্তে অধিক জরুরি।
আগাথার তলাশে চারদিকে বোবা দৃষ্টিতে ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছি, হঠাৎ করে কালবোশেখিতে গাছ থেকে ঝরে পড়া নারকেলের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত একটি যুদ্ধবিমান থেকে চারদিকে ছিটকে পড়ে কয়েকজন প্যারাট্রুপারস্। দর্শকেরা উল্লাসে হাততালি দেয়। তখনই খেয়াল করি, ম্যানুয়েল অত্যন্ত স্নেহে এক নারীর কোঁকড়া চুল সরিয়ে দিয়ে, কনিয়াকের গ্লাসটি আলোয় তুলে ধরার মতো পানপাতা শেপের মুখখানা তার দিকে তুলে ধরে গাঢ়ভাবে অবলোকন করছে। সে মৃদুস্বরে আগাথাকে কিছু বলছে। দর্শকদের কোলাহলে আমি তেমন কিছু শুনতে পাই না। তবে ম্যানুয়েল তার ঠোঁটে চুমো খেলে আগাথা তার সুঠাম বুকে নিজেকে সমর্পণ করে। ম্যানুয়েলের হাত তার কোমর পেঁচিয়ে অনুভব করছে নারীটির শরীর। খিলখিল হেসে আগাথা তার বুক থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল, সে তার নিতম্বে মৃদু চাটি মেরে বলে, ‘হানিসাকোল, ইউ আর ওয়ে সেক্সিআর দ্যান হোয়াট আই সো ইন ইয়োর পিকচারস্।’ আগাথা চোখেমুখে শরমের কৃত্রিম ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলে বলে, ‘থ্যাংক ইউ সো মাচ ম্যানুয়েল ফর ফাইন্ডিং টাইম ফর মি ইন আ সর্ট নোটিশ।’
কথাবার্তায় দুজনে মগ্ন হয়ে আছে মৃদুভাবে। এ সুযোগে আমি গ্রিক দেশের পরনারীটিকে পর্যবেক্ষণ করি ব্যাপকভাবে। অরগানজা ম্যাটেরিয়েলে তৈরি তার স্কার্টে ভিনটেজ অনুপ্রাণিত ডিজাইনটি স্পষ্টত সুরুচির পরিচয়বাহী। সে একটু ঘুরে দাঁড়ালে আমি আগাথাকে সামনে থেকে সরাসরি দেখি। তার দৈহিক গঠনে প্রথম দৃষ্টিতে চোখে পড়ার মতো এমন কিছু নেই। তবে হালফ্যাশনের লিবার্টি টাই-নেকের টপ পরে এসেছে বলে বুকের বিঘত অনাবৃতিতে ছড়াচ্ছে নারীশোভন মমতা। আমাকে খেয়াল করে দেখে আগাথা তার দৃষ্টি ম্যানুয়েলের দিকে আবার ফেরালে, আমি মনে মনে এ মানবীর বয়সের মনষাঙ্ক কষি। সে আহ্লাদি ভঙ্গিতে একটু কাঁধ ঝাঁকায়। তাতে বেলাশেষের গোধূলি আভায় কাঁপে ঈষৎ বিবর্ণ হয়ে আসা যৌবন। সে আবার গ্রীবা বাঁকালে ম্যানুয়েল আমাকে ‘রাইটার’ বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমি ঝাঁকাঝাঁকির প্রত্যাশায় হাত বাড়ালে সে তা ধরে থাকে একটুক্ষণ। তখনই অনুভব করি, শি লুকস্ আ বিট অনইউজ্যুয়েল। তার আসাধারণ চোখের বর্ণকে ইংরেজিতে বলা হয় ফরেস্ট গ্রিন। তা যেন স্থির হয় না কোথাও। সে আমাকে অবলোকন করতে করতে আবার আকাশে উড়ে আসা বিমানের দিকে চোখ ফেরায়, আর আমি মনে মনে ভাবি—হোয়াই হার আইজ আর ওয়ান্ডারিং অ্যারাউন্ড ইন অল ডিরেকশন?
মৃদু চাপে আমার হাতে অন্তরঙ্গতার পরশ ছড়িয়ে দিয়ে সে জানতে চায়, ‘সো, টেল মি রাইটার, হোয়ার আর ইউ ফ্রম?’ আমি জবাব দেই, ‘সিয়েরা লিওন।’ ‘তুমি কি সাথে করে তোমার বই বা আর্টিকেল নিয়ে এসেছ? আমাকে একটু পড়ে শোনাবে?’ আমি বিব্রত হয়ে জবাব দেই, ‘নট রিয়েলি।’ এতে নিরুৎসাহিত না হয়ে সে বলে, ‘ইউ লুক লাইক মোর অব আ পোয়েট।’ প্রতিক্রিয়ায় আমি নীরব থাকলে, সে আমার ফতুয়ার রেশমি নকশায় আঙুল বুলিয়ে বলে, ‘প্রিন্স অব পার্সিয়া ফিল্মে অভিনয় করা ছোটখাটো এক চরিত্র, কী যেন তার নাম, ভুলে গেছি, তার মতো চমৎকার একটি জামা পরে এসেছ, নেভার সিন আ ম্যান ওয়ারিং সাচ আ অরনেট শাইনি শার্ট।’
আমি নিশ্চুপ থাকলে সে ম্যানুয়েলের দিকে ফিরে জানতে চায়, ‘ক্যান আই কিস ইয়োর ফ্রেন্ড?’ সে উদার হেসে জবাব দেয়, ‘অব কোর্স, এন্ড ইফ ইউ ওয়ান্ট ইউ ক্যান প্লে হিম আ বিট এ্যজওয়েল।’ আগাথা তার দিকে তাকিয়ে রিয়েক্ট করে,‘ আই অ্যাম নট ইন আ মুড ফর ত্রি-সাম।’ ম্যানুয়েল বোধ করি তাকে যাচাই করার জন্য বলে, ‘হোয়াই নট, হি সিমস এবাইলেবোল।’
আগাথার কথায় এবার ফুটে ওঠে ব্যক্তিত্ব। সে একটু ঝাঁঝিয়ে জবাব দেয়, ‘হি ইজ নট দ্যাট কাইন্ড, এ লোক মেয়েদের প্রেমে পড়ে দ্রুত, সম্পর্কে সিরিয়াস হয়, বাট নট রিয়েলি আ প্লে টাইপ।’ ম্যানুয়েল তাকে চ্যালেঞ্জ করে বলে, ‘হাউ ডু ইউ নো দিস?’ আগাথা তার কথার জবাব না দিয়ে আমার খুব কাছে এসে বলে, ‘হাউ অ্যাবাউট আ কিস?’ আমি তাকাতেই এক পাশ থেকে তার প্রোফাইল চোখে পড়ে, আর মনে হয় এ নারীটি এ মুহূর্তে খুব বিপন্ন। তাকে ভালোবাসা যায় তীব্রভাবে। আমি তার রুপালি অলকচূর্ণের নিচে আলতো করে চুমো খাই। সে কিস ব্যাক করে আমার গন্ডদেশে ঠোঁট ছুঁইয়ে।
আকাশে যুদ্ধবিমানগুলো আঁকছে বিচিত্র নকশা। আগাথা ফিরে গেছে ম্যানুয়েলের বাহুবন্ধনে। সে তার পেশিবহুল দু’হাত টেনে এনে তার কোমর জড়ানোর সুযোগ করে দিয়ে বলে, ‘আজকের সময়টা আমি বরাদ্দ রেখেছি সাবমেরিনের গানারের জন্য। কিন্তু তোমাকে ইগনোর করতে চাই না রাইটার। ডু ইউ মাইন্ড গিভিং মি সাম অব ইয়োর স্পেশাস্ টাইম। আই অ্যাম আসকিং ইউ অনেস্টলি..,’ আমি জবাবে বলি, ‘হাউ অ্যাবাউট সে গুডবাই টু ইচ আদার নাও। আমি হোটেলে ফিরে যাই, তুমি ম্যানুয়েলের সাথে সময়টা উপভোগ করো।’
ম্যানুয়েল কিছু বলতে চায়, কিন্তু ব্যক্তিত্বময় ভঙ্গিতে তাকে থামিয়ে দিয়ে আগাথা আমার চোখে চোখ রেখে বলে, ‘ইউ লুক হ্যাংরি, সো অ্যাম আই। চলো না আমাদের সাথে? একসাথে লাঞ্চ করব। কফি আফটারওয়ার্ডস্। পারহেপ্স আ গ্লাস কনিয়াক। প্লিজ বি মাই গেস্ট। তারপর তুমি না হয় ফিরে যেয়ো হোটেলে।’ ম্যানুয়েল ইশারায় আমাকে রাজি হতে ইঙ্গিত দিলে আমি ঘাড় হেলিয়ে সায় দিয়ে বলি, ‘লেটস্ ফাইন্ড আ প্লেস টু ইট সামথিং।’