বাউল হইবার আগে মানুষ হইতে হয়
ভূমিকা
সঙ্গীত সাধক বাউল মকদ্দস আলম উদাসী। জন্ম সুনামগঞ্জ ছাতকের চরবাড়া গ্রামে, বাংলা ১৩৫৪ সনে। বাবা মুজেফর আলী ছিলেন পেশায় কবিরাজ। মা সুখী খাতুন। ভূমিহীন, ঠিকানাহীন এই বাউলের বিশ্বাস, সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার বসত। টাকা-পয়সা, জমি-বাড়ি তাঁর কাছে আবর্জনা। তাই ঘরহীন এই মানুষটাকে সরকার তিন-তিনবার বাড়ি দিলেও গছাতে পারেনি। ছাত্র ছিলেন কওমি মাদরাসার। কিতাবগুলো পড়তেন হৃদয় দিয়ে। কোনো কিছু না বুঝলেই ছুটতেন প্রিয় হুজুরের কাছে। তবু কেন তিনি মাদরাসা ছাড়লেন? কেন মসজিদে না খুঁজে সারা জীবন আল্লাহকে তালাশ করছেন মানুষের মাঝে? সেই চুম্বক অংশটুক উদাসী ভাইয়ের জবানে শোনা যাক: ‘আমি তখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমাদের ক্লাসে একটা উর্দু কিতাব ছিল ‘তালিমুল ইসলাম’। সেখানে একটা প্রশ্ন ছিল, ওয়াজিবুল ওজুদ ক্যায়া মানা হে? ওয়াজিবুল ওজুদ কিসকো কাহ্তে হে? অর্থাৎ ওয়াজিবুল ওজুদ কী এবং কাকে বলে? তাঁর উত্তর—যা নিজে নিজে সৃষ্টি হয়েছে, তাই ওয়াজিবুল ওজুদ। ইসলাম এইটাই শিক্ষা দিতেছে যে, আল্লাহ ওয়াজিবুল ওজুদ। প্রকাশিত বই পরার জমিন [১৯৯৯], বিরহ লহরী [২০০২], উদাসী সঙ্গীত [২০১৭], নির্বাচিত গান [২০১৭]। ২০২২ সালের মার্চে বাউল মকদ্দস আলম উদাসীর এই দুর্লভ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক শেখ লুৎফর
শেখ লুৎফর: কেমন আছেন এখন?
মকদ্দছ আলম উদাসী: একমুঠ খিচুড়ির সাথে একটু কচুশাকও খাইতে পারি।
তার প্রাণশক্তি দেখে অন্য রকম একটা তৃপ্তি, ভরসা আর ভালোবাসায় মনটা ভরে যায়। ঘন ঘনই তো আসা হয়। যত দূর জানি, এক কাপ রং-চা খেতেই বিশ-তিরিশ মিনিট লাগে। মাঝে মাঝে একটু শাক, এক-দুই চামিচ খিচুড়ি। এই দিয়েই সে লড়াইয়ে জিতে যাচ্ছে! এই সব হিসাব ও বেহিসাব থেকে বাউল মকদ্দস আলম উদাসী ভাইকে নতুন করে চিনতে হয়। দেখি, তার মুখজুড়ে কঠিন তপস্যায় পাওয়া গিনি সোনা ঝলমল করছে।
লুৎফর: তাহলে মুর্শিদের দয়া হইছে?
উদাসী: হইব না কেন? বহু আগে আমি তারে কইছিলাম, আমার উপর যেন কারো দাবি না থাকে।
দাবির কথায় আমি নড়েচড়ে বসি। স্ত্রী নাই। সন্তানরাও একে একে চলে গেছে মুর্শিদের দরবারে। অবশিষ্ট এক কিশোর ছেলে আছে। সে দুরন্ত মানুষ। একটা মিশুক চালায়। শিস দিয়ে চটুল হিন্দি গান গায়। গোঁফ উঠার আগে থেকেই দাড়ি কামায়। ঠিকমতো দাড়ি উঠতে না উঠতেই বিয়ে করে ফেলেছে। সেই সুবাদেই এই টিনের চালের আবছায়ায় বসে কথা চলছে। তা না হলে উদাসী ভাইকে পেতে চাইলে ফুটপাতে তালাশ করতে হতো। কারণটা তার মুখ থেকেই শুনুন।
উদাসী: আমি তো মুর্শিদরে সারাজীবন বলছি, আমি বাউল। আমি থাকব গাছতলায়। দোতারা আমার সাধনসঙ্গী। এখন দেখি পুত্র আছে। সে তো বাউল না। তার ঘর চাই, সংসার চাই। এগারোশ টাকার এই কোঠাতে বাপে-পুতে থাকি। তো অসুখে পড়ে বুঝলাম তার ডাক আইছে। সব ফেলে বিছানা নিলাম। দেখতে দেখতে সাত-আট মাস। মুর্শিদেও নেয় না, অসুখও ভালা হয় না। আধা ঘুমের মাঝে একদিন চমকে উঠলাম, আরে... আমার উপরে তো একটা ঘরের দাবি আছে! ছেলেরে ঘর না দিলে তো মুর্শিদ আমারে নিত না। সেইদিনই বাজার থেকে কালিজিরা আনাইলাম। তিন বেলা তিন চিমটি কালিজিরা। এক কাপ গরম পানি।
এই কথা বলে উদাসী ভাই নীরবে হাসে। শেষ হয়ে যাওয়া বিড়িটা (ভারতীয় নাছির বিড়ি। গাছের পাতা দিয়ে বানানো।) ফেলে আরেকটা নেয়। আমি তাড়াতাড়ি লাইটার জ্বালিয়ে বিড়ি ধরাতে সাহায্য করি। ঠোঁটে বিড়ি গুঁজে সে আমার দিকে মুখ বাড়িয়ে দেয়। তার নির্লোভ নির্লিপ্ত মুখের উপর পরম শান্তির আভা দেখে মনে মনে আমি স্তম্ভিত হই! এই মানুষটা কতকাল ধরে একমুঠি পুষ্টিকর খাবার পায় না, ভালো একটা বিছানায় ঘুমায় না। আজকে এই কলোনি, কালকে সেই বস্তি। ঘরের ভাড়া কোথাও আটশ, কোথাও এগারোশ। দুঃখ-কষ্ট ছাড়া যার জীবনে কোনো প্রাপ্তি নাই। তিন সন্তানসহ মোট চারজনকে কবরে রেখে, কয়েদখানার মতো কলোনির এই আবছা অন্ধকার গহ্বরে পড়ে মৃত্যুর সাথে কানামাছি খেলছে! কিন্তু আজ তার হাড়সর্বস্ব দেহের রোগ-শোক-ক্লান্তি যেন উধাও হয়ে গেছে। গলায় ফিরে এসেছে কথা বলার সাবেকি ঢং ও তেজ। কথায় কথায় প্রজ্ঞার আলো ঝলক মারছে। আমি জানালার দিকে এক পলক তাকাই: দূরের গ্রামগুলার মাথায় নীল আকাশ আর হাওরের কালচে-সবুজ মিশে আছে। এই বিশাল শূন্যতার মাঝে কী যেন আছে। বারবার সেদিকে চোখ চলে যায়। নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। তাই আগপাছ বিবেচনা না করে বলে বসি, পৃথিবীতে সুনামগঞ্জ একটাই আর বাংলাদেশেও ভিন্ন কিছু।
উদাসী: শুধু সুনামগঞ্জ না, সিলেট বিভাগটাই। মোগলদের অনেক আগে থেকেই সিলেটের খোজার খলা, বারুদখানা, কাজীবাজারসহ অনেকখানেই ইরানীরা বসত করত। খোজার খলাতে ইরানীরা কৃতদাসদেরকে খোজা করে, মোটা লাভে রাজা-বাদশাদের জেনানা মহলে সাপ্লাই করত। ইরান হইল সুফীবাদের জন্মভূমি। মানুষ যেখানে যায় তার ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতিটাও লগে যায়। অবশ্য তার আগেই আরব বণিকদের বাণিজ্য জাহাজে চড়ে, অনেক আউলিয়া, গাউছকুতুব ভারতে ছড়ায়া পড়ছিল। দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার জিকিরের সুর ভারত পার হইয়া এই হাওরের দেশে আসছিল। তাই আমি বলতে পারি, সুফী সাহিত্য থেকে বাউলের জন্ম। অন্যদিকে বৈষ্ণব সাহিত্য থেকেও বাউলের জন্ম। হিন্দু-মুসলিম উভয় মিলে বাউল সম্প্রদায়। এইজন্যই বাউলরা অসাম্প্রদায়িক। আমাদের কথা হলো: মানুষকে ভালোবাসো। মানুষের মাঝে খোদাকে তালাশ করো। আর এইভাবেই বাউল একটা ধর্ম। মানব ধর্ম। তারপর যে বলছিলাম সিলেটের কথা। তখন গৌড় রাজ্য, লাউড় রাজ্য, জৈন্তা রাজ্য এই তিন রাজ্যে বিভক্ত ছিল সিলেট। গৌর রাজ্যের রাজা গৌরগোবিন্দের জুলুমের প্রতিকার করতে শাহজালাল আসে। গৌরগোবিন্দ উচ্ছেদ হয়। নতুন রাজ্য শাসনের জন্য সারা সিলেটে ছড়িয়ে পড়ে শাহজালালের সহযোদ্ধারা। কোমরে কোষবদ্ধ তলোয়ার, মুখে খোদার পাক কালাম আর বুকে নিপীড়িত মানুষের জন্য দরদ। তারা ছিল পীর ভক্ত। শাহজালাল আউলিয়া তাদের মুর্শিদ। তাই প্রতি বিষুধবার রাতে তিনশ ষাইট আউলিয়ার আস্তানায় আস্তানায় হালকা জিকিরের সাথে খোদার শানে গান হইত। সিলেটের সব সনাতনধর্মীরা তাজ্জব হয়ে শুনল গৌরগোবিন্দের পরাজয়ের কাহিনি, শাহজালাল সাহেবের মারফতি কেরামতি। হাওরময় সিলেটের মানুষ সাত-আট মাস পানিবন্দি হয়ে থাকে। নবীন মুসলমানের বুকে আল্লাহর ভালোবাসা উদাস হাওরের শনশন বাতাসে সুর হয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে। আর এইভাবে সারা সিলেট বিভাগে নতুন একধরনের গান চালু হয়ে যায়। নাম তার হালতি গান। কেউ কেউ বলে হালতি গান থেকে বাউলগানের উদ্ভব।
লুৎফর: বৈষ্ণবধারা বাউলদের বিষয়ে একটু বলবেন?
উদাসী: তারাও মানুষের মাঝে মুর্শিদরে খোঁজে। সৃষ্টিকে ভালোবেসে স্রষ্টাকে পেতে চায়। শুধু করণ-কারণে উনিশ-বিশ আছে। তারা নারীকে সাধন সঙ্গী হিসাবে লয়। তারা মনে করে এক ফোঁটা মণির মাঝে শত শত প্রাণ। তাই বীর্য রক্ষার সাধনাই তাদের ব্রত। আর সুফিধারার বাউলরা নিজের বউকেই সাধনসঙ্গী মনে করে।
লুৎফর: তাহলে স্থানভেদে করণ-কারণে ভিন্নতা আছে?
উদাসী: অবশ্যই। চাওয়া একটা হলেও পশ্চিম বাংলা কিংবা লালন-ঘরানার বাউলদের সাথে সুফি ধারার বাউলদের বাহ্যিক ভিন্নতা আছে।
লুৎফর: দয়া করে হালতি গানটা একটু খোলাসা করবেন?
উদাসী: সেই সময় সিলেটের গ্রামগুলাতে আসন ঘর থাকত। গ্রামের কিংবা পাড়ার সবাই যারে পছন্দ করত তার বাড়িতে থাকত আসন ঘর। বাড়ি থেকে একটু দূরে। আড়ালে। তাই সিলেটের অনেক অঞ্চলে আসন ঘরকে বলে আউলি ঘর। এই ঘরে অজু ছাড়া কেউ ঢুকত না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজিরাও আসন ঘরে আসত। উকিল মুন্সী ছিলেন একটা মসজিদের ইমাম। এখন এই কথা কল্পনা করা যায়? যাহোক, মাগরিবের আগে সবার পছন্দের সেই মানুষটা আসন ঘরে এসে পাকপাঞ্জাতনে বাতি ধরায়। আল্লায় রসুলরে পয়দা কইরা প্রথমে ময়ূর রূপে বানায়া রাখছিল। ময়ূরের মাথার তাজ হইলো হযরত আলী, গলার হার হইলো মা ফাতেমা। তাই মনে করা হয় আসন ঘরের পাঞ্জাতনে হাজির আছেন আল্লা, আল্লার রসুল, হযরত আলী, মা ফাতেমা ও দুই ইমাম। বাতি জ্বালানোর পরে একে একে সবাই এসে বিনা বাক্যে বাতির সামনে গোল হয়ে বসে। পাঞ্জাতনে ধরানো মোমটা একটা ধ্যায়ান। তাই সবাই বসে বসে ধ্যায়ান করে। আগরবাতিও ধরানো হয়। গোলাপ জল ছিটানো হয়। আস্তে আস্তে সবার কলবে ভাব আসতে থাকে। সারা সপ্তাহ সংসার সংসার কইরা কলবে যে ময়লা লাগে এই ময়লা সাফ করার জন্য হালতি গান। হালতি ঘরে যারা আসে তারা পীরভক্ত। বেতরের নামাজের পরে কিছু কিছু জিকির হয়। মুর্শিদ বলে দিছে, কোন কোন জিকির করতে হবে। মুর্শিদ হইল মাধ্যম। মুর্শিদের দিকে তাকাইলে রসুল হইয়া আল্লারে পর্যন্ত দেখা যায়। তো জিকিরের সাথে সাথে তাল আইব। যে সময় তাল আইবে, তালের সাথে সাথে যন্ত্রপাতিও বাজতে থাকবে। এই তো শুরু হইয়া গেল: আল্লার শানে গান, মুর্শিদের শানে গান। দিল উজার কইরা গায়ক গাইতেছে। পাড়ার নারী-পুরুষ সব পবিত্র মনে চোখ বন্ধ কইরা, গানের কথার সাথে সাথে শরীর দুলায়া ধ্যায়ান করছে। এইদিকে একটার পর একটা গান চলছে:
‘রহিম রহমান তোমার নাম,
রহম করা তোমার কাম
উদ্ধারিলা কতশত জন রে...।
এইখানে কোনো পাপ কথা আছে?
শেখ লুৎফর: না।
উদাসী: ‘বন্ধু নিবেদি চরণে,
ভিন্ন যদি বাসো আমি মরিব পরানে।
জন্ম-মৃত্যু, জরা-ব্যাধি সব তোমার অধীনে।’
এই মৃত্যু, জরা-ব্যাধি এইটা তো আমার না। তোমার অধীনে। আমি তো তোমার দাস।
দোতারা, মন্দিরার সুরে সুরে এই যে আজিজিটা (করুণা ভিক্ষা) প্রকাশ করা হইতেছে। এই যে কথাগুলা এইখানে তো কোনো খারাপ নাই। সব তার নিবেদনে। এই যে আজিজি বুকে ধাক্কা মারে। গানের সুরে সুরে কণ্ঠটা পরিষ্কার হইতেছে, গভীর হইতেছে, শরীরে পরিবর্তন ঘটতেছে, রক্তে রোদন জাগতেছে, আল্লার দিকে মন ঘনিষ্ঠ হইতেছে। কান্দা ছাড়া উপায় নাই। খালি কান্দা। খালি রোদন। খালি হালকা। গান তো চলছেই। কত জাগায় যে গান গাইছি। হবিগঞ্জ গেছি। আজমল শাহর মাজার। বিশ্বনাথ পর্যন্ত সারা সিলেট গান গায়া গান গায়া ঘুরছি। বর্তমানে এই গানের হাল ধরছে মাইজভান্ডারি।
লুৎফর: এখন হালতি নাই কেন?
উদাসী: উত্তর সুনামগঞ্জে কিছু কিছু আছে। যারা টাকার জন্য বাউল গানে নারী শিল্পী আনছে, এই গান ধ্বংস করছে, তারাই সেই সময় হালতি গানেও নারী আমদানি করছে। এই গানের নামে চরিত্রহীনরা বছরের পর বছর কলিমা ছাড়া বেটি লইয়া ঘুমাইছে। বর্তমানের বাউল গানের মতো এইভাবে হালতি গানও একদিন ধ্বংস হইছে।
লুৎফর: এখন আপনার যে সময় চলছে, এখন তো আপনার চারপাশে প্রচুর শিষ্য থাকা উচিত ছিল। আমরা যতটা জানি, আপনার অসংখ্য শিষ্য আছে। কিন্তু আপনি কোনো শিষ্যকেই পছন্দ করেন না। স্বীকার করেন না। কেন?
উদাসী: ভাইরে, পছন্দ যে করতাম, আমি নিজেই তো শিষ্য হইতে পারছি না। আমার মুনিবে আমারে যেভাবে রেডি করছে, সেইটাই আমি। আমি কিছু হইতে পারছি না। আমার কোনো শিষ্য নাই। একজনে হয়তো আমারে ভালোবাসে, আমি মানুষকে ভালোবাসি। আমারে সে যতটুকু ভালোবাসে, আমি তারে ততটুকু ভালোবাসা দেই। সে আমারে যে দৃষ্টিতে দেখে, আমি তারে সেই চোখে দেখি। আমারে যে যেভাবে চিনে, আমি তারে সেইভাবে চিনি। তো কথা হইল মানুষ আয়। মানুষ কয়জন? কেউ বাবা ডাকিলায়, কেউ থাইকা যায়। এইটা অইটা কইরা দেয়। দোয়া চায়। হউক সে হিন্দু, মুসলিম। যেতা ইচ্ছা হউক। কিন্তু অন্তরটা মানুষের হইতে অইব। দোয়া চায়। আমি দোয়া করি।
মোগলদের অনেক আগে থেকেই সিলেটের খোজার খলা, বারুদখানা, কাজীবাজারসহ অনেকখানেই ইরানীরা বসত করত। খোজার খলাতে ইরানীরা কৃতদাসদেরকে খোজা করে, মোটা লাভে রাজা-বাদশাদের জেনানা মহলে সাপ্লাই করত। ইরান হইল সুফীবাদের জন্মভূমি। মানুষ যেখানে যায় তার ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতিটাও লগে যায়। অবশ্য তার আগেই আরব বণিকদের বাণিজ্য জাহাজে চড়ে, অনেক আউলিয়া, গাউছকুতুব ভারতে ছড়ায়া পড়ছিল। দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার জিকিরের সুর ভারত পার হইয়া এই হাওরের দেশে আসছিল। তাই আমি বলতে পারি, সুফী সাহিত্য থেকে বাউলের জন্ম
লুৎফর: দোয়াটা বলবেন?
উদাসী: না। তবে অর্থ হইল: হে আল্লা, আমার মাইধ্যমে সে তোমারে স্মরণ করছে, তুমি তারে কবুল করো। যদি দোয়া কবুল হয় তাইলে খারাপ মানুষ হইলেও সে ভালো হইয়া যাইতা পারে। পথের সন্ধান পাইতে পারে। আমার দায়িত্ব আমি পালন করলাম। আমার কোনো ভক্ত নাই। শিষ্য-মুর্শিদ সম্পর্কটা আত্মার সম্পর্ক। আমার আত্মার সাথে মিললে না শিষ্য হইব? আমি তো নাম-কাম-টাকা চাই না। যারা শিষ্য হইতে আসে তারা চায়। তাইলে আমার শিষ্য থাকতা পাড়ে?
লুৎফর: এই রকম শিষ্য তো বিরল?
উদাসী: আমি কী করতাম? শিষ্যটিষ্য না, আমি তো আছি আমারে লইয়া। [একটু বিরক্ত গলায়] আমি পরের কথা ভাবি না। আমি আমারে ভাবি। আমি কোনো নামে নাই, কামে নাই, এরম মানুষ। যে গুরুর মন জয় করতা পারে না সে শিল্পী হইতে পারে না। খালি আইবে আর যাইবে, আইবে আর যাইবে। শিল্পী হইতে পারবে না। শিষ্য হইতে পারবে না। এরা উস্তাদের কাছে গিয়া আরো কলঙ্ক লাইগাইবে।
লুৎফর: গুরু-শিষ্যের কথা, ভক্তের কথা আরেকটু বলবেন?
উদাসী: ভক্ত হইল পাঁচ প্রকার। কাম ভক্ত, নারী ভক্ত, প্রেম ভক্ত, কমভখত্ (মন্দ নসীব), পরম ভক্ত।
লুৎফর: পরম ভক্ত জিনিসটা কী?
উদাসী: পরম মানে পরমেশ্বর। খোদা। কেউ যদি পরম ভক্ত হয়, তার জন্য এই পথ। বাউল একটা কঠিন সাধনা। বাউল হইবার আগে মানুষ হইতে হয়। বাউল শিল্পীও তো বাউল। তারা গানের মাঝে পরমের সন্ধান করে। গান গাইতে গাইতে খোদারে সন্ধান করে। একটু একটু কইরা কলবের চোখ খুলতে থাকে। মিডিয়া না। আড়ালে। দৃশ্য থেকে সাধনায় অদৃশ্য হইয়া যাইতে হয়। এইভাবে বাউল শিল্পী থেকে বাউল হয়। মরমী গান লিখতে চেষ্টা করে। যার হাতে পরমাত্মার প্রভাব পড়ে তার গান হয়। সে বাতাসের মাঝে আল্লারে খোঁজে, শ্বাস-প্রশ্বাসে আল্লারে খোঁজে।
লুৎফর: এই এতটা বছর এক সাথে উঠবস করলাম, কখনো আপনার কোনো চাওয়া দেখলাম না, অভাবের কথা শুনলাম না। মাঝে মাঝে বিস্ময় লাগে।
উদাসী: আমি বাউল মানুষ। মুর্শিদের আরাধনাই আমার ধর্মকর্ম। আমার এইতা দরকার আছে? এই সব আবর্জনার দরকার আছে? খোদার চোখে দুনিয়াটা একটা মরা লাশ। যারা দুনিয়ার পিছে ছুটে তারা কুকুর। পাক রসুলের হাদিসে আছে। সরকারে যে আমারে ঘর দিত এইগুলা রক্ষা করব কে? আমি চাইছি বাউলদের কথাগুলারে নিজের মইধ্যে বাঁচায়া রাখতাম। আমি মুর্শিদরে ছাড়া কেউর কাছে হাত পাতি না। সরকারের লোকজন হয়ত মায়া কইরা দিতে চাইছে। অনেকেই মায়া কইরা টাকা দেয়। মুর্শিদ যে দেয়, সে-তো জানে, সামনে আমার কঠিন দিন। এইটার থেকে উদ্ধারের জন্য মুর্শিদ একজনের উছিলা কইরা কিছু টাকা পাঠাইছে। আমি তো তারে কইছি, আমারে তুমি কোনোখানে আটকাইয়ো না। কত বিপদে পড়ছি, কত বড় বড় গানে গেছি, কোনোখানে আল্লা আমারে আটকাইছে না। এইটা আমার ঈমানী শক্তি। আর ঘর দিবার যারা চাইছিন, তারা তাগর মানবতা দেখাইছে। আমি তাগরে ধন্যবাদ জানাই। জীবনে আমি বায়না কইরা গান গাইছি না। ভালোবেসে যা দিছে তা নিয়া খুশি মনে আসর থেকে ফিরছি। আমি উপাস থাকলেও কেউর কাছে চাইছি না। আমি চাইলে তার কাছে চাইব। আমি মানুষের কাছে কেন চাইব? যে দাতা তার হাতটা থাকবে উপরে, আমারটা নিচে। সে দেখতেছে না? সে যদি বলে, এই-ই...মানুষের কাছে তুই কী চাছ? তুই না আমারে বইলা রাখছস তরে কোনোখানে আটকাইতাম না?
লুৎফর: জীবনের শেষ ইচ্ছা কী?
উদাসী: আমি মুর্শিদরে কই, মরণকালে যেন আমার হুঁশ ঠিক থাকে। তখন যেন আমি কলিমাটা সঠিক করে পড়তাম পাড়ি। ছরকাত হইত না।
লুৎফর: ছরকাত কী?
উদাসী: শাস্তি। মরণকালে যেন শাস্তি না হয়। ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে। কইছে, এই... আইজকু তোরা বাড়িৎ থাকিছ। এইরকম কথা বলতে বলতে স্টোক করে মরে যায়। আমার দাদাপীর মরবার কথা কইছে না, কইছে, এই তোমরা বাড়ির সব ওমুক দিন বাড়িৎ থাকিছ। সেই বিশেষ দিনটাতে সবার সাথে আলাপ করতে করতে ঘুমায়া পড়ছে। ছরকাত না। সহজ মৃত্যু।
আমি বেরিয়ে আসতে আসতে উদাসী ভাইকে জোর গলায় বলে আসি, আপনি সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। তাই মনে মনে রেডি থাকবেন, দুই সপ্তাহ পরে আমরা হাওর ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ব।
উদাসী ভাই মুখভরা হাসি দিয়ে বলে, সব মুর্শিদের ইচ্ছা।