গোলাম কাসেম ড্যাডির আলোকচিত্র ‘বিপুলা জীবন’
আলোকচিত্র যখন বাংলায় ঠিক জমে ওঠেনি, তখন যে গুটিকয়েক মানুষ মনের আনন্দে ছবি তুলতেন, গোলাম কাসেম ড্যাডি ছিলেন তাঁদের একজন। তিনি যখন ফটোগ্রাফি শুরু করেন, তখন ভারতবর্ষে ছবি তোলার বিষয়টি ধর্মীয় দৃষ্টিতে গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচিত হতো। ওই রকম পরিস্থিতিতে তাঁকে কতটা কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, তা ভাবনার বিষয়। বিপুলা জীবনের রূপচ্ছবি ক্যামেরায় ধরার আকুতি বহন করেছেন সব সময়। তুলেছেন প্রকৃতি-প্রতিকৃতি, ফুল-পাখি, বহতা নদী, পালতোলা নৌকা, খুঁচি দিয়ে গ্রাম্য নারীর মাছ ধরা, টলটলে জলের আরশিতে পুরাকীর্তির প্রতিচ্ছবি, গেরস্থ বাড়ির উঠানে শাখা-সিঁদুর পরা নারী, সূর্য হেলে পড়া আকাশ—আরও কত কী!
তাঁর তোলা শিশুদের ছবিগুলো সবচেয়ে জাদুকরী মনে হয়। ছবিগুলোতে গভীর আবেগ ধরা। তাঁর ছবির কম্পোজিশন খুবই সাধারণ। অতীতের ক্যামেরা ও লেন্সের সীমাবদ্ধতা না জানা যে কারও মনে হতে পারে, ড্যাডির কম্পোজিশন কেন এত সরল। সরলতাই হচ্ছে শিল্পের আসল সৌন্দর্য। এই সরলতা ও সাধারণত্বকে বহু সাধনার মধ্য দিয়ে রপ্ত করেছেন তিনি। ড্যাডির ছবিগুলো বলে দেয়, তিনি নিজেও ছিলেন এক সরল মানুষ। এই সরল হৃদয় দিয়ে তিনি সৃষ্টি করে গেছেন অসাধারণ সব শিল্পকর্ম। ড্যাডির তোলা ছবিতে ভর করে নরম আলোর সুনিপুণ সুষমা। তাঁর গ্লাস প্লেট নেগেটিভের প্রতিচ্ছবিগুলো আমাদের কৌতূহলী মনে শিহরণ জাগায়।
আন্তর্জাতিক শিল্পবিষয়ক লেখক স্কাই অরুন্ধতী থমাস লিখেছেন, ‘ড্যাডির ছবিগুলোতে শক্তিশালী গল্পের আবহ পাওয়া যায়। ছবির চরিত্ররা সচেতন, তাদের চাহনি-শরীরী ভাষা অর্থপূর্ণ। এ বিষয়গুলোই সমসাময়িকদের থেকে ড্যাডিকে আলাদা করে দেয়। দক্ষিণ এশিয়ায় আলোকচিত্রের হাতেখড়িটা হয় উপনিবেশ স্থাপনকারী ইংরেজদের হাতে। যে কারণে বেশির ভাগ আলোকচিত্রই এদেশীয়দের প্রতি ইংরেজদের দৃষ্টিভঙ্গিরই একটা বর্ধিত সংস্করণ বলে মনে হয়। গৎবাঁধা কিছু স্থান আর নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে বিষয়বস্তু করে তোলা ছবিগুলো অসম্পূর্ণ, যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে অনেকাংশেই ব্যর্থ। সেই স্থানকালে দাঁড়িয়ে ড্যাডি যেন ইতিহাসের আরেক ভুবনের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। ড্যাডির ছবিতে স্পষ্ট অথচ ঘোলাটে বিচিত্র আলোর দেখা মেলে। চরিত্রগুলো দ্যুতিময়। তাঁর ছবির সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ফিল্মের খানিক মিল পাওয়া যায়। ভিগনেটিং [ছবি মাঝখানে আলো রেখে চারপাশ থেকে কালো হয়ে আসার শৈলী] এবং ওভার এক্সপোজারের এমন কাব্যিক ব্যবহার দুর্লভ।’
আলোকচিত্রবিষয়ক শিক্ষক আরফান আহমেদ লিখেছেন, ‘তাঁর [ড্যাডি] ছবিতে যে অদ্ভুত প্রেম থাকে, একটা পালকের মতোন ভালোবাসা থেকে; তা কোথা থেকে আসে আমরা হয়তো আঁচ করতে পারি। পেশাদার হননি কখনো, তাই হয়তো ছবিগুলোতে থাকে কিছু অপরিমেয় মায়া। ভূমি রেজিস্ট্রি অফিস শেষে জীবনের শিল্পের সব সঞ্চয় বিলিয়ে দিলেন। আজকে যে দেশি মেয়েটা একটা ছবি নিজে নিজে আবিষ্কার করে নিজেকেই তাক লাগিয়ে দেয়, ড্যাডি সেখানেও বিহার করেন হয়তো।’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক দুই বছর আগে ফটোগ্রাফিতে অভিষেক গোলাম কাসেম ড্যাডির। ড্যাডি যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের পাশাপাশি আলোকচিত্রী হিসেবেও কাজ করেছেন, সে বিষয়টিও এত দিন কোথাও বা কোনো মহলে যথাযথভাবে উচ্চারিত হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুবাদে তিনি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম ও বিহারের মধুপুর রণপ্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অসংখ্য ছবি তোলার সুযোগ পান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ড্যাডি যত ছবি তুলেছেন, ভারতবর্ষের আর কেউ এত ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছেন বলে জানা যায়নি।
মধুপুরের বিশাল ময়দানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন ইনফ্যানট্রি কোরের সদস্যরা। সবার হাতেই থ্রি নট থ্রি রাইফেল। প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন ক্যাপ্টেন গ্রে। নিবিড় গাছগাছালির ছায়ায় বসে রণপ্রশিক্ষণের মহড়া দেখছেন উৎসুক মানুষ। প্রখর রোদে ইউনিফর্ম পরা প্রশিক্ষণার্থীদের দীর্ঘ ছায়া মাটিতে প্রতিফলিত। স্লো সাটারের কারণে প্রশিক্ষণার্থীদের কর্মচঞ্চল হাতগুলো কিছুটা সেইক করায় ছবিতে গতিময়তা যোগ হয়েছে। লাইন, ফ্রেম, কম্পোজিশন দেখে বোঝার উপায় নেই এই ছবি তোলার মাত্র তিন বছর আগে ড্যাডির ফটোগ্রাফিতে হাতেখড়ি। ড্যাডির এই আলোকচিত্র দেখে যুদ্ধকালীন ভারতবর্ষের সমাজচিত্রের একটা ধারণা করা যায়। মহাযুদ্ধের টালমাটাল সময়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে ভারতীয়দের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব যে কিছুটা ঘুচে গিয়েছিল, ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড আর ভিজ্যুয়াল এলিমেন্ট সে রকমই আভাস দেয়। তা না হলে মধুপুরের মতো একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ ব্রিটিশ সেনাক্যাম্পের আশপাশে ঘেঁষার সাহস দেখাতে পারতেন না। গ্লাস প্লেট নেগেটিভে ধারণ করা ছবিটির ওপরের দিকে ফাঙ্গাস কিছুটা দখলে নিয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় কালো ছোপ ছোপ দাগ। পুরোনো বলে ছবিতে ছিপিয়া টোন স্পষ্ট। এসব অবশ্য ছবিটাকে একটা অ্যান্টিক মর্যাদা দিয়েছে। ড্যাডির তোলা এ ছবি আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় প্রথম মহাসমরের প্রশিক্ষণ ময়দানে।
আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, তাঁবুর সামনে দাঁড়ানো দুই ব্যক্তির সাহেবি ভঙ্গি। ছবিটি অনুমতি নিয়ে তোলা সন্দেহ নেই। সাধারণত অনুমতি ছাড়া সেনাক্যাম্পে ছবি তোলা যায় না। একটা সূক্ষ্ম ব্যাপার লক্ষণীয়, ছবিতে কারও দৃষ্টি ক্যামেরার দিকে নয়। ফলে এ দৃশ্য তুলতে গিয়ে ড্যাডি যে একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন এবং ওই সময়ই তিনি যে ক্যামেরা চালনায় দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন, ছবিটা কিন্তু সেই ইঙ্গিতই দেয়। ভার্টিক্যাল ফ্রেমে তোলা ছবিটির ব্যাকগ্রাউন্ডের তাঁবুটি হঠাৎ দেখলে পিরামিডের মতো মনে হয়। তাঁবুটি কিন্তু ছবিতে একটা ত্রিমাত্রিক বা থ্রি ডাইমেনশনাল ফিল দেয়। ছবির দুজন ব্যক্তি কে কিংবা কী তাঁদের পরিচয়—এ ব্যাপারে ড্যাডি বিস্তারিত কাউকে বলে যাননি। তবে রণপ্রশিক্ষণের ছবিটার সঙ্গে এই ছবিটার মিল খুঁজলে হ্যাট পরা লোকটিকে ক্যাপ্টেন গ্রে বলেই মনে হয়। তাঁর পাশে টানা রশি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কিংবা বড় কর্মকর্তা—এই ধারণা করা যেতে পারে।
ড্যাডির একটা আইকনিক ছবি আছে। পাশাপাশি দাঁড়ানো দুই বালিকার একটা ভার্টিক্যাল ফ্রেম। একজনের স্নেহের হাত আরেকজনের কাঁধে রাখা। দুজনের গায়ে নরম সাদা শাড়ি। শাড়িতে কালো পাড়। তেলে জবজবে কাজল কালো চুলের মাঝখানে সূক্ষ্ম সিঁথি। চোখে মায়া জড়ানো সারল্য। পেছনে কালো পর্দা। ওপরের দিকে একটু সাদা অংশ বের হয়ে আছে। তাতে একটা কার্ভ লাইন তৈরি হয়েছে। ড্যাডি ইচ্ছে করেই হয়তো ফ্রেম থেকে ওটুকু বাদ দেননি। ছবিতে দুজনের চোখ ঠিক ক্যামেরার দিকে নয়। একটু ওপরে অন্যদিকে তাকানো। একজনের মুখে মৃদু হাসি, আরেকজনের কৌতূহলী দৃষ্টি। দেখে মনে হয় ক্যামেরার পেছন থেকে ইশারায় কেউ তাদের কিছু বলার চেষ্টা করছে। এই চিত্র ধারণের ১০১ বছর পর জানা যায় তাদের প্রকৃত পরিচয়। ছবির এই দুই বালিকার নাম জামাল আরা ও জাহান আরা এবং তারা সম্পর্কে সহোদর। ১৯২০ সালে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরের ১৭ নম্বর টার্ফ রোডের বাড়িতে ছবিটি তোলা।
ড্যাডির তোলা ‘তার প্রথম নাচ’ শিরোনামের ছবিটি একটা অনবদ্য আলোকচিত্র। এ ছবিতে এক অপূর্ব কন্যাশিশুর দেখা পাওয়া যায়। শিশুটি ছোট একদল মানুষের মাঝে নেচে চলেছে। আর সবাই চোখে প্রশংসার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। ওভার এক্সপোজারের কারণে মেয়েটির পেছনে একটা স্বপ্নময় আবহ তৈরি হয়েছে। মাথার ওপর সম্ভাষণ জানাচ্ছে গাছের পাতা। ছবির জমিনময় কালো কালো ছোপ নির্দেশ করে সূর্যের তপ্ত আলো। ছবিটি ১৯৪৭ সালে রাজশাহীতে তোলা। আলোকচিত্রের নন্দনতাত্ত্বিক উৎকর্ষের উদাহরণ এ ছবি।
নরম আলোয় ঝোপালো বাগানে বেতের চেয়ারে বসা এক মিষ্টি কিশোরী। বসবার ভঙ্গিটা অদ্ভুত। মাথার ওপর উজ্জ্বল আলো যেন তার মনের কথা বলে দেয়। ফ্রেম ভেদ করে বেরিয়ে আসে তার চোখের দৃষ্টি। কালো মণিটা কার সাথে যেন কথা বলে। ক্যামেরার সামনে মানুষের যে সহজাত লাজুকতা থাকে, এই মেয়ের চোখে তা অনুপস্থিত। ছবিটা ১৯১৮ সালে হাওড়ায় তোলা। ছবি দেখে অনুমান করা যায়, মেয়েটি তাঁর কাছের কেউ। কৈশোরে এলসি নামে এক খ্রিস্টান মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন ড্যাডি। ছবিটি এলসির কি না, তা ভাবা যেতে পারে। একজন কিশোরীর নজরের সামনে কেন ড্যাডি ক্লিক ডিফোকাসড হয়, তা ভাববার বিষয়।
প্রায় একই রকম আরেকটি ছবি আছে। একটি মেয়ের খোঁপায় গাঁথা স্পাইডার লিলি। দাঁতে কাটছে গমের শিষ। মাথাটা খানিক হেলিয়ে দুষ্টুমিমাখা স্বপ্নিল চোখে, ক্যামেরার দিক থেকে মুখ সরিয়ে তাকিয়ে আছে দূরে কোথাও। কানে দুল, গলায় মুক্তার মালা, নখে নেইলপলিশ, হাতে একগাছি চুড়ি। ১৯৫৭ সালে তোলা কালো ব্যাকড্রপের সামনে রূপসী এ তরুণীর পোর্ট্রেটের নাম ‘হ্যাপি গার্ল’।
শৌখিনভাবে ছবি তুললেও ড্যাডির ছবি মানুষের কাজে লেগেছে। ১৯২৯ সালে বাঁকুড়ার সাংগারি ক্রিশ্চিয়ান মিশনের ধর্মযাজক মি. ফ্রেড তাঁকে একটি সাঁওতাল গ্রামে নিয়ে যান। অনাবৃষ্টিতে ফলন না হওয়ায় ওই গ্রামের মানুষ খুবই করুণ দিনাতিপাত করছিল। না খেতে খেতে তারা দুর্বল হয়ে পড়ছিল। অতি সাধারণ মানের কোডাকের ফোল্ডিং ক্যামেরায় তিনি অভাবী মানুষ ও ক্ষীণকায় শিশুদের দুর্দশা বন্দি করেছিলেন। শিশুরা ড্যাডিকে ঘিরে জানতে চেয়েছিল, কালো রঙের অদ্ভুত জিনিসটা কীভাবে নিজের পেটের ভেতর তাদের আটকে ফেলে! ড্যাডির তোলা ছবিগুলো মিশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ সাহায্য আনতে সহযোগিতা করেছিল।
ড্যাডি কোনো প্রতিযোগিতায় ছবি পাঠাতেন না। ছবি তুলতেন সাবজেক্টকে বুঝতে না দিয়ে। এতে তাঁর আনন্দ হতো। ড্যাডি তখন রাজশাহীর ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার। ড্যাডির পোষ্যকন্যা আনোয়ারা বাড়ির সামনের পুকুরঘাটে কাপড় ধুচ্ছেন। পরনের সাদা শাড়ির এক পাশে, ঘাটের সিঁড়িতে সকালের নরম আলো এসে পড়েছে, আলোছায়ার মায়ারঞ্জন তৈরি হয়েছে। ১২০ ফরম্যাট ক্যামেরায় ভার্টিক্যাল ফ্রেমে ড্যাডি ছবিটা তোলেন। ছবিটি প্রিন্ট করে তিনি আনোয়ারাকে উপহার দেন। এর কয়েক দিন পরের ঘটনা। পত্রিকায় ‘অল পাকিস্তান আগফা ফটো কনটেস্ট’-এর বিজ্ঞাপন বের হয়। আনোয়ারা ড্যাডিকে না জানিয়ে ছবিটি ডাকযোগে করাচিতে পাঠান। মাস দুয়েক পর খবর আসে, ছবিটি আগফার কনটেস্টে প্রথম পুরস্কার জিতেছে।
ড্যাডির একটি ছবি বেশ নাটকীয়। গায়েহলুদের সকালে কনেবাড়িতে বিশাল আকৃতির রুই মাছ। বরপক্ষের পাঠানো মাছ দুটি বারান্দার টেবিলে সাজিয়ে রাখা। কাগজে মোড়ানো সেই মাছ ঘিরে লিজি, ইমু, ফ্লোরা, বাবুসহ পাঁচ শিশুর চোখে রাজ্যের কৌতূহল। একটা উচ্ছ্বাসের আলো সবাইকে ঘিরে আছে। দুটো অচেনা জীবের সঙ্গে তাদের প্রথম পরিচয়! ১৯৬৬ সালে ঢাকার গোপীবাগে তোলা ছবিটার শিরোনাম ‘টেম্পটিং ফিশ’। ড্যাডির প্রকৃতিপ্রদত্ত ক্ষমতা ছিল এমন সব মুহূর্তকে ধরার। যে ছবি পলকে হারিয়ে যেত, ড্যাডির ক্যামেরায় তা হৃদ্যতা আর বন্ধনের অমলিন স্মারক হয়ে উঠত।
১৯২২ সালে একটি ছবির কথা না বললেই নয়। একজন নারী মাছ ধরছেন। তাঁর ঊরু পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে। হাতে একটি ঠেলা জাল। সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে একটি বিশাল মালবাহী নাও। ছবিটা একটি ভাঙা কাচের নেগেটিভ থেকে প্রিন্ট করা, যা মাকড়সার জালের মতো আবহ তৈরি করেছে। পেশাগত জীবনে সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে তাঁর ছিল বদলির চাকরি। তিনি যখন যেখানে গেছেন, নেগেটিভগুলোও সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। পরিবহনের সময় অনেক গ্লাস প্লেট নেগেটিভ ভেঙেছে, নষ্ট হয়েছে। সেগুলোও অতি যত্নে সংরক্ষণ করতেন ড্যাডি। ভাঙা নেগেটিভ থেকে পজিটিভে রূপান্তরিত ছবিটি ধারণা দিচ্ছে একটি শুষ্ক পৃথিবীর অথবা শীতের রুক্ষ ত্বকের, যা ছবির বিষয়ের সঙ্গে বৈপরীত্য প্রকাশ করে।
ড্যাডি সেলফ পোর্ট্রেট বা আত্মপ্রতিকৃতি তুলতে পছন্দ করতেন। তিনি ১৯২০ সালে প্রথম সেলফ পোর্ট্রেটটি তুলেছিলেন। তবে ১৯৫১ সালে তোলা সেলফ পোর্ট্রেটটি তাঁর একটা গুরুত্বপূর্ণ এক্সপেরিমেন্টাল কাজ। এই পোর্ট্রেটটির ভিজ্যুয়াল এলিমেন্ট থেকে বোঝা যায়, এটি তাঁর ইন্দিরা রোডের বাড়ির শয়নকক্ষে তোলা। ১২০ বা মিডিয়াম ফরম্যাট টুইন লেন্স রিফ্লেক্স ক্যামেরা গলায় ঝোলানো। ভিউ ফাইন্ডারে রাখা চোখ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে শাটার রিলিজ বাটন প্রেস করছেন। এতে তাঁর ডান হাতের রগগুলো বটগাছের শিকড়ের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে আধুনিক আলোকচিত্রকলার পুরোধা গোলাম কাসেম বেশি পরিচিত ড্যাডি নামেই। আলোকচিত্রীদের অভিভাবক আর আলোকচিত্রের ব্যাপারে শিক্ষাগত এবং উপলব্ধিগত সামষ্টিক কাজের কারণেই তিনি ‘ড্যাডি’ খেতাব পেয়েছিলেন। তিনি সারা জীবনে আট-দশ হাজার ছবি তুলেছেন। শুরু থেকেই আলোকচিত্র সংরক্ষণের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন। ১৯১৫ সাল থেকে তোলা নেগেটিভগুলো তিনি পরম মমতায় সংরক্ষণ করেছিলেন। শেষ জীবনে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও পাঁচ শর মতো নেগেটিভ টিকিয়ে রেখেছিলেন। বর্তমানে দৃক পিকচার লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে ১৬৫টি নেগেটিভ। ড্যাডির প্রতিষ্ঠিত ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাব ও নাসির আলী মামুনের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় কিছু সংরক্ষিত আছে। ড্যাডির নেগেটিভগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে বাংলার এক অদম্য ভবিষ্যতের গল্প।
—ভূমিকা : সাহাদাত পারভেজ
তর্ক বাংলায় চলছে গোলাম কাসেম ড্যাডির একক অনলাইন আলোকচিত্র প্রদর্শনী। শিরোনাম বিপুলা জীবন। প্রদর্শনী চলবে ৭ মে ২০২২ থেকে ৭ জুন ২০২২ পর্যন্ত।
বিপুলা জীবন : ১
আলোকচিত্র : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রশিক্ষণ [বিহার, ভারত ১৯১৫]। © দৃক
বিপুলা জীবন : ২
আলোকচিত্র : কিশোরী [রাজশাহী, বাংলাদেশ ১৯৪৭]। © সিআরসি
বিপুলা জীবন : ৩
আলোকচিত্র : উদাসী [হাওড়া, ভারত, ১৯১৮]। © দৃক
বিপুলা জীবন : ৪
আলোকচিত্র : স্বপ্নীল চোখ [ঢাকা, বাংলাদেশ, ১৯৫৭]। © দৃক
বিপুলা জীবন : ৫
আলোকচিত্র : ঠেলা জাল [পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, ১৯২২]। © দৃক
বিপুলা জীবন : ৬
আলোকচিত্র : নদীমাতৃক [ঢাকা, বাংলাদেশ, ১৯৮৩]। © সিআরসি
বিপুলা জীবন : ৭
আলোকচিত্র : দুই বোন [দক্ষিণ কলকাতা, ভারত, ১৯২০]। © দৃক
বিপুলা জীবন : ৮
আলোকচিত্র : মা ও মেয়ে [বাঁকুড়া, ভারত, ১৯২৯]। © দৃক
বিপুলা জীবন : ৯
আলোকচিত্র : মসজিদের প্রতিচ্ছবি [ঢাকা, বাংলাদেশ, ১৯৫৯]। © দৃক
বিপুলা জীবন : ১০
আলোকচিত্র : বিশ্বযুদ্ধের প্রশিক্ষণক্যাম্পের তাঁবুর সামনে [বিহার, ভারত ১৯১৫]। © ফটোজিয়াম
বিপুলা জীবন : ১১
আলোকচিত্র : তার প্রথম নাচ [রাজশাহী, বাংলাদেশ, ১৯৪৭]। © দৃক
বিপুলা জীবন : ১২
আলোকচিত্র : সাওতাল পল্লীতে অনাহারী শিশু [বাঁকুড়া, ভারত, ১৯২৯]। © দৃক
বিপুলা জীবন : ১৩
আলোকচিত্র : নিউ মার্কেটের তোড়ন [ঢাকা, বাংলাদেশ, ১৯৫৬]। © সিআরসি
বিপুলা জীবন : ১৪
আলোকচিত্র : লোভনীয় মাছ [ঢাকা, বাংলাদেশ, ১৯৬৬]। © দৃক
এনারাই হলেন প্রকৃত আলোকচিত্র প্রিয় মানুষ ও শিল্পী। আলোকচিত্রে জীবন উৎসর্গ করা মানুষ এনারা । নমস্কার জানাই এনাদের ।
আশিস শূর
মে ০৯, ২০২২ ১৯:৩১