শুধু আমাদের একা থাকতে দাও: এর্নেস্তো চে গেভারা
এর্নেস্তো চে গেভারা
সারা বিশ্বে যিনি ‘চে’ নাম পরিচিত। ১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনার রোজারিওতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর দুজন কিউবান-মার্কিন সিআইএ এজেন্টের সহায়তায় আহত অবস্থায় বলিভিয়ার সেনাবাহিনীর হাত বন্দী হন চে। বলিভিয়ার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত গেরিলাদের একটি ছোট দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। একদিন পর তাঁকে বলিভিয়ার জঙ্গলে হত্যা করা হয়। চে মানে বিপ্লবের প্রতিশব্দ। ৩৯ বছরের রোমাঞ্চে ভরা জীবনে কী করেননি তিনি? ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনীদের ত্রাস। ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে কিউবা বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কয়েক বছরের জন্য দেশটির শিল্পমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মার্কসবাদী, চিকিৎসক, লেখক, গেরিলা যোদ্ধা বুদ্ধিজীবী, কূটনীতিবিদ ও সামরিক তত্ত্ববিদ ছাপিয়ে আজ বিশ্বের আপামর শোষিত জনগণের কাছে চে’র পরিচয় একজন মহান বিপ্লবী হিসেবে। আর্নেস্তো চে গেভারার সাক্ষাৎকাটি নেন মার্কিন সাংবাদিক লিসা হাওয়ার্ড। কিউবার হাবানায় ১৯৬৪ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে এটি গ্রহণ করা হয়। চে’র সাক্ষাৎকারটি ছিল দীর্ঘ। এবিসি টিভির প্রচারিত অংশটুকু এখানে উপস্থাপিত করা হলো। তর্ক বাংলার জন্য এটি অনুবাদ করেছেন কবি ও লেখক উপল বড়ুয়া।
লিসা হাওয়ার্ড: অর্থনৈতিক অবরোধ কিউবান অর্থনীতিতে কতটা গুরুতর প্রভাব ফেলছে?
চে গেভারা: কিউবার ওপর অবরোধের প্রভাবের সঠিক পরিসংখ্যান আমি দিতে পারছি না। বিশ্বাস করুন বা না করুন, তবে অবরোধের ভালো ও খারাপ উভয় ধরনের প্রভাবই রয়েছে। ভালোর মধ্যে একটি হলো, জাতীয় সচেতনতার জাগরণ এবং কিউবান লোকজনের লড়াকু মানসিকতা—আমাদের সমস্ত কিউবান যন্ত্রপাতি তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে—এমন চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা। মুনাফার লাভের জন্য তাদের সেকেন্ডহ্যান্ড যন্ত্রপাতিও আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে সরবরাহ এখন অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে গেছে। তাহলে আপনি বুঝতে পারছেন, এই অবরোধ আমাদের কিসের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে এবং এর মোকাবিলা করার জন্য কি রকম পালটা প্রচেষ্টা দরকার। এরকম অসংখ্য বিষয় আছে। সবকিছু আমি জানিও না। তবে সুস্পষ্টভাবে এটার মারাত্মক অসুবিধাও রয়েছে। তবে একই সময়ে, এটা আমাদের জন্য এক সহায়ক পাঠ। এটা আমাদের শিখিয়েছে, কীভাবে ভবিষ্যতে আমাদের অর্থনীতিকে পরিচালনা করতে হবে, সে বিষয়ে। আমি মনে করি, আপনার প্রশ্নের কম-বেশি উত্তর এটাই।
হাওয়ার্ড: রাশিয়া প্রতিদিন কিউবান অর্থনীতিতে প্রচুর অর্থ ঢালছে। হঠাৎ যদি এই সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এই দ্বীপের অর্থনীতির কী হবে?
গেভারা: আমি মনে করি, বিনিয়োগ নিয়ে, দৈনিক অর্থ ঢালার যে কথা আপনি বলছেন সেগুলো টিপিক্যাল আমেরিকান ধাঁচের চিন্তা ও ধারণা। আমেরিকানরা ‘সাহায্য’ বলতে যা বোঝায়, এটা আসলে তারই প্রতিফলন। দক্ষিণ আমেরিকান দেশগুলোতে আমেরিকান সাহায্য শেষ পর্যন্ত সহায়তা গ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধেই যায়। আমরা পুরোপুরি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চুক্তি করি, যেমন—নির্দিষ্ট বাণিজ্যিক ঋণ, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রভৃতি; একে আপনার ভাষায় তথাকথিত সাহায্যও বলতে পারেন। তবে এটা দুই দেশের মধ্যকার সাধারণ বাণিজ্যিক বিনিময়, যা নিয়মমাফিক চলে। কিউবার ক্ষেত্রে, যুক্তরাষ্ট্র এখন আর প্রধান আমদানি-রপ্তানি গ্রাহক নয়। এটা এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন।
এখন যদি আপনার প্রশ্নে আসি, আপনি জানতে চেয়েছেন, সোভিয়েত সাহায্য বন্ধ হলে কী হবে। উত্তরে আমি বলবো, দেশের জনজীবন অচল হয়ে যাবে। আমাদের সকল বিনিময়গুলোর দিকে খেয়াল করুন—যেমন তেল, আমাদের সব তেল, প্রায় চার মিলিয়ন টন, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আসে। তবে এটা সহায়তা হিসেবে নয়, এটা সম্পূর্ণ সমতার ভিত্তিতে বাণিজ্যিক বিনিময় হিসেবে। আমরা চিনি ও অন্যান্য পণ্য দিয়ে এর মূল্য পরিশোধ করি।
হাওয়ার্ড: যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ কতটা কার্যকরী, এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?
গেভারা: মনে হচ্ছে, আপনার কাছে গোপন তথ্য ফাঁস করার জন্য প্রায় আমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। আমরা অবরোধের গুরুত্ব স্বীকার করেছি, তবে আমরা বিপরীতভাবে এ-ও জানিয়েছি, অবরোধ আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হতে যাচ্ছে না। তবে শুরু থেকে এটা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনোকিছু বলা কঠিন, এবং তারপর, এটা নিয়ে বলা খুব একটা ঠিক হবে না। মোটের ওপর, আপনার ভালো অভিপ্রায় থাকে, তবুও আমরা এখনো শত্রু হিসেবে গণ্য। এবং শত্রুর উচিত সত্যিকারার্থে কেবল অপর পক্ষের মূল বিষয় সম্পর্কে জানা।
হাওয়ার্ড: কিউবা সম্প্রতি লন্ডন থেকে বাস কিনেছে। আপনি স্পেন থেকে জাহাজ কেনার জন্য আলোচনা করছেন। আমি বুঝছি, সুইজারল্যান্ডে একটি অর্থনৈতিক মিশন রয়েছে। এটা কি কিউবান অর্থনীতিতে মৌলিক পরিবর্তনের দিক তুলে ধরে, আপনার কাছে কি মনে হয়?
গেভারা: আমি এমনটা মনে করি না। আমার মনে হয়, কিছু দেশের অর্থনৈতিক পলিসিতে পরিবর্তন এসেছে। মুক্ত বিশ্বের তথাকথিত একচেটিয়া ঐক্যে নিঃসন্দেহে ফাটল ধরেছে। কিউবার সঙ্গে এখন আরও বাণিজ্য বেড়েছে। আমাদের বাণিজ্যিক আগ্রহ সব সময় একই রকম আছে। অন্য অর্থে, ব্যবসা মানে ব্যবসাই এবং এটা পারস্পরিক ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে হওয়া উচিত। এই ভিত্তিতে আমরা পুরো বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য করছি। তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রও আছে, এমনকি আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া সত্ত্বেও।
আমাদের কাছে নির্দিষ্ট কিছু পণ্য বিক্রি বন্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র খুব চাপ দিয়েছিল। কারণ, লেল্যান্ড (ব্রিটিশ মোটর উৎপাদনকারী) আমাদের কাছে বাস বিক্রি করায় যে বিতর্ক ও আলোচনা হয়েছিল, তা আপনি ভালো করেই জানেন। আসলে এ নয় যে আমরা পাল্টে গেছি। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নির্দিষ্ট কিছু প্রেক্ষিত পরিবর্তন হয়েছে। আমি জানি না, এর সঙ্গে আমাদের কিছু করার আছে কি না। আমি এমনটা মনে করি না। মনে করি না, আমরা এত গুরুত্বপূর্ণ।
হাওয়ার্ড: আপনার কি মনে হয়, এই ক্রয়গুলো যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের ব্যর্থতাকে উপস্থাপন করে?
গেভারা: হ্যাঁ।
হাওয়ার্ড: মারাত্মক ব্যর্থতা?
গেভারা: এটা নির্ভর করছে আমেরিকান ইগোতে কেমন প্রভাব ফেলেছে তার ওপর।
হাওয়ার্ড: মেজর গেভারা, আপনি কি মনে করেন, পশ্চিমের সঙ্গে এই বাণিজ্য, যেখানে এখন আপনিও জড়িয়ে আছেন, অব্যাহত থাকবে এবং অদূর ভবিষ্যতে প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
গেভারা: আমিও তাই আশা করি। স্বাভাবিকভাবে এটা কেবল আমাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে না, আজ আমরা যাদের সঙ্গে বাণিজ্য করি, তাদের ইচ্ছের ওপরও নির্ভর করছে। তবে আমি আশা করি, কিউবা যেভাবে সম্পর্কের ক্ষেত্রগুলো বিবেচনা করে, সেভাবে এটা অব্যাহত থাকবে এবং আমরা নতুন একটা যুগে প্রবেশ করব। ইউরোপের দেশগুলোও বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব উপলব্ধি করছে, তাছাড়া কিউবা একটি ভালো বাজার। যে বাজার নির্ভরযোগ্য, স্থিতিশীল, এককথায়—স্থায়ী বাজার।
এসব কিছু আমাদের আশাবাদী করে তোলে, এই সম্পর্কগুলো অব্যাহত থাকবে এবং ভবিষ্যতে আরও সম্প্রসারিত হবে। এ ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত আগ্রহী। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও জাপানের মতো কিছু দেশের সাথে আমাদের কিছু পূর্বের চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে, প্রস্তুতকৃত যন্ত্রপাতি কেনার জন্য। আমরা মনে করি, ভবিষ্যতেও এই ধরনের লেনদেন আমরা অত্যন্ত নিরাপত্তার সঙ্গে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারব। কারণ, যদি বাণিজ্য-সম্পর্ক বিঘ্নিত হয়, তবে আমরা কীভাবে খুচরা যন্ত্রাংশ পাব, এ নিয়ে অতীতে ভয় ছিল। তবে, বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স এ ক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে। বিপ্লব পর্যায়ের সময় আমাদের তাদের কাছ থেকে কেনা ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়েছে তারা।
নতুন যন্ত্রপাতি আমদানির সম্ভাবনার বিষয়ে এটা আমাদের আস্থাকে শক্তিশালী করেছে এবং লেটেস্ট মডেলের প্রথম শ্রেণির কারিগরি সরঞ্জাম দিয়ে আমরা শিল্পের একটি পূর্ণাঙ্গ সিরিজ নির্মাণ করছি, যা এখন এগিয়ে চলেছে।
হাওয়ার্ড: যদি পশ্চিমাদের সঙ্গে হঠাৎ এই বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়, তবে কিউবান অর্থনীতিতে কী ঘটবে?
গেভারা: কিছুই না।
হাওয়ার্ড: মেজর গেভারা, অনেক বাহ্যিক প্রমাণ ইঙ্গিত দেয় যে, অর্থনীতির মার্ক্সবাদী ব্যবস্থা তেমন কাজ করে না। এটা তার লোকদের প্রাচুর্যপূর্ণ জীবন দিতে ব্যর্থ। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ৪৭ বছর পরেও, সোভিয়েত ইউনিয়ন এখনো তাদের জনগণকে যথাযথ খাদ্য, বাসস্থান ও পোশাক দিতে পারেনি। সত্যিকারের উচ্চস্তরের উৎপাদনশীলতার সূচনা করতে মার্ক্সীয় ব্যবস্থা যথাযথ প্রণোদনা সরবরাহ করছে না, এটির সম্ভাবনা সম্পর্কে আপনি কি মনে করেন?
গেভারা: প্রশ্ন আকারে ঘোষণা দেওয়ার প্রবণতা আছে আপনার। এক্ষেত্রে আবার, প্রথমে আমি আপনার ঘোষণাকে খণ্ডন করব, তারপর প্রশ্নের উত্তর দেব। আপনি বলেছেন, এটা প্রমাণিত যে, মার্ক্সবাদ বা মার্ক্সবাদী ব্যবস্থা জনগণকে তাদের যা প্রয়োজন, তা সরবরাহ করে না এবং ভাল থাকার রসদ যোগায় না। আমি মনে করি, এটা ঠিক উল্টো। আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যান্য দেশের জীবনমানের তুলনা করি, তাহলে আমরা অবশ্যই স্বীকার করব যে, অন্য দেশগুলোর মান খুবই নিম্ন। কিন্তু যখন আপনি আমেরিকান জীবনযাত্রার ধরন এবং মুক্ত বিশ্বের কথা বলবেন, আপনাকে বিবেচনা করতে হবে লাতিন আমেরিকার ২০০ মিলিয়ন লোকের কথা, যারা ক্ষুধায়-রোগে ভুগে মারা যায়, এমনকি তারা যৌবনেও পৌঁছাতে পারে না, শিশুকালেই মারা যায় ক্ষুধায়। কোনো না কোনো উপায়ে শোষিত হওয়ার বিনিময়ে এসব লোকই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অবদান রাখে। একই ঘটনা ঘটে আফ্রিকা ও এশিয়ায়। মার্ক্সবাদ এসবকে উপড়ে ফেলে। একই সময়ে যখন আমরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা অবরুদ্ধ, তখন আমরা আমাদের জনগণকে পছন্দমতো সবকিছু দিতে পারি না। তবে মন্ত্রী থেকে সরকারের সর্বনিম্ন কর্মচারী পর্যন্ত, সমতার ভিত্তিতে, আমরা যা দিতে সক্ষম তা তাদের দিয়েছি। এবং এটাই জণগণের মুক্তির লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ।
হাওয়ার্ড: তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার লাতিন আমেরিকার সমস্যা নিয়ে বেশ সচেতন। এবং বন্ধুত্বের মাধ্যমে এই গোলার্ধের লোকজনের জীবনমান উন্নতি করতে কঠোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এখন যদি শাসকশ্রেণি ভূমি ও কর সংস্কার করতে রাজি হয় এবং জীবনযাত্রার মান উন্নীত হয়, তবে কি কিউবান বিপ্লবের বার্তা কার্যকারিতা হারাবে না?
গেভারা: অবশ্যই, এখনই হারাবে। কিউবান বিপ্লবের বার্তার মধ্যেই সেই অর্থ নিহিত রয়েছে। কারণ, সাম্রাজ্যবাদ নিজ অবদানের মধ্যে কেবল অল্পবিস্তর সংস্কারই করতে পারে, যা সমস্যার মূলে যেতে পারে না। যদি পুরো লাতিন আমেরিকা সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়, তাহলে সাম্রাজ্যবাদ নিজেই গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি হবে। কাঁচামালের জন্য উৎপাদিত পণ্যের মাধ্যমে অসম বিনিময়, দেশীয় পুঁজিপতি শাসকগোষ্ঠীর মাধ্যমে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করা—যারা সাম্রাজ্যবাদের দোসর, এই হলো লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয় সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের ভিত্তি।
এখন এসব যদি পরিবর্তন করা যেত, সাম্রাজ্যবাদ শক্তি হারিয়ে ফেলত। তখন এটি পুঁজিবাদের সর্বজনীন সংকটের মুখে পড়ত। অন্য অর্থে, নিজের দেশেই তারা সংকটে পতিত হতো, শ্রমিক শ্রেণির পক্ষ থেকে।
যদিও তা আপনার দেশে এত নিকটবর্তী নয়; যেহেতু, শ্রমিকশ্রেণির শোষণ স্থানান্তরিত হয়েছে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ায়। তবে দ্বন্দ্বটা সরাসরি হবে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই। অবশ্যই, কিউবান বিপ্লবের বার্তাটি তার সমস্ত গুরুত্ব হারাবে, তবে এর প্রয়োজনীয়তাও তখন আর থাকবে না। কারণ, লাতিন আমেরিকার আমাদের সব লোকের জন্য আমরা সর্বদা এটাই কামনা করি, এবং একবার তা অর্জন করা গেলে বার্তা দেওয়ার আর প্রয়োজন হবে না। এটা অর্থহীন হয়ে পড়বে।
হাওয়ার্ড: তাহলে আমাদের আকাঙ্ক্ষা এসব সংস্কার, আমরা একমত?
গেভারা: সত্যিকারের সংস্কার। ক্ষমতায় জনগণের প্রবেশাধিকারের জন্য। তারপরই আমরা একমত।
হাওয়ার্ড: মেজর গেভারা, আপনি কি মনে করেন, এটা বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হতে পারে না বা এটা অবশ্যই আসে সহিংসতা ও বৈপ্লবিক উত্থানের মাধ্যমে?
গেভারা: তা অবশ্য নির্ভর করে প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণির ওপর। তারাই ক্ষমতা ছাড়তে, ক্ষমতার লাগাম হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। সকলের ইচ্ছের বাইরে যেখানে প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণি জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখে। স্ফুলিঙ্গ একদিন ছড়িয়ে পড়বে এবং তা পুরো লাতিন আমেরিকায় আগুন ধরিয়ে দিতে পারে। আর ক্ষমতায় আসীন হবে জনগণ।
হাওয়ার্ড: মেজর গেভারা, বিপ্লবের সাফল্যের পর থেকে, সব রিপোর্ট অনুসারে, কিউবার অর্থনীতি প্রতিটি সেক্টরে মারাত্মকভাবে ধসে পড়েছে। শিল্পোৎপাদন, সবজি ফসল, চিনি ফলন গত বছর সর্বনিম্নে পৌঁছে হয়েছিল সাড়ে তিন মিলিয়ন টন। এই অর্থনৈতিক পশ্চাদগতিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
গেভারা: আচ্ছা, আবারও প্রশ্ন আকারে বিবৃতি পাওয়া গেল। সুতরাং প্রথমে যে কাজটি করতে হবে, তা হলো বিবৃতিটি খণ্ডন করা এবং তারপর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। আপনি বলেছেন, বিপ্লবের সময় সমস্ত দিক থেকে কিউবান অর্থনীতির অবনতি হয়েছে, এবং আমি বলছি আপনি ভুল জানেন। ১৯৫৯ থেকে শিল্পোৎপাদন বেড়েছে এবং এটা আরও বেশি বাড়তে পারত যদি না চিনিশিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ত, প্রকৃতপক্ষে যা হ্রাস পেয়েছে। শিল্পোৎপাদন বার্ষিক ৭ শতাংশ হারে বেড়েছে, অবশ্য চিনি হিসাবে নেই। ১৯৬৩ সালের প্রবৃদ্ধি এবং ১৯৬৪ সালের বরাদ্দ আরও বেশি হারে হবে। ১৯৬৩-তে এর পরিমাণ ছিল ১০ শতাংশ এবং ১৯৬৪ সালের বরাদ্দ আরও বেশি হবে। চিনির উৎপাদনও বাড়বে।
হাওয়ার্ড: মেজর গেভারা, যখন আপনি সিয়েরা মায়েস্ত্রার পাহাড়ে যুদ্ধ করছিলেন, তখন কি আগে থেকে জানতেন, এই বিপ্লব এতটা চরমপন্থায় মোড় নেবে?
গেভারা: স্বজ্ঞাতভাবে, মনে করেছিলাম। অবশ্যই, বিপ্লবের গতিপথ কি হবে এবং অতি সহিংস অবস্থার পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। কিংবা বিপ্লবের মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী ফর্মুলেশনেরও পূর্বাভাস ছিল না। এর ফল কী ছিল, তা ভালো করেই জানা। সমস্যা সমাধানে কমবেশি অস্পষ্ট ধারণা ছিল আমাদের। তবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দেখেছিলাম চোখের সামনে, যারা আমাদের সঙ্গে লড়াই করেছিল, এবং শ্রমিকদের জীবনের সমস্যাও দেখেছিলাম আমরা। আসলে আমাদের ধারণার রূপান্তর প্রক্রিয়ার পুরো বর্ণনা দেওয়া একটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।
হাওয়ার্ড: যুক্তরাষ্ট্রে এক দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, মেজর গেভারা বিপ্লবের সবচেয়ে চরমপন্থী প্রভাবশালীদের একজন এবং তিনি কাস্ত্রোকে বামপন্থার দিকে টেনে নিয়েছিলেন। এখানে যা ঘটেছে, তা আংশিকভাবে তার ব্লু প্রিন্ট। তিনি তা গ্রহণ নাকি বর্জন করেছিলেন?
গেভারা: যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য অনেক দেশে দীর্ঘদিন ধরে আমাকে বিপ্লবের মস্তিষ্ক, ঠাণ্ডা মাথার পরিকল্পনাকারী, বামপন্থী, মসনদের পেছনের লোক হিসেবে বিবেচনা করে সম্মান দেখানো হয়েছে। ঠিক আছে, ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে আমি এসবে বিব্রত হই না। তবে বিপ্লবী হিসেবে আমার প্রতিজ্ঞা, সহজাত বিনয় এবং সততা আমাকে স্বীকার করতে বাধ্য করে যে, কিউবার শীর্ষ বামপন্থী হলেন ফিদেল কাস্ত্রো এবং কিউবায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো ফিদেলের বিপদ, আমি নই।
হাওয়ার্ড: সিয়েরা মায়েস্ত্রার পাহাড়ে, যখন ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, তিনি কমিউনিস্ট নন, তখন আপনি কি বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি কমিউনিস্ট নন এবং তিনি কমিউনিস্ট হবেন না?
গেভারা: আমি জানতাম, তিনি কমিউনিস্ট নন। তবে আমার বিশ্বাস ছিল), আর জানতামও যে, তিনি কমিউনিস্ট হবেন। এক সময় আমিও যেমন জানতাম, আমি কমিউনিস্ট নই। আবার এ-ও জানতাম, অল্প সময়ের মধ্যে আমিৎ একজন কমিউনিস্ট হয়ে যাব। অর্থাৎ বিপ্লবের এই স্বাভাবিক পর্যায় আমাদের সবাইকে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের দিকে নিয়ে যাবে। আমি বলতে পারি না যে, যুক্তরাষ্ট্রের মনোভঙ্গি বিকাশের সতর্ক মূল্যায়ন পরীক্ষার ফলাফল এবং আপনার দেশ ওই সময় বাতিস্তার পক্ষে এবং আমাদের বিপক্ষে কেমন আচরণ করছিল, সে ব্যাপারে স্পষ্ট বা সচেতন জ্ঞান ছিল। তবে একটা অন্তর্দৃষ্টি ছিল।
হাওয়ার্ড: ফিদেল কাস্ত্রোর যদি কিছু ঘটে, তাহলে কিউবান বিপ্লবের কী হবে এবং কে ক্ষমতায় আসবে বলে আপনি মনে করেন?
গেভারা: আপনার প্রশ্ন থেকে আমি অনুমান করছি যে, আপনি তাঁর সঙ্গে ঘটতে যাচ্ছে এমন সহিংস কিছুর ঈঙ্গিত করছেন। হ্যাঁ, এটা যে কিউবার বিপ্লবের জন্য গুরুতর আঘাত হবে, তা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। ফিদেল আমাদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অবিসংবাদিত নেতা। কিউবা যে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল, তার মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের সত্যিকারের পথ প্রদর্শক হয়ে উঠেছেন। একই সময় তিনি বিশ্বনেতা হিসেবে নিজের মর্যাদার প্রমাণ দিয়েছেন। আমি মনে করি না, আমাদের কারও সেই গুণাবলি আছে। তবে আমরা তাঁর পাশে লড়াই করার বছরগুলোতে বিপ্লবী অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। একই মত ও পথের অনুসারী হয়ে শৌর্য, সাহস ও ত্যাগের দীক্ষায় দীক্ষিত হতে পেরেছি। সংকল্পবদ্ধ হয়ে উঠেছি মূলনীতির প্রশ্নে ও সমস্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে। এককথায়, আমরা আসলে তাই হয়ে উঠেছি যা আমাদের হওয়ার কথা ছিল। তাই আমি মনে করি, যদি তাঁর সঙ্গে কিছু ঘটেও, আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারব এবং সেই কঠিন সময় পাড়ি দিতে পারব।
তাঁর স্থলাভিষিক্ত কে হবেন, তা সে সময় আলোচিত হবে। এই মুহুর্তে আমরা এ ধরণের কোন চোগলখোরি আলাপে প্রবৃত্ত হতে চাই না। আমাদের কারোরই তেমন রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নেই। তবে যৌক্তিকভাবে, তাঁর ভাই রাউল—উপপ্রধানমন্ত্রী—আমাদের মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যাক্তি। ভাই বলে নয়, নিজের যোগ্যতার কারণে ও কিউবান বিপ্লবের একই পথ অনুসরণে তাঁর একাগ্রতা বিচারে।
হাওয়ার্ড: মেজর গেভারা, কাস্ত্রো প্রায় কিউবা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইচ্ছে পোষণ করেন। আপনিও কি সম্পর্কের এমন স্বাভাবিকীকরণ চান?
গেভারা: এটা যদি নীতিগত ভিত্তির ওপর হয়, হ্যাঁ। এবং আমি সম্ভবত অন্য কারও চেয়ে তা আরও বেশি করে চাই; কারণ, অবরোধে শিল্পই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবরোধের কারণে উৎপাদন খাত—শিল্প ও পরিবহন—সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর থেকে পরিবহন কমবেশি নিজেকে মুক্ত রাখলেও শিল্প পারেনি। তাই নীতিগতভাবে ও সামগ্রিক সমতার ভিত্তিতে হলে, আমাদের জন্য সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ উত্তম।
হাওয়ার্ড: কিউবা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে কি আপনি আশাবাদী?
গেভারা: আমি মনে করি, উত্তর দেওয়ার পক্ষে এটি কঠিন প্রশ্ন। আমরা দেখছি। আমরা অপেক্ষা করছি। সব ধরণের পথই আমরা খোলা রেখেছি, যে কোন পথই আমরা অনুসরণ করতে পারি। এটা অনেকটাই নির্ভর করছে আমেরিকান সরকারের বৈশিষ্ট্য ও পরিস্থিতির ধারাবাহিকতার ওপর। আমেরিকান সরকার বিশ্বের পরিস্থিতি কীভাবে পরিমাপ করতে সক্ষম, তার ওপরও এটি নির্ভর করে। পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে বিশ্বের অপরাপর শক্তির সাথে কিভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে, সে ব্যাপারে আপনার সরকারের পক্ষ থেকে কোন স্পষ্ট ধারণা এখনো পাওয়া যায়নি। সুতরাং, এমন পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিকরণ বিষয়ে স্পষ্টভাবে কিছু বলার নেই।
হাওয়ার্ড: কিউবার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কী প্রত্যাশা করেন আপনি?
গেভারা: এর যথাযথ উত্তর দেওয়া খুবই কঠিন। উপরন্তু প্রশ্ন হিসেবেও এটা কিছুটা অবাস্তব। সম্ভবত সবচেয়ে অকপট এবং উদ্দেশ্যমূলক উত্তর হবে: কিছুই না। একেবারে কিছুই না। আমাদের পক্ষেও না, বিপক্ষেও না। শুধু আমাদের একা থাকতে দাও।
হাওয়ার্ড: অনেক ধন্যবাদ, মেজর গেভারা।