গ্রামসি রাষ্ট্রচিন্তার পর্যালোচনা
১
আন্তোনিও গ্রামসি [১৮৯১-১৯৩৭] ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী দার্শনিক ব্যক্তিত্ব। যিনি শুধু তত্ত্ব চর্চা করেই ক্ষান্ত হননি, প্রয়োগের রাজনীতিও করেছেন আজীবন। আন্তোনিও গ্রামসিকে বোঝার জন্য তত্ত্ব ও প্রয়োগের এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটা জেনে রাখা দরকার।
লক্ষণীয় যে, গ্রামসি তাঁর জীবদ্দশায় আদতে কোনো বই লিখে যাননি। তাঁর নামে বর্তমানে আমরা যা গ্রন্থাকারে পাই, তা কতগুলো পান্ডুলিপির সমাহার। যেগুলো তিনি লিখেছিলেন কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায়। সেই পাণ্ডুলিপি সমগ্রই এখন গ্রন্থাকারে পাওয়া যায় ‘দ্য প্রিজন নোটবুকস’ বা ‘কারাগারের নোটবই’ নামে।
উল্লেখ্য, ১৮৯১ সালের ২২ জানুয়ারি তৎকালীন ইতালির দক্ষিণে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপাঞ্চল সার্দিনিয়া অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করা আন্তোনিও গ্রামসি বেঁচে ছিলেন মাত্র ৪৬ বছর। যার চার ভাগের এক ভাগ সময় কেটেছে কারাবন্দি অবস্থায়। সর্বশেষ ১৯২৬-৩৭ কালপর্বে তিনি বন্দি ছিলেন ইতালির তৎকালীন ফ্যাসিস্ট শাসক বেনিতো মুসোলিনির কারাগারে।
২
গ্রামসি পাঠের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার, তিনি লিখছেন কারাগারে বন্দি অবস্থায়। বন্দিশালার সেন্সরশিপ এড়িয়ে তাঁকে লিখতে হয়েছিল। যে কারণে তাঁর লেখার কোথাও মার্কস, লেনিন কিংবা অন্যান্য বিপ্লবী দার্শনিকের নামের সরাসরি উল্লেখ নেই। এমনকি মার্কসবাদ [Marxism] কিংবা কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি পরিভাষাও কোথাও পাওয়া যাবে না। গ্রামসি মার্কসবাদ বোঝাতে কারাগারের নোটবই-এ লিখছেন ‘অনুশীলন বা প্রয়োগের দর্শন’ [Philosophy of Praxis]। আর মার্কসকে অভিহিত করেছেন অনুশীলনের দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে।
আন্তোনিও গ্রামসির চিন্তা ও কর্ম কতটা ভয়ংকর ছিল যে তাঁকে কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছিল? কিংবা কারাগারের নোটবইয়ে কী এমন লিখেছিলেন, যার জন্য সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট বিচারালয়ে গ্রামসি সম্পর্কে বিচারক যে মন্তব্যটি করেছিলেন সেটির মধ্যে। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘এই মস্তিষ্কটি অন্তত আগামী ২০ বছরের জন্য নিষ্ক্রিয় করে রাখা দরকার [We must stop this brain working for the next 20 years]।
কিন্তু জীবন যেখানে দ্রোহের প্রতিশব্দ হয়ে ওঠে, মৃত্যুই সেখানে যে শেষ কথা নয়—এটি হয়তো মুসোলিনি ও তার লোকদের পক্ষে ভাবা সম্ভব হয়নি। আর সে কারণেই গ্রামসি মৃত্যুর পরেও আজও বেঁচে আছেন তাঁর চিন্তা ও কর্মের মধ্য দিয়ে।
৩
গ্রামসির চিন্তাকে বোঝার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। প্রথমত, রাষ্ট্র; দ্বিতীয়ত, বিপ্লব; ও তৃতীয়ত, পার্টি। এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই গ্রামসি তাঁর চিন্তাকে প্রকল্প আকারে হাজির করেছেন।
একই সাথে গ্রামসির কাজের পটভূমি হিসেবে তৎকালীন ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনির ক্ষমতা দখল ও ফ্যাসিস্ট শাসনের প্রতিষ্ঠা, রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব এবং রিসর্জিমেনতো [Risorgimento] তথা ইতালির পুনর্জাগরণ আন্দোলনকে বিবেচনায় নিতে হবে।
গ্রামসির চিন্তাপদ্ধতি ছিল দ্বান্দ্বিক [Dialectical]। যে কারণে তিনি রাষ্ট্রকে দ্বান্দ্বিকভাবে দেখতে চেয়েছেন। তাঁর কাছে রাষ্ট্র হলো সম্মতি ও বলপ্রয়োগের সংশ্লেষ। রাষ্ট্র মানেই শুধু বলপ্রয়োগ [Force], সহিংসতা [Violence], দমন-পীড়ন [Coercion] ইত্যাদি নয়; রাষ্ট্র একই সাথে সম্মতিও [Consent] উৎপাদন করে। অর্থাৎ গ্রামসির রাষ্ট্র শাসক শ্রেণির কাছে জনগণের সম্মতি আদায়ের ভাবাদর্শিক ও নৈতিক হাতিয়ারও বটে।
এই সম্মতি আদায়ের ব্যাপারটা খোলাসা করতে গিয়ে গ্রামসি তাঁর ‘হেজিমনি [Hegemony]’ ধারণাটির অবতারণা করেন। ‘হেজিমনি’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘আধিপত্য’, ‘নেতৃত্ব’ প্রভৃতি [হতে পারে]। তবে ‘হেজিমনি’ বোঝার ক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দ ‘ডমিনেশন [Domination]’ অর্থাৎ ‘কর্তৃত্ব’ এর সাথে এর পার্থক্য বোঝাটা জরুরি। কেননা, গ্রামসি এই দুটোকে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। গ্রামসি মনে করেন, হেজিমনি ও ডমিনেশনের সম্মিলিত রূপ হচ্ছে রাষ্ট্র।
৪
‘হেজিমনি’ মানে কী, এটি কীভাবে কাজ করে? এটি ব্যাখ্যা করার জন্য গ্রামসি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জনসমাজ বা নাগরিক সমাজ [Civil Society] ও রাজনৈতিক সমাজ [Political Society] দুটি পরিসর চিহ্নিত করেন। সরকার, আদালত, পুলিশ, মিলিটারি, বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক সমাজের [Political Society] অন্তর্ভুক্ত, যা সাধারণত দমনমূলক [Coercive]।
অপরদিকে জনসমাজ [Civil Society] বলতে গ্রামসি অ-রাষ্ট্রীয় ও আপাত-অর্থে স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনসমূহকে নির্দেশ করেছেন। যেমন শিক্ষাব্যবস্থা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, পত্র-পত্রিকা, মিডিয়া ও আজকের বাস্তবতায় বিভিন্ন এনজিও এই পরিসরের অন্তর্ভুক্ত।
‘হেজিমনি’ কাজ করে জনসমাজের পরিসরে। জনসমাজে বিদ্যমান পুঁজিবাদী কাঠামোতে শাসকশ্রেণি তার ‘হেজিমনি’ প্রতিষ্ঠা করে দ্বিবিধ প্রক্রিয়ায়। প্রথমত, এই পরিসরেই শাসকশ্রেণি নিজস্ব মূল্যবোধ, আদেশ, অনুশাসন ও ভাবাদর্শ তৈরি করে। দ্বিতীয়ত, এগুলোকে বৈধতা দেওয়ার কাজেও এই পরিসরকে তারা কাজে লাগায়।
গ্রামসি এখানে এসে পরিষ্কারভাবে বলবেন যে, ‘হেজিমনি’ প্রতিষ্ঠাই হলো রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান নৈতিক কার্যাবলি [Moral Function of the State]। কেননা, এটি হলো আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বলয়। সুতরাং এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে প্রথমত এই প্রতিরক্ষা বলয়কে পরাস্ত করতে হবে। অর্থাৎ, শাসকশ্রেণির প্রতিষ্ঠিত হেজিমনির বিরুদ্ধে পাল্টা হেজিমনি [Counter Hegemony] তৈরি করে সেই লড়াইয়ে জিততে হবে। আর তখনই রাষ্ট্রের সাথে সরাসরি সংঘর্ষের পর্যায় উপনীত হবে। রচিত হবে বিপ্লবের ভিত্তিভূমি। একটি বিপ্লবী পার্টি সেই বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়ে শ্রমিকশ্রেণির সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণ করবে।
এভাবেই রাষ্ট্রের প্রশ্নে ‘হেজিমনি’র ধারণার মাধ্যমেই বিপ্লব ও বিপ্লবী পার্টির বিষয়ে গ্রামসি আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন।
আলতাফ পারভেজ গ্রামসি ও তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা নামক বইয়ে আন্তোনিও গ্রামসি ও তাঁর কাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করেছেন। বইয়ের নামের কারণে এটি ভাবলে ভুল হবে যে, শুধু গ্রামসির রাষ্ট্রবিষয়ক ভাবনাই এখানে উপস্থিত; বরং এটিকে প্রাসঙ্গিকভাবেই গ্রামসির সমগ্র কাজের একটা সহজ-সরল সারসংক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে
৫
গ্রামসি ম্যাকিয়াভেলির দ্য প্রিন্স [The Prince] বইয়ের আলোকে পার্টির ধারণাটি বিবৃত করেছেন। তিনি আজকের দিনের বিপ্লবী পার্টির স্বরূপ বোঝাতে গিয়ে ম্যাকিয়াভেলির ‘প্রিন্স’কে অ্যানালজি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। গ্রামসির মতে, আধুনিক যুগে এসে ম্যাকিয়াভেলির কথিত একক ব্যক্তি ‘দ্য প্রিন্স’ দরকার নেই, দরকার ‘মডার্ন প্রিন্স’। আর এই ‘মডার্ন প্রিন্স’-ই হলো গ্রামসির ‘বিপ্লবী পার্টি’ তথা ‘কমিউনিস্ট পার্টি’।
ম্যাকিয়াভেলি যেমন প্রত্যাশা করেছিলেন যে, তাঁর কথিত ‘প্রিন্স’ নবজারণের পটভূমিতে ভগ্নদশার ইতালিকে নেতৃত্ব দেবে। ঠিক তেমনি গ্রামসি মনে করতেন, ‘মডার্ন প্রিন্স’ তথা ‘বিপ্লবী পার্টি’ আজকের দিনে পুঁজিবাদী কাঠামোর রাষ্ট্রকে ভেঙে নতুন দিনের সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের সংগ্রামকে নেতৃত্ব দেবে।
এভাবে ধারাবাহিকভাবে গ্রামসির লেখায় জাত বুদ্ধিজীবী [Organic Intellectuals], প্রথাগত বুদ্ধিজীবী [Traditional Intellectuals], সম্মুখ সমর [War of Maneuver], অবস্থায়ী যুদ্ধ [War of Position], নীরব বিপ্লব [Passive Revolution], নিম্নবর্গ [Sub-altern] প্রভৃতি ধারণার প্রাসঙ্গিক উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি।
৬
আলতাফ পারভেজ গ্রামসি ও তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা নামক বইয়ে আন্তোনিও গ্রামসি ও তাঁর কাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করেছেন। বইয়ের নামের কারণে এটি ভাবলে ভুল হবে যে, শুধু গ্রামসির রাষ্ট্রবিষয়ক ভাবনাই এখানে উপস্থিত; বরং এটিকে প্রাসঙ্গিকভাবেই গ্রামসির সমগ্র কাজের একটা সহজ-সরল সারসংক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
আলতাফ পারভেজ যথাসাধ্য সহজবোধ্য ও সংক্ষিপ্ত আকারে গ্রামসির জীবন ও কর্মের উল্লেখযোগ্য দিকসমূহ বইয়ে সন্নিবেশ করেছেন। এ কারণে বইয়ের শুরুতেই গ্রামসির জীবন ও তাঁর সমসাময়িক ইতালি সম্পর্কে দুটি পৃথক অধ্যায় সন্নিবেশিত হয়েছে। আর কৈফিয়ত হিসেবে বলেছেন, এই পটভূমি ছাড়া গ্রামসিকে বোঝা দুরূহ। আলোচ্য বইয়ে গ্রামসির দর্শনের মূল বিষয়গুলোর একটা পরিভাষা পরিচিতি যুক্ত করেছেন লেখক, যেখান থেকে পাঠক সহজেই গ্রামসির কাজের একটা সাধারণ পরিচয় পেয়ে যেতে পারেন। পরবর্তীকালে লেখক মূলত আলোচনা করেছেন গ্রামসির বহুল আলোচিত হেজিমনি তত্ত্ব নিয়ে।
আলতাফ পারভেজ লেখক গ্রামসির চিন্তার তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। গ্রামসির চিন্তায় যাঁরা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন—যেমন ম্যাকিয়াভেলি, ক্রোচে, সোরেল, ল্যাব্রিওলা প্রমুখ চিন্তাবিদের সাথে গ্রামসির তুলনামূলক একটা আলোচনা করেছেন।
শেষের দিকে আমরা দেখব, লুই আলথুসারের সাথে গ্রামসির একটা তুলনামূলক বিচার। লেনিন, প্লেখানভ, ট্রটস্কি প্রমুখ সোভিয়েত বিপ্লবী ও দার্শনিকেরাও কীভাবে গ্রামসিকে প্রভাবিত করেছেন, সেটির উল্লেখ পাওয়া যায় এই বইয়ে। সর্বোপরি বিভিন্ন দার্শনিক ভাবনার ওপর দাঁড়িয়ে গ্রামসি মার্কসীয় চিন্তা-ঐতিহ্যে যে নতুন ও ভিন্নধর্মী এক ধারণা-কাঠামো নির্মাণ করেছিলেন, সেটির একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক।
৭
উল্লেখ্য, গ্রামসি এমন একজন দার্শনিক, যাঁর চিন্তা-দর্শন নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। তাঁর চিন্তার একই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে। বইটি পড়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়ে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন রয়েছে, যে বিষয়ে লেখকও পাঠককে সতর্ক করে দিয়েছেন।
আন্তোনিও গ্রামসি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নেওয়ার জন্য বইটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলা ভাষাভাষী পাঠক যাঁরা গ্রামসির কাজ সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জানতে আগ্রহী, তাঁদের জন্যও এই বই প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা যায়।