নির্বাসনের ভাষা: কারাইম, লাদিনো আর ইদ্দিশ
বহু শতাব্দী ধ’রে—সেই ক্ল্যাসিক্যাল যুগের শেষভাগ থেকে মধ্যযুগের গোড়ার দিক অব্দি—ইউরোপীয় ইহুদিরা খ্রিস্টান অথবা মুসলিম সংখ্যাগুরুদের মধ্যে যাদের সঙ্গেই থেকেছে, তাদের ভাষাতেই কথা বলেছে। অবশ্য একথার মানে এই না যে, তারা এসব ভাষা একবারে ঠিক অ-ইহুদিদের মতো ক’রেই ব্যবহার করেছে। প্রথমত, এই সংখ্যাগুরু খ্রিস্টান ও মুসলিমদের ভাষায় ইহুদি ধর্মবিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধ্যান-ধারণা ও টুকিটাকি নানান ব্যাপার-স্যাপার বর্ণনা করার মতো বিশেষায়িত শব্দমালার অভাব। তাই, তাদের জবান যা-ই হোক, ইহুদিরা তোরাহ আর তালমুদের ভাষা হিব্রু ও আরামায়িক থেকে এসব শব্দ ধার করেছে। ইহুদি আর অ-ইহুদি বুলির মধ্যে ফারাকটা আরও বেড়েছে এই কারণে যে, যেসব স্থানে সেমিটীয়-বিরুদ্ধ মনোভাব বিদ্যমান ছিল সেখানে ইহুদি সম্প্রদায় অপেক্ষাকৃত বিচ্ছিন্ন দশায় বাস করেছে। আর তার ফলে ইউরোপের বেশ কিছু অঞ্চলে ইহুদিরা তাদের নিজস্ব ভাষাতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যের জন্ম দিয়েছে, যেমন, জুডীয়-ইতালীয়, জুডীয়-কাতালান, শুয়াডিট [জুডিয়-প্রোভেসাঁল] বা ইয়েভানিক [জুডীয়-গ্রিক]।
দেশান্তর অথবা অভিবাসন, আত্তীকরণ, অথবা গণহত্যার কারণে এসব দেশি ইহুদি ভাষার অনেকগুলোই পরের শতকগুলোতে হারিয়ে গেছে। তবে, সেসব ভাষার মধ্যে তিনটি অপেক্ষাকৃত বেশি সুদৃঢ় ভাষাতাত্ত্বিক স্থানে পৌঁছুতে পেরেছে, যদিও দেশান্তর, আত্তীকরণ এবং হেনস্তা-হয়রানি আর নিধনজনিত যন্ত্রণাভোগ তাদের ইতিহাসেরও অংশ বটে। তো, এই তিনটি ভাষা হচ্ছে: কারাইম, লাদিনো আর ইদ্দিশ।
কারাইমের ইতিহাস প্রায় সোয়া ছয় শ বছরের পুরোনো। সেই ১৩৯০-এর দশকে যখন লিথুয়ানিয়ার গ্র্যান্ড ডিউক, প্রবল প্রতাপশালী ভিতাউতাস ৩০০ থেকে ৪০০ ইহুদি পরিবারের একটি দলকে নব্য বিজিত ক্রিমিয়া থেকে লিথুয়ানিয়ার মূল ভূখণ্ডে এনে পুনর্বাসিত করেছিলেন। এই পরিবারগুলো কারাইম নামের একটি জাতিগত দলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের ভাষা ছিল তুর্কীক পরিবারের অন্তর্গত, এবং ক্রিমীয় তাতারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। তাদের পুনর্বাসন তাদেরকেসহ কারাইমভাষীদের কাছ থেকে আলাদা ক’রে ফেলে। তবে স্থানীয় ইহুদি জনগণের সঙ্গে পুরোপুরি আত্তীকৃত না হয়ে গিয়ে কারাইমরা তাদের নিজস্ব এবং অত্যন্ত ভিন্ন ভাষাটির ব্যবহার অব্যাহত রাখে। এই গত বিংশ শতাব্দীতেও সেটি যথেষ্ট জীবন্ত ছিল। হলোকাস্ট ও স্ট্যালিনীয় আতঙ্কের পরেও লিথুয়ানীয় শহর ত্রাকইয়ে ভাষাটি একটি শক্ত ঘাঁটি আছে। সেখানে বেশ কয়েক ডজন মানুষ এখনো ভাষাটি ব্যবহার করে। জানা গেছে, ইউক্রেনের উত্তর-পশ্চিমে ক্রিমিয়া এবং গ্যালিসিয়ায় এখনো অল্প কিছু লোক কারাইম ভাষা ব্যবহার করে।
কারাইম ভাষা ব্যবহারকারীদের সংখ্যা একশো না হলেও, লাদিনোভাষী রয়েছে লাখখানেক। আর সারা বিশ্বে ইদ্দিশভাষীর সংখ্যা ১৫ থেকে ৩০ লাখ, যাদের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েলে বাস করে। সংখ্যাটা বেশ উল্লেখযোগ্য মনে হতে পারে, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে ইদ্দিশ ভাষা ব্যবহৃত হয় এবং স্বাভাবিকভাবে পিতামাতাদের কাছ থেকে সন্তানেরা স্বতঃসিদ্ধভাবে ভাষাটি পাচ্ছে এমন সম্প্রদায় বেশ বিরল। ইউরোপে সবচেয়ে বড় ইদ্দিশভাষী সম্প্রদায় রয়েছে লন্ডন আর অ্যান্টওয়ার্পে। বেশির ভাগ ইদ্দিশভাষী-ই হয় বৃদ্ধ; অথবা সেটা তাদের ২য় ভাষা।
লাদিনো ভাষার গল্পের শুরু কারাইম পুনর্বাসনের এক শতক পর। ইউরোপের অন্য ধারে। স্পেনের তথাকথিত ক্যাথলিক নৃপতিদ্বয় রানি প্রথম এলিজাবেথ আর রাজা দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ ১৪৯২ সালে স্পেন থেকে সেই সব ইহুদিকে নির্বাসিত করেন, যাঁরা খ্রিস্টান হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এমন নয় যে স্পেনের এই ঘটনা ইতিহাসে অনন্য: তারও দু শতক আগে, রাজা প্রথম এডওয়ার্ড বেশ কয়েক শ ইংরেজ ইহুদিকে কতল করার পর বাকি ২০০০ জনকে নির্বাসিত করেন; আর ১৩৯৬ সালে ফ্রান্স থেকে এক লাখের মতো ইহুদিকে বিতাড়িত করা হয়।
ফারাকটা সংখ্যায়: ঐতিহাসিকেরা একটা আনুমানিক হিসাব কষে দেখেছেন যে, প্রায় আড়াই লাখ ইহুদি স্পেন ত্যাগ ক’রে গোটা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে নতুন ক’রে বসতি গেড়েছে। বেশ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইহুদি অটোমান সাম্রাজ্যে চ’লে গিয়েছিল, যা ছিল সে সময় একটি উদীয়মান পরাশক্তি। সেখানে তাদেরকে সাদরে বরণ করে নেওয়া হয়। সত্যি বলতে কি, মুসলিম শাসকেরা ইহুদিদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করলেও, খ্রিস্টীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা বা পলিটির চেয়ে তা মোটের ওপর বেশি ন্যায়সঙ্গত ছিল।
হিস্পানি ইহুদিরা নিজেদের সঙ্গে যে-ভাষাটি বহন ক’রে নিয়ে এল, সেটা গোড়ার দিকে খ্রিস্টীয় হিস্পানি ভাষার উল্লেখযোগ্যভাবে কাছাকাছি ছিল। কিন্তু পরের শতকগুলোতে এই দুটো রূপভেদ বেশ আলাদাভাবে বিকশিত হয়। লাদিনো—যা কিনা জুডিও-হিস্পানির অপর নাম—এখনো পঞ্চদশ শতাব্দীর বহু বৈশিষ্ট্য ধারণ ক’রে আছে, যদিও আধুনিক হিস্পানি সেসব হারিয়ে ফেলেছে। এই যেমন, সেখানে b আর v ধ্বনি আলাদা; এবং ভাষাটি I am ও you are এর জন্য soy ও eres-এর বদলে so আর sos ব্যবহার করে। অন্যদিকে আবার, জুডীয়-হিস্পানি নিজেই সেটার নতুন ভাষাতাত্ত্বিক প্রতিবেশীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, যেমন টার্কিশ আর সার্বো-ক্রেয়েশিয়ান, বিশেষ ক’রে শব্দভাণ্ডারের দিক থেকে। তবে, গত পাঁচশ বছর ধ’রে আশ্চর্যজনকভাবে, স্প্যানিয়ার্ডরা এখনো মোটামুটি স্বচ্ছন্দেই জুডীয়-হিস্পানি বুঝতে পারে। এমন নয় যে, মাদ্রিদের রাস্তায় রাস্তায় তারা লাদিনো শুনতে পায়; কারণ, বেশির ভাগ লাদিনোভাষীর বাস ইস্তাম্বুল বা ইসরায়েলে।
লক্ষণীয়ভাবে ভিন্ন এক ভাষার অধিকারী তৃতীয় দলের ইহুদিরা মধ্যযুগে সাদামাটাভাবে বেড়ে উঠলেও একসময়ে তারা জগতের অন্য যেকোনো কালের এবং স্থানের ইহুদি জনগোষ্ঠীর চেয়ে বড় হয়ে ওঠে। নিজেদেরকে তারা আশকেনাযিম ব’লে পরিচয় দেন, আর তাদের সেই ভাষাটির নাম ইদ্দিশ—শব্দটা এসেছে জর্মন Jüdisch থেকে অর্থাৎ Jewish থেকে। ইদ্দিশ উদ্ভূত হয়েছিল ১২৫০ সালের খানিকটা আগে [এর চাইতে সঠিক তারিখ নির্ণয় করা অসম্ভব], সেই সব ইহুদির মধ্যে যারা সম্ভবত ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চল এবং ইতালি থেকে জর্মন দেশে গিয়েছিল। তারা জর্মন অ্যাডপ্ট করেছিল, তবে অল্প কিছু রোমান-শব্দও তারা রেখে দিয়েছিল, সঙ্গে কিছু হিব্রু আর আরামাইক উপাদান। পরের শতকগুলোতে, আশকেনাযি ইহুদিদের আবাসস্থলের মূল অংশে যারা বাস করত, তারা জার্মানি থেকে পোল্যান্ডে চলে যায়। কারণ, জার্মানিতে নিপীড়ন-নির্যাতন আর হত্যা-নিধনের তীব্রতা ছিল প্রচণ্ড, আর পোল্যান্ড তখন খ্রিস্টীয় জগতে সহনশীলতার শরণস্থল। [অল্পসংখ্যক অভিবাসী হয়েছিল এমন আরেকটি স্থান হচ্ছে ডাচ রিপাবলিক]। পরে লিথুয়ানিয়া, বেলারুশ, আর ইউক্রেন ও রাশিয়ার খানিকটা অংশসহ পূর্ব ইউরোপ এই মূল এলাকার অন্তর্ভুক্ত হয়।
তার ফলে, কারাইম ও লাদিনোর মতো ইদ্দিশ এবার সেই সব সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষার মধ্যে ব্যবহৃত হতে থাকল যেগুলো সে-ভাষা থেকে যথেষ্টই আলাদা, যেটা থেকে সেগুলোর উদ্ভব হয়েছিল। ইদ্দিশ তার প্রাচীনা মাতার কাছ থেকে দূরে সরে গেল, পদ্ধতিগতভাবেই অনেক ধ্বনি বদলে গেল, জর্মন ব্যাকরণের কিছু কিছু জটিলতা সহজ হয়ে এল, পোলিশ ও অন্যান্য স্লাভিক ভাষা থেকে বেশ কিছু শব্দ গ্রহণ করা হলো। ইদ্দিশ ভাষা সমৃদ্ধি লাভ করল। কিছু কিছু এলাকায় ইদ্দিশভাষীর সংখ্যা এত বেড়ে গেল যে অ-ইহুদি বহুসংখ্যক ভাষা সেটা থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শব্দ, শব্দবন্ধ কর্জ করল। অবশ্য সেসবের বেশির ভাগই স্ল্যাং। পরে, মার্কিন ইংরেজি-ও তাই করল। এই যেমন, মার্কিন ইংরেজি chutzpah [চরম আত্মবিশ্বাস] এসেছে জর্মন chuzpe, তার আগের পোলিশ hucpa, তার আগের চেক chucpe এবং তারও আগের ওলন্দাজ gotspe হয়ে।
ইদানীং ইউরোপীয় ইহুদিরা আবারও অ-ইহুদি সংখাগরিষ্ঠদের মধ্যে বাস করছে এবং তাদের ভাষায় কথা বলছে। কারাইম লাদিনো আর ইদ্দিশ, এই তিন ভাষাই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। অবশ্যই, নাৎসিদের গণহত্যা এই অবক্ষয়ের জন্য দায়ী। কিন্তু এটাই ঘটনাটির পুরো ব্যাখ্যা নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আত্তীকরণের ফলে জার্মানি আর নেদারল্যান্ডসে ইদ্দিশের ব্যবহার ধীরে ধীরে ক’মে আসতে থাকে। ইদ্দিশ ও সংখ্যালঘু ভাষাগুলোর প্রতি গোড়ার দিকে সোভিয়েত কমিউনিজমের সমর্থন থাকলেও বিংশ শতাব্দীর তিন-এর দশকে তারা সেগুলোর রুশীকরণ শুরু করে। ইসরায়েলে ইদ্দিশের বদলে নবজীবন সঞ্চারিত ভাষা হিব্রুকে জাতীয় ভাষা করা হয়। যেসব ইহুদি থার্ড রাইখের হাত থেকে পালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং অন্যত্র চলে গিয়েছিল। তারা এক প্রজন্মের মধ্যে আত্তীকৃত হয়ে গিয়েছিল।
কারাইম ভাষা ব্যবহারকারীদের সংখ্যা একশো না হলেও, লাদিনোভাষী রয়েছে লাখখানেক। আর সারা বিশ্বে ইদ্দিশভাষীর সংখ্যা ১৫ থেকে ৩০ লাখ, যাদের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েলে বাস করে। সংখ্যাটা বেশ উল্লেখযোগ্য মনে হতে পারে, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে ইদ্দিশ ভাষা ব্যবহৃত হয় এবং স্বাভাবিকভাবে পিতামাতাদের কাছ থেকে সন্তানেরা স্বতঃসিদ্ধভাবে ভাষাটি পাচ্ছে এমন সম্প্রদায় বেশ বিরল। ইউরোপে সবচেয়ে বড় ইদ্দিশভাষী সম্প্রদায় রয়েছে লন্ডন আর অ্যান্টওয়ার্পে। বেশির ভাগ ইদ্দিশভাষী-ই হয় বৃদ্ধ; অথবা সেটা তাদের ২য় ভাষা। এই বৃদ্ধ দেশি ইদ্দিশভাষীরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে ভাষাটির ভবিষ্যৎ এ-বিষয়টির ওপর নির্ভর করবে যে লোকে সেটা শিখতে আগ্রহী কি না।
পাদটিকা
১. লাদিনো আর কারাইম ভাষার কোনো চিহ্ন ইংরেজিতে না থাকলেও, ইদ্দিশ থেকে নেওয়া স্ল্যাং সেখানে কম নেই কিন্তু। যেমন tush [নিতম্ব], schmooze [গাল-গল্প করা], klutz [অমার্জিত মানুষ], এবং আরও বেশ কিছু। আর একটা বিরল ব্যতিক্রম হিসেবে, ইংরেজিতে একটা ইদ্দিশ উপসর্গও আছে: shm, shmolitics...
২. সেরা ইদ্দিশ শব্দগুলো মার্কিন ইংরেজিতে এরই মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
[ইদ্দিশ ভাষার দুই জগৎখ্যাত লেখক হলেন শলোম আলেকম (যার অর্থ আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক) আর আইজ্যাক ব্যাশিভিস সিঙ্গার]
অনুবাদ: জি এইচ হাবীব