আহমদ কবির: নাটকের শেষ দৃশ্য
রসনা-যন্ত্রের তার যত দিন বহে
ভাবের সঙ্গীত-ধ্বনি, বাঁচে সে সংসারে।
—মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২০০৪: ১৭৮)
১
মৃত্যু দুঃখের, কিন্তু মোটেও দুর্ঘটনা কবলিত জিনিশ নহে। দুর্ঘটনা কিছু যদি ঘটিয়াই থাকে তো তাহার নাম জন্ম। ‘জন্মিলে মরিতে হবে—অমর কে কোথা রবে’! দুঃখের বোঝার উপর শাকের আঁটি, এ বছরের গোড়ার দিকে—৩রা জানুয়ারি নাগাদ—অধ্যাপক আহমদ কবিরের মৃত্যুবরণ সংবাদটাও আমি যথাসময়ে পাই নাই। করোনা মহামারী আমাদের যে মহান গৃহকারাগারে বন্দী করিয়াছিল তাহাই হয়তো ইহার একমাত্র কারণ নহে। অধ্যাপক মহোদয় তাঁহার যৌবন কোন কলায়, কোন শিল্পে কাটাইয়াছিলেন দেখি নাই; আমার সহিত তাঁহার যাহা কিছু জানাশোনা তাহা নাটকের শেষ দৃশ্যে। গোলমালটা সেখানেই। তিনি যে খুব বেশি চলমান ফোন ধরিতেন আমার অভিজ্ঞতায় তাহার প্রমাণ নাই। ফলে শেষের দিকে তাঁহাকে ফোনে ধরিবার চেষ্টাও কমাইয়া দিয়াছিলাম।
অধ্যাপক আহমদ কবিরকে জড়াইয়া আমার একটিই মাত্র উল্লেখ করিবার যোগ্য স্মৃতি আছে। স্মৃতিটা আহমদ ছফার—বলা উচিত মরণোত্তর আহমদ ছফার—সহিত জড়িত। ২০০১ সালের জুলাই মাসে আহমদ ছফা যখন ইহলোক ত্যাগ করিলেন তখন ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার অনুরোধে তিনি যাহাকে বলে একটি ব্যক্তিগত শোক-নিবন্ধ লিখিয়াছিলেন। সেই নিবন্ধই তাঁহার সহিত আমার নবপরিচয়ের সূত্র। পরে দেখিয়াছিলাম—২০০৩ সালের দিকে—বাংলাপিডিয়া বিশ্বকোষে ‘আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১)’ নামধেয় নিবন্ধটিও—অপভাষায় যাহাকে বলে ভুক্তি—তাঁহার রচনা।
প্রায় দেড় দশকের মাথায় একদিন তাঁহাকে অনুরোধ করিয়াছিলাম, কোন এক বছরের আহমদ ছফা স্মৃতিবক্তৃতাটা যদি তিনি লিখিতেন! তিনি রাজি হইয়াছিলেন পরের বছর। ২০১৭ সালের বক্তৃতাটা তিনি শেষ পর্যন্ত দানও করিয়াছিলেন। তিনি যে দানেশমন্দ লোক সেই সত্য ঐ বক্তৃতায় কান পাতিতে পাতিতে নতুন করিয়া ঠাহরও করিয়াছিলাম। তিনি নামোল্লেখ করিয়াছিলেন অনেক বিশ্বাসী বিদেশি গবেষকের যাঁহারা বাংলা পুথির গবেষণায় নিবেদিত ছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে কানাডায় হিজরতি মহারাষ্ট্র দেশের অন্তর্গত পুনের বিদূষী বেগম আয়েশা ইরানির নামও ছিল। এই বছর বেগম আয়েশার বই—দি মুহম্মদ অবতার—প্রকাশ পাইয়াছে। তাহাতে দেখি অধ্যাপক আহমদ কবিরের নাম কৃষ্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করিতেছে।
অধ্যাপক মহোদয়কে দিয়া ‘আহমদ ছফার মন ও মনন’ বক্তৃতাটি লেখাইবার হাজার চেষ্টা করিয়া আমি মাত্র শতকরা ৬৭ ভাগ সফল হইয়াছিলাম। বক্তৃতার বাকি অংশ তিনি মৌখিকভাবেই নিষ্পন্ন করিয়াছিলেন। পুরো লেখাটা আর শেষ করিবার অবকাশ পান নাই। তাঁহার সুযোগ্যা কন্যা—অধ্যাপক উপমা কবির—সেদিন মাত্র আমাকে জানাইয়াছেন, বক্তৃতাটার শেষ অংশটিও তিনি লিখিয়া থাকিবেন। তিনি খুঁজিয়া দেখিতেছেন। আমি এখনও সেই সমাপ্য শেষাংশটুকু খুঁজিয়া পাইবার আশা ছাড়ি নাই। পাই তো পুরা বক্তৃতাটা কখনো ছাপাইব। এই বক্তৃতার অভাবে আমাদের পত্রিকা—‘অর্থ’—খানিক রক্তশূন্য ‘নিরালোকে দিব্যরথ’ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।
বক্তৃতার যে অংশটুকু তিনি আমার হাতে দিয়াছিলেন আমি নিজের বিশ্ববিদ্যালয় দপ্তরে তাহার বর্ণবিন্যাস করাইয়াছিলাম। এই বর্ণবিন্যাস উপলক্ষে তিনি ধানমন্ডি আবাসিক (অথবা বলিবেন নতুন ব্যবসায়িক) এলাকায় মদীয় কর্মস্থলেও একবার পা রাখিয়াছিলেন। আর আমারও গোটা দুই কি তিনবার তাঁহার ফুলার রোডস্থ অধ্যাপসিক বাসায় মাথা নত করিবার সৌভাগ্য হইয়াছিল। তিনি সত্যকার ‘কুঁড়ের বাদশা’ ছিলেন কিনা জানি না—তবে আমার মনে নিরাশার ছায়াটা শেষ পর্যন্ত না পড়িয়া যায় নাই। আমি অল্পেই নিরাশ হইয়াছিলাম। আমাদের সেই অসমাপ্ত বক্তৃতা লেখা শেষ না করিলেও পরে একদিন ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকার সাহিত্য বিষয়ক পাতায় তিনি—আহমদ ছফার জন্মদিবস উপলক্ষে—মোটের উপর পূর্ণদৈর্ঘ্য একটা লেখাও ছাপাইয়াছিলেন। অসীম দুঃখের মধ্যে, আমার পুরানা প্রার্থনা পূরণ করিবার অবকাশ আর তাঁহার জোটে নাই। ইহাই হইতেছে তাঁহার সহিত আমার বিয়োগ কাহিনী। ইহাই নাটকের শেষ দৃশ্য। বাকি নেপথ্যে—এখন ধূসর। ‘আমি প্রতিশোধ কিংবা মাগফেরাতের কথা তুলিব না; বিস্মৃতিই একমাত্র প্রতিশোধ আর বিশুদ্ধ মাগফেরাত’ । কথাটি ধার করিলাম দক্ষিণ আমেরিকার কবি ও গল্পকার হর্হে লুই বোর্হেসের কেতাব হইতে (বোর্হেস ১৯৯৯: ২৯২-৯৫)।
এই করোনা মহামারী—বাংলা অপভাষায় যাহাকে বলে ‘অতিমারি’—উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি বন্ধ হইবার কিছুদিন আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে যে দুঃস্থ জায়গাটির নাম শিক্ষকদের লাউঞ্জ সেখানে তাঁহার সহিত আমার শেষ দেখা। করোনার জীবাতঙ্কে আমাদের যখন চাচা আপন প্রাণ বাঁচা দশা, সেই কাহিল অবস্থার অব্যবহিত আগেকার শেষ কোন দিবসের শেষ আলোক দেখাতেই তাঁহার আমার দেখাদেখির শেষ।
২
অনেকদিন পরে জানিতে পারিয়াছি, যে গ্রামে তিনি জন্মিয়াছিলেন তাহার নাম ‘মিঠাছড়া’। তাঁহার মুখের কথায়ও সেই মিঠাই বুঝি ছড়াইত। বড় মিষ্টভাষী ছিলেন তিনি। একদিন তাঁহাকে কঠিন এক কাজের ফরমায়েশ দিয়া আহমদ ছফা ঠিকই বলিয়াছিলেন, ‘এটি আপনারই কাজ, আপনি বললে কেউ কিছু মনে করবে না, আপনাকে সবাই ভালোবাসে।’ আমার দুর্ভাগ্য যে অধ্যাপক আহমদ কবিরের সাক্ষাৎ ছাত্র হইতে পারি নাই। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসবিদ্যা যাহা কিছু শিখিয়াছি তাহার খানিক তাঁহার লেখা হইতেও। তাঁহার ছড়ানো ছিটানো লেখার সংগ্রহ একদিন নিশ্চয়ই বাহির হইবে। কবরে সৌধ নির্মাণের স্থলে লেখার ভার—রসনা-যন্ত্রের তার—বহিতে দেওয়া বেহতর। আমাদের দেশের এক কবি গাহিয়াছেন, ‘আমার কবরে কোন চিহ্ন দিয়ো না, কেউ জিয়ারতেও যেও না—গেলে তো দেখবে সেই মাটি আর ঘাস—সে সব তো সব জায়গায় দেখা যায় (নূর ২০১৫: ৮)।’ আহা! কবিও এই বছর দেহ রাখিয়াছেন। কবির নাম ইবনুন নূর। তাঁহার কেতাবের নাম লখ্তে খয়াল।
আমাদের নালিশ ছিল তিনি—অধ্যাপক আহমদ কবির—খুব বেশি লিখিতেন না। কিন্তু বলিতেন বেশ! তিনি কেমনধারা লোক ছিলেন বুঝাইতে হইলে মনে হয় একটি ঘটনার উল্লেখ করিলেই সারিবে। আমরা ছাত্রজীবনেই তাঁহার একটি বইয়ের নাম শুনিয়াছিলাম, রবীন্দ্রকাব্য: উপমা ও প্রতীক। আপন দুহিতাদের একজনের নাম তিনি রাখিয়াছিলেন ‘উপমা’। সেদিন বিদূষী উপমা কবির জানাইলেন, তাঁহার দুহিতার নাম আরো—‘তুলনা’। এই তুলনা নামটিও রাখিয়াছিলেন উপমার বাবা আহমদ কবির। রোমাঞ্চ আর কাহাকে বলে!
আহমদ কবির চট্টগ্রাম কলেজের উপরের শ্রেণীতে পড়িতেছিলেন। সেখান পড়িয়াই তিনি—১৯৬৬ সালে—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হইয়াছিলেন। এক নম্বরের একটা শিহরণ আছে। তাঁহার আগের বছর একই পরীক্ষায় একই জায়গায় দাঁড়াইয়াছিলেন অধ্যাপক মনসুর মুসা—পুরা নাম আবুল মনসুর মুহম্মদ আবু মুসা। তাঁহাদের এক কি দেড় দশক পশ্চাতে এই অকৃতী, অধম আমিও চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র বনিয়াছিলাম, তবে নীচের শ্রেণীযোগে। কলেজ জীবনের একটি মূল্যবান স্মৃতির কথা তিনি তৎপ্রদত্ত আহমদ ছফা স্মৃতিবক্তৃতায় উল্লেখ করিয়াছিলেন। কথাটা এখনও আমার কানে বাজে: ‘উনিশশ পঁয়ষট্টি সনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় আমি ও আমার এক সহপাঠী চট্টগ্রাম বেতারের বেলাল মোহাম্মদের অনুকরণে ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চট্টগ্রাম কলেজ মিলনায়তনে পুথিপাঠ করে প্রশংসা পেয়েছিলাম।’ কথাটা যদিও পুথিপাঠের তবে তাহাতে নিহিত অন্য একটি সত্যও ধরা পড়িয়াছে। আমি সেই কথাটাই পাড়িতেছি। পার্থক্যটা সেখানেই। জিকমুন্ট ফ্রয়েড সাহেবের দৌলতে আজ আমরা সেই জিনিশের নাম রাখিতেছি ‘অজ্ঞান’—‘জ্ঞানের অভাব’ অর্থে নহে, ‘অভাবের জ্ঞান’ অর্থে।
শুদ্ধ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীর ছাত্র আহমদ কবির একা নহেন, আমাদের দেশের প্রথিতযশা অনেক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীও সেদিন—ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারের—সেই কাজটিই সার করিয়াছিলেন। তাঁহাদের লেখা অনেক বইয়ের এক বই—‘রণাঙ্গন থেকে ফিরে’—হয়তো এখনও এদেশের সকল লাইব্রেরী হইতে সরাইয়া ফেলা হয় নাই। বুদ্ধিজীবীদের বিচারবুদ্ধি বরাবরই খাটো ছিল আমাদের এই পর্যুদস্ত দেশে। তাঁহারা ভারত-বিরোধিতাকে হিন্দু-বিরোধিতায় তর্জমা করিয়া দিলেন। আর এই যুদ্ধে পাকিস্তান যে সম্পূর্ণ হাড়ে-মাংশে পর্যুদস্ত হইয়াছিল—এই যুদ্ধই যে ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের পতনের পহিলা অঙ্কটাও শুরুটা করিয়া দিয়াছিল—আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তাহা লুকাইবার চেষ্টা প্রাণপণে করিতেছিলেন। আর বি.এ. (অনার্স) নাপাশ আহমদ ছফা সেদিন কি করিতেছিলেন? শ্রমিক নেতা ও দার্শনিক মহিউদ্দিনের সহিত মিলিয়া তিনি ঢাকা শহরের দেয়ালে দেয়ালে পাক-ভারত যুদ্ধবিরোধী পোস্টার সাঁটিয়া নিজের বিপদগ্রস্ত জীবন আরও বিপন্ন করিতেছিলেন। পার্থক্যটা অনুধাবন করিবার মতো।
পুথিপাঠের গল্পটি বলার পর পরই আহমদ কবির বলিলেন, ‘এসব পুরনো কথা দিয়ে আজি এটা বোঝাতে চাইছি যে আহমদ ছফা, মনসুর মুসা, আবুল কাসেম ফজলুল হক, আমরা সবাই ছোটবেলা থেকে গ্রামীণ পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বড় হয়ে উঠেছি আর লেখাপড়া শিখে শেষ পর্যন্ত ঢাকা শহরের নাগরিক বৃত্তে স্থিত হয়েছি। কিন্তু আমাদের প্রজন্মের প্রায় সকলেরই জীবনের এই রীতি, এই পথযাত্রা।’ আমি সবিনয়ে যোগ করিব, প্রায় সকলেরই—তবে সকল সকলের নহে। আহমদ ছফা এই নিয়মের যম, তাহার ব্যতিক্রম। এই ঢাকা শহরের নাগরিক বৃত্তে আহমদ ছফা শেষ পর্যন্ত স্থিত হইতে পারেন নাই। তিনি হইতে পারেন নাই ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী’। তিনি প্রথম যৌবনে খুব একটা চকচক করিতেন না, শেষে চকচক করিলেও শেষ পর্যন্ত তিনি সোনা হইতে পারেন নাই। তাঁহার আশ্রয় জুটিয়াছে মিরপুরে—তুরাগ নদীর তীরে—এক সাধারণ গোরস্তানে। নিয়তির কি সদয় পরিহাস—অধ্যাপক আহমদ কবিরও শেষ পর্যন্ত ঢাকা শহরে স্থিত হইতে পারিলেন না! জানিতে পারিলাম, তিনিও ফিরিয়া গিয়াছেন জন্মভূমি মিঠাছড়ার শীতল ক্রোড়ে।
৩
আরো একটা বিষয়ে আহমদ ছফার সহিত আহমদ কবিরের উপমা কিংবা তুলনা দেওয়া চলে। সেই বিষয়ের অবতারণা করিয়াই এই শ্রদ্ধাঞ্জলি সমাপ্ত করিতেছি। আহমদ কবির লিখিয়াছেন: ‘বাংলা বিভাগের ছাত্র আবুল কাসেম ফজলুল হক ছিলেন তাঁর সহপাঠী ও নিবিড় বন্ধু। এ কারণে মনসুর মুসা, মোহাম্মদ আবু জাফর, নরেন বিশ্বাস, আমি এবং আরো অনেকে, তাঁর বন্ধু থাকলেও ফজলুল হকের কথাই ছফা বিশেষ করে বলতেন—আমার বন্ধু ফজলু। সভা-সমিতিতে ফজলুল হক যখন বক্তৃতা দিতেন, ছফা আমার পাশে বসে কানে কানে বলতেন, ‘ফজলুর কাণ্ড দেখেছেন! ও তো কথা থামাবে না, বলেই চলবে। অন্যরা কখন বলবে? ইতিহাসের আদি থেকে শুরু করে।’ আমি বললাম, ‘বিরক্ত হলে চলবে না, ফজলুর মনের ভেতরে একটি পূর্ণবৃত্ত আছে—দেশ দুনিয়ার কথা ভাবেন তো!’ ছফা আমাকে একটা গুঁতো দিয়ে পার্শ্ব ছাড়লেন। সহপাঠী ফজলুল হকের জন্য ছফার মনের মধ্যে সবসময় একটি দরদী জায়গা ছিল। ফজলুল হককে তিনি “রাজনীতির লেখা” নামে বইটি উৎসর্গ করেছেন।’
আহমদ ছফার সাহিত্যবুদ্ধি কি তীক্ষ্ণ ও মর্মভেদী ছিল তাহার একটুকরা উদাহরণ দেখাইয়াছেন অধ্যাপক আহমদ কবির। সেই উদাহরণ দিয়াই আমাকে এই অতি ক্ষুদ্রাঞ্জলির ইতি টানিতে হইবে: ‘একবার বাংলা একাডেমিতে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর আয়োজনে লেখক সংঘের সভায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সমক্ষে তাঁর কথাসাহিত্য নিয়ে আমি প্রবন্ধ উপস্থাপন করছিলাম। শওকত ওসমান সভাপতি ছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে মাঝে মাঝে তাঁর নাসিকা গহ্বরের রোমরাজি ছিন্ন করছিলেন। আমার প্রবন্ধের আলোচক ছিলেন দুজন—আনোয়ার পাশা ও আহমদ ছফা। আনোয়ার পাশা গল্প নিয়ে আর আহমদ ছফা উপন্যাস নিয়ে বলেছিলেন। আহমদ ছফার মন্তব্য এখনো আমার মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী পূর্ববঙ্গের নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। এই তুলনাটি আমার খুব মনে ধরেছিল। আমার তখন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর “চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান” এবং নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস “উপনিবেশে”র কথা মনে পড়ল।’
আর এক্ষণে আমার—এই অধস্তন লেখকের—কি কথা মনে পড়িল, জানেন? মনে পড়িল, বাংলা ও অন্যান্য পূর্বাঞ্চলীয় মাতৃভাষায় লেখা হাজার বছর পুরানা গানের একটি পংক্তি: ‘উদক চান্দ জমি সাচ ন মিচ্ছা’—‘পানিতে যে চাঁদ দেখা যায় সে চাঁদ কি সাচ্চা না মিছা?’ (শহীদুল্লাহ ১৯৭৪: ৮১) এই গান বাংলাদেশে ‘চর্যাপদ’ নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। গীতিকারের নাম লুইপা। সৌভাগ্যের মধ্যে, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আজও বাঁচিয়া আছেন। আহমদ ছফা বলিতেন, ‘আগুনের ছবি আর আগুন ঠিক এক জিনিশ নহে। আগুনের ছবির দাহিকাশক্তি নাই।’ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর শেষ পরিণতি প্রমাণ করিতেছে আহমদ ছফা কদাচ মিথ্যা বলেন নাই। এই লেখায় আমি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কথা উচ্চারণ করিতে চাহিব না। সে কথা যত কম বলি ততই প্রগতিশীলদের ক্রোধ কম উপার্জন করিব। তবে মিথ্যা শেষ পর্যন্ত মিথ্যাই থাকিয়া যাইবে।
আরবি ভাষায় আমার দানজ্ঞান শূন্যের চেয়েও অনেক নীচে। সেই অনন্ত নাদান পরিশূন্যের জোরে বলিব, অধ্যাপক আহমদ কবির সার্থকনামা পুরুষ ছিলেন। তাঁহার নামের অর্থ—অল্পদান ভয়ঙ্কর যদিও—বলিব ‘যিনি প্রশংসাকারীদের মধ্যে বড়’। তাঁহার প্রশংসা ছিল অকৃপণ, অবারিত, অসূয়ামুক্ত, উদার, মানবিক এবং প্রীতিময়।
৩০ নবেম্বর ২০২১
দোহাই
১. আহমদ কবির, ‘আহমদ ছফার মন ও মনন,’ অপ্রকাশিত ‘আহমদ ছফা স্মৃতি বক্তৃতা’ (ঢাকা: আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা ও এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা, ২০১৭)।
২. ইবনুন নূর, লখ্তে খয়াল (ঢাকা: সিন্ধু-হিন্দোল, ২০১৫)।
৩. মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ‘অর্থ,’ মধুসূদন রচনাবলী, ক্ষেত্র গুপ্ত সম্পাদিত, পুনর্মুদ্রণ (কলকাতা: সাহিত্য সংসদ, ২০০৪)।
৪. Jorge Luis Borges, ‘Fragments from an Apocryphal Gospel (Fragmentos de un evangelio apόcrifo), Selected Poems, ed. Alexander Coleman (London: Penguin, 1999), pp. 292-295.
৫. Ayesha A. Irani, The Muhammad Avatāra: Salvation History, Translation, and the Making of Bengali Islam (New York: Oxford University Press, 2021).
৬. Muhammad Shahidullah, Buddhist Mystic Songs: Oldest Bengali and other eastern vernaculars, reprinted (Dhaka: Renaissance Printers, 1974).
ঘটনাচক্রে এই লেখাটি দৃষ্টিগোচর না হওয়া পর্যন্ত আমি এতোদিন নিশ্চিত ছিলাম- আহমাদ কবীর স্যার ভালোই আছেন- বহাল তবিয়তেই আছেন। আমি তাঁর সাক্ষাৎ ছাত্র ছিলাম। অনেক অনেক স্মৃতি এখন হানা দিচ্ছে, যা বর্ণনা করার ভাষা এই মুহূর্তে নেই। পুত্রবৎ স্নেহ বলতে যা বোঝায়, স্যারের কাছ থেকে তা পেয়েছি! স্যারের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। আপনাকে ধন্যবাদ এই লেখার মাধ্যমে স্যারকে উপস্থাপন করার জন্য। ভালো থাকবেন।
তুহিন সমদ্দার
ফেব্রুয়ারি ০২, ২০২২ ০১:১৯
অত্যন্ত চমকপ্রদ কিছু তথ্য সমৃদ্ধ ও বিশ্লেষণী লেখা। অত্যন্ত উঁচু মানের লেখা নিঃসন্দেহে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে এই মুহূর্তে সম্ভব না।
সৈয়দ পারভেজ কায়সার
ডিসেম্বর ০১, ২০২১ ১৬:৩৬