হাসান আজিজুল হকের অজানা অধ্যায়

 

নানান কারণে এখন আর চিঠিপত্রের কোনো দরকার নেই বোধ হয়; কিন্তু, একসময় তা ছিল। ভীষণ রকম দরকারিই ছিল চিঠিপত্র। বিশেষ করে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অতি দরকারি বিষয় হিসেবে চিঠিপত্রকে বাতিল করে দেওয়া একেবারেই অ্যাবসার্ড বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে, মানে এই সময়ের আগের সময়ের বিবেচনায়। ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে সবকিছুই যেন খোলনলচে পাল্টে গেছে; তা ঠিকই বটে, বদলে গেছে। কিন্তু কয়েক যুগ আগেও এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। এরও অবশ্য কারণ পূর্বোক্ত বিষয়: সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেটএই দুটো বিষয়ই আমাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতিকে গাড়লের মতো গিলে খেয়েছে। ফলে এখন চিঠিপত্রের আদান-প্রদান একেবারেই নেই বললে চলে। যতটুকু আছে, তা কেবলই প্রশাসনিক প্রয়োজনে। এখন আর চিঠির লাল বাকশোগুলো প্রায় খোলারই দরকার পড়ে না; মরচে ধরে পড়ে আছে ভাঙা কুলোর মতো।

কিন্তু এই ভাঙা কুলোর অবদান বাংলাদেশের জনজীবন, সামাজিক পরিকাঠামোয় যেমন প্রখর অবদান রেখেছে; তেমনি করে শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বিষয়টা নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এখন মোবাইল আর ইন্টারনেটের বদৌলতে এক মিনিটেই যে কাউকে যেকোনো বিষয়ে জানিয়ে দেওয়া সম্ভব যে, কী দরকারে সে ফোন করেছে। যোগাযোগব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি এই বিষয়কে আরও সহজ করে তুলেছে। কিন্তু একসময় তা সম্ভব ছিল না। তখন চিঠিপত্রই ছিল একমাত্র সম্বল। বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনে চিঠিপত্রের একটা বড় ভূমিকা রয়েছেএই কথা উচ্চারণ করলে বোধ হয় বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না। বিশ্বসাহিত্যের বেলায় যেমন বিষয়টা সত্য, তেমনি বাংলা সাহিত্যের বেলায়ও এই সত্য সূর্যের মতো উজ্জ্বল। কারণ, চিঠিপত্রের সাথে কেবল লেখক-সম্পাদকের লেখা আদান-প্রদানের সম্পর্কটাই থাকে না। এ ভিন্ন আরও নানান বিষয় রয়ে যায়।

এই বিষয়ে প্রথমেই বলা যেতে পারে যে, একটা নির্দিষ্ট সাহিত্য-গোষ্ঠীর সাহিত্য-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা সম্ভব হয় চিঠিপত্রের মাধ্যমেই। কারণ, লেখক তাঁর ব্যক্তিজীবনের নানান অভিজ্ঞতাই সাহিত্যে স্পষ্ট করেন। কিন্তু তা প্যারাডক্সের মাধ্যমে; নানান সাহিত্য-টেকনিক ব্যবহারের মাধ্যমে। কিন্তু যেকোনো লেখকের আঁকাড়া জীবন-বাস্তবতা জানতে হলে পড়তে হবে তার আত্মজীবনীতাতেও মাঝে মাঝে মিথ্যে-টিথ্যে দিয়ে ভরে ফেলেন কেউ কেউ। কিন্তু বিষয়টা সম্পূর্ণই ভিন্ন থাকে নির্দিষ্ট লেখকের চিঠিপত্রে। কারণ, ব্যক্তিজীবনে কারও কাছে অর্থ-সাহায্য চেয়ে কেউ যখন চিঠি লেখেন, তখন সে অবশ্যই ভণিতা করেন না। কারণ, ভণিতা অর্থপ্রাপ্তির জন্য প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করে, কোনোভাবেই অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টা সরল করে না। এ বিষয়ে স্মরণ করা যেতে পারে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে। মধুসূদন দত্ত যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে চিঠি লিখেছিলেন, তা তো অবশ্যই মেঘনাদ বধ কাব্যের ভাষা-টেকনিকের বিষয় নিয়ে নয়। তা তো অবশ্যই অর্থ-সাহায্য চেয়ে লেখা যায় এমন ভাষায়। আবার বাংলা ভাষা ও বাংলা ভাষায় লেখাজোখার ব্যাপারেও মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে চিঠি লিখছেন। একান্ত ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের বিষয় নিয়েও কথা হয়েছে মধুসূদনের, আরও কারও কারও সাথে। ধরা যাক এই চিঠিপত্রের [মধুসূদনের] কথা যদি আমরা জানতে না পারতাম, তবে কেবলই সাহিত্য-পাঠের মধ্য দিয়ে মধুসূদনের বিবর্তনের ইতিহাসটা আমাদের বোঝা এতটা সহজ হতো না। এমন লেখকের খোঁজ একটু চোখ লাগিয়ে করলেই আরও পাওয়া যাবে। কিন্তু থাক। কথা তো যথেষ্টই হলো।

ওপরে মধুসূদনকে নিয়ে যে কথাবার্তা বলা হলো, ঠিক একই কথা খাটবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেলায়ও। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের এক বৃহৎ যুগকে ধারণ করেছেন, নানামাত্রিক প্রভাব-প্রতিপত্তিসমেত। তিনি তাঁর কালকে যেমন প্রভাবিত করেছেন, তেমনি করে তাঁর কালের পূর্ব ও পরবর্তী কালকেও প্রভাবিত করেছেন; তাঁর জীবনী পাঠেও এই বিষয়-আশয়ই স্পষ্ট হয়। ফলে রবীন্দ্র-পাঠের ক্ষেত্রে একবাক্যে স্বীকার করে নিতে হবে যে, রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সময়ে নানাজনকে লেখা এবং নানাজন রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিপত্রের গুরুত্বের বিষয়টাকে। বিশেষ করে তাঁর ভ্রমণ ও প্রবন্ধ-সাহিত্যের ভিত্তি গেড়ে আছে তাঁকে দেওয়া ও তাঁর লেখা চিঠিপত্রের মধ্যে। চিঠিপত্রের মাধ্যমেই তিনি যেন তাঁর আধ্যাত্মিক ও অলৌকিক জগৎকে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন রোদ ঝলমলে দিনের মতো করে। এবং তার পরিমাণও নেহাতই কম নয়। হিসাবের খাতায় তা বিস্ময়জাগানিয়া তো বটেই। বর্তমানে রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রের যে ঢাউস সংকলন বের হচ্ছে, তা-ই এর প্রমাণ। মনে রাখা জরুরি যে, রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর পরবর্তী যুগের লেখকদের জন্যও চিঠিপত্র ছিল আবশ্যক বিষয়। তা সত্য লেখার বেলায়, নানান মত-পথ নির্ধারণের বেলায়, এমনকি নানান কাজের বেলায়ও। কিন্তু ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া এসে তা অনেকটাই স্তম্ভিত করেছে বটে, তবে পূর্ব-ইতিহাসকে তো কেউ খারিজ করে দিতে পারবে না সহজে। সেটা সম্ভব নয়।

বিশ্বসাহিত্যের দিকে নজর বোলালেও এই একই সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেখানেও দেখা যায়, চিঠিপত্রের গুরুত্ব কেমন বাজার বসিয়েছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক: ক্রাইটেরিয়ান পত্রিকাগোষ্ঠীকে ঘিরে যে সাহিত্যান্দোলন গড়ে উঠেছিল, তা-ও নানানভাবে চিঠিপত্রের সাথে সম্পৃক্ত। এবং এই গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত নানান বিষয়-আশয় বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়েছে তাঁদের লেখা বিভিন্ন সময়ে লিখিত চিঠিপত্রের মাধ্যমে। ফলে দৈশিক ও বৈদেশিক সাহিত্যের ইতিহাস-আলোচনায় দারুণভাবে গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্র। চিঠিপত্রের ভিতর দিয়েই একটা নির্দিষ্ট সময়ের সাহিত্যান্দোলনকে যেমন ধরা সম্ভব হয়, তেমনি করে নির্দিষ্ট সাহিত্যান্দোলনের সমর্থনে লেখালেখিতে মশগুল লেখককেও ওই নির্দিষ্ট সাহিত্যান্দোলন থেকে নানানভাবে আলাদা করা সম্ভব হয়।

বাংলাদেশে, কথাসাহিত্যের হিসাব-নিকাশটা করতে গেলে, গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের মধ্যে অন্যতম হাসান আজিজুল হক। বাংলা কথাসাহিত্যে দেশভাগ ও স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম বয়ানশিল্পী হিসেবেও বিবেচিত হন হাসান আজিজুল হক। তাঁর লেখালেখি যদিও শুরু হয়েছিল ষাটের দশকের আধুনিক সাহিত্য-আন্দোলনের সাথে সাথে। কিন্তু তা বিবর্তিত হয়ে একটি সমাজ-নিরীক্ষাধর্মী সাহিত্য-প্রবণতায় সিক্ত হয়েছে শেষমেশ। বিশেষ করে সমাজ-সম্পর্কিত নানান লেখাজোখার সাথে তাঁর সম্পর্ক বিশেষভাবে বিবেচিত হয়। দেশভাগ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পারফেক্ট ন্যারেটিভ যাঁরা তৈয়ার করেছেন, তাঁদের মধ্যেও অন্যতম হাসান আজিজুল হক। তাঁর আত্মজা ও একটি করবী গাছের মতো বিখ্যাত গল্প যেমন তিনি রচনা করেছেন, তেমন করে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ওপর রচনা করেছেন ফেরার মতো গুরুত্বপূর্ণ গল্প। আবার ষাটের উত্তপ্ত সময়কে ধারণ করেছে তাঁর আগুনপাখি উপন্যাস। কিন্তু এই সব লেখার তো একটা পটভূমি অবশ্যই আছে। তা আমরা কীভাবে জানতে পারব। জানতে পারব তাঁর আত্মজীবনী পড়ে, কিংবা চিঠিপত্রের মাধ্যমে। তবে বিশেষভাবে চিঠিপত্রের মাধ্যমে। কারণ, আগেই বলা হয়েছে যে, সাহিত্যে এই বিষয়সমূহ থাকে অনেকটা প্যারাডক্সের মধ্যে; কিন্তু চিঠিপত্রে এই বিষয়সমূহ থাকে একেবারেই অকৃত্রিমতায় ভরপুর হয়ে।

আত্মজা ও একটি করবী গাছের মতো গল্পগ্রন্থ লেখার জন্য যে বাস্তব জীবনাভিজ্ঞতার দরকার, তা হাসান আজিজুল হকের ছিল বলেই এই কাজটা তিনি করে উঠতে পেরেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর পিতার লিখিত চিঠিগুলো যেন চোখে আঙুল চালিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, কীভাবে তিনি প্রভাবিত এবং বিমর্ষ হয়েছিলেন দেশভাগের ফলে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়কালে। তাঁর দেশভাগের গল্প-পাঠের পর তাঁকে বাংলা সাহিত্যের মান্টো বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। কারণ, মান্টোও এই রকম দুর্বিষহ জীবন-বাস্তবতা পেরিয়ে এসেছিলেন এবং এরই ফলে লিখতে সমর্থ হয়েছিলেন কালো সীমানার মতো বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ। সেই সূত্র কিন্তু মান্টোর জীবনী-পাঠেই আমরা খুঁজে পাই। আবার টোবাটেক সিং-এর মতো গল্প লেখার জন্য যে বাস্তব জীবনাভিজ্ঞতার দরকার হয়, তা-ও মান্টোর ছিল। এই সমস্ত অভিজ্ঞতাযা মান্টোর ছিলহাসান আজিজুল হকেরও তা ছিল পুরোমাত্রায়, কিন্তু অবস্থানগত দিক থেকে তাঁরা দুজনেই ভিন্ন। এই সূত্রগুলো আসলে তাঁকে লেখা চিঠিগুলোর মধ্যে প্রোথিত রয়েছে। বিশেষ করে তাঁর পিতার লেখা চিঠি এবং বন্ধু শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠি পাঠ করলে বোঝা যায় যে, তিনি কীভাবে নিজ বাসভূমে পরিযায়ী পাখি হতে বাধ্য হয়েছেন। এইটা গল্প লেখার পেছনের গল্প। কিন্তু গল্প ছাপার জন্য কী কী পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে হাসান আজিজুল হকের, তা কিন্তু তাঁর লেখা গল্পের ভেতরে থাকে না, আছে তাঁর চিঠিপত্রের ভেতরে। এই বিষয়ে বহু কথা বাড়াব না। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়েই সব আলাপের মুড়ো মেরে দেব।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে তিনি যে সমস্ত বিষয় নিয়ে লিখেছেন, তা এই আলাপের বেলায় গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সে সময়কার দেশপূর্বমেঘ পত্রিকার বিষয়ে যে চিঠিগুলো লেখা হয়েছে। কারণ, শ্যামলের লেখার গুরুত্বটা এইখানে যে, শ্যামল সাহিত্য-পত্রিকাকে যোগাযোগের [তা অবশ্যই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক] অন্যতম মাধ্যম হিসেবে দেখেছেন। এবং দুই বাংলায় প্রকাশিত সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকাসমূহকে বলেছেন, দুই বাংলার বাঙালি লেখকদের মিলনস্থল। বিষয়টা আদতে তেমনই ছিল। কেউ কেউ এর বিরোধিতা করতে পারেন। কিন্তু বিষয়টা কেবল বিরোধিতা করতে হবে বলে বিরোধিতা করা। সাংস্কৃতিক রাজনীতিটা কেউ কেউ খাটো করে দেখে। এটা ভয়ানক ব্যাপার। রাজনীতিকে রাজনৈতিক ভাবলে সংস্কৃতিকে রাজনীতির গুরু হিসেবে ভেবে দেখা উচিত। কারণ, রাজনীতির চেতনাগত ভিত্তিটা সংস্কৃতির পাটাতনেই নির্মিত হয়। কেউ অস্বীকার করলে তাকে বেশ কিছুদিনের ইতিহাসটা পাঠ করানো উচিত। তাহলে হবে। আজিজুল হকের কাছে শ্যামলের চিঠিগুলো এই প্রক্রিয়ায়ই সম্পাদিত হবে। এবং এই চিন্তায়ই পাঠ করা দরকার। তাহলে হিসাবটা কড়ায়-গণ্ডায় ঠিকঠাক হয়ে উঠবে।

ওপরে দুইটা বিষয় নিয়ে আলাপ করা হলো। এরপরও যাঁরা জিজ্ঞেস করবেন, এই চিঠিগুলো কেন দরকারি? এই প্রশ্ন যে কেউ করতে পারেন। করাটাই স্বাভাবিক। দরকারি এই চিঠিগুলো বাংলাদেশের সাহিত্যের হয়ে ওঠার কালের ইতিহাস জানার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পুরোনো সময়কে আমরা জানতে পারি ইতিহাসের ভেতর দিয়ে। কিন্তু ইতিহাস তো আর আসমান থেকে পড়ে না। ইতিহাসের নির্মাণের জন্য দরকার পড়ে তথ্য-উপাত্তের। সাহিত্যেরও ইতিহাস রয়েছে। সেই ইতিহাস জানার জন্য দরকার পড়বে তথ্য-উপাত্তের। তাই যখন কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ের সাহিত্যের ইতিহাস জানতে হবে, তখন সেই সময় নিয়ে রচিত লেখাজোখার ভেতর দিয়ে। কিন্তু আগেই বলেছি, এই ধরনের লেখাজোখার একটা ফাঁকি আছে। সেই ফাঁকিটা ধরলেই ইতিহাস নির্মাণের বিষয়টা ঢিলে হয়ে যায়। তাই এই ঢিলে ব্যাপারটা শক্ত করার জন্য শক্তপোক্ত প্রমাণ দরকার। হাসান আজিজুল হকের চিঠিগুলো সেই শক্তপোক্ত প্রমাণই সরবরাহ করবে, সাহিত্যের ইতিহাসটা নিখাদ আর পুরা করার জন্য।

হাসান আজিজুল হক © ছবি: চন্দন আনোয়ার

এরপরও অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলা যেত, মানে হাসান আজিজুল হকের সাহিত্য-বিচারের জন্য, তাঁর সাহিত্য করার সময়ের হিসাব-নিকাশের জন্য এই চিঠিগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণসেই বিষয়ে। কিন্তু তাতে মাল কেনার আগে ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়ার মতো অবস্থার তৈয়ার হবে। তবু আমি কয়েকটা বিষয় নিয়ে বলব। বিষয়টা নিসর্গ ও সাহিত্যের ভেতরকার সম্পর্ক বিষয়ে। নিসর্গ নির্মাণ-প্রক্রিয়া হাসান আজিজুল হকের গল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাঝে মাঝে অনেকেই তাঁকে কেবলই রাঢ় বাংলার লেখক হিসেবে বিবেচনা করেন। এ বিষয়টা যে সর্বৈব সত্য নয়, তা তাঁর চিঠিপত্র পাঠের পর স্পষ্ট হয়। কারণ ফেরা গল্পের যে নিসর্গ বা ভূমি-বাস্তবতা তা নির্মাণ করতে গিয়ে তাঁর ব্যবহৃত ভূমি আসলে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চল, তা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাঁর গল্প-পাঠের পর নয়, তাঁর চিঠিপত্র পাঠের পর। বিশেষ করে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় যে চিঠি লিখেছেন, সেই চিঠিতে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে হাসান আজিজুল হকের খুলনার দৌলতপুর কলেজে শিক্ষকতা এবং সেই অঞ্চলের নিসর্গের যে বিষয়-সংকেত তিনি দিয়েছেন, তা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া ঘরগেরস্থি গল্পে যে সময় আর যে পরিস্থিতি উপস্থাপিত হয়েছে, তা-ও খুলনা অঞ্চলের নিসর্গের সাথে যাদের জানাশোনা আছে তাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এই বাস্তবতা রাঢ় বাংলার নয়। তবে রাঢ় বাংলার বাস্তবতা তাঁর গল্পে নেই তা নয়। কিন্তু ঢালাও মন্তব্যের বিপরীতে একটা নতুন যৌক্তিক মন্তব্যের বিষয়টা এই চিঠিপত্রের মাধ্যমে করে ফেলা সম্ভব হবে।

এ তো গেল কেবল নিসর্গের বিষয়টা। এ ছাড়া সাহিত্য হওয়ার জন্য আরও যেসব বিষয়-আশয়ের দরকার হয়, সেই বিষয়সমূহের খোঁজ-যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ হাসান আজিজুল হকের এই চিঠিপত্র। ধরা যাক দেশভাগের কথা। দেশভাগের গল্প নিয়ে যে কেউ হিসাব-নিকাশ করতে গেলে হাসান আজিজুল হককে বিবেচনায় আনবেন। কিন্তু কী কী বাস্তবতার ভেতর দিয়ে হাসান আজিজুল হক এই সময়ে সময় পার করেছেন, সে বিষয়ও ভাবতে হবে; বিশেষ করে সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের সন্ধানের জন্য এই চিঠিপত্র নানান কারণে যে জরুরি, তা আর বলার ফুরসত রাখে না। আবার দেশভাগ ছাড়াও ৪৭-পরবর্তী পূর্ব বাংলায় ঘটে যাওয়া নানান বিষয়-আশয়ও হাসান আজিজুল হকের সাহিত্য-পাঠের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কেবল দেশভাগেই তো সব শেষ হয়ে যায়নি। দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চলের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। এই ঘূর্ণাবর্ত সময় ইতিহাসে যেমন আছে, তেমনি আছে শিল্প-সাহিত্যে। কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের হিসাবটা একটু ভিন্ন। সেই ভিন্নতা অনেক সময় বুঝে ওঠা বেশ কঠিন হয়ে ওঠে।

আরেকটা বিষয় এই আলাপের সাথে মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। সাহিত্য বিষয়টা মানুষ ও তার চারপাশ থেকে আসে, এই বিষয়টা হাসান আজিজুল হক প্রথম থেকেই বুঝেছিলেন। ফলে সাহিত্যের সাথে সামাজিক নানান কর্মকাণ্ডের যে যোগাযোগ থাকতে পারে, তা কোনোভাবেই বাতিল করে দেন নাই হাসান আজিজুল হক। এই কারণেই, মানে শিল্পের জন্য শিল্প ঘরানায় আস্থা না থাকায়, হাসান আজিজুল হক কণ্ঠস্বর পত্রিকায় কয়েকটি লেখা দেওয়ার পর আর লেখা দেন নাই। সে কথা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর ভালোবাসার সাম্পানে বলেছেন। ফলে সাহিত্যের সাথে মানুষ, মানুষের নানান কর্মকাণ্ড, সমাজ, সামাজিক নানান কর্মকাণ্ডের বিষয় তাঁর সাহিত্য-বিচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে হাসান আজিজুল হক এই বিষয়সমূহ তাঁর সাহিত্যে সংযুক্ত করেছেন, তার চোরাগলিটা খুঁজে পাওয়া এই সময়ের লেখক-গবেষকদের জন্য বেশ কষ্টের। কিন্তু চিঠিপত্র সেই চোরাগলির সন্ধান দিতে পারে। কারণ, চিঠিপত্রের সেই নানামাত্রিকতা রয়েছে। আর এমন নানামাত্রিক বিষয়-আশয় একজন সাধারণ পাঠক কিংবা ঝানু গবেষকের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে কারও সাহিত্যের সূত্র-সন্ধানের বেলায়।

শেষ কথা। এই গ্রন্থ সম্পাদনার ব্যাপারে। এই গ্রন্থ-সম্পাদনায় বড় একটা সংকট উপস্থিত না হলেও প্রচুর মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়ে। বিষয়টা আপাতদৃষ্টে ছোট হলেও বিষয়টা এতটা সহজ-সরল বিষয় হিসেবে নেওয়া উচিত নয়। কারণের কথা যদি এই ক্ষেত্রে বলা হয়, তবে বলতে হবে যে, এই গ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে যখন কেউ নতুন করে কোনো লেখা লিখবেনতা যে ধরনের লেখাই হোক না কেন, তখন এই মুদ্রণপ্রমাদ চলতেই থাকবে। কারণ, প্রাথমিক উৎস থেকে যে তথ্য একজন লেখক ব্যবহার করবেন, সেই তথ্য যদি ভুল হয়, তবে পরবর্তী সময়ে রচিত নতুন লেখাও ভুল হতে থাকবে। ফলে একটা ভুলের সিরিজ লেখা চলতেই থাকবে। বিষয়টা তাই সরল হলেও এতটা সরল নয়। হয়তোবা ছাপানোর জন্য এক অনিঃশেষ তাড়া এই ব্যাপারে ট্রিগার-ম্যাটার হিসেবে কাজ করেছে।

দ্বিতীয়ত, এই গ্রন্থে চিঠিপত্র সম্পাদনার বেলায় টীকা সংযোজনটা বিশেষভাবে দরকারি হয়ে পড়ে। যেমন বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি বিষয়ে টীকা লেখন বেশ জরুরি বিষয় হিসেবেই বিবেচিত হওয়া উচিত। কারণ হলো এই যে, বাস্তবে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু নানান কারণে অপরিচিত ব্যক্তি সম্পর্কে এই সময়ের মানুষের জানা-শোনা কম থাকবে বলেই ধরে নেওয়া যায়। তাই যাঁদেরকে নিয়ে, যাঁদেরকে ঘিরে এই চিঠিপত্র লেখার বিষয় সম্পাদিত হয়েছে, তাঁদের সম্পর্কে কয়েক কথার টীকা এই গ্রন্থ-সম্পাদনাকে নিয়ে যাবে সম্পূর্ণ অন্য পর্যায়ে। আবার ব্যক্তি নাম বাদেও নানান বিষয়ে, যে সমস্ত বিষয়ের উল্লেখ আছেযে সমস্ত বিষয়েও একটা টীকা বা পরিশেষ অংশ সংযোজন করা যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলব যেমন সেই সময়কার প্রধান ধারার পত্রিকাগুলো সম্পর্কে দু-চার কথায় টীকা লেখা যেত। যা পুরা করা হলে এই গ্রন্থ পাবে এক ভিন্ন রূপ, পাঠক পাবেন এক ভিন্ন আমেজ। আশা করছি পরবর্তী সংস্করণে সম্পাদক এই বিষয়টা মাথায় রাখবেন। যে সামান্য ভুল-ত্রুটি আছে, তা পুরোই সারিয়ে তুলবেন।

হাসান আজিজুল হকের চিঠিপত্রের একটা সংকলন সম্প্রতি বের হয়েছেহাসান আজিজুল হক সমীপেষু নামে, ওপরের আলোচনা হলো মূলত এই গ্রন্থ নিয়ে। যে গ্রন্থে হাসান আজিজুল হকের চার শতাধিক চিঠি সংযোজিত হয়েছে। যেসব চিঠি নানাজন নানা সময় হাসান আজিজুল হককে লিখেছিলেন। আমি কেবলই কয়েকজনের কথা বললাম। পাঠক এই গ্রন্থ-পাঠের মাধ্যমে বাদবাকি সবার চিঠিই পড়তে পারবেন। জানতে পারবেন এক অজানা অধ্যায় সম্পর্কে; এক বৃহৎ সময়ের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে। এই বৃহৎ কাজটি সম্পাদনা করেছেন চন্দন আনোয়ার। যিনি নিজেও কথাসাহিত্যিক এবং গবেষণা [পিএইচডি] করেছেন হাসান আজিজুল হকের সম্পূর্ণ কথাসাহিত্য নিয়ে। ফলে ব্যক্তি-সম্পর্ক এবং সাহিত্যের ক্ষেত্র-সম্পর্কের বেলায়ও নানান সূত্রে একীভূত এই সম্পাদক। বিশেষ করে হাসান আজিজুল হকের সাথে নিবিড় সম্পর্ক না থাকলে এই কাজ করা সম্ভব হতো না। এই কাজ অবশ্যই নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল, বাংলা সাহিত্যে। কারণ, এই গোপন মণিকাঞ্চনের সন্ধান জানাটা নানা কারণে জরুরি বিষয় ছিল। এই চিঠিপত্রের সংকলনের মাধ্যমে একজন গবেষক হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যের সমালোচনার নতুন অভিমুখ খুঁজে পাবে।