বেতারে আলমগীর কবিরের মুক্তিযুদ্ধ
আলমগীর কবিরের নাম উচ্চারিত হলে ধীরে বহে মেঘনা [১৯৭৩], সূর্যকন্যা [১৯৭৬], সীমানা পেরিয়ে [১৯৭৭] বা রূপালী সৈকতে [১৯৭৯]-এর কথা মনে পড়ে। চলচ্চিত্রগুলো দেখলে বোঝা যায়, কেবল বিনোদন দান তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তির ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন তিনি। চলচ্চিত্র নির্মাণের আগে তিনি লন্ডনের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পত্রিকা সাইট অ্যান্ড সাউন্ডের নিয়মিত চিত্রসমালোচক ছিলেন, অংশ নিতেন কান-বার্লিন-ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে, চিত্রসমালোচক হিসেবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নামার আগে আগে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধে। সদস্য হয়েছিলেন আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এফএলএনের। তিনি প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতায় সাহায্য করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৬৩ সালে গঠন করেন ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট নামে এক গোপন সংগঠন। সংগঠনের প্রচারপত্র হিসেবে বের করেন এশিয়ান টাইড ও পূর্ব বাংলা নামে দুই ভাষার দুই পত্রিকা। তখনো ছয় দফা প্রবর্তিত হয়নি, খুব কম মানুষই তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু আলমগীর কবির ষাটের দশকের শুরুতেই সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। হালকা অস্ত্র চালাতে শেখেন। প্রকৌশলী হিসেবে একটি বহুজাতিক কোম্পানির লোভনীয় চাকরি ছেড়ে তিনি ১৯৬৬ সালে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আসেন দেশকে স্বাধীন করার জন্য। পাকিস্তান সরকার ১৯৬৬ সালেই তাঁকে গ্রেপ্তার করে। জেলে পাঠায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ইংরেজি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। জহির রায়হানের সঙ্গে সহযাত্রী হয়ে নির্মাণ করেছেন প্রামাণ্যচিত্র স্টপ জেনোসাইড [১৯৭১], নিজে এককভাবে নির্মাণ করেছেন লিবারেশন ফাইটার্স [১৯৭১]।
চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিসংগ্রামী—এই দুই বড় পরিচয় যাঁর, তাঁর বাংলা ভাষার লেখাপত্রকে এক জায়গায় করে, তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পর ২০১৮ সালে কিছু উদ্যমী তরুণের সুসম্পাদনায় ‘চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি’ শিরোনামে রচনা সমগ্র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আলমগীর কবির রচনা সংগ্রহ দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে।
১৯৭১ সালের ১২ জুন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করেন আলমগীর কবির। সন্দেহ নেই মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর মনোবলকে উদ্দীপ্ত করতে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিল। যুদ্ধের সময়ে প্রতিদিন মানুষ অধীর আগ্রহে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার জন্য অপেক্ষা করত। তিনি সেখানে ছিলেন ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। এর পরপরই তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্র ধারণের কাজে ঝাপিয়ে পড়েন। ৭ ডিসেম্বর তিনি যশোহর মুক্ত হওয়ার দৃশ্য ধারণ করেছিলেন। পাক সেনাবাহিনীর শেষদিকের গণহত্যার অনেক প্রমাণ, বহু দলিল তিনি ক্যামেরাবন্দি করেন। তাঁর ‘ধীরে বহে মেঘনা’ ছবিতে এসকল দলিলের কিছু কিছু দেখানো হয়েছে।
আলমগীর কবিরকে পেয়ে বেতারে ইংরেজি ভাষায় প্রচারের জন্য ভিন্ন একটি বিভাগ খোলা হয়। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে সেই বিভাগের প্রধান পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ‘আহমেদ চৌধুরী’’ ছদ্মনামে তিনি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি নাম ‘রেডিও বাংলাদেশ’ রেখেছিলেন আলমগীর কবির। তিনি প্রচারধর্মী সংবাদ পরিক্রমা কিংবা মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংগঠনের ভূমিকা সম্পর্কে ইংরেজিতে লিখতেন এবং স্বকণ্ঠে প্রচার করতেন। সেসবের মধ্য থেকে একাশিটি কথিকা সংকলন করে দিস ওয়াজ রেডিও বাংলাদেশ ১৯৭১ নামে ১৯৮৪ সালে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। সে বইয়েরই বঙ্গানুবাদ করেছেন পাঁচ তরুন লেখক আফজালুর রহমান, আরস্তু লেনিন খান, তাহমিদাল জামি, প্রিয়ম প্রীতম পাল ও সামসুদ্দোজা সাজেন। বইটি সম্পাদনা করেছেন আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান, আরস্তু লেনিন খান ও ও তাহমিদাল জামি।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের মাথায় বইটি যাঁরা তরজমা ও সম্পাদনা করেছেন, নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। বইয়ের শিরোনামের বাংলা করা হয়েছে শুনছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ১৯৭১। আলমগীর কবির রচনা সংগ্রহ-২-এর পুরোটাই এ বইটি। বইটির ভূমিকা লিখেছেন বেগম মমতাজ হোসেন, কামাল লোহানী এবং এর শেষে রয়েছে আলমগীর কবিরের কথিকাগুলোকে নিয়ে সলিমুল্লাহ খানের মূল্যায়নধর্মী এক গুরুত্বপূর্ণ গদ্য।
এখানে অন্তর্ভুক্ত কথিকামালার প্রধান লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ন্যায্যতা বিশ্বব্যাপী তুলে ধরা। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষণে ক্ষণে উদ্ভূত অভাবিতপূর্ব প্রশ্নের ও অনিবার্য প্রসঙ্গের অনবদ্য বিশ্লেষণ এসব কথিকা। এতে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনা, বিশ্ব নেতৃবৃন্দ আর নানান পরাশক্তির ভূমিকার কথা। আরো আছে গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধের পদ্ধতিগত কৌশল, স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকল্প এবং অন্যান্য প্রসঙ্গের অন্তর্ভেদী আলোচনা। তবে লক্ষণীয় বিষয়, যুদ্ধকালীন প্রচারের মধ্যেও আলমগীর কবির কোথাও সত্যের সীমা লঙ্ঘন করেন নাই। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের যুগপদ অনন্য ও অমূল্য দলিল এই বই। সলিমুল্লাহ খান বইটি প্রসঙ্গে লিখেছেন—
এই বই—এক কথায় বলিতে—বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে যত দলিল এই পর্যন্ত পড়িয়াছি তাহাদের সব কয়টিকে ছাড়াইয়া গিয়াছে—অন্তত রাজনৈতিক চিন্তার উৎকর্ষে। [পৃ: ২৮৭]
১৯৮৪ সালে বইটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন এর মুখবন্ধ লিখেছিলেন আলমগীর কবির নিজে। মুখবন্ধের শেষে তিনি লিখেছিলেন—
আশা করি এই সংকলন শুধু যুদ্ধ বিষয়ক জাদুঘরেই জমা থাকবে না, বরং বিপ্লবী রণকৌশলে আগ্রহী শিক্ষার্থীদেরও কাজে লাগবে। [পৃ:৪]
আমরাও চাই না, আলমগীর কবিরের এ সংকলনটি কেবল যুদ্ধ বিষয়ক জাদুঘরে জমা থাকুক। আমরা চাই তার এ সংকলন নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ চলুক। তার লেখা মুখবন্ধের শেষ বাক্য, ‘বিপ্লবী রণকৌশলে আগ্রহী শিক্ষার্থীদেরও কাজে লাগবে’, আমাদের মনে করিয়ে দেয়, তিনি প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসি ছিলেন। প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে তিনি শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসি ছিলেন। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল ফিদেল কাস্ত্রোর। তাঁর চলচ্চিত্র ও জীবনযাপন বলে দেয়, তাঁর চিন্তাজগৎ স্থানীয় কাঠামোতে বন্দি ছিল না। তাঁর চিন্তাজগৎ ছিল বৈশ্বিক।
প্রশ্ন জাগে, ২০২১ সালে তো স্বাধীনতার ৫০ বছর পালিত হল, যে স্বপ্ন আর আশা নিয়ে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, তা কতটা পূরণ হয়েছে? একটি নতুন দেশের জন্মে শেষপর্যন্ত লাভবান হয়েছে কারা, এদেশের সমস্ত শাসকই কি শেষপর্যন্ত পুরনো শাসকদের চেহারায় আবতীর্ণ? নব্বই পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে সকল শাসকই কি আইয়ুব খানের মত স্বৈরশাসক, ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টায় রত? কেবলমাত্র অবকাঠামোগত উন্নয়ন দিয়ে কি রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব? সে বিপ্লবীরা কোথায়, বইটি যাদের কাজে লাগবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন তিনি!
কথিকামালায় পালাক্রমে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতিসংঘের নেতিবাচক ভূমিকা, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কর্মকাণ্ড, ভারতীয় মুসলমানদের বিভ্রান্তি, নীরদ চৌধুরীর মত পণ্ডিত-বুদ্ধিজীবীদের এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হীন বল হিসেবে দেখানোর প্রসঙ্গ।
২
আলমগীর কবিরের প্রথম কথিকা প্রচারিত হয় ১৯৭১ সালের ১৫ জুন। এ কথিকা পাঠ করলে বোঝা যায় আলমগীর কবিরের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দেশাত্মবোধ কতটা গভীর ছিল। কথিকাটিতে তিনি তীব্রভাবে আক্রমণ করেছিলেন বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকসেনাদের নির্মম হামলার বিষয়ে পশ্চিমা সরকারগুলোর উদাসীনতাকে। তিনি উল্লেখ করেছিলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় তিন মাসের মাথায়ও কোনো কোনো প্রভাবশালী পশ্চিমা মিডিয়া এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলা’ বলে প্রচার চালাচ্ছিল। জাতিসংঘের ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পশ্চিমাদের বর্ণবাদী মনোভাবের প্রকাশ। বর্ণবাদকে তিনি লক্ষ্য করেছেন শ্বেতাঙ্গ বিপ্লবীদের মধ্যেও। ভিয়েতনামে আমেরিকান সৈন্যদের বর্বরতার বিরুদ্ধে যে শ্বেতাঙ্গরা প্রতিবাদ করেছিল, তারাই দেখা গেছে পাকসেনাদের দ্বারা বাঙালিদের ওপর আক্রমণের বিষয়ে নিরব ছিল। এ বিষয়টি কবিরকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। তাই অনেকটা ক্ষোভ নিয়ে তিনি কথিকায় বলেছিলেন—
আমরা বিশ্বাস করতে চাই দুনিয়া নানান জাতিতে বিভক্ত। কিন্তু সত্য হল এই দুনিয়া বিভক্ত মূলত ধলা আদমি আর কালা আদমি এই দুই আলাদা ভাগে। ধলাদের তুলনায় কালারা সংখ্যায় অনেক বেশি। ধলারা যখন কালাদের আক্রমণ করে কেবল তখনই বিবেকের দংশনে ভোগে ধলা বিপ্লবীর দল। কিন্তু কালারা যখন কালাদের উপর গণহত্যা চালায় তখন নিজেদের অভ্যন্তরীণ ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সব ধলা এক হয়ে বোধ হয় একপ্রকার গোপন পুলক অনুভব করে থাকে। যতক্ষণ খোদ ধলারা রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে না পড়ে, ততক্ষণ ধলা বিপ্লবীদের বিবেক থাকে একেবারে ধলা ফকফকা। আমার এই ব্যাখ্যা গলদ সাবুদ হলে আমিই সবচেয়ে খুশি হব। [পৃ : ৬]
২৫ জুনের কথিকায় বলা হয়—
যতক্ষণ পর্যন্ত না উন্নয়নশীল দেশের সামরিক স্বৈরাচারী শাসন পশ্চিমা শক্তিসমূহের নির্দেশ অমান্য করে তাদের বৈশ্বিক প্রভাব ক্ষুণ্ন করে ততক্ষণ পর্যন্ত পশ্চিমারা সেই শাসনের ঠিক বিরোধিতা করে না। সরকারগুলির এই শীতল আচরণ তাদের গণমাধ্যমকেও প্রভাবিত করেছে। [পৃ : ১৬]
স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় ১৯৭১ সালের কথিকামালায় উল্লিখিত বক্তব্য আমাদের ভাবায়। আমরা বুঝি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো নিজ স্বার্থে অপর রাষ্ট্রের প্রতি বিরোধীতা বা পক্ষপাত প্রকাশ করে, সেখানে প্রকৃতই মানবিকতার কোনো স্থান নেই। সে হিসেবে যে সব পরাশক্তি বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, নিজ স্বার্থেই নিয়েছিল। পাশাপাশি যারা বাংলাদেশের পাশে বন্ধু হিসেবে দাঁড়িয়েছিল তাদেরও হয়ত ছিল সুদুরপ্রসারি কোনো হিসাব-নিকাশ। মনে পড়ছে, ২০১৭ সালের শেষের দিকে যখন মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা চালিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হলো, নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নিজ স্বার্থ রক্ষার পুনরাবৃত্তি দেখা গিয়েছিল। মাঝখান থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় সাত লক্ষাধিক শরণার্থী, যাদের আজও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। যে ভারত ১৯৭১ সালে ৯ মাস ধরে অসংখ্য বাংলাদেশি শরণার্থী আশ্রয় দিয়েছিল, সেই ভারতও এ সময় নীরব ভূমিকা পালন করেছে। মায়ানমারের বিপক্ষে কোনো অবস্থান গ্রহণ করেনি। চীনও যেন গণহত্যাকে সাপোর্ট করে গেছে। বুঝি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বিশ্ব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের খুব বেশি বদল ঘটেনি। রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে চির বন্ধু বা চির শত্রু বলে কোনো কথা নেই। প্রশ্ন জাগে, মায়ানমারে গণতন্ত্রের জন্য আজ যারা রাস্তায় নেমেছে, তারা কেন সামরিক বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের প্রতি গণহত্যা চালানোর সময় রাস্তায় নামেনি। তাদের প্রসঙ্গে মনে পড়ে, জার্মানি কবি মার্টিন নেমলারের ফার্স্ট দে কেইম কবিতার লাইনগুলো—
যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিল,
আমি কোনো কথা বলিনি,
কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।
তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল,
আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি শ্রমিক নই।
তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে,
আমি তখনও চুপ করে ছিলাম,
কারণ আমি ইহুদি নই।
আবারও আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে,
আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,
কারণ আমি ক্যাথলিক নই।
শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোন কথা বলল না,
কারণ, কথা বলার মত তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না।
আলমগীর কবিরের বইতে উল্লেখ আছে বাঙালি নিধনে মার্কিনিদের কাছ থেকে পাকিস্তানিদের একের পর এক অস্ত্র নেওয়ার কথা। রয়েছে চীন সরকারের বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকা নিয়ে কড়া সমালোচনা। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রশ্নে চিন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। পাশাপাশি এও উল্লেখ আছে, বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শক্তি তৎকালীন সোবিয়েত ইউনিয়ন জুলাই মাসেও বাংলাদেশের বিষয়ে কেমন রহস্যময়ভাবে নীরব ভূমিকা পালন করে গেছে। এ তো গেলো পরাশক্তিগুলোর কথা। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে আলমগীর কবির তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন তৎকালীন আরব বিশ্ব ও মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা নিয়েও।
২৫ জুনের অপর এক কথিকায় উল্লেখ করা হয়েছিল এ বিষয়ে—
লিবিয়া, সিরিয়া, সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র ওরফে মিশর ও নাইজেরিয়ার প্রতিনিধিরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে এতই আবেগাপ্লুত ছিলেন যে এই ধর্মের নামে চালান হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিবেচনার দিকে তাঁরা মনোযোগই দিতে পারেন নাই। নাইজেরিয়া নিজেই বায়াফ্রাতে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে দমন করার জন্য একইরকম অপরাধ সংঘটিত করেছে। তারা যে বাংলাদেশের সংগ্রাম সমর্থন করবে না তা তো জানা কথা। লিবিয়ায় চলছে মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র; গণতান্ত্রিক রীতিনীতির থোড়াই পরোয়া করে তারা। আর নাসেরের মৃত্যুর পর সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র দ্রুতই ডানপন্থী উগ্রবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীল আরব সরকারগুলির বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন ফিলিস্তিনের গেরিলা সংগঠন আল ফাতাহের নেতা ইয়াসের আরাফাত। ইতিহাসের নিকৃষ্টতম অপরাধীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন তিনি। ঘটনাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। [পৃ : ২২]
৩
মার্চের ২৫ তারিখ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায় বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। যুদ্ধের পুরো নয় মাস জুড়েই জানা যায় না, বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন নাকি তাঁকে হত্যা করা হয়েছে! বঙ্গবন্ধুর কারাগারে আটক থাকা প্রসঙ্গে আলমগীর কবির কঙ্গোর বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী নেতা প্যাট্রিস লুমুম্বার কথা উল্লেখ করেন। লুমুম্বাও বঙ্গবন্ধুর মতো বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। কঙ্গোর মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁকে সামরিক বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে খুন হতে হয়। ইয়াহিয়া খান কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকেও একইভাবে হত্যার ষড়যন্ত্র চলে। এ প্রসঙ্গ ধরেই ১৯৭১ সালের ২৩ জুলাই কথিকায় উল্লেখ করা হয়—
ইয়াহিয়া ও তাঁর কুচক্রী জেনারেলদের মত মার্কামারা কাপুরুষের কাছ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি কোনো সভ্য আচরণ প্রত্যাশা করা বোকামির নামান্তর মাত্র। শেখ সাহেব চাইলে সময়মত সটকে পড়তে পারতেন। কিন্তু একজন সাহসী গণতন্ত্রী হিশাবে এবং সভ্য আচার-আচরণে পরম বিশ্বাসী ব্যক্তি তিনি পালানোর চিন্তাকে ঘৃণ্য কাজ বিবেচনা করেছেন। [পৃ: ৭৬]
কিংবা,
লুমুম্বার হত্যাকারীর ভাগ্যে কি ঘটেছিল ইয়াহিয়াকে তা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। সোম্বে শুধু কাতাঙ্গাই হারান নাই, তিনি নিজেও পটল তুলেছেন শোচনীয়ভাবে—রাশি রাশি তপ্ত গুলি তাঁর আঁতুড়ি-ভুতুড়ি এফোড়-ওফোড় করে দিয়েছিল। ইয়াহিয়ার পতন এর থেকে গৌরবজনক কিছুতে হবে না। [পৃ : ৭৮]
১১ ও ১৪ আগস্টের কথিকায় বলা হয়—
ইসলাম ও জাতীয় সংহতির দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের উপর একটা গণহত্যা চাপিয়ে দিল ইয়াহিয়া খান। আর অসহায়ের মতন চেয়ে দেখল সারা বিশ্ব। তারই ধারাবাহিকতায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক আদালতে বিচারের মুখামুখি দাঁড় করানোর হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এবারও দুনিয়ার টনক নড়ে নাই। ভারত ও সোবিয়েত ইউনিয়ন বাদে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলির তেমন কেউই ইসলামাবাদের সামরিক জান্তা যে অপরাধ সংঘটিত করবে বলে বারবার হুমকি দিয়ে আসছে তার বিরুদ্ধে একটা হুশিয়ারি উচ্চারণ কারার দরকার পর্যন্ত বোধ করল না। নীরবতাকে খুব দ্রুত পরোক্ষ সমর্থন বলে চালিয়ে দিলেন ইয়াহিয়া। [পৃ: ১২৮]
কথিকামালায় পালাক্রমে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতিসংঘের নেতিবাচক ভূমিকা, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কর্মকাণ্ড, ভারতীয় মুসলমানদের বিভ্রান্তি, নীরদ চৌধুরীর মত পণ্ডিত-বুদ্ধিজীবীদের এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হীন বল হিসেবে দেখানোর প্রসঙ্গ। উঠে আসে, পাক সেনাদের চালানো গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুটপাট এবং কোটি বাংলাদেশি শরণার্থীর ভারতে আশ্রয় গ্রহনের প্রসঙ্গ। সর্বোপরী এ যুদ্ধে সমস্ত নৈতিক বল ছিল এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে, আর পাকিস্তানিদের পতনের মূল কারণ নিহিত ছিল এখানেই। তাই একটা সময় বাংলাদেশের পক্ষে ভারত, ভুটান, তৎকালীন সোবিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব জার্মানি, যুগোশ্লাবিয়ার মত দেশগুলো দাঁড়াতে শুরু করে। সোবিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি করে ভারত সরাসরি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। ভারতের সেনাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ বাংলাদেশের যুদ্ধজয়ের পথ সহজ করে দিয়েছিল। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এ শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। এ বিভ্রান্তির সমাধান হওয়া জরুরী। আলমগীর কবিরের এ বইয়ে জুন এবং আগস্টে দুটি কথিকায় শহীদদের সংখ্যার কথা উল্লেখ আছে, যার মধ্য দিয়ে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের কিছুটা সমাধান খোঁজা যেতে পারে।
২৫ জুনের কথিকায় উল্লেখ আছে—
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি গণঘাতী যুদ্ধ এরই মধ্যে প্রায় দশ লাখ নিরপরাধ প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। [পৃ : ২০]
১২ আগস্টের কথিকায় উল্লেখ আছে—
বাংলাদেশে কুড়ি লাখ লোককে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করার সময় যারা নিশ্চুপ দর্শক হয়ে ছিল আজ তারাই আবার উপমহাদেশে শান্তির দূত সেজেছে। [পৃ : ১৩২]
লক্ষণীয় বিষয়, আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত আলমগীর কবির পাক সেনা কর্তৃক ২০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কথা প্রচার করেন। এরপরও যুদ্ধ চলেছিল আরও প্রায় চার মাস। এক্ষেত্রে শেষপর্যন্ত ত্রিশ লক্ষ শহীদ হওয়ার প্রসঙ্গটি কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না! তবে শহীদের সংখ্যা তিন বা ত্রিশ লক্ষ যাই হোক না কেন, পাকিস্তানের অবশ্যই উচিত বাংলাদেশের কাছে তাদের নির্মম কর্মকাণ্ডের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া।
৪
১৯৮৯ সালের ২০ জানুয়ারি আলমগীর কবির মৃত্যুবরণ করেন এক ফেরি দুর্ঘটনায়। অনেকের মতে আলমগীর কবিরের এ মৃত্যু দুর্ঘটনা ছিল না, ছিল হত্যাকাণ্ড! আলমগীর কবিরের এমন মৃত্যুর প্রসঙ্গে মনে পড়ে স্বাধীনতার পরপর জহির রায়হানের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কথা; মনে পড়ে আলমগীর কবিরের মৃত্যুর অনেক পরে তারেক মাসুদের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা। দেশের তিন গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতার অস্বাভাবিক মৃত্যু আমাদের ভাবায়। আলমগীরের কবিরের মৃত্যু দুর্ঘটনায় হয়েছিল কি-না, এ প্রসঙ্গে সলিমুল্লাহ খানও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন—
একটা ট্রাকের ধাক্কায় তাঁহার গাড়ি ফেরি হইতে নদীতে পড়িয়া গেল। সহকর্মী টিনা খান ও তিনি মরিয়া গেলেন। সকলেই মানিয়া লইয়াছেন এই মৃত্যু নিতান্তই দুর্ঘটনা। যেন ইহাতে প্রশ্ন করিবার কিছু নাই। কি কারণে জানি দুর্ঘটনার এই উপপাদ্যটা আমি প্রাণ হইতে পুরা মানিয়া লইতে পারি নাই। আমি তখন দেশে থাকি না—থাকি দূরদেশে। সে দেশটি মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সাহায্য করে নাই। ঘটনার কয়েকদিন পর খবরটা কাগজে পড়িলাম। আশেপাশে কাহারও সহিত আলোচনার উপায় ছিল না। সে ছিল স্তব্ধ শূন্যে তাকাইয়া থাকিবার দিন। কেবলি ভাবিতাম, এই দুর্ঘটনার পিছনে আরো ঘটনা থাকিলেও থাকিতে পারে। [পৃ :২৯৩, ২৯৪]
সলিমুল্লাহ খান এমন সন্দেহের পেছনে আলমগীর কবিরের দেওয়া শেষ ভাষণের কথা উল্লেখ করেন। যেখানে আলমগীর সিনেমায় সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, জীবনবোধ নিয়ে সব সময় সত্যকে প্রকাশের কথা বলেছিলেন। এ সত্য প্রকাশ তৎকালীন সামরিক শাসকের বিপক্ষে গেলেও নির্দ্ধিধায়, নির্ভয়ে প্রকাশের কথা বলেছিলেন। আলমগীর কবিরের মৃত্যু নিয়ে যে ধোঁয়াশা রয়েছে, তা নিয়ে নিশ্চয় নতুন করে ভাবা যেতে পারে।
উল্লেখ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে স্বার্থন্বেষি মহল ইতিহাসকে নানাভাবে বিকৃত করে, তখন ইতিহাসের মূল সত্য হারিয়ে গিয়ে ভুল বার্তা প্রচারিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সত্যকে ধরে রাখতে, তখনকার বিশ্ব রাজনীতিকে উপলব্ধি করতে আলমগীর কবিরের রচনা সংগ্রহ-২ শুনছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ১৯৭১ নিশ্চিতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
যে সমস্ত তরুনেরা আলমগীর কবিরের "দিস ওয়াজ রেডিও বাংলাদেশ ১৯৭১" বইটি অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন তাঁদেরকে আন্তরিক অভিনন্দন এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। যে সমস্ত কর্মকান্ড ও অনুষ্ঠানমালা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে পূর্ণতা দিতে চেষ্টা করেছে এটি তার মধ্যে অন্যতম। ঐতিহাসিকভাবে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে বলে আমরা সবাই মনে করি।
এম আক্তারুজ্জামান
এপ্রিল ১৬, ২০২১ ১৪:৫৭