দিল্লি দাঙ্গা ও গাজীর পট
হরদম গাজীর নাম লইও
পাষাণ মনরে, হরদমে গাজীর নাম লইয়।
দমে দমে লাইয় নাম, জিরানীনা দিয়
পাষাণ মনরে, হরদমে গাজীর নাম লইয়।।
লাইন কটা আবছা মনে পড়ে, কেন মনে পড়ে কোথায় শুনেছি, তা আর কিছুতেই মনে পড়ে না। ভীষণ মন খারাপের পাশে চুপচাপ বসে আছে দিল্লি। খবরের চ্যানেলজুড়ে আতঙ্কিত মুখ আর অচেনা দেশ। দাঙ্গা শেষের দিল্লিকে প্রথম যখন দেখলাম, তখন থেকেই লাইন চারটা কোথা থেকে যেন আমাকে আচ্ছন্ন করল। এই লাইন কটা কি আমি কোথাও পড়েছি? শুনেছি? মনে করতে পারি না। টিভি থেকে ভেসে আসে আর্তনাদ, চিৎকার ও গুলির শব্দ।
বাবার বইগুলো নাড়াচড়া করতে গিয়ে আজ সকালে ১৯৩৯ সালের একটি বই পেলাম গুরুসদয় দত্তের লেখা ‘পটুয়া সঙ্গীত’। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত বইটিতে ২৯টি পটের গান। পটের গান! বেশ অবাক হলাম। কয়েক দিন আগেই কোচবিহার রাজবাড়ীতে আমার সঙ্গে পরিচয় হয় এক বৃদ্ধর। তাঁর কাছেই শুনেছি, তাঁরা বংশপরম্পরায় রাজবাড়ীর পটচিত্র আঁকেন। তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, একসময় তাঁদের কত কাজ ও সম্মান ছিল। কোচবিহার মহারাজা শহরের শেষ প্রান্তে তাঁদের ঠাকুরদাকে বিশাল সম্পত্তি দান করেছিলেন, সেই গল্পও বললেন। সঙ্গে এ-ও বললেন, তাঁর দুই ছেলে পট আঁকতে পারে কিন্তু পটচিত্রের কদর ও ব্যবহার কমে গেছে বলে ওরা টাইলসের কাজ করে। তবে তাঁর ভাইয়ের ছেলে আর্টের স্কুল খুলেছে। চকচকা অঞ্চল অফিসের কাছেই তাদের বাড়ি। পটচিত্র নিয়ে আরও অনেক কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। সেদিন সন্ধ্যা নেমে এসেছিল, হঠাৎ ঘোর কাটিয়ে দিল নিউজ চ্যানেলের থেকে ভেসে আসা একটি খবর, দিল্লির মুসলমান বাসিন্দারা ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।
আমার ঠাকুরদা নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত বেশ শিল্পবোদ্ধা মানুষ ছিলেন, ছোটবেলাতেই তাই আমি জেনে গেছিলাম, বাংলার লোকশিল্পের অন্যতম শিল্প পটচিত্র। ভারতবর্ষে নানা রকম পটচিত্র প্রচলন ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত। তখন পটচিত্র দেখিয়ে গ্রাম-গঞ্জের মানুষকে ধর্মাচার ও লোক বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো। পটচিত্র দেখিয়ে পটের গান গ্রাম-গঞ্জের মানুষের বিনোদনও ছিল। কাগজ আবিষ্কার হওয়ার আগে সব পটচিত্র কাপড়েই আঁকা হতো। জড়ানো পটের বেশির ভাগই ধর্মের বিষয় করে কিছু ছবির মাধম্যে বয়ান করা হতো। আবার কিছু পট ছিল যমের ভয় দেখানোর জন্য।
রামায়ণ, কৃষ্ণলীলা, মনসামঙ্গল, শক্তি, যম, দশাবতার, চণ্ডীমঙ্গল, গাজী ইত্যাদি জড়ানো পটের প্রচলন ছিল। ব্রিটিশ আমলের ময়মনসিংহ মহকুমার ম্যাজিস্ট্রেট গুরুসদয় দত্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ২৬৩টি জড়ানো পট সংগ্রহ করেছিলেন। তার বেশির ভাগই সংগ্রহ করেছিলেন বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ থেকে। গুরুসদয় দত্ত তার মধ্যে আটটি পট সংগ্রহ করেছিলেন বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলা থেকে। এই আটটি পটই ছিল গাজীর পট। সিলেটের সন্তান গুরুসদয় দত্ত বাংলাদেশ থেকে অন্য কোনো পট সংগ্রহ করেননি বা পাননি। সেই গুরুসদয় বাবুর লেখা বই পেয়ে আমি যতটা আনন্দিত ততটাই বিস্মিত, কেননা বইটিতে গাজীর পটের কোনো গান পেলাম না। টিভিতে তখন বিশেষ প্রতিবেদনে দেখছি—সৌহার্দ্যের প্রতীক, চাঁদ বাবার মাজার পুড়ে ঝামা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক্কেবারে রাস্তার ওপরে। পাঁচ ফুট দূরে নীরব দর্শক দিল্লি পুলিশের চৌকি।
প্রাচীনকালেই মানুষ তার প্রয়োজনের তাগিদে ও দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে উপলব্ধি করেছে সত্য ও সুন্দরের ইশারা। আর এ সত্য ও সুন্দরকে স্থায়ী রূপ দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের হাতে সাধারণ মানুষের জন্য সৃষ্টি হয় লোকশিল্প। অনায়াসে বিকাশ লাভ করেছে এ লোকশিল্প। পরে এ অনায়াসলভ্য ও স্বতঃস্ফূর্ত শিল্পধারা সমাজ, নিয়মরীতি, জোতদার, সামন্ত, রাজা, সামাজিক ও প্রাত্যহিক প্রয়োজনে লোকধারাও বিভক্ত হয়। জীবন-উদ্ভূত শিল্পের এ পরম্পরাগত ধারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে— ১. লোকশিল্প ও ২. মার্গশিল্প।
লোকশিল্প ধারায় অন্তর্গত হলো আলপনা, পটচিত্র, পুঁথিচিত্র, দশাবতার তাস, গ্রামবাংলার কাঁথার অলংকরণ, পোড়ামাটির পুতুল, মাটির হাঁড়ি, কাঠের পুতুল, ঘট, লক্ষ্মীর সরা, নকশা করা শীতলপাটি। অন্যদিকে মার্গীয় ধারায় রয়েছে পালশৈলী, মন্দির-মঠের গায়ে পোড়ামাটির অলংকরণ, মধ্যযুগের মোগল ও রাজস্থানি চিত্রশৈলী এবং আধুনিককালে ইউরোপীয় চিত্রকলার অনুকরণে রচিত শিল্পকর্ম। আমাদের লোকশিল্পের অন্যতম প্রকাশ হলো আমাদের পটচিত্র। প্রসঙ্গক্রমে যামিনী রায় বাংলার চলিত চিত্রকলার যে সাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন, সেখানে তিনি বলেছেন, ‘চিত্রকলা বাংলাদেশে চলিত ছিল দুভাবে; এক হলো ঘরোয়া বা আটপৌরে শিল্প, আর এক হলো পালাপার্বণের শিল্প, যাকে পোশাকি শিল্প বলা যায়। বাংলাদেশের আটপৌরে ছবি, তার পটের ছবি আর তার পালাপার্বণের শিল্প দেবমূর্তি, প্রতিমা ইত্যাদি। এ দু-এর পার্থক্য স্পষ্ট: প্রথমটিতে প্রসাধনের প্রচেষ্টা নেই, সংস্কারের উৎসাহ নেই। দ্বিতীয় ছবি সংস্কৃত, আভিজাতিক। বেদাদির ঐতিহ্য তার নির্ভর। গঠনের দিক থেকে এ দু’জাতের ছবির বহু প্রভেদ।’ যামিনী রায়ের এই উদ্ধৃতি উপলব্ধি করতে পারলে পটের বহু বিস্তৃত মাধুর্য ও আমাদের যাপিত জীবনের সঙ্গে এর আত্মিক যোগসূত্রটি সহজেই আবিষ্কার সম্ভব হবে। টিভির স্ক্রলে ভেসে উঠছে ১২৩টি এফআইআর, আটক ৬৩০, স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে থমথমে রাজধানী।
একসময় গাজীর পট দেখিয়ে গাওয়া গান ছিল বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষের বিনোদন। ধর্ম ও নীতিবাক্য শেখার ভরসাস্থল এই পট। সম্ভবত পীর গাজী তখন জনপ্রিয় ছিলেন। এই পটে বর্ণনা থাকে গাজী পীর, তাঁর ভাই কালু, তাঁদের বাবা-মা ও মাণিক পীরের। কিন্তু ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বার বাজারের পূর্ব পাশে ১ কিলোমিটার দূরে গাজী কালু-চম্পাবতীর যে মাজার অবস্থিত, তার যে গল্প আমরা পাই, সুন্দরবনের গাজীর পটে তা পাই না। অথচ লোককথায় জানা যায়, গাজী পীর সুন্দরবন এলাকার জনপ্রিয় পুঁথি সাহিত্য গাজী কালু চম্পাবতীর প্রধান চরিত্র। আর মায়ী চম্পা তার স্ত্রী। যার পিতা ১৪ শতকের প্রথমার্ধের প্রতাপশালী রাজা মুকুট রায়। যার রাজ্য ছিল দক্ষিণে সুন্দরবন ও পশ্চিমে হুগলি পর্যন্ত বিস্তৃত। পাবনা, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, নদীয়া, বর্ধমানের বিস্তৃত এলাকায় দাপটের সঙ্গেই জমিদারি করেছেন এই ব্রাহ্মণ। তার রাজধানী ছিল ঝিকরগাছা সদর থেকে দেড় মাইল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে লাউজানিতে। সুন্দরবনের বাঘের দেবতা হিসেবে পূজিত ব্রাহ্মণ দক্ষিণ রায় ছিলেন এই মুকুট রায়েরই সেনাপতি। আর গাজী পীর লোকজ দেবতা হিসেবে পূজিত হন। হিন্দু ও মুসলমান-অধ্যুষিত সুন্দরবনের সবাই তাঁকে স্মরণ করে। যে কেউ সুন্দরবনে ঢোকার আগে হাতজোড় করে বনবিবির পাশাপাশি গাজীর নামে দোহাই দিয়ে ঢোকে। সুন্দরবনসংলগ্ন লোকালয়গুলোতে সাদা বর্ণের মুখে দাড়িসহ কোথাও জামা-পায়জামা-পাঞ্জাবিসহ মূর্তি, কোথাও লুঙ্গি পরা ঘাড়ে গামছাসহ মূর্তি পূজিত হয়। এই পূজার নিরামিষ নৈবেদ্য হলো বাতাসা, পাটালি, আতপচালের শিরনি ইত্যাদি। গ্রামের সাধারণ মানুষ জঙ্গলে প্রবেশ ছাড়াও গৃহপালিত পশুপাখি কামনা করেও গাজী সাহেবকে স্মরণ করে থাকেন।
মুকুট রায়কে পরাজিত করে তাঁর রাজ্য ও রাজধানী ছারখার করে তাঁর কন্যা চম্পাবতীকে বিয়ে করেন এই গাজী পীরই। তাঁর প্রকৃত নাম গাজী মিয়া বা বড়খান গাজী। পিতা জাফর খান গাজী বা শাহ সিকান্দার ছিলেন ত্রিবেণী ও সপ্তগ্রাম অঞ্চলের শাসনকর্তা। গাজী পীরের বংশ পরিচয় পুঁথিতে বর্ণিত হয়েছে এভাবে—
গোড়া বাজা গয়েপদি, তার বেটা সমসদি
পুত্র তার সাঁই সেকান্দার, তার বেটা বড়খান গাজী
খোদাবন্দ, মুলুকের কাজী
কুলযুগে তার অবসর বাদশাই ছিড়িল বঙ্গে
কেবল ভাই কালুর সঙ্গে, নিজ নামে হইলো ফকির।
ত্রিবেণীতে জাফর খান গাজীর মাজারে সংরক্ষিত কুরসীনামার সঙ্গে পুঁথি সাহিত্যে উল্লেখিত বংশতালিকার অনেকটাই মিল পাওয়া যায়। কুরসীনামার তথ্য বলছে, জাফর খান গাজীর মৃত্যু হয় ১৩১৩ সালে। তার পুত্রসংখ্যা ২। একজনের নাম উগওয়ান খান, অপরজনের বড়খান গাজী। বড় শব্দটি থাকায় বড় খান গাজীকেই জ্যেষ্ঠ পুত্র ধরা হয়।বাল্যকালেই ফকির-দরবেশের সাহচর্যে আধ্যাত্মিক সাধনায় উন্নতি লাভ করেন গাজী। পিতার কাছে শাসন ক্ষমতা নিতেও অস্বীকার করেন তিনি। ইসলাম প্রচার শুরু করেন দক্ষিণ বঙ্গের যশোর-খুলনা অঞ্চলে। ধর্ম প্রচারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রাজা মুকুট রায়ের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয় তাঁর।
পুঁথি সাহিত্যের তথ্য অনুযায়ী, মুকুট রায়ের স্ত্রী লীলাবতীর ৭ পুত্র। ১ কন্যা চম্পাবতী বা শুভদ্রা। তাঁর রূপের খ্যাতি ছিল জগৎজোড়া। এ নিয়ে পিতার গর্ব ছিল সীমাহীন। কিন্তু গাজী তাঁর প্রেমে পড়েন। পুঁথিতে বলা হচ্ছে—
বিধুমুখী চম্পাবতী কার কাছে আছে বসি
জ্বলিতেছে রূপ যিনি লক্ষ কোটি শশী।
হঠাৎ চম্পার রূপ নয়নে হেরিয়া
মূর্চ্ছিত হইয়া গাজী পড়িলো ঢলিয়া।
কিন্তু চম্পাবতীর রূপে গাজীর এভাবে চেতনা হারানোর ঘটনাকে অলীক বলেই মনে করেন এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ‘সাতক্ষীরার পুরাকীর্তি’ বইয়ের লেখক মিজানুর রহমান। তাঁর যুক্তি, পুঁথিতেই আছে, গাজী ছিলেন সংসারবিবাগী মানুষ। তাই তাঁর রূপ দেখে গাজীর মূর্ছিত হওয়ার কথা নয়। এমনকি চম্পার জন্য তাঁর যুদ্ধে লিপ্ত হওয়াটাও অস্বাভাবিক। কার্যত মুকুট রায়ের কাল হয় জাতিবিদ্বেষ।
ভাই কালুকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে মুকুট রায়ের দরবারে পাঠিয়েছিলেন গাজী। কিন্তু মুকুট রায় তাঁকে বন্দি করেন। এরই জেরে ঝিকরগাছার লাউজানিতে মুকুট রায়ের সঙ্গে গাজী পীরের যুদ্ধ হয় ১৩৬৫ সালে। গাজীর দল যুদ্ধে জেতে। মুকুট রায় সপরিবারে আত্মহত্যা করেন। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র কামদেব ও চম্পাবতী বন্দি হন গাজী বাহিনীর হাতে। পরে ইসলাম গ্রহণ করে কামদেব হন পীর ঠাকুর। আর ভক্তদের অনুরোধে চম্পাকে বিয়ে করেন গাজী। পরবর্তীকালে গাজীর নামেই গড়ে ওঠে গাজীর হাট, গাজীপুর, গাজীর জাঙ্গাল, গাজীডাঙ্গা, গাজীর ঘাট, গাজীর দেউল, গাজীর খাল, গাজীর ঘুটো ইত্যাদি এলাকা।
কৃষ্ণরাম দাসের রায়মঙ্গল কাব্যেও চম্পাবতীর পরিচয় ও বিয়ের গল্প একই। তবে কেউ কেউ মুকুট রায় নিজেই চম্পাকে গাজীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বলে দাবি করে থাকেন। আবার নৌকাডুবির কারণে মায়ী চম্পা এই লাবসায় এসে আস্তানা গাড়েন বলেও গল্প প্রচলিত আছে। তবে যশোরের বারোবাজারে গাজী, কালু, চম্পাবতীর মাজার আর এই মায়ী চম্পার মধ্যে যোগসূত্রটা আসলে কী, আদৌ কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তা আর এখন নিশ্চিত হওয়ার জো নেই। এই পটে চম্পাবতীর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। আচার্য বংশের প্রতিমাশিল্পীরা তৈরি করতেন এই পট। তাঁদের থেকে পট কিনে নিয়ে পটের গান গাইতেন বেদে সম্প্রদায়ের লোকেরা। সে গানের শ্রোতা ছিলেন ভাটি অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। আধুনিকতার দাপটে জনপ্রিয় এই লোকসংস্কৃতি এখন বিলীনই বলা চলে।
একসময় বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে পটচিত্র দেখিয়ে গাজীর গান গেয়ে বেড়াত বেদে সম্প্রদায়ের পুরুষেরা। তাদের মধ্যে মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, নরসিংদী এবং তার আশপাশের অঞ্চলেই এমন বেদেদের বিচরণ ছিল বেশি। বেদে সম্প্রদায়ের লোকেরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে গাজীর গান পরিবেশন করতেন ধানের বিনিময়ে। গান পরিবেশনের সময় ছিল অগ্রহায়ণ-পৌষ মাস। অন্য সময় কখনোই বেদেদের গাজীর গান গাইতে দেখা যেত না। এই সময় কৃষক ধান তুলে আনেন উঠানে। দু-একজন চাল বা টাকাও দিতেন। গাজীর পটের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রবাদ আছে, ‘অদিনে গাজীর পট’। সঠিক সময় ছাড়া বা অসময়ে কেউ কিছু করলে এই প্রবাদটি বলা হয়। গাজীর পট হচ্ছে মূলত মার্কিন কাপড়ে আঁকা একটি চিত্রকর্ম, যা প্রস্থে চার ফুট, দৈর্ঘ্যে সাত-আট ফুট। আদিতে পটচিত্র করা হতো গামছার ওপর। ইটের গুঁড়া, বেলের আঠা, তেঁতুলের বিচির আঠাসহ নানা প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে গামছা বা মার্কিন কাপড়ে পট তৈরি করা হয়। পটের মাঝখানের বড় ছবিটি পীর গাজীর। তার দুই পাশে গাজীর ভাই কালু ও মাণিক পীরের। গাজী বসে আছে বাঘের উপর। এই ছবিটি কেন্দ্র করে আরও আছে কিছু নীতিবিষয়ক ছবি বা চিত্র। পটের গায়ক পটচিত্রটি পেঁচিয়ে হাতে রাখে। যেখানে গাওয়ার জায়গা পাওয়া যায়, সেখানে পটচিত্রটি খুলে একটি লম্বা লাঠিতে ঝুলিয়ে পেছনে এক হাতে ধরে রাখে। অন্য হাতে ছোট্ট একটি লাঠি দিয়ে পটটির বিভিন্ন অংশের ছবি চিহ্নিত করে গান গাওয়া হয়। পটের গান গায় যারা, তারা গাজীকে ভক্তি করে। তার গুনগান মানুষের প্রচার করে সম্মানের সঙ্গে।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ঠাকুরদাকে খুব মনে পড়ে। এই ছুটির দিনটি ছিল ঠাকুরদা আর আমার আড্ডাদিন। ঠাকুরদা কত গল্প যে করত। দিল্লি শান্ত হয়ে আসছে। কালও নর্দমা থেকে পাওয়া গেল চারটি লাশ। গুজরাট দাঙ্গার মতো আবছায়া ঘিরে ধরেছে আমায়। ঠাকুরদার কথা কেন যেন বারবার মনে পড়ে, মনে পড়ে যায় কয়েক দিন ধরে মাথায় ঘুরতে থাকা লাইন—
হরদম গাজীর নাম লইও
পাষাণ মনরে, হরদমে গাজীর নাম লইয়।
দমে দমে লাইয় নাম, জিরানীনা দিয়
পাষাণ মনরে, হরদমে গাজীর নাম লইয়।
ঠাকুরদার কথা আমি স্পষ্ট শুনতে পাই, তিনি বলছেন—
জানো দাদুভাই, প্রতিটি বর্ণনা গানের পর এই ধুয়াটি গাওয়া হয়। প্রথমেই বয়ান করেন গাজীর মাহাত্ম্যের কথা। সেখানে তাজ মাথায় সোনার খড়ম পায়ে গাজীর পোশাকের বর্ণনা যেমন আছে, তেমনি আছে সৃষ্টিকর্তার প্রতি গাজীর আনুগত্য ও ভালোবাসার কথা। যেমন—
আশা হাতে তাজ মাথে সোনার খড়ম পায়
আল্লা আল্লা বলে গাজী ফকির হইয়া যায়।
সুন্দরবন যাইয়া গাজী খুলিলেন কালাম
যত আছে বনের বাঘ জানায় ছালাম।।
গাজীর বাবা-মায়ের পরিচয়, তার মাহাত্ম্য ও সাধনা বর্ণনা করেন এক এক করে। গাজীকে না মানলে কী হয়, সে বর্ণনাও করেন। এর সঙ্গে নিজেদের প্রাপ্য আদায়ের জন্যও গান রয়েছে পটে আঁকা। ‘বক্ষিল’ বা কৃপণদের মরার পর কী হবে, তার ভয় দেখান।
সুন্দরবনে গাজীর পটে চম্পাবতীর দেখা মেলে পটজুড়ে। সুন্দরবন, সুন্দরবনের প্রাণ বাঘও আছে পটজুড়ে। গাজীর গল্প শেষ করে নীতিকথা—
রান্ধিয়া-বান্ধিয়া অন্ন পুরুষের আগে খায়,
ভরানা কলসের পানি তিরাসে শুকায়।
দুবদুবাইয়া হাঁটে নারী চোখ ঘোরাইয়া চায়,
অলক্ষ্মীরে দিয়া ঘরে লক্ষ্মী লইয়া যায়।।
নারীকে কম খেয়ে কম পরে সুখী থাকতে এই নীতি কথা। তবে এতে সে সময়ের নারীর কষ্টের কথা দৃশ্যমান। পুরুষের জন্য পটজুড়ে একটি নীতিকথাও নেই। সিরিয়াস এই পটের গাছে হাস্যকৌতুকও কম নেই। তবে তারও বেশির ভাগ নারীকে নিয়েই।
এই বাড়ীর কুটনাবুড়ী ওই বাড়ীতে যায়,
পথে একটা ইন্দুর মরা দুই হাতে কিলায়,
কিলাইতে কিলাইতে বুড়ী খেতা হইয়া যায়।
অথবা
চুল নাই বুড়ী খোঁপার লেইগা কান্দে,
কচুপাতার ডিপা দিয়া বড় খোঁপা বান্দে।
পটের নিচের সারিতে তিনটি ছবি। দুই পাশে দুটি ভয়ানক দানব দু’টি করে ছুরি হাতে। মধ্যখানে তাদের মা একটি পাত্রে মানুষের মুন্ডু নিয়ে বসে আছে। এই ছবিগুলো দেখিয়ে গেয়ে মানুষকে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানায়।
যমদূত কালদূত ডাইনে আরও বায়।
মধ্যখানে বইসা আছে যমরাজের মায়।
যমদূত কালদূত দেইখ্যা লইবেন তারে
দুই হাতে দুই লোহার গদা যমের মতো ফিরে।
যমরাজের মায় বইছে তামার ডেকচি লইয়া
পাপী মানুষের কল্লা দিছে সে ডেগেতে ফালাইয়া।
গাজীর পটের গান দু’টি চরণ দিয়ে শেষ হয়—
এই পর্যন্ত বইলা আমি ইতি দিয়া যাই,
আল্লায় বাঁচাইলে আবার আরেক দিন গাই।
আমি কখন যেন ঘুমিয়ে গেছি। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ঠাকুরদা দৃশ্য থেকে অদৃশ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। স্বর্গের মতো ভোর চোখে মেখে আমি উঠে বসি। বুঝতে পারি ঠাকুরদা নেই, গাজীর পটচিত্র নেই, চমকে মনে পড়ে দিল্লি নিয়ে আমি কী দেখলাম এসব এই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে! পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে—এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না…আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বিছানা ছেড়ে নেমে আসি ব্যালকনির দিকে, ক্যালেন্ডারে তখন হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ২১ ফেব্রুয়ারি।
তথ্যসূত্র
১. ভারতের চিত্রকলা, অশোক মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৫৬, পৃ ৪৭।
২. পটুয়া সঙ্গীত, গুরুসদয় দত্ত, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৯, পরিচায়িকা অংশ।
৩. ‘কালীঘাট পটচিত্র’, অশোক কুমার রায়, কলকাতা পুরশ্রী, ২০ নভেম্বর, ২০০৯, নব পর্যায়, নবম বর্ষ, একাদশ সংখ্যা, পৃ ১৬।
৪. সঞ্চয়িতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী, ১৩৪০, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ ৫১৯।
৫. https://irabotee.com/banglar-pot-patachitra/
৬. https://www.youtube.com/watch?v=WMBypS98_hw
৭. https://www.youtube.com/watch?v=1Z8dEgk9fvc
বেশ মনোহর রচনা। শুভ কামনা।
হুসেইন ফজলুল বারী
সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২১ ১৩:০৫
আহা বাংলাদেশের হিন্দুবিদ্বেষ নিয়ে লেখার মত কোন লেখক, চিত্রশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, পরিচালক, গায়ক কেউ নেই।
চন্দনা
সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২১ ২০:১৭