সর্বকালের শোষিতের সত্য

 

ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে আমেরিকায় আমরা দেখেছি—বর্ণ বিদ্বেষ, জাতি বিদ্বেষ, গণতন্ত্রের স্বাভাবিক চর্চায় ব্যাঘাত আর পেশিশক্তির প্রদর্শনী। এসব কিছু আমেরিকায় নতুন নয়। তবুও আমেরিকা আমেরিকা হয়ে ওঠার আগে নানা ধরনের শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস তো বহন করেছেই। কালো মানুষেরা বরাবরই হয়েছে শোষিত। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার জনগণ যে বিক্ষোভ এবং আন্দোলনে ফেটে পড়েছিল, সে সম্পর্কে নোম চমস্কি বলেছেন, ‘এটা ৪০০ বছরের নির্মম অত্যাচারের ফল।’ তিনি বলেন, ‘মানব ইতিহাসে দাসত্ব সবচেয়ে জঘন্যতম ব্যবস্থা, যা কিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের মূল ভিত্তি। আর কালোদের প্রতি শোষণের অবসান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনো হয়নি। কালোদের অপরাধী হয়ে ওঠার জন্য রাষ্ট্র বাধ্য করেছে।’

 উনিশ শতকের শেষাবধি সাবেক দাস রাষ্ট্রগুলোতে এরকম একটা আইন ছিল যে, কোনো কালো মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে ভবঘুরে অভিযোগে বন্দি করা হতো। এবং একটা জরিমানাও ধরিয়ে দেয়া হতো যা তার পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব হতো না। তাকে সোজা জেলে পাঠিয়ে দেয়া হতো। যেখানে নানা কাজে তাকে শ্রমিক হিসাবে কাজে লাগানো যাবে। আর হাল শতকে এসে এই মহামারির মধ্যে আমরা দেখতে পাই আমেরিকায় করোনায় কালো রোগীরা বেশি মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। এবং যে বদ্ধভূমিতে মৃতদের গণ কবর দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেখানে কবর খোঁড়া এবং সৎকারের জন্য কালো কয়েদিদের নিয়োজিত করা হয়েছে। অষ্টাদশ শতকেও আমেরিকায় ছিল রাশিরাশি দাস। ১৭৫০ থেকে ১৭৫৫ সাল, এই পাঁচ বছরে একমাত্র নিউইয়র্ক বন্দরেই নাকি জাহাজ থেকে সমুদ্রে বিসর্জন দেয়া হয়েছিল দুই হাজারের বেশি দাসের মৃতদেহ। নিউইয়র্ক আজ পবিত্র শহর বটে! কত না গৌরব তার ইতিহাসে! অথচ বন্দরে পানির নিচে কংকালের পাহাড়।

আমেরিকান ঔপন্যাসিক হারপার লি’র বিখ্যাত উপন্যাস টু কিল এ মকিংবার্ড তেমনই এক বঞ্চনা ও শোষণের দলিল। লি তাঁর উপন্যাসটি রচনা শুরু করেন ১৯৫০ সালে নিউ ইয়র্কে বসবাস শুরু করার পর। হারপার লি ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি উপন্যাসটি রচনা শুরু করলেও এটি সমাপ্ত হয় ১৯৫৭ সালে এবং ঐ বৎসরই প্রকাশিত হয়। এটির সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। লি’র উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্রগুলো তাঁর পরিবার ও প্রতিবেশী সম্পর্কে এক গভীর পর্যবেক্ষণ। তাঁর উপন্যাসের কাহিনী—জন্ম শহর অ্যালবামা অঙ্গরাজ্যের মনরোভিলে ১৯৩৬ সালে ঘটা একটি ঘটনার ছায়া অবলম্বনে। ঘটনাটি ঘটেছিল তাঁর বয়স যখন ১০ বছর।

প্রকাশের সাথে সাথেই বইটি দুনিয়া জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৬১ সালে এটি পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করে। বর্তমানে বইটি আধুনিক আমেরিকান সাহিত্যের একটি ধ্রুপদি গ্রন্থ বা ক্লাসিক বুক হিসেবে স্বীকৃত। বিক্রি হয় ৩০ মিলিয়নের মতোই। শুধু তাই নয়, এটি অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। চলচ্চিত্রটিও অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়। উপন্যাসটিতে তৎকালীন আমেরিকার জাতিগত বৈষম্যের চিত্র প্রকট হয়ে আছে। অনেক বছর ধরে বইটি আমেরিকার বিভিন্ন স্কুলে পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত। মূলত ছাত্রছাত্রীরা যেন বর্ণ-বিদ্বেষের মানসিকতা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারে তাই এটা পড়ানো হয়।

তবে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প শাসনামলে উপন্যাসটির নাট্যরূপ দেয়া হয়।  মঞ্চ নাটকটি ১ সপ্তাহে ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার আয় করে রেকর্ড গড়েছে। কিছুদিন আগেও গণতান্ত্রিক সহাবস্থানের নজির ছিল আমেরিকায়। তবুও সেই দেশে যখন রাষ্ট্রনায়কের প্ররোচনায় জাতি বিদ্বেষ-বিষে জর্জরিত হয়, তখন সেটা মানবতার পক্ষে বড় অপমানজনক। তবে রাজনৈতিক সময় আর উপস্থাপনা মিলিয়ে লি’র উপন্যাসটি যেন কালের সাক্ষী হয়ে উঠল। 

উপন্যাসের ক্ষেত্র রচিত হয়েছে অ্যালবামা অঙ্গরাজ্যের মেকম্ব নামক নিরিবিলি একটি শহরকে ঘিরে। লেখিকার ভাষায় যেটি একটি ঝিম ধরা শহর। এখানকার উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে তুলোর চাষ আর কাঠের ব্যবসা। তবে মেকম্ব শহরের দালানকোঠা আর ইমারতগুলো বেশ মনোরম। এবং প্রাসঙ্গিকভাবে, এখানকার কোর্ট বিল্ডিংটাও বেশ অভিজাত মানের। এই ‘অভিজাত মান’টা একটা রূপক যার দেখা আমরা কাহিনির পরতে পরতে দেখতে পাব। অভিজাত কোর্ট বিল্ডিং হলেই যে সেখানে ন্যায় বিচার পাওয়া যাবে এমন কোনো কথা নেই। 

মেকম্ব অঞ্চলে সাদা আর কৃষ্ণাঙ্গ দুই শ্রেণির মানুষের বাস। কালোরা এখানে সাদাদের নীরব নির্যাতনের শিকার। এ এলাকাটাকে বলা চলে একটি উপনিবেশ। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লোকজন নানা কর্মের সাথে যুক্ত হয়ে এখানে আবাস গড়েছে অনেক কাল আগেই। উপন্যাসে বর্ণিত চরিত্র নয় বৎসর বয়সী স্কাউটের পিতা এটিকাস ফিঞ্চের পূর্ব পুরুষেরাও এখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। সার্দান আমেরিকার এক ছোট্ট শহর, যেখানে একজন বিপত্নীক আইনজীবী বাবার আদরে লালিত দুই সন্তান জেম আর তার বোন স্কাউট। যাদের মন শিশু-কিশোরের মতোই পবিত্র ও নিষ্কলঙ্ক। তারা মনে করে—পৃথিবীর সব কিছুই সুন্দর, ভালো। আস্তে আস্তে তারা পৃথিবীর কদর্য রূপ দেখতে পায়। দেখে একই মানুষের কত রকম রূপ হতে পারে। 

উপন্যাসের বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, একজন কম বয়সী বালিকার দৃষ্টিতে শ্রেণিগত বৈষম্যের রূপটি ধরা পড়ে। বিশেষ করে সাদা-কালোর মধ্যকার যে ব্যবধান তার সামনে উন্মোচিত হয়, তা তাকে জগৎ সম্পর্কে এক দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দেয়। স্কাউট বর্ণনায় তার সহপাঠীদের আচরণগত দিক পর্যবেক্ষণ করে এই শ্রেণিগত দ্বন্দ্বের দিকটি বিশেষভাবে উন্মোচিত করেছে। স্কুলেও স্কাউট এই পার্থক্য সচেতনভাবে লক্ষ্য করে। স্কুলে কালোরা সবসময়ই সাদাদের অত্যাচারে জর্জরিত। মূলত সাদারা তাদের কালো সহপাঠীদের ‘নিগার’ বলে অবমূল্যায়ন করে। স্কাউটের বাবা উকিল এটিকাসকেও আড়ালে-আবডালে সাদারা ‘নিগার’ বলে ডাকে।  

প্রকাশের সাথে সাথেই বইটি দুনিয়া জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৬১ সালে এটি পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করে। বর্তমানে বইটি আধুনিক আমেরিকান সাহিত্যের একটি ধ্রুপদি গ্রন্থ বা ক্লাসিক বুক হিসেবে স্বীকৃত। বিক্রি হয় ৩০ মিলিয়নের মতোই। শুধু তাই নয়, এটি অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।

সাদা আর কালোর এই দ্বন্দ্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, উপন্যাসে বর্ণিত কৃষ্ণাঙ্গ টম রবিনসন আর শ্বেতাঙ্গ যুবতি মায়েলা। এদের দুজনকে ঘিরেই সাদা-কালোর পারস্পরিক বিদ্বেষ প্রচণ্ড রূপে ধরা দেয়। টম রবিনসন এক নিরীহ কৃষ্ণাঙ্গ যুবক। সে তার এক সন্তানসহ নিরুপদ্রব সহজ-সরল জীবনযাপন করে। এমনকি টমের এই স্বভাবজাত সারল্যের সুযোগ নিয়ে তাকে দিয়ে শ্বেতাঙ্গরা অনেক কাজকর্মও করিয়ে নেয়। টম বিনাবাক্যে সরল মনে তাদের সাহায্য সহযোগিতা করে। 

অন্যদিকে বব ইউয়েল বাজে নোংরা স্বভাবের এক বিপত্নীক শ্বেতাঙ্গ, নিকৃষ্ট চরিত্রের একজন মানুষ। সে সব সময় অপকর্ম করার জন্যই যেন প্রস্তুত থাকে। অন্যায় কাজে যার জুড়ি নেই, কালোদের একদম সহ্য করতে পারে না। এই বব ইউয়েলের কন্যা মায়েলা। একদিন মায়েলা টমকে রাস্তা থেকে বাড়ির ভেতরে ডেকে নেয় এবং অনেকটা জৈবিক আকর্ষণেই তাকে জোর করে জাপটে ধরে। আর এমন সময় বাড়িতে আবির্ভাব ঘটে বব ইউয়েলের। কন্যাকে টমের সাথে এমন অবস্থায় দেখে বব ইউয়েল সরাসরি আদালতে নালিশ করে বসে। সে অভিযোগে জানায়, টম তার মেয়ে মায়েলাকে ধর্ষণ করেছে। মিথ্যে এই কেসে গ্রেফতার হয় টম। টমের পক্ষে উকিল হিসেবে দাঁড়ান মি. এটিকাস। তবে টমের বিচার নিয়ে আদালতে চলে প্রহসন। কৃষ্ণাঙ্গ টমের পক্ষ নেয়াতে মেকম্ব অঞ্চলের সাদা মানুষেরা এটিকাসের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে থাকে। এমনকি বব ইউয়েল এটিকাসের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। 

আদালতে জুরি বোর্ড গঠিত হয় সাদাদের নিয়ে। এরা বরাবরই কালোদের প্রতি অবিচার করে এমন দুর্নাম সর্বত্রই প্রচারিত। কালোরা জানে তারা কোনো অপরাধ না করলেও, আদালতে অপরাধ প্রমাণিত না হলেও, তাদের অপরাধী করে জুরি বোর্ড আর আদালতের শ্বেতাঙ্গ বিচারকরা সে দিকেই রায় প্রদান করেন। টম রবিনসনের ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটল। টম নির্দোষ হলেও তাকে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করল জুরিগণ। আর বিচারক তাদের মতেই টমকে দোষী সাব্যস্ত করল। শ্বেতাঙ্গদের এই একপেশে বিচারের সাক্ষী হয়ে থাকল জেম আর স্কাউট, কোমলমতি এই কিশোর-কিশোরীর মনে দাগ কেটে গেল বিষয়টি। তারা এবার সম্যক উপলব্ধি করল, সাদা চামড়ার লোকেরা আসলেই কৃষ্ণাঙ্গদের চরম শত্রু হিসেবেই ভাবে এবং পদে পদে তাদের হেয় করার জন্য সর্বদা মুখিয়ে থাকে। মি. এটিকাসের দোষ তিনি কেন টমের পক্ষে দাঁড়ালেন। শ্বেতাঙ্গগোষ্ঠী এটা সহজে মেনে নিতে পারে না। শুধু তাই নয়, মায়েলার পিতা বব ইউয়েল তাকে একবার রাস্তায় পেয়ে মুখে চপেটাঘাত করে এবং তাকে দেখে নেবে বলে হুমকি দেয়। 

শুধু এটিকাস নয়, তার পরিবারবর্গের উপরও হামলা আসতে থাকে শ্বেতাঙ্গদের তরফ থেকে। জেম আর স্কাউট এক রাতে বব ইউয়েলের আক্রমণের শিকার হয়, চরমভাবে আহত হয় জেম। তবে অন্যায়ের শাস্তিস্বরূপ বব নিজের ছুরির উপরে পতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। মূলত একজন কিশোরীর ক্রমে বেড়ে ওঠা, তার সমসাময়িক কাল আর সমাজের নানা অসংগতি দর্শন—এ সব কিছুই লেখকের কলমে উঠে এসেছে খোলসহীন বাস্তব হয়ে। হারপার লি সমাজের সাদা-কালোর প্রকট অসংগতি প্রকাশ করতে নানা বিষয় তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে আইন-কানুন এবং আদালতের বিচার, জুরিদের স্বজনপ্রীতি অর্থাৎ সাদা প্রীতি, গভীর দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করে জেম আর স্কাউট। দুজন বালকবালিকার মাঝে আইনি জটিলতার দিকটিও প্রকট হয়। আর আইন কতটা একপেশে, পক্ষপাতদুষ্ট সেটাও বুঝতে পারে তারা। মানবিকতা যে সাদাদের কাছে ভুলুণ্ঠিত এটাও অনুধাবন করে খুব সহজেই।

নিরপরাধ সহজসরল কৃষ্ণাঙ্গ টমের প্রতি অবিচারের দিকটি প্রচণ্ড দাগ কাটে জেম আর স্কাউটের মনে। সাদাদের ভেতরের কালো রূপ দর্শন করে এ দুটো কিশোরকিশোরীর মাঝে পারস্পরিক বৈষম্য সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়। হারপার লি মূলত ‘মকিংবার্ড’ বলতে নিরীহ সহজসরল মানুষদেরই বুঝিয়েছেন যারা প্রতিনিয়ত অশুভ শক্তির দ্বারা নিষ্পেষিত হচ্ছেন। এই শতকে এসে বারাক ওবামার রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া কিংবা জো বাইডেন সরকারের অভিষেক অনুষ্ঠানে ২২ বছরের নিগ্রোকবি আমান্ডা গরমেনের ‘পাহাড় ডিঙানো’র কবিতার মতোই কত না পাহাড় ডিঙাতে হয়েছে সাদাদের রাজত্বে কালো মানুষদের!