ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার শৈল্পিক রূপ
‘মানুষের মনের যেমন ইতিহাস আছে, ঠিক তেমনি মানুষের দেহেরও ইতিহাস আছে।’ কথাটা আমার নয়, দার্শনিক ও মনোরোগবিশারদ কার্ল গুস্তাব ইয়ংয়ের। কথাটা তিনি বলেছেন স্মৃতি, স্বপ্ন, প্রতিফল বইয়ে। গুস্তাব আরও বলেছিলেন, ‘দেহের মতো আমাদের অচেতন মনও অতীতের পুনর্নিদর্শনের গোলাঘর ও স্মৃতির ভাণ্ডার।’ বস্তুত স্মৃতি হচ্ছে মানুষের অভিজ্ঞতাকে বর্তমানে দেখা রূপ। ব্যক্তিমানুষ যে ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে সময় আর জীবন বাহিত করে, স্মৃতি হলো তার বর্তমান আর অতীতের ভিত্তি। আর ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে যখন ব্যক্তি কিংবা সমষ্টির বিকাশ হয়, তখন ব্যক্তি বা সমষ্টিও ইতিহাস হয়ে ওঠে। ব্যক্তির এই ক্রমবিকাশ শুধু মন বা দেহের নয়, ক্রমবিকাশ তাঁর অর্জিত অস্তিত্ব কিংবা স্মৃতি রূপেও বর্তমান থাকে। স্মৃতি কখনো কখনো কোনো জনগোষ্ঠীর মুক্তির ভাষায় রূপান্তরিত হয়। সেটাকে তখন আমরা ইতিহাস বলে বিবেচনা করি। আমরা খানিক পরখ করব, চিত্রশিল্পী বীরেন সোমের শিল্পকর্মে সেটা কীভাবে জায়মান আছে।
তর্ক বাংলা আয়োজন করেছে ষাটের দশকের খ্যাতিমান শিল্পী বীরেন সোমের একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। তাঁর প্রদর্শনীর শিরোনাম ইতিহাসের স্মৃতি। কেন ইতিহাসের স্মৃতি? সহজ কথায় ইতিহাস মাত্রই স্মৃতি, কিন্তু সব স্মৃতি ইতিহাস নয়। সাধারণভাবে ইতিহাস হলো অতীতের অভিজ্ঞতা, যা মানুষের ঘটনাবহুল কর্মের লড়াই, ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত আর আচরণগত ফল। যাকে সহজ ভাষায় বলে অতীত অনুসন্ধানের জ্ঞান। এটাই ইতিহাসের বস্তুগত ভিত। প্রশ্ন হচ্ছে, শিল্পকলার সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক কী? প্রাচীনতম ধারণায় এটা শিল্পের ক্রমবিকাশের ধারা ও ধারণের অনুসন্ধান। কিন্তু ব্যক্তি যখন অতীতে সংগঠিত কিংবা বিদ্যমান ঘটনার অংশীদার হন, আর সেটা শিল্পে কোশেশ করেন, তাহলে তিনি ইতিহাসের ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। আর শিল্পে ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যোগ হয় স্মৃতির ভাণ্ডার, যা হয়ে ওঠে শিল্প প্রকরণের ভেতর দিয়ে ইতিহাসের ভাষা। চিত্রশিল্পী বীরেন সোমের বেলায়ও ঠিক তাই। তবে সেটা কীভাবে?
শিল্পী বীরেন সোমের জন্ম ভারত ভাগের এক বছর পর, মানে ১৯৪৮ সালে। তাঁর শিশুকালেই পূর্ব পাক-ভূখণ্ডে তখন বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। ফলে ভাষার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আন্দোলনের উত্তাপ আর প্রভাব তিনি কৈশোরে পেয়েছেন। যদিও তাঁর পূর্ণ বিকাশকাল ষাটের দশকে। চারুকলায় পড়াশোনা, রাজনৈতিক আন্দোলন, স্বাধীনতার যুদ্ধ আর নতুন রাজধানী ঢাকার স্বপ্ন—সবকিছু মিলিয়ে তাঁর তারুণ্যকে ইতিহাসের অংশ করে তুলেছিল। বীরেনের কাছে ইতিহাস ব্যক্তির একক নিয়ামক নয়, ইতিহাস হচ্ছে সর্বজনীন শুক্তির নতুন বাতাবরণ। ফলে শিল্পকে তিনি ঐতিহাসিক ঘটনার প্রকরণের আধার করে তুলেছেন। তাঁর ইতিহাসের স্মৃতিও একটি নবসমাজ কাঠামোর পুনর্জন্মের মতো। কারণ, একজন ঘটনাবহুল ইতিহাসের সন্তানের কাছে অতীতের ফেলে আসা স্মৃতি কেমন হতে পারে, তার সাক্ষ্য আমরা কিন্তু বীরেনের শিল্পকর্মে পাই। ঠিক এখানেই আমরা আলোচনার আলো ফেলতে চাই।
শিল্পকলায় বীরেন সোমের উন্মেষ ঠিক বিমূর্তবাদের চর্চার ভেতর দিয়ে হয়নি। তাঁর শুরু হয়েছিল বাস্তববাদের শিল্প দিয়েই। আর বিকাশ ঘটেছে বিমূর্ত শিল্পের ভেতরেই। কারণ, দুটোই—তাঁর বাস্তববাদী চিত্রকর্মের মূলে আছে রাজপথে হাজির থাকা, আর বিমূর্তবাদী প্রকরণের বিকাশ স্মৃতি নির্ভরতায়। স্মৃতি মানে পুনর্জন্ম নয়, পুনর্জাগরণ। প্রথম কারণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের বিভিন্ন সময়ে আঁকা তাঁর ড্রয়িং আর শিল্পাক্ষর। সেটাই বাস্তববাদের ভেতর বেঁচে থাকা একজন শিল্পীর অস্তিত্বের জানান দেওয়া। দ্বিতীয় কারণ, শিল্পকর্মে স্মৃতিসত্তার ভেতর ইতিহাসের অধরা জগৎ নির্মাণ। প্রশ্ন হচ্ছে, বীরেনের শিল্পের ক্ষেত্রে সেটা কীভাবে ঘটেছিল? আমরা তাঁর কয়েকটা দিক বিবেচনায় আনতে চাই। প্রথমত তাঁর শিল্পকর্মের ভাষাগত প্রকরণ, দ্বিতীয়ত রঙের ব্যবহার আর স্মৃতিসত্তা কীভাবে শিল্পে কাঠামোর রূপ দেয়।
শিল্পকলায় বীরেন সোমের উন্মেষ ঠিক বিমূর্তবাদের চর্চার ভেতর দিয়ে হয়নি। তাঁর শুরু হয়েছিল বাস্তববাদের শিল্প দিয়েই। আর বিকাশ ঘটেছে বিমূর্ত শিল্পের ভেতরেই। কারণ, দুটোই—তাঁর বাস্তববাদী চিত্রকর্মের মূলে আছে রাজপথে হাজির থাকা, আর বিমূর্তবাদী প্রকরণের বিকাশ স্মৃতি নির্ভরতায়। স্মৃতি মানে পুনর্জন্ম নয়, পুনর্জাগরণ। প্রথম কারণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের বিভিন্ন সময়ে আঁকা তাঁর ড্রয়িং আর শিল্পাক্ষর। সেটাই বাস্তববাদের ভেতর বেঁচে থাকা একজন শিল্পীর অস্তিত্বের জানান দেওয়া। দ্বিতীয় কারণ, শিল্পকর্মে স্মৃতিসত্তার ভেতর ইতিহাসের অধরা জগৎ নির্মাণ।
চিত্রশিল্পী বীরেন সোম © প্রতিকৃতি এঁকেছেন শিল্পী মুর্তজা বশীর [২০০৭]
প্রথমত, তর্ক বাংলায় প্রদর্শিত বীরেন সোমের শিল্পকর্মে দেখা মেলে বিমূর্ত প্রকরণের ভাষা। বিমূর্ত এই অর্থে যে, অবয়বহীন বিন্দু বিন্দু আকারের সমাহার। বিষয় আবছা। আবছা ভাষার এই প্রকরণ মনে হতে পারে নির্বিকার, সরল আর নানা সংগঠিত ঘটনাপ্রবাহের সূচিমুখ। ইতিহাসে মুখ ফেরাবার ঝাপসা স্মৃতির আকর। যেন যে জীবন শিল্পী পার করেছেন, সেই জীবনই তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন। বিস্মৃত জগৎ তাঁর অধরা রূপে ধরা দেয়। বিমূর্ত শিল্পের প্রথাগত কাঠামোর রূপ বিবেচনা করলে দেখা যাবে—বস্তুহীন অবয়ব, রূপকহীন, অনির্দিষ্ট আকার আর রেখার জ্যামিত্যিক রূপের ধরন। ফলে এই শিল্পভাষার এমন প্রকরণকে বলা হয় কংক্রিট শিল্প। কারণ, শিল্পে সমস্ত দ্বারই উন্মুক্ত থাকে এতে। যদিও এমন মতবাদের বিরোধী ছিলেন কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো। পিকাসোর পাল্টা মত, ‘এটা শিল্পের সেতুবন্ধ’। শিল্প রসিক এর্নেস্তো হিমেনেথ একবার পিকাসোকে প্রশ্ন করেছিলেন, শিল্প কি বিমূর্ত হওয়া উচিত? তাঁর সাফ জবাব, না! বিস্তৃত আলাপে তাঁর সারকথা এই—এটা বিচ্ছিন্ন দূরত্বকে শিল্পে সেতুবন্ধ রচনা করা। মানে শিল্পকে এক সুতোয় বাঁধা। পিকাসোর শিল্পভাবনার আলোকে বলা যায়, শিল্পী বীরেন সোম অতীতের স্মৃতিকে ইতিহাসের আলোকে এক ক্যানভাসে এঁকেছেন।
দ্বিতীয়ত, শিল্পী বীরেন সোমের শিল্পকর্মে রঙের ব্যবহার কেমন? শিল্পের ভাষার সঙ্গে ক্যানভাসে রঙের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা রং শুধু শিল্পের আকার দেয় না, প্রতীকী রূপে শিল্পের বার্তাও হাজির করে। ক্যানভাসের রং হচ্ছে শিল্পীর আবেগের প্রবহমান গতি। এই গতি কোনো পরিস্থিতি বা সংঘটিত ঘটনার মুহূর্তকে চিহ্নায়নে রং শিল্পকে অর্থ আরোপ করে। কেননা প্রস্ফুটিত রং শিল্প আর শিল্পীর যোজনা স্থাপন করে। বীরেনের শিল্প ক্যানভাসে দেখা যায়—সাদা রঙের আস্তরণের ওপর কখনো লাল-কালো, কখনো সবুজ-কালো, কখনো হলুদ-কালো, কখনো নীল-কালো, আবার কখনো হালকা সবুজাভ রঙের মাঝখানে কালো বৃত্ত দেওয়া। নানা ঘটনাপ্রবাহের মতো আবেগের পরিবর্তনকে অনুসরণ করে এমন রঙের রূপায়ণ। এটি শুধু পরিবর্তিত ঘটনা কিংবা পরিস্থিতির সৌন্দর্য রূপায়ণ নয়, স্মৃতিজাগানিয়া নানা বক্তব্যও সামনে আনে।
তৃতীয়ত, প্রশ্ন হলো ইতিহাসের স্মৃতিসত্তা বীরেনের শিল্পকর্মে কীভাবে হাজির থাকে? নানা প্রকরণ আর অবয়বে সেটা দেশ বা ভূখণ্ড, মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার মূল্যবোধকে একাকার করে দেখার প্রয়াস সৃষ্টি করে। কোনো কোনো চিত্রকর্মে লালাভ রঙের ব্যবহার এতই প্রকটিত যে, সেটা কেবলই একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের লালাভ রক্ত কিংবা ছোপ ছোপ বিভীষিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে তাঁর চিত্রকর্মের ভালো দিক—একক ব্যক্তির অবয়ব না এঁকে তিনি রক্তকেই প্রতীকী করেছেন। এটিই শিল্পের সামষ্টিক প্রকরণ। এমন প্রতীকী রূপে তিনি কোনো কোনো ক্যানভাসে সৃষ্টি করেছেন সবুজ-কালোর শোকাবহ আবহ। এমনকি, কোনো কোনো ক্যানভাসে উজ্জ্বল সোনালি রঙের হলুদাভ দৃশ্য, মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত বার্তাকে সামনে এনে দেয়। মোটাদাগে বলা যায়, বীরেনের শিল্পে লড়াই-সংগ্রামের অতীতের ক্ষতচিহ্ন যেমন আছে, ঠিক তেমনি আছে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। আছে শোকাকুল আবহ, হতাশার সফেদ জমিন, ঠিক তেমনি আছে সামষ্টিক মানুষের স্বপ্ন আর জাগরণের দৃশ্য।
চিত্রশিল্পী বীরেন সোম বাংলাদেশের বিমূর্তবাদী একজন আধুনিক খ্যাতিমান শিল্পী। বাংলাদেশের চিত্রকলা বিকাশের যে বিমূর্ত আধুনিক ধারা, তিনি সেই যাত্রার একজন পথিক শিল্পী। তবে শিল্পের আকাঙ্ক্ষা, অনুভূতি আর অভিজ্ঞতা তাঁর স্মৃতিসত্তাকে ইতিহাসের রূপকল্পে শিল্পের মহার্ঘ্য দান করেছে। শিল্পসত্তার সঙ্গে স্মৃতিসত্তার এমন মিলনকে আমরা বলতে পারি ইতিহাসের স্মৃতি। যা শুধু যাপনের অস্তিত্বকে স্মৃতির মণিকোঠায় নাড়া দেয় না, ইতিহাসকে বর্তমানের দুয়ারে উন্মীলিত করে। হয়তো এমন জিজ্ঞাসাও বাতুলতা হবে না, আকাঙ্ক্ষার পথ পদদলিত হলে আমাদের মুক্তি কোথায়? উত্তর একটাই—মুক্তি যুদ্ধে!
তত্ত্বতালাশ
১. Memories, Dreams, Reflections: C. G. Jung [Author], Aniela Jaffe [Editor], Clara Winston and Richard Winston [Translator], Vintage, London, 1989.
২. আমি, আমার ছবি: পাবলো পিকাসো, ভাষান্তর ও সংকলন বিন্যাস: সন্দীপন ভট্টাচার্য, মনফকিরা, কলকাতা, ২০১৩।
চমৎকার পর্যলোচনা.. শিল্পীর অঙ্কিত দুটি ছবি সংযুক্ত করা যায় কি...?
অংকুর চন্দ্র দেবনাথ
আগস্ট ২৫, ২০২১ ১৫:৩৭
আমরা খুবই ভাগ্যবান চিত্রশিল্পী বীরেন সোম এর মতো সংগ্রামী শিল্পী পেয়েছি। চিত্রশিল্পী বীরেন সোমের এ পর্যন্ত যে শিল্পকর্মগুলো দেখেছি অসাধারণ নান্দনিকত ছিস ????
ফয়সাল আহমেদ
আগস্ট ২৪, ২০২১ ১৮:৪৩