চারুকলার প্রথম মডেল শতবর্ষের দাদু
বেতবন বেয়ে নেমে আসা ছায়ার সাথে কথা হয়েছে অনেক। মাছধরা মানুষ, জালের সূক্ষ্ম বুনন, পাখির বিচিত্র কথন, শুভ্র কাশবনের মায়াবী ক্যানভাস আর বকুলের সুগন্ধ হাত ধরে বড় করেছে আমাকে। নদীবিধৌত সরল মাটির গন্ধে আমার জন্ম হয়েছিল এক উর্বর সবুজ গ্রামে। ঢাকায় এসে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে চলেছি। কিন্তু দাদুর মতো বিষাদহীন মানুষ খুব বেশি একটা পাইনি! এই দাদু সবার দাদু হওয়ার উদারতা নিয়ে বসে থাকতেন, হেঁটে চলতেন বা গান ধরতেন। তিনি প্রতিটি প্রহরে বিলিয়ে চলতেন অশেষ ভালোবাসা, আন্তরিক কথামালায় নিষ্পাপ জ্ঞান। তাঁর চেহারায় ভেসে থাকত শীতল নদীর মতো শান্ত অভিব্যক্তি। দাদু ছিলেন আমার ভালো লাগার মানুষ; কারণ, মানুষের স্বপ্নকে তিনি সুদূরের পথ দেখাতে জানতেন।
প্রায় আট বছর ধরে আমি দাদুর অসংখ্য ছবি তুলেছি। তিনি আমার ক্যামেরার আনন্দ হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৯৩ সালে পড়াশোনার সুবাদে আমি গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসি। ভর্তি হই ঢাকা কলেজে। থাকতাম পলাশী স্টাফ কোয়ার্টারের একটি ছোট্ট বাসায়। একদিন চারুকলার পাশ দিয়ে যেতেই হঠাৎ দাদুর দেখা পেলাম। তিনি চারুকলার দেয়াল ঘেঁষে নানা রকম গয়নার পসরা সাজিয়ে বসে আছেন। তাঁর ব্যতিক্রমী পোশাক, কথা বলার ভঙ্গি আর চেহারার শুদ্ধতা আমাকে বেশ আকর্ষণ করল। আগে কখনো তাঁকে দেখিনি, তবু মনে হলো তিনি খুব চেনা। কার সঙ্গে যেন চেহারার খুব মিল; কিন্তু মেলাতে পারি না। সবকিছু কেমন যেন রহস্যময় লাগে। রাতে হঠাৎ করে চোখের সামনে রবীন্দ্রনাথের মুখটা ভেসে আসল। ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথের ‘নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে/ তিল ঠাঁই আর নাহি রে’ কবিতাটি পড়ে ভেবেছি বড় হয়ে কবি হবো। ফলে তাঁর একটা প্রভাব আমার মধ্যে ছিল। হঠাৎ যেন দাদুর চেহারার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের একটা মিল খুঁজে পেলাম।
এর অনেক পর আমার সংবাদচিত্রী হিসেবে আলোকচিত্র সাংবাদিকতা জীবন শুরু হলো। সংবাদচিত্রের পিছু পিছু আমার সময় কেটে যায়। হঠাৎ একদিন দাদুর কথা মনে হয়। এক বিকেলে দাদুকে খুঁজতে চারুকলায় যাই। ওই দিন তাঁর কয়েকটা ছবি তুলি। এরপর প্রায় প্রতিদিন তাঁর কাছে যাই, সুযোগ পেলে ছবি তুলি। প্রথম দিকে দাদু আমাকে খুব বেশি একটা পাত্তা দিতেন না। পরে দেখলাম, তিনি আমার ক্যামেরার সামনে অনেক সাবলীল হয়ে গেছেন। আমি ছবি তুললে তিনি আনন্দ অনুভব করেন। দাদু মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন না। তিনি তাঁর ব্যাগে আমার ভিজিটিং কার্ডটি খুব যত্ন করে রাখতেন। কয়েক দিন দেখা না হলে কারও মোবাইল থেকে ফোন করে বলতেন, ‘আপনার কথা মনে হচ্ছিল খুব।’ ফোন পেলে আমি দাদুর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। এভাবে আট বছরে আমি তাঁর সাড়ে পাঁচ হাজার ছবি তুলেছি। দাদু সব সময় তাঁর হাতে একটি পানির বোতল রাখতেন। অবহেলিত পশুপাখির প্রতি তাঁর ছিল অসম্ভব দরদ। দুপুরের খাবারের সময় কাক কিংবা কুকুর-বিড়াল এলে তিনি তাদের না দিয়ে খেতেন না। ছবি তোলার সময় আমি তাঁকে কোনো নির্দেশনা দিতাম না। তিনি তাঁর মতো থাকতেন আর আমি আমার মতো ছবি তুলতাম।
এই ছবি তোলার ফাঁকে ফাঁকে দাদুর কাছে শুনতে চাইতাম তাঁর জীবনের নানা গল্প। নদীভাঙা অঞ্চলের মানুষ তিনি। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঘঢ়িষা গ্রামে তাঁর পৈতৃক ভিটা। দাদুর মায়ের নাম আছিয়া বেগম, বাবা গনি মৃধা। পাঁচ বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবাকে হারান। ফলে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন তিনি। একসময় মায়ের সঙ্গে তাঁর আশ্রয় মেলে নানার বাড়ি গোপালপুরে। সেখানেই একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হন তিনি। পড়েছিলেন কিছুদিন। কিন্তু মাদ্রাসায় পড়তে তাঁর ভালো লাগেনি। তিনি চেয়েছিলেন স্কুলে পড়তে। সেই সময় নদীঘেরা ওই অঞ্চলে মুসলমান ছেলেদের স্কুলে পড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। ফলে তাঁর আর পড়া হয়নি। মান-অভিমানে দাদু ঘরছাড়া হন। দাদু বলতেন, ‘আপনাকে যা বলে গেলাম, তা আর কাউকে বলিনি। অবশ্য আপনার মতো কেউ আমাকে জানতেও চায়নি।’
মমিন আলী মৃধা © ছবি: সাহাদাত পারভেজ
দাদু কখনো নির্দিষ্ট করে তাঁর নিজের বয়স বলতে পারেননি। তবে মায়ের কাছে শুনেছিলেন, আশ্বিন মাসে জন্ম। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল তিরিশের কাছাকাছি। যুদ্ধকর্মী হিসেবে তিনি কিছু সময় লুসাই পাহাড়ে ছিলেন। সেই পাহাড়ের একটি মেয়ের নামও ছিল লুসাই! তাঁর সঙ্গে দাদুর খুব ভাব হয়েছিল। লুসাই কাঠ ও বাঁশ দিয়ে গয়না বানাতে জানত। ষোড়শী লুসাইয়ের গায়ে পাহাড়ি অলংকার দাদুকে মুগ্ধ করত। দাদু একদিন নিজের হাতে অলংকার বানিয়ে লুসাইকে দিলেন। সামান্য উপহার পেয়েই লুসাইয়ের চোখে আলো ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল। সে-ই প্রথম কোনো নারীর জন্য আকুতি অনুভব করেন দাদু। কিন্তু এই দাদু যে যাযাবর—যুদ্ধ তাঁকে নিয়ে যায় ভারতের মণিপুর রাজ্যের ইম্ফল ও নাগাল্যান্ড রাজ্যের কোহিমা, ডিমাপুরসহ নানা জায়গায়। যুদ্ধ শেষে দাদু ফিরে গেলেন লুসাই পাহাড়ে। কিন্তু লুসাইকে আর পাওয়া গেল না। সেই পাহাড়ে কোনো জনমানুষের চিহ্ন ছিল না। ভূমিকম্প ধ্বংসলীলা চালিয়ে সবকিছু মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। সেখান থেকে ব্যাথাতুর হৃদয়ে দেশে ফিরে আসেন দাদু। এসে সংসার পাতেন।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন থেকে দাদু সপরিবার ঢাকায়। চাকরি করতেন ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আলী আহমেদের ডাকবাংলোর ফুলবাগানে, মালি হিসেবে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মাঝেমাঝেই সেই ডাকবাংলোয় যেতেন। সেখানেই দাদুর সঙ্গে শিল্পাচার্যের পরিচয়। শিল্পাচার্যের হাত ধরে তিনি চারুকলায় এলেন। এসে মডেল হলেন; আর সান্নিধ্য পেলেন বহু শিল্পীর। জীবনের পুরোটা সময় তিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে। অন্তরে লালন করেছেন বাউলিয়ানা। সাধুসংঘে ঘুরে ঘুরে আত্মস্থ করেছেন লালনের গান। ’৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি চারুকলার মডেল ছিলেন। এরপর তিনি গয়না বানানোকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
একদিন দাদুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আপনি কেন গয়না বানান? দাদুর সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘লুসাইয়ের জন্য’। লুসাই তো নাই। দাদু বললেন, ‘আমি কল্পনায় লুসাইকে দেখতে পাই। আমার গয়না পরে সে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে চঞ্চল হয়ে ওঠে। এ দেশের নারীরা যখন আমার বানানো গয়না পরে, আমি তখন তাঁদের মাঝে লুসাইয়ের সৌন্দর্যটা দেখতে পাই।’
আমি দাদুকে নানা রকম প্রশ্ন করতাম। কিন্তু তিনি আমার সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে চাইতেন না। একদিন তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ‘আমাকে যে আপনি আপনার এত গোপন কথা বলেন, আপনি কি আমাকে চেনেন?’ দাদু বললেন, ‘আমি আপনাকে ভালো করেই চিনি; আপনি আমার পীরের দেশের মানুষ।’ ‘কোথায় আপনার পীরের দেশ?’ দাদু বললেন, ‘বাউশিয়া’। বাউশিয়া শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! আমার শৈশবের কত স্মৃতি বাউশিয়ার সঙ্গে। মনে হলো, এই লোক সাধারণ কোনো লোক না।
দাদু আমার নামটা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারতেন না। আমাকে ‘সাহাদাত পারভীন’ ভাই বলে ডাকতেন। দাদুর হাসিমাখা এই আদুরে ডাকটা আমি এখনো ঘুমের মধ্যে মাঝেমাঝে শুনতে পাই। এক রাতে দাদু তাঁর দুই ছেলে লাবু আর হাবিবকে নিয়ে চারুকলার গেটে বসে আছেন। তিনি তাঁর ছেলেদের বলছিলেন, আমার সঙ্গে নাকি আজ রাতে তাঁর দেখা হবে। লাবু কাকা বললেন, ‘আব্বা, রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। চলেন বাসায় চলে যাই। সাহাদাত কাকার সঙ্গে তো আপনার আগে থেকে কোনো কথা হয় নাই। উনি এত রাতে কোথা থেকে আসবেন?’ দাদু বললেন, ‘ধৈর্য ধরো। কত মানুষ রাস্তায় ঘুমায়। আজ না হয় আমরা রাস্তায়ই থাকলাম।’ আমি পত্রিকার কাজ শেষে বাসায় ফিরব। হঠাৎ মনে হলো টিএসসি ঘুরে তারপর বাসায় যাই। চারুকলার পাশ দিয়ে যেতেই দাদু ও তাঁর ছেলেদের দেখে মোটরবাইক থামিয়ে দিই। ‘আপনারা এত রাতে এখানে!’ দাদু একবার আমার দিকে তাকালেন। তারপর লাবু কাকার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বলছিলাম না আজ রাতে দেখা হইবো।’ দাদু তাঁর দুই ছেলের হাত আমার হাতে তুলে দিলেন। বললেন, ‘পারভীন ভাইকে তোমাদের সামনে রেখে গেলাম। আমার অবর্তমানে যেকোনো কিছুতে তাঁর পরামর্শ নিয়ো।’
দু্ই সন্তানসহ মমিন আলী মৃধা © ছবি: সাহাদাত পারভেজ
আমি দাদুকে নিয়ে দুটি প্রদর্শনী ও প্রকাশনা করেছিলাম। একটি দাদুর জীবদ্দশায়, ২০০৮ সালে। জয়নুল গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত সেই প্রদর্শনীতে অতিথি হয়ে এসেছিলেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ও অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। দাদু ছিলেন অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। সেদিন তিনি কী যে খুশি হয়েছিলেন; বলছিলেন, ‘আজকের দিনটা আমার জীবনে বড় আনন্দের দিন। এর চেয়ে বেশি আনন্দ আমি কোনো দিন পাই নাই।’ দাদুর দ্বিতীয় প্রদর্শনী করি ২০১২ সালে ঢাকা আর্ট সেন্টারে। প্রদর্শনী উপলক্ষে ‘শতবর্ষের পথিক’ নামেও একটি দ্বিভাষিক ফটো অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এই অ্যালবাম প্রকাশের ছয় মাস আগে দাদু একদিন বলছিলেন, ‘যা করার তাড়াতাড়ি করেন। সময় কিন্তু বেশি দিন নাই।’ দাদুর কথা শুনে ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। অ্যালবামটি প্রকাশের জন্য স্পন্সর পেতে দেরি হয়ে গেল। ফলে দাদু আর দেখে যেতে পারলেন না।
২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর দুপুরে লাবু কাকার ফোন পেলাম। আমি তখন মেহেরপুরে। জানলাম, দাদু আর নেই। লাবু কাকা জানালেন, শেষ রাতে দাদু আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এত রাতে আমাকে ফোন করাটা ঠিক হবে না ভেবে দাদুকে বলেছিলেন, সকালে আমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিবেন। কিন্তু জীবিকার খাতিরে লাবু কাকা সকালে চারুকলায় চলে এলেন। গয়নার দোকান খুলে বসলেন। আর ওদিকে মাঘের হাড় কাঁপানো শীতে দাদুর শরীরটা জমে বরফ হয়ে যায়। ওই রাতে দাদু আমাকে কী বলতে চেয়েছিলেন, সেটি আমার পক্ষে আর কখনো জানা সম্ভব হবে না!
দাদুর মৃত্যুর পর আমার চারুকলায় যেতে ইচ্ছে করত না। পেশাগত কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেতে হলে আমি ঘুরে অন্য দিক দিয়ে যেতাম। একদিন ফটোগ্রাফির ক্লাস নিতে যেতে হলো চারুকলায়। গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখি, যেই আমগাছটার নিচে দাদু বসতেন, সেই গাছটা নেই। মনটা খাঁ খাঁ করে উঠল। ক্লাসে গিয়ে শুনলাম, গাছটিতে আমের মুকুল ধরেছিল। কিন্তু হঠাৎ গাছটা মরে গেল। একদিন ক্যাম্পাসে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের রুমে বসে গল্প করছিলাম। স্যারকে বিষয়টা জানালাম। স্যার বললেন, ‘মানুষের সঙ্গে গাছের একটা আত্মিক ব্যাপার আছে। মানুষ চলে গেলে গাছও চলে যায়।’
দাদুর আসল নাম ছিল মমিন আলী মৃধা। তাঁর মতো একজন সাধারণ মানুষ কেমন করে সবার ভালোবাসার ‘দাদু’ হয়ে গেলেন—সেই বিস্ময় আমার এখনো কাটে না। তবে এতটুকু বুঝতে পারি, শিল্পের বেদিমূলে তাঁর জীবন সমর্পিত ছিল। ফলে চারুকলা গড়ে ওঠার কাল থেকে দাদু এই চত্ত্বরকে আপন ভেবে নিয়েছিলেন। তাঁকে নিয়ে আলোকচিত্র হয়েছে, চলচ্চিত্র হয়েছে; বহু ক্যানভাসে শিল্পকর্ম হয়েছেন—এই অর্থে তিনি বহুল চর্চায় চর্চিত। চর্চার এই বাহুল্যের পরও এই বিষয়কেই উপজীব্য করার সাহস দেখিয়েছি নদীপাড়ে বেড়ে উঠেছি বলে। বাড়ির চারপাশ দিয়ে অজস্র জলরাশি নিয়ে নিত্য ছুটে চলে মেঘনা, গোমতী, ফুলদী আর কাজলী। একই জলের এত রূপের সঙ্গে পরিচিত বলে একঘেয়েমির ভীতি আমাকে গ্রাস করতে পারেনি। আমার ক্যামেরা ও মনের কাব্যময়তার প্রকাশ শতবর্ষের পথিক।
দেখুন ► সাহাদাত পারভেজের আলোকচিত্র প্রদর্শনী