শিল্পে নিরর্থকতার সৌন্দর্য!
মহামারি মানুষকে নতুন সংকট আর অভিজ্ঞতা দিয়েছে। প্রাণের অস্তিত্বের সংকট তাকে বাঁচার লড়াইয়ে শামিল করেছে। কারণ, অতিমারিকবলিত দুনিয়ায় অপ্রাকৃতিক মৃত্যু জীবন সম্পর্কে মানুষকে নতুন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। অতীতেও এমন প্রশ্নের ঘটনা ঘটেছে, বর্তমান বলবৎ আছে কিংবা ভবিষ্যতে ঘটবে। প্রশ্ন মানে সংকট কিংবা কোথাও অধরা জগৎ আছে। কোথাও অজানা অর্থ লুকিয়ে আছে, যা মানুষের সজ্ঞার বাইরে। যা মানুষের দৃশ্যমান জ্ঞানজগতের বাইরের ঘটনা। যেকোনো শিল্পের সঙ্গে বাস্তব বা অতিবাস্তব ঘটনা অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত। শিল্প বিকাশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা মিলবে, মহামারির ভয়াবহ পরিস্থিতি মানুষকে নতুন চিন্তা, নতুন উপলব্ধি, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আর নতুন জগতের সন্ধান দিয়েছে। একাকিত্ব আর অসহায়ত্ব তাকে নতুন জগতের মুখোমুখি করেছে। শিল্পের সেই রূপ আর প্রকৃতি কেমন করে চিন্তার আদল বদলে দেয়, দেখবার খানিকটা পথ করে দিয়েছেন বাংলাদেশের আশির দশকের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী ওয়াকিলুর রহমান। তর্ক বাংলা আয়োজন করেছে তাঁর একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর। প্রশ্ন হচ্ছে, কী আছে তাঁর শিল্পকর্মে?
আমরা তাঁর শিল্পকর্মের কয়েকটি দিক দৃষ্টিপাত করতে চাই। প্রথমত শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর নাম ‘দরকারি নিরর্থকতা’। কেন তিনি নিরর্থকতাকে দরকারি বলছেন? দর্শনের কথা বিবেচনা করলে বলা যাবে, প্রকৃতিতে কোনো বস্তু অনরর্থক নয়। বস্তুমাত্রই অর্থবোধক। কারণ, বস্তুর ধর্মই অর্থের রূপান্তর ঘটানো। বস্তুর রূপান্তর কখনো ক্ষমতাকেন্দ্রিক, কখনো ব্যবহারিক কিংবা কখনো প্রাকৃতিক। আর মানুষ সেই অনরর্থকতাকে নব অর্থে রূপ দান করে। মানে, অর্থ তার ব্যবহারিক উপযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন করে। তবে সাধারণত ভাবা হয়, অনরর্থক বস্তুর ব্যবহারিক মূল্য বাহ্য। কিন্তু প্রকৃতির বিন্যাসে সকল বস্তুই সমান। প্রকৃতি তার সকল বস্তুকে আপন আলয়ে সাজায়। মানে বস্তুর ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র থাকলেও তা একীভূত থাকে প্রকৃতির বিন্যাসে। তবে শিল্পে বস্তুর বিন্যাস শুধু প্রকৃতির সজ্জা নয়, শিল্পীরও নিজস্ব যুক্তি-কাঠামোর হস্তক্ষেপ থাকে। কিন্তু শিল্পী যখন কোনো ‘অদরকারি’ বস্তুকে ‘দরকারি’ রূপে হাজির করেন, তখন ভিন্ন অর্থ বহন করে। সেই অর্থ কী?
‘দরকারি নিরর্থকতা’ নামায়নের মানে খাড়ায় ‘অদরকারি বস্তুর দরকারি অর্থ’। অথবা কথাটা ঘুরিয়ে বলা যায়, যে বস্তুর কোনো অর্থগত উপযোগিতা নেই, তবু দরকারি। যেন এই নিরর্থক বস্তুর উপাদান অদরকারি নয়। সর্বোপরি নিরর্থকতাকে দরকারি করে তোলা। দর্শনের ভাষায় বললে—‘দরকার’ মানে ‘প্রয়োজন’ কিংবা উপযোগপূর্ণ উপাদান। আর ‘নিরর্থক’ মানে যার কোনো অর্থ নাই। যার কোনো ব্যবহারিক মূল্য নাই। উপযোগহীন উপাদান, যা দরকারি শিল্প হয়ে উঠছে। শিল্পের ভাষ্যে—‘দরকারি লোকের অদরকারি কথা’ কিংবা ‘অদরকারি বস্তুর দরকারি কথা’১। শিল্পী ওয়াকিল সেই কাজটি তাঁর শিল্পকর্মে করেছেন। অবহেলাপূর্ণ বস্তুর বাস্তব উপাদানকে শিল্পে হাজির করেছেন। তাঁর ভেতর আছে চাবির রিং, পোশাক ইস্ত্রির শয্যা, অকেজো প্যান্ট, ছেঁড়া জুতো, ভাঙা চেয়ার, ছেঁড়া পর্দা, পুরাতন জামা, শলার ঝাড়ু, ক্ষয়ে পাওয়া সাবান, ভাঙা স্যুটকেস, বাজারের অকেজো থলেসহ নানা মনিহারি উপাদান। ক্যানভাসে প্রদর্শিত কোনো কোনো উপাদান প্রাত্যহিক ব্যবহার্য, আবার কোনো কোনো উপাদান ব্যবহারের উপযোগহীন বস্তু। আপাত-ক্যানভাসে এসব অদরকারি বস্তুর নান্দনিক উপস্থাপন শিল্পের হেঁয়ালি মনে হতে পারে। কিন্তু লক্ষ করার বিষয়—ক্যানভাসে দৃশ্যমান বস্তুর প্রকরণ যুক্তিনির্ভর। প্রশ্ন—সেই কাঠামোগত প্রকরণ কী?
তাঁর বিশাল ক্যানভাসে অবয়ব বা দৃশ্যমান বস্তুর খুদে-উলম্ব উপস্থিতি শূন্যবোধের সৌন্দর্য হাজির করে। শিল্পের এই পদ্ধতি গুণগত রূপের প্রকাশ, তবে পরিমাণগত নয়। ফলে সেটা ক্যানভাসে সামঞ্জস্য আর নির্বিরোধ ছন্দ আকারে দৃশ্যমান থাকে। গূঢ় অর্থে বলা যায়, উপযোগহীন অবয়বের ভেতর আরামদায়ক প্রশান্তি। কেননা সময়োচিত ঘটনা আর অনুধাবনমূলক অভিজ্ঞতা—দুটোই শিল্পে পরিমিতি দিয়েছে।
আত্মপ্রতিকৃতি © ওয়াকিলুর রহমান
শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান শিল্পের নানা মাধ্যমে কাজ করেছেন। তবে প্রদর্শনীর উপস্থাপিত শিল্পকর্মে তিনটি পদ্ধতি বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। তাঁর প্রধান অবলম্বন বস্তু বা অবয়বের পরিপাটি উপস্থাপন। কেননা ক্যানভাসে অকেজো বস্তু বা অবয়ব গোছানো সুন্দর লালিত্য বহন করছে। শূন্য ক্যানভাসের ভেতর শিল্পের উপাদান পরিপার্শ্বে বড় শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। সেই শূন্যতা ব্যক্তির অর্থহীন সময়কে ধারণ করে আছে। বলা যায়, ক্যানভাসের উপাদান ভারসাম্যপূর্ণ শূন্যতায় ভরা। কোথাও কোনো বাড়তি চাপ নেই। মনে হতে পারে, ওয়াকিলের ক্যানভাসে অবয়ব শয্যা উদ্দেশ্য এবং প্রণোদিত। হয়তো তাই! যা শিল্পের সঙ্গে ব্যক্তির একাকিত্ব যাপনের উৎসব। কেননা শূন্যতা হলো ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতার একক। এই বিচ্ছিন্নতা ব্যক্তির আপন সিদ্ধান্ত নয়, বরং বলা চলে—অতি প্রাকৃতিক কার্যকারণ! অতিমারি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিকে আলাদা করে দেওয়ার ফলই হলো বিচ্ছিন্নতা। দর্শনের ভাষায় বললে—এটাই সামাজিক শূন্যতা! যে শূন্যতা মানুষের পক্ষে উপেক্ষা অসম্ভব। ক্যানভাসে সেই শূন্যতাকে ওয়াকিল শিল্পিতভাবে উদ্যাপন করেছেন। বস্তুত মানুষের একাকিত্ব শুধু ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা নয়, বস্তুর প্রয়োজনীয়তা ফুরালে ব্যক্তিও বস্তু থেকে আলাদা হয়ে যায়। সেই ক্ষেত্রে শিল্পী ওয়াকিল খানিক ব্যতিক্রম। কারণ, শিল্পে তিনি বস্তুর নিরর্থকতাকে দরকারি করে তুলেছেন।
দ্বিতীয়ত, পদ্ধতিগতভাবে তিনি সাজানো বস্তুকে আলোকচিত্রে সংশ্লেষ ঘটিয়েছেন। কোনো কোনো ক্যানভাসে গ্রাফিক ইমেজ সংযোজন করেছেন। কিন্তু এসব শিল্পকর্মে অবয়ব বা বস্তু আকারে ন্যূনতম শৈলী ছবির পাঠক কিংবা দর্শককে দুদণ্ড শ্রান্তি দেয়। কেননা, তিনি ক্যানভাসের পাটাতনে এমন শূন্যতা সৃষ্টি করেছেন, যা দেখলে অযাচিত বস্তুকেও দৃষ্টিকটু মনে না হয়। যেন বস্তু বা অবয়বের আবছা চেহারার সংযত উপস্থাপন। বিমূর্ত এসব অবয়বের প্রকাশভঙ্গি মনোজগতে একধরনের ঐকতান সৃষ্টি করে; যা রংচটা বিষয়ের বিপরীতে একক রঙের বিমূর্ত এক শিল্পকলা। এটা এমন এক শিল্পপদ্ধতি—যেখানে মুক্ত ক্যানভাসে অবয়বের উপস্থাপন এতই ছোট, যা পাটাতনে জ্যামিতিক বিমূর্ততার ভরকেন্দ্র সৃষ্টি করে। মানে অবয়ব বা বস্তুর একঘেয়েমি থেকে শিল্পের বিপরীত দিশা দেয়। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ষাটের দশকে এমন মিনিমালিস্ট আর্ট বা ন্যূনতম শিল্পচর্চার উন্মেষ হয়। গ্রিক শিল্পী নাসোস ডাফনিস, মার্কিন শিল্পী ফ্রাঙ্ক স্টেলা, ক্যানেথ নোলেন্ড, আল হেল্ড, এলসোর্থ কেলি, রবার্ট রেমন প্রমুখ শিল্পী আধুনিক শিল্প-কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করেন জ্যামিতিক ফর্মের আধা বিমূর্ততা। একই সঙ্গে তাঁরা জ্যামিতিক বিমূর্ততায় বিষয় বা সাবজেক্টকে একক কেন্দ্রে না রেখে অনুভূমিক করে দেন। এমনকি, তাঁরা অবয়ব বা লক্ষ্যবস্তুকে ক্যানভাসে গুরুত্বহীন, তবে দৃষ্টিনন্দন শীতল করে তোলেন; যা শিল্পে অ-উদ্দেশ্যমূলক মায়াজাল সৃষ্টি করে। সে ক্ষেত্রে ওয়াকিলের শিল্পকর্ম কী? এই শিল্পীদের থেকে খানিক ভিন্ন তিনি। কারণ, ওয়াকিলের শিল্পকর্ম আলোকচিত্রের সঙ্গে গ্রাফিক টোনের সংশ্লেষে পদ্ধতিগতভাবে আলাদা হয়ে গেছে। প্রশ্ন জাগে, তাঁর শিল্পকর্মে সৌন্দর্য কোথায়?
তাঁর বিশাল ক্যানভাসে অবয়ব বা দৃশ্যমান বস্তুর খুদে-উলম্ব-কৌনিক উপস্থিতি শূন্যবোধের সৌন্দর্য হাজির করে। শিল্পের এই পদ্ধতি গুণগত রূপের প্রকাশ, তবে পরিমাণগত নয়। ফলে সেটা ক্যানভাসে সামঞ্জস্য আর নির্বিরোধ ছন্দ আকারে দৃশ্যমান থাকে। গূঢ় অর্থে বলা যায়, উপযোগহীন অবয়বের ভেতর আরামদায়ক প্রশান্তি। কেননা সময়োচিত ঘটনা আর অনুধাবনমূলক অভিজ্ঞতা—দুটোই শিল্পে পরিমিতি দিয়েছে। ইতালির দার্শনিক ও জগদ্বিখ্যাত লেখক উমবার্তো একোর ভাষায় বললে, সৌন্দর্য একই রকম, বিরক্তিকর। ধারণাগতভাবে তা নিয়মানুবর্তিকার শর্ত মেনে চলে। উপযোগহীন অকেজো অবয়ব অনাকাঙ্ক্ষিত, তবে সেটা সম্ভাবনার সীমাহীন সীমার প্রস্তাব দেয়।২ শিল্পী ওয়াকিলুল রহমানের চিত্রকর্মও কি তাই? তবে খানিক দূরে! বস্তুর বাহ্যিক রূপ যতই কদর্য হোক না কেন, চারপাশের শূন্যতা তাকে সৌন্দর্য আকারে স্থান দেয়। ন্যূনতমবাদী শিল্পের মতোই এটা আবছা অবয়বের শৈলী নির্দেশ করে। ক্যানভাসে অবয়বের জ্যামিতিক ভরকেন্দ্র থেকে উৎসারিত শূন্যতা পাঠক কিংবা দর্শককে নিখিলের দিকে নিয়ে যায়, যা সজ্ঞার অবলোকন আর স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গির। এমনকি, এই প্রকরণ যেকোনো অবয়ব অথবা বস্তুকে বাছাইহীনভাবে শিল্পের বিষয় রূপে উপস্থাপনের সহজ পথ বলে বিবেচিত। তবে ওয়াকিলের শিল্পকর্ম সরল নয়, সহজ। যা শূন্যতার ভেতর অবয়বের অপূর্ব লীলা। দর্শনের ভাষায় বললে—অসুন্দর বস্তু বা অবয়বে যখন আনন্দ ধরে, তখন জগৎ সুস্থির হয়। রূপ তখন মায়ায় ঝলকায়। তর্ক বাংলায় প্রদর্শিত ওয়াকিলের ‘দরকারি নিরর্থকতা’ও সেই সাক্ষ্য বহন করে। শিল্পের পাঠক ও দর্শক মায়ায় মিললে শিল্প সার্থক হয়ে ওঠে।
তত্বতালাশ
১. বুদ্ধিজীবী দেখ সবে: সাখাওয়াত টিপু, প্রকাশক: অনঘ, ঢাকা, ২০০৯.
২. On Ugliness: Umberto Eco, Publisher: Rizzoli, Italy, 2011.
পরিমিত আওয়াজে নানাবোধের উপস্থিতি এই লেখায়। ক্যানভাস , বিভিন্ন শিল্পী তাদের আঁকাঝোকার চিন্তা , টেকনিক, তথ্য এবং শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান কে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ন এবং শিক্ষনীয় লেখা। ভাল লাগলো।
shumi Sikander
জুন ১৫, ২০২১ ১৭:৪৫