কানাডার রেল জাদুঘরে এক ঝলক

 

কানাডিয়ান রেল মিউজিয়াম যার ব্রান্ড নেম এক্সপোরেল, পৃথিবীর বৃহত্তর ট্রান্সপোর্ট মিউজিয়ামের একটি। কানাডার প্রথম রেলপথের কাছে অবস্থিত, সেন্ট-কনস্ট্যান্ট এবং ডেলসন মিউনিসিপ্যালিটির সাথে লাগোয়া এই মিউজিয়ামের মূল ভবনের বাইরে আছে বড় বড় ট্রেন। ছোট প্রদর্শনীগুলো দেখানো হয়় ভবনের ভেতরে। ভবনটি [ওপরে দেখা যায়] ১৯৯০-এর দশকে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি পুরোপুরি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।

১৯৬১ সালে ১০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই মিউজিয়াম পরিচালনা করে কানাডিয়ান রেলরোড হিস্টরিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। কানাডিয়ান রেলরোড হিস্টরিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩২ সালে। মিউজিয়ামটি এখন ৫৫ একর জায়গায় বিস্তৃত হয়েছে। বলা যায়, এই অলাভজনক সংস্থা কানাডার রেলপথের ইতিহাস এবং এর উন্নয়নের ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করে মিউজিয়ামটি গড়ে তুলেছে। অ্যাসোসিয়েশনে ফুল টাইম কর্মীর সংখ্যা ২০ জন। তবে এর মূলপ্রাণ ১৪০ জনের বেশি পুরুষ এবং মহিলা স্বেচ্ছাসেবক যারা বছরে প্রায় ৪০ হাজার ঘণ্টা সময় দেয় স্বেচ্ছায়। অ্যাসোসিয়েশনের লক্ষ্য যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ এবং প্রচার করা। বর্তমানে এখানে ১৬০টা যানবাহন, প্রায় ২ লাখ দলিল ও ৬৯০টি মডেল ট্রেন আছে।

মূল ভবনটিতে আছে রেস্টরুম, ছোট ক্যাফেটেরিয়া, স্যুভেনির শপ এবং বিশেষ ইভেন্টগুলোর জন্য প্রদর্শনীর স্থান। প্রদর্শনী হল ঘুরে দেখা হলে আমরা কিছু স্যুভেনির কিনি বন্ধুবান্ধবকে উপহার দেওয়ার জন্য।

মূল ভবনে ঢোকার আগে বাইরের বড় বড় ট্রেনের সামনে লেখক

এই মিউজিয়ামে রেলওয়ের যান্ত্রিক, বৈদ্যুতিক, টেলিযোগাযোগ, সংকেত, ট্রাফিক ও প্রকৌশল বিভাগের বিভিন্ন জিনিস সংরক্ষিত আছে। আছে বিভিন্ন ধরনের বাতি ও আলো, পাখা ও ঘণ্টা, রেলকর্মীদের পোশাক এবং আনুষঙ্গিক, সিগন্যাল সরঞ্জাম, ট্রান্সমিটার, অ্যানালগ টেলিফোন, মনোগ্রাম, ট্র্যাক সুইচ এবং রেলওয়ে স্লিপার।

মন্ট্রিয়লের দক্ষিণ উপকূলে সেন্ট কনস্ট্যান্ট-এর ডেলসনে এ রকম যে একটা চমৎকার দর্শনীয় স্থান আছে, তা খুঁজে পাওয়ার কৃতিত্ব আমাদের বউমা সেজার। আমাদেরকে কোথায় কোথায় ঘুরিয়ে দেখানো যায়, তা বের করতে গিয়েই তার এই আবিষ্কার! সেদিন তুরিও ও সেজার অফিস ডে ছিল, তাই লাঞ্চ ব্রেকের সময় নিয়ে এল মিউজিয়ামে। অন লাইনে টিকিট কেটে দিল তুরিও। বলল, তোমরা ঘুরে ঘুরে দেখো। তারপর দেখা শেষ হলে ফোন করো, আমরা এসে নিয়ে যাব।

আমি আর বেবী মূল ভবনে ঢোকার আগে বাইরের বড় বড় ট্রেন ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তারপর যখন ভবনে গিয়ে মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখছিলাম, তখন শৈশবের কথা মনে পড়ছিল। আমার ছোটবেলাটা কেটেছে রেলগাড়ি কিংবা রেললাইন থেকে বহুদূরে, দক্ষিণ খুলনার এক গ্রামে। রেল তো দূরের কথা, সেখানে তখন রিকশা-বাস কিছুই চলত না, নৌকা ছাড়া। অনেকে অবশ্য হাম্বার, বিএসএ এই সব সাইকেলে গ্রীষ্মকালে গ্রামের ভেতরে কিংবা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর চলাচল করতেন। বর্ষাকালে হাঁটুসমান কাঁদা থাকত, তাই কাঁদা ভেঙে হাঁটা কিংবা নৌকায়ই চলতে হতো। তবু আমাদের জীবনেও ছিল সেই ‘রেল গাড়ি ঝমাঝম পা পিছলে আলুর দম ছড়া আর তার সাথে মজার একটা খেলা। আমার পাঁচ মামার ছিল অনেক ছেলেমেয়ে। আমার বয়সী ছিল যারা তারা পায়ে পা আর হাতে হাত লাগিয়ে এই ছড়া পড়তাম। তারপর কোনো একদিকে কাত হয়ে পড়ে কী যে মজা পেতাম, আজ তা ভাবলে খুব হাসি পায়।

জীবনে প্রথম রেলে চড়ি খুলনা থেকে আমার বোনের বাড়ি যশোরে আসার পথে। সে কী উত্তেজনা! একের পর এক গ্রাম-মাঠ-গাছ-গাছালিকে চোখের সামনে মুহূর্তেই সরে যেতে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। তারপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বন্ধুবান্ধবীরা দল বেঁধে এক বগিতে চেপে রাত দশটা এগারোটার পৌঁছাতাম বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে। সময় কোথা দিয়ে চলে যেত টেরও পেতাম না!

এই সব ভাবতে ভাবতে বর্তমানে ফিরে আসি। ভবনে ঢুকে চোখে পড়ল ৪-৬-৪ মডেলের সেই কানাডিয়ান প্যাসিফিক লোকোমোটিভ ২৮৫০ যা হাডসন টাইপ নামে পরিচিত। ঘূর্ণায়মান বেদীতে বসানো এই লোকোমোটিভ ১৯৩৯ সালে রাজকীয় ট্রেনকে নিয়ে রাজা ষষ্ঠ জর্জ ও রানি এলিজাবেথকে কানাডার পশ্চিম অঞ্চল ঘুরিয়ে দেখায়। ফলে রাজা-রানির এই ট্রেন ব্যবহারকে স্মরণে রাখার জন্য কর্তৃপক্ষ এর নাম পালটে রয়্যাল হাডসন নামকরণ করে।

এই মিউজিয়াম ঘুরতে এসে জানা গেল ১৮৯২ সালে মন্ট্রিয়লে প্রথম বৈদ্যুতিক পরিবহন চালু হয় আর এর দুবছর পর ১৮৯৪ সালে মন্ট্রিয়ল স্ট্রিট রেলওয়ে তার সবশেষ ঘোড়াগুলোকে বিক্রি করে দেয় যারা একদিন হ্রেষা তুলে রাস্তায় ছুটে বেড়াত।

জানা গেল, ১৯১২ সালে যাত্রীসেবা থেকে অবসরে গেল এমএসআর ২৭৪। এরপর কর্তৃপক্ষ একে লবণ টানা গাড়িতে রূপান্তর করে চালিয়ে নেন ১৯৪৭ সাল নাগাদ। কানাডিয়ান রেলেওয়ে হিস্টোরিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সংগ্রহই হলো এই এমএসআর ২৭৪।

কানাডিয়ান রেলরোড হিস্টরিক্যাল এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের ছবি

প্রদর্শিত প্রতিটি রেলের নমুনা যেন এক একটা সময়ের চমকপ্রদ কাহিনি! যেমন, ১৯০২ সালে মন্ট্রিয়ল এবং পার্ক আইল্যান্ড রেলওয়ে শহরতলির লাইনগুলোতে চলাচলের জন্য স্ট্রিটকার নম্বর ১০৪৬ নির্মিত হয়েছিল, যা একসময় কার্টিয়ারভিল এবং লাচিনে চলাচল করত। ১৯২৪ সালে মন্ট্রিয়ল ট্রামওয়ে কোম্পানির কার্টিয়ারভিল লাইনে ব্যবহারের জন্য আরও দশটি স্ট্রিটকার সম্পূর্ণরূপে সংস্কার করা হয়েছিল। কারটির চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হলো এর সিটগুলো শীতলপাটি মোড়ানো। বাইরে উজ্জ্বল কমলা রং করা হয়েছিল যাতে এটি চলাচলের সময় ভালোভাবে দেখা যায়। কারটিতে লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার সময় সংকেত দেওয়ার জন্য বেল ও হুইসেল লাগানো ছিল। ১৯৩৫ সালে এটি রাস্তা থেক উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং ছয় বছরে মাথায় এর পাঁচটি ধ্বংস হয়ে যায়। অন্য পাঁচটিতে সবুজ রং করা হয়। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশ আওয়ারে ব্যবহারের জন্য এগুলো পুনরায় রাস্তায় নামানো হয়। তবে ১৯৫৫ সালে পরিষেবা থেকে এগুলো চূড়ান্তভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছিল এবং ১৯৫৬ সালে এগুলোতে আবার ১৯২৪ সালের সেই উজ্জ্বল কমলা রং করা হয়।

একটা ছাদবিহীন ট্রেনের সামনে এসে জানা গেল, এটি মন্ট্রিয়ল স্ট্রিট রেলওয়ে কোম্পানির কীর্তি। ১৯০৫ সালে মন্ট্রিয়লে এই কোম্পানি আরবান ট্যুরিজমের গোড়াপত্তন করে। তারা সারা শহরে ঘুরে বেড়ানো, পাহাড়ে চড়া, স্টেডিয়ামে যাওয়া, বিনোদন পার্ক বা অন্যান্য আকর্ষণীয় স্থানে গিয়ে আনন্দ করার জন্য একটা স্ট্রিটকার যার ডাকনাম ছিল গোল্ডেন চ্যারিয়ট বা সুবর্ণ রথ চালু করে। গোল্ডেন চ্যারিয়ট-এর আগে ১৮৯৭ সালে টরেন্টো নাইট টাইম রাইডের জন্য মুন লাইট কার বা চন্দ্রযান নামের ট্রাম চালু করে। মন্ট্রিয়ল স্ট্রিট রেলওয়ে কোম্পানি সেন্ট লুইসে ব্যবহৃত কারের সাথে তাদের কোম্পানির ব্লেচার স্ট্রিটকার স্টাইল জুড়ে দিয়ে গোল্ডেন চ্যারিয়ট-এর জন্ম দেয়। এরপর ১৯০৫ থেকে ১৯২৪ সালের মধ্যে এ রকম ৪টি গোল্ডেন চ্যারিয়ট দিয়ে মন্ট্রিয়লের সুন্দর সুন্দর প্যানোরমিক জায়গাগুলোতে ঘোরার ব্যবস্থা করে বেশ নাম করে। মন্ট্রিয়লের দেখাদেখি, ক্যুবেক, ক্যালিগরি ও ভ্যাঙ্কুভার শহরে ট্যুরিস্টদের জন্য চালু হয় এই ধরনের সাইট সিয়িং কার।

জানা গেল, প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলকে দেশের বাকি অংশের সাথে সংযুক্ত করার জন্য, কানাডিয়ান রেল প্রকৌশলীদের রকি মাউন্টেনের মধ্য দিয়ে একটি উপায় খুঁজে বের করতে হয়েছিল। তারা কিকিং হর্স পাসের মধ্য দিয়ে যাওয়ার জন্য বেছে নিয়েছিল; এটি ছিল সবচেয়ে ছোট এবং সবচেয়ে সরাসরি পথ। দুর্ভাগ্যবশত, এটি ছিল উত্তর আমেরিকার রেলপথের সবচেয়ে খাড়া অংশ। এখান থেকে ট্রেনের ওপরে ওঠা এবং নিরাপদে নেমে আসা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়। তাদের প্রথম পরীক্ষামূলক ট্রেন দ্য বিগ হিল ট্রেনটি দুটো ইঞ্জিন আর তিনটি বগি নিয়ে যাত্রা করতে গিয়ে প্রথম বাঁক নেওয়ার সময়ই লাইনচ্যুত হয়ে ডুবে গেল কিকিং হর্স নদীতে। মারা গেল তিনজন শ্রমিক। সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেল ট্রেন চলাচল। প্রকৌশলী জেমস রসকে বলা হলো ট্রেনগুলো নিয়ন্ত্রণ করার একটি ভালো উপায় খুঁজে বের করতে। প্রকৌশলী রস তখন রেলপথে এবং রেলের ইঞ্জিনে দ্বৈত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

যে রকি মাউন্টেনে রেললাইন স্থাপন ছিল কঠিন কাজ, আজ সেই রকি মাউন্টেনিয়ার রুটে চালু হয়েছে দারুণ সব বিলাসবহুল ট্যুর প্যাকেজ। দুই দিন থেকে ১৩ দিনের প্যাকেজ পাওয়া যায়। জনপ্রতি খরচ পড়ে ২০০০ কানাডিয়ান ডলার থেকে শুরু করে ১৩ হাজার ডলার। একা ভ্রমণ করলে দুজনের চেয়ে জনপ্রতি খরচ বেশি পড়ে। আবার তিনজন যাত্রী মিলে একটা রুম ভাড়া নিলে জনপ্রতি খরচ আরও কিছুটা কম হয়। রকি মাউন্টেনিয়ার রুট বিস্তৃত ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে আলবার্টা অবধি। এর মাঝে যে স্টপেজ আছে তা হলো লেক লুইস, ব্যানফ, ভ্যাঙ্কুভার, হুইসলার, কুয়েসনেল ও কমলুপস।

সমস্ত রকি মাউন্টেনিয়ার রুটে আছে সিলভারলিফ এবং গোল্ডলিফ পরিষেবা। সিলভারলিফ কারগুলো হলো এক স্তরবিশিষ্ট, যার জানালাগুলো ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে বাঁকা হয়ে। আর গোল্ডলিফ কার দুই স্তরের এবং একটি উঁচু জায়গায় বসার ব্যবস্থা থাকে। সিলভারলিফ সার্ভিসে খাবার সিটে পরিবেশন করা হয় কিন্তু গোল্ডলিফ কারের যাত্রীদের পৃথক ডাইনিং কারে খাবার পরিবেশন করা হয়। সিলভারলিফের একটি খোলা জানালাসহ ট্রেনের গাড়ির মধ্যে একটি প্যাসেজ রয়েছে। প্রতিটি গোল্ডলিফ কারের পিছনে ওপেন এয়ার প্ল্যাটফর্ম আছে, বাইরের দৃশ্য দেখার জন্য। তা ছাড়া গোল্ডলিফ সার্ভিসের আওতায় হোটেলের প্রশস্ত রুম ও বাইরের সুন্দর দৃশ্য দেখার বাড়তি সুবিধা থাকে।

আমরা সবাই জানি ট্রেন পণ্য ও যাত্রী পরিবহন করে। কিন্তু কে ভেবেছিল এই ট্রেন একদিন প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো জ্বালাবে? বাস্তবে তা ঘটেছিল। কানাডিয়ান ন্যাশনাল এবং কানাডিয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিশেষত আদিবাসী, কানাডিয়ান এবং অভিবাসীদের ছেলেমেয়েদের জন্য চালু করে ভ্রাম্যমাণ স্কুল কার্যক্রম। ছাত্ররা ছিল রেলকর্মী, ট্র্যাপার ও শিকারিদের সন্তান। অন্টারিও এবং প্রেইরিগুলোতে, ১৯২৮ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৩৬ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত নিউফাউন্ডল্যান্ডে এই স্কুল গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল।

দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে শিক্ষা বিস্তারে লাইভ-ইন শিক্ষক দ্বারা পরিচালনা করা হতো এই ভ্রাম্যমাণ স্কুল গাড়ি। স্কুল গাড়িটিকে কোনো একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেনে নিয়ে যায় একটি ইঞ্জিন। স্কুলটি সেখানে ৮ থেকে ১০ দিন থেকে সেখানকার ছাত্রদের পাঠ দিতে থাকে। তারপর অন্য একটি অঞ্চলে যায়। এভাবে নির্দিষ্ট কয়েকটি অঞ্চলে পাঠদানের পর সার্কিটটি সম্পূর্ণ হলে স্কুল গাড়িটি আবার প্রথম শহরে আসবে। শিক্ষক বা শিক্ষিকা এই চলমান স্কুলের তার পরিবার নিয়েই কেন্দ্রগুলোতে ভ্রমণ করতেন। রেলে তার পরিবারের থাকার জন্য আলাদা একটা কামরা থাকত। এতে শোবার ঘর, কিচেন, লিভিং রুম ও বাথ রুমের ব্যবস্থাও থাকত।

প্রভিন্সের স্কুলের পাঠ্যক্রমের সাথে মিল রেখেই চলত চলমান স্কুলের পাঠ্যক্রম, যেমনপড়া, ব্যাকরণ, পাটিগণিত, ইতিহাস এবং ভূগোল।

প্রদর্শিত ভ্রাম্যমাণ স্কুলের ক্লাসরুমে আছে ১২টি ডেস্ক, ছয়টি পুল-ডাউন বা গোটানো মানচিত্র, একটি গ্লোব, দাগ কাটার রুলার একটি প্রাথমিক চিকিৎসার বাক্স, দুটি ব্ল্যাকবোর্ড, দুটি চেয়ার, দুটি বুককেস, যার মধ্যে অনেক বই, কালি, ঝরনা কলম এবং পেন্সিল, ইরেজার, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের জন্য কাগজ।

ভ্রাম্যমাণ স্কুলটা যখন কোনো এলাকায় অবস্থান করত, তখন সেই এলাকার বয়স্করাও সেখানে জড়ো হতেন। তাঁদের জন্যও ছিল বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম! এই ট্রেনে হাসপাতালের বগি, পোস্ট অফিসের বগি এমনকি কোনো কোনো কোম্পানির অফিস সার্ভিসও চালু করা হয় বিচ্ছিন্ন অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে! শিশুদের জন্য ভ্রাম্যমাণ বগিতে শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও, অন্যান্য বগিতে কৃষকদের সেবা দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা থাকত। ফলে ট্রেনগুলো যখন এক একটি স্টেশনে অবস্থান করত, এলাকাবাসীর মধ্যে সাড়া ফেলে দিত। ট্রেন স্টেশনগুলো তাদের জীবনব্যবস্থা ও যোগাযোগের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির পাশাপাশি প্রথমবারের মতো, কানাডিয়ানরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এই কার্যক্রমের জন্য।

ভ্রাম্যমাণ স্কুল কার্যক্রম

দেখলাম পুরোনো আমলের একটি রোটারি স্নোপ্লাউ বা ঘূর্ণায়মান স্নোপ্লাউ যা রেলপথের বরফ সরানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। ট্রেনের সামনের প্রান্তে ব্লেডগুলোর একটি বড় বৃত্তাকার সেট, যা সামনের রেললাইনের ওপর বরফের মধ্য দিয়ে কাটতে কাটতে যায়। এই রোটারি স্নোপ্লাউর অগ্রদূত ছিল ওয়েজ স্নোপ্লাউ।

১৮৬৯ সালে কানাডার টরন্টোতে ডেন্টিস্ট জে ডব্লিউ এলিয়ট এই রোটারি আবিষ্কার করেন। তিনি কোনো ওয়ার্কিং মডেল বা প্রোটোটাইপ ছাড়াই সরাসরি এই মেশিন তৈরি করে ফেলেন। পরে অন্টারিওর অরেঞ্জভিলের অরেঞ্জ জুল, এলিয়টের নকশায় এ আরও প্রসারিত হয়েছিল। তিনি বালি দিয়ে পরীক্ষা করা ওয়ার্কিং মডেলগুলো তৈরি করেছিল। ১৮৮৩-৮৪ সালের শীতকালে, জুল টরন্টোর লেসলি ব্রাদার্সের সাথে একটি সম্পূর্ণ রোটারি স্নোপ্লাউ তৈরির জন্য চুক্তিবদ্ধ হন, যা সফল প্রমাণিত হয়।

রোটারি স্নোপ্লাউগুলো শীতকালে যখন অতিরিক্ত তুষারপাত হয়, তখন কাজে লাগানো হতো। সাধারণত পার্বত্য অঞ্চলে, যেখানে দ্রুতগতির কারণে লাইনচ্যুত হওয়ার ভয় থাকে, সেখানে এর ব্যবহার খুব সুবিধাজনক। কারণ, তখন এ ট্রেনের গতি না কমিয়ে বরফ কেটে যেতে পারে। তবে, রোটারি স্নোপ্লাউগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল, যা একটি নির্দিষ্ট বছরে প্রয়োজন পড়বে কি না, তা বিবেচনা না করেই বহন করতে হতো রেল কোম্পানিকে। ফলে, বেশির ভাগ রেলপথ ব্যয়বাহুল্যের কারণে তাদের রোটারগুলো নির্মূল করেছে। তারা বিভিন্ন ধরনের ফিক্সড-ব্লেড লাঙল ব্যবহার করতে শুরু করে, যা বুলডোজারগুলোর সাথে একত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে কম রক্ষণাবেক্ষণ খরচে ব্যবহার করা যায়। শুধু তাই নয়, এগুলো অফ-ওয়ে প্রকল্পগুলোতে সারা বছর ব্যবহার করা যেতে পারে।

উত্তর আমেরিকার অবশিষ্ট ঘূর্ণায়মান স্নোপ্লাউগুলো হয় জাদুঘর, না হয় রেলওয়ের মালিকানাধীন রয়ে গেছে, না হয় নিয়মিত গুরুতর তুষারপাত মোকাবিলার জন্য সংরক্ষিত থাকে।

আরেকটা কথা জানা গেল। কানাডায় ট্রেন যখন সহজলভ্য তখন রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য ছিল বিলাসবহুল বিজনেস কার নম্বর-১। আজকাল অবশ্য সেসব আর তেমন চালু নেই তবে কিছু কিছু এখনো দেখা যায়। তবে তা রেলের কর্তাব্যক্তিরা ব্যবহার করেন। রাজনীতিবিদেরা এখন বিমানে চলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সেন্ট লরেঞ্চ এন্ড অটোয়া রেল তখন একমাত্র কোম্পানি, যা রাজধানীতে এই সেবা দিত। ১৮৬৭ সালে যখন রেল নেটওয়ার্ক পুনর্বিন্যস্ত করা হয় তখন কোম্পানি তার ডিরেক্টর ও রাজনীতিবিদদের জন্য দ্বিতীয় বিলাসবহুল কার-১ নির্মাণ করে। এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে ১৮৭০ সাল নাগাদ ম্যাকডোনাল্ড, কাটিয়েরসহ আরও অনেক রাজনীতিক তখন এই কারে যাতায়াত করতেন।

রেল মিউজিয়ামের ভেতরের প্ল্যাটফর্মে রক্ষিত [ওপরের ছবির মাঝখানে] আছে লোকোমোটিভ নং. ৭১৩। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রেলওয়ে দ্বারা উপকূল থেকে উপকূল পর্যন্ত কানাডাকে যুক্ত করার জন্য নির্মিত বিশাল ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে এটি একটা উদাহরণ।

শক্তি এবং গতির জন্য এই ইঞ্জিন ডিজাইন করা হয়, যাতে বিশাল কানাডার ল্যান্ডস্কেপের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দ্রুত গতিতে দূরের স্টেশনগুলোতে পৌঁছাতে পারে।

কানাডা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। পুবের আটলান্টিক থেকে পশ্চিমের প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। শুরু থেকে এই বিশাল কানাডার যানবাহন ব্যবস্থা ছিল এক বিশাল সমস্যা। লক্ষ লক্ষ স্থানীয় দ্বীপ বা লেকে স্থানীয় আদিবাসী ও অভিযাত্রীরা ক্যানোস বা নৌকায় চলাচল করলেও উত্তরের একটা বড় অঞ্চল থাকত বরফে ঢাকা। কুকুর-টানা স্লেজগাড়িগুলোই ছিল ভরসা। ইউরোপিয়ানরা ঘোড়া ব্যবহারের চেষ্টা করলেও তা বিশেষ কাজে লাগেনি।

বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালু হওয়ার পর নোভাস্কোশিয়ার হ্যালিফ্যক্সের স্যামুয়েল কানরাড জাহাজে এই যন্ত্র বসিয়ে জলপথে একটা বড় পরিবর্তন আনেন। আর লোকোমোটিভে স্টিম ইঞ্জিন সংযোজনের পর স্থলপথে উত্তর আমেরিকা মহাদেশ পালটে গেল চিরদিনের জন্য।

রেলওয়েতে কানাডার সম্পৃক্ততা শুরু হয়েছিল ১৮৩১ সালে যখন মন্ট্রিয়‍লের ব্যবসায়ী এবং নির্মাতারা মিলে চ্যাম্পলেন এবং সেন্ট লরেন্স রেলপথ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ব্রিউয়ার এবং স্টিমবোটের মালিক জন মোলসনের নেতৃত্বে এই দলটি কলোনির প্রথম ট্র্যাকগুলো তৈরি করেছিল, যা মন্ট্রিয়লের দক্ষিণ তীরে ল্যাপ্রেইরি থেকে সেন্ট-জিন-সুর-রিচেলিউ [ওরফে ডরচেস্টার] শহরে চলেছিল। তবে মন্ট্রিয়লের লাচিন ক্যানেল বা খালকে ঘিরে থাকা এলাকাটি কানাডার প্রথম শিল্পবিপ্লবের কেন্দ্রস্থল ছিল এবং উনিশ শতকের শেষের দিকে, এর সবচেয়ে দর্শনীয় শিল্প ছিল রেলপথ। বিশেষত পয়েন্ট সেন্ট চার্লস ট্রেন-তৈরির ব্যবসা এবং রেলশিল্প শ্রমিক শ্রেণির আবাস হিসেবে গড়ে উঠেছিল।

লোকোমোটিভ নং. ৭১৩

১৮৫০-এর দশকে অর্থনীতি সম্প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রেলওয়ে কোম্পানি জিটিআর [GTR] ১৮৫২ সালে মন্ট্রিয়লের বাইরে টরন্টো এবং শেষ পর্যন্ত সারনিয়া পর্যন্ত রেল নেটওয়ার্ক প্রসারিত করার ব্যবস্থা নেয়। জিটিআর মন্ট্রিয়ল এবং পোর্টল্যান্ডের মধ্যে ট্র্যাকগুলোও ইজারা দেয় এবং ক্যুবেক সিটি থেকে রিচমন্ড থেকে লেভিস পর্যন্ত একটি স্পার তৈরি করে, পরে মেরিটাইমসের রেল নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত হয়। পূর্ব এবং দক্ষিণ দিক থেকে ট্রাফিক সেন্ট ল্যাম্বার্ট গ্রামে মিলিত হয়েছে, এটা ল্যাপ্রেইরি থেকে ডাউন রিভার এবং মন্ট্রিয়লের কাছাকাছি ক্রসিং স্পট। ১৮৫৯ সালে ভিক্টোরিয়া সেতুর [বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য] সমাপ্তি এই ট্র্যাফিককে পয়েন্ট সেন্ট চার্লসের জিটিআর ফ্রেইট ইয়ার্ডের সাথে এবং অবশেষে বোনাভেঞ্চার স্টেশনের সাথে সংযুক্ত করে, যা কোম্পানিটি তার মন্ট্রিয়ল টার্মিনাসের জন্য কিনেছিল।

কানাডার রেলপথের ইতিহাসে মন্ট্রিয়ল যে ভূমিকা রেখেছে তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই মিউজিয়ম আমদেরকে মনে করিয়ে দিল আমাদের দেশের রেলব্যবস্থার কথা। কানাডা থেকে মাত্র এক দশক পরে চালু হওয়া রেলের ইতিহাস সম্পর্কে কতটুকু জানি আমরা? চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত দেশের একমাত্র রেলওয়ে জাদুঘর, যেখানে শতবর্ষের পুরোনো বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিবর্তন ও আধুনিকায়নের ইতিহাস সংরক্ষিত রয়েছে। পাহাড়তলী থানার অন্তর্গত রেলওয়ে ক্যারেজ ও ওয়াগন কারখানার সম্মুখে প্রায় ১২ একর পাহাড়ি এলাকাজুড়ে অবস্থিত। এই জাদুঘরের কাঠের তৈরি দোতলা বাংলোটি, যা প্রায় ৪২০০ বর্গফুট এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। আমাদের দেশের স্থল যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য এই রেল মিউজিয়াম সম্পর্কে জানার গভীর আগ্রহ ও অঙ্গীকার নিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলাম এক্সপোরেল মিউজিয়াম থেকে। হাঁটতে হাঁটতে কাঠের সাঁকো পার হয়ে চলে এলাম মেইন রোডের দিকে। কিছুক্ষণ বাদেই তুরীয় আর সেজা এলো আমাদেরকে বাসায় নিয়ে যেতে।