আলোকচিত্রী আব্দুল হামিদ রায়হান
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্রীদের মধ্যে অন্যতম আব্দুল হামিদ রায়হান। পাশাপাশি স্টুডিও আলোকচিত্রে তাঁর কৃতিত্ব বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত। তাঁর জন্ম ১৯৩২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, কুষ্টিয়ার জগতি ইউনিয়নের বড়িয়া গ্রামে। পৈতৃক ভিটেবাড়ি গড়াই নদীর ওপারে শালদা গ্রামে। বাবা চয়েন উদ্দিন ও মা জোবেদা খাতুন। পড়ালেখার হাতেখড়ি আড়ুয়াপাড়ায় এক মক্তবে [বর্তমানে ২নং পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়]। তিনি কুষ্টিয়া মুসলিম হাইস্কুলে নবম শ্রেণি নাগাদ পড়ালেখা করেন। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা ও পারিবারিক দায়িত্ব নেওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ইতি ঘটে। ১৯৪২ সালে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর কুষ্টিয়া আগমন উপলক্ষে প্রথম রাজনৈতিক মিছিলে অংশগ্রহণ করেন মাত্র ১০ বছর বয়সে। ১৯৪৬ সালে যষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন মায়ের কাছে বায়না ধরে প্রথম ক্যামেরা কেনেন। আলোকচিত্রের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে বাংলাদেশের অনন্য ইতিহাসের সাক্ষী করে তোলে।
১৯৫১ সালে পরিবারের হাল ধরতে শুরু করেন তামাক পাতার ব্যবসা। ১৯৫২ সালে কুষ্টিয়াতে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করেন তিনি। ১৯৫৩ সালে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যোগদান করেন। উল্লেখ্য, পারিবারিক দায়-দায়িত্ব, পেশা ও রাজনৈতিক নানা তৎপরতা হেতু কৈশোরে আলোকচিত্রের প্রতি আগ্রহে কিছুটা ভাটা পড়লেও ১৯৬৬ সালে নতুন রূপে তিনি কাজ শুরু করেন। এই সময়ে তিনি তৎকালীন তিন শত টাকায় কেনেন লুবিডো-২ ক্যামেরা। নিজে নিজেই নানা বইপত্র সংগ্রহ করে শেখেন ছবি তোলা থেকে প্রিন্ট করার নানা কৃৎকৌশল। নিজ হাতে বন্ধুর লেদ মেশিনের কারখানা থেকে বানিয়ে নেন এনলার্জার। আর নিজ অফিস রুমে এক পাশে তৈরি করে নেন ডার্করুম। প্রথম দিকে আশপাশের প্রকৃতি ও আত্মীয়স্বজনের ছবি তুলে নিজেকে দক্ষ করে তোলেন। তাঁর আদর্শ ছিল সে সময়ে কলকাতার ঐতিহাসিক বর্ন আন্ড শেফার্ড স্টুডিও। ফলে আরও ভালো মানের ছবির জন্য তিনি ১৯৬৯ সালে নিজের জমানো টাকায় করাচি থেকে পোস্টালের মাধ্যমে আনিয়ে নেন ইয়াসিকা ৬৩৫। এই ক্যামেরাতেই ধারণ করেন সেই সময়ের উত্তাল রাজনৈতিক ঘটনা ও মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র। ১৯৬৯ সালেই তিনি কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের সহসভপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। এবং আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। সত্তরের নির্বাচনী সভায় বঙ্গবন্ধু যখন কুষ্টিয়ায় আসেন, পার্টি থেকে তাঁকে বঙ্গবন্ধুর খাবার ও জনসভার আলোকচিত্র ধারণের আহ্বান করা হয়। বঙ্গবন্ধুর এই জনসভার আলোকচিত্রই তাঁকে পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। একাত্তরের উত্তাল মার্চ পর্যন্ত কুষ্টিয়ার নানা রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের আলোকচিত্র তিনি নিজ উদ্যোগেই ধারণ করতে থাকেন।
২৫ মার্চের পরেই তাঁকে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আত্মগোপনে যেতে হয়। গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত নেগেটিভ নিয়ে প্রথমে তিনি নিজ শ্বশুরালয়ে আশ্রয় নেন, পরে ভারতের করিমপুরে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট ক্যাম্প/ইয়ুথ ক্যাম্পে সহকারী ইনচার্জ হিসেবে নিযুক্ত হন। মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি এই ক্যাম্পেই ছিলেন, ক্যাম্পের দায়িত্ব ও অর্থাভাবে সেই সময়ে ফটোগ্রাফির জন্য নেগেটিভ না কিনতে পারায় কোনো আলোকচিত্র তিনি ধারণ করতে পারেননি। রাজনৈতিক সতীর্থ, বাল্যবন্ধু ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম সে সময়ে মুজিবনগর সরকারের অনুমোদনে গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোর নামের এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ৭১ সালের জুন মাসে আমীর-উল ইসলাম করিমপুর ইয়ুথ ক্যাম্পে আসেন। আব্দুল হামিদ রায়হানকে ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের পক্ষে কাজ করার আহ্বান জানান। সেপ্টেম্বর মাস থেকে তিনি এই সংগঠনের পক্ষ হয়ে আলোকচিত্র ধারণ করতে থাকেন। সে সময়ে ব্রিটিশ এমপি ডোনাল্ড চেজওয়ার্থ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে প্রচার করতে আব্দুল হামিদের রায়হানের আলোকচিত্র দিয়ে ৯টি অ্যালবাম তৈরি করে নিয়ে যান। যার একটি বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। হাজার দুয়েক আলোকচিত্র সে সময়ে ধারণ করলেও ৫৪০টি নেগেটিভ তাঁর কাছে সংরক্ষিত আছে। এগুলোর মধ্যে আছে যেমন নানা ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, তেমনি মানবিক মাত্রাযুক্ত জনজীবনের ছবি।
মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি স্থায়ীভাবে ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে নেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ মার্চ তিনি কুষ্টিয়ায় গড়ে তোলেন রূপান্তর ফটো স্টুডিও। তাঁর গড়ে তোলা রূপান্তর ফটো স্টুডিও বৃহত্তর কুষ্টিয়ায় প্রায় তিন দশক ধরে আলোকচিত্রের প্রধান কেন্দ্র হয়েছিল। বৃহত্তর পরিসরে তাঁর আলোকচিত্র প্রথম নজরে আসে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠালগ্নেই সেখানে তাঁর দুই শতাধিক আলোকচিত্র সংগ্রহ করা হয়। ঢাকা, যশোর, ময়মনসিংহ ও বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে তাঁর আলোকচিত্র সংগ্রহে আছে। কিন্তু জনপরিসরে ঢাকায় প্রথম তাঁর আলোকচিত্রের প্রদর্শনী হয় ২০০৭ সালে আমার দেখা ৭১ শিরোনামে দৃক গ্যালারিতে।
দৃক পিকচার লাইব্রেরির কর্ণধার শহিদুল আলম ও আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফি এজেন্সি অটোগ্রাফ এবিপির কর্ণধার মার্ক শেলির কিউরেটিংয়ে লন্ডনে ২০০৮ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ আলোকচিত্র নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীতে তাঁর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আলোকচিত্র স্থান পায়। ২০০৯ সালে আয়োজিত ছবিমেলা-০২ পর্বে বাংলাদেশ ৭১ প্রদর্শনীতেও তাঁর আলোকচিত্র বিশেষ গুরুত্বসহকারে প্রদর্শন করা হয়। ২০১২ সালে ঢাকায় আর্ট সেন্টারে তাঁর দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাগ্রন্থে তাঁর আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে।
২০১৪ সালে আলোকচিত্রের প্রতিষ্ঠান কাউন্টার ফটো তাঁকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করে। ২০১৭ সালে কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ তাঁকে ভাষাসংগ্রামের জন্য বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে।
তর্ক বাংলা আয়োজিত আলোকচিত্রী আব্দুল হামিদ রায়হানের প্রথম অনলাইন আলোকচিত্র প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর শিরোনাম রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ।
রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ : ১
রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ : ২
রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ : ৩
রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ : ৪
রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ : ৫
রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ : ৬
রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ : ৭
রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ : ৮
রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ : ৯
রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ : ১০
রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ : ১১
রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ : ১২
রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ : ১৩
রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ : ১৪
রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ : ১৫
দুর্লভ ছবি সমূহ অাগামীর পথ চলার পাথেয়
Jannatul Ferdaush
ডিসেম্বর ০৬, ২০২১ ২২:৪৩