নেত্রকোনার ভাবসঙ্গীত বাউলিয়ানা

 

কর্মসূত্রে পদায়িত হয়ে নেত্রকোনায় যাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই এক অনুজ সহকর্মী একদিন কথা প্রসঙ্গে বললেন, নেত্রকোনার মানুষ সঙ্গীত, সাহিত্য, নাটক-যাত্রা অনুষ্ঠান তথা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি যে-রূপ আগ্রহী, শিক্ষার জন্য যদি তাদের নিবেদন একই রকম হতো, তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দিক থেকে নেত্রকোনা এতটা পিছিয়ে থাকত না। তাঁর এই ভাষ্যের দৃষ্টান্ত নেত্রকোনার বাস্তব রূপ। নেত্রকোনা হলো হাওর-পাহাড়ের আপত্য-লালিত এক ঘুমন্ত সন্ন্যাসী তাই প্রাকৃতিকভাবেই এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বৈরাগ্যের প্রভাব প্রকট। তাঁদের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা বৈচিত্র্যহীন সাদামাটাভাবে। তাঁদের চাহিদা অতি সীমিত। গান আর কৃষিভিত্তিক জীবন-জীবিকার বাইরে নিজেদের আর্থিক বা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি খুবই গৌণ এখানে। এ জন্য নেত্রকোনার শিক্ষার হার জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক কম। এই স্বল্প বা স্বশিক্ষিত মানুষেরাই বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে উপহার দিয়েছেন অমূল্য রত্নসম্ভার। এই জনপদের মানুষকে জানতে গিয়েই তাঁদের বৈরাগ্য এবং এর কার্যকারণ স্বরূপ সম্পর্কে অনুসন্ধানে আগ্রহ জন্মে। তারই ধারাবাহিকতায় একটু গভীরে ঢোকার ক্ষুদ্র প্রয়াস।

স্রষ্টা সৃষ্টি সম্পর্কে জানার আগ্রহ চিরন্তন। অজানাকে জানার তথা জ্ঞান অন্বেষণে দীর্ঘ পথ পরিক্রমার নির্দেশনা রয়েছে। ইবনে বতুতা, ভাস্কো দা গামা, ফা-হিয়েন যখন দেশ ভ্রমণে ব্যয় করেছেন জীবনের দীর্ঘ সময়; বিজ্ঞানীরা তখন জীবজগতের কোনো প্রজাতির সদস্যকে ভেঙেচুড়ে এর ক্ষুদ্রতম এককের কার্যক্রম জানতে ঘাম ঝরাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ধর্ম আধ্যাত্মিক জীবন সম্পর্কে নানাবিধ ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করছেন। করেছেন দৃশ্যমান বাস্তবতার অদৃশ্য ব্যাখ্যার অনুসন্ধান। ড. আহমদ শরীফের ভাষায়, এই একই জিজ্ঞাসা কাউকে করেছে বহির্মুখী, কাউকে দিয়েছে অন্তর্দৃষ্টি। বহির্মুখিতা মানুষকে করেছে বিজয়ী বিজ্ঞানী। অন্তর্দৃষ্টি মানুষকে করেছে রহস্যবাদীগড়ে তুলেছে অধ্যাত্মবাদ। বিজ্ঞান এনেছে ভোগবাদ বা ঐহিক জীবনবাদ তথা বস্তুতান্ত্রিকতা। অধ্যাত্মবাদ দিয়েছে বৈরাগ্য বা ইহবিমুখতাজাগিয়েছে জীবনেতর জীবনের আকাঙ্ক্ষা। বৈরাগ্য প্রাচ্যের মানসসম্পদ, আর বিজ্ঞান পাশ্চাত্যের ঐশ্বর্য। দুটোরই মূল প্রেরণা জিগীষা, একটার লক্ষ্য আত্মজয়, অপরটির কাম্য দুনিয়া জয়, একটার সম্বল হৃদয় মনোবল, অপরটির হাতিয়ার বুদ্ধি বাহুবল

স্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার জোর দিয়েছেন সামগ্রিকতার ওপর। কারণ, কাছে থেকে দেখলে কোনো জিনিসের অংশবিশেষ দেখা যায়, পূর্ণাঙ্গ রূপ নয়। এই অংশবিশেষ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে সম্পূর্ণ বস্তু সম্পর্কে কেবল ভ্রান্ত বা দ্বান্দ্বিক মতামত পাওয়া যেতে পারে; অন্ধ ব্যক্তিকে হাতি চেনানোর মতো অনেকটা। তাই অসীমকে সীমার মধ্যে পাওয়ার জন্য তার পূর্ণরূপ উপলব্ধি করা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, যখন অণুবীক্ষণের সাহায্যে আমি একটি গোলাপের পাপড়িকে দেখি, তখন আমি সাধারণভাবে তা যতটা স্থান অধিকার করে, তার চেয়ে বিস্তারিত ক্ষেত্রে তাকে দেখি। আমি যত বেশি ক্ষেত্র বিস্তারিত করি, তা ততই অস্পষ্ট হতে থাকে। সুতরাং শুদ্ধ অনন্তে তা গোলাপের পাপড়ি নয়, অন্য কিছুও নয়। একটি বিশেষ ক্ষেত্রে অসীম যেখানে সীমার মধ্যে ধরা দেয়, সেখানে তা কেবল একটি গোলাপের পাপড়িতে পরিণত হয়। যখন আমরা এই ক্ষেত্র বিনষ্ট করি, তখন গোলাপের পাপড়িটি অবাস্তব হতে শুরু করে।

স্রষ্টাকে খুঁজতে গিয়ে বাস্তবতা অবাস্তবতা এবং সসীম অসীমের মধ্যে এই দ্বান্দ্বিকতা মানুষের মধ্যে এক প্রকার ঔদাসীন্য তৈরি করে। প্লেটো বিশ্বাস করতেন, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ সতত পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হওয়া এর বৈশিষ্ট্য। আজকের দিনে পরিবর্তনশীল এই বস্তু সম্পর্কে লব্ধ জ্ঞান আগামীকাল নতুন তত্ত্বের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। অপরদিকে, ভাবজগৎ সম্পর্কে লব্ধ জ্ঞান অপরিবর্তনীয়। কারণ, তা ইন্দ্রিয়নির্ভর নয়, বরং মানুষের প্রজ্ঞা দিয়ে অর্জিত। তিনি মনে করতেন, প্রজ্ঞার এই ব্যবহার আত্মনিয়ন্ত্রণের মূল সূত্র। আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জাগতিক ঐশ্বর্য বিলাসদ্রব্যের প্রলোভন থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা সম্ভব। চারপাশে বিদ্যমান উপভোগ্য ঐশ্বর্য বা বিলাসদ্রব্যের উপস্থিতি খুবই ক্ষণস্থায়ী; তাই সামান্য অভ্যাসের মাধ্যমে এগুলোর প্রয়োজন থেকে নিজেকে মুক্ত করা সম্ভব। পাশ্চাত্যের এই বৈরাগ্য দর্শনের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন ডায়োজেনিস [Diogenes]। তাঁর সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে। গল্পটি এমনডায়োজেনিস একটি পিপার মধ্যে থাকতেন। তাঁর কেবল একটি আলখাল্লা, একটি লাঠি আর রুটি রাখার একটি থলে ছিল বলে কথিত রয়েছে। একদিন তিনি পিপার পাশে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিলেন। এমন সময় দিগ্বিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সম্রাট তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন, এমন কিছু কি আছে যা তিনি চান? ডায়োজেনিস উত্তরে বললেন, হ্যাঁ, চাই। এক পাশে সরে দাঁড়ান। আপনি রোদ আটকে দাঁড়িয়ে আছেন অর্থাৎ জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে যার অবস্থান, তাঁর সম্মুখে ক্ষমতাবান সম্রাটের উপস্থিতি কিংবা প্রতিশ্রুতি পূরণের অঙ্গীকার কোনো পার্থক্য তৈরি করে না।

আত্মনিয়ন্ত্রণ এখানে মুখ্য বিষয়। এ জন্য দেহের মতো আত্মারও প্রয়োজন খাবারের; তবে একটু ভিন্ন প্রকৃতির। সেই অমৃতের সন্ধানে বাউলগণ ছুটে যায় প্রকৃতির কাছে। নিবিষ্ট হয় প্রকৃতির সঙ্গে আত্মার যোগসূত্র স্থাপনে। প্রকৃতির উদারতা বিশালতার মাঝে নিজের অস্তিত্বের সন্ধান তাঁকে ধাবিত করে আধ্যাত্মিকতার নিগূঢ় রহস্য উন্মোচনে। যখনই এই বিনে সুতার সংযোগ স্থাপিত হয়; জাগতিক চাওয়া-পাওয়া নিতান্ত বাহুল্য মনে হয়। আবার চিত্তবৃত্তি নিরোধের মূল খুঁজে পাওয়া যায় বহুপ্রাচীন ভারতীয়-যোগশাস্ত্রে। যোগশাস্ত্রের বিশেষ দুটি উপাদান হলো অভ্যাস বৈরাগ্য। অভ্যাস আত্মনিয়ন্ত্রণের অন্যতম মাধ্যম। এভাবে পরমাত্মার সন্ধানে ইন্দ্রিয়সমূহকে ব্যস্ত রাখার অভ্যাসের মাধ্যমে পার্থিব চাহিদা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার সামর্থ্য অর্জনের প্রচেষ্টা থেকেই বৈরাগ্যের জন্ম। এই বৈরাগ্যই হলো সুফিবাদের অন্যতম শাখা।

শরদিন্দু ভট্টাচার্য সুফিবাদকে আখ্যায়িত করেছেন একধরনের মরমিবাদ হিসেবে, যার মধ্যে রয়েছে বৈরাগ্যবাদ সর্বেশ্বরবাদের অপূর্ব সমন্বয়। তিনি সুফিবাদের উদ্ভবের চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, আরবদের নিকট অগ্নি উপাসক পারসিকগণ পরাজিত হলে তাঁদের মধ্যে যে নৈরাশ্যবাদের উদ্ভব ঘটে, তাই তাঁদেরকে ক্রমশ বৈরাগ্যবাদের দিকে ধাবিত করে; আর এই বৈরাগ্য সর্বেশ্বরবাদী চিন্তাচেতনা থেকেই উৎপত্তি লাভ করে সুফিবাদ। উল্লেখ্য, সুফিবাদ মূল আরব ভূখণ্ড থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হলেও প্রাচীন আর্য-অধ্যুষিত ইরানে তার পরিবৃদ্ধি। পারস্যের অধিবাসীগণ বিজয়ীদের ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মের প্রতি অনুগত ছিলেন না; বরং প্রাচীন সভ্যতা সংস্কৃতির গর্বসম্পন্ন জাতি নতুন ধর্মের অনুশাসন আনুষ্ঠানিকতার প্রতি ছিলেন সম্পূর্ণরূপে উদাসীন। নতুন পুরাতনের সংঘর্ষ মিশ্রণে ভিন্ন একটি মতের উদ্ভব ঘটা তখন তাই ছিল খুবই স্বাভাবিক। একদিকে প্রাচীন বিশ্বাস ঐতিহ্য, অন্যদিকে নতুন ধর্ম রাজনৈতিক হতাশা; এসবের ফলস্বরূপ পারসিকদের মনে জন্ম নেয় সর্বেশ্বরবাদ বৈরাগ্যবাদী চেতনা। কারণে এতদঞ্চলে সর্বপ্রকার পার্থিব ভোগসুখের প্রতি উদাসীন একটি গোষ্ঠী গড়ে ওঠে; বলা বাহুল্য, এরাই সুফি সম্প্রদায়। অর্থাৎ আরবীয় কিংবা ইরাকি নয়; পারসিক বা ইরানিদের হাতেই উৎপত্তি ঘটে মানবতাবাদী সুফি মতের।

পারস্যের অনুরূপ ঘটনা সংঘটিত হয় ভারতবর্ষেও। প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন রাজবংশের ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়। এই অস্থিরতা এবং তৎকালীন সামন্তপ্রভু কিংবা সমাজের উঁচুতলার মানুষের দ্বারা নির্যাতিত, শোষিত বঞ্চিত সাধারণ বা নিম্নশ্রেণির দিশেহারা মানুষ ধর্মান্তরিত হওয়ার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়াস পায়। ক্ষেত্রে ইসলামের পতাকাতলে শামিল হওয়ার প্রবণতা ছিল লক্ষণীয়। কারণ, পশ্চিম থেকে আগত ধর্মপ্রচারকদের শুধু সম্মোহনী শক্তিই ছিল না, ছিল সাংগঠনিক দক্ষতা এবং চাষাবাদ সম্পর্কে প্রগাঢ় জ্ঞান। ইটন ধরনের পীরদের উদ্যোক্তা পীর নাম দিয়েছেন। এই উদ্যোক্তা পীরের প্রভাবে বৌদ্ধধর্মের অনুসারী অনেকেই ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়; আবার বিপরীতমুখী হলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নতুন করে জীবন সাজাতে সচেষ্ট হয়। মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিজয়ী আরব-তুর্কিদের আগমন ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার পালে হাওয়া লাগে। তবে, বাহ্যিকভাবে তাঁরা ধর্ম পরিবর্তন করলেও আচরণে প্রাধান্য পায় তাঁদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ফলে এই বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদ সামাজিক আচরণের সংমিশ্রণে একটি নতুন মতবাদ গড়ে ওঠে। আহমদ শরীফের ভাষায়—‘সেদিন ইসলামের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ব্যক্তিস্বাধীনতার মহিমা যে আবেগ মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছিল, তারই ফলে মন্দির ছেড়ে মসজিদের পথে না গিয়ে উদার আকাশের নিচে স্রষ্টার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপনের নতুন প্রয়াস মাত্র।

এই নতুন মতবাদই পরিচিতি পায় বাউল ধর্ম বা লৌকিক ধর্ম হিসেবে। ফলে তারা ধর্মীয় রীতি সামাজিক আচরণের মতো প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে ওঠার একটি সুযোগ পায়। বিভিন্ন মত পথ, ধর্মীয় সামাজিক আচরণে অভ্যস্ত মানুষগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ লেনদেন সহজ হয়। বিকশিত হয় নতুন আচরণ জ্ঞান। এই মতের অনুসারীগণ প্রচলিত ধর্মীয় সামাজিক বিভাজন বা আচরণের ঊর্ধ্বে উঠে স্রষ্টা বা পরমাত্মাকে নতুনভাবে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে।

ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ভারতবর্ষে একই ধরনের বৈরাগ্যের উদ্ভব ঘটেছে। প্রশ্ন হলো, ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশে একই ধরনের জ্ঞান বা বৈরাগ্য কি সম্পূর্ণ পৃথকভাবে বিকাশ লাভ করেছে, নাকি এদের মধ্যে কোনো যোগসূত্র রয়েছে! এই প্রসঙ্গে কন্টিনেন্টাল ড্রিফট তত্ত্ব একটি পথের নিদর্শন দিতে পারে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীর ভূ-ভাগ কোনো এক সময়ে একত্র ছিল। কিন্তু ভূ-অভ্যন্তরের প্রচণ্ড তাপমাত্রা আলোড়নের ফলে ভিত্তি-প্লেটগুলো প্রতিনিয়ত স্থানান্তরিত হয়। এভাবে কোটি কোটি বছর যাবৎ স্থানান্তরিত হতে হতে বর্তমান অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। পৃথিবীর মানচিত্র পর্যবেক্ষণ করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। অর্থাৎ পৃথক হয়ে যাওয়া ভূ-ভাগ বা মহাদেশগুলোকে যদি ঠেলে ঠেলে কাছে নিয়ে আসা হয়, দেখা যাবে আমেরিকা মহাদেশের পূর্ব কিনার ইউরোপ আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিম কিনারের সঙ্গে পারফেক্টলি ফিট করছে। একইভাবে মনে হবে গভীর অভিমানে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে গেছে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ। কিংবা ইন্দোনেশিয়া বিচ্ছিন্ন হয়েছে হংকং ভিয়েতনামের মধ্যবর্তী উপকূল থেকে। অধিকন্তু ভিন্ন ভিন্ন পারফেক্ট ফিট স্থানে একই রকম জীবাশ্ম, পাথর, প্রাণী উদ্ভিদ প্রজাতির উপস্থিতি এই তত্ত্বের সমর্থনে জোরালো প্রমাণ হিসেবে আবির্ভূত হয়। অর্থাৎ একই অভিন্ন মূল সুস্পষ্ট। তেমনি জ্ঞান অন্বেষণের প্রচেষ্টা কখনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ থাকেনি। একটি মত অনুযায়ী পাশ্চাত্য দর্শন সম্পর্কে জানতে সম্রাট অশোকের সময় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ইউরোপে প্রেরণের নজির রয়েছে। আবার ভারতীয় দর্শন তথা জ্ঞানকে আরবিতে অনুবাদের জন্য ভারতীয় পণ্ডিতবর্গকে আরবদের রাজদরবারে নিয়োগ করার তথ্যও পাওয়া যায়। অপর মত গুরুত্ব প্রদান করে আরবদের দিগ্বিজয়ী বৈশিষ্ট্যকে। আরবগণ যেমন আফ্রিকা থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাদের সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছে, একইভাবে তারা ভারতবর্ষেও প্রবেশ করেছে বিজয়ীর বেশে। দ্বিতীয় এই মত অধিকতর গ্রহণযোগ্য আলোচিত এবং ইসলামের প্রসার এখানে মিসিং লিঙ্ক হিসেবে কাজ করছে। ইসলামি শাসকগণ কেবল রাজ্য জয়ই করেনি, বরং সাহিত্য-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতাও করেছে। স্বাভাবিকভাবেই পাশ্চাত্যের দর্শন বা জ্ঞান আরবদের মাধ্যমে আত্মস্থ হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছে মর্মে অনুমেয়। কারণেই এই জ্ঞানের মধ্যে সুফিবাদ বা বাউলিয়ানার প্রভাব সুস্পষ্ট। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতো নেত্রকোনাও এর ব্যতিক্রম নয়। ১০৫৪ খ্রিস্টাব্দে হজরত শাহ সুলতান কমরউদ্দীন রুমী [রহ.]-এর আগমনের মাধ্যমেই এই অঞ্চলে ইসলামের প্রচার প্রসার শুরু হয়। তিনি শুধু ধর্ম প্রচারই করেননি, বরং মানুষের সামাজিক প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রেও রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। এতদঞ্চলের মানুষের মধ্যে তাঁর প্রভাব আজও ম্লান হয়নি এতটুকু।

ড. আকবর আলি খান বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ বইয়ে বাংলায় ইসলাম প্রচারের সাফল্যের নানান তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। বিভিন্ন প্রকার তথ্য তত্ত্ব আলোচনাপূর্বক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, বাংলায় ইসলামের প্রচার হয়েছে সুফি-দরবেশদের মাধ্যমে। ইসলামের এই বিস্তারে উম্মুক্ত গ্রাম অর্থাৎ দুর্বল সামাজিক রীতি-নীতিবিশিষ্ট গ্রাম প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। সর্বত্র প্লাবন ভূমি বা জলাধিক্য গ্রামীণ বন্ধন বা রীতিগুলোকে দুর্বল করে দেওয়ায় গোষ্ঠীর চেয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে শক্তিশালী সামাজিক সংগঠন বা গোত্রে যেমন গণধর্মান্তর সম্ভব হয়, উন্মুক্ত গ্রামের ক্ষেত্রে এই ধর্মান্তরে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। আধ্যাত্মিক নেত্রকোনায় এই ভাষ্য বা মতবাদের পূর্ণ প্রতিফলন দেখা যায়। এখানে গ্রামের পর গ্রাম পানিবিধৌত। গ্রামের বাড়িগুলো ছড়ানো-ছিটানো। ধর্মান্তরের প্রক্রিয়া ছিল খুবই মন্থর। তাই, আজও দেখা যায় হিন্দু-মুসলমানদের চমৎকার সহাবস্থান এবং সাংস্কৃতিক অংশীদারত্ব। তাদের জীবন কর্মে পীর-ফকির বা সুফি প্রভাব লক্ষণীয়।

বাংলার বাউলেরা ধর্মাচার ধর্মবিশ্বাসের সমন্বয় ঘটিয়েছিল তাদের ধর্মাচরণে। অর্থাৎ ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মতবাদের সঙ্গে সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে সামাজিক আচরণের। ফলে নতুন পুরাতনের এই মিশ্রণে মৌলিকত্ত্ব হারিয়েছে সকলেই। উদ্ভব হয়েছে এক স্বতন্ত্র মতবাদের, যেখানে প্রাধান্য পেয়েছে মানবতা বা লৌকিকতা। প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, ‘… জিনিস হিন্দু মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি, এই মিলনে সভা-সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়নি, এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা সুর অশিক্ষিত মাধুর্য সরস। এই গানের ভাষায় সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে, কোরান-পুরাণে ঝগড়া বাধেনি। বাংলার এই বাউলমত মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত সুফিবাদের প্রবল প্রভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। ফলে মানবতাবাদের কেন্দ্র আলোকিত করেছে অসাম্প্রদায়িকতা। নেত্রকোনার বাউল শরত চন্দ্রের দীন শরতের এসলাম সঙ্গীত তার উদাহরণ। হিন্দুধর্মের অনুসারী হলেও তিনি এসলাম সঙ্গীত বইয়ে সৃষ্টিকর্তার মহিমা, দেহতত্ত্ব, মৌতনামা, নামাজনামা, আখেরাতসহ ইসলাম-সম্পর্কিত খুঁটিনাটি বিষয়ের হৃদয়গ্রাহী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। হাজী বাবা এবং মৌলানা মায়ের সন্তান কিশোর আব্দুল মজিদ বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় খুঁজে পান বাউল সাধক গোবরধন-এর আখড়ায়। কবিয়াল লাল মাহমুদ চর্চা করেছেন রামায়ণ, মহাভারত, চৈতন্য চরিতামৃত। অর্থাৎ হিন্দু বাউলের মুসলিম গুরু কিংবা বিপরীতমুখিতা এখানে গৃহীত হয় খুবই সাধারণ ব্যাপার হিসেবে। নেত্রকোনার পীর-মুর্শিদের মাজারে আজও ব্যাপক আনাগোনা রয়েছে সকল ধর্মের অনুসারীদের।

বাউল সাধকগণ দেহের মধ্যে পরমাত্মাকে খুঁজে ফেরেন। তাঁদের এই নীতিকে ড. আহমদ শরীফ উদ্ধৃত করেছেন know thyself, আত্মানং বিদ্ধিনিজেকে চেনো হিসেবে। অর্থাৎ যে নিজেকে চিনেছে, সে আল্লাহকে চিনেছে সৃষ্টিকর্তা প্রথমে রুহ বা আত্মা সৃষ্টি করেছেন এবং পরবর্তীকালে দেহ তৈরি করে তার মধ্যে রুহকে স্থাপন করেছেন। গানের কথায় মাটির একখান কেস বানাইয়া, মেসিন দিছে তার ভিতর অর্থাৎ আত্মা দেহ পৃথক সত্তা হিসেবেই প্রকাশিত। পাওলো কোয়েলহোর মতে, দেহ হলো পবিত্র আত্মার মন্দির তাই, আত্মাকে পবিত্র রাখার জন্য দেহের পবিত্রতা বা পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে সকল ধর্মমতে বা সাধনায়। অর্থাৎ আত্মার আধার হিসেবে দেহ গুরুত্বপূর্ণ। অধিকন্তু সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন নিজ হাতে; দিয়েছেন শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা। মানুষের কল্যাণেই নিয়োজিত করেছেন পৃথিবীর সবকিছু। এ জন্য কেউ কেউ মানুষকে উল্লেখ করেন স্রষ্টার সর্বোত্তম প্রতিরূপ হিসেবে। বাউল রশিদ উদ্দিনের বর্ণনায় বিষয়টি প্রস্ফুটিত হয় অনন্য রূপে-

দেখবি তাহার রঙ ছুরত অবিকল তোমারি মত
তোমার সঙ্গে অবিরত করে চলাচল
তোমার রঙে রঙ ধরেছে হইয়াছে একমিল
তোরে দেখলেই তারে মিলে আর কারে তুই দেখবি বল।। 

সুফি সাধকগণও মানবদেহের মধ্যেই স্রষ্টার অস্তিত্ব খুঁজে পান। বিখ্যাত সুফিসাধক মাওলানা রুমীর মসনবি রুমী মূল ইংরেজি ভাষ্য থেকে ড. আহমদ শরীফের অনুবাদে বিষয়টি ফুটে উঠেছে এভাবে—‘তাঁকে আমি খুঁজে ফিরেছি পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। কোথাও তাঁর সন্ধান আমি পেলাম না। মন্দিরে, মসজিদে, গির্জায়কোথাও না। তাঁর সন্ধান কেউ আমায় দিতে পারল না। হেরার পর্বত গুহা থেকে শুরু করে কাবুল কান্দাহার পর্যন্ত পাগলের মতো তাঁকে আমি খুঁজে ফিরেছি। কিন্তু তবু তো তাঁকে পাওয়া আমার হলো না। তারপর সব খুঁজাখুঁজির শেষে যখন আমি আমার নিজের হৃদয়ের দিকে তাকালাম। তখন দেখলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি মধুর হেসে বলছেএই আমি।’

এই একই কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলেছেন

কে তোরা খুঁজিস তাঁরে, কাঙাল বেশে দ্বারে দ্বারে
দেখা মেলে না, মেলে না
তোরা আয়রে ধেয়ে, দেখরে চেয়ে আমার বুকে
ওরে দেখরে আমার দুই নয়নে
প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তায় সকল খানে।

আবার বাউলিয়ানা সম্পর্কে অধ্যাপক যতীন সরকারের মতামত হলো, বাংলার লৌকিক ধর্ম শুধু ইহবাদী নয়, সোহংবাদীও। অর্থাৎ ধর্ম আকাশে বা কাল্পনিক স্বর্গে অবস্থিত ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, এ-ধর্ম আস্থা রাখে অনুমান-এ নয় বর্তমান-এ; এ ধর্মের অনুসারী মানুষ নিজের ভেতরেই ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করে; এ ধর্মে খোদ খোদা এই খোদ বা অহং বা আমি দৃশ্য অদৃশ্য রূপে সমগ্র বিশ্বে পরিব্যাপ্ত পরিব্যক্ত,এই আমির বাইরে অন্য কিছুরই অস্তিত্ব নেই। এই আমিকে চিনলেই খোদাকেও চেনা যায়

নেত্রকোনার বাউলগণও এই দেহের আরাধনায় বিশ্বাস করতেন। দেহের মধ্যেই আত্মার স্বরূপ খুঁজে ফিরেছেন। লালন ফকিরের বিখ্যাত গানের কথা আট কুঠুরি নয় দরজা অনুসরণে জালাল খাঁ তার বসার ঘরটি বানিয়েছিলেন আটটি চাল নয়টি দরজা-জানালা এবং আট কোনাবিশিষ্ট। তিনি প্রাণখুলে গেয়েছেন

তুমি যে অনন্ত অসীম, আমাতে হয়েছ সসীম;
কালী-কৃষ্ণ করিম-রহিম কত নামে ডাকছি তাই।।

নেত্রকোনায় বাউলগানের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। কারণ, এই গান মানুষের হৃদয়ের গভীর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসারিত। এই গান মানুষের প্রাণের কথা বলে। স্রষ্টার সঙ্গে বিচ্ছেদের কথা বলে। মানুষের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা বলে। তবে, বাউলগানের আসরে বাউলগণ কর্তৃক মাদকসেবন নানাবিধ অনাচারের বিষয়েও কেউ কেউ অভিযোগ করেন। কারণে বাউলগানকে নিষিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রায় পৌনে শতাব্দী পূর্বে ১৯৫১ সালের শীতের মৌসুমে শরীয়তপন্থী আলেম সমাজ এক ধর্মসভার আয়োজন করে। নেত্রকোনা সদর উপজেলার বালী অনন্তপুর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আয়োজিত উক্ত সম্মেলনকে সার্থক জনবহুল করার নিমিত্ত সে-সময়ে প্রচারপত্রও বিলি করা হয়। খবর জানতে পেরে বাউলগণও প্রতিবাদী আসরের আয়োজন করে। এই আয়োজনে মুখ্য ভূমিকা রাখেন লেটিরকান্দার পীর আছমত আলী শাহ ফকির। বালী অনন্তপুর গ্রামের মিরাজ আলীর বাড়ির সামনে অনুষ্ঠিত উক্ত আসরে বাউল রশিদ উদ্দিন, উকিল মুন্সি, উপেন্দ্র সরকার, মিরাজ আলীসহ তখনকার বিশিষ্ট বাউল সাধকগণ যোগদান করেন। মুরিদানের জিকিরের জোশ এবং বিরতিহীন বাউলগানে জমে ওঠে আসর। বাউলগানের তৎকালীন নামজাদা এই সকল মহারথীর উপস্থিতিতে আকৃষ্ট হয়ে লোকসমাগম ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে আলেমদের বাউলবিরোধী ধর্মসভা ভণ্ডুল হয়ে যায়। অপরদিকে বাউলগানের আসর চালু থাকে গভীর রাত অবধি। বাউলগানের এই জনপ্রিয়তা গ্রহণযোগ্যতাই উকিল মুন্সিকে মসজিদে ইমামতি করার পাশাপাশি বাউলগান চর্চার সুযোগ করে দিয়েছে। দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে পাস করা মাওলানা মিরাশ উদ্দিন পেশায় ছিলেন হাইস্কুলের হেড মৌলভী; অথচ নেশায় ছিলেন একজন বাউল। চর্চা করেছেন বাউলিয়ানা। এমন উদাহরণ নেত্রকোনার প্রত্যেক মানুষের অন্তরে লুকিয়ে থাকা বাউলিয়ানার দিকেই ইঙ্গিত করে।

নেত্রকোনার লোকসাহিত্য সংস্কৃতি বইয়ে সঞ্জয় সরকার শতাধিক বাউলের একটি তালিকা দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে বর্ণিত বাউল কবি আব্দুল মজিদ তালুকদার, জালাল উদ্দিন খাঁ, রশিদ উদ্দিন, উকিল মুনশি ছাড়াও রয়েছেন মিরাজ আলী, ইদ্রিস আলী, আলী হোসেন সরকার, চাঁন মিয়া, পীতাম্বর নাথ প্রমুখ। থেকেই নেত্রকোনার মানুষের জীবনে বাউলিয়ানার প্রভাব স্পষ্ট হয়। বাউলগান বা বাউলিয়ানাকে নেত্রকোনার মানুষ গ্রহণ করেছে একান্ত নিজের সংস্কৃতি বা সুর হিসেবে। বাংলায় বাউলিয়ানার আদিপুরুষ ধরা হয় কুষ্টিয়ার লালন ফকিরকে। তিনিই বাউলগানকে প্রতিষ্ঠিত করেন সঙ্গীতের একটি ধারা হিসেবে। অন্যান্য অঞ্চলের বাউলদের মতো নেত্রকোনার বাউলগণও তাঁকে অনুসরণ করেছেন। তবে, নেত্রকোনার বাউলগণ লালনকে আত্মস্থ করে নিজেদের মতো করে একটি নতুন ধারা তৈরি করে নিয়েছেন। কতিপয় বিশেষত্ব নদীয়া, কুষ্টিয়া বা যশোর এলাকার বাউলদের থেকে নেত্রকোনার বাউলদের করেছে স্বতন্ত্রমণ্ডিত। নেত্রকোনার বাউলগণ ছিলেন পুরোদস্তুর সংসারী। পাহাড় হাওরে ঘেরা নেত্রকোনার অবস্থানই যেন সমস্ত পৃথিবীর বিচ্ছিন্ন এক প্রান্তে। তাই, সাধনার জন্য সেখান থেকে নির্জনে যাওয়ার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। লালনপন্থী বাউলগণ গুরুর নিকট দীক্ষা লাভ করলেও নেত্রকোনার বাউলগণ পীর বা ফকিরের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করতেন। ফলে তাঁদের আচরণে সুফিবাদ তথা পীর-মুর্শিদের প্রভাব অত্যন্ত লক্ষণীয়।

বাইরে থেকে আসা কোনো কিছুকে নিজের বা নিজেদের ছাঁচে ফেলে নিজেদের মতো করে তৈরি করে নেওয়ার নামই হলো আত্মস্থকরণ [contextualization]। বাইরে থেকে আসা তত্ত্বগুলো কতটা টেকসই হবে, সেটি নির্ভর করে কতটা সাফল্যের সঙ্গে তা আত্মস্থ করা যায় তার ওপর। বিশ্বায়নকে সঠিকভাবে আত্মস্থ করতে না পারার কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে; কিন্তু চীন সাফল্যের সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে নিজেদের উন্নয়নে। নেত্রকোনার ক্ষেত্রে এই বাউলিয়ানাতেও তেমনটিই ঘটেছে। এই অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষাপট বাউলদের মধ্যে প্রখর দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে। তাই তো, ফকির বিদ্রোহ, পাগল বিদ্রোহ, টঙ্ক আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে বাউলগণ সম্পৃক্ত হয়েছেন অবলীলায়। লেটিরকান্দার টিপু পাগলার হাত ধরে বিকশিত পাগলপন্থা আন্দোলন ব্রিটিশদের হাতে পতন ঘটলেও টিপু পাগলের বাড়ি লৌকিক ধর্মচেতনার ধারক-বাহকদের তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়। আর এই আখড়াকে কেন্দ্র করেই বাউলগানের নেত্রকোনা ধরন তৈরি হয় বলে অনেকে মনে করেন। ময়মনসিংহের লোক সাহিত্য প্রবন্ধে আবদুর রাজ্জাক ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব পশ্চিম তীরের জনপদের গহিনে কান পেতে খুঁজে পেয়েছেন সুরের বৈচিত্র্য। তাঁর মতে, পশ্চিম তীরের ইতিহাস ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ, তাই তার কথা বেশি, সুর কম। পূর্ব-তীরের জনপদে শুধু সুর আর সুর। সে সুর কোথাও উঁচু, কোথাও টানা, কোথাও-বা গভীর। অনাহত তরঙ্গে তার কারুকাজ। প্রকৃতি থেকে এর জনপদবাসীদের আলাদা করে দেখার কোনো উপায় নেই। প্রকৃতির সাথে সংযোগ স্থাপনে তাদের লীলা প্রকাশিত মানুষ আর প্রকৃতি এখানে একাকার হয়ে থাকে বাউলগান তাই নেত্রকোনার নিজস্ব সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। স্বল্প শিক্ষিত মানুষগুলোর অন্তরের অকপট অনুভূতি প্রকাশিত হয় তাদের সুরে সামাজিকতায়। নেত্রকোনার প্রত্যেক মানুষের অন্তরের গহিনে লুক্কায়িত রয়েছে একেকজন বাউল। নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, পরিপাটি রাজনীতিবিদ কিংবা আপাদমস্তক গৃহস্থ একজন মানুষ আপন খেয়ালে গেয়ে ওঠে জীবনের জয়গান; সংগ্রহ করতে নেমে পড়ে পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লৌকিক সম্পদ। এভাবে নেত্রকোনার বাউলিয়ানা জীবন্ত হয়ে আছে সেখানকার মানুষের হৃদয়ের একান্ত গভীরে।

 

তথ্যসূত্র

১. আকবর আলি খান, বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ, প্রথমা প্রকাশন, ১৯ কারওয়ান বাজার, ২০১৯, ঢাকা-১২১৫।
২. আবদুর রাজ্জাক, ময়মনসিংহের লোক সাহিত্য [শাকির উদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ময়মনসিংহের সাহিত্য ও সংস্কৃতি, জেলা পরিষদ, ময়মনসিংহ, ১৯৭৮ [পুনর্মুদ্রণ, অক্টোবর ২০০০]।
৩. আলী আহাম্মাদ খান আইয়োব , নেত্রকোনা জেলার ইতিহাস, বইপত্র, ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ২০০৭, ঢাকা-১১০০।
৪. আহমদ শরীফ, বাউল ও সুফি সাহিত্য, অন্বেষা প্রকাশন, পি.কে. রায় রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।
৫. ইয়েস্তেন গার্ডার, সোফির জগত [অনুবাদ: জিএইচ হাবীব, ২০০২, সন্দেশ, আজিজ সুপার মার্কেট, ২০১০, শাহবাগ, ঢাকা]।
৬. জাকির শাহ, বাউলকবি রশিদ উদ্দিন, বন্ধু লাইব্রেরি অ্যান্ড পাবলিকেশন, ২০১৯, জিন্দাবাজার, সিলেট।
৭. জালাল উদ্দীন খাঁ, জালালগীতিকা সমগ্র [সম্পাদনা যতীন সরকার, ২০০৫, নন্দিত, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা।
৮. পাওলো কোয়েলহো, মাকতুব [অনুবাদ: মোহাম্মদ হাসান শরীফ, ২০২০, অন্যধারা, ৩৮/২-ক বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০]।
৯. মাসুদ সিদ্দিকী, লোকসাধনার সংস্কৃতি, ধ্রুবপদ, ৬৮-৬৯ প্যারীদাস রোড, ২০১৩, ঢাকা-১১০০।
১০. মোহাম্মদ আাজিজুল হক চৌধুরী, ময়মনসিংহের লোকগীতি ও লোকসঙ্গীত [শাকির উদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ময়মনসিংহের সাহিত্য ও সংস্কৃতি, জেলা পরিষদ, ময়মনসিংহ, ১৯৭৮ (পুনর্মুদ্রণ, অক্টোবর ২০০০)]।
১১. মো. গোলাম মোস্তফা, মজিদগীতি সমগ্র [সম্পাদিত], সৃজনী, ৪০/৪১ বাংলাবাজার, ২০২০, ঢাকা-১১০০।
১২. যতীন সরকার, ময়মনসিংহের কবিগান ও কবিয়াল, [শাকির উদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ময়মনসিংহের সাহিত্য ও সংস্কৃতি, জেলা পরিষদ, ময়মনসিংহ, ১৯৭৮ (পুনর্মুদ্রণ, অক্টোবর ২০০০)]।
১৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্যক্তিত্ব, অনুভব প্রকাশনী [২০১৯], ঋষিকেশ দাস রোড, শিংটোলা, ঢাকা-১১০০।
১৪. শরদিন্দু ভট্টাচার্য, বাউল বৈষ্ণব সুফী, রোদেলা প্রকাশনী, ৬৮-৬৯ প্যারীদাস রোড, ২০১৯, ঢাকা-১১০০।
১৫. সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনার লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি, আবিষ্কার প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ঢাকা।