উপনিবেশবিরোধী শিল্প শতাব্দীর আখ্যান
দুনিয়ার দেশে দেশে উপনিবেশ বিস্তারের ইতিহাস নতুন নয়, পুরাতন। সাম্রাজ্য বিস্তারকারীদের ইতিহাস পরখ করলে স্পষ্ট হবে—তাঁরা যেন সভ্যতার সকল দায় নিয়ে পরদেশ দখল করেন। প্রত্যেক সাম্রাজ্য বিস্তারকারী শাসক বলেন, ‘আর দশ দেশ দখলের মতো এটি নয়, যার লক্ষ্য লুণ্ঠন বা নিয়ন্ত্রণও নয়। বরং সভ্যতা, গণতন্ত্র আর মানুষকে মুক্ত করাই তাঁদের উদ্দেশ্য।’ মার্তিনিকের দার্শনিক ফ্রাঞ্জ ফানোঁর কথা বিবেচনায় আনলে বলা যায়, কথিত নিষ্ঠুর শাসকেরা মানবসভ্যতার বিস্তারের নামে এমন উপনিবেশের গোড়াপত্তন ঘটান। উপনিবেশ কায়েমের পেছনে প্রধান রহস্য দুটো—ভিনদেশে ক্ষমতা-ব্যবসার বিস্তার আর সম্পদের লুণ্ঠন। উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। সেই সময়ের হিসাব ভিন্ন, কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের ফল জনসংস্কৃতি, শিল্পসাহিত্যের ওপর বিরূপ প্রভাবগুলো কোনো না কোনোভাবে বর্তমান থাকে। তাতে নিহিত থাকে ঐতিহাসিক সূত্রও। ঐতিহাসিক এমন সূত্রকে অবলম্বন করে আশির দশকের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী ঢালী আল মামুনের প্রদর্শনী শতাব্দীর আখ্যান। প্রদর্শনীর আমরা কয়েকটি দিক আলোকপাত করব।
প্রশ্ন হলো—কেন প্রদশর্নীর নাম শতাব্দীর আখ্যান? সহজ ভাষায় বললে—শতাব্দীকাল ধরে ঔপনিবেশিক শাসনামলের সংগঠিত নানা ঘটনাপ্রবাহ, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষতচিহ্ন, স্মৃতিসত্তার শৈল্পিক উপাদানকে শিল্পী ঢালী আল মামুন ক্যানভাসে ঠাঁই করে নিয়েছেন। এটা নিছক অতীতের ঘটনা কিংবা বিষয়বস্তুর উপস্থিতি নয়, তাঁর উপস্থাপিত শিল্প অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সংযোগের চিহ্ণগুলো স্পষ্ট করার নতুনতর প্রয়াস। ঢালীর শিল্পের বড় গুণ সরল সচিত্রকরণ নয়, বরং সমালোচনামূলক রাজনৈতিক শিল্পের অর্গল খুলেছেন তিনি। উত্তর-উপনিবেশ যুগে বাংলাদেশের শিল্পকর্মে এমন শিল্পরূপ চর্চা নেই বললে চলে। আমাদের শিল্পচর্চার ধরন মূলত পশ্চিমা আধুনিকতা শাসিত নয়তো আধুনিকতার সাথে দেশীয় উপাদান মিশ্রিত। সেই ক্ষেত্রে গতানুগতিক আধুনিকতার বাইরে ঢালী আল মামুনের শতাব্দীর আখ্যান নতুন অর্থ বহন করে। কেননা তাঁর শিল্পের অন্তর্গত সুরে বাঁধা জাত-পরিচয়, ঐতিহাসিক ভাষায় অবলম্বন, স্মৃতিনির্ভরতা ও ইতিহাসের ট্রমা। সেটা কীভাবে?
শতাব্দীর আখ্যান নামায়নে মনে হতে পারে—ঢালী আল মামুন সময়ের ছকে সুনির্দিষ্ট কালখণ্ডকে শিল্পে কোশেশ করেছেন। বস্তুত ভূখণ্ড দখলজনিত উপনিবেশকে একটা নির্দিষ্ট সময় ছকে ফেলা সম্ভব। কেননা কোনো ভূখণ্ডের পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত তার কালখণ্ড। সময়ের নির্দিষ্ট ছক নয়, বরং ঢালীর শিল্পকর্ম তিন সময়খণ্ডের আখ্যান রূপে জারি থাকে। জায়মান তিন সময়খণ্ড—উপনিবেশ-পূর্ব, উপনিবেশ-কাণ্ড আর উপনিবেশ-উত্তর সময়হীনতার দিকে নিয়ে যায়। ফলে তিনি অতীতকে বর্তমানের পাটাতনে আর বর্তমানকে ভবিষ্যতের সময়ের দিকে নিয়ে গেছেন। তাঁর আখ্যান নিছক শত অব্দের নয়, সময়হীনতার এক বিশেষ ইতিহাস। ফ্রেদরিখ হেগেল নন্দনতত্ত্বের বিচার করতে গিয়ে বলেন, সময় শেষের আগেই ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে। বলা যায়, ইতিহাস সময়ের মাথায় চড়ে চলে। কেননা ইতিহাস শেষ হলেও সময় শেষ হয় না। সেই ক্ষেত্রে ঢালীর শতাব্দীর আখ্যান সমাপ্ত ইতিহাসের অসমাপ্ত সময়ের রূপকল্প।
তাত্ত্বিকভাবে দেখলে স্পষ্ট হয়, যেকোনো ঔপনিবেশিক শাসক দখলীকৃত ভূখণ্ডের সমজাতীয়তাকে নস্যাৎ করে। আত্মসাৎ করে ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক উপাদান। যুদ্ধের ইতিহাসে দেখা যায়, কোনো দেশের রাজধানীর পতন হলে প্রথমে লুট হয় শিল্প-সংস্কৃতির আধার—জাদুঘর। তারপর শাসনকাঠামো ও অর্থনৈতিক সম্পদ করায়ত্ত করে তারা। প্রধান কারণ সমজাতীয়তাকে নস্যাৎ করলে বিজাতীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা সহজ। আর স্থানিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লুটের ভেতর দিয়ে বিজাতীয় শাসকশ্রেণির সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে অনুসরণ করতে বাধ্য করে। ফলে ঔপনিবেশিক উত্তর সময়ে জাতি-পরিচয়ের উদ্ভূত সংকট স্থানিক সংস্কৃতিতে জাতীয় পরিচয় প্রধান হয়ে ওঠে। প্রশ্ন হলো, শিল্পকলার ক্ষেত্রে সেটা কীভাবে বিরাজ করে? তর্ক বাংলায় উপস্থাপিত শিল্পী ঢালী আল মামুনের শতাব্দীর আখ্যানে সেটা দুভাবেই আমরা দেখতে পাই। প্রথমত শিল্পে তিনি স্থানিক বিষয়াবলির আশ্রয় নিয়েছেন। ইতিহাসের স্থানিক উপাদান, ঘটনাপ্রবাহ, মিথিক চরিত্র, শাসকশ্রেণির রাজরাজড়াদের প্রতীকী অবয়ব, ভূখণ্ডের ক্ষত-বিক্ষত দৃশ্য, যুদ্ধের ময়দানে ব্যবহৃত নিবীর্য ঘোড়া, শাসকশ্রেণির কাণ্ডকারখানা, নির্যাতিত মানুষের আবছা অবয়ব—এমত নানা প্রকারের রসায়ন তাঁর চিত্রকল্পে জায়মান। দ্বিতীয়ত স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া জাতি পরিচয়ের চিহ্ন পুনরুদ্ধারের অভূত প্রকল্প। এই ক্ষেত্রে তিনি ইতিহাসের লুপ্ত উপাদানের ভেতর স্থানিক লৌকিক চিহ্নাবলির সন্ধান করেছেন।
শিল্পের অন্তর্গত মহিমা হলো—ভূত ও অভূত জগতের বিষয়বস্তুর অসীমতাকে প্রকাশ, যা নিজেই অনুপস্থিত আখ্যানেরই প্রতিনিধিত্ব করে। সেই প্রতিনিধিত্বের আখ্যান শিল্পের ক্ষেত্রে মূলত নতুন ভাষার কারুকাজ। ঢালী আল মামুনের শতাব্দীর আখ্যানের ভাষা কেমন? তাঁর শিল্পকর্ম আদতে ইতিহাসজারিত ভাষা। ঢালীর আখ্যানে শিল্পের ভাষায় দেখা যায় রেখার সমানুপাতিক ব্যবহার, যা ভারসাম্যপূর্ণ। কখনো কখনো মনে হতে পারে, এটা নিছক পৃথিবীর অনুরূপ। যার নানাভাগে ভগ্নাংশের মতো ভূখণ্ড, যাতে উপনিবেশের ঘটনাপ্রবাহ ও ক্ষতচিহ্নগুলো স্পষ্ট হয়ে আছে। এমনকি—ক্যানভাসে পাত্রপাত্রীর অবয়ব নির্যাতিত মানুষের পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণির কাঠামোগত রূপেরও প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু শাসকের উপস্থাপিত অবয়বে তিনি কখনো ক্রূর, কখনো ব্যঙ্গাত্মক, কখনো সম্পদের ভক্ষক, আবার কখনো যুদ্ধের ময়দানে ব্যবহৃত ঘোড়াকে নিবীর্য আকারে উপস্থাপন করেছেন। নির্যাতিতের অবয়বে কোথাও তিনি ভুখানাঙ্গা মানুষের আবছা রূপ, কোথাও শোষিত শ্রমজীবী মানুষের কর্মাবলি, কোথাও স্থানিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন। শিল্পের অনুষঙ্গকে জীবন্ত করতে তিনি জয়নুল আবেদিনের মন্বন্তরের ছবিসহ নানা শৈল্পিক সূত্রের আশ্রয় নিয়েছেন; যা তাঁর শিল্পকর্মকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে।
প্রশ্ন হলো, ঐতিহাসিক শিল্পের কাজ কী? ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সংগঠিত বাস্তব ঘটনাকে শিল্পের পাটাতনে সত্যাশ্রয়ী করে তোলা। কিন্তু উপনিবেশ-উত্তর যুগে মুছে যাওয়া স্মৃতি কিংবা বাস্তব ঘটনার অনুপুঙ্খ রূপ ধারণ করা প্রায় অসম্ভব কাজ। তবে ইতিহাসের বাস্তব ঘটনার স্মৃতিচিহ্ন কিংবা অনুষঙ্গের সূত্রাবদ্ধ ভাষা যখন প্রতীকী আকারে উপস্থাপিত হয়, তখন শিল্পে ঐতিহাসিক রূপ সত্যাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে সেটা শিল্পে উপনিবেশবিরোধী পুনর্জাগরণ ঘটায়। শিল্পী ঢালী আল মামুন শতাব্দীর আখ্যানে সেই পুনর্জাগরণের কাজটিই করেছেন। মূলত তিনি শিল্পকর্মকে নিয়েছেন ইতিহাসের সুলুক সন্ধানের পাথেয় হিসেবে। যেমন তাঁর ক্যানভাসে গোলাকৃতির ব্যাসে নানা প্রকৃতির জীব এমনভাবে প্রদর্শিত আছে, যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী উপনিবেশ সমস্ত পৃথিবীতে ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরছে। যেন উপনিবেশ কালখণ্ড এক সমাপ্তিহীন সময়। তাত্ত্বিকভাবে দেখলে বস্তুত তা-ই। কেননা উপনিবেশী শাসনের পতন হলেও শাসকশ্রেণির কাঠামো, জ্ঞানকাণ্ডের প্রভাব, নির্মম অত্যাচারের চিহ্ন, স্থানিক সংস্কৃতির রূপান্তরের ক্ষত কোনো না কোনোভাবে জায়মান থাকে। ফলে উপনিবেশ-উত্তর যুগে শিল্প যখন স্থানিক সংস্কৃতিতে প্রবেশ করে, তখন সেটা সমালোচনামুখর আর আত্মপরিচয়ের শিল্পরূপে পরিগঠিত হয়। ঢালীর শিল্পকর্ম সেই আত্মানুসন্ধানের নামান্তর রূপ বটে।
উপনিবেশের স্মৃতিচিহ্ন খুব সুখকর নয়। ঔপনিবেশিক সব সভ্যতার মিশন সত্য সত্য সভ্য জগৎ নির্মাণের জন্য নয়, বরং কথিত অসভ্যতার ওপর আরেক বর্বরতা নিদর্শন বৈ কিছুই নয়। উপনিবেশের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক—ভূখণ্ড ও মানবমনের ওপর অত্যাচারের দাগ, অপ্রাকৃতিক মৃত্যুর করুণ, বিষণ্ণ, ভয়াবহ ছায়াপাত। সেই ছায়াপাতের রং কী? শিল্পী ঢালীর মত—‘ক্যানভাসে অবয়বের বিষয়, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত ও সময়খণ্ডের কথা বিবেচনা করে দেশীয় উপাদানের রং বানিয়ে নিয়েছেন, যা ছবির প্রেক্ষাপটকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। ঐতিহাসিক ক্ষতের চিহ্নগুলো সেই অর্থ খুঁজে পায়।’ বাংলা অঞ্চলে ঔপনিবেশিকতার আরেক চিহ্ন নীল চাষ। সেই নীল গাছ আর চায়ের মিশ্রণে এই রং শিল্পীর নিজস্ব প্রক্রিয়ায় তৈরি। রঙের দেশীয় উপকরণের ব্যবহার একধরনের উপনিবেশ বিরোধিতা বলা যায়। কেননা ক্যানভাসে অবয়বের রং বাস্তবাশ্রয়ী ঘটনার সাক্ষ্যকে সামনে আনে, যা ঐতিহাসিক জ্ঞানকাণ্ডের পরাধীনতার বিপরীতে স্থানিক স্বাধীনতাকে আমলে নেয়।
এমনিতেই ঢালী আল মামুনের শিল্পকর্ম শতাব্দীর আখ্যান দেখলে মনে হয়, বাংলার উপনিবেশ খুব বেশি দিনের নয়, হালের। যেন ইতিহাসের চিহ্ণগুলো জীবন্ত ও ঘটনাবহুল আখ্যান। কারণ, ক্যানভাসে উপস্থাপিত শিল্পকর্ম অতীতকে বর্তমান রূপে হাজির করে। তবে একথা সত্য, উপনিবেশের দৈহিক উপস্থিতির চেয়ে অর্থনৈতিক ও মানসিক উপনিবেশ অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী। উপনিবেশের পতনে শাসকের বদল হয় ঠিক, কিন্তু জনসংস্কৃতির ওপর দীর্ঘ শাসনের প্রভাব রয়ে যায় নানাভাবে। তবে তাত্ত্বিক দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে, ভূখণ্ডের স্বাধীনতা কেবল স্বাধীনতা নয়। অপরের সমস্বাধীনতা সমুন্নত রাখাই প্রকৃত স্বাধীনতা। জর্জ অরওয়েলের ভাষায়, সাদা লোক যখন অত্যাচারী শাসক হন, তখন তিনি নিজের স্বাধীনতা নিজেই ধ্বংস করেন। প্রতীকী এই ‘সাদা লোক’কে যদি পরাজয়ের সৌন্দর্য ধরা হয়, তাহলে উপনিবেশবিরোধী শিল্প সৌন্দর্যের বেলায় দশকাঠি সরেস। শতাব্দীর আখ্যানের সৌন্দর্য সেখানেই, সমালোচনামূলক শিল্পের ভেতর দিয়েই মানসিক উপনিবেশের পতন হওয়া। ঢালীর শিল্পকর্মের সৌন্দর্য সেখানেই নিহিত।
তত্ত্বতালাশ
১. The Wretched of the Earth: Frantz Fanon, Richard Philcox [Translator], Grove press, New york, USA
২. Aesthetics: Lectures on Fine Art: G. W. F. Hegel, T. M. Knox (Translator), Clarendon press , Oxford, UK
৩. Burmese Days: George Orwell, Penguin Classic, London, UK