বিন্দু থেকে সিন্দুর কথা

 

তর্ক বাংলার উদ্বোধনী সংখ্যায় আমরা আশির দশকের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী দিলারা বেগম জলির শিল্পকর্মের প্রদশর্নীর প্রয়াস নিয়েছি। আমরা আনন্দিত আশির গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী জলিকে উপস্থাপন করতে পেরে। নতুন শতাব্দিতে তাঁর আঁকা বাছাই শিল্পকর্মের কিছু ক্যানভাস হাজির করেছি আমরা। জলির প্রদশর্নীর নাম ‘তাহাদের কথা’। ব্যক্তি বিচারে বাংলাভাষায় ‘তাহাদের কথা’ প্রথম পদ নয়। বাংলায় তৃতীয় পদ বলে বিবেচিত। নিরীহ পদের দিকে তাকালে অর্থ দাঁড়ায় এটা নিছক ‘তৃতীয় ব্যক্তিবাচক বহুবচন’। ভাবা যায়, ভাষার কাঠামোগত এমন রূপ সরল ও নিরীহ। কারণ এটা সংখ্যাবাচক সর্বনাম। শুধুই ব্যাকরণের কর্তার বহুবচনের একরূপ মাত্র। কিন্তু আমরা যখন ভাষার সঙ্গে অর্থের, শিল্পের সঙ্গে বিষয়ের, সৌন্দর্যের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্বন্ধের প্রশ্ন সামনে আনব—তাতে ভিন্ন অর্থ, ভিন্ন রূপ আর ভিন্ন রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোর চেহারা দেখতে পাব। প্রশ্ন হচ্ছে—কি আছে দিলারা বেগম জলির শিল্পকর্মে?

আলোচনায় আমরা দিলারা বেগম জলির শিল্পকর্মের কয়েকটি দিক বিবেচনায় আনব। প্রথমত, তাঁর শিল্পের ভাষা। তাহলে ভাষা কি পদার্থ? আমরা ভাষা দিয়ে চিন্তা করি, ভাষাই তার অর্থের প্রভাব সৃষ্টি করে। আর ভাষা আমাদের ভাবায়। ভাষাও ঠিক একই রূপে চিন্তা করে, আমরা যা করি। মানে মানুষ ভাষার অধীন। ঠিক তেমনি ভাষাও মানুষের অধীন। ভাষার এই প্রকৃতিগত সম্বন্ধ আমলে নিলে জলির চিত্রকর্মের ভাষ্যরূপ দেখা যাবে। শিল্পের নামায়নে ‘তাহার’ নয়, জলি ‘তাহাদের’ কথা বলেছেন। মানে একক ব্যক্তিসত্তার কথা নয়, বলেছেন যৌথ ব্যক্তিসত্তার কথা। তাই সেটা তাহাদের কথা। সেটা নির্দিষ্টবাচক সর্বনাম এবং বহুবচনের। সেই ভাষা কখনো যন্ত্রণাক্লিষ্ট, কখনো রক্তাক্ত, আবার কখনো আনন্দদায়ক প্রকৃতির ভেতর প্রবাহিত। জলির ক্যানভাসে শিল্প প্রকরণের ভাষা দেখতে স্নিগ্ধ, তবে তার অন্তর্গত রূপ শান্ত নয়। সেটা অব্যক্ত অবরোধবসিনীর ভাষা। নারীর না বলা কথা। যেই ভাষা সমাজের অন্তঃপুরের আড়ালে-আবডালেই থাকে। প্রচলিত সমাজ কাঠামোয় থাকে। থাকে অধরাও। অন্তঃপুরের সেই অধরা জগতকে লোকচক্ষুর সামনে হাজির করেছেন তিনি।

দ্বিতীয়ত, শিল্পের বিষয়ের ক্ষেত্রে নারী সমাজের বাস্তব দশাকে হাজির করেছেন জলি। সহজ ভাষায় বললে নারীর মনোজগত আর বাহ্যিকজগত দুই-ই তাঁর শিল্পকর্ম কেন্দ্রীভূত। ক্যানভাসে বিমূর্ত অবয়বে কখনো নারীর মুখাবয়ব, কখনো ছিন্ন-বিছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কখনো অর্ধাঙ্গ শরীর, দেহের নানা ক্ষত-অক্ষত ছাপ, আঙুলের কররেখা, ঢেকে রাখা আবছা মুখমণ্ডল, পদহীন দেহ কিংবা মস্তকহীন দেহ যেন ক্লেদজ কুসুম হয়ে ফুটে আছে। তার অবোধ যন্ত্রণা সমাজ আর শাসন কাঠামো গ্রাহ্য না করলেও তা যেন প্রকৃতিতে লীন হয়ে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে—দেহের সঙ্গে শিল্পের ভাষার সম্পর্ক কি? বস্তুত দেহ যখন ভাষা হয়ে ওঠে, তখন শিল্পের ভাষাটাই সমাজে রাজনীতি আকারে বিদ্যমান হয়। তবে জলি এখানে বিষয়ের দিক থেকে অপূর্ব কৌশলের অবলম্বন করেন। নারীর দগদগে ক্ষতকে ফুলের চিহ্ন আকারে ফুটিয়ে তোলেন তিনি। যেন সময়ের শত বঞ্চনা, অত্যাচার সহ্য করা নারী এক কোমল সভ্যতার প্রতিঘাত। তারা জেগে উঠতে চায় প্রকৃতির অপর আকারে। এই অপর পর নয়, রূপান্তরেই নয়া রূপ। বলা চলে, সমাজ-প্রকৃতিতে টিকে থাকা নারী পূর্বাপর সভ্যতারই জিয়ন কাঠি। যাকে ছাড়া মানব সভ্যতার সবকিছুই বিবর।

দিলারা বেগম জলির চিত্রকলায় সবচেয়ে বড় জিজ্ঞাসা, জগত সংসার-সমাজে নারীর অবস্থান কোথায়? তাঁর শিল্পকর্ম মূলত অবক্ষয়ী সমাজ কাঠামোর বিপরীতে ভবিষ্যতের স্বাপ্নিক চিহ্নই। নারী কিভাবে নির্যাতন, অবদমন আর শাসন প্রকোষ্ঠের ভেতর কালযাপন করেন তারই চিত্রালেখ্য এটা। তবে তাঁর কোনো কোনো ক্যানভাসে আছে একক নারীর আকাঙ্ক্ষা হত ছবি। বস্তুত সেটা বহু নারীর দৈহিক চিহ্নের একক। বিমূর্ততার কারণে এই একক অনিদিষ্টবাচক নয়, নির্দিষ্টবাচক ঘটনা বা চিত্রকল্পে রূপান্তরিত হয়। এই নির্দিষ্টবাচক ঘটনা বা চিত্রকল্পকে তিনি নারীর যৌথ অচেতনের দিকে নিয়ে যান। নারী কোনো ভোগ্য পন্য নয়। নয় কোনো রক্তাক্ত দগদগে ফলক। প্রকৃতির অপরাপর প্রাণ জগতের মতোই আরেক সপ্রাণ নারী। শিল্পকর্মে সেটাই নারীর সপ্রাণ মনোজগতের ভাষা। বস্তুত জলির ক্যানভাসে সেই সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব হাজির। আপাত প্রশ্ন জাগতে পারে—ক্যানভাসে শুধুই কি নারীর অত্যাচারিত দেহ? কিন্তু না, তিনি তার ভেতর দিয়ে প্রকৃতির এক যৌথ যাপনের পান্থ খোঁজেন। এতে নারীর যন্ত্রণা যেমন আছে, ঠিক তেমনি আছে পুষ্পের মতোই আনন্দ যাপন। কেননা কাঁটা আর পুষ্পের দ্বৈরথে তিনি পুষ্পকেও সমান প্রাধান্য দিয়েছেন। পুষ্প মানে প্রস্ফূটিত বীজ। যাতেই লুকিয়ে আছে অপার ভবিষৎ। এই ভবিষৎ যৌথচারী আর স্বপ্নের।

দর্শনের ভাষায় বলা যায়—রঙ ছাড়া আদতে ইহজাগতিক বস্তুবিশ্বে দৃশ্যমান কোনো জিনিস নাই। রঙ বিষয়ের আকার দেয়। রূপকে প্রকাশ করে আপন পরিচয়। এই রূপ স্থিত বস্তু বা ঘটনাকে অর্থগত জগতে পৌঁছায়। সেখানেই রঙের অর্থগত সূত্র নিহিত।

তৃতীয়ত, জলির শিল্পকর্মের রঙ আর প্রকরণ কি? শিল্প সৃষ্টির পেছনে তিনি নানাবিধ উপায় অবলম্বন করেছেন। রঙের ক্ষেত্রে তিনি প্রকৃতিকে আমলে নিয়েছেন বেশি। কেননা প্রকৃতির সবুজ কিংবা সোনালি হলুদাভ প্রকরণে সেটা স্পষ্ট। কিন্তু দেহ কিংবা অন্তঃপুরের রূপ-অরূপ অবগাহনে তিনি কখনো লাল রক্তাভ, কখনো গাঢ় কালো উজ্জ্বল্যকে প্রাধান্য করেছেন। জলির রঙের এই কারুকাজ, বিমূর্ত অবয়ব আর আকার বাস্তব রূপেই ধরা দেয়। প্রকৃতিতে এই রঙ এন্তার দৃশ্যমান। কেন তিনি এটা বেছে নিলেন? কারণ তিনি বিমূর্ত ভাবকে বাস্তব আকারে জায়মান দেখাতে চান। মানে অধরা আকারকে সজ্ঞানে আনা। ক্যানভাসে এমন পরিমিত রঙের ব্যবহার অচেনা জগত নয়, বরং আমাদেরকে চেনা অনালোকিত জগতের মুখোমুখি করে। দর্শনের ভাষায় বলা যায়—রঙ ছাড়া আদতে ইহজাগতিক বস্তুবিশ্বে দৃশ্যমান কোনো জিনিস নাই। রঙ বিষয়ের আকার দেয়। রূপকে প্রকাশ করে আপন পরিচয়। এই রূপ স্থিত বস্তু বা ঘটনাকে অর্থগত জগতে পৌঁছায়। সেখানেই রঙের অর্থগত সূত্র নিহিত। জলির শিল্পকর্মের বেলায়ও সেটা ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু তাঁর শিল্পকর্মের প্রকরণ কি?

দিলারা বেগম জলি প্রকরণের ক্ষেত্রে লৌকিক প্রথার আশ্রয় নিয়েছেন। লৌকিক প্রথা কি? দিনের পর দিন বুনে যাওয়া চিরায়ত সংস্কৃতির নকশী কাথার আদল। জলির চিত্রকর্মে দেখা মেলে নকশী কাথা বুনন পদ্ধতির প্রতিফলন। অবয়বের আদল আর রেখায় যেন নকশী কাথার সুঁই-সুতোর মতোই সহজ প্রবহমান। সুঁইয়ের মতোই বিন্দু বিন্দু আকারের রেখা আর চিত্রে নকশী কাথার বাহারি কৃৎ-কৌশল। এখানে জলি নারীর উদ্ভাবিত প্রকৃতি জ্ঞানের আত্মপরিচয়ের সম্বন্ধ স্থাপন করতে চেয়েছেন। মূলত নকশী কাথার দৃশ্যশিল্প নারীর প্রকৃতিজাত জ্ঞান। এবং সৃষ্টির তাৎপর্যে তা মৌলিকও বটে! নকশী কাথার চিত্রে অনেক প্রকরণ আছে। জলি যে সব প্রকরণের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করতে চেয়েছেন, শুধু তা নয়। তাঁর প্রকরণে নকশী কাথার দুটো আকার দৃশ্যমান। তার একটি স্বস্তিকা নকশা, আরেকটি জীবনবৃক্ষ নকশা। স্বস্তিকা নকশা সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক শিল্পের আদি নিদর্শন। সংস্কৃত ভাষার স্বস্তিকা মানে ‘যা ভাল’। বক্ররেখা বেষ্টিত শিল্পের এই প্রকরণ ধনাত্মক ভাবেরই প্রতীক। আর জীবনবৃক্ষ নকশা আকার প্রকৃতিজাত। যেখানে জীবনের পত্রপুষ্পবীজ নিহিত। জীবের দেহের সঙ্গে প্রকৃতির ভাষার যে সম্বন্ধ, শিল্প সেখানে আকার লয়। শিল্পের এমন আদি প্রকরণকে জলি চিত্রকর্মের বাহন করেছেন।

চতুর্থত, রস আদি হলেও দিলারা বেগম জলির শিল্পের সৌন্দর্য আধুনিক শিল্পকলার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানকাণ্ড বিচ্যুত নয়। উপকরণের দিক থেকে তিনি ঐতিহ্যকে ধনাত্মকভাবে মিশিয়েছেন আধুনিক শিল্পের মনিকোঠায়। বিন্দু বিন্দু রেখার তরঙ্গ ক্যানভাসের চিত্রে অবয়বকে গতি দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবছা রঙের রহস্যাবৃত কল্পচিত্র সংবেদনশীলতাকে সামনে এনেছে। শিল্পের এমন যোগকে আমরা বলছি—জলির শিল্পকর্মের সৌন্দর্যের উপযোগ। সৌন্দর্যতত্ত্বের প্রশ্নে বলা যায়, শিল্পে যে কোনো বাস্তবই বস্তু বা ঘটনার উপযোগিতা নির্ভর। মানে বিদ্যমান বস্তু কিংবা সংগঠিত ঘটনার গল্প বা কল্পনা ‍শিল্পে সেই রসদ ক্রিয়া করে। শিল্পও তখন সৌন্দর্যের বাস্তব আকার লয়। কিন্তু বিমূর্ত অবয়বের শিল্প বাস্তবতায় অধরা রূপের বাড়তি উপযোগ সৃষ্টি করে। সেটা বাস্তব বিবর্জিত উপযোগ নয়, বরং বাস্তবেরই বাড়তি রূপ দান। যেটা চিত্রের আবহ কিংবা বস্তুর উদ্দেশ্য কিংবা ঘটনার কল্পলোককে আরো প্রকটিত করে। আমরা খানিক রুশ বিমূর্ত গঠনবাদী শিল্পী ভ্লাদিমির তাতলিনের দোহাই টানবো। বিংশ শতাব্দির আভাগার্দ শিল্পী তাতলিনের তত্ত্ব মোতাবেক—‘জীবন গুণে শিল্প’ মানে ‘শিল্প জীবন অধরা নয়’। জলির শিল্পকর্মের সৌন্দর্যও জীবনের প্রশ্নে অধরা রূপ নয়। সেই নারীর মানসলোক সারিত অবগুণ্ঠিত সৌন্দর্য। যে সৌন্দর্য অবগাহনে উন্মুল রাষ্ট্রে কিংবা অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে প্রশ্ন তোলে আর উত্তর খোঁজে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়। বস্তুত পরাহুত রূপ যখন মুক্ত বাসনায় হাজির হয়, তাহলে ‘তাহাদের কথা’ আর ঠেকায় কে?

পরিশেষে এটুকু বলব—দিলারা বেগম জলির ‍শিল্পকর্ম আমাদের সৌন্দর্য যাপনের নতুন অভিজ্ঞতার ভেতর নিয়ে যায়। যে অভিজ্ঞতাকে সমাজের বিদ্যমান বাস্তবতার মুখোমুখি করে। যে বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে নারীর মুক্তির প্রশ্ন খানিকটা অসম্ভবও বটে। আমরা ‘তাহাদের কথা’ প্রদর্শনীর মধ্যে দিয়ে মুক্তির সেই প্রশ্ন আর সম্ভাবনা খানিকটা জাগিয়ে রাখলাম। আশাকরি দর্শক আর ছবির পাঠক জলির প্রদর্শনীতে সামিল হবেন। আমাদের প্রত্যাশা এটুকুনই।